![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আপেল গাছের সঙ্গে ধাক্কা খাব, মরে যাব
'একদিন, আপেল গাছটির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ঠিকই মরে যাব'_ কবিতাটি কী মৃদুল দা'র? মৃদুল দাশগুপ্ত? বাতাসে তুলোর বীজ উড়তে উড়তে এই লাইনটা মাথায় ঢুকে পড়ল। কবে? মনে নেই। তবে, অনুমান করি, এই ইচ্ছে রোপিত হয়ে গেল বালকবেলায়। মৃত্যুর এ রকম ধারণাযুক্ত কবিতার ভেতর দিয়েই পাড়ি দিলাম দু'দুটি দশক, আগুনমুখো মাঠ। তাহলে কি আমি আজও আপেল গাছের সঙ্গে ধাক্কা খাইনি? খেয়ে, একবারও মরিনি?
মরেছি। বারবার মরেছি মরার ইচ্ছায়। শতবার মরে ফের জন্ম নিয়ে হামাগুড়ি-হাঁটতে হাঁটতে আবার তাকিয়ে দেখেছি, দূরে একটি গাছ দেখা যায়। আপেল গাছ। মনে মনে প্রস্তুত হই। ছুটে যাই। আপেল গাছও এগিয়ে আসে। আমরা ধাক্কা খাই। তারপর মরে যাই। এই হচ্ছে এক প্রকার অটোবায়োগ্রাফি। এর কোনো মূল্য আছে? মানে অাছে? মানে নেই।
মরেছি তো আরও। মরার জন্যই জন্মাই, কিছুদিন থাকাথাকি করি, কাটাকুটি করি, কয়েকটা কবিতা লেখা হয়। তারপর মরে যাই। আবার একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার আশায় জন্মলাভ করি।
মৃত্যু নিয়ে এ রকম হেঁয়ালিপনা থেকে কিছু তো পরিষ্কার হয় না। পরিষ্কার না করলে পাঠক বুঝবে কি? পাঠক কি বুঝবে, না বুঝবে, আমি তার ধার ধারি? হ্যাঁ, কথা থাকে, পাঠিকার কথা থাকে। পাঠিকা পেলেই মনে হয়, আমি ওকে চিনি। আমিই মরে গিয়ে ওর মধ্যে বেঁচে আছি। আমিই ওর মনের মানুষ। বলতে ইচ্ছে করে, মতিজান, আমিই তোমার লালন ফকির। তোমার ভ্রুকুটিতে মরি, ভ্রু-পল্লবের ইঙ্গিতে বাঁচি। যে কথা বলছিলাম, কী কথা বলছিলাম? কোনো কথাই হয়তো বলছিলাম না, কেবল বলব বলে ভাবছিলাম। ভাবছিলাম, এমন চৈতালি দিনে, খরখরে হাওয়ায়, ওকে কী বলা যায়? ওকে বলতে এখানে কার কথা বলা হচ্ছে, তাও পরিষ্কার হলো না। আচ্ছা, ধরি, ও হচ্ছে আপেল গাছ। ও সেই অব্যয়। ও সেই কলেজের মেঘ (মেঘ পরে ইউনিভার্সিটিতে যাবে, পড়তে, পড়াতে) কিংবা ও সেই বাঁক, যার বাঁকে গেলেই আমার মৃত্যু হয়। আমি মরে যাই। মূলকথা হচ্ছে, ওর শরীরের যে কোনো বাঁকেই আমার মৃত্যু লেখা থাকে। না মরে যাব কনে?
শীতকাল আসার আগেই ভাস্কর মরে গেছে। সুপর্ণার চিঠিতে জেনেছি। চিঠির ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছি। এখন জানি না, সুপর্ণা কোথায় থাকে? ফোন নম্বর কত? ই-মেইল অ্যাকাউন্ট আছে কি-না? ফেসবুকে পাব? আবার, খুব ছোট কিছুর জন্য হুমায়ুন আজাদ মারা যাননি, মারা গেলেন অনেক বড় কিছুর জন্য।
আহমদ ছফা মরেছেন স্রেফ অনাদরে, অবহেলায়, চিকিৎসার আদর ছাড়াই। তরুণ কবি মরে যায় রাগে, অভিমানে। তরুণ কবি চলে যায় নক্ষত্রের ইশরায়। আবুল হাসানকে দেখলে আমার তাই মনে হয়।
মোটা দাগে, কয়েকবার মৃত্যুর দরজা পর্যন্ত গেছি। একবার লিফ্ট ছিঁড়ে পড়ে, একবার মৃদু হৃদরোগের ঝাঁকুনিতে এবং একবার মরতে যাচ্ছিলাম রাঙামটিতে শুটিং করতে গিয়ে। শুটিংয়ের গল্পটা বলি_
২০০৩ সালের দিকে, আমরা একটা দল ট্রাভেল শো নির্মাণে বেরিয়ে পড়লাম ঢাকা ছেড়ে। টেলিভিশনের জন্য সেই প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে আমরা কাজ নিয়েছিলাম। প্রথমে আমরা যাই চট্টগ্রামে, ওখানে দু'দিন কাজ করে যাই কক্সবাজারে। সমুদ্র-শহরেও আমরা দু'দিন কাজ করি এবং এরপর যাই শৈলশহর বান্দরবানে। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে ঘুরি। ভিজিওগ্রাফির কাজ, প্রামাণ্যচিত্রের আঙ্গিকেই, মৃদু ফিকশন ভঙ্গিও ছিল। বান্দরবান ছেড়ে পৌঁছাই রাঙামাটিতে। রাঙামাটি নামটাই কত সুন্দর। তো যাই হোক, আজও মনে পড়ে সেই চাকমা মেয়েটাকে। শ্যামলা মেয়ে। চাকমারা সাধারণত শাদা, কিন্তু মৌসুমী চাকমা ছিল শ্যামলা। বেশি সুন্দর। তো মৌসুমীও আমাদের সঙ্গে কাজ করছিল। প্রথমদিন কাজ শেষে, সন্ধ্যায় আমরা মাইক্রোবাসে করে মৌসুমীকে ওদের বাড়িতে পৌঁছে দিতে গিয়েই বিপত্তি বাধল। দেবাশীষনগরে একদল চাকমা ছেলে আমাদের পথ আটকালো। আমরা মাইক্রোবাস থেকে নামলাম। সারিবদ্ধভাবে আমাদের এগারোজনকে দাঁড় করানো হলো মাইক্রোবাসের হেডলাইটের সামনে। বুঝলাম, কিছু একটা হতে চলেছে। শুরু হলো আমাদের উদ্দেশে গালি, বাঙালি বলে। শুরু হলো বাঁশ দিয়ে পিটানি, দায়ের উল্টো দিক দিয়ে ঘা। আমাদের ২/৩ জন তো মুহূর্তেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল রাস্তায়। সে সময়, মৌসুমী চাকমাই চিৎকার করে নির্দেশ দিল আমাদের, পালান, পালান। যে কয়েকজন দৌড় দিল আমিও তার একজন। পাহাড়ি পথে রাত ৮-৯টার দিকে দৌড়াচ্ছি দিগ্গি্বদিক। পেছনে বাঁশ হাতে, দা হাতে একদল পাহাড়ি ছেলে। আর তো পারি না। দৌড়াতে দৌড়াতে কোথায় যাচ্ছিলাম, জানি না। শুধু মনে হচ্ছিল, ধরে ফেললেই আমাদের মেরে ফেলবে। কী ভয়ার্ত দশা আমাদের, কী ভয়ানক মুখ আক্রমণকারী পোলাগুলোর। মৌসুমী ওদের পাড়ার নায়িকা, খুবই আকর্ষণীয়। আমাদের টিমে ও কাজ করছে_ এটা মানতে পারেনি ওদের পাড়ার প্রেমপিয়াসী যুবকেরা। ফলে, আমাদের ওপর আক্রমণ করে বসে। অাবার বাঙালিদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের একটা রাজনৈতিক বিরোধ তো অাছেই। যেহেতু ব্যাপারটা নারীঘটিত, আজ আমি স্বীকার করব, সে রাতে ওদের আক্রমণ ঠিকই আছে। এমন কি আমাদের সবাইকে হত্যা করলেও মনে হয় ঠিকই ছিল। কারণ, মৌসুমী চাকমা। শ্যামলা তরুণী। পাহাড়ি আপেল গাছ। সেই গাছে ধাক্কা খাবে বাঙালি পোলা? উঁহু! অত সহজ না। যাই হোক, আমরা বেঁচে গেলাম, সে-বারের মতো। এরপর আর রাঙামাটি যাত্রা হয়নি। রাঙামাটির পাহাড়ে কি মৃত্যু লুকিয়ে আছে? থাকলে থাকুক, আমি সেই মৃত্যুকে ভালোবাসি। মরতে তো হবেই, তাহলে আপেল গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মরাটাই ভালো না?
না, মরতে মরতে আমরা বেঁচে যাই। হ্যাঁ, বাঁচতে বাঁচতে আমরা মরে যাই। হয়তো বহু বহুকাল টেরই পাই না, বেঁচে আছি, না মরে গেছি! ঢিলিমিলি মরীচিকা চোখে পড়ে দুপুর বেলায়, ফাঁকা মাঠে রোদ ঝরে পড়ে। ঝিমঝিম লাগে। মনে হয়, লরেন্স অব অ্যারাবিয়ার ঘোড়াটি এগিয়ে আসছে ওই রৌদ্ররেখার ঢিলিমিলি মরীচিকার ভেতর থেকে।
কিন্তু না, ঘোড়াটিকে আর দেখা যায় না। হঠাৎ মনে হয়, ওই যে একটা গাছ, আপেল গাছ। আপেল ঝুলছে। প্রস্তুত হই ধাক্কা খাওয়ার, মরে যাওয়ার।
কিন্তু মৃত্যুও অত সহজে আসে না...
©somewhere in net ltd.