নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৈয়দ মামুনূর রশীদ

সৈয়দ মামুনূর রশীদ

কাঙাল মানুষ, কাঙাল মন / আগা-গোড়া কাঙালী জীবন/ দুঃখ করি না, দুঃখ দিই না/ জোৎস্নার দিঘীতে স্নান দিয়ে/ সুখে ভাসতে চাই।

সৈয়দ মামুনূর রশীদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাড়ছে নাগরিক ব্যস্ততা, বাড়ছে শিশুদের একাকীত্ব

১৯ শে মার্চ, ২০১৯ বিকাল ৫:০৫

যুগের প্রয়োজনে, জীবিকার তাগিদে, মানুষের জীবন-যাপন প্রকৃতির পরিবর্তনে যৌথ পরিবার ভেঙ্গে দ্রুত বাড়ছে ছোট পরিবার। শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রী নিয়ে পরিবার আবার অনেক সময় কর্মস্থলের প্রয়োজনে স্বামী-স্ত্রী আলাদা আলাদা বসবাস করছে। জীবন যাপনের পরিবর্তনে অথবা সংসারে সচ্ছলতার প্রয়োজনে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকুরী কিংবা কাজ করছে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে। নাগরিক জীবনের এই ব্যস্ত বাস্তবতায় দিনের এক দীর্ঘ সময় মা-বাবার অবর্তমানে শিশুরা এখন একা একা বড় হয়ে উঠছে বাসায়। বিশেষজ্ঞরা এ বাস্তবতা মেনে নিয়ে শিশুদের “কোয়ালিটি টাইম” নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন । শিশুদের জন্য কোয়ালিটি টাইম নিশ্চিত করার কাজ করে থাকে ডে কেয়ার সেন্টার বা শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ৯৪ ধারায় বলা হয়েছে, যেসব প্রতিষ্ঠানে ৪০ বা ততধিক নারী কাজ করেন, সেগুলোতে কর্মজীবী নারীদের ছয় বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য এক বা একাধিক উপযুক্ত কক্ষ ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। কিন্তু ছয় থেকে দশ বছর বয়সী ছেলেরা কি অভিভাবক ছাড়া বাসায় নিরাপদ? বর্তমানে অধিকাংশ কর্মজীবি দম্পতিরা সাধারণত: গৃহকর্মীদের কাছে রেখে কর্মস্থলে যান। পত্রিকায় দেখা যায় বাসায় একা রেখে যাওয়া শিশুদের পরিচর্চায় অনিয়ম, নির্যাতন এমনকি গৃহকর্তার চোখ ফাঁকি দিয়ে শিশুকে ব্যবহার করে গৃহকর্মীর ভিক্ষার উপকরণ বানিয়ে ভিক্ষা করার সংবাদও আমরা পেয়েছি। বাসায় সন্তানকে রেখে যাওয়া মা-বাবাদেরও কর্মস্থলে কাজে মনোযোগী হওয়া কঠিন হযে পড়ে। বিশেষ করে পোষাক কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্পে যারা কাজ করেন, তাদের শিশু সন্তানেরা এক অবর্ণনীয় কঠিন সময়ে মধ্যে বেড়ে উঠে। ঘুমন্ত শিশুকে বাসায় রেখে মা-বাবারা কর্মস্থলে যায় আবার কর্ম-শেষে তারা যখন বাসায় ফিরে তখনও স্বাভাবিকভাবে শিশুটি ঘুমিয়ে পড়ে। অনিয়মিত সাপ্তাহিক বন্ধে অনেক সময় বাসার ছোট্ট শিশুটি মা-বাবার দেখাও পান না। নাগরিক ব্যস্ততার কারণে গৃহ পরিচারিকার হাতে রেখে যাওয়া শিশুটি পাচার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাসহ নানাধরণের ঝুঁকি নিয়েও মা-বাবারা কর্মস্থলে যাচ্ছেন। দিন দিন চাকুরিজীবি নারীর সংখ্যা যত বাড়ছে, শিশুদের একাকীত্বও বাড়ছে। বাড়ছে নিঃসঙ্গ বেড়ে উঠা শিশুর চুড়ান্ত হতাশা। হতাশাগ্রস্থ শিশুরা তরুণ বয়সে জড়িয়ে যাচ্ছে নানা অপরাধে। এভাবে চলতে থাকলে এই জাতি অদুর ভবিষ্যতে একটি অপরাধপ্রবণ জাতি হিসেবে পরিলক্ষিত হলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। একাকীত্বে শিশুরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে বেড়ে উঠছে, ফলে ভবিষ্যত তারা স্ব-স্ব পেশায় দক্ষ হয়ে উঠলেও তাদের ভাল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা কস্টকর হয়ে উঠবে। বাবা-মা সকালেই বের হয়ে যায় অফিসে। এবার সারা দিনের জন্য বাসার কাজের মেয়ে তার অভিভাবক। কি করে ছোট্ট শিশুটি? তার কচি মন নিশ্চয়ই খুঁজে বেড়ায় পরমনির্ভতার মায়ের কোল বা বাবার দায়িত্ববান হাত। সংসারের প্রয়োজনে যারা নিজেদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ নিজের শিশুটিকে বাসায় রেখে যাচ্ছেন তারা কী ধরণের মাসসিক টানপোড়নে কর্মস্থলে যায় তা ভুক্তভোগী ছাড়া বুঝা বড় দায়। কেউ কেউ ভুগছে নিরাপত্ত্বাহীনতায়। অনলাইন ব্লগে কিছু মায়ের অনুভুতি দেখেছিলাম এরকম; সকালে বাচ্চার কান্না দেখে বের হই, কান্না দেখে ঢুকি। বাচ্চাকে একা শুধু কাজের মেয়ের হাতে ছেড়ে যেয়ে চাকরি করতে ভাল লাগে না অথচ পরিবারের জন্যই তো করছি?- বলছিলেন ঢাকার একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা এক মা কায়সার জাহান। ব্যস্ত নগর জীবনে বাবা-মাকে চাকরি করতে হয় পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে। অথচ পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিশুটি হয়ে পড়ে একা। এই একাকীত্ব কেমন প্রভাব ফেলে শিশুটির মনে? অন্য আরেক মায়ের কথা ছিল এরকম; আমার আট বছরের ছেলেটাকে নিয়ে বড় বিপদে আছি। ইদানীং সারাক্ষণ কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকে। কোন কিছুতেই তার আগ্রহ নেই। আগে কম্পিউটারে গেম-টেম খেলতো, এখন কম্পিউটার ছুঁয়েও দেখে না। আর এটা-ওটা অসুখ-বিসুখ তো লেগেই আছে। মা-বাবাহীন একা বেড়ে উঠা ছেলে-মেয়েরা দিন দিন জেদী হয়ে উঠে। জিনিসপত্র ছুঁড়ে মারে। তার কথা না শুনলেই সে অনবরত মারতে থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব আচরণ হওয়ার প্রধান কারণ হলো চাকরিজীবী মা-বাবার একাকী সšন্তানদের সময় না দেয়ার ফলাফল। মনোবিজ্ঞানীদের মত, অফিস থেকে ফিরে এসে শিশুটিকে বাবা-মায়ের পুরোপুরি সময় দেয়া জরুরি। যদি বাসায় আসার পরও তারা সংসারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তাহলে সেই শিশুটি অবধারিতভাবে মানসিক অবসাদে ভুগবে। যা পরবর্তীকালে তাকে উগ্র করবে। আবার উল্টো চরিত্রের হিসাবে গুটানো স্বভাবের হতে পারে। এতে শিশুটি দুর্বল মানসিকতার মানুষ হিসাবে বেড়ে উঠবে। একটি শিশু তার চারপাশ থেকে জ্ঞান আহরণ করে। সে যখন মাঠে খেলতে যায় বা সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে খেলে বা গল্প করে সেখানে নানা আর্থিক অবস্থানে থাকা পরিবারের শিশুরা আসে। সে সব অবস্থান সম্বন্ধে জানতে পারে। সবাইকে গ্রহণ করতে শেখে। কিন্তু এই একলা থাকা শিশুরা সেইসব পর্যায়ে মেশার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও শিশু মনোবিজ্ঞানী ড. দিলরুবা আফরোজ বললেন, মা-বাবার উচিত হবে অফিস থেকে ফিরে এবং ছুটির দিনে পুরোটা সময় শিশুটিকে দেয়া। যাতে সে বুঝতে পারে যে, মা-বাবা তাকে অবহেলা করছে না। এই সময় দেয়া এমন না যে, একসঙ্গে টিভি দেখা। বরং তার সঙ্গে গল্প করা, খেলা। এতে শিশুর সঙ্গে কথা হয় তার মন হালকা হয়। এছাড়া অফিসে থাকার সময়ও দিনে অন্তত দুইবার শিশুটির সঙ্গে ফোনে কথা বলা। এতে শিশুর মনে ধারণা জন্মায় যে, মা-বাবা বাসায় না থাকলেও তার প্রতি টান আছে। শিশুর মনে এই বোধ জন্মানোটা খুবই জরুরি। ড. দিলরুবা আফরোজ আরো বলেন, যেসব শিশু এগ্রোসিভ হয়ে উঠেছে বা যারা গুটানো স্বভাবের হয়ে পড়েছে তাদের সঙ্গে জোরজবরদস্তি না করে ভালবাসা দিয়ে তাদের এই অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। মারধর বা বকা দিলে তাদের মানসিক অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের স্কুলে বা নগরীর প্রতিটি পাড়ায় সম্ভব হলে প্রতিটি বাসায় খানিকটা করে খেলার জায়গা রাখা। তা না হলে শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হবে। ফলে আমাদের অতি আদরের শিশুরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে বেড়ে উঠবে। তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দেবে। আর শারীরিকভাবে দুর্বল হবার কারণে তার মাঝে যেমন ভীরুতা প্রকাশ পাবে তেমনি কোন কাজে উৎসাহ পাবে না। আজ এই সময়ে আমাদের দেশে প্রশিক্ষিত বেবি-সিটার ও ডে-কেয়ার সেন্টারের খুব প্রয়োজন। বাচ্চাকে কারো কাছে রেখে আসার সমস্যাটি তো একদিনের নয়, প্রতিদিনের। তাই এ সমস্যা সমাধানের জন্য ভুক্তভোগীদেরই পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ব্যাপারে কয়েকজন সহকর্মী একত্রে আলোচনা করে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী বেবি সিটারের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নেয়াও সম্ভব। প্রতিষ্ঠান প্রধানের সাথে আলোচনা করে বিশেষ করে শিল্প-কারখানাগুলোতে কর্মস্থলে ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করার সুবিধাগুলো বুঝিয়ে সমাজে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনা যায়। কর্মস্থলে বা তার আশে-পাশে ডে-কেয়ার সেন্টার থাকলে তাতে সন্তানকে রেখে এসে মায়েরা স্বস্তিতে কাজে মনোযোগ দিতে পারেন। কাজে ফাঁকি দেবার প্রবনতাও হ্রাস পায়। তাতে চাকুরীদাতা প্রতিষ্ঠানের লাভ ছাড়া লোকসান হওয়ার কথা নয়। এ্ই সমস্যা সমাধানে আরো বেশী কার্যকর এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমাধান হতে পারে, সামাজিক ব্যবসা ধারণাটি কাজে লাগিয়ে বেসরকারী উন্নয়ণ সংস্থা, জনকল্যাণকামী উদ্যোক্তা, কোম্পানী, বিভিন্ন হাউজিং/ কলোনী / মহল্লা / এ্যাপার্টমেন্ট পরিচালনা কমিটি গুলো আরো বেশী সূ-সংঘটিতভাবে, ০১-১২ বছরের বয়সী শিশুদের কথা মাথায় রেখে কেন্দ্রের কর্ম-পরিধি আরো বৃদ্ধি করে পুর্ণাঙ্গ শিশু বিকাশ কেন্দ্র গঠনের মাধ্যমে। শুধু ঢাকা কেন্দ্রিক নয় এই ব্যবস্থা শিল্পাঞ্চল কেন্দ্রিক, অফিস পাড়া কেন্দ্রিক, কলোনী কেন্দ্রিক এবং যে সমস্ত এলাকায় কর্মজীবি মা বেশী, তা সার্ভে করার মাধ্যমে একটু বৃহৎ পরিসরে উদ্যোগ নেয়া যায়। অবশ্য এ ব্যাপারে সরকারেরও কিছু প্রনোদনামুলক কর্মসূচী হাতে নেয়া প্রয়োজন। বাণিজ্যিক নয় সামাজিক ব্যবসা ঘোষণা দিয়ে যারা এধরণের উদ্যোগে এগিয়ে আসবেন তাদের সুদমুক্ত ব্যাংক ঋণ, সরকারী পতিত জায়গা বরাদ্দ ইত্যাদি কার্যকর পন্থা অবলম্বন করা যায়। শিশু পরিচর্চা ও বিকাশ কেন্দ্রে দুই শ্রেনীর শিশুর দুই ধরণের ব্যবস্থা রাখা যায়। যারা ০-৪ বয়সী শিশু তাদের জন্য একধরণের আবার স্কুলগামী ০৫-১০ বছর বয়সী শিশুদের জন্য অন্যধরণের ব্যবস্থা থাকবে। স্কুলগামী শিশুদের স্কুল থেকে ফিরে বিনোদনের যেমন ব্যবস্থা থাকবে, তেমনি স্কুলের পাড়া তৈরীর জন্য বৈকালিক পাঠদান ব্যবস্থাও রাখা যায়। এধরণের সেন্টারগুলোতে প্রশিক্ষিত নার্স, ডাক্তার, মনো-কাউন্সিলর, শিশু পালনে প্রশিক্ষিত আয়া, শিশু বান্ধব নিরাপত্তাকর্মী, গাড়ীচালকসহ স্কুলে আনা-নেয়ার নিরাপদ বাহন। বেবি-সিটার ও ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপনের ক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক উদ্যোক্তাদের আত্মসমালোচনা করারও প্রয়োজন রয়েছে। ঢাকার প্রতিটি এলাকায় মহল্লায়, অলি-গলিতে তাকিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি মোড়ে মোড়ে বিউটি পার্লার থাকলেও একটিও ডে-কেয়ার সেন্টার নেই। এত বিউটি পার্লারের ভীড়ে দু-একটা ডে-কেয়ার সেন্টারও স্থাপনা করা যায়। এই বিষয়ে আমাদের উদ্যোক্তাসহ সমাজের নেতৃত্বস্থানীয় লোকজনের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করাও জরুরী। বেবি সিটিং ও ডে কেয়ারের জন্য ভাল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও আমাদের দেশে অপ্রতুল। দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে বেবি-সিটার ও ডে-কেয়ার সেন্টার কিংবা শিশু পরিচর্চা ও বিকাশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হলে কর্মজীবি মায়েদের যেমন ক্যারিয়ার গঠনে সুযোগ সৃষ্টি হবে তেমনি সুস্থ ও সুন্দর আগামী প্রজন্ম বা জাতি গঠনে সহায়ক হবে। দেশে এই সেক্টরে কাজ করার জন্য একদল দক্ষ জনশক্তিও তৈরী হয়ে যাবে, যা দেশের মধ্যে এক বড়ধরণের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের বাইরে উন্নত বিশ্বে কর্ম-সংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে নিশ্চিত। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এই সেক্টরে কাজ করার জন্য আমাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বেবি সিটিং ও ডে কেয়ার সেন্টারের দ্বারা নারীরা নিজেরা যেমন সহজেই কর্মসংস্থানের সুযোগ করে নিতে পারবেন, তেমনি অন্য নারীদেরও সামনে এগিয়ে যাবার পথে অবদান রাখতে পারবেন।

---------------সৈয়দ মামুনূর রশীদ

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.