নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মাতাল ঋত্বিক আমি, প্রেমকথা আমার ঋগ্বেদ

আরণ্যক রাখাল

মাতাল ঋত্বিক আমি, প্রেমকথা আমার ঋগ্বেদ

আরণ্যক রাখাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

কেন নিষিদ্ধ হবে না \'ফেয়ারনেস ক্রিমের\' বিজ্ঞাপন? নিজেদের তবে রেসিস্ট বলেই ডাকি?

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ২:৫৪


কোন একটা জাতি, ধর্ম, গোত্র, উপগোত্র, বর্ণ থেকে নিজ জাতি, ধর্ম, গোত্র বা বর্ণকে উচ্চ মনে করাই বর্ণবাদ বা রেসিজম। ভিন ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ, উগ্র জাতিয়তাবাদ এই রেসিজমের আওতায় পড়ে। পৃথিবীর সব ধর্মের মানুষই অন্য ধর্মাবলম্বীদের ছোট করে দেখে, অন্য ধর্মকে ভ্রান্ত মনে করে। এই সাম্প্রদায়িকতাই রেসিজম। উগ্র জাতিয়তাবাদ কতোটা বিধ্বংসী হতে পারে তা দেখেছে বিশ্ববাসী ২য় বিশ্বযুদ্ধে। জার্মানদের মধ্যে হিটলার এই উগ্র জাতিয়তাবাদ জন্ম দিয়েই হত্যা করিয়েছেন ৪০ লাখ ইহুদিকে। তিনি তাদের বুঝিয়েছিলেন, জার্মানরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি- তারা উচ্চতর যেকোন জাতিগোষ্ঠী থেকে; সারা পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ তাই জার্মানদের হাতে থাকা উচিৎ। এই শ্রেষ্ঠত্বের নেশায় মরিয়া হয়ে উঠেছিল তারা। ঠিক এমন প্র্যতয় ফুটে ওঠে ইসলামী জিহাদিদের কণ্ঠে। ইসলাম শ্রেষ্ঠ ধর্ম, ইসলামের পথ ছাড়া মুক্তি নেই কিছুতেই- এই বিশ্বাস থেকেই তারা মেতে উঠেছে ধ্বংসলীলায়। সারা দুনিয়াকে ইসলামের ছায়াতলে আনার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। হত্যা করছে- মানুষ মারছে। নিজ ধর্মকে শ্রেষ্ঠ মনে করে অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি যে ঘৃণা- এসবকে রেসিজম ছাড়া আর কীই বা বলা চলে?
আমাদের দেশে রেসিজমের ইতিহাস অনেক পুরনো। রাজা বল্লাল সেন হিন্দুদের ৩৬ ভাগে ভাগ করে রেসিজমকে নিয়ে গিয়েছিলেন নতুন মাত্রায়। আজও সেই কৌলীন্য প্রথা বিদ্যমান। যত শিক্ষিতই হোক, কোন ব্রাহ্মণ শূদ্র পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করেছে, শুনিনি। অন্তত আমার পরিচিত, আশেপাশের কেউ করেছে- এমনটাও দেখিনি। আমার এক শিক্ষক ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে পাচ্ছিলেন না বলে অবিবাহিত ছিলেন আটচল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত! শেষে মেয়ের বয়সী ১৭ বছরের এক ব্রাহ্মণকন্যাকে বিয়ে করে ঘরে এনেছিলেন তিনি।
রেসিজম বা বর্ণবাদের নতুন আরেকটি রুপ আমাদের দেশে ঝাণ্ডা গাড়ে, ইংরেজরা এদেশে আসার পর। এ বর্ণবাদ আক্ষরিক অর্থের বর্ণবাদ!
বাংলাভূমি- শুধু বাংলা কেন পুরো ভারতবর্ষই বিদেশী শক্তির কাছে পরাভূত হয়ে ছিলো হাজার বছর ধরে। পালেরা ছিল বাঙালি শেষ রাজবংশ। এরপর শক, হুন থেকে মুঘোল। যে নবাবের পতনে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিলো বলে ধরা হয়, সেই সিরাজ বাঙালি ছিলেন না। উর্দুতে কথা বলতেন তিনি। জাতিতে মুঘোল। সিরাজের পতনের পরপরই যদি ইংরেজেরা ক্ষমতার না শিখরে উঠত, তাহলে হয়তো তাকে নিয়ে আজ এতো মাতামাতি হতো না। নাটক লেখা হতো না, হতো না সিনেমা। ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তিনি তার সাম্রাজ্য বাঁচাতে চেয়েছিলেন শুধু, স্বাধীনতা রক্ষা তার উদ্দেশ্য ছিল না।
এরপর যে ইংরেজেরা আসল, তারা সাদা চামড়ার। ভারতবাসী দেখল, সবখানে সাদা চামড়ার মানুষের জয়জয়কার। সাদা চামড়ার আধিপত্য। তারা মালিক, তারা নিয়ন্তা। স্থানীয় রাজা-মহারাজা-জমিদারেরা পর্যন্ত তাদের সেলাম ঠুকছে। তাদের কথা মেনে নিচ্ছে। এই যে সম্ভ্রম তৈরি হলো সাদা চামড়ার ইংরেজদের প্রতি সাধারণ মানুষের- এর থেকেই পাল্টে গেল সৌন্দর্যের সংজ্ঞা। তাদের মনে প্রোথিত হয়ে গেল- সাদা চামড়া মানেই সুপিরিয়র। সাদারা সুন্দর। যারা দেখতে একটু ফর্সা, তারা তাই হয়ে উঠল সৌন্দর্যের প্রতীক।
ঔপনিবেশিক যুগের অনেক বাঙালি লেখকের লেখায় তাই দেখা যায়, নায়কের রুপ বর্ণনায় তারা লিখছেন, “সাহেবদের মতো গায়ের রঙ”!
সাদা অর্থাৎ ‘ফেয়ার’দের এই যে সুন্দর মনে করার প্রবণতা- এটা কিন্তু খুব প্রাচীন নয়। ১৬০০ গোপীর প্রেমিক কৃষ্ণ ছিল কুটকুটে কালো। ডাকনাম তাই ‘কালা’। এই কালার প্রেমে মজেই রাঁধা কংসের সংসারের মায়া ত্যাগ করতে পরোয়া করেনি। ঝড়ের রাতে সাপের ফণা তুচ্ছ করে গিয়েছিলো তার কাছে। (শারীরিকভাবে অক্ষম ছিল রাঁধার স্বামী ‘কংস’- এটাও একটা কারণ হতে পারে রাঁধার অভিসারের। ‘কংস মামা’ প্রবাদটা সেখান থেকেই উদ্ভূত। এর মানে “নির্মম আত্মীয়”। কংস কৃষ্ণের মামা ছিল)
ইংরেজরা আসার আগ পর্যন্ত কালোদেরই সুন্দর চেহারার অধিকারী ভাবা হতো- মুখশ্রী সুন্দর হলে। এর প্রমাণ- কৃষ্ণের ১৬০০ গোপী। প্রাচীন বাংলার মেয়েরা যদি কালো চামড়ার ছেলেদের পছন্দ না-ই করতো, তবে বড়ু চণ্ডিদাস নির্ঘাত কৃষ্ণের গায়ের রঙ সাদা করে দিতেন! “সাহেবের মতো” হতো তার মুখশ্রী! (তখন হয়তো কৃষ্ণের নাম কৃষ্ণের হতো না। হতো ধওলা!) ইংরেজেরা আসার পরই সৌন্দর্যের সংজ্ঞা পাল্টে গেল আমূল। কালোর জায়গা দখল করে নিল সাদা। এরপর থেকেই সামান্য টাকাওয়ালা শ্বশুরের চাই “দুধে আলতা বদনের” পুত্রবধূ। কালো মেয়ের বাবারা তাই মেয়ের গায়ের রঙ ঢাকতে দিতে লাগলেন নিজের ওজন সমান পণ।
আজ ৭০ বছর হয়ে গেল ইংরেজেরা ভারতবর্ষ ছেড়েছে। কিন্তু যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়েই গিয়েছে তাদের শাসনের দুশো বছরে। আজ এতো বছর পরও সাদা চামড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ একচুল কমলো না। বরং বাড়ে চলেছে দিনদিন। প্রতিদিন। ফেয়ারার স্কিনের প্রতি মানুষের এই ফন্ডনেস বিতর্কের কারণ হতো না কোনদিনও- যদি না এই ফন্ডনেস রুপ নিত রেসিজমে।
বাংলার বিখ্যাত কবি, হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন কালো। তিনি প্রচন্ডভাবে দুর্বল ছিলেন ফর্সা মেয়েদের প্রতি। কয়েকবছর প্রেম করার পরও তার কালো প্রেমিকাকে বিয়ে না করে ফর্সা এক মেয়েকে (সাইদা হাসান) বিয়ে করেছিলেন তিনি। সাহিত্যিক কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরী একথা লিখে গিয়েছেন তার আত্মজীবনীতে। হাসান হাফিজুর রহমানের এই সাদা-চামড়া-প্রীতিকে কি বলা যায় রেসিজম ছাড়া? ফন্ডনেস?
ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে আমাদের অর্জিত এই “সাদাচামড়া প্রীতির” প্রধান স্বীকার এদেশের মেয়েরা। গায়ের রঙ কালো হলে তো কথাই নেই- জন্মের পরপরই বাবা মায়ের ঘুম হারাম হয়ে যায় “কীভাবে মেয়ের বিয়ে দেবেন” ভেবে। টাকার অভাব না থাকলে সে চিন্তা থেকে মুক্ত হন তারা কিছুটা- তবে সামান্য দরিদ্র হলে তো কথা নেই। মেয়ের বিয়ে দেয়াটা তখন পর্বত ডিঙ্গানোর মতো।
এক বড় ভাইয়ের সাথে একদিন তার বিয়ে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। কথায় কথায় তিনি বললেন, “আমি তো ট্রাকের টায়ারের মতো কালো রে। আমার বৌ যদি ফর্সা না হয় তাহলে তো বাচ্চা আফ্রিকান জন্ম নিবে।“
“ক্যান কালো বাচ্চা ভালো লাগে না?”
“কুউটনেসের একটা ব্যাপার আছে না? ধপধপে বাচ্চা- গোলগাল- কুইট।”
সেদিন তাকে কিছু বলিনি। পাইনি খুঁজে বলার মতো কিছু।
এলাকার অনেক মহিলাকে বলতে শুনেছি- “ছেলে কালো হলে সমস্যা নেই। কিন্তু মেয়ে ফর্সা না হলে ভালো লাগে না”। তাদের যে কালো মেয়ে পছন্দ নয় এটা প্রমাণ করেই ওরা বহুত টাকার বিনিময়ে ছেলে বিক্রি করে “ফর্সা বৌ” নিয়ে এসেছেন!
Quora.com এ Priya Darshni নামের একজনের কমেন্ট পড়েছিলাম দুএকদিন আগে। তিনি লিখেছেন, “আমি মা হতে চলেছিলাম, তখন প্রেগনেন্সির নবম মাস। আমি দেখতে কালো, আমার স্বামী ফর্সা। এটা নিয়ে আমাদের কোন সমস্যা হতো না। ... এক পারিবারিক ফাংশনে ওর ভাগনে বাড়িতে এসেছিল। বেশ নামীদামী কলেজে পড়ত সে। সে চায়, আমার ছেলে বাচ্চা হোক।
বললাম, “আমার বাচ্চাটা যেন সুস্থ হয়। ছেলে মেয়েতে কিছু যায় আসে না।”
ভাগনে তখন বলল, “না না। আমি সত্যিই চাই তোমার যেন ছেলে হয়। কারণ ছেলে হলে, সে যদি কালোও হয় তোমার মতো, তাও সমস্যা নেই। কিন্তু ভাবো, তোমার মেয়ে যদি তোমার মতো কালো হয়, তোমার স্বামীর মতো না হয়ে, তখন? মেয়েদের একটু ফর্সা হওয়া চাই!”
... তার কথায় আহত হয়েছিলাম খুব। কিন্তু আমি তাকে দোষ দিচ্ছি না। কারণ তাকে যা শেখানো হয়েছে, যা দেখেছে সে- তাই বলেছে।”
দোষটা কার তবে? একটা ছেলে জন্মের পরপরই তো রেসিস্ট হয় না!
দোষটা সমাজের, মিডিয়ার, সরকারের।
আমাদের নাটক-সিনেমা-টেলিফিল্মের নায়ক-নায়িকারা ফর্সা, বাড়ির সামনের পোষ্টারে যে মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে সে ফর্সা, ভালো রেজাল্ট করেছে বলে যে মেয়েগুলো V চিহ্ন দেখাচ্ছে সে ফর্সা। আমাদের গল্প-উপন্যাসে নায়িকারা ফর্সা হয়।
সৌন্দর্যের আর কোন রুপ কি আমরা দেখিয়েছি শুধু দেহের রঙ ছাড়া? তারা তো সৌন্দর্য বলতে ফর্সা রঙ থাকাকে বুঝবেই!
আজকাল টিভি খুললেই “ফেরার এন্ড লাভলি” টাইপ অনেক পন্যের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। সেসব বিজ্ঞাপনে, কীকরে একটা মেয়ে শুধুমাত্র ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে, স্কিন “ফেয়ারার” করে সফল হলো তার গল্প বলা হয় ছোট্টকরে। যেন ফর্সা হওয়া সফল হওয়ার সমার্থক! আর এসব বিজ্ঞাপনের মডেল দেশ বিদেশের সফল ব্যক্তিরা- নায়ক, খেলোয়ার- যাদের সাধারণ মানুষ আইকন মনে করে থাকে। পুরুষদের ত্বক ফর্সাকারী(?) ক্রিমগুলোর নাম তো আরও চটকদার। “ফেয়ার এন্ড হ্যান্ডসাম”! আপনাকে হ্যান্ডসাম হতে হলে ফেয়ার হতে হবে আর এজন্য ডলতে হবে সেই প্রোডাক্ট।
এদেশের কিছু সাহিত্যক তো আরও একধাপ উপরে। কোন গল্পে নায়িকা কালো হলে, লেখা হয়, “সে কালো- তবে তার মুখে একটা অদ্ভুত মায়া আছে!” এখানে এই যে ‘তবে’ ব্যবহার করা হলো, এই ‘তবে’টাই বলে দেয় লেখকের মনোভাব। তিনি বোঝাতে চাচ্ছেন, “কালো মেয়েরা সুন্দরী হয় না। যদিও কালো আমার নায়িকা, তবুও সুন্দর! তার মুখে অদ্ভুত মায়া আছে।”
এধরণের বিজ্ঞাপনের, গল্পের, উপন্যাসের নেতিবাচক প্রভাব কতোটা তা উপলব্ধি করার জন্য ‘চিন্তাশীল’ “বুদ্ধিজীবী” হতে না। সামান্য চোখকান খোলা রাখলেই হয়। ফেইসবুকে আপলোড করা সাধারণ মানুষের পিকগুলো দেখলেই বোঝা যায়। যেসব পিক ফেইসবুকে আপ করা হয়- আপনি আমি করি- সেসব পিকের বেশির ভাগই এডিট করা। স্টোর, অ্যাপস্টোর, প্লেস্টোর-এ ফটো এডিটরের অভাব নেই। যাদের অন্যতম একটি কাজ পিকচার-সাবজেক্টকে “ফেয়ার” করা, মুখ থেকে কালো ভাব দূর করা। যেহেতু আমাদের ‘আইকনেরা’ ফেয়ার, মুখের রঙ কিঞ্চিৎ সাদা- তাই পাবলিক গণহারে নিজের চেহারাকে সাদা করার কাজে নিয়োজিত! যেভাবেই হোক- ফেয়ারনেস ক্রিম লাগিয়ে বা এডিটর ব্যবহার করে।
এই যে সাদা হওয়ার প্রচেষ্টা, ‘ফেয়ারনেস ক্রিমের’ বিজ্ঞাপনে ফর্সা হওয়াকে সফল হওয়ার অন্যতম উপায় বলে চিহ্নিত করা, “কালো হলে আপনি সুন্দর নন, আপনাকে ‘ফেয়ারার’ হবে”- এমনটা তুলে ধরা- এসবে কি কালো চেহারার মানুষদের অপমান করা হচ্ছে না? বলা হচ্ছে না চোখে আঙুল দিয়ে যে তারা অসুন্দর? ভেঙে দেয়া হচ্ছে না তাদের আত্মবিশ্বাস?
তবে এসব রেসিজম নয় কেন? আর রেসিজম হলে কেনই বা ব্যান করা হচ্ছে না “ফেয়ারনেস ক্রিম” টাইপ বিভিন্ন পন্যের বিজ্ঞাপন? আর আমাদের আইকনেরাই বা কেন এসব পন্যের মডেল হচ্ছেন? কেন চিহ্নিত করা হচ্ছে না সেইসব সাহিত্যিকদের রেসিস্ট বলে?
আমাদের দেশের খবরের কাগজগুলো দিব্য ট্রাম্পকে রেসিস্ট, সাম্প্রদায়িক, সেক্সিস্ট বলে গালি দিচ্ছে। তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করছে। সেই সাথে ফাঁক পেলেই লাগিয়ে দিচ্ছে, বিভিন্ন ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপন!
তবে কি ধরে নেব, তাদেরও সায় আছে এতে? তাদের কি শোভা পায় ট্রামকে সেক্সিস্ট, রেসিস্ট বলে গালি দেয়ার?

ব্লগের এই পার্টটা নিজের একটা অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করি। রবি ঠাকুরের ভাষায় বলতে গেলে, লিখতে হয়, "এ জীবনটা না দৈঘ্যের হিসাবে বড়, না গুনের হিসাবে। তবু ইহার একটু বিশেষ মূল্য আছে।"
মেসে নতুন উঠেছি তখন। সদ্য বাড়ি থেকে বেড়িয়েছি। গোটা জগৎটা অচেনা মনে হয়। ভয় লাগে- এই বুঝি ভুল করে ফেললাম। তাও সবকিছু কেমন হাতছানি দিয়ে ডাকে। যে মেসে উঠেছি, সে মেসের মালিক শহরের বিশাল হোমরা চোমরা ব্যক্তি। নিজেই রুম দেখিয়ে দিলেন। কেন তার মেস অন্য সব মেসের চাইতে ভাল- সবিস্তর বর্ণানা করলেন তা।
প্রথম দুএকদিনে পরিচিত হয়ে নিলাম মোটামুটি সবার সাথে। আমাদের সেই ব্লকে প্রায় সাতাশ জন থাকত। আমি থাকতাম সিঙ্গেল রুমে।
একদিন রাতে খুব হল্লা হচ্ছিল একজনের রুমে। কৌতুহল হলো। ভাবলাম গিয়ে দেখে আসি।
সেরুমে গিয়ে দেখি, মেজেতে একটা পেপার পেতে, মুড়ি মেখে খাচ্ছে সবাই। আর চিল্লাহল্লা হচ্ছিল এটা ওটা নিয়ে।
সেরুমের দরজায় আমাকে দেখে ওরা বিব্রত হলো যেন অনেকটা।
রুমে ফিরে এলাম তাই চুপচাপ। এটা ভেবে খারাপ লাগছিল যে, সবাই ছিল ওখানে অথচ আমাকে ডাকলো না। ডাকতেও তো পারত!
পরদিন এক বড় ভাই রুমে এসে জিজ্ঞেস করলেন, "***, তুমি হিন্দু?"
বললাম, "না।"
"তোমার নামটা বাংলা তো আর চেহারা দেখেও বোঝা যায় না। সবাই আমরা তোমাকে হিন্দু ভেবেছিলাম। তাই কাল রাতে তোমাকে ডাকিনি। কিছু মনে করিও না আবার।"
বড় ভাইয়ের কথাগুলো আমাকে ঝাকানি দিয়ে গেল যেন। আমি নতুন, আমাকে তারা চেনেনা, জানেনা- একারণে ডাকেনি- এটা শুনলে বরং ভালো লাগত। কিন্তু তারা আমাকে হিন্দু ভেবে আলাদা করে রেখেছে, এটা মেনে নিতে পারছিলাম না একটুও।
হিন্দুরা অনেককিছু খায় না, জানি। যেমনঃ গরুর মাংস। তবে এরা তো মুড়িতে চানাচুর মাখিয়ে খাচ্ছিল। সেখানে কি একজন হিন্দুকে ডাকা যেত না? মুড়ি চানাচুড়ে হিন্দু কিংবা ক্রিশ্চান কাররই আপত্তি থাকার তো কথা নয়!
তবে কি এই দূরে রাখা হিন্দু বলেই? ধর্ম এক নয় বলেই?
হ্যাঁ, তাই। আমাকে হিন্দু ভেবেই তারা ডাকেনি সেদিন।
নিজেকে খুব অসহায় লেগেছিল আমার। আলাদা করে দিয়েছিল যেন ওরা আমাকে। একা। খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লাগছিল নিজেকে। যেন গুটিয়ে গিয়েছিলাম সেদিন।
তারা সবাই শিক্ষিত। দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে চাকরির খোঁজ করছে কেউ কেউ। কেউ বা ছাত্র- লেখাপড়া শেষ হবে আর দুএক বছরের মধ্যেই। তাদের কাছ থেকে এমন ব্যবহার! এমন মানসিকতা তাদের?
মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়ে (সে ধর্মে বিশ্বাস করি বা না করি, সেটা পরের কথা), শুধু মাত্র চেহারা হিন্দুদের মতো হওয়ায়, যদি আমার এতো বাজে অভিজ্ঞতা হতে পারে, তবে সত্যিকারের হিন্দুদের কতবার এমন অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়? কতবার নিজেকে অসহায় মনে করে নিজ রুমে এসে দরজা আটতে হয়? প্রতিদিন? প্রতিবছর? সারাজীবনে?

রেসিজম শব্দের সমার্থক হচ্ছে “রেস ডিসক্রিমিনেশন’ বা ‘জাতিবৈষম্য”। আর এদেশে রাষ্ট্র কতৃক জাতি বৈষম্য লালন করা হয়। এদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। সংবিধানের শুরুতেই “বিসমিল্লাহ”! অর্থাৎ মুসলিমেরাই এই দেশের ১ম শ্রেণীর নাগরিক! মুসলিমেরাই মুখ্য। যেদেশে একটি ধর্মে বিশ্বাসী ছাড়া অন্য সব মানুষই ২য় শ্রেণীর নাগরিক, সেদেশে কিকরে চাই সমানাধিকার?
আমাদের দেশে সরকারী চ্যানেলে পর্যন্ত “ফেয়ারনেস ক্রিমের” বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। আসলে বিটিভি দিয়েই তো শুরু! যখন এতোএতো চ্যানেল ছিল না, তখন বিটিভিতেই দেয়া হতো সেসব ফেয়ারনেস ক্রিম, বডি লোশন, ফেস ওয়াসের বিজ্ঞাপন! রেসিজম প্রচারিত হত সরকারীভাবেই।
তবে কাকে বলছি এসব কথা? কার কাছে চাইব সমাধান?

মন্তব্য ৯ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৯) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৪:১৬

জেন রসি বলেছেন: বিভিন্ন সময় মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে কিছু ধ্যান ধারনার জন্ম দিয়েছে। এসব থেকেই আসলে তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে তাদের ধর্ম, জাতি কিংবা বর্ণ অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কেন তারা এমনটা বিশ্বাস করে? তার অনেক রকম ব্যাখ্যা আছে। তবে একবার ভেবে দেখুন যেসব সৈনিক ক্রুসেডে একে অপরকে হত্যা করেছিল তারা অন্ধের মত ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাস করেছিল বলেই সেটা পেরেছিল। যে জার্মান সৈনিকরা হিটলারের কথায় কোন রকম দ্বিধা ছাড়া হত্যার হলিখেলায় মেতে উঠেছিল তারা বিশ্বাস করত তারাই শ্রেষ্ঠ জাতি। খুব বেশী দূর যেতে হবেনা। আমাদের দেশের অনেক আওয়ামী বিএনপি সমর্থকদের মাঝেই এটা দেখতে পারবেন। তারা একে অপরকে আক্রমন করে অন্ধ বিশ্বাস থেকে। আসলে মানুষ যখন কিছু করে তখন সে সেটার করার জন্য একটা কারন খুঁজে।

পরম সত্য বলে এখনও কিছু পাওয়া যায়নি। তবে আমরা এখন জানি ধর্ম, রাষ্ট্র সব কিছুই মানুষের সৃষ্টি। সাদাদের মধ্যে এমন কিছু নেই যা কালোদের চেয়ে উত্তম। এই জানা থেকে আমরা অনেক বেটার কোন বিশ্বাস বা উদ্দেশ্য তৈরি করতে পারি।

আপনার পোস্ট ভালো লেগেছে।

১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৫:২৩

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: পুরোটার সাথে একমত এটুকু ছাড়া।
- "এই জানা থেকে আমরা অনেক বেটার কোন বিশ্বাস বা উদ্দেশ্য তৈরি করতে পারি।"
আসলে বিশ্বাস আমাদের ভুগিয়েছে অনেক। বিশ্বাসটাই এক সময় অন্ধ বিশ্বাসে রুপ নেয়। বঙ্গবন্ধুর কথাই ভাবুন। তাকে বিশ্বাস করে মানুষ লাফিয়ে পড়ল মুক্তিযুদ্ধে। এই বিশ্বাসটা তিনি অর্জন করেছিলেন, তার রাজনীতির বিশাল পথে, পাকিস্তান আন্দোলন থেকে এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে। জয় লাভের পর, তার প্রতি মানুষের বিশ্বাস এতোটাই বেড়ে গেল যে, তিনি যখন বাকশাল গঠন করলেন, তার বিপক্ষে বলার মতো শক্তিশালী কেউ রইল না। এদেশের বুদ্ধিজীবি থেকে শুরু করে কবি সাহিত্যিক পর্যন্ত সবাইযোগ দিল বাকশালে। শামসুর রাহমান ছাড়া।
তার ফলাফল তাকে নির্মমভাবে হত্যা। ধর্মবিশ্বাস যেমন ভুগিয়েছে আমাদের গোটা পৃথিবীকে, এমনটা ভোগাতে পারে যেকোন বিশ্বাসই।
আমি মনে করি, সবক্ষেত্রে যুক্তি আর মানবতা টেনে নিয়ে না আসলে এমনটা ঘটবে আগামীতেও।
তবে কিনা আমরা পরিবর্তনে ভয় পাই। যদিও ভিতরে ভিতরে পরিবর্তন হয়েছে অনেক। মানুষ এখন ধর্মে বিশ্বাস করলেও মানে না। এটা কিন্তু একটা বিশাল পরিবর্তন।
এই পরিবর্তনটা ইতিবাচক পথে হলেঈ বাঁচোয়া। আধুনিকতা যদি 'ফেয়ারনেস ক্রিমেই' আটকে থাকে- তবে তার দাম নেই কানাকড়িও।
অনেক ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটার জন্য।

২| ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৫:৩৯

জেন রসি বলেছেন: বিশ্বাস আমাদেরকে করতেই হয়। যেমন আগে মানুষ বিশ্বাস করত জিউস অলিম্পাস পাহাড়ে বাস করে। এখন মানুষ বিশ্বাস করে তার টাকা ব্যাংকে নিরাপদ আছে। কিন্তু সব মানুষ যদি একসাথে তাদের টাকা ব্যাংক থেকে তুলতে যায় তবে ব্যাংক তা দিতে পারবেনা। কারন সে পরিমান টাকা ব্যাংকে নেই। তবে জিউসে বিশ্বাসের চেয়ে ব্যাংকিং সিস্টেমে বিশ্বাসটা বর্তমান সময়ে কার্যকরী এবং যৌক্তিক। আবার ভবিষ্যতে আমরা যা এখন বিশ্বাস করি তাও বাতিল কিছু হয়ে যেতে পারে। এটাই হচ্ছে সভ্যতার অগ্রযাত্রা। আমি বিশ্বাস বলতে যৌক্তিক বিশ্বাসের কথাই বলতে চেয়েছি। এবং এটাও মাথায় রাখতে হবে আমার বিশ্বাস যতই আধুনিক বা বিজ্ঞানসম্মত হোক না কেন সেটাও পরম সত্য না। ভবিষ্যতে তার চেয়ে বেটার কিছুও আসতে পারে।

১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:১৮

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: কোন বিশ্বাসই পরম সত্য নয়, এটা জানলে আর পিছনে তাকাতে হবে না। কোন থিওরিi বেশিদিন টিকে থাকে না। সমস্যাটা হলো, থিওরিটাকে অটল. মনে করা।
এটাই ভোগাচ্ছে আমাদের।

৩| ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ২:১৭

হাসান মাহবুব বলেছেন: বাহ! সুন্দর বক্তৃতা। ব্যাফুক হাততালি হপে B-)

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৩:০১

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: :) :) :)

৪| ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ২:৩০

গেম চেঞ্জার বলেছেন: আমার মতে সাদাকে পছন্দ করাটা রেসিজম না। রেসিজম হলো কালোকে ঘৃণা করা, অবজ্ঞা করা, অস্বীকার করা। অধিকার হরণ করা। কালোকে অপছন্দ করা যেমন কোন সমস্যা না সাদা অপছন্দ করাও না।
আমি আমার এলাকায় এমন লোক পেয়েছি, যারা ইউরোপিয়ানদের মনে করে গিরগিটির মতো কিছু প্রানী। এমনও লোক পেয়েছি যারা ভাবে এইসব বাইরের লোক শয়তানের বাচ্চাকাচ্চা। মানুষ না। হাঃ হাঃ হাঃ

এই সবই হলো মুর্খামি আর ভুল দৃষ্টিভংগি, অন্ধত্বের কারণে। আবারো বলি, অপছন্দ করাটা রেসিজম না। রেসিজম হলো অকারণে ঘৃণা/অবজ্ঞা/অধিকার হরণ!!

৫| ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ১২:৪৪

নীলপরি বলেছেন: খুবই প্রাসঙ্গিক বিষয়ে পোষ্ট । ভালো লাগলো । তবে দু-একটা কথা বলতে চাই ।

রাঁধা < রাধা ( অর্থ আরাধিকা ) হবে । আর কংস রাধার স্বামী নয় । মথুরার রাজা ।তাঁকে বধ করতেই কৃষ্ণ গোকুলে রাধাকে ত্যাগ করে যায় । রাধার স্বামী আয়ান । তথ্যটা এডিট করতে পারেন । ইচ্ছে হলে ।

আর আর্যরাও কিন্তু গৌরবর্ণ ছিল ।

শুভকামনা ।

৬| ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ৮:০২

সাইফুল১৩৪০৫ বলেছেন: সুন্দর বলেছেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.