নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য

তোমার দখিনা হাওয়া

আমি অতি সাধারণ মানুষ ভালোবাসি মানুষকে

তোমার দখিনা হাওয়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

পোস্ট মাষ্টার

১২ ই ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ৯:৪৪


স্থান গুনারীতলা বাজার। আশির দশকে মানুষের মনের ভাব আদান প্রদানের একমাত্র যে অবলম্বনটি ছিলো তা কেবলি এই পোষ্ট অফিস। আমি তখন খুব ছোট। বড় ভাই সবে মাত্র মেট্রিক পাশ করে সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে যোগদান করেছে। মাকে দেখতাম প্রায়ই আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে কখনও জোর স্বরে আবার কখনও ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে। মায়ের কান্না দেখে যেন আমিও ঠিক থাকতে পারতাম না। আমিও হাউমাউ করে কেঁদে দিতাম। মায়ের কান্নার অর্থ তখন বুঝতাম না। কিন্তু এখন বুঝি।

মা আমার কান্না দেখে খুব সযত্নে বোকে জড়িয়ে নিতেন। নিজের চোখ দু’টো মুছে যেন একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাসির ভান করে বলতেন খোকা, তুই কাঁদিস ক্যান। আমারতো কিছু হয়নি। আমি যেন আরও কান্নার বেগটা বাড়িয়ে দিতাম। মা তখন শত কষ্টের অন্তরালে মুচকি হাসি হেসে আমাকে শান্তনা দিয়ে বলতো আয় তোকে ঘুম পাড়ানি চাঁদ মামার ছড়া শুনাই।

প্রতিদিন পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকতো মা। আমিও মায়ের আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। পরিচিত লোক পেলেই দেখতাম মাকে জিজ্ঞেস করতে ছোট হলে নাম ধরে বড় হলে সন্মোধন করে বলতেন পোষ্ট অফিসে গেছিলা।

কেউ বলতো হ্যা, কেউ বলতো না। এমনি প্রতিদিন। তখন পোষ্ট মাস্টার ছিলেন আমাদের উত্তর পাড়া মুন্সিবাড়ির হযরত আলী মাষ্টার। সম্পর্কে আমার দাদা। আমাদের বাড়ি থেকে কোয়াটার কিলো হবে দক্ষিন দিকে।

একদিন মা আমাকে নিয়ে পোষ্ট মাষ্টার দাদার বাড়িতে গেলো। আমাকে পাশে রেখে অনেকক্ষণ সুখ দুঃখের আলাপচারিতা করলো। সময় প্রায় ঘন্টা খানেক হবে এর মধ্যেই মাকে দেখলাম কয়েকবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আর যতক্ষণ কথা বললো সব কথাই শুধু অনুনয় আর বিনয়ের সহিত বললো।

তখন বুঝিনি এতো কেনো অনুনয় বিনয় কিন্ত এখন বুঝি। একজন মায়ের হৃদয় সন্তানের জন্য কতটা মমতার হতে পারে তা না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবেনা। মাঝে মধ্যে মা কেঁদে ফেললে দাদা দেখতাম সান্ত্বনার সুরে বলে উঠতেন কেঁদোনা বউমা আর কেদোনা। ধৈর্য ধারণ করো। কান্না না থামলে বলে উঠতেন দাদা, দেখি কাল ওকে আমি একটা শক্ত চিঠি লিখবো। কেন এতো দেরিতে চিঠি পাঠায় আমি তা জানতে চাইবো।

এবার মা’কে দেখতাম খুব খুশি হয়ে কাপড়ের আঁচলটাতে দাত লাগাতে। গিট্টূ দিয়ে রাখা কিছু টাকাকড়ি সিকি কিংবা আধুলি যাই হবে দাদার হাতে গুজে দিয়ে বলতো মা, রেজিস্ট্রী করে পাঠাবেন কাকা মশাই।

তারঃপর আমি যখন কিছু কিছু বুঝতে শিখলাম। মা তখন আমাকে প্রায়ই দাদার কাছে পাঠাতে শুরু করলেন। কখনও বাড়িতে কখনও পোষ্ট অফিসে যেখানেই থাকতেন দাদা আমি পাশে হাজির হতেই মুচকি একটা হাসি দিতেন। কি অপূর্ব হাসি মাখা মুখ তার, হাসলেই যেন সুন্দর মুখখানা লাল হয়ে উঠতো আর মুক্তোর দানার মত সাদা দাত গুলি ঝিকঝিক করে উঠতো। মুখ ভরা পাঁকা দাঁড়ি ছিলো বেশ লম্বাও না আবার খুব খাটোওনা। সাদা রঙ দাদার খুব প্রিয় ছিলো। সব সময় দেখতাম ইস্রী করা সাদা পাজামা আর পাঞ্জাবী পরিধান করতেন। দাদা যখন হাসতেন তার মিষ্টিমাখা হাসির সহিত যেনো পরিধানের সাদা জামা গুলোও হাসতো।

যা হোক যদি চিঠি থাকতো তবে হাসির পাশাপাশি দুই একটা রসিক কথাও বেরিয়ে আসতো দাদার মুখ থেকে। আর চিঠি না থাকলে সোজা বলে দিতেন, দাদা কোন খবর যে নাই। আমি অল্পতেই বুঝে নিতাম এবং ফের দৌড়াতে দৌড়াতে মায়ের কাছে ছোটে আসতাম। আমার শুন্য হাত খানা দেখার পর মা’য়ের ততক্ষণে বুঝে নিতে আর বাকি থাকতোনা যে, আজও ছেলের চিঠি আসে নাই।

দিন চলছে তার নিয়মে। কত প্রিয় মুখ অন্ন অভাবে আপনজন ছেড়ে ছুটছে দেশ থেকে দেশান্তরে কাজের সন্ধানে। আর ঘরে থাকা আপন প্রাণ গুলো রাত দিন আহাজারি করছে রোদনে। কেউ থেমে থেমে কাঁদে আবার কেউ কাঁদে অহর্নিশ। সরলা বধু, মমতাময়ী মা আর আদরের ছোট ভাই বোন গুলোর চোখ যেন রক্ত কমলে রঞ্জিত থাকে।

নিয়তির উপর ভর করেই দিন কাটায় মানুষ গুলো। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। কোন খবর হয়ত কারো আসে আবার বছর পেরোলেও কারো কোন খবরই আসেনা। কেউ কেউ ধরেই নেয় জংগলের বাঘ হয়তো খেয়ে ফেলেছে। পাল তোলা নৌকা গুলো প্রতিনিয়ত আসতো। দুর থেকে নৌকার পাল দেখলেই প্রতীক্ষায় থাকা মেয়ে মানুষ গুলোর হৃদয় ছটফট করতো। আল্লাহ এই নৌকায় তুমি যদি আমার বাচাধনরে আনতে। যখন দেখতো পাড়ে আর নৌকা ভিড়লোনা।

কেউ চীৎকার দিয়ে বলে উঠতো, ও মাঝি তুমি কি আমার আদরের খোকাটার খবর জানো! কেউ বলতো ও মাঝি ভাই আমার মাঝির খবর কিছু জানো? আবার কেউ চোখের জল আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে ঘরে ফিরে যেতো।

সেকালে ছিলনা তথ্য প্রযুক্তির মেলা। ছিলোনা বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানি। তথ্য আদান প্রদানের হাতিয়ার তো কেবল ঐ একটি গোলাকার লাল রঙের বাক্সটাই। যার পকেট ভরতো হাজারো কথার ব্যঞ্জনা দিয়ে। কত আর্তনাদের কথামালা, কত চোখের জলরাশিতে ভেজা পত্র যার হিসেব মেলা ভার।

দাদাকে একদিন দেখলাম ভীষণ মন খারাপ। যে দাদা আমাকে দেখলেই একটা হাসি দিয়ে ভীতু মনটাকে আমার সাহসে পরিপাটি করে দিতো সে সুন্দর মুখটাতে আজ কোন হাসি নেই। আমি ভয়ে সেদিন দাদার কাছে গেলাম না। দাদা একবার চোখ তুলে আমাকে দেখলেন ফের মাথাটা নীচ করে বেশক্ষণ চুপচাপ রইলেন। আমিও নিস্তুপ পাথরের মত দাঁড়িয়েই রইলাম।

এবার একজন ভদ্রলোক এলেন। উচা লম্বা দেখতেও সেরকম। উনার দিকে তাকাতেই ভয়ে জড়ষড় হয়ে যাচ্ছিলাম। দাদা বিষয়টি খেয়াল করলেন এবং বললেন ক্যারে ছেড়া যাস নাই এখনো?

দাদার কথা শুনে ভদ্রলোক দাদাকেই জিজ্ঞেস করলেন, ক্যাড়া এই ছেলে? দাদা বললেন, আরে আপনাদের নাতিকে আপনারাই যদি না চিনেন তো কেমনে হয়। আমাদের কাশেমের ছেলে সব ছোটটা। ওর মা না আপনার ভাগনী। কি জানি তোর মায়ের নাম? আমার কাছে জানতে চায় আমি বলার আগেই ভদ্রলোক এবার চিনলেন বললেন ও আচ্ছা, সুমতনের ছেলে? বলেই কাছে ডাকলেন আয় আয় এদিকে আয়।ভয় পাস ক্যান আমি তোর নানা। ভয়ে ভয়েই কাছে গেলাম।পকেট থেকে পয়সা বের করে বললেন, নে চকলেট কিনে খাবি। আর তোর মাকে বলবি আমি দিয়েছি পয়সা। তোর নানা ভাই, আমার নাম আব্দুল কাদের সরকার।

তারঃপর আমি পয়সাটা নিয়ে আগের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম।নানাকে দেখলাম,পোষ্টমাস্টার দাদাকে শান্তনা দিয়ে বলছেন, কি আর করবেন মাষ্টার সাব ছেলের হয়তো হায়াত নেই। নইলে এই জোয়ান বয়সে, আল্লাহর ভালোই ভালো। নিয়তির উপর তো আর কারো হাত নেই। বুঝলাম দাদার আপনজন কেউ হয়তো মারা গেছে।

পরে জেনেছি মার কাছ থেকে দাদার ছোট ছেলে রতন কাকার মৃত্যুর খবর। কাকার বিয়েও নাকি ঠিক হয়েছিলো আজ বাদে কাল বিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে রোগ ধরা না পড়লে ময়মনসিংহ চরপরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করে। যতক্ষণে চরপরা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ততক্ষণে তিনি আর বেঁচে নেই। জেনেছি তিনি মারাত্মক জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

এমন জন্ডিস যে সহজে ধরা পড়ে নাই। তারঃপর বেশ দিন কেটে গেলো। আমিও বেশ চঞ্চলতায় পা দিয়েছি। এখন কিছু কিছু রসিকতাও দাদার সাথে মাঝে মধ্যেই করি।

বাড়িতে গেলে দাদীর সাথে বেশ মজা করে আসি। হঠাৎ একদিন শুনি দাদা হার্টএটাক করে মারা গেছেন। কথাটা শুনার পর আমার মাথার উপর যেন আসমান ভেংগে পড়ে। আমি সত্যিই দিশেহারা অবস্থায় ছুটে যাই দাদার বাড়িতে। সাথে বন্ধুরাও ছিলো! রাজ্জাক, আলিফ, (প্রয়াত) ওয়াহাব, (প্রয়াত) বিপ্লব সরকার ও সাজু। বন্ধুদের চোখেও পানি টপটপ করে ঝরছে।

দেখলাম উঠানে একটা কাঠের চারপায়ার উপর উত্তর দিকে মুখ করে দাদাকে শুয়ায়ে রেখেছেন। অনেক লোকের ভীড় সেখানে। বাড়ির ভীতর থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। উপস্থিত সকলের চোখ মুখে কান্নার ছাপ। একজন লোক কাফনের কাপড়টা খোলে দাদার মুখটাকে দেখিয়ে যাচ্ছে।

আমি মুখটা দেখা মাত্রই চীৎকার দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। সাথে সাথে বন্ধুরাও কেঁদে উঠলো। তারঃপর আর কি! যে যায় সে যে আর ফিরে আসেনা শুধু রেখে যায় স্মৃতি আর স্মৃতিময় মুহূর্তগুলো।

একসময় জানাজা হলো অসংখ্য লোকের উপস্থিতিতে। সমাধীস্থল করা হলো। পরিশেষে দোয়া মোনাজাত করে চোখের পানি মুছতে মুছতে সকলেই যার যার নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরে গেলো। ফিরে আসলাম আমিও চোখের পানি মুছতে মুছতে।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২১ সকাল ১০:০৬

ইসিয়াক বলেছেন:



বেশ ভালো লেখেন আপনি।
সামুতে আপনার পথচলা দীর্ঘ হোক।
শুভকামনা রইলো।

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২১ সকাল ১১:২০

তোমার দখিনা হাওয়া বলেছেন: অফুরন্ত শুভকামনা ভাই

২| ০১ লা আগস্ট, ২০২২ বিকাল ৫:০৯

তোমার দখিনা হাওয়া বলেছেন: অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.