![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই কাজ মেয়েদের, এই কাজ ছেলেদের। এই বিভেদ আস্তে আস্তে ঘুচে যাচ্ছে। মেয়েরা এখন অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজও করেন। ক্রিকেটের মাঠে অধিনায়কত্ব থেকে শুরু করে মাসের পর মাস সুন্দরবনে থেকে খুঁজে বেড়ান বাঘের চিহ্ন। আঁকছেন কার্টুন, করছেন প্রতিবাদী অভিনয়। পুলিশ সার্জেন্ট হিসেবে ওয়াকিটকি হাতে আছেন রাজপথে। চামড়াজাত পণ্যের উদ্যোক্তা হয়ে যাচ্ছেন বিশ্ববাজারে। প্রতিবেদকের পাশাপাশি সংবাদপত্রের আলোকচিত্রী হিসেবে ছুটছেন ক্যামেরা হাতে। এই সাতজন কর্মজীবী নারী নিজেদের কাজের কথা বলেছেন নিজেরাই ।
বিশ্ববাজারে নিজের ব্র্যান্ড তৈরি করতে চাই
তানিয়া ওয়াহাব,
উদ্যোক্তা,
ব্যবস্থাপনা অংশীদার পার্টনার, কারিগর
হাজারীবাগ এলাকায় কোনো মেয়ে ব্যবসায়ী ছিল না, তাই জায়গা ভাড়া করা নিয়ে করতে হলো সংগ্রাম। অনেক কষ্টে মিলল জায়গা। স্বপ্ন বাস্তবেও রূপান্তর হতে থাকল। চামড়াজাত পণ্য তৈরিতে আমার তখন পুঁজি খুবই কম, তা ছাড়া চারপাশের মানুষের কটূক্তি ছিলই। তবে কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং সে কথাগুলোই উৎসাহ আর প্রেরণা দিয়েছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। একটু একটু করে দেশের বাইরেও পণ্য সরবরাহ শুরু হলো। আমার পণ্য এখন কানাডা, সুইডেনে। সততা আর মনোবল নিয়ে যে কাজ শুরু করেছিলাম ২০০৫ সালে, তার ফল পেতে শুরু করেছি এখন।
ছোটবেলা থেকেই সৃজনশীল কাজের প্রতি ঝোঁক ছিল।বিশেষ করে দেশীয় কোনো পণ্যের প্রতি ছিল আলাদা ভালোবাসা। পরিবারের কেউ ব্যবসা–বাণিজ্যে না থাকলেও স্বপ্ন ছিল উদ্যোক্তা হওয়ার। বাংলাদেশ ইনস্টিিটউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে অনার্স পড়ার সময় থেকে টুকটাক ব্যবসা শুরু। এরপর পড়াশোনার সূত্র ধরেই চামড়াজাত পণ্যের ব্যবসা করার চিন্তা মাথায় আসে। যদিও নামীদামি কোম্পানির চাকরির সুযোগ ছিল, কিন্তু সেসব বাদ দিয়ে চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদন আর সেগুলো বাজারে ছাড়ার কাজটা শুরু হলো শেষ বর্ষে পড়ার সময়। করপোরেট উপহার সরবরাহ থেকে শুরু। সেটা শুধু চামড়ার পণ্যে সীমাবদ্ধ না হয়ে কৃত্রিম চামড়া, পাট, কাপড় ইত্যাদি দিয়ে তৈরি ডায়েরির মলাটা, কনফারেন্সের ব্যাগ, ওয়ালেটসহ নানা রকম উপহারপণ্য। শুরুটা ছিল এভাবে।
২০০৮ সালে এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে সেরা এসএমই উদ্যোক্তা পুরস্কার পাই। সেটা আমাকে অনেক অনুপ্রাণিত করেছে। তারপর আইটিসি (ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টার) থেকে নির্বাচিত হয়ে ইটালির মিপেল মেলায় অংশ নিই আমরা। সেখানে আমার বিশ্ববাজার সম্পর্কে ধারণা হয়। শুরু করি ব্যাগের নতুন ডিজাইনের কাজ। তারপর দেশি ফ্যাশন হাউসগুলোয় সরবরাহ শুরু করি। এখন দেশের খ্যাতনামা অনেক ফ্যাশন হাউসে আমার পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি ক্রেতার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের জন্য নিজের একটা ওয়েবসাইটও খুলেছি। ইলেকট্রনিক মার্কেটিং মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করার জন্য ওয়েবসাইটটি বেশ সহায়ক। ২০১১ সালে এসে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) থেকে সেরা এসএমই নারী উদ্যোক্তা আর ২০১৩ সালে ‘আউটস্ট্যান্ডিং উইমেন ইন বিজনেস আ্যাওয়ার্ড’ পাই ডিএইচএল-ডেইলি স্টার থেকে। কাজের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, জার্মানি, ইতালিসহ ১৭টি দেশ ঘুরেছি। আমার লক্ষ্য দেশে ও বিদেশে ব্যাগ ও জুতার নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি করা আর আমার কারখানা আরও আধুনিক করে গড়ে তোলা।
ইচ্ছা, চেষ্টা আর পরিশ্রম থাকলে এগিয়ে যাওয়া যায়। আমি উদ্যাক্তাদের প্রশিক্ষণ দিই। তাঁদের উদ্যোগে পরামর্শক হিসেবেও কাজ করি। তরুণ প্রজন্মের কিছু উদ্যোক্তার মেন্টর হিসেবেও কাজ করছি। স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম নিয়ে। আত্মবিশ্বাস সৎ সাহস আর ধৈর্য দিয়ে অনেক কিছুই জয় করা সম্ভব। কাজকে পুরোপুরি ভালোবেসেই এগিয়ে যেতে হবে। যত বাধাই আসুক, থেমে যাওয়া চলবে না।
স্বপ্ন ছুঁয়েছি
কাজল রেখা,
সার্জেন্ট, শাহবাগ ট্রাফিক পুলিশ জোন
আমার গর্ব হয়—বাংলাদেশ পুলিশের ট্রাফিক সার্জেন্ট হিসেবে প্রথম যে নারী ব্যাচটা নিয়োগ পেয়েছে, আমি সেই ব্যাচেরই একজন। আমার কাজের বয়স খুব বেশি হয়নি, কিন্তু এ কয়েক দিনে জনগণের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার সুযোগ পেয়ে পুলিশের ইউনিফর্মের প্রতি ভালোবাসাই বেড়েছে। যে ভালোবাসার শুরু আমার শৈশবে। মফস্বলের আট–দশটি সাদাসিধে পরিবারের সন্তানের মতো বাগেরহাট জেলার রামপাল থানায় আমি জন্মেছি। এ ধরনের জায়গায় আমাদের সময়ে বিনোদন বলতে কেবল সিনেমা দেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। শৈশবে সিনেমা দেখতে দেখতেই জন্ম নিয়েছিল ইউনিফর্মের প্রতি এই ভালোবাসা। তখন একধরনের ঘোরের মধ্যে থাকতাম। ভাবতাম, আমিও কাজ করব কোনো একটি বাহিনীতে। মুহূর্তেই বিরাট সমস্যার সমাধান করে ফেলব। জনগণের সেবা করব। এ ধরনের স্বপ্ন শৈশবে অনেকেরই থাকে। তাই আমার মনে হয় এটি একবারে ভিন্ন কোনো স্বপ্ন নয়। তবে স্বপ্নের পথে অবিচল থাকাটাই ছিল আমার মূল লক্ষ্য। কাজল রেখাএ জন্য পড়াশোনা চালিয়ে যাই। বাগেরহাটের সরকারি পি সি কলেজে অর্থনীতি বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করি। একই বিষয়ে মাস্টার্স করি খুলনার বি এল কলেজে। পড়াশোনা শেষে যখন চাকরি খোঁজার পালা তখনই পত্রিকায় দেখি পুলিশে প্রথমবারের মতো নারী সার্জেন্ট নিয়োগ করা হবে। যেই দেখলাম সঙ্গে সঙ্গেই আবেদন করে ফেলি। গত বছরের ৩১ মে স্বপ্ন পূরণের দিন চলে এল। এ দিনই বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দিই আমি। আর সঙ্গে সঙ্গে বনে গেলাম সেই ২৮ জনের একজন, যাঁরা পুলিশের নারী সার্জেন্ট বিভাগে প্রথম যোগ দিয়েছেন। তখন অনুভব করেছিলাম আমি আমার স্বপ্নকে ছুঁয়েছি। এ জন্যই বোধহয় প্রশিক্ষণের সময় এত কষ্ট সহ্য করতে পেরেছি। প্রশিক্ষণের সময়টা যে কারোর জন্যই কষ্টের। মানসিক, শারীরিক উভয় দিক দিয়ে।
ছয় মাসের প্রশিক্ষণ শেষে চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি কাজে যোগ দিই। প্রথমেই শাহবাগ ট্রাফিক পুলিশ জোন। আমি যখন ডিউটিতে থাকি কখনো অনুভব করিনি এ পেশা নারীদের জন্য নয়। বরং সব সময় মনে হয় এটি একটা চ্যালেঞ্জিং পেশা। নিজের যোগ্যতা দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। একজন পুরুষও যে কাজ করছে, আমিও তা করছি। সবার কাজই সমান। এখানে কাউকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। আসলে আমাদের দেশের পুলিশ ব্যবস্থা এমনভাবে সাজানো, যেখানে মানুষের প্রত্যক্ষ সেবা করার সুযোগ রয়েছে। কেউ যদি এ পেশায় আসতে চায় সে ক্ষেত্রে তাদের জন্য আমি বলব, এটি একটি ভালো পেশা। জনগণের সেবা করার উদ্দেশ্যে আসুন। আমরাও চাই পুলিশে আরও অধিক হারে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাক। সে জন্য তো নারীকেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে আসতে হবে।
আমার স্বপ্নের পথে হাঁটতে আমার পরিবার সব সময় পাশে ছিল। আমার দুই ভাইও বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডে চাকরি করেন। এ জন্য পুরো পরিবারেরই সমর্থনটা প্রতিনিয়ত পাচ্ছি। এটিই আমার কাজের বড় শক্তি। আমিও মনে করি, প্রতিটি পরিবারের উচিত সন্তান যে কাজ করতে আগ্রহী, সে কাজে সমর্থন জানানো। তাতে লক্ষ্য পূরণ করা সহজ হয়।
(অনুলিখিত)
বাঘের খোঁজে সুন্দরবনে
১৬ ডিসেম্বর, ২০১৫। বিজয় দিবসের আলো–ঝলমলে প্রিয় ঢাকা শহরটাকে পেছনে ফেলে রওনা হয়েছিলাম খুলনার পথে, বাঘ-হরিণ-কুমিরের সুন্দরবনের দিকে।
বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ওয়াইল্ড টিমের কর্মী হওয়ার সুবাদে বাঘ জরিপের কাজে গিয়েছিলাম সুন্দরবনে। ইউএস এইডের বাঘ সুরক্ষা প্রকল্পের প্রথম ফিল্ডট্রিপের অংশ হিসেবে ৮০ জনের দলে সর্বসাকল্যে দুজন মেয়ে—আমি ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী আয়েশা সিদ্দিকা (স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে)।
সুন্দরবনের খালের পাড়ে বাঘের পায়ের ছাপ এবং বাঘের বিভিন্ন শিকার যেমন হরিণ, বন্য শূকর বা অন্যান্য প্রাণীর উপস্থিতির চিহ্ন রেকর্ড করাই ছিল আমাদের কাজ। সুন্দরবনে বাঘের আপেক্ষিক প্রাচুর্য নির্ণয় করা ছিল এই জরিপের উদ্দেশ্য।
জরিপের সব প্রস্তুতি শেষ করে খুলনা থেকে একটা লঞ্চে সুন্দরবনের পথে যাত্রা শুরু করি ২০ ডিসেম্বর। ভাসমান এই বাড়িতে করে প্রায় দেড় মাসে দেখেছি পূর্ব সুন্দরবনের পুরোটা এবং পশ্চিম সুন্দরবনের কিছু অংশ। জরিপ করেছি প্রায় ১৫০টার বেশি খাল। লঞ্চের সঙ্গে দুটো সাম্পান বেঁধে নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতাম। লঞ্চ বড় নদীতে নোঙর করা থাকত আর ভাটার সময় আমরা সাম্পানে করে ঢুকে পড়তাম আশপাশের খালগুলোতে।
চাঁদপাই রেঞ্জের নন্দবালা থেকে আমাদের কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় গত ২৬ জানুয়ারি খুলনা রেঞ্জের আদাচাইতে গিয়ে। এর মাঝে ঘুরে বেরিয়েছি হাড়বাড়িয়া, তাম্বুলবুনিয়া, হরিণটানা, শরণখোলা, কটকা, কোকিলমনি, দুবলার চরসহ আরও অনেক জায়গায়।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনের খালে জোয়ার–ভাটার সময় প্রতিদিন একটু একটু করে পরিবর্তন হতো, তার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কাজের সময়ও বদলে যেত। কখনো–বা ঘুম থেকে উঠেই কোনোমতে হাত–মুখ ধুয়ে কাজে চলে যেতাম, কখনো–বা নাশতা সেরে ধীরে–সুস্থে রওনা হতাম, ফিরতাম বিকেলে। আর প্রায়ই মাঝরাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকতাম দিনের সংগৃহীত ডেটা এন্ট্রির কাজে।
চমৎকার কিছু অভিজ্ঞতাও হয়েছে আমাদের সুন্দরবনকে ঘিরে। এই যেমন, কটকার খানিকটা ওপরের দিকে এক খালে কাজের ফাঁকে নৌকা একটা বাইনগাছের সঙ্গে বেঁধে দুপুরের খাবার সেরে নিচ্ছি। সাম্পানের ছাদে বসে সবাই গোগ্রাসে খাচ্ছি এমন সময় দেখলাম কেউ কেউ খাওয়া বাদ দিয়ে নাক উঁচু করে কী যেন শুঁকছে। কী হলো? জিজ্ঞেস করতেই বলল, আশপাশে নাকি বাঘের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে! সঙ্গে সঙ্গেই খাওয়া ফেলে উন্মুখ হয়ে চারপাশে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম, যদি মামার দেখা পাই! কিন্তু না, বাঘমামা দেখা দেননি।
আবার এই তো, চরাপুটিয়ার পাশের এক খালে জরিপ করে ফিরে আসার সময় পড়ন্ত বিকেলে সাম্পান গেল নষ্ট হয়ে। ঘরঘর... শব্দ করে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরই নাকে একটা পচা গন্ধ এসে ধাক্কা দিল। তাকিয়ে দেখি পাশেই গোলপাতার গোড়ায় একটা গুইসাপ মরে পচে আছে! লগি দিয়ে নৌকা বেয়ে কিছুদূর সামনে গিয়ে তারপর শান্তি।
সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ছিল সার্ভের শেষ দিন। আদাচাইতে গিয়ে শুনেছি আশপাশে কোথাও গহিন জঙ্গলের ভেতর কয়েক শ বছরের পুরোনো ভাঙা একটা মন্দির আছে। সেই মন্দির দেখতে যেতে হলে ঘন বনের ভেতর দিয়ে হাঁটুসমান কাদা আর কোমরপানির খাল পার হয়ে যেতে হয়। শোনার সঙ্গে সঙ্গেই কয়েকজন মিলে ঠিক করে ফেললাম যে পরের দিন কাজ শেষেই মন্দিরটা খুঁজতে যাব। পরিকল্পনামাফিক মানচিত্র আর জিপিএস দেখে পরের দিন দুপুরে জোয়ারের সময় নৌকা নিয়ে সরু একটা খালে ঢুকলাম। নৌকা থেকে নেমে কাদা মাড়িয়ে প্রায় আধা কিলোমিটার হেঁটে যেতেই চোখে পড়ল সরু একটা খাল পথ রোধ করে আছে। এই খাল পার না হয়ে সামনে যাওয়া সম্ভব না! হাতে একটা সিংড়াগাছের মোটা ডাল নিয়ে নেমে গেলাম পানিতে। কোমরসমান পানি পার হয়ে আরও কিছুদূর এগোনোর পর সামনে তাকাতেই দেখি লাল ইটের পুরোনো ভাঙা দেয়াল দেখা যাচ্ছে গাছের ডালপালার আলো–আঁধারির মধ্য থেকে। খুশিতে লাফাতে ইচ্ছা করছিল। যাক, অবশেষে পেয়েছি মন্দিরটা! কত আগে তৈরি হয়েছিল এই মন্দির? কে তৈরি করেছিল? কোন দেবতার পূজা হতো এখানে? কারা আসত এই গহিন জঙ্গলে পূজা দিতে? কত প্রশ্ন যে ভিড় করে এল মনে! আহ্! কত কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই মন্দির!
সুন্দরবনকে সবচেয়ে সুন্দরী মনে হয় বৃষ্টিমুখর দিনে। এমনি একটা দিন পেয়েছিলাম চরাপুটিয়াতে থাকতে। রাতের বেলা শুরু হয়ে সেই বর্ষণ চলল পরের দিন বিকেল পর্যন্ত। সেদিন জরিপে যাওয়া সম্ভব হয়নি নদী অশান্ত ছিল বলে। ইশ্! জঙ্গলের কী রূপই না দেখেছি সেদিন! বাতাসে সামনের গোলপাতাগুলো দুলছে সরসর শব্দ করে, সুন্দরীগাছের অনুজ্জ্বল পাতাগুলো যেন সজীব হয়ে উঠেছে, কেওড়ার বনে তো ঝড়ই বয়ে যাচ্ছে। এই তো সামনেই ভাঙা নৌকার গলুইয়ে একটা নীলকান মাছরাঙা কাকভেজা হয়ে বসে আছে। তন্ময় হয়ে দেখার মতো দৃশ্য।
বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা বেশ বড় অর্জন। নদীতে বা খালে লঞ্চে থেকে এতদিন কাটিয়ে দেওয়া খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। মিষ্টি পানির স্বল্পতা আর ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসের কনকনে শীত কাজটাকে আরও কঠিন করে তুলেছিল। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়াটাও ছিল একটা বড় অভিজ্ঞতা। মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক অনেক জায়গাতেই নেই। সার্ভের মাঝামাঝি সময়ে খালা যখন মারা গেলেন, সেই খবরও আমি পেয়েছিলাম দুই দিন পর!
জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করা নারীদের জন্য খানিকটা হলেও পুরুষদের থেকে বেশি চ্যালেঞ্জিং। সুন্দরবনে গিয়ে কাজ করতে আমাকেও বেশ খানিকটা চড়াই–উতরাই পার হতে হয়েছে। মা–বাবার কিছুটা আপত্তি ছিল এত দিন ফোন নেটওয়ার্কের বাইরে থেকে সুন্দরবনে কাজ করা নিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার আগ্রহ দেখে আর মানা করেননি। মূলত এই ক্ষেত্রে যেহেতু মেয়েরা তুলনামূলক একটু কম কাজ করছে, সেহেতু আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও খুব বেশি বদলায়নি। তবে এদিক থেকে আমরা ভাগ্যবান। আমাদের দলের সবার সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের কারণেই সম্ভব হয়েছে এই লম্বা সময় সুন্দরবনের ভেতরে গিয়ে কাজ করাটা। সবার মনোভাব যদি এ রকম সহযোগিতাপূর্ণ হয়, তবে নারীরাও অবশ্যই পারবে জীববৈচিত্র্য রক্ষার মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় আরও বেশি করে কাজ করতে। নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবার দক্ষতা কাজে লাগালে আমাদের ছোট্ট সবুজ দেশটার পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় আমরা আরও বেশি সার্থক হতে পারব।
৪০ দিন পর ২৭ জানুয়ারি, ২০১৬ সুন্দরবন ছেড়ে আসি। ফেরার দিন মনে হচ্ছিল কী যেন পেছনে ফেলে যাচ্ছি। বনের শেষ সীমানায় এসে বারবার ফিরে তাকাচ্ছিলাম। তারপর থেকে ওই একটা ভাবনাই পেয়ে বসেছে, আবার কবে যাব সুন্দর ওই বনে?
কার্টুনটা যেন জীবনের অংশ
নাসরিন সুলতানা (মিতু), কার্টুনিস্ট |
এখন ২০১৬ সাল। কার্টুন আঁকা শুরু হয়েছিল কাঁটায় কাঁটায় ১০ বছর আগে, ২০০৬ সালে। শুরুটা শখের বশেই, পেশা হিসেবে নেব এমন চিন্তা মাথায় ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ি তখন হঠাৎ করেই উন্মাদ ম্যাগাজিনের অফিসে গিয়েছিলাম, উন্মাদ–এ যুক্ত হওয়ার আবদার নিয়ে। যতটা আশা করেছিলাম তার চেয়েও বেশি প্রশ্রয় পেয়ে যাতায়াত শুরু করলাম নিয়মিত। প্রথম কার্টুনে হাতেখড়ি হলো ওখানেই, উন্মাদ সম্পাদক কার্টুনিস্ট আহসান হাবীবের হাত ধরে। আঁকতে আঁকতে হঠাৎ খেয়াল করলাম কার্টুনটা কখন যেন জীবনের অংশ হয়ে গেছে!
নাসরিন সুলতানা (মিতু)। ছবি: সংগৃহীতকার্টুন শুরু করার সময় মাথায় কখনোই আসেনি যে মেয়ে হয়ে এই পেশায় আসাটা খুব সাধারণ ঘটনা না। সত্যি বলতে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে কার্টূনকে পেশা হিসেবে নিয়েছে এমন মেয়ে আমিসহ দুজন মাত্র।
বিভিন্ন জায়গায় বারবারই একটি প্রশ্ন শুনতে হয়েছে যে কার্টুন আঁকিয়ে মেয়ের সংখ্যা এত কম কেন? আমার ব্যক্তিগত ধারণা যদিও অন্য রকম, সমাজস্বীকৃত হাতে গোনা কয়েকটি পেশা বাদে অন্য কোনো পেশাতেই মেয়েদের সংখ্যা বেশি নয়। আমাদের দেশে এই কিছুদিন আগেও ছেলেমেয়ে–নির্বিশেষে কার্টুন এঁকে জীবন চালাবে, এটা ভাবা যেত না। আর কার্টুনিস্টরা সব দেশেই একটা ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের অংশ। সেখানে মেয়েদের সংখ্যা আরও কম থাকবে তাতে আশ্চর্য কী? আমেরিকা–ইউরোপেও নারী কার্টুনিস্টের সংখ্যা হাতে গোনা! আশার কথা হচ্ছে, এ দেশে ইদানীং বেশ কয়েকজন মেয়ে এই পেশায় আসতে আগ্রহী হচ্ছে, কাজেই আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতেই এই চিত্র কিছুটা হলেও পাল্টাবে!
আমার মূল আগ্রহের জায়গা হলো ক্যারিকেচার, পাশাপাশি রাজনৈতিক কার্টুন এবং অলংকরণ করতেও ভালোবাসি। ২০১৪ সালে দেশের প্রথম ক্যারিকেচার প্রদর্শনী হিসেবে অলিয়ঁস ফ্রঁসেজে ‘মিট দ্য ফেসেস’ শিরোনামে আমার একক ক্যারিকেচার প্রদর্শনী হয়। উন্মাদ–এ সহযোগী সম্পাদক হিসেবে থাকার পাশাপাশি এই মুহূর্তে অনিয়মিতভাবে রাজনৈতিক কার্টুন করছি বিডিনিউজ২৪ডটকমে। এ ছাড়া অন্যান্য অভিজ্ঞতার মধ্যে উল্লেখ করার মতো বলা যায়, এনসিটিবির পাঠ্যবই অলংকরণ। খুবই সম্প্রতি একটি বিজ্ঞান নিয়ে একটা কমিকসের কাজ করেছি, যেটা আলোর মুখ দেখেছে এবারের বইমেলায়।
.নাতিদীর্ঘ কার্টুনিস্ট–জীবনে হয়েছে নানা অভিজ্ঞতা, বেশির ভাগ অভিজ্ঞতাই সুখকর, পাশাপাশি আছে কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতাও। প্রাপ্তির খাতায় যোগ হয়েছে বিভিন্ন সময়ে অর্জিত পুরস্কার, তার মধ্যে সাম্প্রতিকতম হচ্ছে গত বছর টিআইবি আয়োজিত জলবায়ু অর্থায়ন–বিষয়ক কার্টুন প্রতিযোগিতায় পাওয়া প্রথম পুরস্কার। তবে কার্টুন এঁকে মূল প্রাপ্তি পুরস্কার নয়, বরং যখন কোনো কার্টুন সময়ের বিচারে সত্যিকার অর্থেই মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলতে পারে, সেটাই যেকোনো কার্টুনিস্টের জন্য বড় অর্জন। সেই বিচারে আমার একটা কার্টুনের কথা উল্লেখ করা যায়, যেটি এখন পর্যন্ত আমার সফলতম কার্টুন বলে আমার বিশ্বাস। কার্টুনটি হলো রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর করা আমার একটি কার্টুন, যেটি পরে প্রথম আলো ও নিউ এজ পত্রিকায় ছাপা হয়। এই কার্টুনর নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে সাড়া আমি পেয়েছি, তা অভাবনীয়। কার্টুনটি দেশে-বিদেশে শেয়ার হয়েছে সম্ভবত এক লাখেরও বেশি, এর ওপর ভিত্তি করে একাধিক ডকুমেন্টারি ও প্রোমো তৈরি হয়েছে দেশীয় চ্যানেলসহ বাইরের মিডিয়ায়। উল্টো দিকে একই সঙ্গে এটি সম্ভবত দেশের কার্টুনের ইতিহাসে অন্যতম সমালোচিত কার্টুন হয়েও থাকবে। এই কার্টুনের পরে আমি রাতারাতি এই দেশের কর্পোরেটদের একটা অংশের কাছে রীতিমতো জাতিশত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাই, যে পরিমাণ হুমকি এবং গালি শুনতে হয়েছে, তা আসলে অবিশ্বাস্য! এই ঘটনার পর উপলব্ধি করেছি যে আমাদের চারপাশের সভ্য সমাজেও কত বিকৃত মানুষ আছে! তবে সবকিছুর পরেও, সেই সময় যত মানুষকে আমি পাশে পেয়েছি, সেই ভরসাই আমাদের ভালো সময়ের স্বপ্নগুলো বাঁচিয়ে রাখে।
কার্টুনের মতো মাধ্যমে মেয়েদের উপস্থিতি কতটা জরুরি, সেটা নতুন করে অনুভব করেছি গত বছরের পয়লা বৈশাখের ঘটনার পর। কঠোর পুরুষতান্ত্রিক একটা ইকোসিস্টেমে একজন নারীর নিজে প্রতিষ্ঠিত হলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। সামাজিক, রাজনৈতিক সমস্যাগুলো বাদ দিলেও মেয়েদের নিজেদের কথাগুলো বলার জন্যও এই মিডিয়া দরকার, কারণ কার্টুন এঁকে মানুষের যতটা কাছাকাছি যাওয়া যায় অন্য মাধ্যমে সেটা কঠিন। তবে এ মুহূর্তে না হলেও ভবিষ্যতে নারীদের এই ক্ষেত্রে বিচরণ নিয়ে আমি যথেষ্টই আশাবাদী।
এখন তাঁরাই আমার জন্য প্রার্থনা করেন
জাহানারা আলম, ক্রিকেটার,
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ক্রিকেট
ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় থেকে স্কুলে হ্যান্ডবল–ভলিবল খেলতাম। আমাদের খুলনা পাইওনিয়ার মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে সে সময় ক্রীড়া শিক্ষক ছিলেন সেলিমা আজিজ। খেলাধুলার ব্যাপারে দারুণ উৎসাহ–অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম তাঁর কাছেই। তবে পরিবারের কাছ থেকে যে সমর্থন আমি পেয়েছি, তা অতুলনীয়! আমার বাবা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম কোনো দিনও আমার খেলাধুলা নিয়ে নেতিবাচক কিছু বলেননি। এখনো মনে আছে, ২০০৮ সালের সে দিনটির কথা। সামনেই এসএসসি পরীক্ষা। তখনই ডাক এল বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের হয়ে শ্রীলঙ্কায় খেলতে যাওয়ার। বাবাকে বললাম, ‘আমি কি যাব? সামনে তো পরীক্ষা।’ বাবা বললেন, ‘পরীক্ষা তো পরেও দিতে পারবে, এই সুযোগ আর আসবে না। তুমি যাও।’
কেবল বাবাই নন, আমার মা এবং নানিও তুমুল উৎসাহ জুগিয়েছেন। ভাইবোনদের কাছ থেকে পেয়েছি অকুণ্ঠ সমর্থন। তাই বলতে পারি, পরিবারের সমর্থন না পেলে সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন। বিশেষ করে বাংলাদেশের নারীদের পক্ষে তো অসম্ভব!
এখন আমি জাতীয় দলে খেলছি। আমার মতো আরও অনেকে ক্রিকেট খেলছে। আমি সবার উঠে আসার গল্প জানি। আমি জানি, আমাদের লতা মণ্ডল কিংবা ফারজানা হক পিংকির কথা। পরিবার ওদের পক্ষে ছিল না। পিংকির মা–বাবা ক্রিকেট খেলার কথা উঠলেই রেগে অগ্নিশর্মা হতেন। ওর দাদি ওকে লুকিয়ে লুকিয়ে মাঠে নিয়ে যেতেন! তাই উপলব্ধি করি, কত উঁচু বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে আজ ওরা এখানে এসেছে। এখন ওদের জন্য কেবল পরিবারই নয়, গোটা দেশ গর্ব করে। আমার বেলায়ও এটা প্রযোজ্য। প্রথম প্রথম প্রতিবেশীরা আমার খেলাধুলা নিয়ে নাক সিঁটকাত, ‘আরে, ও তো মেয়ে! ওর খেলাধুলা করার কী দরকার!’ এখন তাঁরাই আমার জন্য প্রার্থনা করেন। পত্রিকায় খবর না বেরোলে বাসায় গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘মেয়ের খবর কী? ও সুস্থ আছে তো?’
নারীদের এগিয়ে চলার এই পরিবর্তন কেবল ক্রিকেটই নয়; বাংলাদেশের প্রতিটি অঙ্গনেই স্পষ্ট। অনেক কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নারীরা অগ্রগামী। তৈরি পোশাকশিল্প তো আছেই; বিমান চালনা, প্রতিরক্ষা, চিকিৎসা, প্রকৌশল, শিক্ষা, কৃষি কিংবা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পেও নারীদের অবদান বিশাল। কয়েক দিন আগে পড়লাম, দেশের মোট ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ৩৫ শতাংশই নারী। তৈরি পোশাকশিল্পের মোট জনবলের মধ্যে নারী আছেন ৮০ শতাংশ। এ ছাড়া প্রবাসী শ্রমিকদের কথাও যদি বলি, সেখানেও নারীদের অংশগ্রহণ আমাদের অগ্রযাত্রার প্রমাণ। দেশে এখন যে ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হয়, সেটার ৯০ শতাংশই পান নারীরা। তাই আমি ভীষণ আশাবাদী, নারীদের এগিয়ে চলার পথ আরও সুগম হবে।
তবে এটাও জানি, এখনো পরিবারের একটা ছেলেকে যতটা প্রাধান্য দেওয়া হয়, মেয়েটা অবহেলিত হয় ঠিক একই পরিমাণে। পরিবারের বড়রা ভাবেন, ছেলেটা অনেক কাজ করে, ওকে বেশি খেতে দেওয়া উচিত। মেয়েকে কেন নয়? কারণ, মেয়ে তো ঘরেই বসে থাকে! তারপর ধরা যাক, মফস্বলের একটা মেয়ে চায় মেডিকেল কলেজে পড়বে। বাবা হয়তো বলেন, এত কিছুর কী দরকার! জেনারেল লাইনেই কিছু করো। অথচ সেই বাবাই অসুস্থ হলে হয়তো একজন নারী চিকিৎসকের কাছেই যান! তাই আমি বারবার বলি এবং গভীরভাবে বিশ্বাস করি, পরিবারের সবারই উচিত মেয়েদের সমর্থন দেওয়া। কারণ, মেয়েরা অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে নতুন উদ্যমে সমাজের উন্নয়নে অংশীদার হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।
আজ বাদে কাল, মানে নারী দিবসে আমরা যাচ্ছি ভারতে; টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে। দলের অধিনায়ক আমি। এটা আমার জন্য বিরাট অর্জন। আমি জানি, বাংলাদেশের নারীরা এ রকম আরও অনেক অর্জনের জন্য উন্মুখ। যারা এখনো বাধার পাহাড়ের ওপারে, তাদের জন্য একটা কথাই বলি—নিজের মন যেটা বলে, সেটাই করো। নিজের বুদ্ধিমত্তা, কর্মস্পৃহা কাজে লাগাও। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের ওই কথাটা অমূল্য, ‘ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যা দেখি, তা স্বপ্ন নয়; স্বপ্ন তা–ই, যা আমাদের ঘুমাতে দেয় না।’ তাই যে স্বপ্নটা আমরা দেখি, সেটা সত্যি করতে দরকার পরিশ্রম। সাফল্য আসবেই।
(অনুলিখিত)
মা, তুমি আমার পোলারে বাঁচাইছ’
২০১৩ সালের নভেম্বর, পেট্রল বোমার সহিংসতার দিন তখন। রোজ কিছু মানুষ পুড়ছে। বার্ন ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হয়, সকালে মারা যায় অনেক। আমি কাজ করি আর জড়িয়ে যাই একেকটা পরিবারের গল্পে।
এমনই একদিন, ২১ নভেম্বর। তোফাজ্জল নামের নয় বছরের শিশুর তিনটি আঙুল ঝলসে যায় ককটেল বোমায়। তোফাজ্জলের বাবা লুঙ্গি বিক্রি করে। মা রান্না করে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে। চিকিৎসার টাকা নেই। পঙ্গু হাসপাতালের বারান্দায় মা–ছেলে কাঁদছে। আমি গিয়েছিলাম খবর আনতে। প্রিয় ক্যামেরাটা বের করে কয়েকটা ছবি তুললাম। পরদিন পত্রিকার শেষ পাতায় ছবি ও নিউজ ছাপা হলো। ছবিটি সাড়া জাগাল।
সাবিনা ইয়াসমিন,
ফটো সাংবাদিক, প্রথম আলো
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক নিজ উদ্যোগে আমার হাতে বেশ কিছু টাকা তুলে দিলেন। আমি হাঁটব না দৌড়ে যাব বুঝতে পারছি না । এমন সময় আমাদের বিশেষ প্রতিবেদক জাহাঙ্গীর আলম গাড়িতে করে আমাকে পৌঁছে দিলেন। তোফাজ্জলের মায়ের হাতে টাকা তুলে দিলাম। তিনি আমার মাথায় হাত দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদলেন। জীবনে একটা কিছু করতে পেরেছি এমন আনন্দ নিয়ে সেদিন ফিরলাম।
শুধু তোফাজ্জল নয়, এক বছরের শিশু লিমা, সুমি, রাকিব, মুরাদ—অনেকের গল্প আমি লিখলাম, সেই সঙ্গে তাঁদের ছবিও তুললাম। ওদের সঙ্গে পারিবারিক একটা বন্ধনই তৈরি হয়ে গেল। গত ঈদেও তোফাজ্জলের মা আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, ‘মা, তুমি আমার পোলারে বাঁচাইছ।’ জীবনের এই পাওয়াগুলোর মূল্য আমার কাছে অনেক। এ জন্য আমি আমার কাজকে ভালোবাসি। আমার ছবি, আমার লেখা সংবাদ—এসবই তো আমার জন্য বিশেষ পুরস্কার।
সাবিনা ইয়াসমিন। ছবি: প্রথম আলোগত ৮ ফেব্রুয়ারি ‘বাবার যত্ন’ শিরোনামে রাজধানী পাতায় একটি ছবি ছাপা হয়। এই ছবিতে দেখা যায়, ফুটপাতে মা নেই। ছোট্ট মেয়ে আমেনাকে বাবা আনোয়ার হোসেন ফুটপাতে মাথায় শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করিয়ে চুলে তেল দিয়ে আবার বেঁধে দিচ্ছেন। ছবিটি প্রকাশের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে বেসরকারি অনেক সংস্থা তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল।
২০১৩ সালের ১৬ এপ্রিল প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ছাপা হয় ‘নারীর জন্য এ কেমন ব্যবস্থা’ শিরোনামে ঢাকা মেডিকেলে ফরেনসিক বিভাগে ধর্ষণের চিকিৎসা করেন পুরুষ চিকিৎসকেরা। এই সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে সংসদে আলোচনা হয়। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রাণালয় সব হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে দুজন করে নারী চিকিৎসক নিয়োগ দেয়।
কিশোরী ও প্রতিবন্ধী কিশোরীদের ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ব্র্যাক ১৮ ডিসেম্বর। এই ছবিতে দেখা যায় ক্রাচে ভর দিয়ে আত্মবিশ্বাসে বল চালিয়ে গোল করে দলনেতা শাকিলা জাফর।
এমন হাজারো বাধা পেরিয়ে নারী এগিয়ে যাচ্ছে। এমন ছবির পেছনে থাকে অনেক আজানা গল্প। বিভিন্ন সময় হাত কাঁপে রক্ত দেখে। কখনো চোখে পানি থেমে থাকতে চায় না। একবার মোহাম্মাদপুর বস্তিতে আগুনের ছবি তুলছি, হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন ধাক্কা দিয়ে ক্যামেরা কেড়ে নিতে চাইল। আমি তো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। পরে বুঝলাম তার ছেলে মারা গেছে, তাই রাগে–ক্ষোভে সে আমাকে বাধা দেয়।
প্রায় তিন বছর ধরে সাংবাদিকতা করছি। মোটরবাইক চালিয়ে এখন আমি কাজে বের হই। আমার পরিবার থেকে প্রথমে বাধা ছিল আমি মোটরবাইক চালাতে পারব না। বিশেষ করে আমার মা। কিন্তু আমার আপনজনেরা আমাকে সাহস দিয়েছে। প্রায়ই বাইক নিয়ে ঝামেলা হয়। মাঝপথে টায়ার নষ্ট, হাওয়া কমে যায়। তারপরও ঢাকা শহরে রাস্তায় পাবলিক বাসে চলাফেরা করার মতো কষ্ট কমেছে।
নারীর কাজ, পুরুষের কাজ বলে এখনো আলোকচিত্রীর পেশাকে বিভাজন করতে চান অনেকে। তবে এ ক্ষেত্রে টিভি চ্যানেলগুলোও এগিয়ে আছে। আনেক নারী টিভি ক্যামেরা পারসন হিসেবে কাজ করছেন।
আমার হাতে ক্যামেরা দেখে অবাক হয় অনেকে। কাছে এসে জিজ্ঞেস করে আপনি কোন পত্রিকার।
সংবাদ চিত্র সংগ্রহে বেশির ভাগ জায়গায় একাই যেতে হয়। বুড়িগঙ্গা থেকে রেলস্টেশন সবখানে একটা নারী ক্যামেরা হাতে কী করেন? এটা দেখতে ভিড় জমায় লোকেরা। এমন পরিস্থিতিতে এড়ানো খুব বিপত্তিকর। বাজারঘাট সবখানে নারীকে নারীরূপে দেখবে এমনটাই চিরায়ত নিয়ম হয়ে আছে। রাজধানীতে একটু সহজ হলেও ঢাকার বাইরে প্রত্যন্ত গ্রামে আলোকচিত্রী নারীদের কাজ করাটা এখনো বেশ কঠিন।
২| ০৯ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ১০:১৮
সাদা-কালো মন বলেছেন: Thanks !
©somewhere in net ltd.
১|
০৮ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ১০:১৪
বিজন রয় বলেছেন: দারুন পোস্ট।
++++