নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

উননুর

সামাইশি

সময় বয়ে যায়, ক্ষয়ে যায় জীবন, মন, সৃষ্টি, ক্লেদের গ্লানি জমা হোল যত যথাপি ঝরে যায় বৃষ্টি।

সামাইশি › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুক্তির আলয়

১২ ই জুন, ২০১৭ সকাল ৮:৪০




মুক্তির আলয় (পূর্বের পর)।

ঘটনার বর্ণনা এখানেই শেষ হতে পারত! কিন্তু না, তাহলে এক মহান অমরত্বের কথা অজানা থেকে যেত সবার. কয়েক সপ্তাহ পার হতেই দেখলাম আমার ভাই টুকু ভাইদের এড়িয়ে চলেন. মেশেন না ওনাদের সাথে. পরে বুজতে পেরেছিলাম ওনাদের পথ, চিন্তা ধারা আর ভাইয়ের সম্পূর্ণ আলাদা. একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হিসেবে উনি মূর্ত হয়ে উঠেছিলেন উনার কাজে কর্মে. কয়েক সপ্তাহ পরে একদিন স্কুল থেকে বাসায় এসে দেখি ভাই বারান্দায় বসে কম্বল বিলাচ্ছেন কলেজের মধ্যে বসবাসরত বস্তির লোকজনের মধ্যে. আশ্চর্যের বিষয় হোল উনি নিজের বাসার জন্য একটা কম্বল ও রাখেননি, অথচ আমাদের তখন শীতবস্রর বেশ প্রয়োজন ছিল. শেষে আব্বার অফিস থেকে আনা সৈন্যদের পুরানো কম্বল দিয়ে আমরা চালিয়ে নিয়েছি. ভাই কৃষি কলেজে নিয়মত হলেন, আমি ক্লাস এইটে বৃত্তি পেলাম. বৃত্তির টাকা আব্বার হাতে তুলে দেয়ার দিন ওনার চোখ চিক চিক করছিলো.৭২ সালের শেষ দিকে একদিন ভাই বাসায় আমাকে এবং সেলিমকে বলল বিকেলে কমিউনিটি সেন্টারের দোতলায় কলোনির যত পারা যায় বেশি সংখ্যক ছেলেদের নিয়ে যেতে, সাথে অন্তত: একটা খাতা এবং পেন্সিল বা কলম নিয়ে যেতে. এদিকে লাকি আপাকেও (পরবর্তিতে আমার ভাবির বড় বোন) বলেছেন. উনিও কয়েকজনকে নিয়ে গিয়েছেন. ওখানে গিয়ে দেখি এক স্কুলের আয়োজন. লাকি আপা শিক্ষিকা এবং আমরা উপস্থিত সবাই ছাত্র. এখন শিপন, উর্মি, শাম্মী, মাহমুদ, মাহবুব, রুমি, মাসুম, জুবায়ের জোসেফ, নাসিমা, লিনার কথা মনে আছে যারা উপস্থিত ছিল. লাকি আপা আমাদের পড়াচ্ছেন. একটু পরে দেখি ভাই কয়েকজন লোক নিয়ে সিড়ি দিয়ে দোতলায় আসছেন. খেয়াল করলাম ভাইয়ের কলেজের প্রিন্সিপাল আলাউদ্দিন সাহেবকে নিয়ে আসছেন. উনি একটু খুড়িয়ে হাটতেন. ওনার মেয়েরা বিশেষ করে বকুল আপা ছিলো লাকি আপাদের বান্ধবী আর ছোট ছেলেটা আমার প্রায় বন্ধুর মতই ছিল, যদিও বয়সে কিছুটা ছোট ছিলো. এখন নামটা মনে নেই, খুব ভালো গোলকিপিং করত. লেখাটি পড়ে আমেরিকা থেকে তারিক আমাকে মনে দিয়েছিলো ওর নাম ছিল ভুলু। যাই হউক আলাউদ্দিন সাহেবকে বেশ হাসি খুশি এবং প্রফুল্ল মনে হোল. তার কারণ এখন বুঝি. ভাইয়ের ওনাদের সাথে কথাবার্তায় বুঝতে পারলাম কলেজ এবং আশেপাশের বস্তির ছেলে মেয়েদের জন্য ভাই একটা স্কুল দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন. প্রিন্সিপাল সাহেবকে অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করতে হবে. সহজেই অনুমেয় উনি তা সানন্দে করেছিলেন.

কয়েক মাসের মধ্যেই বিদ্যালয়টি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের অনুমোদন পেল এবং এম পি ও ভুক্ত হোল. কৃষি কলেজের (এখন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) ভিতরে উদ্যানতত্ত্ব মাঠের পুকুরের পিছনে বস্তির মধ্যে স্কুলের অস্থায়ী অবকাঠামো নির্মিত হোল. ভাই হলেন স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি. স্কুলের শিক্ষকদের ভাতা বেতনাদিতে উনার স্বাক্ষর লাগত. এর মধ্যে ভাই কৃষিতে স্নাতক হলেন. ইতিমধ্যে টুকু ভাই দের সাথে উনার যোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে শুন্যের কোঠায় নেমে এলো. টুকু ভাইয়ের ভাই শহীদ বাশারের কথা কি সবাই ভুলে গেলো? ৭৪ সনের প্রথম দিকে ভাই কৃষি তত্বে মাস্টার্স করতে ময়মনসিংএ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন. ট্রেন যোগাযোগ ভালো থাকায় তিন চার মাস পর পর ঢাকা এসে স্কুলের কাগজ পত্রে ভাই স্বাক্ষর করতেন. পরে পড়াশুনার চাপ বাড়ায় ৭৫ সনের মাঝামাঝি ভাই স্কুল কমিটির সভাপতির পদ ছেড়ে দেন. ওই বছরের শেষের দিকে প্রাইমারি স্কুলটি সরকারীকরণ হয়. ইতিমধ্যে স্কুলটি স্থানান্তরিত হয় কৃষি কলেজের পশ্চিম গেটের মুখে তখনকার বিএডিসির পিছনে উত্তর পচ্চিম কোনায়. সে ১৯৭৬/৭৭ সনের কথা।

২০১২ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রবাস থেকে দেশে গিয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দিয়ে বন্ধু শাহিনের ইকবাল রোডের বাসায় মটর সাইকেল করে যাচ্ছি পচ্চিম গেটের দিকে, উদ্দেশ্য ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি দেখব বলে. পচ্চিম গেটে এসে দেখি স্কুলের নাম গন্ধ নাই, ইতি উতি তাকিয়েও কোনো স্কুলের সন্ধান পেলাম না. দক্ষিন দিকে একটা তিন তলা হলুদ বিলডিঙ এর পিছনের পাশ দেখতে পেলাম. স্কুলটা তো রাস্তা ঘেষেই ছিলো. হলুদ বিলডিঙটা হয়তবা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নতুন স্থাপনা হবে. আমার বুকটা মনে হচ্ছিল ভেঙ্গে পড়ছিলো. পারলে হাও মাও করে কাঁদি. ভগ্ন মনোরথে মটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়ে গেট দিয়ে বের হয়ে বা দিকের রাস্তা কিছুদুর এগুতেই হলুদ বিলডিঙএ চোখ পড়লে আমার মটর সাইকেল আপনা আপনি থেমে গেলো. দেখি চকচকে হলুদ রং করা তিন তলা দালানের গায়ে লেখা "শহীদ আবুল বাশার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়". এবার সত্যি সত্যি কান্না পেল. ঠুকরে ঠুকরে কাঁদলাম নীরবে অনেকক্ষণ. বীর অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা বাশার চিরদিন বেচে থাকুন এই মুক্তির আলয়ে. আপনাকে লাল সবুজের এই জমিনের সশ্রদ্ধ সালাম ।

পাদটিকা: সত্তরের দশকের শেষের দিকে টুকু ভাই কিসলু ভাই জার্মানি চলে যান, এখনো ওখানেই আছেন. বন্ড ভাই কিছু দিন শ্যামলী হলের সাথে যুক্ত ছিলেন এখন কোথায় জানিনা. ওনার ছোট বোনকে ভাইয়ের বন্ধু মাসুদ ভাই বিয়ে করেন. রাজা ভাই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন, বেচে আছেন কিনা জানিনা.( কেবল আজকে কৃষি কলেজে আমার সিনিয়র ভাই রউফ ভাইয়ের কাছ থেকে জানলাম রাজা ভাই উনার বড় ভাই। অথচ কি আশ্চর্য্য কৃষি কলেজে থাকা অবস্থায় কোনদিন জানতে পারিনি তা। হয়তো রউফ ভাই আমার সিনিয়র ছিল বিধায়। তবে অত্যন্ত দু:খ ভারাক্রান্ত হলাম উনার মর্মান্তিক মৃত্যু সংবাদ জেনে।) আমার ভাই মাহবুব উল ইসলাম অকাল প্রয়াত হন ২০০৪ সনের ১১ জুন. আমার ভাইয়ের জানাজা পড়িয়েছিলেন আমাদের সেই সিলেটি আত্বীয় জনাব আব্দুস সামাদ আজাদ বিজ্ঞান জাদুঘরের সামনে উনি নিজে জানাজা পড়িয়ে উপস্থিত সকলকে অনুরোধ করেছিলেন নির্মোহ বিরল চরিত্রের মানুষটিকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য. সেখানে উপস্থিত চা বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং উর্ধতন কর্মকর্তারা বিস্ফারিত নয়নে তা দেখছিল. মৃত্যুকালে ভাই বাংলাদেশ চা বোর্ডের অধীনে চা উন্নয়ন প্রকল্পে উর্ধতন উন্নয়ন কর্মকর্তা হিসাবে কর্মরত ছিলেন। প্রধানের পদ উনার প্রাপ্য ছিলো কিন্তু পাননি. চাইলে উনি অনেক অনেক উপরে উঠতে পারতেন। নিজের চেচ্টা ছাড়া জীবনে নিজের জন্য তিনি কারো কাছে হাত পাতেন নি. অথচ কেবল মুখ ফুটে বললেই হোত। আজ ১১ই জুন আমার ভাইয়ের মৃত্যু বার্ষিকী। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস ২০০৪ সনের ১১ই জুন উনার সাথে আমার টেলিফোনে শেষ কথা হয়। উনার হাই প্রেসার বহুমূত্র আরো নানাবিধ রোগ একসাথে শনাক্ত হওয়ায় আমাকে দোআ করার জন্য বলেছিলেন। আমার ভাইয়ের সাথে সেটাই শেষ কথা. ওই দিন আমি কানাডা আসার জন্য আকাশ পথে থাকা অবস্থায় আমার ভাই হৃদ যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে পরলোকগমন করেন। আল্লাহ নিশ্চয়ই উনার মত একজন নির্মোহ নিভৃতচারী দেশ মাতৃকার সত্যিকারের সেনানীকে অমরত্ব দান ও হাজার হাজার শিশুকে মুক্তির আলয়ে উপনীত করার কাজ করার জন্য উনাকে স্বর্গে স্থান দিবেন এই কামনা করি. (সমাপ্ত)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.