![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি সহ আমার বাকি চার ভাইবোনের জন্ম হয়েছিল একটা গোয়াল ঘরে। সে ঘরে প্রতিদিন সাপ এসে গাভির দুধ খেয়ে যেত। আমরা আতংকে জড়সড় হয়ে সাপের দুধ খাওয়ার দৃশ্য দেখতাম। সাপ সম্ভবত কুকুরের সাথে খুব একটা বিবাদে যায় না। আমাদের সাথে সে সাপের বিবাদের কথা কেউ কখনো বলেনি।
আমি আর বুটির বাপ আমাদের থাকার ঘর আর ঘরের বাইরে স্থির জ্বলে থাকা বাতি দুটি নিভিয়ে দিলাম। ষাট আর চল্লিশ ওয়াটের বাতি গুলো জ্বলতে জ্বলতে এদের চিমনির তলাতে কাল-খয়েরি দাগ বসিয়ে ফেলেছে। লাইট গুলোর ভেতরেও কিছু বালু জমেছে। এয়ার টাইট বাল্বে বালু কিভাবে ঢুকতে পারে আমার মাথায় আসেনা। বুটির বাপ ঘুম থেকে উঠেই তাঁর কাকরাইলের অফিসে চলে যায়। মাস শেষে নয়শ টাকা নাকি স্যালারিও পায়। ২০০৬ সালে একটা সি এ ফার্ম তাঁদের শিক্ষানবিশদের নয়শ টাকা স্যালারি দেয়- কথাটা ঢাকার কোন ভিক্ষুকই বিশ্বাস করবে না। আমরা করি এবং নয়শ টাকা আমাদের জীবনে অসম্ভব জরুরী। সো, আমরা এসব কেয়ার করিনা। আমাদের কাছে নয়শ টাকা নয় লাখ টাকা, নয় কোটি টাকার চেয়েও বেশি। এই নয়শ টাকায় বস্তির ঘরটার ভাড়া হয়, কারেন্ট বিলের টাকা হয়। বাসার মালিকের পাগল ছেলে তরুন ভাই ( বয়সে আমার অনেক ছোট। শুধু রডের ভয়ে ভাই ডাকি, সালাম দেই, শালীনতার সাথে মাথা নিচু করে কথা কই ) তাঁর মা বাবাকে রোড দিয়ে পিটিয়ে প্রায়ই আমাদের দু'জনকে তাঁর জীবনের গল্প শোনায়। সবই কাজের ছেরি'কে কিভাবে ধর্ষণ করেছে, এরপর লাগাতার আপোষের মাধ্যমে একই কাজ চালিয়ে গেছে সেইসব গল্প। বুটির বাপ আমার চেয়ে বেশি সাহসী। তাঁর ভয়ডর নেই কিন্তু আমি ভয় পাই। সারাক্ষন ভয় পাই এই পাগল ছেলে কখন তাঁর ঘরের দরজা খুলে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পরে। আমি এই ঘর, এই বিছানায় বেশিরভাগ সময় একা শুয়ে শুয়ে বই পড়ি, বৈ দিয়ে মুখ ঢেকে ঘুমিয়ে পরি, ঘুম ভাঙ্গার পর বৈ পড়ি। আমার যাবার জায়গা নেই। এই ঘরে বসার জায়গা নেই। খিলগাঁ ব্রিজের নিচ থেকে আড়াই শ টাকায় কেনা খাট, তাঁর উপর পারমানেন্টলি লাগানো মশারীই আমাদের ভরসা। এখানে দিন আর রাতের কোন পার্থক্য নেই, সব অন্ধকার। চব্বিশ ঘণ্টা লক্ষ লক্ষ মশার বিচরন। আমার জীবনে এমন বহুবার হয়েছে যে, ঘুম থেকে উঠে বউয়ের সাথে দেখা করতে যাব কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছিনা, ভদ্র মহিলার সাথে লাস্ট কবে আমার দেখা হয়েছে। কতক্ষন বা কতদিন ঘুমিয়েছি তাও ধারনা করতে পারছিনা। ঘরের ভেতরের আলো রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা-ই জ্বলে। অনবরত জ্বলতেই থাকে। যে জ্বলে তাঁর জ্বলার শেষ নেই- আমি যেন এই সত্যকে শিখলাম বাতির দিকে তাকিয়ে থেকে থেকেই।
ঘরের একমাত্র যে দরজা দিয়ে আমরা দুজন নির্গত হই সেটা বের হয়েছে লেট্রিনের পাশ ঘেঁষে। এখানকার লেট্রিনটা কমন, সকলের জন্য উন্মুক্ত। এখানে আপনি বাথরুম করার সাথে সাথেই সেই নোংরা জিনিস গুলো একটা পাইপ দিয়ে খোলা ড্রেনে পরে। সেই ড্রেন চলে গেছে আমার ঘরের দরজার মুখ ঘেঁষে। দরজা খুলে আমরা দুজনে লাফ দিয়ে বের হই। বৃষ্টির সময় আমাদের খুব সমস্যা যায়। লাফ দিয়ে বের হবার উপায় থাকে না। সামনের কলোনির সকল পানি এখানটায় জমা হয়। এক ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই পানি অবধারিতভাবে আমাদের ঘরে ঢুকে পরে। ঘরের পাশে দিয়ে সারাক্ষনই কেউ না কেউ হেঁটে যায়। আমাদের ঘরে তাঁদের চলায় পানিতে ঢেউ উঠে। আমরা খাটে বসে বসে সাগরের মত এওমন ঢেউ দেখি। সেই ঢেউয়ের সাথে যোগ হয় টয়লেটের ময়লা। সেসব না দেখার ভান করি। এখানে একটা টয়লেট ব্যাবহার করে রশিদের মা, রশিদ, আমি, বুটির বাপ, আমার এই মহান ফ্ল্যাটে ( দ্যা লিটল হাউজ অন্য দ্যা প্রেইরি ) বেড়াতে আসা বন্ধু বান্ধব, কলোনিতে ভিক্ষা করতে আসা সকল নারী পুরুষ ভিক্ষুক আর আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের সামনে পসরা বসানো শ'খানেক চা, বিস্কুট, পুরি, সিঙ্গারা, পেয়াজু বিক্রি করা দোকানি। এ পানি দিয়ে তাঁরা ধোয়ামোছা, রান্না এবং খাওয়ার কাজ চালিয়ে যায় কত সহজে। ভ্রাম্যমান এইসব দোকানের লোকেদের গোসল, টয়লেট সবই এখানে। এটা ঢাকার ব্যাস্ততম একটা ল্যাট্রিন, বাথরুম, নিত্য ব্যাবহার করা কমন রুম, হাজার মানুষের ব্যাবহারের পানির উৎস। এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আমাদের মত দুই উঁই পোকার বসবাস।
- বাতি নিভাইলাম কতক্ষন হইল রে ? আস্তে করে বুটির বাপরে জিগেস করলাম।
; পনের বিশ মিনিট হইছে- তাঁর সংক্ষিপ্ত উত্তর। আমার জীবনে দেখা সে-ই একমাত্র মানুষ যিনি উভয়চর, সব্যসাচী, সাহসী, সংগ্রামী। আমি এমন একজন লোকের সঙ্গ পেয়ে সন্যাস জীবনের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছি। এ সিদ্ধান্তকে নিজের কাছে কখনো ভুল বলে মনে হয়নি।
- তোর কি মনে হয় কেউ টের পাইব ? ফিসফিস করে জিগেস করলেও আমি জানি আমার গোলা উঁচা। আওয়াজ হয়, অনেক আওয়াজ।
; খাইয়া আইসা যদি ধরাই আর হাঁটা চলার উপ্রে টাইনা শেষ কইরা ফেলি তাইলে গন্ধ বেশি দুর ছড়াইব না মনে হয়। এই খাওয়া হচ্ছে আইডিয়াল স্কুলের উল্টা পাশে রাস্তায় বানানো চিতই পিঠা আর লাল মরিচ পিষে শুটকি সহ ভর্তা। আমরা দুইজনে পেটভরে খাই বারো টাকায়।
- তাঁর কাছে এইটাই শুনতে চাইছিলাম। আমি আর সে প্রতিরাতে এইসব খাইয়া ঘুমাইতে যাই। সে ঘুমাইয়া পরে। সারাদিন অনেক অনেক কাজ শেষে তাঁর ঘুম এসে যায়। সে ঘুমায়। আমি তাঁর গায়ে হেলান দিয়ে ঝিমাই। আমার ঘুম আসে না। ঘুমের অসুধে না, ধোঁয়ায় না, ওপিয়য়েডসে না, কোন কিছুতে-ই না। সারারাত হাটুর নিচ থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত হাড় দুইটা যেন ব্যাথা করতে করতে ফেটে যায়। পায়ের তালু আগুনের মত গরম হয়ে থাকে। একটা তেনা পানিতে ভিজিয়ে কিছুক্ষন পরপর পায়ের তালু মুছি। দুই হাঁতে দুই পা টিপতে থাকি। এক সময় কান্না আসতে থাকে। বুটির বাপের ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে আমার সাথে রাগ দেখায়।
- ' তুইও এই অভিশপ্ত জীবন বেছে নিলি ? কেন ? তুই কেন আমার মত হতে যাবি ? আমার জীবন কি মানুষের ? পশুর জীবন এরচে অনেক ভাল- সে চিৎকার করে উঠে। তারপর এক সময় কিছুটা শান্ত হয়ে বলে- দেখি কাল আগারগাও বিএনপি বস্তিতে যাব। এখন ঘুমা বলে পাশ ফিরে শোয়।
কৃতজ্ঞতায় আমার চোখে পানি এসে যায়। কাল সে যদি আগারগাও যায় কখন যাবে, কখন ফিরবে , আসা যাওয়া কেনাকাটায় কতক্ষন লাগবে, সে কি বোরাক পরিবহনে যাবে ? বোরাকের ভাড়া বেশি। জনপ্রতি বারো টাকা। আসা যাওয়ায় চব্বিশ টাকা। অথচ আট নাম্বার বাসে গেলে তাঁর সব মিলে খরচ পড়বে চৌদ্দ টাকা। সমস্যা বলতে সামান্য দেরি হবে। নাহ, দেরি করা যাবে না। ত্রিশ টাকা খরচ হলেও দেরি করা যাবে না। নরমালি আসলে এত দেরি হত না যদিনা আগারগাও বস্তির মধ্যখান দিয়ে খাল টা না যেত। এটা পার হতে হয় হেটে হেটে, তাঁর আগে শিশুমেলায় নেমে সাবধানে এগুতে হয়। পুলিশের ভয় আছে। একে খাটো করে দেখার উপায় নেই। আগে এদের হাঁতে ধরা পড়লে টাকা পয়সা রেখে দিত। এখনো রেখে দেয় তবে তাঁর আগে রাইফেলের বাট দিয়ে পায়ের পাতা গুলো থেতলে দেয়। নানান অপ্রাসঙ্গিক, অপ্রয়োজনীয় চিন্তায় ডুবে যাই।
এ রকম অদ্ভুত,অপ্রাসঙ্গিক এবং আজেবাজে চিন্তা করতে করতেই এক সময় ফজরের আজান দেয়। আজান শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গেছি। একেকজন মুয়াজ্জিন যেন একেক স্টাইলে, একেক ফেরকায়, একেক পজিশনে, একেক সময়ে আজান দেয়। তাঁদের আজান শেষ হয় না। দুই মিনিটের একটা আজানের আগে তিরিশ মিনিট দুরুদ পড়ে, জিকির করে। উপদেশ দেয়। এদিকে আমার পেট খারাপ। আজান শেষ হবার আগে টয়লেটে যেতে খুব ভয় আমার। আমি অসহায়ভাবে অপেক্ষা করতে থাকি। এক সময় চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে। পেটে অসহ্য যন্ত্রনা। পা' দুটো কেটে ফেলতে হবে- এত ব্যাথা সহ্য হয় না। হাটুর জয়েন্ট নাড়াতে পারি না, গোড়ালির নিচে পানি জমেছে। বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিয়ে ছেড়ে দিলে পায়ের পাতার চামড়া স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে না। ট্যাপ খেয়ে গভীর খাদের মত দেখায়। পায়ে প্রচুর পানি জমে গেছে।
১৪.১২.১৬ ইং
আগারগাও, ঢাকা।
©somewhere in net ltd.