![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এটা একটা কারাগার । কারাগারের নাম ‘ভালোবাসা’। ঠিক যেমন গুয়ান্তানামা বে ঠিক তেমন বা তারচেয়েও ভয়াবহ ভালবাসার কারাগার । আমরা কয়েকজন মাত্র কয়েদি এই সেলে । আমি, একটা মেয়ে , নাম......উম......নাম যেনো কি! নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরতে ভালোবাসে, হাসার সময় গালে পুষ্ট ধানের মাখনে পলিমাটি পূর্ণচাঁদে ভাটিয়ালি গানের মত টোল পড়ে, কাজল পড়ে তবে শুধু বা চোখে । ওর দুটি চোখ সামান্য ছোট বড়, কাজল পড়লে বোঝা যায় না , ওর কাজল থেকে দুস্বপ্ন আক্রান্ত রাতের শুভ্র দুধেল ওলানের মত পবিত্রতার ঘ্রাণ ভেসে আসে । বাকি কয়েদিদি বলতে একটা আকাশ, নীল নীল, ভীষণ নীল কিন্তু তার বুকে সকালবেলা ক্ষুরের ক্রোধে গাল কেটে গেলে যেলাল বেরিয়ে আসে তার মত চাক চাক লাল দাগ, যেন ক্লাসে পড়া পারেনি বলে মাস্টারমশাই খুব পিটিয়েছেন । একটা নদী, ভীষণরকম পলায়নপর, যেন কারো উঠোন ছেড়ে সবে পালিয়ে এসে হাপাচ্ছে । হাপানির সাথে সাথে পাঁজরের উঠানামা, ওষ্ঠ, গ্রীবা, বাহু আর রক্ত জুড়ে ঢেউ। একটা শস্যখেত সমেত দীঘি, ওপাশে সবুজ ধান আর তরমুজের বীজ, সরিষার নষ্ট ফুলে দুষ্ট কীট, মৌমাছি তো এপাশে জলপদ্মে দোয়েল, রুপালী মাছ, মাছেদের অশ্রু আর ছিল একটা দুঃখিনী বর্ণমালা ।
প্রতি ভালোবাসা দিবসে একজন করে কয়েদীকে মুক্তি দেয়া হবে । এটা ছিল কারাগারের বিধান । সেদিন ছিল পূর্ণচন্দ্রের রাত, কাজল সেলের দেয়ালে হেলান দিয়ে গান ধরেছে,
“ আমার ভাঙা ঘরের ভাঙা চালা , ভাঙা বেড়ার ফাঁকে
অবাক জোস্না ঢুইকা পড়ে হাত বাড়াইয়া ডাকে,
হাত ইশারায় ডাকে কিন্তু কথা বলে না,
আমার কাছে আইলে বন্ধু আমারে পাইবা না” ।
-ও হ্যাঁ, ওর নাম মনে পড়েছে- ওর নাম কাজল । এরকম কোন এক পূর্ণচন্দ্রের রাতের শেষেই ভালবাসার দিনে নীল আকাশটা তার কয়েক লক্ষ কোটি লালচে দাগ নিয়ে আমাদের ছেড়ে মুক্ত পৃথিবীর মুক্ত আকাশে চলে গেল । আমাদের সেলে একজন বন্দী কমল। আমরা দুঃখিত হলাম, দুখটা এই ভেবে যতটা ছিল যে আকাশ মুক্তি পেল আমরা পেলাম না তারথেকে বরং এই ভাবনায় দুঃখ আরও বেশি ছিল যে নীল আকাশের সঙ্গ আমরা আর পাবনা, আর হাতে ছুয়ে দেখবো না নীল আকাশকে, মাথা রাখবো না আকাশে। আমার বুকের ভেতরের আকাশটায় খুব হাহাকার করতে শুরু করলো, হঠাত করে খুব ফাঁকা ফাঁকা, খুব শুন্য শুন্য লাগতে শুরু করলো ।
আকাশটা যাওয়ার আগে তার লালচে দাগে হাত রেখে ছেলেবেলার স্লেটে আঁকা তারকাপুঞ্জ আর ছায়াপথের এক সংক্ষিপ্ত ভার্সন বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, এগুলো তোমার! আমার ছোট্ট কারাগার তারায় তারায় ভরে গেল! কি যে আলো! কি যে ভালো! কি যে জমকালো!
আমার তারকাপুঞ্জ আর ছায়াপথ দেবার মত কেউ ছিল না, তাই কাজলের সামনে নতজানু হয়ে বললাম, এই ভালোবাসা দিবসে এই তারাদের আর এই ছায়াপথদের আমি তোমাকে দিলাম ।
তারপরের ভালোবাসা দিবসে ভাগ্যচাকায় নদীর নাম উঠে এল । নদীকে বললাম,
মুক্তি পেয়ে প্রথম কার কাছে যাবে?
-সাগরের কাছে ।
আমাদের সাথে থেকে গেলে পারতে...
-মোহনায় যদি না মিশলাম তবে কি লাভ এই নদী জন্মে ।
তেরোশ নদীর মাঝে কে তোমাকে আলাদা করে চিনবে বল? আমরা এখানে তোমাকে মাথায় করে রাখবো।
শুধু পরিচয়ের চেষ্টায় যদি জীবন কাটাতাম তবে হয়তো আমিও একদিন লোহিত সাগর হতাম । কিন্তু এত জল বুকে ধরার সাধ্যি আমার কই? এই সামান্য জলের বেদনাতেই আমার চোখ ভিজে আসে।
নদী যেদিন চলে গেল কাজল সেদিন খুব কাঁদল। কাজল আর চোখের জল মিশে কি যে সুন্দর ওকে লাগছিল । আমি শুধু এটুকু জানলাম, নদী চলে গেছে কিন্তু আরেক নদী রেখে গেছে।
নদীটাটা যাওয়ার আগে দুঃখের জলে হাত দিয়ে পাঁচটা নীলপদ্ম বের করে আমার হাতে দিল । বলল, এগুলো তোমার! কি যে স্বচ্ছ ,কি যে চোখ ধাধালো আর কি যে পবিত্র! আমার নীলপদ্ম দেবার মতও কেউ ছিল না, তাই কাজলের সামনে নতজানু হয়ে বললাম, এই ভালোবাসা দিবসে এই পাঁচটি নীলপদ্ম আমি তোমাকে দিলাম ।
তারপরে একদিন খবর এল নতুন ভোরের সূর্যকিরণের সাথে আজকের ভালোবাসা দিবসে শস্যখেত সমেত দীঘি চলে যাবে মুক্ত হতে । শস্যখেত আমাকে দিল একরাশ নীল আলো জ্বলা আর নেভা জোনাকি আর দিঘিটা দিয়েছিল একটা রঙিন মাছের ঝাক । আমি বললাম, কি নিয়ে যাচ্ছ তবে? সব তো দিয়ে গেলে? ওরা বলল, তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি, তোমাকে আর কাজলকে! হঠাত আমার কি যে হল, আর ভাষা খুঁজে পেলাম না! সময় ছিল বড় অল্প। প্রহরি এসে ওদের মুক্ত করে দিল, আমার কিছু আর বলা হল না । ছোট্ট কালো সেলের আকাশে এক রাশ জোনাকি, আর কংক্রিটের মেঝে জুড়ে একঝাক রঙিন মাছ । কি যে আলো, কি যে ভালো, শস্য খেত আর দীঘি কি যে ফেলে গেলো! যদি জানত!
আমি কাজলের চুলে হাত বুলিয়ে বললাম, এই ভালোবাসা দিবসে এই জোনাকিদের আর এই রুপালী মাছেদের ঝাক আমি তোমাকে দিলাম ।
এভাবেই একদিন চলে গেল দুঃখিনী বর্ণমালা, পড়ে রইলাম শুধু আমি আর কাজল। বর্ণমালা যাবার আগে বলল, আমি জানি সবাই তোমাকে কিছু না কিছু দিয়েছে । আমার তো তোমাকে দেবার কিছু নেই। আমি তোমাকে কি দেব বল?? আমি বললাম, তোমাকে কিছু দিতে হবে না। আমি চেয়ে নেব যা আমার চাই । আমাকে তোমার একরাশ দুঃখ থেকে কয়েকটা মুক্তোর মত বর্ণ দাও । বর্ণমালা মলিন হেসে বলল, যে কয়েকটা তোমার ইচ্ছা, সব নাও ।
আমি বেছে বেছে নিলা ‘ভ’ ‘ল’ ‘ব’ ‘স’ তারপর ‘আ’ কার ‘ও’ কার নিয়ে হয়ে গেল ‘ভালোবাসা’ । কাজলের বুকের কাছে এসব মুক্তাদের অঞ্জলি দিয়ে বললাম , এই ভালোবাসা দিবসে তোমার জন্য ভালোবাসা, এদের গ্রহন করো।
ও বলল, আমার গ্রহন পাত্র বড় ভঙ্গুর! বরং তুমি আমাকে নাও!
তারপরের একটা বছর তারকারাজি , ছায়াপথ, নীলপদ্ম, জোনাকি আর রঙিন মাছেদের সাথে খেলতে খেলতে কিভাবে কেতেছে আমরা টের পাইনি। একদিন চিঠি এসে বলে গেল, এবারের ভালোবাসা দিবসে মুক্তির তালিকায় যে তীর নিক্ষেপ করা হয়েছিল টা কাজলের নামে বিঁধেছে, কাজল মুক্তি পাবে । আমি খুশি হলাম না দুঃখিত বুঝতে পারলাম না! তীর কাজলের নামে বিঁধেছিল না আমার বুকে তাও জানা হয়নি!
সারারাত এপাশ ওপাশ করলাম। উল্টাপাল্টা অনেক কিছু ভাবলাম । এই যে কাজল শুয়ে ঘুমিয়ে আছে, এই যে মায়া, এই যে আলো, এই যে ধুপ, এই যে ধোঁয়া এরা আর আমার পাশে থাকবে না! আমি আর ভাবতে পারি না! সেই শুরু থেকে বারবার ভাবি অথচ একজায়গায় এসে ভাবনারা থেমে যায়, আর এগোয় না। আবার শুরু থেকে শুরু। মাঝরাত্তিরে সিদ্ধান্তে পৌছে গেলাম কি করবো। তারপর বসে থেকে কাজলের জন্য একটা গান লিখলাম। শুয়ে শুয়ে সুর বসালাম ।
বাকিটুকু ভেতরে, অন্য কোথাও,
কলিজার কবিতাদের চলে যেতে দাও,
কবিতার গভীরতায় কফিতা বানাও
বলে দেব সেই কথাটা, তুমি যদি চাও ।
বাকিটুকু ভেতরে, অন্য কোথাও,
কলিজার কবিতাদের খাঁচা খুলে দাও,
কবিতার গভীরতায় কাজল সাজাও
বলে দেব সেই কথাটা, তুমি যদি চাও ।
ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিল , কাজল পিঠে নাড়া দিয়ে ডেকে তুলল, বলল সামনের ভালোবাসা দিবসে তুমি মুক্তি পাবে, তারপরের ভালোবাসা দিবসে আমরা বিয়ে করবো! একটু দুষ্টুমি হেসে খানিক থেমে বলল, তারপরের ভালোবাসা দিবসে আমাদের যময বাচ্চা হবে , একটা ছেলে একটা মেয়ে। ছেলেটার নাম আমরা রাখবো সপ্তর্ষি আর মেয়েটার নাম চিত্রা । এবার আমাকে হাসিমুখে বিদায় দাও । সময় হয়েছে নিকট, এবার যে বাঁধন ছিঁড়িতে হবে। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো ।
আমি শেষবারের মত কাজলকে বুকে জড়িয়ে বললাম, সত্যি আমার জন্য অপেক্ষা করবে?
আমার কণ্ঠ শুনে কাজল চমকে গেলো। অস্থির হয়ে বলল, কি হয়েছে তোমার?
কিছু হয়নি। তুমি কি সত্যি এক বছর আমার জন্য অপেক্ষা করবে?
-এক বছর কেন?? আমি তোমার জন্য জনম জনম অপেক্ষা করতে পারি।
আমি হাহা করে অট্টহাসি হেসে উঠলাম । জনম জনম অপেক্ষা?? পৃথিবীর মুক্ত বায়ুতে, মুক্ত আকাশের নিচে জনম জনম অপেক্ষা? আর আমি এই অন্ধকার সেলে একা কি করে থাকবো ভাবতে পারো?? একা, আলোহীন, সঙ্গীহীন আমার প্রতিটা সেকেন্ড হবে তোমার এক জনম অপেক্ষার সমান দীর্ঘ। আম তোমাকে ছাড়া এক বছর থাকতে পারবো না কাজল। আমার কোন উপায় নেই, আমি অনেক ভেবেছি, সারারাত ভেবেছি, আমার কিছু করার নেই ।
আমার হাসিতে ,আমার কণ্ঠে অশনী বার্তা ছিল। কাজল চমকে বলল, কি করতে চাচ্ছ তুমি?
এই ভালোবাসা দিবসে তোমাকে দেয়ার মত আমার এক্তাই উপহার আছে- মৃত্যু! এই ভালোবাসা দিবসে মৃত্যু আমি তোমাকে দিলাম!!
সকালবেলা প্রহরী এল। আমি কারাগারের দরজার কাছে শিক ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাকে দেখেই হাসিমুখে বলল, এই কারাগারের নিয়ম আজকে তোমাদের জন্য ভঙ্গ করা হয়েছে। মানুষ তো আর একা বাঁচতে পারে না। একটা বছর তুমি নিঃসঙ্গ অন্ধকার সেলে থাকলে হয়তো মরেই যাবে। কিন্তু এখন আর তোমার ভয় পাওয়ার কোন কারন নেই । এই ভালোবাসা দিবসে তোমরা দুজনেই মুক্ত! তোমার সঙ্গিনী কই? ওকে ডাক, তোমাদের দুজনকেই আজকে মুক্তি দেয়া হল!
©somewhere in net ltd.