নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রঙ্গলীলার দর্শক

মোটাসোটা - গোলমুখ - চোখ ছোট একজন মানুষ

toysarwar

লেখার চেষ্টা করি।

toysarwar › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটগল্প - একটি খুনের অভিপ্রায়

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৮:২৪

হারুন সাহেব অস্বস্তি নিয়ে বসে আছেন। তার কাজ শেষ। জিনিষটা ঢুকিয়েছেন বেশ খানিকক্ষন আগে। তার এখন দ্রুত বের হওয়া দরকার। কিন্তু তিনি উঠতে পারছেন না। তাড়াহুড়ো করছেন। গরম চা প্রতিবারে জিহবার বেশ খানিকটা পুড়িয়ে দিচ্ছে। তবুও তিনি কষ্ট করে দ্রুত চা শেষ করতে চাইছেন। জিহবার কোষ পুড়লে আবার গজাবে। চোরাই মালসহ ধরা পড়লে মান-সম্মান সব যাবে। ওটা ফেরৎ আসবে না।



হারুন সাহেব বসে আছেন বেইলী রোডের গ্রাম-বাংলা এ্যান্টিক শপে। বেশ বড় আর বাহারী রং এ সাজানো দোকান। জিনিষপত্রে ঠাসা। নিত্য নতুন জিনিষের যতটা আধিপত্য দোকানটায় , সে তুলনায় পুরানো জিনিষপত্রের সংখ্যা হাতে গোনা। নতুন জিনিষগুলোর নকশায় নতুনত্বের ছোঁয়া আছে। বেচা-বিক্রি ভালই হয়। বাঁধা কিছু খদ্দের আছে এ দোকানের। তারাই প্রতি সপ্তাহে ঘুরে ফিরে আসে। কেনা-কাটা করে। দোকানটা তার বন্ধু ইসতিয়াকের। এ্যান্টিকের আড়ালে অন্য কোন ব্যবসা থাকতে পারে বলে প্রায়ই হারুন সাহেব সন্দেহ করেন । কিন্তু মুখ ফুটে সে কথা বন্ধুকে জিজ্ঞেস করা যায় না। অভদ্রতা। হারুন সাহেবের মনে সন্দেহটা উদ্রেক হবার পেছনের বড় কারন তার শখ। ডিটেকটিভ নভেল।



হারুন-অর-রশিদ ইংরেজীর লেকচারার। সিটি কলেজের ইংরেজী বিভাগে যোগ দিয়েছেন আজ বছর তিনেক । খুবই সৌখিন মানুষ। সেই ছাত্রাবস্থা থেকে গ্রীষ্ম-বর্ষা, শরৎ-হেমন্ত, শীত-বসন্ত বাছাই করে জামা কিনেন। ম্যাচ করে পোষাক পড়েন। কোমরের বেল্ট থেকে মানিব্যাগ , এমনকি শেভিং রেজারটা পর্যন্ত হাজার দোকান খুঁজে কিনবেন। প্রতিটা জিনিষে নতুনত্ব থাকতে হবে। তার ব্যবহার করা ডিজাইনগুলো যখন বাজারে আসতে শুরু করে তখন তিনি ব্যবহৃত জিনিষ পাল্টাতে শুরু করেন। অন্য ডিজাইনের দিকে নজর দেন। এমনি করতে করতে একদিন গ্রাম-বাংলা এ্যান্টিক শপে তার আগমন হয়। বছর দুয়েক ধরে প্রতিদিন একবার ঢুঁ মারেন। মগবাজার থেকে হেঁটে বেইলীরোড আসতে তার ঘড়ি ধরে চব্বিশ মিনিট সময় দরকার। আসতে-যেতে আটচল্লিশ মিনিট। বৈকালিক হাঁটাও হয়, সে সাথে নতুন জিনিসের খোঁজও নেয়া হয়। আসা-যাওয়ার ভেতরেই দোকানের মালিক ইসতিয়াক আহমেদের সাথে তার পরিচয়। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। আজকাল সে বন্ধুত্ব বৈকালিক চা চক্রে গড়িয়েছে। সেই চা-টুকুই কোন রকমে এখন গিলছেন হারুন সাহেব। চোরাই জিনিষ নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সটকে পড়া যায় তত উত্তম। তার জিনিষটা তিনি লুকিয়েছেন প্যান্টের তলায়। মাঝে মাঝে ওটি তার গোপন অঙ্গে হালকা পরশ দিচ্ছে। যতই ঢাকা থাকুন না কেন গোপন অঙ্গে ছুরির খাপের ধাক্কাধাক্কি ভাল লাগার কথা না।



ছুরিটা তিনি কিনতে পারতেন। কেনার যথেষ্ট টাকা তার পকেটে আছে। দিনে চার ব্যাচ ছাত্র-ছাত্রী পড়ান। মানুষ যেভাবে বাদামের আবরন হালকা বাতাসে উড়িয়ে দেয় হারুন সাহেব সেভাবে টাকা উড়ান। তাহলে চুরি করাটা কি তার রোগ? না। রোগ না। এখানেও সেই ডিটেকটিভ উপন্যাসের ছায়া আছে। হারুন সাহেব অজ¯্র গোয়েন্দা কাহিনী পড়েছেন ,পড়েন এবং পড়বেন। উপন্যাসের বর্ণিত অপরাধী এবং গোয়েন্দা উভয়ের চিন্তা-ভাবনাগুলো তার মাথায় অনবরত ঘুরপাক খায়। সম্প্রতি তিনি একটা অপরাধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অপরাধটা করবেন অপরাধীর মত কিন্তু নিজেকে বাঁচানো জন্য গত সাতদিন ধরে চিন্তাভাবনা করছেন পুলিশের মত। অপরাধটা গুরুতর। একটা খুন। খুন জিনিষটা ছুরি দিয়ে না হলে তাতে কোন আভিজাত্য তিনি খুঁজে পান না। তাই তার অস্ত্র হবে ছুরি। তার বাসায় অনেকগুলো শৌখিন ধারালো ছুরি আছে। কিন্তু নিজের ব্যবহৃত জিনিষ খুনে ব্যবহার করা যায় না। আবার খুনের জন্য তিনি ছুরিও কিনতে চান না। কারন ধরা পড়তে পারেন। পাঁচদিন আগে এ দোকানটায় লম্বা লম্বা ধারালো ছুরিগুলো দেখেই ঠিক করেছেন ওমন একটা ছুরি তিনি সরিয়ে ফেলবেন। ছুরিগুলো তেমন আহামারী কিছু না। বাজারের প্রায় দোকানেই খাপ বসানো এ ছুরি পাওয়া যায়। গতকাল একবার একটা সরানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেন নাই। আজ দোকানের ছেলেটা চা আনতে গেলে চট করে টি-শার্টের একটা কোনা উপরে তুলে ছুরিটাকে খাপসহ প্যান্টের ভেতর চালান করে দেন। তাড়াহুড়োয় ছুরির মাথাটা আন্ডারওয়ারের ভেতর চলে যায়। একটু পর পর ছুরির খাপ বসানো মাথাটা তার অন্ডকোষ স্পর্শ করছে আর তিনি একটু পর পর চমকে উঠেছেন।



দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর কাপের চা শেষ হয়। তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়েও উঠলেন না। যদি ইসতিয়াক সাহেব কিছু সন্দেহ করেন এ ভয়ে। ভয়ের অবশ্য কোন কারন ছিল না। এর চেয়েও তাড়াহুড়ো করে অনেকবার তিনি বের হয়েছেন। ইসতিয়াক সাহেব এ জন্য মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে বলেন, আপনার ভেতর নোয়াখালীর স্বভাব আছে। খাওয়ার সাথে সাথেই কি বিদেয় নিতে হবে? কথাগুলো শুনে অন্যদিন হারুন সাহেব ভেজা হাসি দিয়ে বের হয়ে যেতেন। আজ বাড়তি সতর্ক থাকায় চা শেষ হবার মিনিট দশেক পর একটু কুঁজো হয়ে বের হলেন। বের হবার সময় আশংকা ছিল যদি কোনভাবে ছুরিটা প্যান্টের পা গলিয়ে নিচে পড়ে যায় তাহলে কি হবে। এ সন্দেহটাও ছিল অমূলক। অন্যদিনের মত তিনি আজ আর হাঁটবেন না। রিকশা নিলেন। তার আগে একটা মোটাসোটা মাসিক ম্যাগাজিন কিনে নিয়েছেন। রিকশায় বসে খানিকটা কসরত করে ছুরিটা বের করে ম্যাগাজিনের ভেতর ওটা গলিয়ে দিলেন।



বাসায় এসে পত্রিকাসহ ছুরিটা টেবিলের উপর রেখে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতলটা বের করে ঢকঢক করে পুরো বোতলটা খালি করলেন। শরীর দুর্বল লাগছে। হাতটা একটু একটু কাঁপছে। অপরাধ পড়া আর করা যে কত পার্থক্য তা নিয়ে টের পেতে শুরু করেছেন। কিন্তু খুনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন না। চুলোয় ভাত তুলে দিয়ে খাপ থেকে ছুরির ফলাটা বের করে হালকা আঙ্গুল ছোয়ানো মাত্রই আঙ্গুলের চামড়াটা একটু কেটে গেল। তাড়াতাড়ি পানি দিয়ে ওটা ধুয়ে ফেললেন। কাপড় দিয়ে মুছে মুছে আঙ্গুলের ছাপ সরিয়ে ফেললেন। তার আগে হাতে গ্লাভস পরে নিয়েছেন।

হারুন সাহেব একা মানুষ না। তার স্ত্রী আছে। নাম রুবি। সুন্দরী। তারই কলেজে এক সময় বাংলায় মাস্টার্স পড়ত। পড়ত না বলে বলা ভাল এখনও পড়ছে। তবে ক্লাশ করে না এখন আর। আগ থেকেই পরিচিত মুখ। সং¯কৃতমনা। কলেজের সকল অনুষ্ঠানে তাকে ছাড়া অনুষ্ঠান হত না। বছরখানেক আগে মেয়েটিকে দেখে তার মনে ধরে। খোঁজ খবর নেন। পরিষ্কার রেকর্ড। প্রেম-পরিনয়ের কোন রেকর্ড নাই। না কলেজে, না মহল্লায়। মুরব্বী পাঠিয়ে সরাসরি বিবাহের প্রস্তাব। হারুন সাহেব দেখতে সুদর্শন, স্মার্ট আর রুচিশীল। বংশ মধ্যবিত্ত সমাজের জন্য চলনসই। বিবাহ হয়ে যায়। স্ত্রী এতদিন তার সাথেই ছিল। সন্তান-সম্ভাবনা হওয়ায় শ্বশুড়বাড়িতে আছে এখন। যতদিন স্ত্রী বাসায় ছিল ততদিন পুরো বাসাটা গমগম করত। ওমুক অনুষ্ঠান, তমুক অনুষ্ঠানের রিহার্সেল লেগেই থাকত। রুবির বন্ধু-বান্ধবরা আসত নিয়মিত। হারুন সাহেব নিজেকে অনেক উদার ভাবতেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল তিনি এতটা উদারমনা নন। স্ত্রীর বন্ধু-বান্ধবের অবাধ আগমন তিনি পছন্দ করতে পারলেন না। কিন্তু তা প্রকাশ না করে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতেন আর তাদের সাথে হেসে হেসে কথা বলতেন। এর মধ্যে একটি ছেলের নাম শুভ। হারুন সাহেব আজ রাতে সে ছেলেটিকেই খুন করবেন।



ছেলেটির দোষ অনেক। সবচেয়ে বড় দোষ এ ছেলেটির সাথে রুবির ঘনিষ্ঠতা বেশী। প্রায়ই ছেলেটি রাত-বিরাতে রুবিকে মেসেজ পাঠায়। রুবি সে ক্ষুদে বার্তা আবার তাকে পড়ে শোনায়। হাসাহাসি করে। মেসেজগুলোর কোনটিই বন্ধুতের সীমানা পেরিয়ে যায় না। কিন্তু হারুন সাহেবের মনে সন্দেহের বীজ ঢুকতে থাকে। সন্দেহ নিয়ে পড়াশোনাটা যে কখন তার অভ্যাসে পরিনত হয়েছে তা তিনি টের পান নাই। নিজের অজান্তেই ছেলেটিকে তিনি প্রতিপক্ষ হিসেবে ভাবতে শুরু করেন। সে ভাবনার ডাল-পালা মেলতে থাকে। খুনের সিদ্ধান্তটা চূড়ান্ত করেছেন সাতদিন আগে। তার আগে সন্দেহটা চরমে উঠে যেদিন তিনি তার আসন্ন পিতা হবার খবর রুবির মুখে না শুনে কলেজের করিডোরে শুভর মুখে শুনতে পান। স্যারের কাছে মিষ্টি খেতে চেয়ে শুভ যে তার মৃত্যুকে ঢেকে এনেছে এতে তার এখন কোন সন্দেহ নাই। রুবির কাছে ঘটনার ব্যাখা চান তিনি সে রাতে। তবে কি শুভ তোমার সন্তানের পিতা যে তাকে আগে এ খবর দিতে হবে?



রুবি সেদিন নিশ্চিত হয় তার বর তাকে সন্দেহ করে। আগেই সে অনুমান করেছিল । কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে ঝাঁঝিয়ে উঠে সে। বেশ উত্তপ্ত কথার পর উত্তরটা দেয় সে। সন্দেহের কারন নাই। শুভর মামী বড় গাইনোকলজিস্ট। তাকে দেখিয়েছিলাম। শুভই নিয়ে গিয়েছিল মামীর কাছে। তোমাকে তো দুদিন বললাম। তোমার সময় কই?



কথা সত্য। রুবি দু’দিন ডাক্তার ডাক্তার করেছিল। তিনি সময় দিতে পারেন নাই। কিন্তু সন্দেহ যুক্তিকে অন্ধ করে দেয়। আর বুক সেলফ ভর্তি ইংরেজী- বাংলা রহস্য উপন্যাস তাকে বারবার উসকানী দেয়। সেদিন রাগের মাথায় বলে ফেলেছিলেন, ওকে আমি খুন করব।



সাতদিন আগে রুবির কথা মত রওয়ানা হয়েছিলেন ডাঃ রওনকের চেম্বারে। কি সব রিপোর্ট ওখান থেকে সংগ্রহ করে সিলেট পাঠাতে হবে। রুবিদের বাড়ি সিলেটে। ও এখন সিলেট জিন্দাবাজারের বাসায়। বাসা থেকে বের হয়ে সিএনজিতে বসেছেন মাত্র, তখনি ফোন আসে রুবির। বলে, তোমাকে কষ্ট করে যেতে হবে না। শুভ পাঠিয়ে দিয়েছে।

কথাটা শোনার পর মাথায় রক্ত উঠে যায় তার। কিন্তু খুব শান্ত থাকেন। কোন প্রতিক্রিয়া দেখান না। সিঁড়ি বেয়ে যখন খালি বাসায় উঠতে থাকেন তখন ঠিক করেন এই ছেলেকে দুনিয়া থেকে সরাতে হবে। এ বেঁচে থাকলে সন্দেহ আর অবিশ্বাস তার দাম্পত্যজীবনকে ধ্বংস করবে। ভাড়ায় খুনী পাওয়া যায়। কিন্তু শেষমেষ তা ফাঁস হয়ে যায়। বরং পঠিত সব উপন্যাসে অপেশাদার খুনীদের ধরতেই কষ্টটা বেশী।



সেই খুনটা করার জন্য খাপসহ ছুরিটা কাঁধের ব্যাগে নিয়ে হারুন সাহেব এখন মগবাজার রেলক্রসিং থেকে রেললাইন ধরে হেঁটে হেঁটে এফডিসি গেটের দিকে হাঁটছেন। শুভ একটা খবরের কাগজে পার্ট-টাইম কাজ করে। প্রতিদিন রাত এগারোটা করে এ রেললাইন দিয়ে হেঁটে আসে সে। তথ্যটা রুবী তাকে দিয়েছে। তিনি নিজেও গত ছয়দিন ধরে শুভকে অনুসরন করে দেখেছেন ও এ রাস্তাতেই একটা সময় অনুসারে মগবাজারের দিকে আসে। শুভর সাথে দুদিন আগে নিজে হেঁটে এসেছেন। এফডিসি গেট ও মগবাজার গেটের মাঝামাঝি একটা জায়গায় একটা গলি ঢুকে গেছে দুটো পুরানো দালানকে দুপাশে নিয়ে। গলিটায় শুভ প্রতিদিন একবার ঢুঁ মারে। গলির মাথায় একটা টং দোকান। খুব ভাল চা বানায়। তবে শুভ যায় গাঁজার খোঁজে। সে নিয়মিত গঞ্জিকা সেবন করে। সেদিন অবশ্য হারুন স্যারকে সে চায়ের স্বাদ দিতেই নিয়ে গিয়েছিল । গাঁজার ব্যাপারটাও তিনি কায়দা করে রুবির মুখ থেকে জেনেছেন। গলিটার অপরপাশে রেললাইনে ওধারে একটা বড় ছাদিম গাছ। ওতে জমাট অন্ধকার। হারুন সাহেব গতকাল দাঁড়িয়ে খেয়াল করেছেন ওখানে কাউকে তেমন একটা অন্ধকারে চেনা যায় না।

হারুন সাহেব একটা সিগারেট খেতে খেতে স্লিপার মাড়িয়ে সামনে এগুচ্ছেন। খুন করার জন্য আজকের পরিবেশটা ভাল। লোডশেডিং চলছে। আকাশে চাঁদ- তারা কিছুই নাই। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকায়। বেশ জোরে বাতাস বইছে অনেকক্ষন ধরে। রেললাইন জনমানবহীন। একটু আগে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। আবারও বৃষ্টি আসতে পারে। ছাতিম গাছের নিচে এসে ব্যাগের ভেতর ছরিটার ফলা আর খাপ আলাদা করতে করতে তিনি ভাবছেন শুভর গলার শিরাগুলোর ঠিক কোন কোন জায়গাটা কেটে দেবেন। সপ্তাহখানেক ধরে তিনি ধমনী কেটে খুনের সবগুলো কৌশল নিয়মিত পড়েছেন। কোথায় কোথায় কাটবেন তা ঠিক করেছেন। এমনকি দু’দিন আগে গলির ও মাথার দোকানটায় চা খাবার সময় পোকা তাড়াবার নাম করে ধমনী-শিরাগুলো ছুঁয়েও দেখেছেন। কাঁধের ছোট ব্যাগে ছুরিটার সাথে একটা কালো মুখোশও ভাঁজ করা আছে। এমন দিনে শুভ আজ আসবে তো?



হারুন সাহেব সিগারেটের গোড়ায় শেষ টান দিয়ে ওটা ফেলতে গিয়ে হতাশায় মনটা ভরে উঠল। ঠিক তখুনি আকাশে বিদ্যুৎ চমকেছে। ক্ষনিকের সে আলোয় তিনি দেখলেন শুভ এগিয়ে আসছে গলির ভেতর থেকে। আজ ও তাড়াতাড়ি এসে গলিতে ঢুকে পড়েছে। তিনি চেয়েছিলেন গলিতে ঢোকার পর পেছন থেকে এগিয়ে ছুরির কাজটা সারবেন। আজ মনে হয় আর করা গেল না। ছেলেটা একটু টলছে মনে হল তার। গাঁজাটা কি বেশীই টানল নাকি?



পরের বিদ্যুৎতের আলোয় যা দেখা গেল তাকে ইংরেজী বিভাগের উদীয়মান শিক্ষক হারুন-অর-রশিদের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ছেলেটার পেটে লম্বা একটা ছুরি আটকানো। একটানা রক্ত ঝড়ছে। শুভর মুখ সাদা হয়ে এসেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। গলা দিয়ে কোন আওয়াজ আসছে না। কেবল চোখ দুটো বের হয়ে আসতে চাইছে।



হারুন সাহেব লাফ দিয়ে সামনে এগুলেন। টান দিয়ে ছুরিটা বের করে নিলেন । শুভর পেট চেপে ধরে রক্তটা বন্ধ করেত চাইলেন। মানুষটাকে বাঁচাতে হবে। হাতে রক্তের গরম ছোঁয়া লাগতেই হারুন সাহেবের চেতনা ফিরে এল। এ কি করছেন তিনি ? তিনি তো খুন করতে এসেছেন। উনাকে এখন কিছুই করতে হবে না। কেবল ছেলেটার পেট থেকে এভাবে রক্ত বের হলেই তার কাজ হয়ে যায়। তিনি হাতটা সরিয়ে নিলেন। রক্ত তীব্রবেগে বের হতে লাগল। বিদ্যুৎ চমকাল আবার। বিদ্যুৎতের আলোয় শুভ তাকে চিনে ফেলেছে। তার স্যার কেন হাতটা সরিয়ে নিল তা শুভ বুঝতে পারছে না।



হারুন সাহেবের এক মূহুর্তের ভুলের জন্য ঠিক সে সময় শুভর মৃত্যু এল না। হাতটা পুরোপুরি সরিয়ে নেবার আগেই দুজন গাঁজাখোর কোথা থেকে যেন এসে উদয় হয়েছে গলির ভেতর । হারুন সাহেব আবার তার হাতটা শুভর পেটের উপর চেপে ধরলেন। রক্তের গতি কমে। তিনজনে টেনে শুভকে মগবাজার রেলক্রসিং এ এনে সিএনজিতে উঠায়। সিএনজি ছুটল মেডিকেলের দিকে। মগবাজারেই ক্লিনিক ছিল। কিন্তু নিজ অভিজ্ঞতা থেকে হারুন সাহেব জানেন এ সব কেস মেডিকেলেই শেষ পর্যন্ত ঝোলাঝুলি করে। সারাটা রাস্তায় অনেক কষ্টে তিনি তার হাত সামলেছেন। ব্যাগ থেকে ছুরিটা বের করে দুটো পোচ দিতে হাতটা নিশপিশ করছিল।



হাত ধুয়ে হারুন সাহেব এখন জরুরী বিভাগের বাইরে যে রুটি-কলার দোকান আছে তার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছেন। তার মেজাজটা অসম্ভব খারাপ। জামা ভরে আছে ছেলেটার রক্তে। এটা তিনি কি করলেন?



হারুন সাহেবের আর না থাকলেও চলে। ছেলেটার পেটটা সেলাই হয়েছে। রক্ত ম্যানেজ হয়েছে। পনের-বিশ মিনিট পর ফজরের আযান হবে। তিনি বাসায় চলে যেতে পারেন। কিন্তু তিনি অপেক্ষা করছেন। ছেলেটাকে যদি একবার একা পাওয়া যায় সে আশায়।



মানুষ হয়ে যে কাজটা তিনি করেছেন, অমানুষ হয়ে অসমাপ্ত কাজটা শেষ না করা পর্যন্ত তার স্বস্তি নাই।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৯:০৭

খেয়া ঘাট বলেছেন: Starting is very good,in the middle of the story got thrilled but the ending just simply finished. Overall better. Sorry for english text..logged in frm mobile.

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৯:২৭

toysarwar বলেছেন: সময় নিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। গল্প লেখায় তেমন কোন হাত নাই। তবে চেষ্টা করি।

২| ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ১০:২৮

আরজু পনি বলেছেন:

আপনার আগের অনেকগুলো লেখা! যদি স্মৃতি বেইমানী না করে.....

আমি কিন্তু পড়েছি।

অনেকদিন পর লিখলেন।...হ্যাঁ, শেষটা আরো ভালো করা আপনার পক্ষে সম্ভব। তবে অমানুষ আর মানুষ -এর তফাৎটা ভালো লেগেছ।

৩০ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ১১:৩০

toysarwar বলেছেন: আমাদের সবার ভেতরেই একটা মানুষ থাকে। আমরা না চাইলেও সেটা মাঝে মাঝে বের হয়ে আসে। তার জন্য কেউ আপষোস করে আবার কেউ করে গর্ব। ধন্যবাদ ভাই আপনার মন্তব্যের জন্য ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.