নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

৩২ পৃষ্ঠায় খড়, ৩৩ পৃষ্ঠায় অাগুন

টোকন ঠাকুর

কবিতা গল্প লিখি, ছবি আঁকি-বানাই, একাএকা গান গাই...

টোকন ঠাকুর › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফুটপাত মাথায় করে ফিরি,,,

১৭ ই মে, ২০১৫ রাত ২:০৩

ফুটপাত মাথায় করে ফিরি

হাঁটতে হাঁটতে, ভাবতে ভাবতে যাচ্ছিলাম। বালক বেলায় তো নাচতে নাচতেই যাচ্ছিলাম। কোথায় যাচ্ছিলাম? কে কে যাচ্ছিলাম? এবং কেন যাচ্ছিলাম?
দিগন্ত-মাঠের ভেতরে শুয়ে ছিল আলপথ বন্দ্যোপাধ্যায়। দীর্ঘ আলপথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে ইশকুলে যাচ্ছিলাম। আলপথ আমাকে ইশকুলে নিয়ে গেছে। ইশকুল চলে গেছে কলেজের দিকে। কলেজ গিয়ে পৌঁছেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আমি ফুটপাতে নেমে গেছি। এখন, ফুটপাত ধরে হাঁটছি। হয়তো কোথাও যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি? কেন যাচ্ছি?
যেতে যেতে, হাঁটতে হাঁটতে, ভাবতে ভাবতে, রাত্রি গভীর হলে তাকিয়ে দেখেছি_ দূরে, সপ্তর্ষিপাড়ার ছায়াপথ। সেই পথে ঘণ্টাকর্ণ শব্দ করে যায়। এক কথায়, ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে আমি ছায়াপথের দিকেও চলে গেছি বহুবার। দেখেছি নক্ষত্রেরা সংসার করছে বউছেলেমেয়ে নিয়ে। নক্ষত্রদের বাড়িঘরদোরে খুব আলো, নিজের চোখে দেখেছি। দেখেছি ফুটপাতের নিয়ন আলো। নিয়ন আলোর ফুটপাত ধরে রাত্রিবেলায় হেঁটে যায় সারি সারি সিংহের শব, তৃণভোজী মানুষের পা। ফলে ফুটপাত আমার চেনা হয়ে যায়। ফুটপাতে রেখে যাই অাদিগন্ত স্বপ্ন, সম্ভাবনা, ভালোবাসা। ফলে ফুটপাত আমার পিছু ছাড়ে না। ফুটপাত আমাকে ভুলতে পারে না, আমিও ফুটপাতকে এড়াতে পারি না। মনে হয়, প্রতিদিন ফুটপাত পায়ে পায়ে ঘরে ফিরি। ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে ফুটপাত। তখন দেখি, ফুটপাতে শুয়ে থাকা বিকলাঙ্গ ভিখিরিও শুয়ে আছে আমার ঘরে, ফুটপাতের দোকানদার দাঁড়িয়ে চানাচুর বেচছে আমার ঘরের বারান্দায়। আমি বিছানায় শুয়েই বারান্দায় তাকিয়ে বলি, দশ টাকার চানাচুর দাও।
এবং একদিন, ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে দেখি, চারপাশ কেমন অচেনা। এ কোন সময়? এ কোন শহর? ফুটপাতেই, আমাকে ক্রস করে গেলেন যে লোকটি, তাকে তো এক সময় বরিশাল সদর রোডের ফুটপাত ধরেও হাঁটতে দেখেছি। চেনাচেনা লাগল। ঘুরে, সে-লোকের পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করি ফুটপাত ধরে। কোথায় যাচ্ছেন তিনি? আমরা ঢুকে পড়লাম রাসবিহারি এভিনিউতে। হঠাৎ লোকটি আমার দিকে ঘুরে তাকালেন। আমিও থমকে দাঁড়ালাম। লোকটি বললেন, এ নদীর জল কেন বিকেলের হলুদ নরম চোখের মতো?
ফুটপাতে নদী কোথায়? কিছু বুঝতে পারার আগেই তিনি ফের বললেন, লিবিয়ার জঙ্গল এই নগরীর রাত্রির মতো।
বললাম, হতে পারে।
লোকটি বললেন, আমার কবিতাগুলো চিরকাল বুকশেলফেই থেকে যাবে, নাকি ফুটপাতে নেমে আসবে? ফুটপাত ধরে হাঁটবে!
এতক্ষণে বুঝলাম, উনি কুসুমকুমারী দাশের ছেলে। কবিতা লেখেন। উনিও ফুটপাত ভালোবাসেন। ফুটপাত ধরে হাঁটেন। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আকাশগঙ্গার প্রচ্ছায়া কুড়িয়ে ফেরেন।

তারপর কমপক্ষে আরও তিনবার আমার দেখা হয়েছে ফুটপাতে। শেষবার অবশ্য কলকাতাতে নয়, ঝিনেদায়। ছোট জেলা শহরের রাস্তার ফুটপাতও ছোট। রিকশাই বেশি চলে। এক সন্ধ্যায় নবগঙ্গা নদীর পাড়ে যে দেবদারু এভিনিউ_ আমরা কবিতার বন্ধুরা আড্ডা দিচ্ছিলাম, লোকটি অচেনা লোকের মতোই ঢুকে পড়লেন আমাদের আড্ডায়। আমরাও তাকালাম। তিনি বললেন, আমরা যাইনি মরে আজও, তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়।
'হম, হয়! তারপর!'
'সেই দৃশ্য তুলে রাখো_ মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের শ্যামল প্রান্তরে।'
তারপর আর তার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়নি। কেন এ রকম লোকের সঙ্গে আমরা আর সন্ধ্যা ফিরে পাই না_ এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন শহীদ কাদরী। শহীদ কাদরীর সঙ্গেও দেখা হলো ফুটপাতে, প্রথম দিন পুরানা পল্টনের রাস্তায়। তারপর একদিন তাকে দেখা পাই বোস্টনের রাস্তায়। কাদরীর পায়ে ঢাকার ফুটপাত লেগে আছে দেখে খুশি হলাম। শহীদ কাদরীর সঙ্গে অবশ্য খুব বেশি দেখা হয়নি, বেশি পেয়েছি আমরা শামসুর রাহমানকে। পুরান ঢাকার অলিগলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, বিউটি বোর্ডিং হয়ে আমরা প্রথমে অাসি চানখারপুল, ওখানে অনেক খাবারের হোটেল। এক হোটেলে গরম পরোটা খেয়ে শামসুর রাহমানের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছি তিন বাই এক_সেই দোতলা বাড়ি, শ্যামলীতে। তারপর গেছি বারাবো মাহানপুর রিং রোড। দেখি রোডেই দাঁড়িয়ে আছেন ফরহাদ সাঁই। মজহার সাঁইয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্বমুখর ভাব ভালোবাসার পর সোজা শাহবাগ। শাহবাগই আমাদের তারুণ্যের রাজধানী। শাহবাগ থেকে একেকটি রাস্তা চলে গেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রত্যন্তে। তাই কেউ একবার শাহবাগে এসে পড়লেই সে পৌঁছে যাবে ফ্লোরেন্সে,, মিউনিখে, জ্যাকসন হাইট বা ব্রিকলেনে। শাহবাগ পুরোটাই ফুটপাত। রাস্তা নেই। তাই শাহবাগের ফুটপাতে বই পড়ে থাকে। শাহবাগের ফুটপাতই মনে হয় পাবলিক লাইব্রেরি। হজরত আহমদ ছফা ও ডক্টর হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে এখনও মনে মনে প্রতিদিন দেখা হচ্ছে শাহবাগের ফুটপাতে। টুকটাক আলাপ-সালাপ, ঝগড়া-তর্ক হচ্ছে। অবশ্য ফুটপাত বিষয়ে একটা ঘটনা এতটাই সত্যি যে, তা না জানলে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুকে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা দেখানোর নামান্তর মনে হবে। ছফা হাঁটছিলেন কাঁটাবনের রাস্তা দিয়ে, নীলক্ষেতের দিকে। যে কোনো কারণেই যেভাবেই হোক, একটি বেগুন গাছের চারা পড়েছিল ফুটপাতে। ছফা যখন বেগুন চারার পাশে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছেন, তখনই বেগুন চারাটি তাকে ডাক দিল। বলল, ভুলে গেলি? ছোটবেলায় তুই যে খুব বেগুন ভাজি পছন্দ করতিস, আর আজ আমাকে ভুলে গেলি?'
ছফা দাঁড়িয়ে গেলেন। গাছের প্রাণ আছে, গাছ কথা বলতে পারে এ কথা ছফারও অজানা নয়। ছফা খুব মুখ কাঁচুমাচু করে দু'কদম পিছিয়ে এসে বেগুন চারাটিকে তুলে নিয়ে গেলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসের সামনের মাঠের মাটিতে পুঁতে যত্ন শুরু করলেন। ক'দিনেই বেগুন গাছ সতেজ হয়ে উঠল। লায়েক হয়ে উঠল। এরই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসের সামনের পুরোটা মাঠজুড়ে আহমদ ছফা ছাত্রদের সহযোগিতায় বেগুন চাষ শুরু করলেন। কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে সেই বেগুন চাষের ইতিহাস তৈরি হয়েছিল। শিল্পী এসএম সুলতানও তখন থাকতেন ছফার হিল্লায়। কিন্তু কথা হচ্ছিল ফুটপাতে, ফুটপাত নিয়ে। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল আমার ফুটপাত-বন্ধুদের সঙ্গে। বন্ধুরা সবাই ঘরে ফিরেছে যখন, পায়ে পায়ে ফুটপাতও সঙ্গে নিয়ে ফিরেছে। ফলে যে কারোরই দুই পায়ে ফিরে গেছে অনেকগুলো পা। দুই পায়ে জড়িয়ে আমরা পুরো শাহবাগই ঘরে নিয়ে ফিরেছি। উঠতি বয়সে আমার সেই ফুটপাত-বন্ধু কবি ব্রাত্য রাইসু, আমার ফুটপাত-বন্ধু ভাষ্কর নাসিমুল খবীর ডিউক, ছবি-নির্মাতা নূরুল আলম আতিক। আমার ফুটপাত-বন্ধু কবি আলফ্রেড খোকন, কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল, গল্পকার ও সাংবাদিক নজরুল কবীর। আমার ফুটপাত-বন্ধু চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, কবি-গীতিকার-অভিনেতা মারজুক রাসেল। আমার ফুটপাত-বন্ধু গল্পকার-অনুবাদক মাসরুর আরেফিন, কবি-অনুবাদক মিলটন মোললা। আমার ফুটপাত-বন্ধুর সংখ্যা যে কত তা যদি লিখতেই হয়_ তাতে একটি পূর্ণ পুস্তক হয়ে যাবে। আমার ফুটপাত বলতেই ঝিনেদার দিলীপ ঘোষ, যশোরের মারুফুল আলম, খুলনার পল লা-ভেল্যু। আর ঘুরে ফিরে শাহবাগ। আগেই তো বলেছি, শাহবাগের যে কোনো রাস্তাই চলে গেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন শহরে। এই শাহবাগেই কেটে গেল দীর্ঘ দুইযুগ। শাহবাগের ফুটপাত মুখস্থ হয়ে গেল। শাহবাগ বুকের মধ্যে নিয়ে ঘোরাফেরা করে যাচ্ছি।
শাহবাগের ফুটপাতে ধুলো হয়ে পড়ে আছে কবিতা, ধুলো হয়ে উড়ছে গান, হাওয়ায় হাওয়ায়। শাহবাগের দেয়ালে দেয়ালে ক্যানভাস ঝুলছে। ছবি আটকে আছে গাছে গাছে। মানুষের ভিড়ে। এই শাহবাগের ফুটপাত ধরেই আমি জাতীয় জাদুঘর, পাবলিক লাইব্রেরি, চারুকলা, টিএসসি-উদ্যানে চষে বেড়াই। দেখলাম তো, চার দেয়ালের অফিস-বাসার চেয়ে ফুটপাত কত স্বাধীন। ফুটপাত থাকে আকাশের নিচে। ফুটপাত থাকে পায়ের নিচে। তারপরও স্বীকার যদি করতেই হয়, তবে বলব, প্রত্যেক দিন ঘর থেকে কি বাইরে যাই, নাকি বাইরে থেকে ফিরি ঘরে? এই প্রশ্ন মাথা কুটে মরে। তারপরও যাই, তারপরও আসি। আলটিমেটলি, যতই থাকুক আকাশ, উপরে, ফুটপাতই মাথায় করে ফিরি। ফেরার সময়, ঠোঁটে জ্বলে বিড়ি...

কালের খেয়া, ১৫ মে ২০১৫

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে মে, ২০১৫ রাত ১২:৩৬

জরীফ উদ্দীন বলেছেন: সমকালের কালের খেয়ায় পড়েছিলাম আজ আবার পড়লাম। পড়ে হারিয়ে যাই ভাবনার সাগরে। অনেক অনেক ভালো লাগল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.