![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১.
অন্যান্য দিনের থেকে আজ আমার ঘরটা একটু বেশীই এলোমেলো হয়ে আছে।
পুরোটা ঘরে ছড়িয়ে আছে অপ্রয়োজনীয় কাগজ। কোনটা দোমড়ানো-মোচড়ানো, কোনটা একেবারেই নিভাঁজ আবার কোনটায় চায়ের কাপের গোল দাগ পড়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে বেশ বড়সড় কয়েকটা টর্নেডো সিরিজ হামলা করেছে আমার ঘরটাতে।
মেঝে আর বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এক্সাম পেপার, নোটের ফটোকপি, টেস্ট পেপারের পাতা সহ আরও অনেক হাবিজাবি কাগজপত্র। টেবিলের উপর স্তূপ হয়ে আছে পুরোনো খবরের কাগজ।
এতসব কাগজের মাঝে আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয় লেখা সুইসাইড নোটটা আলাদাভাবে একদমই চোখে পড়ছিলো না। নোটটা হাইলাইট করতে পারে এমন কোন কিছুই এই মুহূর্তে আমার মাথায় আসছে না।
একটা এ-ফোর সাইজের কাগজে লাল মার্কার দিয়ে বড় করে কথাটা লিখে নীচে আমার নাম সই করেছিলাম। এখন মনে চাইছে কাগজটা কুচি কুচি করে ছিড়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে। মনে হচ্ছে আত্মহত্যার মতন একটা মহৎ কাজের সামনে সুইসাইড নোট ঝালমুড়ি খাবার একটা ঠোঙা হবার যোগ্যতাও রাখেনা।
কিন্তু পরক্ষণেই উদীয়মান ইচ্ছেটার গলা টিপে ধরলাম। সুইসাইডের আগে একটা নোট লিখে যাওয়া হচ্ছে শত শত বছরের একটা ট্রেডিশান। সারা জীবনে ভালো কাজ বলতে তেমন কিছু্ই করা হয়নি। মড়ার আগে অন্তত একটা ঐতিহ্যবাহী কাজ করে যেতে ইচ্ছে করল।
কিন্তু নোটটার দিকে তাকিয়ে আমার হাসি পেল। বড়ই সেকেলে আর গতানুগতিক হয়ে গিয়েছে বাক্যটা। কাগজটাকে একটা দলা বানিয়ে ঘরের কোণে ছুড়ে মারলাম আমি। আলমারির পাশে ঝুলছিলো গত বছরের একটা ক্যালেন্ডার। সেখান থেকে একটা ক্যালেন্ডারের পাতা ছিড়ে নিয়ে সেটার উল্টো পিঠে লাল মার্কার দিয়ে বড় করে লিখলাম –
“ আজ আমার মত্যুদিবস … এই দিনে আমি মৃত্যুবরণ করছি ”
লিখে আপন মনে হাসলাম। যাক, কিছুটা ক্রিয়েটিভিটি দেখানো হলো আমার সুইসাইড নোটে। অন্যদের মতন গতানুগতিক সুইসাইড নোট না লিখে বরঞ্চ এতে একটা নতুন ধারা যোগ করা হলো ভেবে পুলক অনুভব করলাম।
আজ আমার মৃত্যু দিবস, এই দিনে আমি মৃত্যুবরণ করছি- লেখার পরও পৃষ্ঠাটায় অনেকখানি জায়গা বাকি ছিলো বলে আমি কয়েকটানে লেখাটার পাশে একটা ফাঁসিতে ঝোলা একটা বেড়ালের কার্টুন একে দিলাম। নীচে একটা ক্যাপশন ও দিয়ে দিলাম : নিজে আত্মহত্যা করুন, অন্যকেও করতে উৎসাহিত করুন। তারপর নিজের নাম সই করলাম নীচে।
ক্যালেন্ডারের পাতাটা স্কচ টেপ দিয়ে আমার দেয়ালে এমন ভাবে সাঁটলাম যাতে কেউ ঘরে ঢুকলেই নোটটা চোখে পড়ে। নোটটার দিকে তাকিয়ে তৃপ্তিবোধ করলাম। জোস একটা জিনিস হয়েছে। সময় থাকলে রং করে মরতাম কার্টুনটা। আর তাছাড়া আমার মাথায় যে বড় সড় একটা হার্ট এট্যাক হয়েছে নোটটা দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবে।
খাটের পাশে রাখা চেয়ারটাতে গাদা করে রাখা ছিলো আমার কতগুলো জিন্স আর টি-শার্ট। আবর্জনা সরানোর মত করে সেগুলো আমি চেয়ারের উপর থেকে ফেললাম। চেয়ারটা নিয়ে বসলাম আমার বারান্দায়।
সূর্য ডুবি ডুবি করছে। একটু পরই সন্ধ্যা নামবে। বিদ্যুতের লাইনের উপর দাড়ানো একটা কাকের ঠোঁট যত্ন করে তারের সাথে ঘষা দেখতে দেখতে জীবনের শেষ সিগারেট ধরালাম। মড়ার পর এই জিনিস আর পাওয়া যাবেনা। তাই মড়ার আগে যতটুকু পারি টেনে নিচ্ছি।
সিগারেট শেষ করে ঘরে ঢুকলাম আমি। খাটের নীচে খবরের কাগজ ভর্তি বস্তার পিছনে লুকিয়ে রাখা বড় সাইজের গরু কাটার ছুরিটা বের করলাম। প্রায় অন্ধকার হয়ে আসা ঘরে ছুরির ফলাটা চক চক করছে দেখে মনে মনে তৃপ্তিবোধ করলাম। ঘরে অন্যকেউ থাকলে আমার ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠা শয়তানের মতন হাসিটা আরাম করে দেখতে পারত।
টেবিলের উপরের কাগজের স্তুপ মেঝেতে ফেলে ছুরি হাতে চেয়ারে বসলাম আমি। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম আমার হাতে তালু দরদর করে ঘামছে … আমি খুবই অবাক হলাম ! আমি ঘামবো কেন ? হাত ঘামালে তো চলবেনা। আমাকে কাজটা করতেই হবে। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই !
ডান হাতে শক্ত করে ছুরির ফলাটা ধরলাম আমি। এক পোঁচে কাজ সারতে হবে … নয়ত বেঁচে যাবার সম্ভাবনা আছে। আমার সুযোগ একটাই।
কাঁপাকাঁপা হাতে আমি ছুরির ফলাটা বাম হাতের কব্জির নীচের রগে ছোয়ালাম। কি অস্বাভাবিক ঠান্ডা ফলাটা ! হালকা করে ফলাটা দিয়ে চামড়ার উপর একটা আচড় কাটলাম। সরু একটা রক্তের ধারা ফুটে উঠলো। শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে আস্তে আস্তে চাপ দিতে থাকলাম।
ভয়ানক একটা শিহরণ বয়ে গেল সারা শরীরে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো। তারপরই মাথায় শুরু হল অসাধারণ যন্ত্রনা ! মনে হল মাথায় কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। চোখের সামনে দৃশ্যপট ঘোলা হয়ে যেতে লাগলো আমার। গলা শুকিয়ে কংক্রিটের মতন হয়ে যেতে লাগলো। হঠাৎ করেই অপ্রত্যাশিত একটা ঝাঁকি নাড়িয়ে দিয়ে গেল পুরো শরীরটাকে !
টলে উঠলাম আমি। স্পষ্টতই বুঝলাম চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছি আমি। ধড়াম করে স্বশব্দে চেয়ার উলটে মেঝেতে পড়লাম আমি … রঙিন থেকে আস্তে আস্তে সাদাকালো, তারপর সব অন্ধকার হয়ে গেল আমার সামনে।
কটকটে কালো পর্দায় মোড়ানো অন্ধকার !
২.
চোখ মেললাম আমি।
চোখ মেলতেই চিরচেনা ময়লা সিলিং ফ্যানটা চোখে পড়ল। মনে হল সেই পুরনো বিছানায় শুয়ে আছি।
নিশ্চিত হতে উঠে বসলাম আমি।
ঠিক তা-ই, বিছানাতেই শুয়ে আছি আমি।
কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে ঠায় বসে থাকলাম। বেশ স্পষ্ট ভাবেই মনে পড়ছে কিছু সময় আগে আমি হাতের রগ কেটেছি আমার কোনভাবেই বেঁচে থাকার কথা না !
বাম হাতটা ভালো ভাবে খেয়াল করলাম। কোন আচড়ের দাগও নেই !
তবে কী আমি স্বপ্ন দেখলাম ?
কিন্তু পরক্ষনেই আমি নিশ্চিত হলাম আমি কোন স্বপ্ন দেখিনি। ঘাড় ঘোরাতেই দেখলাম চেয়ার উল্টে বেকায়দা ভাবে পড়ে আছে আমার মৃত দেহ। বাম হাতের কব্জি প্রায় আলাদা হয়ে গেছে শরীর থেকে। রক্তে সয়লাব হয়ে আছে আশপাশটা !
খাট থেকে নেমে লাশের কাছে গেলাম আমি। চিত করে শোয়লাম নিজের মৃত শরীরটাকে। বিচ্ছিরি ভাবে তাকিয়ে আছে সেটা। কোন প্রাণ নেই তাতে। একেবারেই অভিব্যক্তিহীন নিষ্প্রাণ চোখ জোড়া !
পুরো ব্যাপারটাই আমার মস্তিষ্কে কনফিউশন সৃষ্টি করতে ওস্তাদের উপর বাটপাড়ি করল। এমন ভয়াবহ একটা অবস্থার সম্মুখীন যে আমাকে কোনদিন হতে তা আমি আমার ভয়াবহতম দুঃস্বপ্নেও কখনও চিন্তা করিনি !
চেখের সামনে নিজের লাশটাকে দেখছি। যেটাকে আমি নিজেই বেকায়দা অবস্থা থেকে চিত করেছি। লাশটা যদি আমি হই, তাহলে যে আমি দাড়িয়ে আছি সেটা কে ? আমার আত্মা ?
রূঢ় সত্যটাকে উপলব্ধি করে সহজ ভাবে নিতে আমার অনেক্ষণ লেগে গেল। আমি মড়ে গেছি, আমার অস্তিত্ব এখন আত্মায় – অনুভূতিটা মোটেও সুখকর নয় !
সারাজীবন শুনে এসেছি অপঘাতে মড়া মানুষগুলোর আত্মা নাকি পৃখিবীতে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, মাঝে মাঝে ডাক ছেড়ে আর্তনাদের সুর তুলে কেঁদে কেঁদে ওঠে। হেসেই উড়িয়ে দিতাম কথাগুলো। আজ সত্যটাকে খুব ত্যাড়া ভাবেই বুঝতে পারছি ! নিজেরই এখন ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
উল্টো ঘুরতেই চোখ পড়ল আয়নার দিকে। আমার নিখুঁত প্রতিদিম্ব দেখতে পেলাম। বই পত্রে ছোট থেকে পড়ে এসেছি আয়নায় আত্মার প্রতিদিম্ব তৈরী হয়না। আজ দেখলাম সেটা হয়, এবং ভালো মতনই হয়। লেখকদের দোষ দিয়েও লাভ নেই … তারা লিখেছে তাদের কল্পনা শক্তি থেকে। মড়ে ভূত হয়ে তো আর গল্পগুলো লিখেনি।
আমি তলপেটে চাপ অনুভব করছি। পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে গোলমেলে মনে হচ্ছে।
এর মানে কি ?
আত্মারাও কি এই জাতীয় কাজ থেকে মুক্ত নয় ?
তাদেরও বাথরুম পায় ?
আত্মাদের জন্য কী পাবলিক টয়লেটের মতন আলাদা সৌলিক টয়লেটের ব্যবস্থা আছে ?
মৃত্যুর পরবর্তী জগতের সকল ধারণাকে লাথি মেরে আমি আমার খাটের উপরে থাকা সিগারেটের প্যাকেটটা থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে বিকারহীন ভাবে আমার লাশের দিকে তাকিয়ে টানতে থাকলাম। লাশের মুখের উপর গোটা কয়েক মাছি কে ভন ভন করতে দেখলাম। এটা সবেমাত্র শুরু। আস্তে আস্তে পিঁপড়ারা খবর পাবে, তারপর পাবে তেলাপোকারা।
তলপেটের চাপটা অসহ্য হয়ে উঠলো। এমন অবস্থা দাড়াল যে টয়লেটে না গেলেই না। টয়লেটে যাব বলে যেই ঘুরে দাড়িয়েছি, ঠিক সেই সময়েই আমার দরজায় ঠক ঠক একটা আওয়াজ পেলাম। কেউ একজন আমার দরজায় নক করছে।
আমি অবাক হলাম। আমার বাসায় কেউ-ই আসেনা। গত ছয় মাস যাবৎ আমার পরিবার, বন্ধু বান্ধব কারও সাথেই আমার কোন রকমের যোগাযোগ নেই। আমার এমন কোন বন্ধু কোন কালেই ছিলোনা যে আমি ছয় মাস যাবৎ লাপাত্তা দেখে খোঁজ নিতে আমার বাসায় এসে পড়বে। তার থকে বড় কথা আমার বাসার ঠিকানা আমি নিজেই ঠিক মতন জানিনা !
আমি দরজা খুলবনা বলে ঠিক করলাম। যে এসেছে বাসায় কেউ নেই ভেবে চলে যাক।
*
প্রায় পনেরো মিনিটের মতন হয়ে গিয়েছে।
যে পনেরো মিনিট আগে দরজা নক করেছিলো সে এখনও রবার্ট ব্রুসের মতন অসীম ধৈর্য নিয়ে দরজায় ছন্দে ছন্দে নক করে যাচ্ছে। এর মাঝে আমি বাথরুম থেকে ঘুরেও এসেছি। আমি তার ধৈর্যের একটা পরীক্ষা নিব ভাবলাম। আরও পনেরো মিনিট চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম।
কিন্তু সে ধৈয্যে রবার্ট ব্রুসকেও হার মানাল। পনেরো মিনিটের পরও সে দরজাতে তার নক করা অব্যাহত রাখল।
দরজা খোলার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। একবারও ভাবলাম না যে এসেছে সে যদি ঘরের ভেতর পড়ে থাকা আমার মড়া লাশটা দেখে তাহলে কি অবস্থা হবে। মনেহয় আত্মাদের এই জাতীয় কোন অনুভূতি থাকেনা।
দরজাটার লক খুলে সামান্য একটু ফাকা করলাম।
একটা মেয়েকে লাগেজ হাতে দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, ‘এতক্ষণ লাগে দরজা খুলতে ?’
‘আপনি কে ?’ বলেই চমকে উঠলাম। নিজের গলার স্বরটাকে অনেকটা অন্যরকম মনে হল। আমার স্বর কর্কশ আর কোলাব্যঙের মতন বলে যে দুর্নাম ছিল, তা যেন মুহূর্তেই বদলে গেছে। অনেকটা মোলায়েম শোনালো নিজের কন্ঠ।
‘আমি নাদিয়া,’ মেয়েটা উত্তর দিল।
‘আমার কাছে কি দরকার?’
‘ভিতরে এসে বলি ?’
‘কি ব্যাপারে কথা বলতে চান?’
‘আপনার লাশের ব্যাপারে,’ বলে হাসল মেয়েটা। খুব স্বাভাবিক বলে মনে হলেও সেটাতে এমন কিছু একটা ছিলো যে সেটা আমাকে চমকে উঠতে বাধ্য করল।
আমি কোন কথা না বলে ঠায় দাড়িয়ে থাকলাম সেখানে।
মেয়েটা বলল, ‘আমি কি ভিতরে আসব ?’
আমি ওকে ভেতরে আনলাম।
ঘরে ঢুকে হাতের লাগেজটা মেঝেতে রাখতে রাখতে নাদিয়া বলল, ‘তুমি দেখছি ভালো আঁকতে পারো,’ ওর কন্ঠে সামান্য উচ্ছ্বাসিত হবার মতন সুর। সে আমার দিকে ফিরল। বলল, ‘জানি তোমার মনে অনেক প্রশ্ন।’ স্মিত হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটে এবার, ‘সব উত্তর পাবে। তার আগে তোমার লাশ টাকে সাইজ করতে হবে।’
কথাটা সামান্য গোলমেলে মনে হল আমার কাছে। আগে জানতাম গরু সাইজ করে ওটাকে কেটেকুটে।
মানুষের লাশ আবার সাইজ করে কিভাবে ?
পোস্টমর্টেম করে ?
কনফিউশন দূর করতে আমি ওর দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সাইজ করতে হবে মানে ?’
‘লাশটাকে কয়েক টুকরো করতে হবে। তারপর ফেলে দিতে হবে,’ হাসি মুখে এই ভয়াবহ বাক্যটা বলল নাদিয়া। যেন এটা কোন ব্যাপারই না।
এতক্ষণে মেয়েটাকে ভালো করে খেয়াল করলাম আমি। মেয়েটা সুন্দরী। বেশ সুন্দরী। সহজ ভাষায় পৃথিবীতে আগুনের মতন রূপ নিয়ে আসা গুটিকতক সুন্দরী মেয়েগুলোর একটা বললেও ভুল হবেনা। সুন্দরী মেয়েদের মুখে যে এই জাতীয় ভয়াবহ কথা যে মানায় না সেটা বোধহয় ওকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি। তাই আমি গলার স্বরটাকে যথাসম্ভব কড়া করে বললাম, ‘এসব কি উল্টা পাল্টা বলছেন আপনি ?’ বলে নিজেই চমকে উঠলাম। কড়ার বদলে আরও মধুর সুর বের হলো গলা থেকে। আত্মাদের গলার স্বর কি কোমল হয় ?
নাদিয়া মুচকি হাসল, ‘তোমার সাথে যা ঘটছে সেটাই তো যথেষ্ট উল্টা পাল্টা। এই অবস্থায় তুমি কি সরল সোজা কথা বার্তা আশা কর আমার থেকে ?’
এক সেকেন্ড সময় নিলাম ভাবতে। তারপর উত্তর দিলাম, ‘নাহ্,’ বলে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম, ‘আপনি কি বলতে পারেন কি হচ্ছে এসব ?’
‘তুমি তোমার যে অপরাধবোধ থেকে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে সে পাপের কোন অস্তিত্বই তোমার মাঝে আর নেই। তোমার সেই অপরাধী সত্তা কে তুমি কিছুক্ষণ আগে খুন করেছ। এখন তোমার সত্তা কোন আত্মায় নয় বরং এটা একটা পরিপূর্ণ মানুষে।’
আমি কোন মন্তব্য করতে পারলাম না। হঠাৎ করেই আমার মাথাটা পুরো ফাঁকা হয়ে গেল। তার মানে আমার মাঝে সেই সব অপরাধের জন্য কোন প্রায়শ্চিত্ত থাকবেনা যেটার জন্য আমি এতকাল পুড়ছিলাম ?
‘তোমার খারাপ সত্তাটা শেষ হয়ে গিয়েছে। তুমি এখন থেকে একজন সত্যিকারের মানুষ।’ নাদিয়া বলল।
আমি নাদিয়ার দিকে তাকালাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি জানো আমি কেন আত্মহত্যা করেছিলাম ?’
‘জানি,’ নাদিয়া বলল, ‘তুমি নতুন ড্রাইভার। তোমার গাড়ি চালানোর অদক্ষতায় একটা ছেলে তোমার গাড়ির নীচে পড়ে মারা যায়। ছেলেটার পরদিন বিয়ে ছিলো।’
আমি অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কিভাবে জানলে ?’
নাদিয়া মুচকি হাসল, ‘আমি আরও অনেক কিছুই জানি। তবে সেটা শুধুই একটা একসিডেন্ট ছিলো। তোমার কোন দোষ ছিলোনা। তুমি বিনা কারণে নিজেকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলে। কিন্তু এটা প্রকৃতি মেনে নেয়নি। এটা প্রকৃতির নিয়মের বাইরে। তাই তোমার অপরাধবোধহীন দ্বিতীয় জন্ম হয়েছে।’
‘সত্যি ?’ আমার ব্যাপারটা তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না।
‘সত্যি,’ নাদিয়া হেসে অভয় দিল, ‘তুমি আজ থেকে সেই অপরাধবোধ থেকে মুক্ত। আজ থেকে তোমার ইচ্ছায় অনেক কিছুই হবে পৃথিবীতে।’
কথাটা আমার কাছে কিছুটা গোলমেলে লাগল। কিন্তু আমি কোন প্রশ্ন করলাম না।
নাদিয়া ওর লাগেজটা থেকে একটা চটের বড় সড় বস্তা বের করে আমাকে বলল, ‘তোমার লাশটা এটাতে ভরে আমার গাড়িতে নিতে সাহায্য কর। তারপর তোমার ছুটি। খুব বেশী কষ্টের কাজ না এটা, তাইনা ?’
আমি কোন উত্তর দিলাম না।
৩.
লাশটাকে যত্ন করে নাদিয়ার গাড়ির পেছনে ভরলাম আমরা।
ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট করতে করতে নাদিয়া আমাকে বলল, ‘নতুন জীবনে স্বাগতম তোমাকে। অনেক সুন্দর, ছবির মতন একটা জীবন কাটবে তোমার।’
‘তুমি কিভাবে জানো ?’
‘আমি অনেক কিছুই জানি।’ নাদিয়া উত্তর দিলো, ‘আর শোন, একা একা থাকা কোন ভালো মানুষের কাজ না। তোমার বাবা-মা, তোমার ছোট্ট বোনটা তোমাকে অনেক মিস করছে। ওদের কাছে ফিরে যাও তুমি।’
ওর কথাগুলো আমাকে নস্টালজিক করে দিলো। আমার মতন পাষন্ডের চোখও বাবা-মার কথা মনে করে ভিজে উঠলো।
আমি নাদিয়াকে বললাম, ‘তুমি কি আমাতে নামিয়ে দিতে পারবে বাসার সামনে ?’
‘দুঃখিত রাদিফ। তোমার জগতে আমার আর কয়েক মিনিট সময় আছে। তুমি একাই সেখানে চলে যেতে পারবে।’ মুচকি হেসে বলল নাদিয়া।
আমি কিছু না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মানে ?’
ও প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে বলল, ‘আসি রাদিফ। গুড বাই।’
গাড়িটা শব্দ করে আমার সামনে দিয়ে ভোস করে চলে গেল। যতক্ষণ দেখা যায়, ততক্ষণই আমি তাকিয়ে থাকলাম লাল গাড়িটার দিকে।
রাস্তার গাড়ি, মানুষজন একেবারেই নেই।
সময় কত এখন ?
আমি জানিনা। জানার কোন চেষ্টাও করলাম না। কদাকার শহরের আকাশে মায়াবী এক চাঁদ উঠেছে আজকে। বসন্তের হালকা ঠান্ডা বাতাস আরও মোলায়েম করে তুলেছে পরিবেশটাকে। চাঁদের আলোর বন্যায় যেন ধুয়ে মুছে যাচ্ছে সব কষ্ট। আমার মনে কাজ করছে এক অন্যরকম প্রশান্তি। যেন পুরো পৃথিবীতে আজ কোন দুঃখ কষ্ট নেই।
ফাঁকা রাজপথে হাঁটতে হাঁটতে অনেক্ষণ ধরে পূর্ণিমা দেখছি আমি। সোডিয়াম আর পূর্ণিমার আলো এক হয়ে যেন এক অন্যভুবনের এক মায়া সৃষ্টি করছে এই পঙ্কিল নগরীতে।
কে ছিলো এই নাদিয়া মেয়েটা ? এত কিছু সে জানলো কিভাবে ? কিভাবে সে জানলো আমার আত্মহত্যার কথা ? কোথা থেকে এসেছিলো সে ? আমার লাশটা নিয়েই বা সে কোথায় গেল ?
ধুত্তোর ছাই - বলে মাথা থেকে তাড়িয়ে দিলাম ভাবনাগুলোকে। রহস্য আছে বলেই বেঁচে থাকায় আজও এত আনন্দ। কখনও কি জানতে পারব এসব প্রশ্নের উত্তর ?
সাথে সাথেই মন থেকে উত্তর আসল – “না”
অসহ্য সুন্দর হয়ে উঠেছে চাঁদটা। ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। ঝিরি ঝিরি এই বাতাসে একটা রিকশায় চড়ে সেখানে যেতে পারলে মন্দ হতনা। আমার মনের কথা শুনতে পেরেই হয়ত দূর থেকে একটা রিকশাকে টুং টাং বেল বাজিয়ে আসতে দেখলাম।
আমার পাশে এসে সে রিকশা থামিয়ে বলল, ‘উঠেন স্যার। চান্নি দ্যখছেন আইজকা ? সব ফকফকা কইরা থুইছে। চলেন আপনারে নামায়া দেই।’
আমি রিকশায় চড়লাম। পংখিরাজের মতন উড়ে চলছে যেন রিকশাটা। আর আমাকে যেন পথ দেখিয়ে নিয়ে চলছে সেই ভয়াবহ সুন্দর চাঁদটা ...
২| ০৩ রা মে, ২০১২ বিকাল ৪:৩৯
হাবীব কাইউম বলেছেন: অসাধারণণণণণণণণণণণণণণণণণণণণণণণণণণণণণণণণণণণ
৩| ০৩ রা মে, ২০১২ বিকাল ৪:৪২
হাবীব কাইউম বলেছেন: মড়া মানে মৃতদেহ
মরা মানে মারা যাওয়া
৪| ০৩ রা মে, ২০১২ বিকাল ৫:২১
আহমেদ মুস্তফা জিহাদী বলেছেন: ধন্যবাদ রাহি !
৫| ০৩ রা মে, ২০১২ বিকাল ৫:৪৩
সপ্তডিঙা বলেছেন: অসাধারণ লিখেছেন। ভয় পাইছিলাম ।
০৩ রা মে, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৩৭
আহমেদ মুস্তফা জিহাদী বলেছেন: তাই নাকি !
৬| ০৩ রা মে, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:২৩
জ্যোস্নার ফুল বলেছেন: আপনার লেখার হাত ভালই। অনূসরনে নিব ভাবছি, কিন্তু আপনিতো লিখেনইনা। এত কম লিখেন কেন?
০৩ রা মে, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৩৭
আহমেদ মুস্তফা জিহাদী বলেছেন: এখন থেকে লিখব ভাবছি। রাইটার্স ব্লকে ভুগছি অনেকদিন হল। পড়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে জ্যোস্নার ফুল !!
৭| ০৩ রা মে, ২০১২ রাত ১১:৫৪
হাসান মাহবুব বলেছেন: বেশ ভালো লাগলো গল্পটা। নিয়মিত লিখুন।
০৪ ঠা মে, ২০১২ সকাল ১১:১৩
আহমেদ মুস্তফা জিহাদী বলেছেন: পড়ার জন্য ধন্যবাদ হামা ভাই !
৮| ০৩ রা মে, ২০১২ রাত ১১:৫৯
পাগলমন২০১১ বলেছেন: খুব ভাল হয়েছে ভাই।
০৪ ঠা মে, ২০১২ সকাল ১১:১৩
আহমেদ মুস্তফা জিহাদী বলেছেন: ধন্যবাদ
৯| ০৪ ঠা মে, ২০১২ রাত ১২:১৬
রবিন মিলফোর্ড বলেছেন: যাক অনেকদিন পর লেখা আসল তাহলে । অনেক দারুন হয়েছে গল্পটা ।
নিয়মিত লেখা আশা করছি ।
++++
০৪ ঠা মে, ২০১২ সকাল ১১:১৪
আহমেদ মুস্তফা জিহাদী বলেছেন: হুম বহুদিন পর ! পড়ার জন্য ধন্যবাদ !
১০| ০৬ ই জুন, ২০১২ বিকাল ৪:৩৯
Dee Dee বলেছেন: বাহ!
০৫ ই জুলাই, ২০১২ সকাল ১০:৪১
আহমেদ মুস্তফা জিহাদী বলেছেন: এইটা একটা কমেন্ট হইল !!
১১| ০৫ ই আগস্ট, ২০১২ বিকাল ৩:০৯
বিন্দু বাসিনী বলেছেন: অসাধারন!!এতো ভাল লিখিস কিভাবে!!??!!
১২| ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৯:৩০
লেজকাটা বান্দর বলেছেন: আসলেই অসাধারণ এবং চমৎকার। প্লাস।
©somewhere in net ltd.
১|
০৩ রা মে, ২০১২ বিকাল ৪:২৮
রাহি বলেছেন: অসাধারণ লিখেছেন। কইষ্যা পিলাচ দিলাম।