![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি লিখি আমার দেখা, শোনা আর অনুভবের গল্প। কল্পনা আর বাস্তবের মিলনে গড়ে তুলি নতুন এক জগত। কলমে আমি হলো আমার একান্ত লেখা, শুধু আমার নিজের শব্দের ভুবন।
রাউতি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবার। ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট মিজান। তার জন্মের আগেই পরিবারের দুই ছেলে অকালেই চলে গেছে—একজন দুই মাসে, আরেকজন তিন মাস বয়সে।
এ–কারণে মিজানের জন্মের পর বাবা–মা তাকে বুকের মধ্যে চেপে রাখতেন। অকারণেও দোয়া, রাতে বারান্দায় বাতাস লাগাতে গিয়ে গায়ে কাপড় টেনে দেওয়া—সবই যেন একটাই আকুতি, ছেলে যেন বেঁচে থাকে।
বেঁচেও থাকে। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই বোঝা যায়, জন্ম থেকেই তার মানসিক একটি সমস্যা আছে। আমরা যাকে সহজ ভাষায় বলি—‘পাগল’। বাবা–মা ডাক্তার দেখিয়েছেন অনেক—এই শহর, সেই শহর—কিন্তু লাভ হয়নি। মিজান বড় হতে থাকে, আর গ্রামের বাচ্চারা তাকে এড়িয়ে চলে। সে সময় বাংলাদেশের বেশিরভাগ গ্রামে যাদের ‘পাগল’ বলা হতো, তাদের সঙ্গে যা করা হতো—ঠাট্টা, ধাক্কাধাক্কি, মুঠো মুঠো কাদা ছোড়া—সব শুরু হয় মিজানের সঙ্গেও। বাবা–মা, ভাই–বোনরা অনেক চেষ্টা করেও মানুষের আচরণ বদলাতে পারেনি।
মিজানের বয়স যখন আট–নয়, তখন গ্রামের মানুষরা তার ব্যাপারে আলাদা করে সতর্ক হতে শেখে। অদ্ভুত ব্যাপারটা প্রথম ধরা পড়ে মোনা মিয়া নামের এক দোকানদারের কাছে।
ঘটনাটা হাটবারের রাতের। দোকান বন্ধ করে মোনা মিয়া বাড়ি ফিরছে। যাওয়ার পথে মিজানদের কাচারিঘর পড়ে—মূল বাড়ি থেকে একটু দূরে, যেখানে মেহমান বসে, অনেক জায়গায় যাকে বাংলাঘরও বলে। কাচারিঘরটি প্রায় মেইন রাস্তায়। মোনা মিয়া ঘরটার সামনে দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ খেয়াল করল—বাড়ির পাশের কাঁঠাল গাছের ডালে বসে আছে মিজান। তার পাশে দু’টো ছোট্ট বাচ্চা। বাচ্চা দুটোর গায়ে সাদা কাপড়। বাচ্চাদের শরীরের চারপাশে মৃদু, উজ্জ্বল এক আলো ছড়িয়ে আছে—যেমন রাতের অন্ধকারে মঠের প্রদীপের আলো থাকে, শান্ত, স্থির।
মোনা মিয়া একটু ঘাবড়ে গেলেও সাহস করে ডাকে—
—কেডা? মিজান নাকি? এত রাতে কী করো? তোমার লগে ওরা কারা? কোন বাড়ির?
মিজান নিচু গলায় বলল,
—তুই বারিত যা। আর লুঙ্গি এত্তো উপরে তুইলা হাঁটস ক্যান—সব তো দেখা যায়!
মিজানের কথা শেষ হতেই পাশের বাচ্চারা ‘হিক হিক’ করে হেসে উঠল। মোনা মিয়ার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। লুঙ্গি তিনি আসলেই একটু তুলে হাঁটছিলেন। কিন্তু সেটা মিজান দেখল কী করে? বাচ্চাদের হাসিটাও কেমন অচেনা… সে কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি লুঙ্গি নামায়, মাথা নিচু করে হাঁটতে শুরু করে। বাড়ি গিয়ে বউকে সব খুলে বলে। পরের দিন গ্রামের কয়েকজনকে জানায়। কেউ–কেউ কথাটা খুব হালকাভাবে নেয়—গ্রামের রাতে এমন ‘একা–একা দেখা’ জিনিস চোখ ফাঁকি দিয়ে দেখা দিতেই পারে—তাদের যুক্তি।
দিন কেটে যায়। মিজানকে আগের মতোই বাচ্চারা জ্বালায়—কেউ কাদা ছোড়ে, কেউ আবার পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। এসবের মধ্যেই মিজানের আরেকটা স্বভাব লক্ষ করা যায়—সে খুব পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালোবাসে। গায়ে একটু ময়লা লাগলে চিৎকার–চেঁচামেচি করে পুকুরে নেমে গোসল সেরে নেয়। তারপর ধুয়ে–মুছে, চুপচাপ বসে থাকে মসজিদের বারান্দায়। নামাজের সময় হলে মসজিদের আশেপাশে বসে, খুব পরিপাটি।
টাকা তার হাতে থাকে না, থাকে কাগজ। সে কাগজগুলো টাকার মতো ভাঁজ করে হাতে ধরে। দোকানে গিয়ে বলে—চা দাও, বিড়ি দাও। আশ্চর্য! দোকানিরা দেয়ও। গ্রামে কথা রটে—যে দিন মিজান যে দোকান থেকে কিছু নেয়, সেদিন নাকি সেই দোকানে বেচাকেনা ভালো হয়। রিকশাওয়ালারা তাকে রিকশায় তুলতে চায়—যদি বসলেই দিনটা ভালো কাটে! কুকুরগুলো—গ্রামের অলিগলি ভরা কুকুর—মিজানকে দেখলেই দূরে সরে যায়। সে যেদিক দিয়ে হাঁটে, কুকুর সেদিকটা এড়িয়ে চলে।
রাতের বেলায় অনেকেই দেখেছে—মিজান ধীরে ধীরে হাঁটছে, সঙ্গে দু’টো বাচ্চা, সাদা কাপড় পরা। চারদিকে ওয়াজ–মাহফিলের মৌসুম—খোলা মাঠে মাইকে তেলতেলে বক্তব্য। মিজানকে অনেক সময় দেখা যায় সে সব মাহফিলের আশেপাশে ঘুরে–ফিরে বেড়ায়। আর কিছু নির্দিষ্ট মানুষকে দেখলে সে হঠাৎ–হঠাৎ গালাগালি শুরু করে। ওই মানুষগুলোর নাম গ্রামে একটু বাজে কাজের সঙ্গেই শোনা যায়—মানুষ তাদের সমালোচনা করে। তাই মিজানকে দেখলেই তারা পথ বদলায়।
কখনো–সখনো গ্রামবাসীরা মিজানকে শিকলে বেঁধে রাখে—কথাটা তাদের মুখে–মুখে। কিন্তু মিজানের পরিবার বলে, তারা কোনোদিন শিকল দেয়নি। যা–ই থাক, নামাজের সময় আর ওয়াজ–মাহফিলের দিনগুলিতে মিজান ঠিকই হাজির হয়—কোনো শিকল তাকে আটকে রাখতে পারে না, এমনই যেন ব্যবস্থা।
এরই মধ্যে এক রাতে নতুন এক ঘটনা। গভীর রাত। করিম সাহেব—গ্রামের একজন সম্মানিত মানুষ—তাঁর বাড়ি মিজানদের বাড়ি থেকে পনেরো–কুড়ি ঘর দূরে। সে রাতেই মিজান গিয়ে তাঁর দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকাডাকি শুরু করে। গ্রামে নয় বছর বয়সী বাচ্চারা এ–সময় গভীর ঘুমে থাকে, বড়দের সঙ্গে । কিন্তু মিজান জেগে আছে, কথা বলছে। বাড়ির ভেতর থেকে করিম সাহেব রাগ–ভয়ে মিশ্র গলায় জানালেন, দরজা খুলবেন না। ডাকাত–টাকাতের ভয়। বাইরে থেকে মিজান বলল,
— খুলাইতে হইব না। কিন্তু আপনে এখনই ধাকায় জাওহাইন (ঢাকায় যেতে হবে)। আপনের পোলার এক্সিডেন্ট হইছে—হাসপেতালে ভর্তি। অবস্থা খারাপ।
বাড়ির বড় দরজায় খিল, চকাঠায় মোটা কাঠের ব্যারিকেড— এমন অবস্থায় দরজা খুলে একা ছোট ছেলে এত রাতে বাহিরে বের হবার কথা না । করিম সাহেব তবু কাঁপা গলায় স্ত্রীর দিকে তাকান। দরজা খোলেন না। কিছুক্ষণ পর বাইরে আর কোনো শব্দ নেই—মিজান চলে গেছে।
পরদিন সকালে করিম সাহেব মিজানদের বাড়িতে গেলেন। মিজানের বাবাকে সব বলে শোনালেন। মিজানের বাবা মাথা নাড়লেন—
—এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমাদের দরজা খিল–চকাঠায় এমনভাবে বন্ধ থাকে, মিজানের পক্ষে খোলা বা তোলাই সম্ভব না।
করিম সাহেবও বললেন,
—আমিও বুঝি । কিন্তু ডাক তো মিজানের গলাই লাগছিল। আমারও বিশ্বাস হয় না একা ছোট ছেলে এত রাতে বাহিরে বের হবার কথা না। দরজায় খিল, চকাঠায় মোটা কাঠের ব্যারিকেড ওইটা তো ওর পক্ষে খোলা সম্ভব না।
ব্যাপারটা এমনিতেই মিলিয়ে যেতে পারত। গেলও, দু’দিনের মতো। তৃতীয় দিন সকালে ঢাকা থেকে খবর এল—করিম সাহেবের ছেলে সড়ক–দুর্ঘটনায় মারা গেছে। খবরের সঙ্গে হিমেল বাতাস এসে গ্রামটাকে স্তব্ধ করে দিল। বড়রা মিজানকে নিয়ে ঠাট্টা–বিদ্রুপ প্রায় বন্ধ করে দিল। বাচ্চারা এখনো মাঝেমধ্যে টোকা দেয়, তবে আগের মতো নয়—কিছু বাচ্চা তাকে সত্যি–সত্যিই ভয় পায়।
দিন যায়। মিজান বড় হয়। তার অদ্ভুত সব আচরণ গ্রামের দৈনন্দিন কথাবার্তার অংশ হয়ে যায় —মসজিদের বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকা, কাগজ দিয়ে চা–বিড়ি কেনা, দোকানে বেচাকেনা বেড়ে যাওয়া, রিকশায় একটু উঠলেই রিকশাওয়ালার দিন ভালো যাওয়া, কুকুরেরা দূরে থাকা, রাতের অন্ধকারে সাদা পোশাকের দুই বাচ্চার সঙ্গে হাঁটা, ওয়াজ–মাহফিলের আশেপাশে ঘুরে বেড়ানো, কিছু মানুষকে দেখে অকস্মাৎ তিরস্কার করা—সবই যেন এই গ্রামের হাঁটুপথের মতো স্বাভাবিক হয়ে যায়। তবু একটা কথা সবাই জানে—মিজান কারও কোনো ক্ষতি করে না। সে কাঁদে, ধুয়ে–মুছে নেয়, আবার চুপ করে থাকে।
মিজানের বাবা—একজন ক্লান্ত, স্নিগ্ধ মানুষ—রোজ রাতেই ছেলের জন্য দোয়া করেন। ভয় তাঁর একটাই—তিনি না থাকলে ছেলের কী হবে। দোয়া করতে–করতেই একদিন তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে মিনতি করেন—“আমার মৃত্যুর আগে যদি আমার এই ছোট ছেলেটাকে তুলে নেন, তবে আমার ভয়টা কমে।” সৃষ্টিকর্তা—যিনি মানুষের মিনতি শোনেন—অদ্ভুতভাবে সাড়া দেন। মাত্র তেইশ বছর বয়সে মিজান চলে যায়। কেউ বলে অসুখ, কেউ বলে ‘যেমন আসে তেমনই হঠাৎ চলে গেল’—গ্রামে কথারও তো নিজস্ব যুক্তি থাকে।
কিন্তু মিজান থেমে থাকে না। মৃত্যুর পরও অনেকে তাকে দেখেছে বলে কথা বলে। আনিস—যার কথা “আসলে উনি কে”–তে বলেছিলাম —সে নাকি ডালিম গাছের নিচে মিজানকে দেখেছিল। মিজানের নিজের ভাষ্যমতে, ওই ডালিম গাছের নিচের জায়গাটাই তার ঘর। আনিসের দেখার ঘটনাটা আরেকবার ঘটেছিল—সেটার বিস্তারিত আছে “আবারো মিজান” অংশে। (অপেক্ষা করুন।)
~ পরিশেষে— ~
মিজানের সব অস্বাভাবিকতার গল্পে গ্রামটা ভরে গেলেও, তার মৃত্যুর পর গ্রামবাসীদের একটা অংশ চেয়েছিল সেই জায়গাটায় মাজার হোক—মিজানের নামে। কিন্তু মিজানের পরিবার, বিশেষ করে তাঁর বাবা, দৃঢ় আপত্তি করেন। তাই মাজার আর হলো না। এখন মিজান নেই—মানুষের মুখে আছে, স্মৃতিতে আছে। সেই সময়কার যারা এখনও বেঁচে, তারা আজও মিজানকে আগের মতোই সম্মান করে। কেউ–কেউ মসজিদের বারান্দার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে—যেখানে একসময় খুব পরিষ্কার কাপড় পরা, চুপচাপ একটা ছেলেকে বসে থাকতে দেখা যেত।
মাঝে–মাঝে রাতের দিকে কুকুরেরা হঠাৎ দূরে সরে যায়—কারণটা কেউ বোঝে না। গ্রামের বাতাসে তখনও প্রায়শই একটা নীরবতার ঢেউ ওঠে। এই ঢেউয়ের নাম—মিজান।
২| ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৪৭
জনারণ্যে একজন বলেছেন: @ সুম১৪৩২, প্রথম পর্বের চেয়ে এই পর্বটা পড়তে বেশি ভালো লেগেছে। একটু গতানুগতিক ছিল আগের পর্বটা।
যাই হোক, বেশ সাবলীল আপনার লেখার হাত। গল্প লেখার সময় চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। পড়তে যেয়ে হোঁচট খেতে হয়নি। তবে মিজান-ঘটিত বর্ণনার আধিক্যে গল্প একটু হলেও গতি হারিয়েছে।
পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় রইলাম। ভালো থাকবেন।
পুনশ্চ: গোবিন্দলগোবেচারা চমৎকার মন্তব্য করেছেন। ওনার অবজারভেশন বেশ ভালো।
৩| ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৫৭
আবেদি১২৩ বলেছেন: ভালো লেগেছে। আমিও "জনারণ্যে একজন" উনার সাথে একমত , "গোবিন্দলগোবেচারা অবজারভেশন নিয়ে "
©somewhere in net ltd.
১|
১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৩৫
গোবিন্দলগোবেচারা বলেছেন: দুই পর্বই ভালো লেগেছে।
তবে মিজান যে জীবিত মানুষ না এটা প্রথম পর্বে মিজান যখন বাজারের দোকান এড়িয়ে কালভার্টের উপরে চলে গেল তখনই বোঝা গিয়েছে।
আপনি যদি এটা ইচ্ছে করে করে থাকেন তাহলে কিছু বলার নেই। তবে আমার মনে হয় অধিভৌতিক গল্পে চমকটা শেষে দিলে আরো ভালো কাজ করে।
যেমন এখানটাতে বলা যেতে পারত- মিজান লাজুক মুখে বলল 'ওখানকার বেশিরভাগ দোকানদার আমার মুরুব্বী লাগে, উনাদের কাছ থেকে বিড়ি কিনতে শরম লাগে, আমার জন্য দুইটা বিড়ি কিনে আনবেন ?আমি সামনে যাইয়ে অপেক্ষা করতেছি?'
আরো বেশি লেখা আশা করছি।