নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

উননুর

সামাইশি

সময় বয়ে যায়, ক্ষয়ে যায় জীবন, মন, সৃষ্টি, ক্লেদের গ্লানি জমা হোল যত যথাপি ঝরে যায় বৃষ্টি।

সামাইশি › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুক্তির আলয়

০৮ ই জুন, ২০১৭ সকাল ৮:০৮



মুক্তির আলয়।

১৯৭১ সাল মার্চ এর প্রথম সপ্তাহ. মোহাম্মদপুর স্কুল থেকে বাসায় ফিরছি. কলেজ গেট, কৃষি কলেজ (এখন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) এবং কলোনি হয়ে. কৃষি কলেজ লাগোয়া ই টাইপ (স্বাধীনতা পরবর্তিতে যেখানে বাস করেছি দশ বছর) পার হতেই দেখলাম রোলেনদের বাসার পিছে দেয়ালে হেলান দিয়ে আড্ডা মারছে টুকু ভাই, বন্ড ভাই ও কিসলু ভাই. আমাদের দেখে (সঙ্গে ছিল পিঠে পিঠী ভাই সেলিম) বলে উঠলো মাহবুবের ভাইরা (আমাদের বড় ভাই) আস, ডেকে নিয়ে আদর করলো, কিছু খাবে কিনা জিগ্গেস করলো. যদিও আসে পাশে কোনো দোকান ছিলনা. আদর করে বলা আর কি! কয়েক দিন আগেই তিন জনই আমাদের আগার গায়ের বাসায় (এখনকার শেরে বাংলা নগর থানার ঠিক পিছনেই) বিশাল বিশাল চিতল মাছের পেটি দিয়ে ভুরি ভোজন করে এসেছিলো. বিশালাকায় চিতল মাছ গুলো ছিল সুনামগঞ্জ অঞ্চলের হাওরের. পাঠিয়েছিলেন আমাদের এক সিলেটি আত্ত্বীয়, যিনি পরবর্তী কালে বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে পদ অলংকৃত করেছিলেন দুই দুই বার. শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের সময় উনি ছিলেন সরকারের দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি. মার্চের ওই সময়ে সম্বভত: উনি ছিলেন আওযামী লীগের সমাজ কল্যান সম্পাদক.

যাই হউক আমরা বাসায় চলে আসলাম. মার্চের অগ্নিঝরা দিনে ওই সপ্তাহেই বা পরের সপ্তাহে স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল. ৩ মার্চের পর দেখলাম বিকেল বেলায় কলোনির মাঠে (পরবর্তিতে কালে আমরা নাম দিয়েছিলাম লাল মাঠ) খেলাধুলার পরিবর্তে বড় ভায়েরা পিটি করাচ্ছেন তাদের বয়সী শত খানেক ছেলেকে. মেয়েরা ছিল কিনা এই মুহুর্তে মনে পরছেনা. পিটি করাতেন আমার ভাই উনি ছিলেন কমান্ডার, (তার কারণ আছে তা হোল উনি কৃষি কলেজে পড়াকালীন সময় পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে আব্বার অগোচরে নন কমিসন এযার ম্যান হিসেবে যোগদান করেছিলেন. তিন কি চার মাস কোয়েটার কাকুলে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একাডেমিতে ট্রেনিং এ হাঁপিয়ে উঠে কেদে কেটে আব্বাকে চিঠি লিখলে, আব্বা এক অলৌকিক উপায়ে অসম্ভবকে সম্ভব করেন. যাতে আমাদের ওই সিলেটি আত্বীয়ের লক্ষ কোটি অবদান ছিল. যাই হউক ভাই এবং সংগঠক পর্যায়ে আরো ছিলেন টুকু ভাই, বন্ড ভাই, কিসলু, রাজা ভাই এবং টুকু ভাইয়ের বড় এক ভাই বাশার ভাই. টুকু ভাইয়ের বড় ভাই বজলু ছিলেন কিনা এই মুহুর্তে মনে পরছেনা. ভাই ছাত্রলীগ করতেন. সত্তরের নির্বাচনে কলোনিতে প্রচারের জন্য ছাত্রলীগ আওয়ামী লিগ মিলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এসেছিলেন আধা ঘন্টার জন্য. জীবনের প্রথম সামনা সামনি দেখা বঙ্গবন্ধুকে. আগারগাও বাজারের রাস্তার অপর পার্শ্বে ইনকোওয়ারী অফিসের লাগোয়া ফাকা জায়গায় সভা হয়েছিল. তাকে দেখেই সেই যে মনে গেথেছি আজ ও প্রতিদিনের নিশ্বাসে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি এবং শেষ নিস্স্বাস পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাবো. ৭ মার্চের পর পরিস্থিতি আরো উত্তাল হয়ে উঠলো. ভাইদের অনুশীলনে বাশের লাঠি, কাঠের রাইফেল যোগ হোল, এবং প্রচলিত শরীরচর্চা নয় বরং যুদ্ধের অনুশীলন হতে লাগলো. আমরা বিকেলে হলেই দম বন্ধ করা উত্তেজনা নিয়ে গু এর টাঙ্কির (লাল মাঠের পাশেই যে সারা কলোনির পয় নিস্কাশনের বিশাল দুটি টাঙ্কি) উপর বসে দেখতাম. চরম উত্তেজনায় ঠাসা দিন গুলি পার হতে হতে ২৫ মার্চ এর কালো রাত্রে উপনীত হোল গোটা ঢাকা তথা সারা বাংলাদেশ. সেদিন ভাই একটু রাত করে বাসায় ফিরলো. ভাই আব্বা বলাবলি করছিল আজ না জানি কি হয়? আমরা ছোট ভাই বোনেরা অত বুঝিনা একটু পরেই ঘুমিয়ে পরলাম.

গভীর রাতে প্রচন্ড গুলির শব্দে জেগে গেলাম, মনে হোল আমাদের বাসার পাশেই, পরে জেনেছিলাম শেরে বাংলা বালিকা বিদ্যালয় ও এখনকার আর্কাইভ সংলগ্ন মোড়ে গার্লস স্কুলের দেয়ালের ভিতর থেকে ধাবমান পাকিস্তান আর্মির জিপের উপর গুলি চালিয়েছিলো টুকু ভাইয়ের ভাই বাশার ভাইয়ের নেতৃত্বে অন্যরা. চকিতে বাসার ত্রস্থ চাপা আর্তনাদের মত শোনা গেল. আমরা চিত্কার করে কাঁদতে শুরু করব প্রায় সাথে সাথেই আম্মা ফিস ফিস করে ডেকে তুললেন ছোট ভাই বোনদের. দরজা খুলেই নিমিষেই সবাই ঘর থেকে বের হয়েই চেয়ে দেখি পূব আকাশ লালে লাল. আকাশে আগুন ধরবে কিভাবে. বুঝা গেল আর্মিরা আগারগাও বাজার জালিয়ে দিয়েছে. এটুকু মনে আছে বাসা ছেড়ে পালাতে হবে, আব্বা ভাই মামা বলছিল. ভাই মামা থাকতে চাইলে আব্বা বলছিল না তোমাদের একা রাখা যাবেনা, যেখানেই মরি, মরতে হলে সব এক সাথে মরব. তাছাড়া বাসায় দুই সপ্তাহ হয় বাংলাদেশের পতাকাউড়ছে. তাই সবাইকে যেতে হবে. আমার স্পষ্ট মনে আছে ওই অবস্থায়ই মুহুর্তে আমরা বাসার পিছন দিয়ে বের হয়ে যাই. এত কিছু মাত্র দুই তিন মিনিটে. আমি ছিলাম গালি গায়ে একটা হাফ প্যান্ট পরা. ৭১ এর মার্চের সেই কালো রাত্রে ঘুট ঘুটে অন্ধকার আমাদের ওখানে তখন বিদ্যুত ছিলনা. (আয়ুব খানের সেকেন্ড কলোনির কারণে অধিগ্রহণ করেছিল বিধায় ) কিছুদুর এগুনোর পর হঠাত আম্মার আর্তচিত্কার ছোট বোন নাসিমাকে (ওর তখন বয়স ছয় কি সাত ) ফেলে এসেছে. তার কারণ বোধ হয় ওর ছোট আরো ভাইবোন ছিল আমাদের বিধায়, উত্তেজনার বশে ওর কথা তাত্ক্ষণিক মনে ছিলনা. ছোট ভাই মুকুটের বয়স কেবল কয়েক সপ্তাহ. কিভাবে আমরা হাটতে হাটতে আমাদের এখনকার পশ্চিম আগার গাও বাসার কাছে চলে আসলাম. ওখানে তখন বিল, আসে পাশে কোনো বাড়ি ঘর নেই কেবল পশু (প্রাণী সম্পদ) ডাক্তারের বাড়ি ছাড়া. আমার মনে আছে সেখানে জড়ো হওয়া মানুষজন নিরাপদ না ভেবে বিলের ভিতরে বোরো ধানের খেতে আশ্রয় নিয়েছিল. আমরা কিচ্ছুক্ষন আমাদের জায়গার উপর থেকে পরে গোলা গুলির শব্দ বেড়ে গেলে কাদা পানি মাড়িয়ে বোরো ক্ষেতের আইলে গিয়ে আশ্রয় নিলাম. লোকজনের চাপা আর্তনাদ, অবুঝ শিশুদের কান্নায় আকাশ ভারী হয়ে উঠছিল. ওই সময়ই মরার উপর ঘড়ার ঘা এর মত আকাশ ফুরে উদয় হোল লাল রক্ত চক্ষু নিয়ে হায়েনা শকুন রুপি পাকিস্তানি হেলিকপ্টার. আমরা তখন ছিলাম তেজগাঁও বিমান বন্দরের প্রতিবেশী এবং এতদঞ্চলের ওটা ছিল সবচেয় বড় বিমানবন্দর. হেলিকপ্টারের শব্দে মুহুর্তে মানুষজনের চাপা আর্তনাদ,শিশুদের কান্না উধাও. শ্যামলীর দিক থেকে এসে হেলিকপ্টার পীরেরবাগ, পাইকপাড়ার দিকে উড়ে যাচ্ছিল. তার সুতীব্র সার্চ লাইট ফেলছিল বোরো ক্ষেতে. এখনো আমি দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাই হেলিকপ্টারের সুতীব্র আলোয় গোটা বিলে ভেসে উঠেছিল ফরমায়েশি হলিউডের আয়্যাকসন ছবির চেয়ে শত গুন নিপুন ভয়াল ক্যানভাস. হেলিকপ্টারের পাখার প্রবল বাতাসে সারা বিলের আইল জুড়ে ভেসে উঠেছিল আশারফুল মুকলুকাতের সাদা (সাদা জামা পরিহিত বিধায়) আইল, ভয়ার্ত, নিশ্চুপ শব্দহীন এক মৃত্যুপুরী. সবাই হয়ত তখন মৃত্যুর প্রহর গুনছে কখন উপর থেকে পাখির ন্যায় গুলি করে মারবে. ভাগ্য সেখানে সবার সহায় ছিল. হেলিকপ্টারটা কয়েকটা চক্কর দিয়ে কুর্মিটোলার দিকে চলে গেল. মুহুর্তেই আবার বৃদ্ধ, শিশুদের আর্তনাদ ও ক্রন্দন চিত্কারএ সন্বিত ফিরে এলো সবার মাঝে.

ওই অবস্থায় বিলের মধ্যে রাত পার হোল. সকাল হলে আম্মা ছোট ভাই (আমিও তো তখন ছোটই) বোনদের পশু ডাক্তারের বাসায় রেখে আব্বা, ভাই, মামা, আমি (সেলিম ছিল কিনা মনে নেই ) বাসায় আসলাম কাপড় চোপড় এবং খাবার সামগ্রী নেয়ার জন্য. দুইটা ব্যাগে কেজি দশেক চাল, আলু, ডাল (আর মনে নেই) এবং গায়ে জামা চড়িয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যেই না পিছনের নিচু ধানের জমিগুলো (এখনকার ঠিক ইসলামিক ফাউন্ডেসনের সদর দপ্তরের সামনে) পার হচ্ছিলাম হঠাত ভোজবাজির মত দেখি আশেপাশে চতুর্দিকে পাকিস্তানি আর্মি. মুহুর্তে মহিলা, বৃদ্ধ ও শিশুদের চিত্কারে আকাশ ভারী হয়ে এলো. ভাগ্য ভালো ওরা গুলি করছিলনা, তাও ভয়ে নিমিষেই পাশের এক টিনের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিলাম সবাই. সেকেন্ডেই পুরো ঘর ভর্তি হয়ে গেল আমি বড়দের ঠেলা খেতে খেতে টিনের বেড়ার কাছে গিয়ে উপনীত হলাম. টিনের গায়ে ছোট ছোট ছিদ্র ছিল (অর্থাত ব্যাবহৃত টিন) সেই ছিদ্র দিয়ে ভাই বাইরে দেখছিল আমিও কৌতুহল ভরে চোখ রাখতেই দেখি এক সেনা পা উচু করে বেয়নট সহ চাইনিজ রাইফেল সোজা করে সামনের এক মহিলার পেটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সাথে সাথে ভাই খপ করে আমার দু চোখ চেপে ধরল. আমি থর থর করে কাঁপছিলাম. ছোট একটা ঘরে শয়ে শয়ে মানুষের চাপাচাপিতে দম বন্ধ হয়ে মরার অবস্থা. ঘন্টাখানেক পরে সৈন্যরা চলে গেলে বাইরে শান্ত হয়ে এলো. আমরা বের হয়ে এবার দুরু দুরু বুকে অজানা আশঙ্কায় আম্মা ও ছোট ভাই বোনদের দিকে রওয়ানা দিলাম. যন্ত্রচালিতের ন্যায় আমরা এসে দেখি ওখানে কাক পক্ষী ও নেই. আমাদের অজানা আশংকা আরো বেড়ে গ্যালো পশু ডাক্তারের বাসার বাইরে একচিলতে বারান্দার উপর রাত্রে নেয়া আমাদের সুটকেসে খোলা পড়ে থাকতে দেখে. আমরা ভয়ার্ত, সন্ত্রস্থ, আতঙ্কিত, কিন্কর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পরলাম।(চলবে)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই জুন, ২০১৭ দুপুর ১২:১০

জগতারন বলেছেন:
আরেকটু গুছায়ে লিখুন, বানানের প্রতি নজর দিন।
আমি আপনার লিখাটি পড়া শেষ করতে পারলাম না বিরক্ত এসে গেল, দুঃখিত।

০৯ ই জুন, ২০১৭ ভোর ৬:০০

সামাইশি বলেছেন: আপনার অনুযোগ ভরা মন্তব্য দেখলাম। বানানের ব্যাপারে বলছি। গুগুল ট্রান্সলিটারেটে ইংরেজি লেটারে শব্দের বাংলা উচ্চারণ লিখি তাতে যা আসে তাই গ্রহণ করি। অভ্রতে চেষ্টা করেছি কিন্তু ওতে আরো বেশি সীমাবদ্ধতা। গুছিয়ে লেখার কথা বলছেন, দেখেন আমি কোন কল্প কাহিনী ফ্যান্টাসি বা গল্প উপন্যাস লিখিনি। তাই সুখ পাঠ্য বা জনপ্রিয় হওয়ার লক্ষ্য আমার নয়। আমাদের মাতৃভূমিতে ঘটে যাওয়া জগ যুগের অবিস্মরণীয় মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী আমার কিশোর মনে যে প্রতিবিম্ব হয়েছে তাই আমি কলমের আঁচড়ে প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। অনেকটা চিত্রনাট্যের মত। আপনি বিরক্ত হলেন শেষ পর্যন্ত্য পড়তে পারলেননা তাতে দেশের প্রতি মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এবং সর্বোপরি দেশের জনকের প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কি ধরণের তাই পপ্রতীয়মান হচ্ছে। আমরা যখন মানুষ তখন মানুষে মানুষে দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতা থাকতেই পারে কিন্তু দেশ মাতৃকার প্রতি মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমাদের রাষ্ট্রের জন্মের পটভূমির প্রতি সবার সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি থাকায় বাঞ্ছনীয় আমি মনে করি। আমি স্পষ্টত: বুঝতে পারছি আপনার মাত্রার কথা। আপনার দৃষ্টিভঙ্গিকে আমি প্রচ্ছন্ন দৃষ্টিতেই দেখি। কিন্তু আপনার মন্তব্যকে আমার করুনা করতেই কুন্ঠা বোধ করছি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.