![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি সহ আমার বাকি চার ভাইবোনের জন্ম হয়েছিল একটা গোয়াল ঘরে। সে ঘরে প্রতিদিন সাপ এসে গাভির দুধ খেয়ে যেত। আমরা আতংকে জড়সড় হয়ে সাপের দুধ খাওয়ার দৃশ্য দেখতাম। সাপ সম্ভবত কুকুরের সাথে খুব একটা বিবাদে যায় না। আমাদের সাথে সে সাপের বিবাদের কথা কেউ কখনো বলেনি।
আম্মায় হাসি মুখে কইল – তোর আব্বায় আলমারির চাবি পল্টাইছে।
আব্বা তালা বদলাইলে আমার কি সমস্যা ? আমি অবাক হবার ভান করলাম। অভিনয়টা সম্ভবত মানসম্মত হয় নাই। সবাই হুঙ্কার দিয়ে হেসে উঠল। এদের সাথে উঠাবসা করাই বৃথা- গজগজ করতে করতে আমি রুমের বাইরে চলে এলাম। মাথায় ঝড় উঠে গেছে। আজ রোজার পনেরটা পার হয়ে যাচ্ছে। ঘরের কেউ একটা সুতাও পায়নি। প্রতি ঈদে এই সংসারে আমি-ই ত্রাতার ভুমিকায় অবতীর্ণ হই। শুধুমাত্র রোজার ইদের বেতনের টাকা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লুট করি। এই লুটের কারনেই সবাই এক আধটা করে জামা কাপড় পায়। কাগজে কলমে আমরা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। কিন্তু অনেক ভাইবোন আর দাদা নানার বাড়ির লেঞ্জালেঞ্জির কারনে আমাদের অবস্থা করুনতর। আমরা যে ভিক্ষে করিনা এটাই বেশি। পরিচিত জনেরা টাকা পয়সা নিয়ে আলোচনা শুরু করলে আমি রাম নাম জপতে শুরু করি। এদের আলোচনা আর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল হয় আমাদের অবস্থা নিয়ে দুঃখ দুঃখ ভাব করা নয়ত ব্যাক্তিগতভাবে আমার আলোচনা শুরু করে দেয়া। আমি যে একটা চোর- এই বিষয় প্রতিষ্ঠায় তাঁদের আগ্রহের কমতি কোন কালেই ছিল না। যাদের জন্য চুরি করি আজ তারাও আমারে নিয়া হাসি তামসা করল- শালার এই ছিল কপালে।
তালা বদলাইয়া ফেলছে মানে কি? আমার ঘুম নিদ্রা বন্ধের যোগার। পরের দিন দুপুর পর্যন্ত কোনমতে অপেক্ষায় রইলাম। আব্বা কলেজে গেছে আর আম্মা দুনিয়ার কাপড় চোপড় নিয়ে গোসলে ঢুকছে। ছোট কাঠের আলমারিটার কাছে গিয়ে একেবারে থ বনে যাওয়ার যোগার। ইন্ডিয়ান গোল তালা লাগাইছে। এই তালার চাবি বানানো একেবারে অসম্ভব। আমি মনে করতাম দুনিয়ার কোন শক্তিই আমাকে এই কাজ থেকে বিরত রাখতে পারবেনা। কিন্তু আজকে মনে হচ্ছে এই ঈদে ঘর থেকেই বের হবার কোন উপায় আর খোলা রাখা হয়নাই। আব্বা সব বন্ধ করে দিছে। নতুন কাপড় ছাড়া যেহেতু বের হতে লজ্জা লাগবে তাই ইদের দিনেও বের হব না। ধির লয়ে ফিরে এসে আমার ঘরে শুয়ে রইলাম। ঘুম পাচ্ছে। একটা বড় মাছি না কি যেন উড়ে উড়ে যাচ্ছে আবার ফিরেও আসছে। এর ভো ভো আওয়াজে ঘুমানোর সাধ্য কারো নাই। ভালো করে চেয়ে দেখি ভ্রোমরার চেয়ে অনেক চিকন লম্বা কালো একটা মাছি বিশেষ। তাকিয়ে রইলাম। হঠাৎই বিষয়টা আমার মাথায় আসল। এরা কাঠ ছিদ্র করে বাসা বানায়। এবার আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এর দিকে তাকিয়ে রইলাম। মশারির ফ্রেমের কাঠে এর বাসা। উড়ে এসে বসল। কি জানি কি চিন্তা করে আবার উড়ে গেল। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। কত নিখুত আর মিহিভাবে কাঠকে এরা ছিদ্র করে ফেলে। চমৎকার। আমিও ছিদ্র করব পন করলাম।
তালার কড়ার চারপাশের কাঠ সরিয়ে ফেলার জন্য চিকন বই সেলানোর বুট নিয়ে কাজে নেমে পড়লাম। আব্বা আম্মাকে চেক দিয়ে পাতলা এই কাঠ ছিদ্র করতে সাত রাত সাত দিন লাগার যোগার। অবশেষে তালা সমেত কড়া বের হয়ে এলো। আমি খুশিতে কিছুক্ষন গড়াগড়ি খেলাম। আলমারি থেকে একুশ শ টাকা চুরি করে ভাইয়ার হাঁতে দুহাজার দিয়ে বললাম এই টুকুই আনতে পেরেছি। এর মধ্যেই সবার কাপড় কেনা শেষ কর। তারা দেরি না করে ইদের বাজারে বেড়িয়ে পড়ল। ঘরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে আমি আশে পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। মনে মনে আল্লাকে ডাকছি আব্বা যেন ইফতারের পরে বাসায় ফিরে আসে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে জানি বিকেল চারটা থেকে ইফতারের আগ পর্যন্ত আব্বা উন্মাদ হয়ে ঘুরে বেড়ায়। মাগরিবের আধা ঘণ্টা পর সে মানুষে পরিনত হয়। গত সপ্তাহে গোমতী নদীর এক মাঝি কে বিনা কারনে ঘুষি মারতে গেছে। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে মাঝি তখনই তাকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দেবে। মানুষের জানের কাছে দিয়া গুল্লি যায়। সেইদিন আমাদের সবার জান প্রায় নিয়াই গেছিল মাঝির বৈঠা।
আব্বা আজ অন্যদিনের চেয়েও অন্তত আধা ঘণ্টা আগে বাসায় ফিরল। রোদে পুড়ে তামা হয়ে গেছে চেহারা। আমি অপেক্ষা করছি কখন সে কাপড় খুলে শান্ত হয়ে বসবে। বসার কোন লক্ষন তাঁর মধ্যে দেখা যাচ্ছেনা । হাঁটাহাঁটি করছে। আম্মা আতঙ্কে দুরে দুরে থাকতে শুরু করেছে। কি জানি দেখেছে কিনা সে গভীর মনযোগের সাথে আলমারির দিকে তাকিয়ে রইল। হেঁটে হেঁটে সামনে এসে কড়া দুট পরীক্ষা করে তালা খুলল। আমি মাত্র পাঁচ ছয় ফিট দুরে খাটের নিচ থেকে সব দেখে যাচ্ছিলাম।
টেবিলে দুটো চায়ের কাপ ছিল। এগুলো দিয়েই কালে ভদ্রে আমরা চা খাই। আমাদের বাসায় কেউ আসেনা। কাউকে ভালো কাপে চা দেবার বাধ্যবাধকতাও নেই। কাপের ভাঙ্গা টুকরো গুলো আমার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। উপুর হয়ে থাকতে থাকতে সিরামিকের ভাঙ্গায় আমার দু হাতই কেটে গেছে। আব্বা গম্ভীর হয়ে খাটের উপরে বসে আছে। অবাক কাণ্ড আজ ইফতারের পরেও উনি কাপড় বদলাননি। আমার ভাই বোনেরাও ফিরে আসছেনা। খাটের নিচে আছে আলু আর মিষ্টি কুমড়া। অন্য পাশে এক চিলতেয় আমি পশুর মত টিকে থাকার চেস্টা করছি। আজকের ইফতার হয়েছে একেবারে নিঃশব্দে। কেউ আমার খোঁজ করেনি। কেউ এর প্রয়োজনও বোধ করেনি।
©somewhere in net ltd.