![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
Onek onek Khelte, ghumate, khete r majhe majhe porashuna korte valobasi.............
আমাদের উইংটা (রুম নং ৪০০১-৪০০৬, সোহরাওয়ারদী হল) বরাবর_ই নাকি ব্যতিক্রম, বাচ্চা অবস্থায় যেদিন প্রথম র্যা.গ এর মুখোমুখি হলাম, সেদিন_ই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল আমাদের। তাই উইং এর ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য গ্রামের ম্যান্দা টাইপ পোলাপাইন হয়ে থাকা যাবে না, বাইঞ্চোত টাইপ হওয়া জরুরী, সবক্ষেত্রেই। আরো জানানো হল, বুয়েটে কিছু কিছু ব্যাপারের সূচনা এ উইং থেকেই, যেমন উইং বিদায়। কিছুদিনের মাঝেই আরো ব্যতিক্রম ব্যাপারগুলো চোখে ধরা পড়ে গেল কিন্তু সে ব্যাপারে বেশি কথা আপাতত বাড়াতে চাই না। প্রতিবার উইং র্যাতগ এর পর বিদায়ী বড় ভাইয়েরা বুফেতে সবাইকে খাওয়ায়, এতদিন এভাবেই চলে আসছিল ব্যাপারটা। কিন্তু আবারো নতুন কিছুর সূচনা করতেই হয়তো ০৭ ব্যাচের রবি ভাইয়ের প্রস্তাবনা- খাওয়া তো অনেক কিছু হইছে, হবে। কিন্তু এবার নতুন কিছু করি, সবাই মিলে ট্যুর_এ যাই। নতুনত্বের স্বাদ পেয়ে সবাই লাফিয়ে উঠলাম। আর তাই বিদায়ী ০৭ ব্যাচের সার্বিক তত্ত্বাবধানে শুরু হল ট্যুরের দিন গোণা।
অবশেষে, ২২-১১-১২ ইং তারিখে উইং এর ১৫ জন মিলে বের হলাম(বাকি ৮ আবাল সন্তান ভীত-সন্ত্রস্ত), উদ্দেশ্য বাংলাদেশের দক্ষিণপ্রান্ত-নিঝুম দ্বীপ। যেহেতু স্মৃতি ধরে রাখার জন্যই লেখা, তাই সবার পরিচয় দিয়ে দিলামঃ
রুম নং নাম ডিপার্টমেন্ট ব্যাচ
৪০০১ খালিদ হোসেন অনিক ধাতব কৌশল ০৮
৪০০২ সৌম্য শেখর পাল সিভিল ১০
৪০০৩ মশিউর রহমান ধাতব কৌশল ০৭
৪০০৩ ইয়াসির আরাফাত নৌ যান ও নৌ যন্ত্র কৌশল ০৮
৪০০৩ মাহবুব আসিফ তড়িৎ কৌশল ১০
৪০০৪ আসিফ উল্লাহ রাফি যন্ত্র কৌশল ১০
৪০০৫ মাশরুর মেহেদী অন্তর পুর কৌশল ০৭
৪০০৫ আবু সাঈদ ফারুক কম্পু কৌশল ০৮
৪০০৫ হাসান পুর কৌশল ১১
৪০০৬ রবি কাকা নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা ০৭
৪০০৬ সজল পোয়েট যন্ত্র কৌশল ০৬
৪০০৬ রনি যন্ত্র কৌশল ১১
৪০০৬ আরিফ ভাই
------ আজাহার (শেরে বাংলা হল) কেমি কৌশল ০৮
৪০০৫ কুন্ডু নৌ যান ও নৌ যন্ত্র কৌশল ১১
রওনাঃ
তখন বেলা ৪টা। আমরা সবাই মিলে বের হলাম সদরঘাট এর উদ্দেশ্যে। অবশ্য রনি আর কুন্ডু (১১ ব্যাচ, এর মধ্যে রনির বাড়ি আবার হাতিয়া, তাই তার এ লাইনে যাতায়াত এর ব্যাপক অভিজ্ঞতা) ২-৩০ এর মধ্যে সদরঘাটে চলে গিয়েছিল যাতে লঞ্চে ভাল যায়গা ম্যানেজ করা যায়। উল্লেখ্য নিঝুম দ্বীপ যেতে হলে হাতিয়া পর্যন্ত লঞ্চে যেতে হয়। লঞ্চ ছাড়ে ঢাকা থেকে মোটামুটি পৌনে ছটায় আর লঞ্চে কোন অগ্রিম টিকেট কাটতে হয় না, গিয়ে যে যেখানে পারে বিছানা ফেলে যায়গা দখল করে, আগে আসিলে আগে পাইবেন ভিত্তিতে। তবে কেবিনে যেতে চাইলে আগে থেকে ম্যানেজ করতেই হবে। সে যাই হোক, সদরঘাটে পৌঁছে ৪টাকা দিয়ে ঘাটের টিকিট কিনে ভেতরে গিয়ে দেখি সারি সারি লঞ্চ। আমাদের লঞ্চটা ছিল ৩তলা, এম ভি টিপু। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ৫০জনের একটা বিশাল বহর আগেই গিয়ে সুবিধাজনক জায়গা দখল করে নেয়াতে আমাদের ঠাই হল একদম তিন তলার ছাদে, খোলা ডেকে। সেখানে তিনটা বিছানার চাদর বিছিয়ে জাঁকিয়ে বসলাম সবাই মিলে। রবি কাকা(আসলে ভাই) দেখলাম কলা, পাউরুটি, পানি নিয়ে হাজির। গীটার, পোকার চিপস, কার্ড, ফুটবল আর আমাদের গাট্টি-বোচকা নিয়ে মোটামুটি বিশাল একটা বহর আমরা।
যাত্রা হল শুরুঃ
পৌনে ছটার সময় ভেঁপু বাজিয়ে হেলেদুলে শুরু হল আমাদের যাত্রা। তখন আমরা ব্যাপকই উত্তেজিত। আমার মত কয়েকজন সাঁতার জানে না, যারা জানে তারাও লঞ্চ ডুবলে কতটা সুবিধা করতে পারবে সে ব্যাপারে সন্দিহান। হালকা আশংকা নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও সময় লাগলো না সেটা কেটে যেতে। পুরোপুরি শীত পড়ে নি, নদী শান্ত, তাই শুরু হল মাস্তি। নদীর বুকে সন্ধ্যা নামা দেখলাম সবাই মিলে। শুরু হল টুয়েন্টি নাইন খেলা। কেউ কেউ কিছুক্ষন গড়িয়ে নিল কিংবা সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চড়ে বসল। এর মধ্যে ব্র্যাক এর ৫০ জনের আনাগোণা(এদের মাঝে মনে হয় ৩০ টায় আবার নারী জাতি, পোলাপাইন তাই চরমই পিনিকে………)। হাসি-ঠাট্টায় এগিয়ে চলল কাফেলা। সন্ধার পর খেলাধুলা শেষে সবাই মিলে উঠে গেলাম ছাদে, গিটারিস্ট সজল পোয়েট এর বাজনায় আমাদের ভোকাল সৌম্য, অনিক আর রবি কাকা শুরু করল আকাশ-পাতাল গান। আর তাদের অনুষঙ্গ হলাম বাকিরা। গান শেষে আরিফ ভাই এর ঘেটু নাচটা ছিল অসাধারণ।
এরপর রাতে খাওয়ার পালা। লঞ্চে জীবনে প্রথমবারের মত খাবো, অভিজ্ঞতা অর্জনের নেশায় মাতোয়ারা, জানি জীবনে প্রথমবারের মত অনেকগুলো অভিজ্ঞতা হবে, তাই প্রতিটার স্বাদ নিতে মরিয়া ছিলাম। লঞ্চের খাবার-দাবার ভালোই। ইলিশ মাছ সহযোগে খেয়ে ফেললাম। দারুণ মজার রান্না। খেয়ে এসে আরো খানিকক্ষণ চলল হই-হুল্লোড়। এর মাঝে ঠান্ডায় সবাই কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে। হিম বাতাসে আমরা জুবুথুবু। বুদ্ধি করে জ্যাকেট আর কম্বল এনেছিলাম বলে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিলাম। কয়েকজন মিলে পোকার খেলতে বসে গেলেও ভাবলাম আগামীদিনগুলোর জন্য শক্তি সঞ্চয়টা বেশি জরুরী। তাই শুয়ে পড়লাম কম্বল শেয়ার করে। ঠান্ডায় একটানা ঘুমানো যায় না। সে এক বিশাল পেইন। রাত দুটোর দিকে কিছু কিছু ঘাটে লোক নেমে যাওয়াতে আমরা খোলা ডেক থেকে দোতলায় নেমে এলাম। জায়গাটা ঘেরা থাকায় শীতের প্রকোপ কিছুটা কম। বাকি রাতটা আরামেই ঘুমালাম, আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নদীর বুকে সূর্যোদয় মিস করলাম।
সকাল ৭টার দিকে লঞ্চ পৌছালো মনপুরা দ্বীপে, আহামরি কিছু না, তবু এই দ্বীপে একটা সিনেমা তৈরি হয়েছে, তাই লঞ্চ থেকে নেমে দ্বীপে খানিকটা ঘোরাঘুরি হল। উল্লেখ্য, লঞ্চ এখানে ঘন্টাখানেক থামে। দ্বীপে গরুর দুধের চা টা বেশ ভাল। দ্বীপ থেকে মশিউর ভাই আর রবি কাকা ডিম ভাজি আর পরাটা কিনে আনলো আমাদের সবার জন্য। ডিম ফ্রাই এখানে বিশ টাকা পিস। লঞ্চের ছাদে বসে পরাটা, ডিম আর পাউরুটি দিয়ে সকালের নাস্তা হল। কলা কে জানি রাতে শোয়ার সময় ভর্তা বানিয়ে ফেলেছে, তাই সেগুলোর আশা বাদ। চারদিকে তখন রোদ উঠে গেছে, আমরা ছাদে দাড়িয়ে-বসে বাকিটা সময় কাটিয়ে দিলাম।
পৌঁছে গেলাম হাতিয়াঃ
লঞ্চ হাতিয়া দ্বীপের তমলদ্দি ঘাটে পৌছাল সকাল ৯-৩০ এ। সবাই লঞ্চ থেকে নামলাম। এর মাঝে মোবাইলের চার্জ খতম। গোটা ট্যুর এ যে ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ঝামেলা গেছে, তা হল মোবাইলের চার্জ। যাই হোক, লঞ্চ থেকে নেমে তমলদ্দি বাজারে এসে চা খেলাম আর এক দোকানি মোবাইলে খানিকটা চার্জ দিয়ে দিল। বাড়িতে জানালাম পৌঁছে গেছি। তারপর রনির ঠিক করা লেগুনার চাইতে খানিকটা বড়, স্থানীয় ভাষায় বাসে চেপে (ভাড়া নিয়েছিল ২০০০টাকা) জাহাজমারা হয়ে একটা ঘাটে পৌছালাম আমরা প্রায় দেড়-দু ঘন্টা ভয়ঙ্কর রাস্তা পেরিয়ে। যাত্রা পথে জিলাপী কেনা হল গরম গরম, এই জিলাপীর প্যাঁচ আমরা যে জিলাপী দেখে অভ্যস্ত, তার চাইতে বেশি আর মুরমুরে। নদীর ঠিক অপর পাড়ে নিঝুম দ্বীপ।
অবশেষে নিঝুম দ্বীপঃ
নদী পাড়ি দেয়ার জন্য একটাই মাত্র ট্রলার। সেটা তখন অপর পাড়ে ছিল। এপাড়ে আসার পর সবাই মিলে গাদাগাদি করে উঠে পড়লাম। নদী পাড়ি দিতে ভয় লাগতেছিল নৌকার দুলুনি দেখে। কিন্তু নিরাপদেই পা রাখলাম নিঝুম দ্বীপে, ভাড়া দশ টাকা মাত্র। নিঝুম দ্বীপে পা রেখেই অন্যরকম একটা শিহরণ খেলে গেল শরীরে, কোন দ্বীপে এই প্রথমবারের মত ঘুরবো, ব্যাপারটা ভেতর থেকে অনুভব করলাম। আর একটা কথা না বললেই নয়, স্থানীয় লোকজন সেই লেভেলের ভাল, বন্ধুবৎসল আর সাহায্যপরায়ণ। ওদের না ঘাটালে ওরা কিচ্ছুটি বলবে না, যে কোন সাহায্যে এগিয়ে আসবে। আর ছেলে-বুড়ো সবাই দেখলাম ফুটবলের প্রতি ভীষণ দুর্বল, আমরা যতবার ফুটবল নিয়ে বেরিয়েছি, পিচ্চিগুলো জুল জুল করে তাকিয়ে থেকেছে, ছেলে-বুড়োরা অন্তত একটা লাথি হাঁকাতে চেয়েছে। তাই ওখানে একটা ফুটবল নিয়ে গেলে বেশ কিছু ব্যাপারে সুবিধা পাওয়া যেতে পারে।
নিঝুম দ্বীপের ঘাট থেকে রিক্সা কিংবা মটর সাইকেলে করে অনায়াসে যে কোন জায়গাতে যাওয়া যায়। ঘাটে নেমেই সামনে অবারিত খোলা মাঠ পেয়ে আজাহার নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো না, ফুটবল নিয়ে নেমে পড়ল, দেখাদেখি অন্যরাও। নৌকাতে এক চাচার সাথে টুকটাক কথা হয়েছিল, দেখি উনিও ফুটবলে একটা লাথি মারতে চান, সুযোগ পেতেই দিলেন জোরে একটা শট। তারপর ফোকলা দাঁতে বুড়ো দাদুর সে কি হাসি!!
আমরা ঠিক করেছিলাম সবাই মিলে হাঁটবো, তাই বেশি এনার্জি লস না করে হাঁটা শুরু করলাম। ঘন্টা দেড়েক হেলেদুলে মজা করে পৌছালাম একটা বাজার মত জায়গায়, মাঝে অবশ্য আরো কয়েকটা ছোট-খাট বাজার পড়েছিল, কিন্তু এইটা বেশ জমজমাট, নাম বন্দরটিলা বাজার। নিঝুম দ্বীপে যে গেস্ট হাউস সেটা আগে থেকেই বুকড ছিল, তাই কোথায় থাকব সেটা নিয়ে কনফিউশন । ওখানে শতফুল নামে একটা প্রাইমারী স্কুল আছে, ভেবেছিলাম সেখানে থাকা হবে। ওখানকার রতন স্যার নামের এক শিক্ষকের নাম্বারও জোগাড় করা হয়েছিল। কিন্তু ওনাকে ফোন দেয়ার পর উনি নিজেই একজন লোককে বলে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। শীতের রাতে স্কুল ঘরে বেঞ্চের উপর ঘুমানোটা ভাল কিছু হত না। উনি যে লোককে বলে দিয়েছিলেন, তার নাম বাসার, বাজারে একটা রেস্টুরেন্ট আছে (বলা ভাল ঘিঞ্জি হোটেল), নাম সী বার্ড, উনি সকল কাজের কাজী। চেয়ারম্যান বাড়ি নামে একটা রেস্টহাউস টাইপ বাড়িতে (বাজারের একদম পাশেই) উনি থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন, বেশ বড়সড় একটা রুম আমাদের দেয়া হল, পার ডে এক হাজার টাকা হিসেবে। রুমে একটা মাত্র খাট, বাকিরা ফ্লোরিং করবো বলে ঠিক করলাম।
ততক্ষণে দুপুর, পেটে খিদে জানান দিচ্ছে। বাজারে ৪-৫টার মত খাবার হোটেল আছে, সব ঘুরে আমরা সী ফুডেই হানা দিলাম। নামটা বাহারি হলেও হোটেল দেখে হতাশ হতে হয়। তবে খাবার এর আইটেম মাশাআল্লাহ, কয়েক পদের। নানান রকম ভর্তা-ভাজি ( শিম ভর্তা, মিষ্টি কদু, আলু, লাল শাক, ঢেঁকি শাক ইত্যাদি ইত্যাদি), কয়েক পদের মাছ (চিংড়ি, লইট্যা, ইলিশ, বাটা ইত্যাদি), মুরগী। দামও খুব বেশি না, ৫০ টাকার মধ্যে সবগুলো শাক-ভর্তা আর বাটা মাছ খাওয়া হয়ে গেল।
হোটেলটার সামনেই একটা মুদিখানা, ওখানে ৫টাকার বিনিময়ে মোবাইলে চার্জ দেয়া যায়। সেখানে কেউ কেউ চার্জ দিলাম। ওরা শতভাগ বিশ্বস্ত, তাই মোবাইল চার্জে দিয়ে সারা দুনিয়া ঘুরে এলেও মোবাইল হারানো যাবে না। খাওয়ার পর আমরা ব্যাগ গুলো বাশার ভাইয়ের জিম্মায় রেখে লুঙ্গি, গামছা, শর্টস আর ফুটবল নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম, উদ্দেশ্য নিঝুম দ্বীপে বীচ মত একটা জায়গা আছে, ওখানে ফুটবল খেলবো, তারপর গোছল দিব। শুনেছিলাম বীচ টা খুব একটা দূরে না। শুরু করলাম হাঁটা, সারারাত জার্নি আর ঠান্ডাই এমনিতেই কাহিল হয়ে পড়েছিলাম, তাই বেশ ক্লান্ত লাগছিল। তাই যতই হাঁটি, পথ আর ফুরোয় না। গ্রামের লোকজনকে বলি বীচ আর কতদূর, তারা বলে অনেক দূর। শেষমেষ হতাশ হয়ে সবাই মিলে হাঁটায় ক্ষান্ত দিয়ে হাসি কলোনি নামের একটা জায়গায় রাস্তার উপর বসে পড়লাম সবাই মিলে। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।রাস্তার পাশেই বন। অবশেষে রবি ভাই আর মশিউর ভাইয়ের উদ্যোগে বনের ভেতর ঢুকবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম, উদ্দেশ্য যদি হরিণের দেখা মেলে। আমাদের সাথে ইলিয়াস নামের স্থানীয় এক পিচ্চি কোথায় থেকে যেন জুটে গিয়েছিল, তাকেই আমরা গাইড হিসেবে নিলাম। পিচ্চিটা ব্যাপক ত্যান্দর, সে নিঝুম দ্বীপে যে দুদিন ছিলাম, ছায়া হয়ে ছিল, যে কোন কাজ বলা মাত্র করে দিয়েছিল। তাকে সঙ্গী করে ঢুকে পড়লাম বনে। জীবনে প্রথমবারের মত কোন বনের ভেতর প্রবেশ, অন্যরকম অনুভূতি। ছোট ছোট শ্বাসমূল বুঝিয়ে দিচ্ছিল আমরা ম্যানগ্রোভ বনে। পায়ের নিচে কখনও শুকনো পাতার ভেঙ্গে যাওয়া, কখনও শ্বাসমূল কিংবা মরা ডালের মুট মুট করে ভেঙ্গে যাওয়া, প্রতিটা শব্দের আলাদা আলাদা প্রাণ আছে যেন। কান পেতে রাখলে মাঝে মাঝে পাখির ডাকও শুনতে পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে বনের গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করলাম। বনে হারিয়ে যাওয়ার একটা শংকাও মনে কাজ করছিল, সন্ধ্যাও নামি নামি করছে। তবে গাইড পিচ্চিটা আমাদের অভয় দিল। পরে বুঝলাম এসব বনে হারানো গেলেও টেনশনের তেমন কিছু নাই। সারা বনে শিরা-উপশিরার মত অসংখ্য নালা (ওরা বলে খাল) আছে, এসব খালের যে কোন একটা ধরে এগুলেই বন থেকে বের হওয়া যায়। সে যাই হোক, তেমন একটা নালার পাশে এসেই প্রথম হরিণ দেখলাম, ঝাঁক ঝাঁক না, মাত্র দুইটা, তাও কয়েকটা ঝলক মাত্র। ওরা কানে এত্ত বেশি শোনে, আমাদের আওয়াজ পেয়েই দিয়েছে দৌড়। তাই গাছের ফাঁক দিয়ে দ্রুত অপসৃয়মান হরিণ দেখেই সন্তুষ্ট হতে হল। সবাই মিলে ফিরতি পথ ধরলাম। বনের পাশে একটা খোলা মাঠ মত পেয়ে সেখানে কিছুক্ষণ ফুটবল খেলা হল। তারপর ফিরতি পথ ধরলাম। একটা রিক্সা পেলাম, সেটাতে তিনজন চেপে ২.৫ কিমি পথ পাড়ি দিয়ে আবারো বাজারে ফিরলাম, ভাড়া ৫০ টাকা নিল। বাজারে ফিরে নাস্তা সেরে রুমে গেলাম, গিয়ে দেখি বাসার ভাই বিশস্ততার সাথে সব ব্যাগ রুমে দিয়ে গেছেন। সবাই মিলে খানিক্ষণ গড়াগড়ি করে নিলাম, আড্ডা দিলাম, কার্ড খেলাও চলল।
এরপর রাতে খাওয়ার পালা। মেন্যু দুপুরের মতই। আর তারপর এল প্রথম রাতের আকর্ষণ কাঁকড়ার আইটেম। রুটি দিয়ে কিংবা এমনি এমনি খেতে তার তুলনা নেই। অবশ্য কাঁকড়া খেতে চাইলে বাসার ভাইকে আগেই বলে রাখতে হবে। আমরা দুপুরে বলে রেখেছিলাম, তাই রাতে পেয়েছিলাম। খেয়ে এসেই কয়েকজন পোকার খেলতে বসে গেল। বাকিরা ঘুমালাম। ঠান্ডাটাই চরম পেইন দিল। রাতেই ডিসিশন হল, পরদিন সকালে মশিউর ভাই আর রবি কাকার নেতৃত্বে দুটো দল আলাদা আলাদা হয়ে হরিণ দর্শন অভিযানে বেরুব।
২য় দিনঃ
সকালে ঘুম থেকে উঠে বাজারে গেলাম নাস্তা করতে। রুটি, ডিম দিয়ে নাস্তা সেরে দুই দল দু’দিকে রওনা দিলাম। নাস্তা সারতে আমরা বেশ দেরি করে ফেলেছিলাম। আরো আগে রওনা দেয়া উচিত ছিল। মশিউর ভাই ৩০০টাকা চুক্তিতে একজন ভ্যানওয়ালা+গাইড ম্যানেজ করে ফেললেন, ওনার নাম মোক্তার। নিঝুম দ্বীপে টুরিস্ট পরিবহনের একচ্ছত্র অধিকার শুধুমাত্র মোটর সাইকেল আর রিক্সাওয়ালাদের। আর ভ্যান এর কাজ শুধুমাত্র মালামাল পরিবহন। তাই ভ্যানওয়ালা আমাদের নিতে রাজি হওয়ার মোক্তারের সাথে রিক্সাওয়ালারা খানিকক্ষণ গ্যাঞ্জাম করলো, আমরা হতাশ হয়ে হাঁটা দিলাম মাইজ্জার চরের দিকে, যেখানে হরিণের দেখা মিলবে। কিছুক্ষণ হাটার পর দেখলাম মোক্তার তার ভ্যান নিয়ে বীরদর্পে চলে এসেছে। সবাই মিলে ভ্যান এ চড়ে বসলাম। কিন্তু ভ্যান এর যে অবস্থা! একফোঁটা তেল দেয়া নাই। ভ্যান যেন নড়েই না। কি আর করা, সবাই মিলে পালাক্রমে ভ্যান ঠেলে ঠেলে চললাম। উল্লেখ্য, আমাদের এই দলে ছিলাম ৭ জন। বাকিরা অন্য দলে। অবশেষে এসে পড়লাম একটা গ্রামমত জায়গায়, সেখান থেকে নৌকা করে মাঝারি মাপের একটা খাল পাড়ি দিয়ে মাইজ্জার চরে পৌছালাম। নৌকা আর তার মাঝির বর্ণনা না দিলেই নয়। ছোট একটা ডিঙ্গি নৌকা, তার মাঝি তিনটা পিচ্চি, বয়স বড়জোর দশ হবে, আর নৌকাতে একেবারে তিনজনের বেশি পাড়ি দেয়া যায় না। কি আর করা, জান হাতে নিয়ে টলমল করতে করতে পাড়ি দিলাম। একটা বিস্তীর্ণ খোলা ঘেসো জমি পেরিয়ে বনে ঢুকলাম। বনের মাঝে চলা দায়। কেয়া কাঁটা নামে বিচ্ছিরি কাঁটা যুক্ত একটা গাছে সব ঢেকে আছে, পথ চলতে হলে কাঁটার খোঁচা হজম করতে হয়। দুই হাতে দুটো ডাল নিয়ে পথ করে চলতে হল। মোক্তারের নেতৃত্বে আমরা বনের ঢুকলাম। তবে বুঝলাম আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি, হরিণ দেখতে হলে সূর্যোদয়ের আগে রওনা দেয়া উচিত ছিল। কি আর করা, তবু বনের ভেতর ঢুকে ঘোরাঘুরি করতে থাকলাম। একসময় গতদিনের মতই ৩-৪টা হরিণ দেখা গেল। প্রায় ঘন্টা তিনেক বনে কাটানোর পর ফিরতি পথ ধরলাম। বলে রাখা ভাল, পন্ডিতি করে গাছে চেপেছিলাম, গাছে ডাই পিঁপড়ার বাসা, একটা মাত্র কামড়, তাতেই দুইদিন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ দশা। আমরা যখন ঢুকেছিলাম তখন ছিল ভাটা। ফেরার পথে জোয়ার পেলাম। ফলে শুকনো খালগুলোতে পানি ঢুকে পড়েছে, প্রায় বিশটার মত খাল পাড়ি দিয়ে অপেক্ষমান নৌকাতে ফিরে আবার পাড়ি দিয়ে এপারে চলে এলাম। আসার পথে নিজেই ভ্যান চালালাম, বালিকাবন্ধু আর টিমমেটদের আল্টিমেট পচানি সত্ত্বেও পুরোটা পথ মাতব্বরি করে চালিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। স্থানীয় লোকজন এসব দেখে ভালই মজা পাচ্ছিল। তবে আসল মজাটা টের পাইছিলাম রাতের বেলা, হিপের ব্যাথায় পেছনটা যখন মাটিতে ছোঁয়াতে পারছিলাম না……….
চেয়ারম্যান বাড়ি ফিরেই হেভি একটা গোছল দিলাম। এখানকার নলকূপ গুলোতে পানি এত্ত সহজে ওঠে, কোন কষ্টই লাগে না। গোসলের পর হালকা গড়িয়ে নিলাম। তারপর দুপুরের খাবার যথারীতি সী বার্ডে, ওখানকার ইলিশ আর চিংড়িটা এতই অসাধারণ, এখনো জিবে লেগে আছে। খাওয়ার পর দশ টাকা ঘন্টা হিসেবে সাইকেল ভাড়া করে আমরা গতদিনের অসমাপ্ত কাজ অর্থাৎ সী বিচে গমনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। বাজার থেকে সী বীচ পাক্কা সাত কিলোমিটার। যাওয়ার পথে অন্তর ভাই বারদুয়েক আছাড় খেয়ে পেছনটা সাদা বানিয়ে ফেলেছিল। ওখানে গিয়ে ভালোই মজা হল। দুই ভাগে ভাগ হয়ে ফুটবল খেললাম। খেলা শেষে সূর্যাস্ত দেখলাম। সন্ধ্যা গড়িয়ে যেতেই ফিরতি পথ ধরলাম। পথে গরম জিলাপী খেলাম, স্বাদটা দারুণ।
সাইকেল চালিয়ে ফেরাটা বহুদিন স্মৃতিতে রয়ে যাবে। মাথার উপর চাঁদ, কখনও মেঠো পথ, কখনও বা কংক্রিটের রাস্তা, রাস্তার দুপাশে বন, পাতার মর্মর, বাতাসের শনশন আওয়াজ, চারপাশে মায়াময় আলো। শহুরে জীবনে এই স্বাদটা কখনই পাওয়া হবে না।
বাজারে ফিরে সাইকেল জমা দিয়ে নাস্তা সেরে রুম এ ফিরলাম। পরদিন সকালে উঠে চলে যাব, সাথে নিয়ে যাব কিছু অসাধারণ স্মৃতি, ভাবতেই মন খারাপ লাগছিল। সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে আসছিল। কিছুটা গড়িয়ে নিয়ে বারবিকিউ, আগুনে ঝলসানো মুরগী পরটা দিয়ে খাওয়া। এর মাঝে ফারুকের স্পন্সরে আবারো কাঁকড়া খাওয়া হল। খাওয়ার পর ঘুম।
৩য় ও শেষ দিনঃ
ভোরে উঠে আমরা সবকিছু গোছগাছ করে সী বার্ডে গেলাম। সেখানে অপেক্ষা করছিল গরমাগরম নরম খিচুড়ি আর ডিম। সিমপ্লি এমন খিচুড়ী ঢাকায় পাওয়া অসম্ভব। স্বাদে দিওয়ানা টাইপ। খাওয়ার পর একটা টমটম (লেগুনা) ভাড়া করা হল, আমাদের নিঝুম দ্বীপ ঘাটে পৌঁছে দেবে, ভাড়া ৩০০ টাকা। ঘাটে একটা ট্রলার, সেটাতে চেপে দুরু দুরু বুকে রওনা হলাম, গন্তব্য তমলদ্দি ঘাট। মনে মনে আল্লাহ বিল্লাহ করতেছি, ডুবলে তো শেষ। তবে নিরাপদেই প্রায় তিন ঘন্টার যাত্রা শেষ করে পৌঁছে গেলাম তমলদ্দি ঘাট, যেখানে অপেক্ষা করছিল এম ভি টিপু। ঘাটে আমাদের জন্য বাড়ি থেকে হাঁসের মাংস রান্না করে নিয়ে রনির বাবা এনেছিলেন, সেটা আর রুটি দিয়ে দুপুরে হাউকাউ করে খাওয়া হল। লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হল ১২.৩০ এ। আবার সেই আগের মত জায়গা দখল করে বসা, হই চই, পোকার, টুয়েন্টি নাইন। সবার মাঝেই ভ্রমণ জনিত ক্লান্তি স্পষ্ট ছিল, কিন্তু চোখেমুখে একটা তৃপ্তির আভা টের পাচ্ছিলাম।
সারারাত চলার পর ভোর সাড়ে পাঁচটায় সদরঘাটে পৌছে গেলাম। সেখান থেকে হলে ফিরতে ফিরতে সাতটা বেজে গেল। তারপর আর কি, কাকের হাউকাউ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া, মন জুড়ে তখনো নিঝুম দ্বীপ আর তার আশ্চর্য ভাল মানুষগুলো।
২৭ শে নভেম্বর, ২০১২ সকাল ১১:২৮
ইয়াসির আরাফাত শুভ্র বলেছেন: সাড়া দিয়ে ফেলেন ভাই, লেইট করলেই দেরি হয়ে যাবে............
২| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১২ সকাল ১১:৫৪
আরমান ফয়সাল বলেছেন: আমাকেও ডাকতেই আছে ডাকতেই আছে . . .. সাড়া দেয়া হচ্ছে না।
২৭ শে নভেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:১৬
ইয়াসির আরাফাত শুভ্র বলেছেন: সাড়া দিয়ে ফেলেন ভাই, লেইট করলেই দেরি হয়ে যাবে..........
৩| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১২ দুপুর ১:০৩
মাইকেল কলিয়নি বলেছেন: Ahaaa darun akta tour diyechen
Amar je kobe sujug hobe
৪| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১২ বিকাল ৪:৩৭
ইঞ্জিনিয়ার মশিউর রহমান বলেছেন: হুম, স্মৃতিগুলো স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
৫| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১২ রাত ৯:৩০
যান্ত্রিক উন্মাদ ১২৬ বলেছেন: র্যাগের খাওয়ার বদলে ট্যুর !! ট্যুরের পুরো খরচ কি ০৭ দিয়েছে ?!
ভালো লিখছেন ভাই।।
+
২৭ শে নভেম্বর, ২০১২ রাত ১০:০৮
ইয়াসির আরাফাত শুভ্র বলেছেন: আমাদের শুধু লঞ্চ এ যাতায়াত ভাড়াটুকুই দিতে হয়েছে, বাকি পুরোটাই ওনাদের। খাওয়া তো অনেকই হয়, এই ট্র্যাডিশনটা আমরাও ধরে রাখবো ইনশাআল্লাহ।
ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১|
২৭ শে নভেম্বর, ২০১২ সকাল ১১:০৬
মুহিব বলেছেন: আমাকেও ডাকে এই দ্বীপ। ডাকতেই আছে ডাকতেই আছে . . .. সাড়া দেয়া হচ্ছে না।