![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
চারিদিকে মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ। বিশেষ কাজে রণাঙ্গন থেকে বাড়ি ফিরেছে ক্লান্ত হাশেম গাজী। বড়ই ক্ষুধার্ত সে। ভাতের ক্ষুধার কথাটই বলি মনের ক্ষুধা সে নাইবা বলি। বিয়ের বয়স তার ছয় মাস আর যুদ্ধে অবস্থান তিন মাস তের দিন।
যুদ্ধে যাওয়ার পর এই প্রথম দেখা স্ত্রী সখিনার সাথে। হাশেম গাজী যুদ্ধের দাবানল চালিয়ে যতটা না রোগাক্রান্ত সখিনা যেন তার চেয়েও বেশি। যেন মুখপানে তার তাকানোই যায় না। আর যাবেই বা কি করে যে চোখ সহস্র লাশের প্রত্যেক্ষ স্বাক্ষী। বাবার ঝুলন্ত লাশ,মায়ের ছিন্নছরা দেহ, শশুর শাশুড়ী আপনজন সকলের এক এক জনের এক এক রকম রহস্যময় মৃত্যু নিজের চরিত্রে হায়নাদের আঁচড়ের কালো দাগ,এত সব কিছুর পর কি করে সখিনার প্রাণে স্বস্থি থাকে, কি করে মুখেতে হাসি থাকে।
বয়সটাও যে তার খুব বেশি নয়। চৌদ্দ কি পনের হবে। যৌবনের দ্বারপ্রান্তে আসতে না আসতেই শুরু হলো জীবন সংগ্রাম।মৃত্যুর দাবানলে স্বীকার হল এক এক করে আপন জন প্রতিবেশী সকলেই । নিজেকে দফায় দফায় সমর্পিত করতে হল পাক কমান্ডারের কাছে। এখন তার বেঁচে থাকার কারণ একটাই,যুবতী আর সুন্দরী নারী বলে কমান্ডারের নজরে পড়েছে। এ পর্যন্ত তার অস্তিত্ব জুড়ে কত শত কলঙ্কের দাগ যে লেপন হয়েছে তার হিসেব মেলা ভার।
মাঝে মধ্যে ভেবেছে এ জীবনটা একেবারেই শেষ করে দিবে। কিন্তু হাশেম গাজীর কথা ভেবে, বিয়ের পর যে মানুষটাকে মন ভরে দেখতেও পারলোনা, প্রাণখোলে যার সহিত কথাও বলা হলো না তাকে আরেকটা নজর দেখার তীব্র বাসনা সখিনার মনে। দূর থেকে তাকিয়ে হলেওস্বামী হাশেম গাজীকে দেখার পর খোদা যেন তার মৃত্যু দেয় সেই নির্মম প্রত্যাশা টুকু লালন করেই সখিনা বেঁচে আছে। নয়তো নিজেকে সে কবেই শেষ করে দিতো।
অথচ আজ সেই হাশেম গাজীইতো এসেছে যার প্রতিক্ষায় প্রহর গুনেছে সখিনা অহর্নিশি যার মুখদর্শন প্রত্যয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে এতো দিন শত যন্ত্রণা সহ্যের পরও সেই হাশেম গাজী ঘরের দোয়ারে নয় একেবারে মনের দোয়ারে, বাড়ির আঙ্গিনায় নয় একান্ত মনের আঙ্গিনায়। এতদিন পর স্বামী হাশেম গাজী এসেছে জেনেও সখিনা কেন স্থবির। ঘোমটা দিয়ে মুখ খানা কেনো ঢেকে রেখেছে অমন করে। মাথাটা একেবেরেই নত কেনো। সুন্দর মুখখানি তার যেন বৈশাখের কালোমেঘে ছেয়ে গেছে।মনে হয় যেন কি এক অপরাধে সে আজ কাঠগড়ায় দন্ডায়মান ফেরারি আসামির মত।
হাশেম গাজী বারান্দায় থেকে উঠানে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। পেটের ক্ষুধা যেন বরফে পরিনত হয়। বউ সখিনার নতশীর আর নীরবতা তাকে পাগলা কুত্তার মত কামড়াতে থাকে। যে সখিনার চঞ্চলতায় সেদিন হাশেম গাজী অস্থির হয়ে পড়েছিলো আর আজ সেই সখিনা এতো নীরব কেনো। এতোটাই নীরব যে নীরবতা যেনো বারবার বিষাক্ত ছুবলের ন্যায় হাসেম গাজীকে দংশন করতেছিলো।হাজারো প্রশ্ন করেও কোন জবাব পায়না হাশেম গাজী। বাবা কোথায়, মা কোথায়, দাদা দাদি, চাচা চাচী ভাই বোন আত্মীয় স্বজন ওরা কে কোথায় আছে আদৌ বেঁচে আছে না সব ঐ হায়নাদের হাতে খুন হয়েছে সে খবর নেওয়াতো দূরে থাক সখিনাকে ঘিরেই হাশেম গাজীর প্রাণ যেন যায় যায়। তবু সখিনা কোন কথাই বলছেনা শুধু মুখেতে আঁচল দিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে আর কাঁদছে।
প্রশ্ন চলে প্রশ্নের নিয়মে নীরবতা যেন গহীন থেকে গহীনতর হয়। সরলা সখিনা স্তব্ধ হয়ে যায় নিমিষেই। কোথায় এতোটা দিনের স্বপ্নের মানুষটারে ভালবেসে বোকে জড়ায়ে নিবে তা না যেন ঘৃণায় নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে বারবার। ঘৃণা! সত্যিই ঘৃণা আর লজ্জায় সরলা সখিনা লজ্জাবতি লতার ন্যায় আজ নুয়ে পড়েছে। মন্থর পৃথিবীতে সত্যিই নিজেকে বড় অপরাধী মনে করছে সে। যে মনে বাতাবি লেবুর ঘ্রাণ এতোটা সযতনে লালন করে রেখেছিলো সে ঘ্রাণ যেন পচে মজে দুর্গন্ধে রুপ নিয়েছে আজ। হাশেম গাজী বিড়ি টানে একের পর এক টেনেই যাচ্ছে। মা নেই বাবা নেই কেউ নেই। যাদের মুখে হাসি ফোটাবে বলে নিজেকে করেছে সমর্পণ, গিয়েছে যুদ্ধে। ঘরে অবলা স্ত্রী রেখে নিজেকে দাড় করেছে রণক্ষেত্রে। আর সে রণবীরের স্ত্রী আজ কিনা বীরঙ্গনা, বীরঙ্গনা সখিনা।
“ওরে ও মুক্তি সেনা জবাব দেনা অশ্রু হাসে
কোথা মোর মা জননী জন্মভুমি সর্বগ্রাসে”
চোখের পানি তো আর পানি নেই, চোখ যেন রক্তের লাল আভায় পরিনত হয়েছে। আগুনের স্ফুলিঙ্গ যেন জমাট বেঁধেছে তাতে। নীরবতা, নীরবতা, নীরবতা এভাবে আর নীরব থাকিসনারে বউ কথা কহ, কি হয়েছে বল, সব খুলে বল, আমাকে বাঁচতে দেরে বউ, আমাকে বাঁচতে দে..… .কান্নায় কাতর হয়ে পড়ে হাশেম গাজী।
একবার কাছে গিয়ে হাশেম গাজী সখিনার হাত দুটি ধরে সব জানতে চেষ্টা করে কিন্তু সখিনা নিজেকে সরিয়ে নেয়। স্বামী! ওগো দোহায় আপনার আমাকে স্পর্শ করবেন না, আমাকে ছুঁবেন না। আমি কলঙ্কিনী, আমি হতভাগিনী আমি বীরোঙ্গনা সখিনা। আমি আপনার রেখে যাওয়া সম্পদকে রক্ষা করতে পারিনি স্বামী। শুধু একটি বার আপনাকে দেখে মরতে চেয়েছি বলে বিধাতা সে কথা রেখেছেন। আজ আর আমার কোন আশা নেই, কোন সাধ নেই, স্বপ্ন নেই, নেই কোন আহল্লাদ। আজ আর আমার কোন চাওয়া পাওয়াও নেই স্বামী। আমাকে আপনি অনুনয় বিনয় করে অপরাধী করবেন না। আমি আপনার দু’টি পায়ে পড়ি আমাকে যত পারেন প্রহার করেন, রক্তাক্ত করেন, আমায় গলা টিপ মেরে ফেলেন তবু..। কাঁদতে কাঁদতে সখিনা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। পৃথিবীটা যেন নির্বাক। নির্বাক যেন হয় পৃথিবীর সব মানূষ গুলোও। সারা বাংলার আকাশ বাতাসে লাশ আর লাশের গন্ধ। রক্তের নদী বয়ে চলে সমগ্র বাংলা জোড়ে। সখিনার মত লাখো রমনী হয় বিরোঙ্গনা।
সুন্দর পৃথিবীতে কে না বাঁচতে চায়। কার না সাধ হয় স্বামীর চরণতলে মাথা নুইয়ে রাখতে। কত নির্মমতার স্বীকার হলে একটি প্রাণ ঝরে যেতে চায়, যে প্রাণ সম্যক বেদনায় ঝরেছে কেবল সেই জানবে তার মর্মজ্বালা। অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে সখিনা। কান্নায় কাতরাচ্ছে হাশেম গাজী। এদিকে প্রতিদিনের মত সখিনার কাছে এসে হাজির হয়েছে পাক কমান্ডার রঙলীলায় মাতার জন্য। পাক কমান্ডার জানতো সখিনার স্বামী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। উঠানে বসা পুরূষ দেখে কমান্ডার রাজাকার বদর উদ্দিনকে ঈশারা করে। বদর উদ্দিন ফিসফিস করে জানিয়ে দেয় এই সেই সখিনার স্বামী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া হাশেম গাজী। বহুত আচ্ছা হ্যা, বলিয়াই হাশেম গাজীকে গাছের সাথে বেঁধে ফেলে, প্রথমে বেধম পিটালো। আর সখিনাকে ঘরে নেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলো। একি! সখিনা যে আর বেঁচে নেই!
কমান্ডার ব্যঘ্রতার সহিত নিজ হাতে পরপর কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে মারলো হাশেম গাজীর কলিজা বরাবর। নিমিষেই বুকটা ঝাঝড়া হয়ে গেলো। সখিনাকেউ মৃত পেয়ে ক্ষোভে আক্ষেপে বুট দিয়ে পরপর কয়েক বারটা লাথি মারলো। শুধু তাই নয় মৃত দেহটার উপর পরপর কয়েক রাউন্ড গুলিও চালিয়ে গেলো। গুরুম গুরুম শব্দে প্রথমে প্রকৃতি, প্রকৃতির আকাশ বাতাস। পাখিরা কেঁদে কেঁদে উড়াল দিলো দূরাকাশে তারঃপর ফের নেমে এলো নিস্তব্ধতা। দেহ দু,খানা নিথর ভাবে পড়ে রইলো মেঝেতে। হয়তো কোন এক দিন কতগুলো ক্ষুধার্ত শেয়াল কুকুর এসে নয়তো পচে মজে একদিন নিঃশেষ হয়ে গেছে।
©somewhere in net ltd.