নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মাতাল ঋত্বিক আমি, প্রেমকথা আমার ঋগ্বেদ

আরণ্যক রাখাল

মাতাল ঋত্বিক আমি, প্রেমকথা আমার ঋগ্বেদ

আরণ্যক রাখাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প- সূর্যাস্ত, বৃষ্টি ও দরজা

২০ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১১:০২

জেগে ওঠার পর থেকে কিছুই বুঝতে পারছে না রেজা। অস্পষ্ট লাগছে সব। বিছানায় শুয়ে আছে ও, এটা শুধু বুঝতে পারে। কাঁথা একটা গায়ে চাপা দেয়া। গন্ধ আসছে সেটা থেকে। শুকনো গন্ধ। সর্দি লাগলে যেমন করে নাকটা, তেমন করছে। কয়েকবার শ্বাস ছাড়ে জোরে জোরে। সর্দি লাগল নাকি? ঘুমাবার আগে তো সর্দি ছিল না? ধুলো দিয়ে ভর্তি কাঁথাটা। হাত একটু নাড়তেই সামান্য-খোলা-জানালার গ্রিল গড়িয়ে আসা আলোতে অনেক ধুলাবালির ওড়া দেখল ও। কাঁথাটা আস্তে করে সরিয়ে ফেলে শরীর থেকে। উঠে বসে। জানালাটা সামান্য খোলা। এতোই সামান্য খোলা যে মধ্যাহ্নের সূর্যের কৃপা শুধু জানালাটাকেই আলোকিত করেছে আর একটু আলো ঘুমিয়ে রয়েছে বিছানায়।
দুপুর হয়ে গেছে? এই অভ্যাসটা গেল না রেজার- দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা। হাই তোলে একটা। আড়মোড়া ভাঙে।
বিছানায় বসেই থাকে রেজা। টিকটিকি একটা জানালার গ্রিল বেয়ে উঠতে থাকে। একটা পিঁপড়াকে লক্ষ করেছে টিকটিকিটা। খুব আস্তে এগিয়ে যায়। খুব আস্তে। পিঁপড়াটার মাথায় সাদা কি একটা ভার। সাদা ভারটা কালো পিঁপড়াটার মাথার মুকুটের মতো লাগে। খাবার নিয়ে যাচ্ছে? পিলপিল করে এগোয় পিঁপড়াটা। থামেনা একটুও। সামনে বিশাল রাস্তা। অনেক পথ যেতে হবে নিরাপদ গন্তব্যের জন্য। টিকটিকিটা আস্তে হাটে। কোন শব্দ নেই। গ্রিলের জঙধরা লোহা সাহায্য করে টিকটিকিটাকে। পিঁপড়াটা ঠিকমতো এগোতে পারছে না। দ্রুত যায় এবার টিকটিকি।
রেজা জঙধরা গ্রিলের দিকে তাকিয়ে থাকে। টিকটিকি। টিকটিকি। টিকটিকি। কাঠ। পাল্লা। টিকটিকি। পিঁপড়ে। আলো। অন্ধকার। মেঝে। দেয়াল। শ্যাওলা। আবার টিকটিকি। দেয়াল। শ্যাওলা। পিঁপড়েটা নেই। অন্ধকার। পিঁপড়েটা টিকটিকির পেটে। কতোগুলা পিঁপড়ে আছে টিকটিকিটার পেটে? ওরা নড়াচড়া করছে। টিকটিকিটার পেটে কামড় দিচ্ছে। মাংস জ্বালা করছে টিকটিকিটার। অন্ধকার। দরজা। কাঁথাটা গন্ধ করছে। নাকে সর্দি। একটা মশা ভিনভিন করছে। হাতে বসেছে। একটা পায়ে। কামড়াক। ওড়াত আর খেয়ে ফেলছে না?
টিকটিকির লেজ খেলে পাগলা হয়ে যায় মানুষ। নেন্দু এইভাবেই পাগলা হয়েছে।
“আরে টিকটিকির লেজ মারাত্মক জিনিস” বলে হাপান চাচা। দম নেন কথা বলার জন্য। আবার শক্তি সঞ্চয় করে বলেন, এমনভাবে বলেন যেন তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছেন যেটা আর কারো শোনা উচিত না। “নেন্দুকে এই টিকটিকির লেজ খাইয়েই পাগল করল।” গোপন কথাই বটে।
“নেন্দু গাঞ্জা খায় জানিস তো। ওই লেজ পুড়িয়া গাঞ্জার সাথে মিশায় দিছে। ব্যাস”।
শিউড়ে ওঠে রেজা। গাঞ্জা না খেলেও সিগারেট খায় সে। কেউ যদি সিগারেটের সাথে মিশিয়ে দেয়। কে দেবে? “আমার তো কোন শত্রু নেই”। তবুও লোম ওর খাড়া খাড়া হয়ে যায়। হে হে। হাসিও পায় আবার। সিগারেট তো আর গাঞ্জার মতো হাতে বানাতে হয় না।
কিন্তু রেজার লোম খাড়া হয়ে গেছে। নেন্দু কি বঝেনি আগে যে ওর গাঞ্জায় টিকটিকির লেজ মেশানো হয়েছে? বুঝবে কীভাবে? ওরা তো আর কম আটঘাট বেঁধে কাজটা করেনি। তবুও। তবুও।
ঠাণ্ডা লাগে ওর। ভয় পেলে ঠাণ্ডা লাগে কেন? ফুলহাতা সার্টটা এতক্ষণ কনুই পর্যন্ত মোড়ান ছিল, ছেড়ে দেয় সম্পূর্ণ।
বারান্দায় বসে চা খায় ওরা। একটা টিকটিকি লাফ দিয়ে ওর গায়ে পরে। সরসরিয়ে গা বেয়ে উপরে ওঠে। কিলবিল করে ওঠে সম্পূর্ণ শরীর। প্রতিটি কোষ যেন চমকে ওঠে। কাঁপুনি দেয় সারা দেহ। চমকে উঠে দাঁড়ায় ও। পা লাফায়।
না টিকটিকি না। পাতা। গ্রিলের ফাক দিয়ে ঢুকে পড়েছে বাতাসে। ইউক্যালিপটাস পাতা। কি রং রে বাবা। মেটে। একদম টিকটিকির মতো। ইউক্যালিপটাসের পাতার গন্ধ অনেকটা তেজপাতার মতো। তেজপাতার মতো না ঠিক কিন্তু একটা ঝাঁঝ পাওয়া যায়। রেজা পাতাটা হাতে নিয়ে পিষে ফেলে। মনে হয় তামাক পিষছে। বিড়ির ভেতরের তামাকের মতো ছ্যাদা ছ্যাদা হলে নাকে নিয়ে গন্ধ নেয়।
ওর হটাত লাফিয়ে ওঠা দেখে চাচা হতচকিয়ে যায় খুব। ও তখন পাতা পিষছে।
“কি হোল?”
“কিছু না”
চাচা ওর দিকে বিহ্বল চোখে তাকিয়ে থাকে। চোখে একটুও বিস্ময় নেই। তিনি বোধহয় বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন।
টিকটিকিটা পিঁপড়েটাকে খেয়ে ফেলেছে। আচ্ছা পিঁপড়া না পিঁপড়ে? পিঁপড়াটাকে খেয়ে ফেলেছে টিকটিকিটা। রেজা দেখে থাকে টিকটিকিটার দিকে যেন সেই ক্ষুদ্র প্রাণীটির জীবন বৃত্যান্ত জানাই তার আজকের প্রধান কাজ।
টিকটিকিটা পিঁপড়াটাকে খেয়ে ফেলেছে। পিঁপড়াটাকে খেয়েছে নাকি পিঁপড়েটাকে খেয়েছে?
ঘুম থেকে উঠে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করার পর পিঁপড়া আর টিকটিকির লীলা দেখে রেজা। ঘরে সামান্য আলো, অল্প ফাঁককরা জানালা বেয়ে যা গড়িয়ে গড়িয়ে এসেছে বিছানা পর্যন্ত। ও একটা বিছানায় শুয়ে ছিল কিছুক্ষণ আগে এটা নিশ্চিত। এটা ভেবেই শান্তি পায় রেজা যে অনেক অনিশ্চয়তার মাঝে নিজের শুয়ে থাকাটা কিংবা ঘুমিয়ে পড়াটা অন্তত নিশ্চিত।
আবার আড়মোড়া ভেঙে দাঁড়া হয় রেজা। জানালাটা খুলে দেয়। ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে খুলে যায় সেটা। তীব্র আলো এসে মুখচোখ ঝলসিয়ে দেয় তার। পাল্লা একটা নড়বড়ে ছিল খুব। জানালাটার সাথে আটকে থাকার সর্বচ্চো চেষ্টা করে সেটা। কিন্তু খুলে পড়ে যায়। কয়েক মাইক্রোসেকেন্ড লাগে পাল্লাটার মাটিতে পড়ার শব্দ পেতে।
জানালার বাইরে তাকায় রেজা। একটা মেহগনি গাছের ডাল জানালার বাইরে তার চিরকুমার ভাব ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সবুজ পাতায় বসন্তের যৌবনপ্রাপ্ত হওয়ার খবর ব্যাপ্ত। পাতাটার রং সবুজ কিনা রেজা বুঝতে পারেনা। বেগুনি সবুজ বলে কোন রং আছে? থাকতেও পারে। জানালার বাইরে তাই বেগুনি সবুজ। আরেকটা বিল্ডিং দেখা যায় মেহগনি গাছটার পিছনে। সাইনবোর্ড জ্বলজ্বল করছে রোদে। “এক্মি গ্রুপ এন্ড ইন্ডাস্ট্রিস”। ইংরেজিতে লেখা।
“তারমানে আমি এখন একটা বিল্ডিঙের দোতালায় আছি, এতক্ষণ শুয়ে ছিলাম!”
ঘরটার ভেতরটা স্ক্যান করে রেজা। বাল্ব আর ফ্যান ছাড়া আর কিছুই চিনতে পারেনা সে। আয়নাও আছে একটা। জানালার কাছ থেকে আয়নার দিকে এগিয়ে যায় রেজা। পা ঠিকমতোই কাজ করছে, তারমানে ও এখন সুস্থ। কোন সমস্যা নেই।
আয়নাটা বিশাল। দরজাটার অর্ধেক হবে। সামনে একটা চেয়ার আছে। বসে সেখানে রেজা।
গালে হাত বুলাতে বুলাতে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। ওর চাপদাড়ি ছিল। কালোকালো দাড়িতে ওর কালো সাদা মুখটা আরো ফর্সা মনে হতো। এখনো দাড়ি আছে সারা মুখে কিন্তু কেমন যেন ছাড়া ছাড়া। এখানে আছে তো ওখানে নেই। গোঁফটা কামানো। মুসলমানি করেছে যেন কেউ গোঁফটার।
“গোঁফের পানি খাওয়া হারাম” শুনতে পায় রেজা।
ওর আব্বা বলছে। কণ্ঠ কাঁপছে তার। হাতে লাঠি, মাথায় টুপি। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তিনি রেজার গোঁফের দিকে তাকিয়ে বলছেন। রেজার অস্বস্তি লাগে। কেউ এভাবে একমনে কারো মুখ তাও আবার গোঁফের দিকে তাকালে অস্বস্তি লাগারই কথা। সেটা নিজ জন্মদাতা হলেও।
“গোঁফ কেটে ফেলসিছ ভালো হইছে, এবার থেকে নিয়মিত কাটবি”।
গোঁফের জন্য খারাপ লাগে তার। কিন্তু আব্বার প্রশংসা শুনে ভালো লাগে। কতদিন পর তিনি খুশী হলেন তার উপর! কতদিন পর! রেজার মনে পরে না কবে শেষ তার উপর আব্বা খুশী হয়েছিলেন। খুশী কী আদৌ কোনদিন হয়েছিলেন? রেজার মনে পড়ে না। ওর শুধু মনে পড়ে, আব্বার মেঘের মতো মুখ আর দরাজ গলা যেটাকে সবাই ভয় পায় এমনকি বড় ভাইও যে এখন কোন একটা উপজেলার ইউএনও।
রেজার মনে হয়- আজই প্রথম ওর প্রশংসা করল আব্বা। নরসুন্দরকে ধন্যবাদ দেয় ও।
“এবার ইমান্দারের বাচ্চা, মুসলমানের ব্যাটা ব্যাটা লাগছে। এতদিন থাকি হিন্দু হিন্দু মনে হইতেছিল”।
রেজা খুশী হবে না দুঃখিত, বুঝতে পারেনা। নিজের কামানো গোঁফের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ও। অনু বড় ভালোবাসতো! আব্বা এখনো ওর দিকে তাকিয়ে দেখছেন যেন নবাগত শিশুকে দেখছেন কোন নবীন পিতা। অস্বস্তিটা আবার ফিরে পায় রেজা। সঙ্কুচিত হয়ে যায় খানিকটা।
খট করে একটা শব্দ হয়। বায়ে তাকায়। একটা কালো বিড়াল। কোথায় আব্বা? দ্রুত দরজার দিকে তাকায় রেজা। কেউ নেই। দরজা লাগা সিটকিনি দিয়ে। দরজার স্থানে স্থানে কানা। সেই কানা দিয়ে অন্ধকার আসছে অথচ আলো আসা উচিত। এবার কালো বিড়ালটার দিকে তাকিয়ে থাকে ও। বিড়ালটা যেন হিপ্নোটাইস্ট হয়ে গেছে, একদম ওর চোখের দিকে তাকিয়ে। রেজা ভয় পায়। জ্বলজ্বল করছে চোখের মনি। জাহান্নামে হাবিয়া। দোজখ সাতটা। নাকি আঁটটা? আয়নার সামনে থাকা অনেকগুলো প্রসাধনীর কৌটা থেকে একটা নিয়ে ঢিল মারে বিড়ালটার দিকে। কিন্তু ও অবাক হয়ে লক্ষ করে একটুও ভয় পায়না বিড়ালটা। যেখানে বসেছিল সেখান থেকে একচুলও নেড়ে না। কৌটাটা ওর একদম পিঠ ঘেঁষে চলে যায়। রেজা চোখ সরিয়ে নেয় বিড়ালটা থেকে। আয়নার দিকে মনোযোগ দেয় আবার।
খোঁচা খোঁচা দাড়ি ছিল রেজার। এখন অন্য রকম হয়ে গেছে। ছাড়া ছাড়া। গোঁফের মুসলমানি করেছে মৌলবি নরসুন্দর কোন একজন। কৃতজ্ঞ বোধ করে সেই নাউয়ার উপর। কতো সুন্দর লাগছে আমাকে- ভাবে রেজা। একদম অন্যরকম। অনু খুব পছন্দ করবে। কিন্তু অনু বড় ভালবাসে গোঁফগুলো, আর শালা নাপিত কিনা সেটাই কেটে দিল। শালা মালাউন। শালা মৌলবি মালায়ুন।
নিজের মুখের ভাষায় নিজেই চমকে যায় রেজা। মালায়ুন? মালায়ুন শব্দটা ও উচ্চারণ করতে পারল? কালো বিড়ালটা এখনো ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ম্যাও। ম্যাও। না বিড়ালটা ডাকছে না। কিন্তু রেজার মস্তিষ্কে শব্দ সৃষ্টি হয়। ম্যাও। ম্যাও। চোখ পাকিয়ে তাকায় রেজা বিড়ালটার দিকে। এবার ওকে কিছু করতে হয় না। বিড়ালটা নিজেই কেটে পড়ে। নিঃশব্দে হেঁটে বেড়িয়ে যায় অন্ধকার; আলোতে।
আবার আয়নায় মনোযোগ দেয় রেজা- ‘আয়নায় একটা কালো বিড়াল’। চুলগুলো অনেক বড় হয়েছে কিন্তু নরসুন্দর চুলের কোন পরিবর্তন করেননি। কাধ পর্যন্ত নেমে গেছে চুল একেবেকে। বাহ। সার্টটাও তো সুন্দর। বালু রঙের সার্ট। লম্বা হাঁটু পর্যন্ত। কিন্তু ভালো দেখায়।
নিজেকে খুব সুন্দর মনে হয় রেজার। এতো সুন্দর দাড়ি, সার্ট। আহা। এতো সুন্দর কোনদিন লাগেনি নিজেকে। কিন্তু সব যেন একটু মলিন। ময়লা দেখা যাচ্ছে স্থানে স্থানে জামাকাপড়ের। শরীর থেকেও ঘামের গন্ধ আসছে। নাহ গোসল না করলেই নয়। অবশ্য ও ঘুমাবার আগে গোসল দিয়েছিল একবার আচ্ছাসে। কিন্তু এখন আবার দিতে ওর আপত্তি নেই।
আবার ঘরটার চারিদিকে তাকায় রেজা। জানালাটা আবার বন্ধ করে দিয়েছে কে যেন। আবার অন্ধকার। যে পাল্লাটা তখন খুলে গিয়েছিলো সেটা আবার কীভাবে যেন জোড়া লেগে গেছে। কীভাবে আবার জোড়া লাগল সেটা নিয়ে ভাবার অবশ্য সময় রেজার নেই। খুব সুন্দরসব জামা কাপড় পেয়েছে সে। নতুন দাড়ি আর গোঁফ পেয়েছে। চুল অবশ্য একটু বড় হয়ে গেছে, কাধ ছাড়িয়ে গেছে- কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না, এটাই নতুনত্ব ধরে নেয়া যায়।
ওই তো বিছানার ডান পাশে ওয়াশিংরুম। রেজা দ্রুত ওয়াশিংরুমের দিকে এগিয়ে যায়। এই দরজাটাও ক্ষতবিক্ষত, কানা- ফুটা। সেই কানাফুটা দিয়ে অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করে। বেসিনে হাতমুখ ধুয়ে নেয় রেজা। আহ কি আরাম। কি আরাম। যেন এক শতাব্দীকাল পানি স্পর্শ করেনি ও। এখন একটা কিছুদিয়ে হাতপা মোছা দরকার। না চিন্তার কোন কারণ নেই। এখানেই একটা গামছা আছে। কিন্তু গামছাটা ভেজা। তাই ও ভেজা মুখেই আবার আয়নার সামনে দাঁড়ায় রেজা।
আয়নার নিজের মুখ প্রতিফলিত হলে দেখে চমকে যায় ও। কালো। কালো কুটকুটে। যেন কালো বিড়ালটা তার দেহের সব রং, সব কালো তার মুখে মেখে দিয়েছে। সারা মুখে পিচমাখা যেন। ছাগলের পিঠের মতো দেখাচ্ছে তার মুখটাকে। পশমে ছেয়ে গেছে মুখ, শুধু নাকের নিচে পরিষ্কার জায়গা একটু। ওই জায়গাটুকু সাদা রং ধারন করেছে। ধবধবে সাদা। রাশিদা ভাবির বুকের মতো সাদা। একটুও স্পট নেই কোথাও। কিন্তু রাশিদা ভাবির বুকের মতো উঁচুনিচু নয় সেটা। সমতল।
চমকে গেলেও খুশী হয় রেজা। সুন্দর দেখাচ্ছে তো। ভালোই। নতুন একটা লুক।
এবার বেড়িয়ে যাওয়া যায়।
রেজা দরজার দিকে এগিয়ে যায়। ভাঙা দরজা। কানা ফুটা দরজা। একটা জিনিস লক্ষ করল, বুঝতে পারল রেজা যে জানালা আর দরজা ছাড়া ঘরটার সব সামগ্রী আসবাবপত্র একদম ঠিক আছে। কোন ত্রুটি নেই বাকি সব মালের। সিটকিনিতে হাত দেয় রেজা। টান দেয়। না খুলছে না। খুব জোরে আটা। জং ধরে গেছে। তেল দরকার একটু। সামান্য তেল দিলেই অনায়েসে খুলে যাবে চড়াত করে। রেজা তেল খোঁজে সারা ঘরে।
তেলের গন্ধ পায় রেজা কিন্তু কোথায় আছে বুঝতে পারে না। কিন্তু গন্ধটা খুব কাছ থেকেই আসছে। একটা মশা গালে পরে রেজার। থাপ্পর লাগায়। মশাটা পালিয়ে গেলে হাতটা পিছলে যায়। তেল। অনেক তেল মুখে। হাতটা চোখের সামনে নিয়ে আসে রেজা। এতক্ষণ তাহলে তার মুখ থেকেই তেলের গন্ধ আসছিল। সে তাহলে তেল দিয়ে হাতমুখ ধুয়েছে! বিস্মিত হওয়া আর হয়ে ওঠে না রেজার। তার আগেই কথা থেকে যেন কালো বিড়ালটা আবার ফোরে এসে “ম্যাও” ডাক ছাড়ে। ওর তেলের প্রতি যে একাগ্রতাটা ছিল সেটা বিভক্ত হয়। ম্যাও। ম্যাও। বিড়ালটার গোঁফ নেই। গোঁফ ছাড়া খুব খাপছাড়া লাগে বিড়ালটাকে। রেজারও গোঁফ নেই- এটা তার আবার মনে পরে যায়। কালি বিল্লিটাকে খারাপ দেখায়, কুতসিত লাগে কিন্তু নিজেকে সুন্দর সুদর্শন লাগে রেজার।
তেলের সন্ধান তাহলে পাওয়া গেল। এবার দরজায় দিলেই খুলে যাবে সেটা। বেসিন থেকে একমুঠো তেল আনে রেজা। মেখে দেয় সিটকিনিটায়। না এবার ঠিক আছে। অনায়াসে খুলে যায় দরজা। এমনকি কোন শব্দও হয় না। তেল দেয়ার সাথে সাথেই কীভাবে যেন দরজার ফুটাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। সেই ফুটা গুলো দিয়ে সামান্য অন্ধকাররূপী আলো আসছিল। এবার সেই আলোর পথও বন্ধ হয়ে গেল। নিকষ অন্ধকার হয়ে যায় ঘরটা। হোক অন্ধকার রেজার কি? ও তো আর এই বদ্ধ ঘরে আর ফিরে আসছে না? কি গন্ধ কাঁথাটার! এখনো নাকে লেগে আছে।
দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বেড়িয়ে আসে রেজা।


আকাশ কালো করে বৃষ্টি আসে। সূর্যটা ডুবে যায় একাকাশ আঁধারে। সন্ধ্যা নেমে আসে যেন। বৃষ্টি। কালো কাঁদা আর বিশ্রী পানি। তিব্বত কদুর তেলের কথা মনে পরে রেজার। একসময় রেজার মা তিব্বত কদুর তেল মাথায় দিত। বারান্দায় মা পিড়িতে বসে আছেন পা ছড়িয়ে। তার মাথার কদুর তেল দিচ্ছে কাজের মেয়েটা। বেশিরভাগ দিন পাশের বাড়ির বীথি এসে তেল দিয়ে দেয় মাথায়। বীথি ওর দিকে তাকিয়ে হাসে। বিশ্রী লাগে রেজার। দাঁতগুলো ট্যাঁরা ট্যাঁরা। ওর মনে হয় এই মেয়ে যেকোনো সময় কামড়ে দিতে পারে ওকে। সাদা সাদা ট্যাঁরা দাঁত মাংসে অনুভব করে রেজা। বৃষ্টি পড়ছে। তিব্বত কদুর তেল দিত মা।
বৃষ্টিতে নিচতলায় নেমে থেমে যায় রেজা। বারান্দায় এসে দাঁড়ায় ও। দেখে পাশে ওর আরো কয়েকজন দাঁড়িয়ে। সবার চেহারা ওর মতোই কালো। কুটকুটে কালো। একটা ছাত্রকে চিনতে পারে ও। ছাত্রটিকে চিনতে পারেনা ও; কিন্তু ছেলেটা যে ছাত্র সেটা চিনতে পারে। ছাত্রটা একটু ভিন্ন। ওর মুখ এখনো কালো হয়নি। কালচে। কালচে লাল। ছেলেটার মুখে এখনো দাড়ি গজায়নি। কিন্তু গোঁফ দেখা দিয়েছে সামান্য। কি সুন্দর গোঁফ ছেলেটার। ছাড়া ছাড়া কচি ঘাসের মতো। কুকুর একটা সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, ভিজতে ভিজতে। কুকুরটার পিঠ ঝলসানো। গরম পানি নয়তো আগুন কেউ ঢেলে দিয়েছে কুকুরটার পিঠে। ওর চামড়ার লোমগুলো চোখে পরে রেজার। ছাড়া ছাড়া। এখন রেজার মনে হয় ছাত্রটার মুখের গোঁফটা অনেকটা কুকুরের ঝলসানো পিঠের মতো লাগছে।
না, এই বৃষ্টি বোধহয় থামবে না। গুড়গুড়ি বৃষ্টি। আজ শিয়ালের বিয়ে হচ্ছে; কিছুক্ষণ আগে বসন্তের রোঁদ এখন বৃষ্টি! বৃষ্টি মাথায় নিয়েই হাঁটতে শুরু করে রেজা।
তুমুল বেগে বৃষ্টি পড়া শুরু করে এবার। যে যেখানে পারছে লুকিয়ে ফেলছে নিজেকে বৃষ্টি থেকে, এমনকি বাওছিটা পানিও সহ্য করছে না কেউকেউ, প্লাস্টিক ঢাকা দিচ্ছে শরীরে।
রাস্তায় একাই হাঁটছে রেজা। ওকে দেখছে, সবাই রাস্তার পাশের দোকানগুলোয় দাঁড়িয়ে। ও ভ্রুক্ষেপ করে না। জোরে জোরে হাটে সে।
ছপাত ছপাত শব্দ হয় পায়ের, কাদায় পা পড়লে পিছলে যায় সামান্য। সামলে নিয়ে আবার শুরু করে। অনেকদূর চলে আসে রেজা। অন্তত ওর মনে হয় যে ও অনেকদূর এসেছে আগের অবস্থান থেকে। পিছুনে ফিরে তাকায়। যে বিল্ডিঙে ও ছিল সেটা দেখতে পায়না। রাস্তার আসেপাশের দোকানপাঠও কমে এসেছে। ছাড়া ছাড়া দোকান এবার। চায়ের দোকান, হোটেল।
রেজার মনে হয় ওর একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার। ক্লান্ত লাগে বড়। তাছাড়া অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভেজায় ঠাণ্ডাও লাগছে।
মসজিদগুলো থেকে আজানের ধনী আসে। ওঁর ভ্রুক্ষেপ হয় না। হেঁটেই যায়- কোন দিকে? পশ্চিম? বুঝতে পারে না রেজা। সেদিকেই মুখ করে আছে মসজিদগুলো । কিন্তু যেদিকে যাচ্ছে ওদিকে সূর্য ওঠেনা।
আরও কিছুদূর এগিয়ে গেলে বুঝতে পারে ও একটা যাচ্ছে না সেদিকে, সেই ছাত্রটাও ওঁর সহযাত্রী। ওঁর মুখ আর লালচে কালো কিংবা কাললালচে নেই, সম্পূর্ণ কালো হয়ে গিয়েছে। চোখ বন্ধ হয়ে গেছে ওঁর, নয়তো নিজেই চোখ বন্ধ করে হাঁটছে।
পিছনে আরও অনেকের পদশব্দ, সে রাস্তায় যাদের চায়ের দোকানে, হোটেলে, অফিসের বারান্দায় দেখেছিলো- সবাই ছাত্রটির মতো চোখ বন্ধ করে হাঁটছে, রেজার অবশ্য ছেলেটিকে আর ছাত্র মনে হয়না।
রেজার শুধু মনে হয়, ও যেদিকে হাঁটছে, ওরা যেদিকে হাঁটছে, এগিয়ে যাচ্ছে, সেদিকে সূর্য ওঠেনা। কিন্তু ও এগিয়ে যায়, পিছনেও অনেকে চলেছে।

মন্তব্য ১৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে জুলাই, ২০১৫ দুপুর ২:০৮

কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: আপনার নিয়মিত গল্প লেখার এই প্রচেষ্টাটা আমার বেশ ভালো লাগে। লেখা ভালো হচ্ছে, সামনে আশা করি আরো ভালো হবে।

আপনার প্রিয় লেখক কারা? বা কোন লেখকের লেখা আপনাকে অনুপ্রাণিত করে??

২১ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ৮:২৮

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: ধন্যবাদ কাভা ভাই। অনুপ্রাণিত হলাম।
বিভূতিভূষণ আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্পকার। তাছাড়া আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক, শহিদুল জহির, জহির রায়হান, বনফুল আর হাসান আজিজুল হকের গল্প বেশি পড়ি, তাঁরাই প্রিয় গল্পকার

২| ২১ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৫:৩৪

নীলপরি বলেছেন: ভালো লাগলো ।

২১ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১১:০৬

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে

৩| ২১ শে জুলাই, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৪৫

আহমেদ জী এস বলেছেন: আরণ্যক রাখাল ,



অন্ধকারের দিকে যাত্রা ।
ভালো লেগেছে বর্ননার কারিকুরি ।

২১ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১১:১৩

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: ধন্যবাদ অনেক ভাই।
আপনার নিয়মিত উপস্থিতি অনেক প্রেরণা যোগায়।

৪| ২১ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১১:২৫

জেন রসি বলেছেন: আপনার গল্পে হতাশাময় যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়!

গল্প ভালো হয়েছে।

২২ শে জুলাই, ২০১৫ সকাল ৯:২৫

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: হতাশা কিনা জানি না, কারণ ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব আশাবাদী।
ধন্যবাদ আপনাকে অনেক

৫| ২২ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৩:১৪

হাসান মাহবুব বলেছেন: ডার্ক, মেটাফরিক, এন্ড গ্লুমি! ভালো লেগেছে আমার চায়ের কাপ।

২৪ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১০:৫৪

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: :) ভালো লেগেচে ামার চায়ের কাপ মানে বুঝি নাি

৬| ২২ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ৯:১৩

দীপংকর চন্দ বলেছেন: ও যেদিকে হাঁটছে, ওরা যেদিকে হাঁটছে, এগিয়ে যাচ্ছে, সেদিকে সূর্য ওঠেনা। কিন্তু ও এগিয়ে যায়, পিছনেও অনেকে চলেছে।

শুভকামনা থাকছে।

অনেক ভালো থাকবেন। সবসময়।

২৪ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১০:৫৬

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: ধন্যবাদ অনেক আপনাকে

৭| ২৪ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১১:২৪

হাসান মাহবুব বলেছেন: মানে, My cup of tea. যেমনটা আমি পছন্দ করি। একটা দাড়ি থাকার কথা ছিলো মাঝখানে।

২৪ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১১:৩২

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.