নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

স্বপ্ন আর বাস্তবতা- ঘুমভাঙা সকালের মতো

তৌহিদ জামান73

বাইসাইকেলও কখনো কখনো সুখকর স্মৃতি হয়ে যায়!

তৌহিদ জামান73 › বিস্তারিত পোস্টঃ

রকেটের মতোই ক্ষিপ্র ছিলেন রকেট জলিল!

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:১৯

মো. আব্দুল জলিল, বীর প্রতীক। যশোরে ‘রকেট জলিল’ নামেই খ্যাত। একাত্তরের রণাঙ্গনে হানাদার বাহিনীর কাছে ছিলেন মূর্তিমান এক আতঙ্ক! তিনি নিজেই বলেন, ‘রকেট জলিল আমার খেতাব’। একাত্তরে একই দিনে ৪-৫ জায়গায় অপারেশনে নেতৃত্ব দিতেন। অল্পসময়ে দ্রুত কাজ করার কারণেই খান সেনারা ওই সময় বলত, ‘রকেট হ্যায় না কিয়া হ্যায়!’
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৬ সালে ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয় তাকে।
যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার শিমুলিয়া ইউনিয়নের মনোরম একটি গ্রামের নাম পাল্লা। ১৯৬৩ সালে এই গ্রামের মহর আলী মোড়ল আর চেয়ারবানুর ঘরে জন্ম আব্দুল জলিলের। স্থানীয় স্কুলেই লেখাপড়া। ১৯৬৩ সালের দিকে তিনি মুজাহিদ কোম্পানিতে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মুজাহিদ কোম্পানি থেকে কেউ সেনাবাহিনী, কেউ পুলিশ কিংবা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-ইপিআরে যোগ দেন। আব্দুল জলিল ১৯৬৮ সালে ইপিআরে যোগ দেন সিপাহী পদে।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ যোগ দেন ইপিআরের রাজশাহী অঞ্চলে কর্মরত এই জওয়ান। ২৮ মার্চ তিনিসহ চারজন চারটি রাইফেল নিয়ে রাজশাহী থেকে প্রথমে যশোরে, এরপর একইদিনে বেনাপোলে ক্যাম্পে গিয়ে যোগ দেন। রাতেই মার্চ করেন যশোরের চাঁচড়া ক্যাম্পে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সরাসরি অংশ নেই মুক্তিযুদ্ধে। ৮ নম্বর সেক্টরে মেজর আবু মঞ্জুরের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। ছিলাম টুআইসি ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার তত্ত্বাবধানে ।’
আলাপকালে রকেট জলিল তুলে ধরেন রণাঙ্গনের স্মৃতিকথা। বলেন, ‘একাত্তরের জুলাই মাসে ঝিকরগাছার গঙ্গাধরপুর-দোসতিনায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হই। গুলিটি বামপায়ের হাঁটুর নিচে বিদ্ধ হয়, নিহত হয় চার পাকসেনা। এরপর ভারতের বনগাঁ হাসপাতাল থেকে গুলি বের করে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় নৌপথে চলে আসি। ভারতে এক রাত ছিলাম। তারপরই ফিরে আসি। কারণ, আমার অনুপস্থিতিতে অন্যরা হতাশ হতেন।’
ঝিকরগাছার বনমান্দার এলাকায় দ্বীপের মতো একটা আস্তানাই ছিল রাধানগর ক্যাম্প। চারপাশে পানি, নৌকায় যাতায়াত করতে হতো। জলিল বলেন, ‘অনেক অপারেশনে সরাসরি অংশ নিয়েছি। সবই এখনও স্মৃতির পাতায় জ্বলজ্বল করছে।’
এই বীরপ্রতীক মেলে ধরেন যুদ্ধস্মৃতির পাতা। বলেন, ‘জুলাইয়ে প্রথম দিকের ঘটনা। দোসতিনার প্রাইমারি স্কুলের মাঠ, বল ফিল্ডে ক্যাম্প করেছে পাকিস্তানিরা। ছুটিপুরে তাদের হেডকোয়ার্টার। তখন বর্ষাকাল। ক্যাম্পের সেনারা প্রতিদিন বদলি হয়। সকাল ১০টা থেকে সাড়ে দশটা নাগাদ তারা ক্যাম্প বদল করে। আমাদের ২০ জনের একটি টিম নিয়ে মধুখালীর শালবাগান এলাকায় বড় একটি অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিই । রাত ৪টার দিকে আমি, আব্দুস সাত্তার, গোলাম মোরশেদ, রফিকুল ইসলাম, চাপাতলার সাত্তারসহ ২০জন সেখানে অ্যামবুশ করি। এরইমধ্যে রাস্তায় ১২টি এন্টি পারসোনাল জাম্পিং মাইন পুঁতে রাখা হয়। খুবই দক্ষতার সঙ্গে কাজটি সম্পন্ন করি।’
মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সেনানী বলেন, ‘‘সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে সেনারা স্থান বদল করে। কিন্তু যথাসময়ে পাকসেনারা কেউ আসছে না। বেলা ১১টার দিকে রেকি করতে বের হই। টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে। মাথায় টোকা, হাতে নিড়েন আর কাঁস্তে। হঠাৎই আবির্ভূত হয় পাকিস্তানিরা! জিজ্ঞেস করে, ‘মুক্তি হ্যায়?’ আমি চুপ। সেনারা আমাকে আটক করে নিয়ে যেতে থাকে দোসতিনার মধ্য দিয়ে। বেশ বিচলিত হই! কলেমা পড়ি; ভাবি, রাজাকাররা যদি দেখিয়ে দেয়, তবেই শেষ!’’
এরপরের ঘটনা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একই সঙ্গে সাহসিকতারও। রকেট জলিল বলেন, ‘মাথায় একটা গুলির বাক্স দিয়ে আমাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেনারা। কিছুদূর যাওয়ার পর কাদামাটিতে ইচ্ছে করেই পড়ে যাই। ভাবি, যদি অসুস্থ মনে করে যাদ ছেড়ে দেয়। কিন্তু বিধি বাম! উল্টো লাথি মেরে জোর করে উঠিয়ে আবারও মাথায় বাক্সটি তুলে দেয়। এভাবে পৌঁছে যাই দোসতিনার মোমিন মাস্টারের কাঁঠাল বাগানে। সেখানে দু’জন সেনার উপস্থিতিতে গাঁইতি দিয়ে বাঙ্কার খুঁড়তে বলে। দু’এক কোপ দেওয়ার পর দেখি, পাকসেনারা গাছের শেকড়ের ওপরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে দুজন দু’দিকে মুখ করে। এই সুযোগ! আস্তে আস্তে চলে যাই তাদের কাছে। গাঁইতি দিয়ে একজনের মাথা বরাবর দিই কোপ! দু’ভাগ হয়ে গেল মুহূর্তেই। শব্দ শুনে অন্যজন সামনে ফিরতেই তাকেও...। মাথার ঘিলু-রক্তের ছোপ ছিটকে মুখে লাগে। দুটি চাইনিজ রাইফেল নিয়ে দিলাম ভোঁদৌড়। পরদিন সেই জায়গায় আবারও ১২টি মাইন স্থাপন করি। সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ সেনা সদস্যরা সেখানে হল্ট করায় বাহিনীকে। তিন শতাধিক সৈন্য, কাদামাটিতে, অস্ত্র কাঁধে সতর্ক অবস্থায়।’
এ ঘটনার বর্ণনা দেন রকেট জলিল—‘আমরা ২০ জনের মতো অ্যামবুশে। একজনের দায়িত্ব ছিল মাইনের সঙ্গে যে শক্ত সুতো বাঁধা, সেটা টান দেওয়ার। আর্মিদের উপস্থিতিতে দেখি সে আর নেই; পালিয়েছে আরও ৫-৬জন। আমি বাঙ্কারে, এসএলআর হাতে। এখান থেকে পালানো সম্ভব নয়। ইয়া আলি বলেই সুতো ধরে টান দেই। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয় মাইন। এসএলআরটি নিয়ে দাঁড়িয়ে ব্রাশ ফায়ার করি। অন্য সঙ্গীরাও ফায়ার শুরু করে দেন। ফায়ার করতে-করতে আমরা পেছাচ্ছি। লাশ পড়ছে কাদার মধ্যে। কতগুলো সৈন্য মারা গেছে দেখিনি। কিন্তু মাইন বিস্ফোরণের পর দেখি, একটি খেজুরগাছের ডালে মাথাবিহীন দু’সৈন্য ক্রস চিহ্নের মতো ঝুলে রয়েছে। গরুরগাড়িতে করে লাশগুলো নিয়ে যাওয়া হয় ঝিকরগাছা থানায়। যারা নিয়ে গিয়েছিলেন, তারা লাশ গুনে জানিয়েছিলেন, ৩২জন। পরদিন কপোতাক্ষের পানিতে পাওয়া যায় আরও ছয়টি লাশ।’
১৯৯৬ সালে ‘বীরপ্রতীক’ পদকপ্রাপ্ত এই মুক্তিযোদ্ধা ‘বীরপ্রতীক ভাতা’ ও আড়াই বিঘা জমি থেকে পাওয়া ফসল থেকেই সংসার চালাচ্ছেন। ২০১১ সালে হার্টে দুটো রিং পরানো হয়; আছে ডায়াবেটিস আর উচ্চ রক্তচাপও। স্ত্রী হালিমা খাতুন, তিন ছেলে আর চার মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। ছেলেরা সবাই দেশের বাইরে থাকেন। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে স্বাগত জানিয়ে রকেট জলিল বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আরও আগেই এই বিচার হতো। বিচারপ্রক্রিয়ায় কোনও ভুল নেই। যাদের বিচার করা হচ্ছে, তারা সবাই অপরাধী।’
সরকারের কাছে এই বীরপ্রতীকের একটিই চাওয়া—‘যারা মানবতাবিরোধী, তাদের বিচার হোক। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করুক সরকার। যেন তারা মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ধরে আইনে সোপর্দ করতে পারে। আর এ কাজে যেন মানবতাবিরোধী অপরাধীদের স্বজনরা (গডফাদার) বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে।’

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.