নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মাতাল ঋত্বিক আমি, প্রেমকথা আমার ঋগ্বেদ

আরণ্যক রাখাল

মাতাল ঋত্বিক আমি, প্রেমকথা আমার ঋগ্বেদ

আরণ্যক রাখাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠি ও কিছু কথা

১৫ ই জুন, ২০১৫ রাত ১১:৪৪

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় একজনই বাংলাসাহিত্যে। যেমন একজন তারাশংকর, মানিক। কবিতায় জীবনানন্দ, শামসুর রাহমান। বুদ্ধদেব বসুর কথা নিজ কণ্ঠে ধারন করে নিজের মতো করে বলছি- “যে সাহিত্য শুধু সমকালীন মানুষ আর মানবমন নিয়ে খেলা করে, কবিতার গীতিময়তা যেখানে নেই, সে সাহিত্য খবরের কাগজের মতো অনেকটা- সূর্যাস্তের পরপরই যার প্রয়োজন ও দাম থাকে না”। বিভূতিসাহিত্য সেরকম কিছু নয়- অনেক বড় সাহিত্যিক শরৎবাবু- নিমজ্জিত ছিল পাঠক, যেমন এখনও আছে অনেকে, তাঁর লেখায়- কালজয়ী তাঁর রচনা- কিন্তু গীতিময়তা নেই খুব একটা। এটা ব্যতিক্রম। কিন্তু বিভূতি গ্রামবাংলার “গদ্যমহাকাব্য” রচয়িতা- এই উপাধি তাঁকে দিয়েছেন ভাষাশিল্পি হুমায়ুন আজাদ। যখন তাঁর “আরণ্যক” পড়ি মনে হয়, জীবনানন্দ যেন তাঁর কবিতার পরশ দিয়ে যাচ্ছেন আমার শরীরে! বাংলা গদ্যের “জীবনানন্দ” তিনি কিংবা “জীবনানন্দ” বাংলা কবিতার “বিভূতিভূষণ”।
বিভূতির কণ্ঠেই রবীন্দ্রনাথের “আমি সুদূরের পিয়াসী” শব্দকয়টি বেশি মানায়। সারাজীবন ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি- পুব বাংলা থেকে পশ্চিম, কোলকাতা থেকে দিল্লি, অরণ্যঅঞ্চল আরাকান থেকে বরিশাল- বিহার করে বেড়িয়েছেন জঙ্গল থেকে জঙ্গলে- তাই তো তাঁর কলম থেকেই বেড়িয়েছে “আরণ্যক”।

একজন লেখককে সবচেয়ে বেশি- যারা চলে গেছেন- কাছে পাওয়া যায় তাঁর দিনলিপিতে; তারপরের স্থানেই হয়তো- হয়তো কেন, অবশ্যই- অবশ্যই থাকবে চিঠি- অন্তরঙ্গ চিঠি। শুধু লেখককে না- একজন মানুষকে সবচেয়ে বেশি বোধহয় চিঠিতেই পাওয়া যায়। গত কয়েকদিন থেকে বিভূতিভূষণের চিঠিগুলো পড়ছিলাম- একটা দুটো করে। একে একে সংগ্রহে থাকা সব চিঠিই শেষ করে ফেললাম।
বিভূতির চিঠিগুলো থেকে যেমন ব্যক্তি বিভূতি সম্পর্কে জানা যায় তেমনই জানা যায় তাঁর রচিত উপন্যাসগুলো সম্পর্কে তাঁর ধারণা। তাঁর সর্বাধিক পঠিত ও প্রশংসিত উপন্যাস নিঃসন্দেহে ‘পথের পাঁচালী’- শ্রেষ্ঠ নয় হয়তো- অনেকে ‘আরণ্যক’কে শ্রেষ্ঠ মনে করেন। এই পথের পাঁচালী রচনাকালীন সময়ে লেখা পত্রগুলির মধ্যে কিছু নিচে তুলে ধরা হোল। যেখানে তাঁর সেসব মাতৃগর্ভে থাকা শিশুর মতো শ্রেষ্ঠ রচনার বীজ সম্পর্কে বলেছেন তিনি।
অনেক চিঠি লিখেছেন তিনি। তাঁর রচনাবলীর সব খণ্ডেই আছে তাঁর অন্তত ৩০টি করে চিঠি। আমার সংগ্রহে আছে বিভূতি রচনাবলীর ২য় খণ্ড। সেখান থেকে তুলে ধরছি গুরুত্বপূর্ণ কিছু চিঠি, ৩য় বন্ধনীর ভিতর আমার কিছু বাজে কথা থাকবে, ইচ্ছে হোলে ইগনোর করতে পারেন- তবে কথা দিচ্ছি অকারণে কিছু বলব না, আর পড়লে লাভবানই হবেন।
তো শুরু করা যাক-
******
[কালি-কলম সম্পাদক মুরলীধরকে লিখিত পত্রগুচ্ছ]


ভাগলপুর
২০শে ভাদ্র, ১৩৩৩
মান্যবরেষু,
আপনার পত্র পেয়েচি বটে তবে যে লিখেচেন, কালি-কলম একখানা পাঠালেন- সেইখানাই পাই নাই। অসুবিধা না হোলে একখানা পাঠাবেন- দেখবো কাগজখানা। শৈলজাবাবু এর মধ্যে আছেন দেখলুম- তাঁর সঙ্গে আমার একবার আলাপ হয়েছিলো মনে আছে, ২/৩ বছর আগে ডাঃ কালিদাস নাগের বাড়ি এক পূর্ণিমা সম্মিলনীতে- গোকুল* তখন বেঁচে আছে। শৈলজাবাবুর মনে আছে কি?
গল্প দেব, তবে আমি তেমন নিয়মনিষ্ঠ নই, এই মুস্কিল।
আমার নমস্কার জানবেন, কাগজখানা ঠিক পাঠাবেন।
নিঃ
শ্রীবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
(*গোকুল নাগ- কল্লোলের সহ-সম্পাদক)


ভাগলপুর
২-১১-২৫
সবিনয় নিবেদন,
বিজয়ার নমস্কার জানিবেন। আপনার পত্র পাইয়াছি, কালি-কলমও একখানা পাইয়াছি, বেশ কাগজ, অনেক নতুন ধরনের জিনিস চোখে পড়িয়াছে। সব রকম নতুনের মধ্যে আমি আছি। কালি-কলমকে অত্যন্ত আদরের সঙ্গে গ্রহণ করিলাম।
আপনি কলিকাতা ফিরিয়া আসিয়া আমাকে পত্র দিলেই একটা গল্প পাঠাবো। বোধহয় কার্তিক মাসের শেষে আপনার হস্তগত হইতে পারে। কালি-কলম মাসের প্রথমে বাহির হয় না শেষে?
আমিও বোধহয় জানুয়ারীর প্রথমে কলিকাতা ফিরিব। সেখানে আলাপ হইবে।
আপনার বিদেশ ভ্রমণের আনন্দ পূর্ণতা লাভ করুক। নমস্কার জানিবেন।
নিঃ
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়


Ismailpur Katchery
29.1.27
সবিনয় নিবেদন,
আপনার পত্র পেয়েচি। আমি আপনার পূর্বের পত্র পাইনি, পেলে নিশ্চয়ই উত্তর দিতাম। নানাকাজে ব্যস্ত থাকি, কখন কোথায় থাকি এজন্য পত্রাদির গোলমাল ঘটে। মধ্যে দিল্লীতে প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে যাবো বলে রওনা হই, কিন্তু বক্সারে গিয়ে সেইখানে একখানা কাগজে স্বামী শ্রদ্ধানন্দের শোচনীয় হত্যা ব্যাপারে পড়ে মন বড় খারাপ হয়ে পড়ে। দিল্লী না গিয়ে কাশী, চুনার, মৃজাপুর ইত্যাদি ঘুরে ফিরে আসি।
আপনার গল্পের কথা ভুলিনি। আপনাকে আর লুকিয়ে কি হবে, খুলেই বলি। আমি একটা নভেল(১) লিখচি ও শেষ করে এনেচি- আর ২টা চ্যাপ্টার হোলে শেষ হয়। একটু বড় হবে। এইটার জন্য আমাকে সকল সময় খাটতে হয় এবং এইটার পিছনেই চিন্তা করতে হয়- অবশ্য আমি সময় খুব কমই পাই- সে সময়ের মধ্যে এই কাজে ব্যস্ত থাকি। নভেলটা শেষ হয়ে এলো, আর ১০/১২ দিনের মধ্যে সাঙ্গ করে তুলতে পারবো ভরসা করি। প্রায় ৪০০ পাতার বই হবে বোধহয়। এইটাকে শেষ করে আমি অবকাশ পাবো- সেই সময় আপনাদের গল্প দেওয়াই আমার একটা কাজ হবে জানবেন। পৌষের কালি-কলম পেয়েছি। জগদীশ গুপ্তের লেখাগুলি বেশ লাগে। সেদিন সুরেন গাঙ্গুলি মহশয়ের সঙ্গে আপনাদের সম্বন্ধে কথা হোল। তিনি একটা লেখা শিগগির দেবেন বলেছিলেন, দিয়েছেন কিনা জানি না।
এখানে শীত খুব, ওখানে কেমন? নরেন(২) কোন লেখা-টেখা দেয় না কেন? সে তো বেশ পদ্য লেখে জানি।
ওপরের ঠিকানায় পত্র দেবেন। ঐ ঠিকানাতে আপাতত ১৫/ ১৬ দিন থাকবো।

নমস্কার ও প্রীতি জানবেন।
বশম্বদ
বিভূতিভূষণ দেবশার্মা
১।পথের পাঁচালী
২।নরেন বিভূতিভূষণের বাল্যবন্ধু


ইসমাইলপুর
৮/৪/২৭
প্রীতিভাজনেষু,
আপনার পত্র অনেক ঘুরে ঘুরে আমার হাতে পড়ে, এই জন্যই সব পত্র পড়েও না, বা পড়লেও দেরীতে পড়ে। সেজন্য উত্তর দিতে দেরী হয়, সেজন্য কিছু মনে করবেন না। আমার নভেলখানা সম্বন্ধে আপনি যে জিজ্ঞাসা করেচেন বা প্রমেনবাবু যে সদিচ্ছা প্রকাশ করেচেন, আমার নভেল তাঁর উপযুক্ত নয়। তবে আপনাদের শুভাকাঙ্ক্ষার জন্যে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন।
মে মাসের প্রথমে আমি কলকাতা নিশ্চয়ই যাবো। সেসময় আপনাদের সঙ্গে দেখা নিশ্চয়ই হবে।
কালি-কলমের দীর্ঘায়ু ও সাফল্য কামনা করি। ২য় বর্ষও ১ম বর্ষের মতো গৌরবমণ্ডিত হউক। এই বতসরের নানা ঝঞ্ঝাটে লেখা না দিতে পেরে লজ্জিত আছি। আগামী বতসরে কোন ত্রুটি করব না।
হাঁ- একটা কথা লিখি। দেখলাম কালি-কলমে সুরেনবাবা কতগুলো লেখা পুরোনো ‘সংহতি’ কাগজ থেকে নেয়া হচ্ছে। অধুনালুপ্ত “অয়ন” কাগজে আমার দুটো গল্প ছিল। “অয়ন” কাব্যছত্র থেকে বেরুতো, oriental society of arts এর ওখানে কপি আছে, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদক ছিলেন, যদি আপনার পছন্দ হয়, সে গল্প দুটো নিতে পারেন না? একটার নাম “দাতার স্বর্গ” আর একটার “জলসত্র”। আমার কাছে “অয়ন” নেই, গল্পের কপিও নেই- কলকাতার বাসায় আছে। নরেনকে বললে ও যোগাড় করে দিতে পারে।
আমার নভেলটা* শেষ হলেও এখনও কিছু কাটকুট কর্তে হবে। একটা কাগজে বার হবার কথা হচ্চে। যদিও পাকাপাকি কিছু এখনও হয়নি।
আশা করি কুশলে আছেন। নমস্কার জানবেন, যে ঠিকানা নিচে দিলাম, এই ঠিকানাতে পত্র দিলেই ঠিকমতো হাতে পড়ে।
নিঃ
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
*পথের পাঁচালী


Ismailpur katchery
১৯-২-২৮
প্রীতিভাজনেষু,
আপনার সব কয়খানা পত্রই পেয়েছি। নানা কার্যের গোলমালে আপনার আগের পত্র দুখানার উত্তর দেওয়ার কথা এমন চাপা পড়ে গিয়েছিল যে সেজন্য আমি মনে মনে লজ্জিত। আপনার গল্পটি লিখে রেখেও কেন ঠিক সময়ে পাঠাতে পাচ্ছিনে, তাও বলি।
সুরেনবাবুর সঙ্গে ভাগলপুরে কথাবার্ত্তার পর উপেনবাবু এখানে আসেন এবং তাঁর সঙ্গে আমার নভেলের বিষয়ে কথাবার্তা হয়। ঠিক হয় যে আগামী আষাঢ় মাস থেকে নরেনবাবুর উপন্যাস “সতী” শেষ হোলে আমারটা আরম্ভ হবে। কিন্তু নভেলখানা আগাগোড়া কপি করে দিতে হবে। এতে আমি রাজি হই না- অতগুলো পাতা- আপনি দেখে গিয়েছেন অনেকগুলো পাতা- বসে বসে কপি করবার আমার সময় নাই ইত্যাদি নানা অজুহাত দেখিয়ে উপেনবাবুকে রাজী করাই যে নভেল এমনিই নেবেন, কপি করে দিতে হবে না। কিন্তু সর্ত এই যে নভেল বেরুবার আগে অন্ততঃ দুটো ছোট গল্প ‘বিচিত্রা’তে যাওয়া চাই।
এই কথাবার্তার পড়ে ফিরে এসে নভেলের ms. খানা পড়তে গিয়ে দেখি যে অধিকাংশ স্থানে লেখা আমিই ভালো পড়তে পারিনে- তা ছাড়া অনেক অংশ অদলবদল করবার প্রয়োজনের অপেক্ষা করচে এমনও মনে হোল, self imposed task সকলের চেয়ে বেশি exacting হয়- এখন এই হয়েচে যে একদণ্ড অবসর পাইনে। সারা দুপুর নভেল কপি ও সংশোধন- সন্ধ্যার পর বিচিত্রার জন্য গল্প লেখা ও নভেলের ২য় ভলুম এবং তা ছাড়া স্টেটের কাজ তো আছেই। আপনার গল্পটাও আর একবার দেখে দেওয়া দরকার- এমন সময় পাচ্ছিনে যে সেটা একবার দেখি। এমনও ভাবচি যে ৩টা ছোট গল্পই একসঙ্গে কপি করবো, আর ২/৪ দিন পড়ে হাতের গল্পটা শেষ করে সব গল্পগুলো একসঙ্গে দেখবো। তারপরে আপনারটা পাঠিয়ে দেবো।
দেখুন- এমন সময় নেই- imperial library থেকে নতুন বেরুনো Coleman’s ice ages বইখানা আনিয়েছিলাম, Glacial epoch সম্বন্ধে আধুনিকতম অনুসন্ধানের ফল তাতে লিপিবদ্ধ আছে- কিন্তু টাকা ২ খরচ করে বই আনিয়ে আজ মাস খানেক পড়ে আছে, পাতা উল্টে দেখেছি মাত্র, পড়বার সময় পাই নাই। এদিকে কাল লাইব্রেরি থেকে বইখানা চেয়ে পাঠিয়েছে। স্টেট সংক্রান্তও একটা বড় মামলা বাধবো বাধবো করচে- এতেই বুঝুন আমার দুরবস্থা।
নভেলখানা খুব বড় হবে না- অনেক ছাটকাট যাচ্ছে, শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়ায় কি জানি? ২য় ভলুমে সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সব ঘটনা Marshall কর্তে গিয়ে অনেক গলদ ও difficulty পৌঁছে গেল, কি যে ঝঞ্ঝাটের কাজ- আর কি বিপদেই পড়েচি! কলকাতা অনেকদিন যাইনি তাঁর জন্যেও মনটা ব্যস্ত আছে। আপনার কালি-কলম কৈ? চিত্রবহা* বেশ লাগচে। নমস্কার নিন।

বিভূতিভূষণ দেবশর্মা
(*সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত উপন্যাস; ১৩৩৪ সালের কালি-কলমে বৈশাখ থেকে চৈত্রে ধারাবাহিক প্রকাশিত)

বড়বাসা
১-৫-২৮
প্রীতিভাজনেষু,
আপনার পত্র পেয়েচি। বৈশাখের কাগজ এতদিনে বার হয়ে গিয়েচে। জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় গল্পটা দিতে পারবো। আপনাকে পত্র লেখবার পড়ে উপেনবাবু উপন্যাসখানার কপি অবিলম্বে পাঠিয়ে দেবার জন্য পত্র লেখেন, কিন্তু আমি কপি শেষ করেই উঠতে পারিনি এখনও। লেখা নিয়ে থাকতে হোলে অন্য কোন কাজ যে করা চলে না তা এতদিনে একটু বুঝচি। সুরেনবাবু সে হিসেবে বেশ আছেন।
মে মাসের কোন নাগাত এখানে আসবেন? প্রথমে না শেষের দিকে? আমি বোধহয় ১৬/১৭ই মে এখানকার মতো মিটিয়ে কলকাতা যাবো। যেখানে হোক দেখা হবে।
ভাগলপুর ইন্সটিটিউটে এককপি ‘চিত্রবহা’ কিনে এনেচে। তা নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছে। আমি অনেক দিন পড়ে ভাগলপুর এসে কাল ক্লাবে গিয়েছিলাম, সেখানে হেমন্তবাবার মুখে শুনলাম বইখানার খ্যাতি এখানে খুব। এ আনন্দ সংবাদ আপনাকে না দিয়ে থাকতে পাড়া গেল না।
বৈশাখের মধ্যে উপন্যাসের কপি যদি শেষ না করে উঠতে পারি, তবে বোধহয় এবারে ‘বিচিত্রা’র আশা আমায় ছাড়তে হোল। বড় মুস্কিলে পড়ে আছি।
নমস্কার জানবেন। পত্র ইসমাইলপুর ঠিকানায় দেবেন। সেখানেই কাল যাবো।
বিভূতিভূষণ দেবশর্মা
(শেষ পর্যন্ত কালি-কলমে বিভূতিভূষণের একটি গল্প পাওয়া গিয়েছিল। কালি-কলমের তৃতীয় বর্ষে ১৩৩৫-এর আশ্বিন সংখ্যায় প্রকাশিত তাঁর ‘গ্রহের ফের’।)

***
[উপরের চিঠিগুলো থেকে এ কথাটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে, বিভূতিভূষণ নিজেই সন্দিহান ছিলেন “পথের পাঁচালী”র আঁকার সম্বন্ধে- কোথাও তিনি লিখেছেন,”একটু বড় হবে” আবার কখনো পাওয়া যায়, লিখেছেন- “নভেলখানা খুব বড় হবে না”। কিন্তু তিনি একনিষ্ঠ ছিলেন “পথের পাঁচালী”র প্রতি। একটা উদ্ধৃতি না দিয়ে পারছি না, “তৃণাঙ্কুর”- বিভূতির দিনলিপি- তৃণাঙ্কুরে তিনি লিখেছেন- “ ১৯২৪ সালের পূজার সময়টা থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সব সময়েই এই বই-এর কথাই ভেবেচি। ১৯২৬ সাল থেকে শুরু করে ১৯৩২ এর ১০ই মার্চ পর্যন্ত এমন একটা দিনও যায় নি , যখন আমি এই বইখানির কথা না ভেবেচি- বিভিন্ন চরিত্র, বিভিন্ন ঘটনা, বিভিন্ন মনোভাব নোট করেছি, মনে রেখেচি- কতো কি করেচি। ইসমাইলপুরের জঙ্গলে এমন কতো শীতের গভীর অন্ধকার রাত্রি, ভাগলপুরের বড়বাসায় এমন কতো আমের বউলের গন্ধভরা ফাগুন-দুপুর, কতো চৈত্র-বৈশাখের নিমফুলের গন্ধ-মেশানো অলস অপরাহ্ণ, বড়বাসার ছাদে কতো পূর্ণিমার জ্যোৎস্না রাত্রি- অপু, দুর্গা, পটু, সর্বজয়া, হরিহর, রাণুদি, এদের চিন্তায় কাটিয়েছি। এর সকলেই কল্পনা-সৃষ্ট প্রাণী। অনেকে ভাবেন আমার জীবনের সঙ্গে বুঝি বই দুখানির খুব যোগ আছে- চরিত্রগুলি বোধহয় জীবন থেকেই নেওয়া; অবশ্য কতকটা যে আমার জীবনের সংযোগ আছে ঘটনাগুলির সঙ্গে, এ বিষয়ে ভুল নেই- কিন্তু সে যোগ খুব ঘনিষ্ঠ নয়- ভাষা ভাষা ধরনের। চরিত্রগুলি সবই কাল্পনিক। সর্বজয়ার একটা অস্পষ্ট ভিত্তি আছে- আমার মা। কিন্তু যারা আমার মাকে জানে, তারাই জানে সর্বজয়া কতখানি আমার মা নয়।”
এখানে একটা জিনিস লক্ষণীয় যে, বিভূতিভূষণ ‘অপু’র সাথে এতোটাই মিশে গিয়েছিলেন এই আট বছরে(১৯২৪-১৯৩২) যে রাণুকে তিনিও অপুর মতো রাণুদি ডাকছেন- লিখছেন!

**********
নুটুবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখা পত্র-
[নুটুবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায় বিভূতিভূষণের ছোট ভাই]

বারাকপুর
মঙ্গলবার
৪/৯/৯৫
কল্যাণবরেষু,
নুটু তোমার পত্র পেলাম। পূজোর লেখার জন্য ব্যস্ত আছি বলে চিঠি দিতে পারিনি। এবার পূজোর বড় বেশি তাগাদা। কানুমামা এখন ঘাটশিলায় যাবে না আমায় বলেচে সুতরাং বাড়ী দেখতে হবে না। গত শনিবার সেখানে গিয়েছিলাম, ওরা জলপাইগুড়ি যাচ্চে। আমি পূজোর আগেই যাবো। নগেন খুড়োর ছোট ছেলে ফুচু আমাদের সঙ্গে যাবে বলে ধরেছে। খুব কাজের ছেলে, যা বলবে তাই করবে। আমাদের বড় অনুগত। দৃষ্টিপ্রদীপ ২য় সংস্করণ বেরিয়েছে। তোমাকে পাঠিয়ে দেবো। ২৯শে ভাদ্র বনগ্রামের তরুণ সঙ্ঘ আমার জন্মদিনের অনুষ্ঠান করবে। তারাশঙ্কর সভাপতি।
এখানকার সব ভালো। মিঃ সিংহ ওখানে এসেছিলেন নাকি আর? গুটকের বাড়ীর সব ভালো আজ। চিঠি লেখো না কেন? তোমরা সবাই আমার আশীর্বাদ নিও ও বৌমাকে দিও।
ইতি
শ্রীবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়



বারাকপুর
সোমবার
কল্যাণবরেষু,
নুটু, শনিবারে বনগ্রামে আমার জন্মতিথি উৎসব খুব ঘটা ও আয়োজনের সঙ্গে হয়ে গেল- ভাবিনি যে ওরা অত বড় করতে পারবে ওটাকে। লেখিকা অন্নপূর্ণা গোস্বামী সম্পাদিকা ছিলেন কার্য্যকরী সমিতির। তারাশঙ্কর সভাপতি। স্কুল হোলে পা রাখবার জায়গা ছিল না, যত লোক ভেতরে তত লোক বাইরে। নানা স্থান থেকে বাণী এসেছিল, টাকা এসেছিল। কলকাতার মেয়র হরেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। কিরণশংকর রায়, নিলিনাক্ষ সান্যাল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতি জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী পাঠিয়েছিলেন। ঘাটশিলার বঙ্গিম চক্রবর্তী ও বাঁকুড়া থেকে অনুকূলকাকা টেলিগ্রাম করেছিলেন। সিংহ সাহেব টেলিগ্রাম করেছিলেন। বহু স্থান থেকে বাণী পাঠিয়েছিল। সভায় সে সব পঠিত হোল। প্রবোধ সান্যাল সভাপতি। কলকাতা থেকে অনেক সাহিত্যিক উপস্থিত ছিলেন। মিতেদের বাড়ীর মেয়েরা ও বৌয়েরা ছিল সভায়। অন্যান্য অনেক বাড়ীর মেয়েরা ছিলেন। হঠাৎ দেখি সেই ভিড়ের মধ্যে ছোটমামা আর খোকা এগিয়ে আসচে ভিড় ভেদ করে। আমি হাত ধরে নিয়ে এসে সভাপতির পাশে নিয়ে এসে বসালাম। তখন সব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে থেকে বাণী ও মানপত্র পড়া হচ্ছে। তখন ছোটমামা অশ্রুপূর্ণ চোখে এই কবিতাটি দাঁড়িয়ে উঠে পাঠ করলেন-
“হে বিভূতি ভারত ‘সাহিত্য’ ক্ষেত্রে গৌরিশৃঙ্গ তুমি,
যশোদীপ্ত শিরে তব উঠিয়াছে অভ্রদেশ চুমি।
পথের পাঁচালী রীতি আরণ্যক মুখে শুনি গর্বভরা প্রাণে।
ভারত কোবিদবৃন্দ চেয়ে আছে তব মুখপানে।।
মল্লারে অনুবর্ত্তনে আর দেবযানের নবীন প্রবাহে
গর্ব্বভরা প্রাণে আজি মহানন্দে গীতি জনে জনে গাহে
আশীর্বাদ করি তোমা হে বতস বিভূতিভূষণ
প্রতিভায় অপরাজিত হও তুমি ভারতভূষণ।।”
কৌশলে এর মধ্যে বাবার নাম ও তোমার প্রথম পক্ষের বৌদিদির* নাম ঢুকিয়ে দেওয়া আছে। কার তৈরি ছোটমামা বললেন না। সভান্তে মোটরে সভাপতি ও সাহিত্যিক বৃন্দের সঙ্গে ছোটমামা ও খোকাকে এবং সেই সঙ্গে তোমার বৌদিদিকে বারাকপুর আনলাম আধঘণ্টার জন্যে। কুটির মাঠ ও বাঁশতলার ঘাট বেড়িয়ে চা ও জলযোগান্তে আবার সব চলল মোটরে বনগাঁ- আমিও। চা পার্টি ছিল স্টেশনের রেলওয়ে ডাক্তারের বাড়ি। দার্জিলিং থেকে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন সভায় যোগদান দেবার জন্য। খুলনা থেকে একদল ছোকরা এসেছিল, বরিশাল থেকে টাকা পাঠিয়েছে। নাগপুর থেকে দুটি মেয়ে ওদিন সাকালের ডাকে আমার বাড়ীর ঠিকানায় ফুল ও শুভেচ্ছা এবং জন্মদিনের উদ্যোগ ঠিকানায় টাকা পাঠিয়েছে। হাওড়া থেকে টাকা নিয়ে লোক এসেচে। বারাকপুর থেকে ফণী চক্রবর্তী, অমৃতকাকা, গজন, অমূল্য মুহুরি গিয়েছিল। উমা, তোমার বৌদিদি, সত্য, ফচু, মনুখুড়োর মেয়ে অন্ন গিয়েছিল আমাদের গাড়িতে। শাঁক বাজাতে বাজাতে উলু দিতে দিতে আমায় রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেল সে এক কাণ্ড আর কি। কালিদাস রায় কবিশেখর একটি চমৎকার কবিতা পাঠিয়েছিলেন। তাঁর প্রথম লাইনটা মনে আছে-
“দাদা বলে ডাকো মোরে সেই পরম গৌরব।”
ভাটপাড়ার শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ এক সংস্কৃত শ্লোক পাঠিয়েছিলেন ছোটমামার হাতে।
এখানের সব ভালো। ওখানে কি খবর? পাল্লার কালিপদ কি ওখানে গিয়েচে? ওকে নিমন্ত্রণ করতে লোক গিয়েছিল বনগাঁ থেকে, বল্লে ঘাটশিলা গিয়েচে। বৃষ্টি নেই, ধান হবে না। এবার ধান সামান্য পাওয়া গিয়েচে, গরম বেশ। গুটককে এক চিঠি দিয়েচে তোমার বৌদিদি পেয়েচে কি? তুমি গুটকে ও বৌমা আমার স্নেহাশীর্বাদ নিও। গুটকের বাড়ীর সিবাই ভালো আছে। নকুল ছেলে মারা গিয়েচে।
ইতি
শ্রীবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
(এই পোস্টকার্ডের কপালটুকিতে লেখা আছে)
নগেনখুড়োর ছেলে ফুচু ঘাঠশিলা বেড়াতে যেতে চায়। পূজোর ছুটিতে থাকবে, সে আমাকে বড় ধরেচে। বেশ কাজের ছেলে। সব রকম কাজ করতে পারে। তাকে বোধহয় তুমি দেখেচো। নিয়ে যাবো?
[বিভূতিভূষণের প্রথম স্ত্রীর নাম গৌরি। তিনি বোধহয় ১৯১৯ সালি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর ২২ বছর বিভূতি ভবঘুরে জীবন কাটিয়েছেন- একদম অপুর মতন। তারপর ১৯৪০ সালে তিনি রমা দেবীকে বিয়ে করেন- আমি ঠিক জানি না- তবে আমার জাহাঙ্গীর স্যার বলেছেন- রমা দেবী নাকি বিভূতির এক ভক্তের মেয়ে- এটা জাস্ট শোনা কথা- হোলেও হতে পারে। রমা দেবীর ডাক নাম কল্যাণী। বিভূতি রচনাবলীর শেষ কয়েকখণ্ডে কল্যাণীকে লেখা অসাধারণ কিছু চিঠি আছে- পড়লে একদম থ হয়ে যেতে হয়- চিঠিগুলো হাতে পেলে অবশ্যই সেয়ার করবো]
[বানানের ক্ষেত্রে বিভূতি যেমন লিখেছেন, তেমনই মুদ্রিত আছে রচনাবলীতে- ভুল না হোলে আমিও বানানরীতি পাল্টাইনি- এই ভুল নিজের ভুল মানে দেখে দেখে লেখার সময় ভুল হতে পারে]


বারাকপুর
শনিবার
কল্যাণবরেষু,
আজ আমার ছাত্র বিভূতির ভায়ের বিবাহ- কলিকাতা যাইতেছি। শান্ত একটু ভালো আছে। বোধহয় এবার সারিয়া উঠিতে পারে। তাহার পরই তোমার বৌদিদি ও উমাকে ঘাটশীলায় পাঠাইবার ইচ্ছা আমার। মিটে যদি আসে সে যেন নিয়ে যায়। শান্তকে কি করা যায় সে বিষয়ে পরে পরামর্শ করা যাবে। এখন সেরে উঠলে তবে। আমার মনে হয় ও অনুতপ্ত হয়েছে। অদ্য মহাদেব রায় প্রশংসাপূর্ণ এক পত্র লিখিয়াছেনঃ-
“প্রাসাদে প্রাসাদে ঘরে ঘরে কুটিরে কুটিরে একটি মহামূল্য জহরত মাটির দরে বিকাইলেন দাদা।” “দেবযান” ও “পথের পাঁচালী”র সম্পূর্ণ এডিসন বিক্রয় হইয়া গিয়াছে।
আমার কালীদার বাড়ী যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু ৫/৬ দিন ছুটি পাইব না। বোধহয় যাওয়া হইল না। বৌমা, তুমি ও গুটকে আশীর্বাদ নিও।
ইতি
শ্রীবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়


কল্যাণবরেষু,
সেদিন রবিবার তোমার কথামত মিত্র ও ঘোষের দোকানের সামনে রোয়াকে বসেছিলাম প্রায় ৪।।০টা পর্যন্ত। প্রথমে তো একাই বসে আছি, এমন সময় বাণী রায়ের বাবা পূর্ণবাবু যাচ্চেন। আমি বল্লাম, নুটু আসবে তাই বসে আছি। তারপর যাচ্চে সজনী দাস, বল্লে, “এখানে বসে?” আমি বল্লাম, “নুটু আসবে বলেচে তাই বসে আছি”। সজনী দাস আমার পাশে এসে বসল, গল্প করতে লাগলো। খানিকটা পরে যাচ্ছে সরোজ রায়চৌধুরী- বল্লে-“এখানে বসে যে?” আমি বল্লাম, এই ব্যাপার। সেও এসে আমাদের পাশে বসে গেল। তিন জনে মিলে ঘন্টাখানেক বসে। সামনের দোকান থেকে চা আনিয়ে খাচ্চি আর রোয়াকে বসে আড্ডা দিচ্চি। এমন সময় যাচ্চে রমাপ্রসন্ন আর গৌর বসু। আমাদের দেখে বল্লে, “কি ব্যাপার এখানে যে?” তাকে বল্লাম এই ব্যাপার। তারাও বসে গেল। সে এক মজার ব্যাপার, তখন যদি আস্তে তবে দেখতে যে, বাংলা দেশের ৩/৪ জন লেখক সাহিত্যিক তোমার জন্যে রোয়াকে বসে অপেক্ষা করচে আর চা খাচ্চে। বেলা ৪।।০টার পর সজনী বল্লে, “নুটু আসবে না, ভাই, আমি যাচ্ছি, কংগ্রেস সাহিত্য সঙ্ঘের মিটিং আছে।” তখন সে চলে গেল। আমরাও চলে এসে রমাপ্রসন্নের বাড়ী আড্ডা দিলাম সন্ধ্যা পর্যন্ত। যদি কলকাতায় এসো। ফিফটিন ছি সুইনহ স্ট্রিটে কানুমামার বাসায় উঠো। ওখানে মায়াদি আছে। গড়িয়াহাটা নতুন ট্রামডিপোর সামনে দিয়ে সুইনহো স্ট্রিট বেরিয়েচে।
এখানে খুব বৃষ্টি চলচে। আর সব ভালো, মশাটা বেড়েচে। গুটকের চিঠি পাওয়া গেছে। বৌমাকে আশীর্বাদ দিও, তুমি ও গুটকে নিও।
ইতি
শ্রীবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়


কল্যাণবরেষু,
নুটু, পুর্ব্বে তোমাকে একখানি পত্র দিয়াছি। আমার স্কুলের পরীক্ষা ও পূজার লেখা লইয়া বড়ই ব্যস্ত আছি। সেজন্য উমাকে আনিতে পারি নাই। দেবযান সামনের সপ্তাহে বাহির হইবে। ঐ সময় কলিকাতা যাইব। এই সপ্তাহে দিল্লী বঙ্গসাহিত্য সমিতির পক্ষ থেকে দিল্লীতে আমার জন্মতিথি অনুষ্ঠিত হইবে পত্র পাইলাম। আশা করি ভালো আছো, পূজার পুর্ব্বে বৌমাকে এখানে আনিব ভাবিতেছি- তুমি সে সময় আসিতে পার?
গুটকের বাবা ও মা উহাকে দেখিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছে, পূজার সময় উহাকে পাঠাইয়া দিবে। অনেকদিন এদিকে আসে নাই। উহাকে বলিবে রাঁচিতে ভোরবেলা হাওড়া নামিলে ৯-৫০ মিনিটের সময় বনগ্রাম লোকাল ছাড়ে। উহাতে আসিলে বনগ্রাম হইয়া আসিতে পারে। হরিনাভি স্কুল হইতে আমার চাকুরীর অফার আসিয়াছে। এসিসটেন্ট হেডমাস্টার- এর পোস্ট। ১০০ টাকা বেতন, কিন্তু যাইব না বলিয়া ঠিক করিয়াছি। পত্র দিও। রমেন পত্র দিয়াছে। আশীর্বাদ নিও।
ইতি
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
পুঃ পিসিমা ও মানু ভাল আছে।


কল্যাণবরেষু,
এইমাত্র স্কুলে বসে তোমার পত্র পেলুম।
চাইবাসা ও সেরাইকেলা ভ্রমণবৃত্তান্তে খুসী হলুম। সুবোধ ও যোগেন লেখা পড়ে কি বললে? এখানে ৪০০ কপি দেবযান বেঁধে এসেছে, হু হু করে বিক্রি হচ্চে। এক ভদ্রলোক বরিশাল থেকে পুত্রশোক ভুলেছেন দেবযান পড়ে, দীর্ঘ পত্র লিখেছেন আমায়, বইখানি লেখা সার্থক। ধনপতিবাবুর ভালো লেগেছে এতে আমি খুসী, তাঁকে আমার নমস্কার জানিও। বড় ভালো লোক। গত রবিবার ভাটপাড়ায় গিয়ে দেখি মনু ভীষণ ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় শয্যাগত, ক্ষীণ নাড়ী। রাত্রে উঠে দুবার নাড়ী দেখলুম। মাসীমা ও ছোটমামা সারারাত জেগে, তোমাকে টেলিগ্রাম করবে বলছিল। এখন একটু সেরেছে। বৌমা সেখানে আছেন। বাপের বাড়ী থেকে ওঁরা আনিয়েছেন। শরীর ভালই আছে, কলকাতায় গিয়েছিলেন। আবার ডাক্তার একবার যেতে বলেচেন। বৌমাকে ঘাটশিলায় নিয়ে যেও। জিনিষপত্র নষ্ট হয়ে যাবে। আমি ইদের ছুটিতে(বকরিদ) ধলভূমগড় যাবো। ইন্দু রায়ও যাবার খুব ইচ্ছা। তিন দিন ছুটি। ইন্দু রায়ের ভয়ানক ভালো লেগেছে ধলভূমগড় ও ধাটশিলা। আমাদের সেই গাছটাতে লাউয়ের জ্বালি পড়েছে। পালং শাক বোনা হয়েছে। এখানে খুব ম্যালেরিয়া- ঘরে ঘরে পড়ে। ইন্দু রায়ের বাড়ী হাসপাতাল, নিজে ইন্দু রায় ৪/৫ দিন শয্যাগত। আমাদের বাড়ীতে ঈশ্বরেচ্ছায় এখনও সব ভালো। বাহাদুর চলে গিয়েচে, তার আর থাকবার ইচ্ছা নেই। দিব্বি চলে যাচ্ছে। /২ খাঁটি দুধ যোগান, দু’আনা করে বেগুণের সের। যাবার সময় নতুন পাটালি নিয়ে যাবো। ঘরে ঘরে ম্যালেরিয়া, লোকও মরচে খুব। গ্রামে ৩/৪ টি মারা গিয়েচে। কলকাতায় ও ভাটপাড়ায় ভীষণ ম্যালেরিয়া দেখা দিয়েচে। বৌমাকে নিয়ে আসার সাহস হ’ল না, তবে আর দু’দিন পড়ে শীত পড়লে থাকবে না। অনুকূল কাকার স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে চিঠি দিয়েচেন। দুঃখ করেচেন খুব।
ইতি
শ্রীবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
****
চিঠিগুলির জন্য দ্রষ্টব্য- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী- ২য় খণ্ড
মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ
ISBN: 81-7293-307-x
[তাঁর সব চিঠিই সংকলিত হয়েছে। এসব চিঠি তাঁর রচনাবলীতে কালানুপাতে ক্রমে সংকলিত]

৩ জুন থেকে ৪ জুন রাত এগারোটা

মন্তব্য ২০ টি রেটিং +৬/-০

মন্তব্য (২০) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই জুন, ২০১৫ দুপুর ১:১৩

হাসান মাহবুব বলেছেন: +++

১৭ ই জুন, ২০১৫ রাত ১১:২৭

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: ধন্যবাদ হামা ভাই এতগুলা প্লাসের জন্য

২| ১৬ ই জুন, ২০১৫ দুপুর ১:৫৯

জেন রসি বলেছেন: চিঠিগুলো শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।

+++

১৭ ই জুন, ২০১৫ রাত ১১:২৮

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: আপনাকেও সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ :)

৩| ১৬ ই জুন, ২০১৫ দুপুর ২:০২

লেখোয়াড়. বলেছেন: +++++

১৭ ই জুন, ২০১৫ রাত ১১:২৯

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: :) :) :)

৪| ১৭ ই জুন, ২০১৫ রাত ১০:৩৪

দীপংকর চন্দ বলেছেন: শুধু লেখককে না- একজন মানুষকে সবচেয়ে বেশি বোধহয় চিঠিতেই পাওয়া যায়।

বক্তব্যে শ্রদ্ধা।

অথচ চিঠি থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে মানুষ! সময়ের প্রয়োজনেই হয়তো!!

অনিঃশেষ শুভকামনা।

অনেক ভালো থাকবেন। সবসময়।

১৭ ই জুন, ২০১৫ রাত ১১:৩২

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: সময়ের প্রয়োজনে কতো কিছু হারিয়েছি আমরা। কিন্তু যা হারিয়েছি তা নিয়ে আর দুঃখ করার কিছু নেই। পেয়েছিও তো অনেক!
অনেক অনেক ধন্যবাদ মনোযোগ দিয়ে লেখাটি পড়ার জন্য।

৫| ১৭ ই জুন, ২০১৫ রাত ১১:৪২

শতদ্রু একটি নদী... বলেছেন: চমতকার শেয়ার। ট্যাগ কমেন্ট, পরে পড়ার জন্য।

২২ শে জুন, ২০১৫ দুপুর ২:৩৭

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: পড়ে নেবেন সময় করে। অবশ্য পোস্টটা বড় হয়ে গেছে

৬| ২০ শে জুন, ২০১৫ রাত ৯:০৬

অপ্রকাশিত কাব্য বলেছেন: পুরো টা পড়তে পারিনি! তবে পড়ে নেবার প্রবল আগ্রহ আছে

২২ শে জুন, ২০১৫ দুপুর ২:৩৮

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: পোস্টটা অনেক বড় হয়ে গেছে। সময় করে পড়ে নেবেন

৭| ২১ শে জুন, ২০১৫ রাত ১০:৪৯

চাঁদগাজী বলেছেন:

আপনি সাহিত্যের মানুষ; সাহিত্যের দিকপালদের নিয়ে কথা বলছেন; আমি কিছুটা পড়েছি, ভালো লেগেছে; বাকীটুকু পড়বো।

কিছুদিন আপনার পোস্টে আসা হয়নি।

২২ শে জুন, ২০১৫ বিকাল ৩:২৬

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: সাহিত্যের মানুষ হওয়া বিশাল ব্যাপার। আমি নিঃসন্দেহে হতে পারিনি এখনও। তবে ভালোবাসি সাহিত্য। সময় হোলে বাকিটুকু পড়ে নেবেন আশা করি

৮| ২১ শে জুন, ২০১৫ রাত ১১:৫১

বিষের বাঁশী বলেছেন: চমৎকার!

২২ শে জুন, ২০১৫ বিকাল ৩:২৭

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: ধন্যবাদ :)

৯| ০৫ ই জুলাই, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৫৭

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: অসাধারণ সংগ্রহ নিঃসন্দেহে। প্রিয়তে নিলাম।

০৮ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১২:৫২

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: ধন্যবাদ প্রোফেসর অনেক

১০| ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ২:১৪

মাহমুদ০০৭ বলেছেন: গুগল সার্চ করে আস লাম আপনার লিঙ্কে ।
আপনার লেখা দেখে খুব খুশি হলাম । প্রিয়তে পোস্ট । আমার কাছে আরণ্যক সেরা ।

০৩ রা এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৯:১৬

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: হা হা। এতদিন পড় দেখলাম কমেন্টটা!! আরো আগে দেখা উচিৎ ছিল!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.