নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নাই নাই

মিয়া মোহাম্মাদ আসাদুজ্জামান

অতি সামান্য একজন মানুষ। যা আছে তা নিয়েই সুখী।

মিয়া মোহাম্মাদ আসাদুজ্জামান › বিস্তারিত পোস্টঃ

সিলেট ডায়েরি, পর্ব-২ঃ বহুরুপী রিক্সাওয়ালা আর যাত্রীকুল

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:৪৯

পর্ব-২ঃ বহুরুপী রিক্সাওয়ালা আর যাত্রীকুল

সিলেট শহরের যানবাহনগুলোর মধ্যে খুব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আধিক্য মোটরসাইকেলের। তারপরেই সিএনজি আর রিক্সা। আমি ছাপোষা গরীব মাস্টর। যাতায়াতের জন্যে মোটরসাইকেল আর সিএনজি এর চাইতে রিক্সা আর রিক্সাওয়ালাদের সাথেই আমার বেশি যোগাযোগ করে চলতে হয়। সকাল এগারোটার আগে দোকানপাট না খোলা যদি সিলেটের অনেকগুলো বৈশিষ্টের একটি হয়, তাহলে রিক্সাওয়ালাদের বিবিধ ধরনের নখরা হচ্ছে আরেকটা গুরূত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই শহরে এসব নখরাবাজ রিক্সাওয়ালাদের বেশিরভাগের আমদানী হয়েছে ঠিক আমার মতনই উত্তরবঙ্গ থেকে!

আপনি যে পেশাই করুন না কেন, সেটা শিক্ষকতা হোক, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে হোক, দিনমজুরের ইট ভাঙ্গার কাজ হোক বা রিক্সাচালনা হোক, প্রতিক্ষেত্রেই আপনার সৎ এবং দায়িত্বশীল থেকে কাজ করা উচিত। আপনার কাজকে দায়সারা হিসেবে নিয়ে তা অন্য মানুষের কাছে হালকা করে ফেলা মোটেই কাম্য নয়। শিক্ষক যদি বলে যে, “আমি এতো ক্লাস টেস্ট নিতে পারবোনা”, “এতো ক্লাস নিতে পারবোনা”, “এতো খাতা দেখতে পারবো না” সেটাও যেমন কাম্য নয়, তেমনি রিক্সাওয়ালা যদি বলে যে, “””অমুক জায়গায় যাবো না”, “এখন যাবো না”, “এইটা কি দিলেন? (হয়তো ন্যায্য ভাড়া ১০টাকা ) ২০টাকা দেন”, সেটাও কাম্য নয়। আরে বাবা, তুমি যদি নাই যাও, তাহলে রিক্সা বের করেছো কেন? তুমি যদি মধ্যাহ্নভোজ বা ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার কারণে বিরতি নিয়ে থাকো, তবে তা মার্কেটপ্লেস বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে পার্ক করে করছো কেন? একটু কম ভিড়ের জায়গায় দাঁড় করিয়ে বিশ্রাম নাও না কেন? আবার মাঝে মাঝে তারা যাত্রীর জন্যে দাঁড়িয়ে থাকে, বিশেষ করে দুপুর ৩টার দিকে, কিন্তু যখন জিজ্ঞেস করি যাবে কিনা, গন্তব্যের নাম শুনে বলে, ওদিকে যাবেনা। এখন কথা হচ্ছে আমার গন্তব্যের দিকে হয়তো জ্যাম বেশি বা জায়গাটা বিপদজনক, আমি হয়তো তা জানিনা। হতেই পারে। তো একদিন পরীক্ষা করার জন্যে অফিসের সামনে এক রিক্সাওয়ালাকে সুধালাম,
- ডাইবর যাইতায় নি?
- কই যাইতা?
- আম্বরখানা।
- নাহ। যাইতাম নায়।
- ভেরি গুড। রিকাবীবাজার?
- নাহ। যাইতাম নায়।
- বারুদখানা?
- নাহ।
- কাজীটুলা, লামাবাজার?
- নাহ।
- আবে হালায়, কই যাইবা তাইলে? আইজকা তুমি যেইহানে যাইবা, আমি ঐহানেই যামু!
খুব সম্ভবতন এরকম রাগান্বিত স্বরের ঢাকাইয়া শুনে রিক্সাওয়ালার মনে আমার মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। কোথাও যেতে আর রাজি হয় না। তা তুই বাবা যদি কোথাও না যাস, তবে জিজ্ঞেস করলি কেন, কই যাইতায়?

সিলেটে রিক্সাওয়ালাদের সাথে ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের বদানুবাদ, তর্কাতর্কি খুব বেশি বেড়ে যাওয়ায়, সিটি কর্পোরেশন জায়গায় জায়গায় রিক্সা ভাড়ার তালিকা টানিয়ে দিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে মনেহয় যে, এখানে আবহাওয়ায় কথা বিবেচনা করা উচিত ছিলো। গ্রীষ্মের অসহ্য গরমের দুপুরে অথবা বর্ষার মুশুলধারে বৃষ্টির মধ্যে আপনি জিন্দাবাজার থেকে আম্বরখানা পয়েন্ট পর্যন্ত এসে রিক্সাওয়ালাকে নিশ্চয় ১০টাকা ভাড়া দিবেন না, তাই না? আবার ভাড়ার তালিকা টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়েছে জানার পরেও রিক্সাওয়ালাদের বেশি ভাড়া চাওয়ার অভ্যাস বদলেনি। চৌহাট্টা পয়েন্ট থেকে কাজীটুলা-নয়াসড়ক পয়েন্ট পর্যন্ত যাবার পরে যখন আমার এক কলিগ ১৫টাকা ভাড়া দেয়, তখন রিক্সাওয়ালা শিং বের করে ফুঁসে উঠে বলে, “এইটা কি দিলেন? আরও ১০টাকা দেন!” সবাইতো আর আমার মতন নিরীহ না। সে যদি বুনোওল হয়, আমার কলিগ হচ্ছে বাঘাতেতুল। সে রিক্সাওয়ালাকে বলে, “খাড়াও দিরাম”। এ কথা বলে সেই মোড়ের যেই মাথায় ভাড়ার তালিকা আছে, সেখানে নিয়ে যায় রিক্সা। তারপর নেমে সেখানে ভাড়ার তালিকায় সিটি কর্পোরেশন থেকে নির্ধারিত ভাড়া দেখিয়ে তার হাতে সেই ভাড়া (১০টাকা) ধরিয়ে দিয়ে হাঁটা দেয়!

বৃদ্ধ কোন মানুষ রাস্তায় রিক্সা চালাচ্ছে, এমন দৃশ্য যদি আপনি দেখেন, তাহলে কি করেন? সেই রিক্সা যদি খালিও থাকে, তবুও সেটা আপনি নেন না। খুবই স্বাভাবিক। আপনার মাথায় কাজ করে, “আহারে! বৃদ্ধ মানুষ। এতো কষ্ট করে রিক্সা চালাচ্ছে। থাক, ওনাকে আর কষ্ট দেয়ার দরকার নেই।“ কিন্তু আপনার মাথায় এটা একবারও আসেনা যে, সেই বৃদ্ধ মানুষটা কতটুকু হতভাগা যে তাকে এই বয়সে এসে রিক্সাচালনার মতন কষ্টসাধ্য কাজ করতে হচ্ছে। আপনার মতন অন্য দশজন মানুষের চিন্তার ফাঁদে পড়ে সেই বৃদ্ধ তার পেট চালানোর মতন যাত্রী আর পান না। সেই হিসেবে আপনার এই মায়া উল্টো তার ক্ষতিই সাধন করছে। আমার নিজেরও ইচ্ছা করেনা এরকম বৃদ্ধ মানুষের রিক্সায় উঠে তাকে কষ্ট দিতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আপনি যদি এগিয়ে গিয়ে রিক্সায় না উঠে তাকে যদি অর্থ সাহায্য করতে যান তাহলেও বিপদ আছে। কারণ তার আত্মসন্মানবোধ প্রবল জন্যেই সে ভিক্ষাবৃত্তিতে না গিয়ে রিক্সাচালনায় এসেছে। যাই হোক, এ প্রসঙ্গে এক রিক্সাওয়ালার কথা মনে পড়ে যায়। মেহেদী দেয়া লাল দাঁড়ির এই রিক্সাওয়ালা আপনাকে তার রিক্সায় ন্যায্য ভাড়াতেই উঠতে দিতে রাজি হবে। গন্তব্যে পৌঁছানোর খানিক আগে সে “বাবাজি” শব্দটা দিয়ে শুরু করবে, অর্থাভাবে মেয়ের বিয়ে না দিতে পারার গল্প। সেজন্যে সাহায্য চাইবে। সিলেটে আসার ছয় বছরের মধ্যে একাধিকবার এই লোকটার রিক্সায় উঠেছি। প্রতিবারই একই গল্প। শেষের বার বাবাজি শব্দটা উচ্চারণ করার সাথে সাথে খুব কর্কশভাবে বলেছিলাম, ‘ছয় বছর ধরে মেয়ের বিয়ে দিয়েই যাচ্ছেন, সেই সাথে মেন্দীও! নতুন কোন গল্প তৈরী করেন না কেন?’ লোকটা তার লাল দাঁড়িওয়ালা মুখে একটা অপ্রস্তুত হাসি ঝুলিয়ে ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

আরেকদিন অফিসে যাবার জন্যে বাসা থেকে বের হয়েছি। রাস্তায় খালি রিক্সা অপ্রতুলতায় অস্থির হয়ে যখন চাতকপাখির মতন ইতিউতি তাকাচ্ছি, তখন দেখলাম একজন বৃদ্ধ মানুষ একটা খালি রিক্সা নিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে আসছেন। আমার গন্তব্যে যেতে রাজি হওয়ায় যখন রিক্সায় চেপে বসলাম, তখন দেখি বৃদ্ধর এক পায়ের পাতা ব্যান্ডেজ করা। প্রচন্ড খারাপ লাগার অনুভূতি আর একরাশ অপরাধবোধ গ্রাস করলো আমাকে।অত্যন্ত ধীরগতিতে রিক্সাচালনারত বৃদ্ধ বলে উঠলো,
- বাবাজি, ফাওয়ো বেদনা। ইতার লাগি আস্তে চালাইরাম।
- কোন অসুবিধা নাই। আপনি আস্তে আস্তে যান।
প্রতিবার হাফ সাইকেল প্যাডেল মারার পরেই পা দুটো একটু ঝাড়া দিয়ে নিয়ে অত্যন্ত কষ্টের সাথে রিক্সা টানতে থাকলো বৃদ্ধ। এভাবে চালাতে চালাতেই স্থানীয় ভাষায় বলতে থাকলো যে, কতটা কষ্ট করে সে জীবন যাপন করছে। পায়ে অপারেশন দরকার। আবার শ্বাসকষ্টের সমস্যাও আছে। ডাক্তার ইনহেলার নিতে বলেছে। কিন্তু এসব করার মতন যথেষ্ট টাকাপয়সা তার নাই। তার এসব কষ্টের কথা শুনে বুকের ভিতরটা হুহু করে ওঠে। আম্বরখানা থেকে চৌহাট্টা পর্যন্ত অত্যন্ত কম দূরত্বটাই আমার কাছে মনে হতে থাকে অত্যন্ত দীর্ঘ । রিক্সা চৌহাট্টা পয়েন্টে পৌছানো মাত্রই লাফিয়ে নামি রিক্সা থেকে। বৃদ্ধের হাতে একটা একশো টাকার নোট গুঁজে দিয়ে পালাতে থাকি। পালাবার সময় পিছন থেকে বৃদ্ধের “এই ভাড়াও অনেক কম হয়ে গিয়েছে” জাতীয় গজরগজর, অপরাধবোধকে সরিয়ে বিস্ময়ের অনুভূতিকে জায়গা করে দিতে বাধ্য হয়। --- সেদিন বাসায় আসার পরে স্ত্রী অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে, আমি অনুপস্থিত থাকাকালীন সময়ে বাসায় ঘটে যাওয়া সেদিনের ঘটনাবলীর বয়ান শুরু করে। এর মধ্যে একটা ঘটনা ছিলো যে, তার ছাত্রী আজকে পড়তে আসার সময় এক বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালার রিক্সায় করে এসেছে। বৃদ্ধের অবস্থায় বিগলিত হয়ে তাকে দশ টাকার জায়গায় পঞ্চাশ টাকা ভাড়া দেবার পরে বৃদ্ধ রাগান্বিত হয়ে গালিগালাজ করে পুরো এলাকা নাকি মাথায় উঠিয়েছে! ঘটনা শুনে কষ্ট লাগে। অর্থনৈতিক ক্ষতির দুঃখের চাইতে প্রতারিত হবার দুঃখটাই তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে বুকের মধ্যে শূল হয়ে বিঁধে। বিশ্বাস জিনিসটাকে একটা তাত্ত্বিক ধারণা ছাড়া বেশি কিছু মনেহয় না। ফলিত ক্ষেত্রে এটার প্রয়োগ বা অস্তিত্ব আছে বলেও সন্দিহান লাগে। বিশ্বাসের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি।

ঢালাওভাবে যেকোন পেশার সকল মানুষকে আপনি অসৎ বলতে পারেন না। সকল পেশাতেই সৎ এবং অসৎ দুই ধরনের পেশাজীবিই আছেন। একই প্রসঙ্গে আরেকটা ঘটনার কথা বলি। কোন এক ঝুমবর্ষার দিনে আমার এক স্যার সকালবেলায় অফিসে আসেন । ক্লাস নেয়া শেষে আমার ডেস্কে চায়ের আড্ডার পরে উনি যখন বের হবেন, তখন আমরা আবিষ্কার করি যে, ওনার মানিব্যাগ ওনার সাথে নাই! স্যার একটু ভুলোমনা। কিন্তু মানিব্যাগতো বাসায় ফেলে আসতে পারেন না। কারণ ঐ ঘটনা হলে রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া দেয়া সম্ভব হতো না। ঘটনা অ্যানালাইসিস করার পরে বোঝা গেলো যে, সকালে মুশলধারে বৃষ্টির মধ্যে এক হাতে ব্যাগ আর আরেক হাতে ছাতা ধরে ভাড়া দিয়ে মানিব্যাগ পকেটে চালান দিতে যাবার সময় সেটা পড়ে গিয়েছে! নগদ টাকার সাথে মানিব্যাগে স্যারের ক্রেডিট কার্ড, অস্ট্রেলিয়ার রেসিডেন্ট পারমিটসহ দুনিয়ার তাবদ দরকারী জিনিস ছিলো। সাথে সাথে ব্যাংকে ফোন দিয়ে ক্রেডিটকার্ডটা বন্ধ করালেন। কিন্তু বাকি জিনিসের কি হবে? স্যার প্রচন্ড মন খারাপ করে বাসায় চলে গেলেন। পরের ঘটনাটা অদ্ভুত। সন্ধ্যার সময় সেই রিক্সাওয়ালা স্যারের বাসায় হাজির! এবং এসেই তার দুঃখ প্রকাশ এই জন্যে যে, সে আরও আগে আসতে পারেনি। বিকেলের দিকে সেদিনের মতন রিক্সাচালনা থেকে ইস্তফা নিয়ে, আখালিয়ায় গিয়ে যে এলাকা থেকে সকালে স্যার রিক্সা নিয়েছিলেন, সেখানকার মানুষজনকে জিজ্ঞেস করে করে খুঁজে বের করে ফেলে স্যারের বাসা! মানিব্যাগে দরকারী কার্ডগুলোর সাথে সাথে নগদ হাজার দুয়েক টাকার পুরোটা অক্ষত! সে কোন পুরষ্কার নিতেও রাজি হয়নি! এই ধরনের ঘটনাগুলো আজও ঘটে। আমাদের সমাজেই ঘটে। এই ঘটনাগুলোর কারণেই এখনও আপনি মানুষের উপর বিশ্বাস হারাতে পারেন না। আপনি প্রতিদিনের ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে হতাশ হয়ে গিয়ে মুখ খারাপ করে গালিগালাজ করে দেশের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে ফেললেও, এই ঘটনাগুলো আপনার মনের কোণে আশার প্রদীপটা জ্বালিয়ে রাখার কাজটা করে যায়।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৩:৫২

করুণাধারা বলেছেন: সিলেটের রিক্সায়ালাদের মত এমন লাটসাহেব আর কোথাও নেই। শুধু ডাইবার বললে তারা পাত্তা দেয় না, ডাইবারসাব বলতে হয়।

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১০:০২

মিয়া মোহাম্মাদ আসাদুজ্জামান বলেছেন: আপনের বাড়ি সিলেটে নাকি?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.