নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বৈশিষ্ট্যহীন একজন মানুষ।

মোটা ফ্রেমের চশমা

বলার মতো কিছু হতে পারিনি এখনো

মোটা ফ্রেমের চশমা › বিস্তারিত পোস্টঃ

করোনার দিনগুলিতে...

২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১:২২

আমার করোনা ধরা পড়ে জুলাইয়ের ২৬ তারিখ। আব্বার রিপোর্ট পজিটিভ আসার একদিন পর। সৌভাগ্যবশত আম্মার নেগেটিভ আসে। একইবাসায় থেকে একজন বেঁচে গেলো কীভাবে সেটা অবশ্য ভাববার বিষয়। আম্মারও বেশকিছু সিম্পটম ছিলো। দুর্বলতা, পেট খারাপ, গন্ধ না পাওয়া। তবে টেস্ট করাবার আগেই তার এই সিম্পটম গুলো সেরে যায়। হয়তো মাইল্ড করোনা-জাতীয় কিছু হয়েছিলো।

মুরগী-ডাল দিয়ে ভাত খেতে খেতে ফোনে বই পড়ছিলাম। হালকা সর্দি আর পেটের একটু গড়বড় ছাড়া আর কোনো সিম্পটম দেখা দেয়নি। আচমকা ল্যাবএইড থেকে আসা এসএমএসটা দেখে থমকে গেলাম খাওয়ার মাঝে। রুচি চলে গেছে। বুক ধড়ফড় করছে। এই কয়দিন সারা ঘর ঘুরে বেড়িয়েছি, আব্বা-আম্মার দেখভাল করেছি, খাবার গরম, চা রান্না, গরম পানি করে দু’জনের ঘরে দিয়ে আসছি। বাসন-কোসন ধোয়ামোছাও করেছি গত ছয়-সাতদিন। সবজায়গাতেই হাতের স্পর্শ লেগে আছে। আব্বা তো বটেই, সিম্পটম চলে গেলেও আম্মাও ফুল বেড রেস্টে ছিলো দুর্বলতার কারণে। তবে আমার রিপোর্ট আসার সাথে সাথে ভূমিকা উলটে গেলো আমার আর তার।
কোমরে আঁচল বেঁধে সারাঘর ডিসইনফেক্ট্যান্ট করা শুরু করে দিলো আম্মা। আমার বাসন-পেয়ালা-গ্লাস-চামচ আলাদা করে ঘরে দিয়ে গেলো। আব্বার তো আগে থেকেই ছিলো।

এর পরের ঘটনা গুলো খুব, খুব বেশি ক্লান্তিকর। আমার জন্য, আম্মার জন্য। শারীরিক-মানসিক দু’ভাবেই।
প্রতিটা দিন যুদ্ধ করা লাগতো। প্রতিদিন। আম্মার উপর চাপটা অমানুষিক রকমের বেশি ছিলো। তার নিজের শরীরে হাজারটা রোগ বাসা বেঁধে আছে। সেসবকে তুচ্ছজ্ঞান করে দুইটা রোগীর সেবা একতালে করে যাচ্ছিলো। আধঘণ্টা-একঘণ্টা পর পর গরম পানির ভাপ, গড়গড়া করা, মশলা পানি খাওয়া, চার-পাঁচটা ওষুধ খাওয়া- সবকিছুর দায়িত্ব তার কাঁধে। দু’জনের খাবার, পানি এনে দেয়া, সেসবের ব্যবস্থা করা, ঘর স্যানিটাইজ করা, বাসন-কোসন-হাঁড়িপাতিল মাজা, ঘর ঝাঁট দেয়া; সব এক হাতে সামলাতে হচ্ছিলো। কাজের বুয়াকে মানা করে দেয়া হয়েছিলো সেই মার্চেই। আমি আর আব্বা নিজেদের বাসন-প্লেট-মগ-পেয়ালা ধুয়ে ফেলতাম ছোট বাথরুমে। পরিষ্কার সেখানেই হতাম দু’জনে। আমাদের আবর্জনা (এঁটো-কাঁটা/মাস্ক/ওয়ান টাইম কাপ-প্লেট/কাগজ/ওষুধের ফয়েল) পলিথিনে ভরে দরজার সামনে রেখে দিতাম ঘুমাবার আগে। সকালে ময়লাওয়ালা আসার আগে দুই রোগীর পলিথিন সংগ্রহ করতো। নিজের ওষুধটা খেতে মনে থাকতো না বেশিরভাগ সময় অথচ বারংবার আমাদেরটার কথা মনে করিয়ে দিতো। কথা বললে পাশের ঘর থেকে ফোন দিয়ে কথা বলতে হতো। অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে কয়েকদিন মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেছে। আমাকে বা কাউকেই বলেনি-বুঝতে দেয়নি, কেউ ফোন দিলে হাউমাউ করে কান্না করতো। আমাদের হারাবার ভয়ে, পরিশ্রম সহ্য করতে না পারার কষ্টে, নামাজেও প্রত্যেকটা দিন কান্নার শব্দ পেতাম পাশের ঘর থেকে। খুব, খুব বেশি অসহায় লাগতো তাকে সাহায্য করতে না পেরে। কিন্তু কাছেও তো যাবার উপায় নেই!
রান্নাটা নিজের করতে হয়নি বলে রক্ষা। বড় বোন আর ভাবি দু’জনে পালা করে খাবার পাঠাতো। কয়েকবার ফুপাতো ভাইও ভাবিকে দিয়ে রান্না করে পাঠিয়েছে। সেটাও আরেক ঝক্কি! বাইরে থেকে কিছু আসলে স্প্রে করে ঘরে ঢোকানো, সেগুলোর প্যাকেটকে আলাদা পলিথিনে ভরে রাখা-তারপর সেই পলিথিনকে আবার স্প্রে করা…

এত কিছুর মাঝে নিজের কথা বলতে গেলেও বিব্রত লাগে। আমি তো ঘরে এনে দেয়া খাবার গিলেছি, বই পড়েছি আর ঘুমিয়েছি- তাই না?
হিমুর একটা বইতে (কোন বই, নাম মনে নেই) এক লোক ছিলো। তার ভাষ্যমতে তার পছন্দের বেহেশত হবে এমন- তার একটা ঘর থাকবে। ঘর ভর্তি থাকবে বই আর বই। সেই ঘরের বিশাল জানালা দিয়ে সে আকাশ দেখবে আর সারাদিন বই পড়বে।
আমার রূম ভর্তিও বই, জানালা দিয়ে তাকালে আকাশ দেখা যায়, সেই আকাশ থেকে ঝরা বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ে বিছানায়-শরীরে। বিশ্বাস করুন, যতদিন কোভিডের থাবায় আটকে ছিলাম, বই পড়তে গেলে মন বসতো না। ভীষণ রকমের ক্লান্তি ভর করে থাকতো। সকালে ঘুম ভাঙ্গাতো আম্মা ফোন দিয়ে। সকাল আটটা নয়টার মধ্যে উঠে পড়া লাগতো ভাপ নেবার জন্য, কুলি করবার জন্য, গরম পানি খাবার জন্য। ইচ্ছা করতো না, শরীর সায় দিতো না। দেহটা টেনে তুলতেই কষ্ট লাগতো, শক্তি পেতাম না। মাঝে মাঝে রাগে চিৎকার করতে ইচ্ছা হতো, দেয়ালে ঘুষি মারতে ইচ্ছে করতো। ঘুমাতে পারি না ঠিকমতো, রাতে ঘুম আসে তো আসে না, নামাজে মন বসে না-পড়তেও ইচ্ছা করে না। একটা সময় স্বাদ চলে গেলো মুখের। ভাত খাবার সময় মনে হতো থকথকে পিণ্ড জাতীয় কিছু গিলছি, খাবারের প্রতি অনীহা চলে এলো। ওদিকে স্বাদের সাথে সাথে বিদায় নিলো গন্ধও। তখনই উপলব্ধি করলাম গন্ধেরও রঙ আছে। সত্যি! ঘ্রাণবিহীন দুনিয়ায় সব কিছু ধূসর লাগে। এক রঙা, নীরস, অসহায়-অসহ্য। নাকের সামনে পারফিউম, লোশন আনি বারে বারে- যদি ঘ্রাণ শক্তি ফিরে আসে! আসে না। সিভিট খাই চিবিয়ে, যদি স্বাদ পাই! পাই না। রাতে প্রায়ই প্রচণ্ড ঘামতাম, চোখ-মাথা ব্যথা করতো অসহ্যকর ভাবে, বুকে চিনচিনে ব্যথা করতো। মন-মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকতো। বেশি দুর্ব্যবহার করেছি আব্বার সাথে, আম্মার সাথেও করিনি- তা না। ভালো কথা শুনলেও সহ্য হতো না। একেক বার একেক সমস্যা উদয় হচ্ছিলো শরীরে- কখনো পেট ভালো যাচ্ছিলো তো কখনো খারাপ, তলপেটে ব্যথা, কিডনিতে ব্যথা লাগতো পানি খেলে। কাশি আর শ্বাসকষ্টটা হয়নি। ঘন ঘন (চার-পাঁচবার হবে) ডাক্তারের কাছে যাচ্ছিলাম কোভিড নিয়েই। একবার ওষুধ পালটে দিচ্ছিলেন তো আরেকবার নতুন ওষুধ দিচ্ছিলেন। ডাক্তার নিয়েও খুব সমস্যায় পড়তে হয়েছিলো প্রথমে। ধরা পড়বার পর যে ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্টই নিতে যাই, উত্তর আসে- ‘স্যার তো বসে না চেম্বারে। কবে আসবে জানা নাই।’ ঘরের কাছে গ্রিনলাইফ হসপিটালে গিয়েও আকাঙ্ক্ষিত ডাক্তারকে পেলাম না। অপরিচিত এক মেডিসিনের ডাক্তারকেই দেখাতাম। উপরওয়ালার উপর প্রচণ্ড ক্ষোভ জন্মেছিলো সে সময়টায়, রাগ হতো তার ওপর। কোভিড দেশে আসবার পর সাবধানতা কম অবলম্বন করিনি। অনেক বেশিই করেছি বাকিদের তুলনায়। তাও কেন দিলেন? দিলেও কেন শুধু আমাকে দিলেন না? আব্বাকেও দিলেন কেন? আম্মাকে এত কষ্টের মধ্যে ফেললেন কেন?

বড় ভাই চাকরি করে এয়ারপোর্টে। করোনার জন্য একটা সময় পর্যন্ত ছুটি থাকলেও অফিস খুলে গিয়েছিলো। প্রচণ্ড ভয় পেতাম তার জন্য, ভাতিজা-ভাতিজি দুটোর জন্য। শিশু দুটোর করোনা হবার কথা ভাবতেই আতঙ্কে কুঁকড়ে যেতাম। ভয় লাগতো বড় বোনের জন্য, ভাইপোর জন্য। দুলাভাইয়ের অফিসও খুলে গিয়েছিলো। পুরান ঢাকার মানুষের সতর্কতায় অবহেলার কথা অজানা না। নিজের অসুস্থতার সাথে সাথে প্রিয়জনদের জন্য আতঙ্ক-আশঙ্কায় ডুবে থাকতে থাকতে খেপামির মতো পেয়ে বসে একটা সময়। সৃষ্টিকর্তার অবাধ্য হতে ইচ্ছে করতো, বিদ্রোহ করতে ইচ্ছে করতো, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ইচ্ছে করতো। কী ধৃষ্টতা!
ফোন আসে একদিন। ভাতিজার জন্মদিন সেদিন। জ্বর আর পানির মতো টয়লেট হচ্ছে। শরীরেও ব্যথা। মাথায় এবার পুরোপুরি আকাশ ভেঙে পড়লো আমার। কখনো নামাজে নিজের বা বাপ-মা’র জন্য কান্নাকাটি করিনি কিছু চাইতে গিয়ে। এবার হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম বাচ্চা দুটোর জন্য ক্ষমা চাইতে চাইতে। সমস্ত অভিমান, রাগ, ক্ষোভ, হতাশা ভুলে হাত তুলে পাগলের মতো আরোগ্য কামনা করতে লাগলাম প্রভুর কাছে।
অবশেষে রহমত নাজিল করলেন তিনি। কয়েকদিনের মাথায় সেরে গেলো সমস্যা। এদিকে আমার কালো হয়ে আসা অন্তর একটু সাদা রঙের দেখা পাচ্ছিলো সম্ভবত। আল্লাহ্র কাছে নিজেকে ছেড়ে দিলাম (যেটা আজীবন করে আসা উচিত)। বাঁচলে যেন আমার বাপ-মা’ই বাঁচে। আমার বাঁচার দরকার নাই। তাদেরকে সুস্থ রাখুক তিনি। শুনতে স্যাক্রিফাইসিং হিরোর মত লাগছে না? নাহ, আসলে মরতে ভয় পাচ্ছিলাম, চাইছিলামও না। কতকিছু করা বাকি! কিন্তু তাদের প্রাণ রক্ষায় যদি মরতে হয় তবে মরলেই ভালো। তাও বেঁচে থাকুক আমার প্রিয় মানুষগুলো।

আব্বার কথা তো বললাম না। এবার বলি- আল্লাহ্র অসীম রহমত যে তার হৃদরোগ থাকা সত্ত্বেও কোভিড সেখানে আক্রমণ করেনি। তবে মানুষটা এই রোগের ধাক্কা আজও সামলে উঠতে পারেনি পুরোপুরি। সত্তোর্ধ্ব বয়সের আব্বা। শুকিয়ে আক্ষরিক অর্থেই পাটকাঠি হয়ে গেছে, সারাদিন শুয়ে থাকতো- এখনো থাকে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকতো- এখনো থাকে, নড়াচড়া করে স্লো-মোশনে। ছোটবেলায় কোকোলা চকলেট জেমস মুঠো ভরে মুখে ঢোকাতাম। তারপর আয়েশ করে চিবিয়ে খেতাম। সেরকম মুঠো ভর্তি ওষুধ খেতে হচ্ছিলো তাকে। হার্টের কয়েক পদের ওষুধ, রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখার ওষুধ, পেট ভালো করবার ওষুধ, ভিটামিন, জিঙ্ক আরও কত কী…

তিনজনের দু’দফায় করোনা টেস্ট করাতেই ব্যয় হয় ২৯ হাজার টাকা। সাথে তিন জনের অসংখ্য টেস্ট আর ওষুধ-পত্র, কোয়ালিটি মাস্ক-গ্লাভস, পলিথিন, ওয়ান টাইম কাপ-প্লেট, কাঁচা বাজার, গ্রোসারি আইটেম, ডিসইনফেক্ট্যান্ট, আব্বা-আম্মার রেগুলার ওষুধ, ডাক্তারের ভিজিটে কত টাকা গেছে সেটা এখন মনেও নেই। তবে সংখ্যাটা ৭৫ হাজারের ঘরে হবে। এটা তাও করোনাকালীন সময়ের হিসেব। আমার মনে আছে লকডাউন শুরু হবার কয়েকদিন আগে শুধুমাত্র আব্বার ওষুধ কিনেছি দু’মাসের- ৮,০০০টাকার। এদিকে গ্রামে ভাড়াটিয়ারা ভাড়া দেয়নি, দোকান ভাড়া আনা যাচ্ছিলো না- দিচ্ছিলোও না তারা, পোস্টাফিস-ব্যাংকের টাকা আনবার উপায় নেই। আয় শূন্য, ব্যয়…ঘরে টাকা ছিলো বলে রক্ষা। নইলে না খেয়ে মরা লাগতো কিংবা কারো কাছে হাত পাততে হতো। পানির মতো খরচ হচ্ছিলো টাকা।

এদিকে চলে এলো ঈদ-উল-আযহা। ২৮ বছরের জীবনের সব থেকে বাজে ঈদ গেছে বলা যায়। আর দশটা দিনের সাথে কোনো পার্থক্য নেই। সেই একই রুটিন, সেই একই ক্লান্তি-দুর্বলতা। মাইকে মসজিদ থেকে ভেসে আসা ঘোষণায় হুটহুট করে মনে হচ্ছিলো- আজকে না ঈদ! বারান্দায় যাবারও উপায় নেই! ঘরবন্দী জীবন। ঈদ হয়েছে তো কী হয়েছে? পোলাও, সেমাইয়ের প্রশ্ন তোলাও হাস্যকর!

এভাবে কাটলো ২১টা দিন। ২১টা দিনকে মনে হয়েছে ২১টা বছর। ক্লান্তিতে তখন হাল ছেড়ে দেবার অবস্থা সবার। কিন্তু আম্মা হার মানলো না। সে পুরোদমে সেবা চালিয়ে যাচ্ছে তখনো। এরপর আরও কয়েকদিন অপেক্ষা করে আবার টেস্ট করলাম। ততদিনে সিম্পটম চলে গেছে মোটামুটি, শরীরে বল ফিরে না এলেও খারাপ কিছু অনুভব হচ্ছিলো না কারো।
অবশেষে আব্বা-আম্মাকে টেস্ট করানো হলো বায়োমেড ডায়াগনস্টিক আর আমাকে ল্যাবএইডে। দুয়েকদিন আগুপিছু করে।
আব্বা-আম্মারটা নেগেটিভ আসে ১৭ তারিখ। আগস্টের ১৯ তারিখে আমার রিপোর্ট পাই। নেগেটিভ। কিছুটা অবসান ঘটে যুদ্ধের তীব্রতায়। আলাদাই থাকলাম আমরা। তিনজন তিন ঘরে। এভাবে গেলো আরও ১৩-১৪ দিন। আব্বা ফিরে গেলো আম্মার সাথে। আমিও
তখন ঘর থেকে বেরুই মাস্ক-টাস্ক ছাড়াই।

এখন কয়েকটা মানুষের অবদানের কথা না বললে অকৃতজ্ঞতা হয়ে যাবে। দুঃসময়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কয়েকজন নীরলসভাবে সাহস জুগিয়ে গেছে, হাসি-ঠাট্টা করে ভুলিয়ে রাখতে চেয়েছে, পরামর্শ-উপদেশ দিয়ে গেছে। সেই মানুষগুলোকে চিনে রেখেছি। যদি কোনোদিন পারি, তাদের এই ঋণ শোধ করবার চেষ্টা করবো। তবে ঋণের ভারে চাপা পড়ে থাকতেও খারাপ লাগছে না। আমার মতো একটা নগণ্য মানুষের জন্য এতজনের মায়া-ভালোবাসা দেখে খুব বেশি অবাক হয়েছি। আমি এই ভালোবাসা পাবার উপযুক্ত কিনা ভেবে ভেবে হাল ছেড়ে দিয়েছি একসময়।

এরপর থেকে আমার অবস্থা হয়ে গিয়েছিলো ঘর পোড়া গরুর মতো। যে কিনা সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরায়। এই সেপ্টেম্বর নাগাদ সবাই স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফেরত চলে গেছে, মানুষ বিয়ে-শাদির আয়োজন করছে, গেটটুগেদার-ট্যুরে যাচ্ছে, অফিস করছে, শপিং করছে, রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে।
আর আমি?
এতদিন দরকার ছাড়া ঘর থেকে বেরুইনি বলতে গেলে। ডাক্তারখানা আর হাসপাতালের জন্য বেরিয়েছি। তবে ইদানীং মোটামুটি হাল ছেড়ে দিয়েছি বলা যায়। দামী কেএন-৯৫ মাস্ক পরে বেরুবার মতো বিলাসিতা করা হচ্ছে না, সার্জিকাল মাস্ক দুটো পরে বের হই। গ্লাভস পরা হয় না। বিরক্ত লাগে এখন। হাত ২০ সেকেন্ড ধোবার কথা মনে থাকে না, থাকলেও আলসেমি লাগে। আবার অন্যকে স্বাভাবিকভাবে, অসতর্ক হয়ে চলতে দেখলে ঠিকই উপদেশ দিই, গালি দিই।
কেন দিই বেশরমের মতো? যেখানে নিজেই কিছু মানি না?

কারণগুলো ওপরেই লিখলাম। ভেন্টিলেটর কিংবা অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য দৌড়াতে হয়নি আব্বা কিংবা আম্মা বা অন্য কাউকে নিয়ে- সেটাই অসম্ভব রকমের দয়া উপরওয়ালার। কাছের-দূরের বেশ কয়েকজন আত্মীয় মারা গেছে এই ভাইরাসের কবলে পড়ে। বন্ধু-বান্ধব আর পরিচিতদের মাঝেও মৃত্যু থাবা বসিয়ে গেছে-বসাচ্ছে। বাবা'র লাশ ছেলে নামাতে পারেনি, নামিয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অচেনা কেউ, সন্তানের মরদেহ কাঁধে নেবার কপালটুকুও হয়নি অনেক পিতার। মা'কে ছটফট করে করতে মারা যেতে দেখতে হয়েছে, স্ত্রী-স্বামী চিকিৎসার অভাবে রাস্তায় মারা গেছে- এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। এতটাই ঘটছে যে এখন আর গায়েও লাগে না এত নির্মম মৃত্যু।

করোনা একদম ঘরে ঢুকে পিষে রেখে গেছে আমাদের। মানসিক-শারীরিক-আর্থিক ভাবে। চাই না আমার ঘোর শত্রুও এই অবস্থার মাঝে দিয়ে যাক।

কথাগুলো লিখে রাখলাম। যাতে করোনার ভয়াবহতা সবার মতো আমিও পুরোপুরি ভুলে না যাই।

পুনশ্চঃ লেখাটা লেখার আরেকটা কারণ হচ্ছে গতকাল রাত থেকে তীব্র জ্বর। প্যারাসিটামলেও কাজ দিচ্ছে না। সাথে খুশখুশে কাশি আর সর্দি। দ্বিতীয়বারের ধাক্কা সামলাতে পারবো কিনা জানি না (যদি হয়ে থাকে আরকি। সিজনাল ফিভার হলে তো বাঁচোয়া।)। প্রস্তুত নই মোটেও। আর কত?

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:৫৯

রাজীব নুর বলেছেন: হায় হায়----
এই জন্যই আপনাকে এতদিন ব্লগে দেখি নাই!!!

২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ বিকাল ৪:৩০

মোটা ফ্রেমের চশমা বলেছেন: জ্বি ভাই। শরীর সায় দিচ্ছিলো না একদমই।
আপনি ভালো আছেন তো?

২| ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৮:২০

সাড়ে চুয়াত্তর বলেছেন: এবার মনে হয় সিজনাল জ্বর হয়েছে। তবে আপনার পরিবারের উপর দিয়ে যে ঝড় গেছে তা যেন আর কারও উপর দিয়ে না যায় এই কামনা করছি। ভালো থাকবেন।

২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ২:৫৪

মোটা ফ্রেমের চশমা বলেছেন: সেটাই যেন হয় ভাই। আপনি ও আপনার পরিবারও সুস্থ থাকুক দোয়া করি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.