নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মঞ্জুরে খোদা টরিক

মঞ্জুরে খোদা টরিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

রাজুভাষ্কর্যে তারুণ্যের উৎসব না আত্মসমর্পন

১৩ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ৮:৩০

ড. মঞ্জুরে খোদা

যে শির একদিন হয়েছিল উদ্ধ্যত, যে বুক দেখিয়েছিল তারুণ্যের দূরন্ত স্পর্দ্ধা ও বেপরোয়া সাহস, যে তরুণের দৃষ্টি ও তর্জনী ছিল নির্ঘাত ট্রিগারের দিকে, সেই ক্যাম্পাসের প্রমিথিউস রাজুর উন্নত শীরে তোমাদের পা..! সেই তারুণ্যের আজ এই অপমান- কোথায় মুখ লুকাই! যে যৌবন মিছিলে যায়, ঝল্‌সে ওঠে সেই যৌবনের মৌনতা, নতশীর, আমার প্রতিবাদের ভাষা নাই। শুনেছি, কাক কখনো কাকের মাংশ খায় না, ধিক্‌ ধিক্‌ তোমাদের। এ উৎসব বিজয়ের নয় এ উসব ছিল আত্মসমর্পনের!

দেশে বড় যে কোন উৎসব-আনন্দের বিষয় হলেই আমি আতঙ্ক বোধ করি। আতঙ্ক বোধ করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজুভাষ্কর্যের কারণে। সাম্প্রতিক অতীতের বেশ কয়েকটি ঘটনা আমার মধ্যে এই দুঃখ ও ক্ষোভ তৈরী করেছে। কয়েকদিন আগে ব্রিটিশের সাথে খেলায় জেতার উ্ম্মাতাল আনন্দে তরুণ-যুবকরা ফের রাজু ভাষ্কর্যের উপর হামলে পরলো। রাজুর মাথার উপর উঠে বিকৃত উ্ল্লাস মেতে উঠলো আমাদের ভবিষ্যত- তরুণ সমাজ। বিবস্ত্র/অর্ধবস্ত্র অবস্থায় নৃত্য করছে যে মূর্তির শিরের উপর সেটি আমাদেরই প্রিয় স্পর্দ্ধিত সহযোদ্ধা রাজুরই প্রতিমূর্তি। এই তরুণরা কি সেটা জানে? না’কি এই যুবকদের ধারণা এটি কেবলি একটি কংক্রিটের উঁচু উল্লাস মঞ্চ। যে কোন বিজয়ে আনন্দে তাদের করতে হবে এর মুন্ডুপাত! যে দেশে শতশত মানুষের সামনে কষাইয়ের চাপাতি দিয়ে কৃতি সন্তানদের কল্লা নামানো হয় সেখানে একটা পাথরের মূর্তির জন্য আর কে প্রতিবাদ করবে?

আমি যখন প্রথম আমার বড় ভায়ের হাত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই তখন এক ভিন্ন রকম শিহরণ বোধ করেছিলাম। অধিক রোমান্স বোধ করেছিলাম অপারাজেয় বাংলার পাদদেশে দাড়িয়ে। পরম শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও দরদ দিয়ে তা ছুঁয়ে দেখেছি, আর বুকের ভিতর এক দারুণ স্পন্দন অনুভব করেছি। সেই প্রতিষ্ঠানের এবং দেশের সর্ববৃহত “সন্ত্রাস বিরোধী রাজু স্মারক ভাষ্কর্য” নির্মানে ছাত্র ইউনিয়নের অনেক নেতা-কর্মীর সাথে সক্রীয়ভাবে যুক্ত থাকায় নিজেকে এর অংশ মনে করি এবং গর্ব অনুভব করি। খুব আপন কোন কিছুর মতই ভীষন একাত্ব বোধ করি এই চেতনাদীপ্ত শিল্পকর্মের সাথে।

রাজু ভাষ্কর্য নির্মানের সময় তার পাদদেশেই এর সরঞ্জাম রাখতে একটি বাঁশের ছাপড়া বানাতে হয়েছিল। সেখানেই অনেক দিনরাত আমি নিজে আমার অনেক সহকর্মীদের সাথে কাটিয়েছি। কাগজের ঠোঙায় খাবার খেয়ে সেখানেই দুপুর-রাত বিশ্রাম নিয়েছি, কাজের তদারকি করেছি মাসের পর মাস। চোখের সামনে জলজল করে ভাসে সেই স্মৃতি। আজও প্রত্যেকটি সহকর্মীর সেই প্রত্যয়ী মুখ আমার কাছে দারুণ স্পষ্ট ও উজ্জল। সংগঠনের জন্য এই কাজটি ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে এটিকে এগিয়ে নিতে হয়েছে। অনেক আনন্দ-বেদনার স্মৃতি মিশে আছে এই কর্মের সাথে। মধুর ক্যান্টিনের শেষে অপরাহ্নে সেই নির্মানাধীন ভাষ্কর্যই হয়ে ওঠে সংগঠনের ছেলে-মেয়েদের আড্ডা ও গল্পের স্থান। সাথে সামান্য ছোলা-মুড়ি-চা-পিয়াজু-বেগুনি ছিল আমাদের সেই রোমাঞ্চকর দিনগুলির অংশ। বলা যায় এই রাজুচত্তরই ছিল সংগঠনের অনানুষ্ঠানিক অপরাহ্ন-সান্ধকালীন অফিস। মনে পড়ে ১৯৯৯ সালে সংগঠনের নেতা প্রটন কুমার দাস হত্যার প্রতিবাদে সচিবালয়ের দিকে মিছিল নিয়ে যেতেই পুলিশ বন্দুকের বাট দিয়ে পিটিয়ে আমার শরীর রক্তাক্ত করে। আমিসহ সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে থানায় আটক করা হয়। পরে সহকর্মীরা আমাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে এনে ভাষ্কর্য়ের সেই টিনের ছাপড়াতেই চিকিৎসা করে। সহযোদ্ধাদের সেই উদ্বেগ আকুল হাতের স্পর্শ আজও আমি অনুভব করি।

ছাত্র ইউনিয়নের ২৬তম জাতীয় সম্মেলনের আগে ভাষ্কর্যের উদ্বোধনকে ঘিরে ছাত্রলীগের কতিপয় সন্ত্রাসী এই ভাষ্কর্যের উপর কোদাল দিয়ে হামলা করতে উদ্যত হয়। তখন কয়েকজন সহকর্মীকে নিযে তা প্রতিরোধ করি। আমি সন্ত্রাসীদের সেই কোদালের আঘাতে আহত হই। এবং আমার ডান হাতের ‘কব্জিতে ইন্টারন্যাল ফ্র্র্যাকচার’ হয়। দীর্ঘ দিন তার কম-বেশী ব্যাথা বিরতি দিয়ে অনুভব করেছি। ধীরে ধীরে সেই ব্যাথা বাড়তে থাকে। অনেক দিন নানা চিকিৎসার কাজ না হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শে জাপানে থাকাকালীন সময়ে আমার হাতের কব্জিতে অপারেশন করে ‘বোন ট্রান্সপ্লান্ট’ করতে হয়্। সংগঠনের দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে চেষ্টা করেছি নিজের দেহ-মন দিয়ে বন্ধু রাজুর স্মৃতি ও চেতনার সম্মান ও মর্যদা রক্ষা করতে। সবটুকু সতর্কতা ও সচেতনতা দিয়ে আগলে রাখতে চেষ্টা করেছি এই শিল্প ও চেতনার প্রতিবাদী মিছিলকে। আজও আমি তার একাত্ব বোধ করি। বিজয়ের উচ্ছাস-আনন্দ প্রকাশ একটি স্বাভাবিক বিষয় কিন্তু তারও একটা মাত্রা ও সৌন্দর্য আছে। আমাদের অনেক কিছুই মাত্রা ও সৌন্দর্যহীন! আমরা বিজয় উৎসব করি কিন্তু তাকে ধরে রাখতে পারি না। কারণ আমাদের আনন্দ, উৎসব, উদযাপন কেবলি তাৎক্ষনিক ও আনুষ্ঠানিক। তা যেন দীর্ঘ মেয়াদী নয়। এত বিজয় ও আনন্দ আমাদের কেন দায়িত্বশীল করতে পারছে না? ৭১ এর বিজয়, ৯০ এর বিজয়, গণজাগরনের বিজয় সব বিজয় যেন আজ অভিভাবকহীন ও বেওয়ারিশ।

এই লাখো যুবকের বেপরোয়া উম্মাতাল উচ্ছ্বাস দেখি আর কেবলি মনে হয়, কোথায় ছিল আপনাদের সেই উদ্ধ্যত শির যেদিন অভিজিত-বন্যার উপর হত্যা-আক্রমন করা হয়। একটু কি লজ্জিত হই না আমরা? এতটুকু কি অস্বস্তি বোধ নেই আমাদের? একটু কি বিনয় বোধ করি না..? এখনও অভিজিতের ফিন্‌কি দেয়া কালশিটে রক্তের দাগ সেখানে স্পষ্ট। আসলেই আমরা বোধহীন, বধীর। আসলেই আমরা প্র ব ল অনুভূতি প্রবণ জাতি! আমাদের তুলনা নেই। আমাদের অনুভূতি যতটা জাগে, যতটা আকাশমুখী হয় তার সবটাই কেবল ধর্মে.. কর্মে নয় তার মোটেও! কর্মে যদি হতো তাহলে আমাদের ধর্ম হতো মানবতা ও সভ্যতার। আর এই আলোচনায় প্রসঙ্গ ক্রমে মনে হয় মাকর্সের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘অনুভূতিহীন কানের কাছে পৃথিবীর সেরা সঙ্গীতটাও অর্থহীন।’

অন্যের সমালোচনা ও পরের ঘাড়ে দোষ চাপাতে আমাদের জুড়ি নেই। অভিজিতের হত্যার পর অনেক বাণী-ছবি দেখছি-শুনছি। শতশত মানুষ তার হত্যার দৃশ্য দেখেছে, কেউ হুঙ্কার দেয় নি, প্রতিবাদও করে নি, প্রতিরোধ তো দূরের কথা। একই দৃশ্য দেখছি রাজুর মস্তকের উপর কতিপর তরুণের উল্লাস নৃত্যে। ঠিক তার পাদদেশেই হাজার হাজার তরুণ-যুবক কিন্তু কেউ কোন প্রতিবাদ করল না এই অনৈতিক, অসুস্থ বিকৃত কান্ডের। ওদের হাতে তো খঞ্জর-চাপাতি কিছুই ছিল না! তাহলে কোথায় আপনাদের অনুভূতি? কোথায় আপনাদের বিবেক? কোথায় আপনাদের শিক্ষা? কোথায় আপনাদের মর্যাদাবোধ? কোথায় তারুণ্য ও যৌবন? কিসের গৌরব ও আনন্দের এই উৎসব? কোথায় আছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের অহঙ্কার? সত্যিই কবি-, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না’কো তুমি..!


দেশের শিল্প-স্থাপত্য-ভাষ্কর্য সংরক্ষন ও উন্নয়নে কতৃপক্ষ ও পুলিশের কি কোন ভূমিকা নেই? একটি সভ্য ও মানবিক সমাজে কোন অন্যায়-অনৈতিক-দৃষ্টিকটু কিছু ঘটলে, চোখে পড়লে মানুষ, আইন, সমাজ তার বিপরীতে দাড়ায়। আর আমরা? আসলে আমাদের সমাজটা হয়েছে আজ এক আত্মকেন্দ্রীক, স্বার্থপর ও বন্ধ্যা। যে সমাজ উদারতা ও সৌন্দর্য ধারণের ক্ষমতা দিন দিন হারাচ্ছে। এখানে সততা, নীতি, আদর্শ, চরিত্র, বীরত্ব, সাহস, মর্যাদা ইত্যাদির সংজ্ঞা এখন পাল্টে গেছে। আমরা যতটুকু অর্জন করি তারচেয়ে অধিক হারাই। একদিন আনন্দ করি, দশ দিন দুঃখ করি। কোন কিছুর গর্বে আমরা আকাশ ছুঁই, ভিন্ন কিছুতে গহীন গর্তে মুখ লুকাই। বড় অদ্ভুত স্ববিরোধীতা আমাদের কর্ম ও জীবনে।

এই ভাষ্কর্যের রক্ষণাবেক্ষরে দায়িত্ব যৌথভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনর। যতটুকু জানি যে স্থানটিতে এই ভাষ্কর্য তৈরী করা হয়েছে সেই সড়কদীপটি সিটি কর্পোরেশনের অধীন, কিন্তু এলাকাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হওয়ায় তা এই প্রতিষ্ঠানের আওতা ও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে উভয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটা সমন্বয়হীনতা আছে, যে কারণে এর যথাযথ সংরক্ষন হচ্ছে না। রাজুভাষ্কর্য নির্মানের সময় স্থানটি অনুমোদনের জন্য এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের এক ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। একটি সংকীর্ণ রাজনৈতিক সমীকরণের কারণে বিষয়টিতে তৎকালীন মেয়রের যথাযথ সহযোগিতা পাওয়া যায় নি। আজকাল এই ভাষ্কর্যকে ঘিরে ব্যাক্তি বিশেষের কৃতিত্ত্ব জাহিরের নানা ধরণের মত/কথা শোনা যায় যার অনেক কিছুই খন্ডিত। পরবর্তিতে পুর্নাঙ্গ কোন লেখায় সেই বিষয়ের তথ্য-উপাত্তসহ বিস্তারিত তুলে ধরতে চেষ্টা করব।

আমি দেশে যেয়ে দেখেছি এবং পরবর্তিতে বিভিন্ন মাধ্যমে জেনেছি গুরুত্বপূর্ণ এই ভাষ্কর্যটির রক্ষনাবেক্ষনের কোন ব্যবস্থা নেই। এর প্লাস্টার খসে পরছে, কিছু কিছু ব্লক উঠে গেছে। রোদে-জলে এর ক্ষতি হচ্ছে, বিভিন্ন অংশে ফাটল ধরেছে, ভেঙ্গে যাচ্ছে। একে ঘিরে লোহার গ্রীল ছিল, সুন্দর ফুলের বাগান ছিল তা্ও আজ আর নেই। অথচ প্রতিদিন মিডিয়া, চলচ্চিত্র, নাটক, সভা-সমাবেশ-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ইত্যাদিতে এর প্রতিবাদী চেতনার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। কিন্তু এটি সংরক্ষন ও উন্নয়নের কোন আয়োজন-উদ্যোগ লক্ষ্য করছি না। সংগঠনের বর্তমান নেতৃত্ত্ব, রাজু সংসদ, প্রাক্তন ও অন্যান্য বন্ধুদের প্রতি অনুরোধ/আহ্বান রাখছি এই বিষয়ে একটা স্থায়ী উদ্যোগ গ্রহন করার। যাতে ভবিষ্যতে এই ধরণের ক্ষতিকর ও অপমানজনক কোন বিষয় এড়ানো যায়, আর কোন লজ্জা ও গ্লানি আমাদের বহন করতে না হয়। প্রয়োজনে বড় ধরণের কোন উৎসব আয়োজনের পূর্বে-সময়ে স্থানটি সংরক্ষন করা বা কোন আয়োজন রাখা। এক রাজুর স্মৃতি-চেতনা যদি আমরা সংরক্ষন করতে ব্যর্থ হই, তাহলে কিভাবে নিরাপদ করব আমাদের অর্জন ও স্বপ্ন? নতুন প্রজন্ম কিভাবে বিশ্বাস ও আস্থা রাখবে আমাদের সামর্থ্য, আন্তরিকতা ও যোগ্যতায়।

ড. মঞ্জুরে খোদা টরিক, কলামিস্ট, গবেষক ও সাবেক ছাত্রনেতা

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.