নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

উননুর

সামাইশি

সময় বয়ে যায়, ক্ষয়ে যায় জীবন, মন, সৃষ্টি, ক্লেদের গ্লানি জমা হোল যত যথাপি ঝরে যায় বৃষ্টি।

সামাইশি › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুক্তির আলয়

১০ ই জুন, ২০১৭ সকাল ৮:৩২



মুক্তির আলয় (পূর্বের পর)

খাওয়া শেষ হতে না হতেই হঠাত লোকজনের ছুটাছুটি, চিত্কার, আর্তনাদ শোনা গ্যালো. ধামরাইএ মিলিটারী এসে পরেছে এবং এই দিকে আসছে. আমরা ভয়ে আতঙ্কে ফের সিটকে গেলাম. তাড়াতড়ি ওই বাড়ির লোকজন বাইরে গিয়ে সহসাই ফিরে জানালো না কারা যেন রটিয়েছে মিলিটারী আসছে. পরদিন সকাল বেলা নাস্তা যা যোগাড় হোল তাই খাইযে তারা আরো অনেকের সাথে দুপুরের একটু আগে আরিচা যাওয়ার ট্রাকের ব্যবস্থা করে দিলেন. আরিচা গিয়ে ফেরিতে নদী পার হয়ে বিকেল শেষ হয় হয়. ফেরি নগরবাড়ি ঘাটে না গিয়ে মাইল খানেক আগে ভিড়ল. ওখান থেকে হেটে ঘাটে এসে আব্বা একটা নৌকা ঠিক করলেন. এরি মধ্যে চারিদিকে অন্ধকার হয়ে এলো. ওই ঘুটঘুটে নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে মাঝি কি করে দিক ঠিক রেখে আমাদের নিরপদে নিয়ে চলল তা আজও আমার কাছে এক চরম বিস্বয়. আমার মনে আছে ভোরের আলো না ফোটা পর্যন্ত আমার ফুফু (আব্বার চেলি আপা, কৃষি কলেজের অধ্যাপক সেলিম আক্তারের বোন) সারা ক্ষণ বিলাপ করে কাঁদছিল আর অনুনয় করে মাঝিকে বলছিল, মাঝি ভাই নৌকা থামাও, নৌকা থামাও. ভোরের দিকে নৌকা শাখা নদীতে (বড়াল?) ঢুকলে আমরা হাফ ছাড়লাম. বড়াল করোতোয়া হয়ে আমাদের নিয়ে নৌকা দুপুরের একটু আগে আমাদের গ্রামের এক মাইল দুরে শিবরামপুরএ গিয়ে পৌছল. সেখান থেকে হেটে আমরা পিতৃভূমিতে গিয়ে পৌছলাম. আগেই খবর পৌছে গিয়েছিলো আমাদের দেখতে গোটা গ্রাম ভেঙ্গে পড়ল. আমার চাচা, ফুফু, খালা সকলেই অঝোরে কাদছিল. প্রিয়জনদের নিরাপদে কাছে পেয়ে. সেদিন ছিল ২৭ মার্চ. পরে যুদ্ধকালীনসময়ে আমরা ছয় মাস গ্রামে ছিলাম, পালা করে দাদার বাড়ি, নানার বাড়িতে থাকতাম. কয়েক সপ্তাহ পর সবাই নানার বাড়িতে গেলাম. কিছুদিন পর একদিন দেখি আব্বা আম্মা নানা নানী মামাদের মুখ গোমড়া, ভারি, মন মরা. জানতে পারলাম আমার ভাই, ছোট মামা এবং নানাদের গ্রাম ও আশে পাশের গ্রামের মোট বাইশ জন তরুণ যুবা যুদ্ধে গিয়েছে. নি:সন্দেহে আমার ভাইই সংঘঠিত করেছে.

পরে শুনেছি তাদের রোমহর্ষকর, বিপদসংকুল মুক্তিযুদ্ধ যাত্রা. ওনারা নৌকায় করে যমুনা নদী হয়ে রৌমারীর চর পার হয়ে মাইনকার চর দিয়ে ভারত গমন করেন. পথে সিরাজগঞ্জের উজানে মাঝি মিলিটারী দেখে সবাইকে নৌকার পাটাতনে লুকিয়ে থাকতে বলে. পাটাতনের অল্প জায়গায় গাদাগাদি করে ছিলেন ওনারা ঘন্টা খানেক. স্বাভাবিক অবস্থায় ওই অল্প জায়গায় ওই ভাবে ঘন্টাখানেক থাকা অসম্ভব, অচিন্তিনীয়, অকল্পনীয় ব্যাপার. ওখানে গিয়ে ভাই যথারীতি কমান্ডার. কয়েক মাস পরে আমরা ঢাকায় চলে আসি,তবে আমাদের বাসায় নয়, তেজগাঁও বেগুন বাড়িতে আমার এক খালুর বাসায় এক রুমে গাদাগাদি করে থাকতাম যুদ্ধ না শেষ হওয়া পর্যন্ত. আব্বা আমাদের আগে ঢাকায় এসে দেখে এসেছে আগার গায়ে আমাদের ঘরবাড়ি ধুলিস্যাত. তিনটা ঘর ছিল আমাদের, ছোট দুইটা ঘরের চিন্হ মাত্র নাই ভিটে ছাড়া. বড় চৌচালা ঘরের শুধু টিনের চালটা রয়েছে. ভাইয়ের জন্য মন খারাপ, আম্মা সব সময় মন খারাপ করে থাকে. এর মধ্যে নভেম্বরের মাঝামাঝি ভাই ঢাকায় এসে হাজির. আমরা অবাক বিশ্বয়ে দেখলাম ভাইয়ের উসকো খুসকো চুল, খোচা খোচা দাড়ি নোংরা দুর্গন্ধময় লুঙ্গি পরা. পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে ভাই খেতে বসে গোগ্রাসে খাচ্ছিলেন মনে হচ্ছিল সব খাবার এক বারে খেয়ে ফেলবেন. আম্মার চোখ বেয়ে টপ টপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছিল. আমরা ছোট ভাই বোনেরা (উনি আমাদের সকলের বড়) তাকে ঘিরে বিস্ফারিত নয়নে দেখছিলাম. এরপর প্রায় প্রতিদিন ভাই সকালে বের হয় আর ফিরে সন্ধ্যা বেলায়. একদিন ভাই মলিন মুখে বাসায় ফিরে আসলো. রাত্রে খাওয়া দাওয়া শেষে আব্বা কারণ জিগ্গেস করলে ভাই বলল তার সাথে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর তার ব্যাচ মেটের দেখা হয়েছে. নানান কথাবার্তার পর তার স্টেসনে চায়ের দাওয়াত দিয়েছে. শুনে আব্বার মুখ থমথমে হয়ে গেল. আব্বা জিগ্গেস করলো ঠিকানা বলেছো কিনা. ভাই বলল না. পরদিন ভাই একটু সকাল সকালই বাসা থেকে বের হয়ে গ্যালো. সেইদিন ভাই আর বাসায় ফিরে আসলোনা,

কয়েকদিন পার হোল ভাই আর ফিরে আসে না. মা বাবা চিন্তায় কাতর. এমনি করে ডিসেম্বর মাস চলে আসলো, কিভাবে দিনগুলো পার করেছি বিস্তারিত অন্য লেখায় বলেছি. ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সৈন্য বাহিনী আত্মসমর্পণ করলো. পরদিন ১৭ ডিসেম্বর আব্বা সেলিম এবং আমাকে নিয়ে আগার গায়ে গেলেন. আমাদের বাড়িটা এক পরিত্যক্ত জঙ্গলে রূপ নিয়েছে. গোটা বাড়িতে কেবল একটা বালিশ পরে থাকতে দেখলাম, দেয়ালের ইট পর্যন্ত নাই. আমরা কাদতে কাদতে ফিরে এলাম. আমাদের বাস্তুভিটা ভস্শিভুত, এখন কোথায় আমরা থাকবো, ওই মুহুর্তে অন্য জায়গায় বাড়ি করার মত সামর্থ আব্বার নাই. আব্বা আমাদের বলে দিশেহারা. এদিকে ভাইয়ের কোনো খবর নাই কোথায় আছে কিভাবে আছে বেচে আছে কি মরে আছে আমরা কিছুই জানিনা.মা বাবার মুখের দিকে চাওয়া যায়না. আমরা এত গুলো ভাইবোন (নয়জন) কোথায় গিয়ে ঠাই নিবো. সপ্তাহ দুই পরে ভাইয়ের চিঠি বা লোক মারফত খবর পেলাম আমরা. আনন্দের অশ্রু বয়ে গেল আমাদের সকলের চোখে. ভাই লিখেছে কলোনিতে (শেরে বাংলা নগর) রাজা ভাই তাদের ই টাইপের বাসা (ই- ৫১) টুকু ভাই, বন্ড ভাই, কিসলু ভাইকে বলেছে আমাদের জন্য পাহাড়া দিয়ে রাখতে. রাজা ভাই ছিলেন ওনাদের লিডার. রাজা ভাইরা ডি টাইপের এক বাসায় ওঠেন ই টাইপ ছেড়ে. খুব সম্ভবত ১৯৭২ সনের জানুয়ারির প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে ভাই ঢাকায় আসলো.

এক দুই দিন পর আমরা কলোনিতে ই-৫১ তে গিয়ে উঠলাম. আমার মনে আছে আমরা মেঝেতে ঘুমাতাম. বাসায় একটি ও আসবাব ছিলনা. রাজা ভাই কিছু দিন পরে অল্প কয়েকটা আসবাবের ব্যবস্থা করে দিলেন. যাই হউক কয়েক দিন পরে সবার খবরাখবর একটু একটু করে জানা শুরু হোল. রাজা ভাই মুক্তিযোদ্ধা, টুকুভাই, বন্ড, কিসলুভাই ও মুক্তিযোদ্ধা. তবে সেই সময় সকলে উনাদের সিক্ষ্সটিন ডিভিসন বলত কেননা উনারা হঠাত কলোনির প্রিন্স হয়ে উঠলেন, গাড়ি চালাতেন দ্রুত বেগে (গাড়িটা ছিলো পরিত্যাক্ত ভক্ষ্সওয়াগন আমাদের লাইনে থাকত অবাঙালি নিয়াজ তথা নিয়াজ মোহাম্মদ ভাইদের যিনি পাকিস্তান টেস্ট ক্রিকেট দলে জায়গা পেয়ে ছিলেন. এবং উনি পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী ছিলেন বলে আমাদের একটু গর্ব ও অনুভব হোত) একদিন হোল কি দ্রুত বেগে গাড়ি চালাতে চালাতে উনারা শ্যামলীর কাছাকাছি গাড়ি উল্টিয়ে ডিগবাজি খান. শোনা কথা গাড়ি থেকে অস্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে চারিদিকে. ভাগ্যক্রমে তারা তিনজন ই বেচে যান. উনাদের কীর্তি কলাপ আলাদা করে বিস্তারিত বলব অন্য কোনো লেখায়. মনটা বিষাদে ভরে ছিল কিছুদিন পর যখন শুনলাম টুকু ভাইয়ের ভাই বাশার ভাই শহীদ হয়েছেন. উনার দল ঢাকা শহরে গেরিলা যুদ্ধে নিয়োজিত ছিল আর উনিতো আগে থেকেই আর্মির ওয়াচ লিস্টে ছিলেন. কোনো মেজরের ঘোষণার অপেক্ষায় না থেকে অকুতভয়ে ২৫ মার্চের রাত্রেই পাকিস্তান আর্মির উপর আক্রমন চালিয়েছিলেন. শোনা যায় আর্মিরা উনাকে ধরে নিয়ে অবর্ণনীয় অত্যাচার করেছিল তথ্য আদায়ের জন্য কিন্তু শত অত্যাচারেও ওনার মুখ থেকে একটি কথাও বের করতে পারেনি পাকিস্তান আর্মি. শেষ মেষ বেয়নট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে তিলে তিলে তাকে মারা হয়. কিন্তু উনি মরেন নি মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে রয়েছেন আমাদের সকলের মাঝে. (ক্রমশ)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই জুন, ২০১৭ সকাল ৯:১৫

নাঈম জাহাঙ্গীর নয়ন বলেছেন: ভালো লাগলো মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের গল্প শুনে। মুক্তিযুদ্ধকাল শুনতে আমার ভালো লাগে, আমি মনোযোগী হয়ে পড়ি। বাঙালি জাতির বীরত্বকাব্যে শ্রদ্ধা রেখে গেলাম।
আর জানার প্রত্যাশা রইল।

শুভকামনা আপনার জন্য।

১৩ ই জুন, ২০১৭ রাত ৩:৫৬

সামাইশি বলেছেন: আপনাকে হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ ও শুভ কামনা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.