![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আশরাফ মাহমুদ। তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে বিয়ে করেননি। তাহার নাকি কোন মেয়েই পছন্দ নয়। তাই পরিবারের পক্ষ থেকে এখন আর বিয়ের ব্যাপারে কোন আলাপ চারিতা নেই।
কিন্তু বেশ দিন যাবৎ লোক মুখে শুনা যায় চেয়ারম্যান নাকি রোজ মনটু পাইনেতির ঘরে যাওয়া আসা করেন। মনটু পাইনেতি পান বিক্রিই যার একমাত্র অবলম্বন। হতদরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। চেয়ারম্যানের সমসাময়িক। দুজনে প্রাইমারী স্কুলে একই সাথে পড়েছে।
যে বছর মনটু প্রাইমারী স্কুল ত্যাগ করে সে বছরই তার বাবা জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। হতদরিদ্র বাপের একমাত্র সন্তান মনটু উপায় আন্তা না দেখে লেখাপড়া ত্যাগ করে বাবার পেশায় মনোনিবেশ করে।
মনটু মিয়া দিনে দিনে ব্যাপারী হয়ে উঠে। একদিকে বাবার মৃত্যুতে আরেকদিকে তরুণ বয়স দুই মিলেই খুব অল্প সময়ে ব্যবসায় লাভবান হইতে থাকে।
মনটু মিয়া অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের। তার নম্রতা ভদ্রতা দেখে গুনয়া বাজারের বড় ব্যবসায়ী হিন্দু বাবু নারায়ণ মনটু মিয়াকে খুব মহব্বত করে। মাঝে মধ্যে টাকা পয়সা দিয়েও সাহায্য করে। এমনি করে দেখতে দেখতে মন্টু একদিন সাবালক হয়ে উঠে। তখন বাবু নারায়ণ তার বন্ধু আবেদ দফাদারের নাতি বিলকিস বেওয়ার সহিত মনটু মিয়ার বিয়ে দিয়ে দেয়।
বিলকিস বেওয়া দেখতে অপরুপ সুন্দরী। রুপের কি বর্ণনা দিবো। কল্পনার রাজ্যেও এরুপ সৌন্দর্যের খোঁজ মিলা ভার। বিয়ের পরদিনই খুব খুশি মনে মনটু মিয়া বাবু নারায়ণ এর কছে যায়। মনটু মিয়া্র মুখে হাসিখুশি দেখেই বাবু নারায়ণের যে আশংকা ছিল তা দূর হয়। বাবু তার অন্দর ঘরে মন্কেটু মিয়াকে ডেকে নিয়ে বসায়। বেশক্ষণ গল্পগুজব করে।
মনটু মিয়া বাবুকে বলে, বাবু এতো সুন্দর বউ দিলে আমি নিতান্তই খুব খুশি। কিন্তু বড ভয় হয় যাহা তুমি দিলে তাহা সারা জীবন আটকিয়ে রাখার ক্ষমতা যেন আমার থাকে সে আশীর্বাদ টুকুই করিও। বাবু মাথায় হাত বুলিয়ে মুচকি মুচকি হাসি হেসে আশীর্বাদ করে।
মন্টু মিয়া ফের বলে,ঘরতো আছে বাবু কিন্ত ঘরের চারদিকের বেড়া গুলো যে ভাংগা। কিছু টাকা হলে তা সেরে নিতে পারতাম। নইলে নতুন বউ এর কি দশা হইবে। বাবু বলে, ভয় কিরে মনটু আমি আছিনা। বলেই তৎক্ষণাৎ বাবু সিন্দুকের চাবিটা হাতে নেয় এবং বেশ কিছু টাকা মন্টু মিয়ার হাতে গুজে দেয়। মনটু পর দিনই নতুন টিন দিয়ে বেড়ার কাজ সম্পন্ন করে।
এমন রূপবতী বউ পেয়ে মনটু মিয়া যেন আনন্দে মাতোয়ারা। নতুন বউ তবু তোয়াক্কা না করেই সকলের সামনে গিয়ে বউ এর সাথে খুশগল্প করে। বউ লজ্জায় মুখ আঁচল দিয়ে ঢাকে।
দিন যেতে থাকে মন্টু মিয়ার সংসার জীবন ভালই কাটতে থাকে। একে একে তিন সন্তানের পিতা হয় মনটু। পরপর দুইটা মেয়ে সন্তানের পর যখন একটা ছেলে সন্তানের মুখ দেখে তখনও যেন স্ত্রী বিলকিস বেওয়ার রুপ সোনালী আলোয় ঝলমল করতে থাকে। শাড়ির অন্তর ভেদ করে যেন রুপ মায়াময়ী আলোয় আলোকিত হয় দেহজোড়ে। আলোকিত হয় মনটু মিয়ার মাটির আংগিনা মাটির ঘর।
ঐদিকে আশরাফ মাহমুদ বাবার মৃত্যুর পর এই প্রথম বারের মত ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদন্দিতা করে অনেক ভোটের ব্যবধানে জয় লাভ করে। নতুন চেয়ারম্যান হয়েছে। সকলের দাবী আনন্দ উৎসব করবে। উৎসবের দিন তারিখ ঠিক করা হয়। অনেক লোকের সমাগমন চলে। সেদিন মনটু মিয়াও স্ত্রী বিলকিস বেওয়াকে বেশ সুন্দররুপে সাজিয়ে নিয়ে চেয়ারম্যানের সামনে হাজির হয়।
একেতো রুপের ঝলকানী তার উপর সাজগোজ এমন রুপের ঝলক দেখে চেয়ারম্যান হতবাক হয়। বিলকিস বেওয়ার আপাদমস্তক বেশ কয়েকবার অবলোকন করে। ভাবে, গোবরে পদ্মফুল ফুটেছে। কার মাঝে কিসের অবস্থান। কোথায় মনটু মিয়া আর কোথায় বিলকিস বেওয়ার মত অপরুপ এক সুন্দরী নারী।
এতো রুপের ঝলকানী যেন নিমিষেই চেয়ারম্যান এর মন কেড়ে নেয়। সেদিন নিজ হাতে বেশ আপ্যায়নও করায়ে দেয় চেয়ারম্যান। মনে মনে বিলকিস বেওয়াকে পছন্দ করে ফেলে। বিলকিস বেওয়াও যেন তাহা অনুধাবন করতে পারলো।
কথায় বলেনা-নারীর মন আকাশের রঙ ক্ষণে ক্ষণে হয় পরিবর্তন। বিলকিস বেওয়ার মনেও যেন মৃদু মৃদু লোভনীয় হাওয়া দুল খেতে থাকলো। চেয়ারম্যানের নজর কাড়া সেকি ভাগ্যের গো! আপন মনের রাজ্যে বিলকিস বেওয়া স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে।
যখন চেয়ারম্যান এর সন্মুখ থেকে বিলকিস বেওয়া চলে আসবে বলে মনস্থির করলো ঠিক তখন যে মায়াবী চাহনীতে বিলকিস বেওয়া দিয়েছিল চেয়ারম্যানের দিকে সেই চাতকী চাহনীই যেন পরে চেয়ারম্যানের জীবনে মস্তবড় কাল হয়ে দাড়াইয়া ছিলো।
সেদিন অনেক ব্যস্ততার কারণে চেয়ারম্যানের কোথাও আর যাওয়া হলো না। কিন্তু মনের আংগিনায় চেয়ারম্যান এর অন্তর চোখে বিলকিস বেওয়া র লাবণ্যময় রুপের ঝলকানী বারবার ঝলক বাতির মত ঝিলিক দিতে থাকে।
হায়রে বিচিত্র মন! হায়রে বিচিত্র জগত! হায়রে বিচিত্র সংসার! সেদিন দেখেছিলাম সুখের ঘরে কিভাবে জলন্ত আগুনের স্তুপ বাসা বাঁধে। কিভাবে নিমিষেই তছনছ হয় সাজানো একটি সংসার। কস্মিতকালেও যে মানুষটি ভাবেনি জীবনের উত্থান পতনের কথা আর অকৎস্যাত কালবৈশাখীর ঝড় এসে তছনছ করে দিয়ে যায় সাজানো বাগান।
সেদিনের পর থেকে রোজ সকাল বিকেল চেয়ারম্যান বিলকিস বেওয়ার কাছে আসে যায়। বিলকিস বেওয়াও দিনে দিনে স্বামী সন্তানের প্রতি বিরুপ আচরণ করতে শুরু করে। বড় মেয়েটি তখন সবই বুঝতে শিখেছে। বাবা মনটু মিয়া সারাদিন বাহিরে থাকে রাতে বাড়ি ফিরার পর মেয়ে বাবাকে সব বলে দেয়। বাবা কিছু বলতে গেলে বিলকিস বেওয়া যে বিভিশিখাময় উত্তর দেয় তাতে মনটু মিয়ার গলা কাঁটা যাওয়ার উপক্রম সে তা বুঝতে পারে তাই মুখ বুঝে সব সহ্য করে চলে।
অল্পদিনেই পাড়া মহল্লায় কথাটি ছড়িয়ে পড়ে। একদিন চেয়ারম্যানের বড় ভাই আবতাব মাহমুদ প্রতিবাদী হলে তাকেও অপমান অপদস্ত হতে হয়
ছোট ভাইয়ের কাছে। এক কথায় চেয়ারম্যান এখন বিলকিস বেওয়ার প্রেমে দিশেহারা, মাতাল, অন্ধ। বিলকিস বেওয়াকে যে তার চাইই চাই।
যে কিনা সমাজের শীর্ষমনি। যার দ্বারা কিনা সমাজের অপকর্ম দূর হবে আর সেই যদি হয়ে উঠে অপকর্মের হোতা সেখানে কে হবে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। প্রেম ভালবাসা তো অপকর্ম নয়। অপকর্ম সময়ের, অপকর্ম পরিস্থিতির। যে প্রেম যে ভালবাসার সহিত জড়িয়ে রয়েছে কতকটি নিস্পাপ প্রাণ তার কি হবে। প্রতিনিয়ত মেয়েকে নিয়ে মন্টু মিয়া স্ত্রীকে বুঝায়। কান্নারত চোখে অনুনয় বিনয় করে কিন্তু বিলিকিস বেওয়ার যেন তাতে কোন ভ্রক্ষেই নেই।
হায়রে বিধাতা! হায়রে জগত পিতা! একি পাষন্ড খেলা তুমি খেলো। যদি এমন খেলাই তুমি খেলবে তবে তিন তিনটা জীবনকে তাতে জড়ালে কেনো। কে নিস্পাপ শিশু গুলোকেে মায়ের মমতা দেবে। কে তুলে দেবে একমুঠো অন্ন। আর কি হবে তিনটা জীবনের পরিসমাপ্তি। কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ওরা কোথায় দাঁড়াবে মন্টু মিয়া। এখন পরিস্থিতি এতোটাই নাজুক যে, কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচতে পারছেনা। তাদের চোখে যেন কোন লাজ সরম এখন আর কিছুই নেই। না চেয়ারম্যানের না বিলকিস বেওয়ার চোখে। ভালবাসায় তারা এখন দুজনেই অন্ধ!
সেদিনের পর থেকে মনটু মিয়া যেদিন বুঝতে পেরেছিলো বিলকিস বেওয়া আর চেয়ারম্যানের প্রেমের গভিরতা সেদিন থেকেই সমাজের গণ্যমান্য বহু লোকের কাছে গিয়েছে অনুনয় বিনয়ে কেঁদেছে কিন্ত কেউ তার ডাকে সাড়া দেয়নি। কেউ এতটুকু শান্তনার বাণীও শুনায়নি যে বিন্দুমাত্র কষ্ট কিঞ্চিৎ সময়ের জন্য হলেও লাঘব হবে। বরং তার বোকে লুকিয়ে থাকা আগুনের তীব্রতা বহু গুনে বাড়িয়ে দিয়েছে।কেউ বলেছে ছিঃ ছিঃ এমন বউ কে নিয়ে এখনও ঘর করছিস? কেউ বলেছে তালাক দিচ্ছিস্ কেন? আবার কেউ বলছে বিষ খেয়ে মরতে পারিসনা। কত কবিরাজ, কত শত হুজুর কত পানি পড়া এটা সেটা কত কি যে কিছুতেই বিলিকিস বেওয়ার মন গলেনি।
তারর একদিন গভীর রজনীতে বিলকিস বেওয়া সকলের চোখকে ফাকি দিয়ে তিন তিনটা সন্তানের জীবনকে বলি দিয়ে মনটু মিয়ার জীবনে তিমির অন্ধকারে ছেয়ে চেয়ারম্যানের হাত ধরে পালিয়ে গেলো। আর এদিকে মুখ থুবড়ে মেজেতে পড়ে রইলো ক্রন্দনরত চোখে অসহায় তিন তিনটা শিশু। কি পাষন্ড হৃদয়ের মা।
পৃথিবীতে এমনও মা হয়, যে কিনা নিজ হাতে সন্তানকে গলা টিপে হত্যা করতে পারে। এ যে তার চেয়েও কঠিন, নির্মম বাস্তবতা। কে শুনে তিন তিনটা হৃদয়ের করুণ কান্নার আকুতি। কে দেখবে মনটু মিয়ার চোখের অগ্নিঝরা জল।
সেদিন সমাজ সকল কতইনা তিরস্কার করেছিলো। কতইনা থুথু ছিটিয়েছিলো ঊর্ধ্বাকাশে চেয়ে। যে পারলো যত, কাটা ঘায়ে নুন ছিটাইয়া গেলো। এমনই পরিস্থিতি হইলো যে, মনসুরের জীবন মরনের প্রশ্ন হইয়া দাড়াইলো। কাউকে ছাড়া কি কেউ বাঁচেনা? বাঁচে নিয়তির অপার মহিমায় বেঁচে থাকে ঠিকই। কিন্তু দাগ থেকে থায়। যে দাগ কষ্টের, যে দাগ চিরায়ত অভিশপ্তের।
তিন তিনটা সন্তানের মুখপানে যেন মনটু মিয়া চোখ তোলে তাকাইতে পারেনা। হৃদয় বিদারক কষ্টে দু হাত তোলে কায়মনোবাক্যে প্রতিনিয়তই প্রভুর কাছে প্রার্থনায় রত থাকে। হে প্রভু! তুমি এর বিচার করো! যে আমার সুখের সংসারে দুঃখের আগুন দাও দাও করে জ্বালিয়ে দিলো তুমি তার বক্ষ্যে তূষের অনল জ্বালিয়ে দিও। আমি যেন দেখতে পাই।
সুখ আমি চাইনি এতোটা যতটা তুমি দিয়েছিলে। একসময় ভেবেছিলাম আমিই বুঝি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখি। আর আজ, আমার মত দুঃখি প্রভু কেউ নেই! অসহায় সন্তানের মুখ পানে চাহিলে আমার যে কি যন্ত্রণা হয় তা তুমি ছাড়া যে কেউ বুঝবেনা প্রভু।
মনটু মিয়া যখন কষ্টে কষ্টে নীরব যন্ত্রণা ভুগতে ভুগতে মরণাপন্ন অবস্থা খবর পেয়ে বাবু নারায়ণ ব্যবসার কাজে তখন কলকাতা ছিলেন তিনি চলে আসেন। এসেই মনটু মিয়ার বাড়িতে যান। বাবুকে জড়িয়ে ধরে মনসুর অনেক কাঁদে, হাউমাউ করে কাঁদে। কান্নায় কাতর হয়ে তিন ছেলেমেয়েও বাবুকে জড়িয়ে ধরে। বাবু সাধ্যমতো শান্তনা দিয়ে শান্ত করে।
শুধু শান্তনাই নয়, সেদিনের পর থেকে বাবুর স্নেহ মায়া মমতার অরশ বুলিয়ে মনটু মিয়া ও তার ছেলে মেয়ের মনের কষ্ট কালিমা যেন দিনে দিনে লাঘব করতে থাকেে। দিনে দিনে পরিবারের মাঝে যেন সাচ্ছন্দতা ফিরে আসে। ছেলেমেয়ে গুলো যেন আর খুব একটা মায়ের কথা ভেবে বেশি কষ্ট পায়না, কান্নাইয় ভেংগে পরেনা। কেউ জিজ্ঞেস করলে যেন প্রতিউত্তর দিয়ে বলে আমার মা মরে গেছে।
বাস্তবতা যেন এখন মনটু মিয়া বুঝতে শিখেছে।ছেলেমেয়ে গুলোর কথা ভেবে বাবু নারায়ণ মনসুরের একদিন মনটু মিয়ার বিয়ে ঠিক করে। ঘরে আসে সৎ মা। দিনে দিনে সৎ মা ই যেন আসল মা হয়ে উঠে। বিধাতার অশেষ মহিমায় সেই সংসার ফের সাচ্ছন্দে ভরে উঠে।
©somewhere in net ltd.