![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সারাদিনের অফিস শেষে বাসায় ঢুকে পোষাকের বাবুগিরি ব্যাপারটা ঠিক মেনে চলা যায় না। বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত পুরুষ তার একান্ত আপন সময়ে লুঙ্গি-গেঞ্জিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সেদিনও এ নিয়মেই কেবল লুঙ্গিতে ভর করে ড্রইং রুমের সোফায় আধাশোয়া অবস্থায় খেলা দেখছিলাম। মানুষটা বসার ঘরে ঢুকে আমাকে ও অবস্থাতেই দেখতে পায়। উঠে গিয়ে কাপড় পাল্টে আসাটাই হত ভদ্রতা। কিন্তু মানুষটার দিকে একবার নজর ঘুরিয়ে সে ভদ্রতাটুকু আর করা হল না। মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মযার্দার উপর কেবল দর্শনপ্রার্থীর পোষাকই নির্ভর করে না। দর্শনদাতার পোষাকও নির্ভর করে। যে মানুষটিকে আমি-আপনি কখন স্যুট,বুট ছাড়া কল্পনাও করতে পারি না , সমাজের নিচু স্তরের মানুষের সামনে তিনি অনায়াসেই উদোম শরীরে দর্শন প্রদান করতে কুন্ঠিত হন না।
না। এ মানুষটি উদোম শরীরে আসে নাই। তার পরনে লালের উপর একটা নাম না জানা ফুলের সাদা ছাপ দেয়া হাফ হাতা শার্ট। নিচে প্যান্ট। পায়ে স্যান্ডাল। হাতে মিষ্টির প্যাকেট। মানুষটার বয়স হয়েছে। গোফ গুলো পেকে সাদা। চুলগুলোয় সাদা-কালোর ছাপ। চোখের চারপাশের চামড়া যেভাবে কুঁচকে থাকে তাতে বোঝা যায় মানুষটার অনেকটা সময় রোদের ভেতর কাটে। হাতের তালুর দিকে নজর গেলে দেখবেন ও দুটোর এখানে সেখানে চামড়া উঠে গেছে। যদি হাত মেলান তাহলে বোঝা যাবে বেশ খসখসে আর শক্ত। লক্ষন থেকে অনুমান করা যায় এ হাত, কর্মঠ হাত। মুখের হাসিটায় অতিরিক্ত আন্তরিকতা । এ ধরনের হাসির সাথে যারা পরিচিত তারা হাসিটা দেখলেই বুঝবেন এ হাসিটা নিশ্চয় কোন কার্যদ্ধোরে এসেছে। আমার বড় চাচা একজন সরকার দলীয় পরিচিত মুখ। বড় চাচার কাছে সারাদিনই এমন হাসির ছেলে-বুড়োর আগমন চলতেই থাকে। চাচা এ হাসিটা ভালই চেনেন। মিষ্টির প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে বললেন , এটার আবার কি দরকার ছিল?
লোকটার হাসিটা বিস্তৃত হয়ে পুরো মুখে ছড়িয়ে পড়ে। বলে, হে। হে। আপনি আমার জন্য যা করেছেন তা তো মিষ্টি দিয়ে শোধ হয় না। আপনারে একটু মিষ্টি খাওয়াতে পারলে শান্তি পামু।
মোড়ের খাজা ভাতঘরের মিষ্টি। অন্তত প্যাকেট তাই বলে। এমন মিষ্টি নিয়ে আসা মানুষ সাধারনত আমাদের বৈঠকখানায় প্রবেশাধিকার পায় না। দরজাতেই কথা শেষ করে বিদেয় নেয়। তবে সময়টা এখন ভিন্ন। সামনেই করপোরেশনের নির্বাচন। বড় চাচা আবার নির্বাচন করবেন। আবার কমিশনার হবেন। জন্ম-মৃত্যু সনদ, নাগরিকত্ব সনদ স্বাক্ষর করার বর্তমান কাজটা বজায় রাখবেন। রাজনীতিকের প্রতি কথায়, কাজে ভোট বাড়ে, কমে। মানুষকে খুশি করতে বেশী কিছু লাগে না। তার বর্তমান সামাজিক মর্যাদার থেকে একটু বেশী দিলেই চলে। সামান্য বেশী এ প্রাপ্যটুকু জন্য সে চাচাকে স্মরন করবে বার বার। বলবে, মানুষটা বড় ভাল। নিজের চাচাকে নিয়ে খারাপ কথা বলা যায় না। তাই বললাম না। অনুমান করতে পারি ভোটের চিন্তার কারনেই তিনি দরজার অতিথিকে এমনভাবে টেনে ড্রইং রুমে নিয়ে আসলেন যেন মনে হয় কতদিনের আপনজন। সামনে কমিশনার ইলেকশনটা না থাকলে নিঘার্ত দরজাতেই লোকটাকে বিদেয় নিতে হত।
ড্রইং রুমে সরাসরি মানুষটাকে আনায় আমি একটু বিব্রত। মানুষটা পরিচিত। সেই ন্যাংটো কাল থেকেই মানুষটাকে মাঝে মাঝে রাস্তায় দেখি। তার যৌবনকাল , বৃদ্ধকালের চেহারা আমার পরিচিত। কিন্তু তারপরও আমি বিব্রত হই। হাজার হোক বাইরের মানুষ। কেবল লুঙ্গি পড়ে বসে থাকাটা অস্বস্তিকর। আধ শোয়া থেকে উঠে বসলেও উপরের উদোম শরীরের অংশটুকু ঢাকবার চেষ্টার কোন গরজ কেন যানি মনে মনে অনুভব করলাম না। আপনারা ধারনা করে নিন কারনটা সামাজিক ব্যবধান। মানুষটা যে অফিসে গার্ডের চাকুরি করে সে অফিসের বস হিসেবে কিছুদিন আগেই বসেছে আমারই বন্ধু তানভীর। দু’চারবার আমার ওর খালি চায়ের পেয়ালা এ মাজেদই পরিষ্কার করেছে। এমন মানুষের সম্মানে আবার জামা পড়বার দরকার কি? যেমন ছিলাম তেমন অবস্থাতেই চুপচাপ টিভি দেখতে থাকি। মানুষটা বসে প্রথমে হাসি মুখে আমার দিকে তাকায়। হাসিটা আমি অনুভব করতে পারি কিন্তু তার দিকে নজর দিতে পারি না। হঠাৎ করেই টিভির পর্দা যেন চোখ দুটোকে আটকে ফেলেছে। এক দৃষ্টিতে টিভি দেখতে থাকি। টিভির পর্দায় আমার অখন্ড মনযোগ দেখে মানুষটার হাসিমুখ আস্তে আস্তে নিভে আসে। ধারনা করতে পারি নরম সোফাটায় বসে থাকতে এক সময় মাজেদ মিয়ার বড্ড কষ্টই হতে থাকে।
তাকে বেশীক্ষন কষ্টটা দিলেন না বড় চাচা। এসে বসলেন। অন্যদিন এমন সময় আমি উঠে যাই। কিন্তু আজ উঠতে ইচ্ছা করছে না। পাকিস্তান - ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা দেখাচ্ছে। ধারনকৃত খেলা। ফলাফল জানা তবু দেখা চাই। চাচা একবার আমার দিকে তাকিয়ে মানুষটার সাথে আলাপ জুড়ে দিলেন। কি খবর মাজেদ? ছেলের খবর কি?
আছে আপনার দোয়ায় ভাল। আগামীকাল চাকুরিতে জয়েন দিব। কিন্তু একটা সমস্যা হইছে ভাই।
রাজনীতিবিদদের সাথে দেখা করার এই একটা সুবিধা। যে বয়সের আর পদেরই হোন না কেন তিনি সবার ভাই। তিনি আমীরের যেমন ভাই, তেমনি ভাই মিসকিনের। চাচা জিজ্ঞেস করেন, কি সমস্যা?
ছেলেটারে তো পোস্টিং দিছে সেই ঈশ্বরদী। একটু আইনা দেন না এ পাড়ে।
চাচা একটু হেসে নড়েচড়ে বসে। ও। এই ব্যাপার। আগে তো জয়েন করুক। তারপর দেখা যাবে।
ভাই। সরকাররে নিয়ম তো বুঝি। একবার যদি জয়েন করে ওইখানে তখন আইতে বহুত কষ্ট। আপনে একটু কইয়া দেন না! আকুতি ঝরে পড়ে যেন মানুষটার গলা থেকে।
আরে তোমার ছেলে তো এখনও জয়েনই করে নাই। জয়েন না করলে কি সে সরকারের লোক যে ট্রান্সফার করতে বলব? আগে করুক। বেতন উঠিয়ে চাকুরিটা পাকাপোক্ত হোক। তারপর না হয় দেখা যাবে।
মানুষটা চুপ করে থাকে। আমি খেলা দেখি। ইমরানের ঐতিহাসিক খেলা। চাচা উঠে যায়। মাজেদ মিয়ার ঘরটা আমাদের চার বিল্ডিং পর। জায়গার মালিক সুলতাম সাহেব। জায়গাটা নিয়ে ভাইদের সাথে তার সমস্যা আছে। তাই উঁচু ভবন উঠাতে পারছেন না। টিনশেড ঘর তুলে ভাড়া দিয়েছেন। ওগুলোর একটাতেই মাজেদের বসবাস। তিন মেয়ে । এক ছেলে। ছেলেটার নাম সুজন। ছেলেটা আমার বয়সী। ছোটবেলায় এক সাথে ফুটবল খেলেছি। কৌতহূল জাগাটা তাই স্বাভাবিক। জিজ্ঞেস করি, কোথায় চাকুরি পেল সুজন?
জ্বি হাসপাতালে। উপজেলা হাসপাতাল। এটেনড্যান্ট।
ও। ভাল তো।
আপনার চাচার কাছে টাকা দিছিলাম বলেই তো চাকুরিটা পেল। নয়ত এটাও জুটত না।
কত?
সাড়ে তিন লাখ।
আর কোন কথা খুঁজে না পেয়ে চুপ করে থাকি। সুজনটা অপদার্থই রয়ে গেল। একটা চাকুরিও নিজে জোটাতে পারল না। এর ভেতর কাজের মানুষটা চা আর মিষ্টি নিয়ে আসে । মাজেদ মিয়ার মিষ্টি। মাজেদ মিয়াকে সোফায় বসিয়ে আপ্যায়ন -এতটা আমিও আশা করি নাই। রাজনীতি বড়ই আজব জিনিষ। মানুষকে ফেরেশতা বানায় আবার বানায় ইবলিশ। নীরবে চা খাওয়া হয়। মিষ্টির স্বাদটা মন্দ লাগে না। বিদেয় বেলায় আবার ট্রান্সফারের জন্য অনুনয় বিনয় হয়। চাচা আবার বলেন, হবে। হবে। আগে তো জয়েন করুক। এত ব্যস্ত হবার কি আছে?
ছেলেটারে বিয়া দিমু। নাতি-নাতনীর মুখ দেখমু- মজিদ মিয়া বলে আর হাসে।
দরজা বন্ধ করতে করতে চাচা আমাকে বলে, দেখছস অবস্থা। পোলার এখনও আয় রোজগার নাই , মাত্র চাকুরি পাইল আর এর ভেতরই নাতি-নাতনী! এই শালারা গরীব থাকব না তো আমরা থাকমু?
আমি হাসি। চাচা চলে যায়। চাচা কথাটা মন্দ বলে নাই। আমি চাকুরি করি আজ প্রায় দু’বছর। বিবাহ করার সাহস পাই নাই। যে বেতন পাই তাতে নিজেরই চলে না, বিয়ে করে বউকে খাওয়াব কি! আবার ছেলে-মেয়ে? ছেলেপুলে মানুষ করার একটা প্রস্তুতি আছে না! সে কি চাট্টিখানি কথা!
বছর পাঁচেক পরের কথা। ছেলেটা আমার এবারই প্রথম ঈদগাহ গেল তার দাদুর হাত ধরে। নাতি নিয়ে ঈদগাহ যেতে বাবার কি যে উৎসাহ। ছেলের সংসারের সাথে বাবা-মায়ের খুঁনসুটি থাকলেও নাতির ব্যাপারটা পুরোটাই ভিন্ন। স্নেহ আসলেই নিম্মগামী।
ঈদগাহে দেখা মাজেদ মিয়ার সাথে। প্রতিবারই দেখা হয়। খেয়াল করি না তেমন। এবার চোখটা আটকে গেল। মাজেদ মিয়ার হাত ধরে নাতি হাঁটাহাঁটি করে। জানলাম ওর নাম ইসমাইল। সুজনের ছেলে। বয়স চার বছর। আরও জানলাম এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মত দাদুর সাথে ঈদগাহে এসেছে। মাজেদ মিয়ার চোখ মুখ থেকে এক ধরনের প্রশান্তির ঢেউ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সে ঢেউয়ের আঘাতেই মনে হয় আমার চোখে তার মুখটা হঠাৎ করেই ঝাপসা হয়ে আসে। ঝাপসা দৃষ্টির চোখটা আটকে যায় আরেকটা মানুষের উপর। কোলে ছোট একটা মানুষ। ছোট মানুষটা আমার ছেলে। বড় মানুষটা বাবা। আমার বাবা। সম্পর্কে তারা দাদু - নাতি। এ দাদুর চোখ মুখ থেকেও এক ধরনের প্রশান্তির ঢেউ যেন ছড়িয়ে যায় চারদিকে।
আমাদের এত ভিন্নতার ভেতরও চাওয়া-পাওয়ায় কত মিল কেন?
০৬ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৮:৩১
toysarwar বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে।
২| ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৮:৩৮
বিনম্র বলেছেন: আপনার বর্ণনা বেশ ভাল। গল্পটি ভাল লেগেছে। লক্ষনীয় ব্যাপার হল উল্টা পাল্টা পোষ্টে হিট আর কমেন্টের ছড়াছড়ি হলেও এধরনের পোষ্টে ব্যাপার গুলো কম হয়।
০৬ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৮:৫১
toysarwar বলেছেন: ধন্যবাদ। আপনার মূল্যবান সময় খরচ করে পড়েছেন সেটাই আমার প্রাপ্তি।
৩| ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৩ দুপুর ২:৫৯
সমুদ্র কন্যা বলেছেন: মুগ্ধ হলাম গল্পটা পড়ে। উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ যাই থাকুক, পিতা-মাতার স্নেহ সবার জন্য একই।
০৭ ই অক্টোবর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:১২
toysarwar বলেছেন: ধন্যবাদ সাগর কন্যা।
৪| ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১২:৩৮
প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: গল্পটা ভালো লেগেছে। সুন্দর লিখেছেন।
শুভেচ্ছা।
০৮ ই অক্টোবর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:০৫
toysarwar বলেছেন: ধন্যবাদ। এটি পোস্ট করার সময় মনটা বড় খচখচ করছিল। আপনার ভালো লাগায় তার খচখচানিটা একটু কমল।
৫| ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১২:৫৯
শাহরিয়ার রিয়াদ বলেছেন:
জীবনে আমরাই বিভেদ গড়ে দিই কিছু অপ্রয়োজনীয় শর্ত দিয়ে।
জীবন আসলেই সুন্দর। চাওয়া পাওয়া গুলো নির্মোহ হলেই হয়।
০৮ ই অক্টোবর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:০৬
toysarwar বলেছেন: আপনার কথাগুলো নাড়া দিল । । । শুভ কামনা রইল।
©somewhere in net ltd.
১|
০৬ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৮:২৫
মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্ বলেছেন: ভাল লাগলো আপনার লেখা!