![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মনের বাগিচা পায়ে দলে হালের অবার্চীন, মুখোশের অন্তরালে তারা মরুয়তে দীন
অন্ধকার চিরে ঢং ঢং করে ঘন্টা বেজে উঠলো। রাতের খাবারের সংকেত এটা। খাবারের সময় হলে ঘন্টা বাজিয়ে দুই হোস্টেলে জানিয়ে দেয়া হয়। এক এক করে পশ্চিম আর দক্ষিন হোস্টেলের একশোর বেশি ছাত্র ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত হলো। আজ ইলিশ মাছ রান্না করা হয়েছে। একটা বিশাল টেবিলে বাটি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিটা বাটিতে ইলিশের একটা করে পিচ আর কিছুটা ঝোল। হোসেন স্যার হাজিরা খাতা নিয়ে টেবিলের পাশে উপস্থিত হলেন। হাজিরা খাতা ধরে তিনি নাম ডাকবেন আর এক জন এক জন করে তার পছন্দ মতো বাটি নিয়ে আসবে। যার নাম প্রথমে ডাকা হবে সেই পছন্দ করে সবচেয়ে বড় পিচটা নেয়ার সুযোগ পাবে। পর্যায়ক্রমে সবাইকে সুযোগ দেয়ার জন্য বিভিন্ন দিন বিভিন্ন রোল থেকে নাম ডাকা শুরু হয়। আজ প্রথম নাম ডাকা হলো রুদ্রের। ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলো ও। মাছের মধ্যে ইলিশ আর মাংসের মধ্যে গরু সবচেয়ে প্রিয় ওর। হোস্টেলে জঘন্য রান্নার জন্য অন্য কোন মাছ ও খেতেই পারে না। এক মাত্র ইলিশ মাছ আর গরুর মাংসটাই রান্না খারাপ হলেও খাওয়া যায়। আজ ওর প্রিয় মাছ রান্না করা হয়েছে, সেই সাথে ডাকটাও প্রথম। নিজের পিঠ নিজেকেই চাপড়াতে ইচ্ছে করলো ওর। টেবিলের সামনে গিয়ে দাড়ালো। সামনে একশোর বেশি বাটি। বাটিগুলোতে এক নজর তাকিয়েই সব চেয়ে বড় পিচটা আবিস্কার করে ফেললো ও। পিচটা মাছের লেজ। যদিও লেজ ওর পছন্দ নয় তবুও প্রিয় মাছের এতো বড় পিচটা সুযোগ পেয়েও হাত ছাড়া করা যায় না। লেজের বাটি নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলো ও। প্রতিটা ডাইনিং টেবিলে একটা করে ভাতের আর একটা করে বিশাল ডালের গামলা। ভাত এবং ডাল যে যতো ইচ্ছে খেতে পারে। ডালের ভিতরে ডাল খোজা বৃথা। ডাল আসলেই ডাল দিয়ে রান্না করা হয় কিনা তাতে ওর যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এই ডাল দিয়ে খাওয়ার পরে অনেকে মজা করে হাতও ধোয়। রুদ্র খেতে বসতেই বুঝতে পারলো আজ কতো বড় আহাম্মক হয়েছে ও। ইলিশ মাছের লেজে মাছের চেয়ে কাটাই বেশি, থকথকে কাটা। মাছের লেজে এতো কাটা হয় কি করে! এতো কাটা বেছে কি খাওয়া যায়? বাড়িতে ওকে কখনো লেজ দেয়া হতো না। তাই ইলিশ মাছের লেজে যে এতো কাটা থাকতে পারে সেটা ওর জানা ছিলো না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো জিবনে কোন দিন আর ইলিশ মাছের লেজ ও খাবে না। খাওয়ার মাঝামাঝি সময়ে চারপাশে লক্ষ করে দেখলো সবারই খাওয়া হয়ে গেছে। পাশের টেবিলে বেলাল নামের এক জন গামলার ভিতরে মুখ দিয়ে ডাল খাচ্ছে। এমন সময় আরেক জন এসে ওর পুরো মাথা গামলায় ডুবিয়ে দিলো। ভাগ্যিস হোসেন স্যার এ সময় উপস্থিত নেই। তিনি থাকলে দুজনকেই পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দিতেন। খেতে অনেক সময় লাগলো রুদ্রের। খাওয়া শেষে মিজুর সাথে একটু কথা বলে রুমে চলে এলো।
আকাশে একটু চাদ উঠেছে। কিন্তু সে চাদকে বার বার মেঘ ঢেকে দিচ্ছে। অদ্ভুত এক ধরনের আলোআধারির খেলা শুরু হয়েছে। দুই হোস্টেলের মাঝে স্কুলের বিশাল মাঠ। রাতে খাওয়ার পরে এক হোস্টেল থেকে আরেক হোস্টেলে কেউ যায় না, ভয়ে। পশ্চিম হোস্টেল মাঠের ওপাশে। পশ্চিম হোস্টেলের পিছনে বাড়িঘড় নেই। শুধুই আবাদি জমি। রাতে মাঝে মাঝেই হোস্টেলের টিনের চালে ঝুরঝুরে ঢিল পড়ার শব্দ হয়। হঠাত করে নাকি সুরে কান্নার আওয়াজও পাওয়া যায়। অনেকেরই ধারনা স্কুলের কোথাও না কোথাও জিনপরি থাকে। এটা তাদেরই কাজ। ছাত্রদের ভিতরে এ নিয়ে একটা আতংক সব সময় লেগেই থাকে। তাই দুই হোস্টেলের কোন ছাত্রই রাতে একা বেড় হয় না। কিন্তু হোসেন স্যারের ভয়ডর নেই। তিনি থাকেন দক্ষিন হোস্টেলের পাশে এক তলা বিল্ডিংয়ের একটা রুমে। ছাত্ররা কি করছে সেটা দেখার জন্য গভির রাতেও চুপিচুপি তিনি পশ্চিম হোস্টেলে যান।
আজও পশ্চিম হোস্টেলে যাওয়ার জন্য হোসেন স্যার গভির রাতে বেড় হয়েছেন। পশ্চিম হোস্টেলে যাওয়ার আগে রুদ্রদের রুমে একবার হানা দিলেন। রুদ্র এবং আবুল সুবোধ বালকের মতো পড়ছে। রুদ্রের রুমে ঢুকে বললেন- হোস্টেলের বাহিরে যাওয়ার চিন্তা ছেড়ে লেখাপড়ায় মন দাও।
রুদ্র বুঝতে পারলো হেড স্যারের সাথে হোসেন স্যারের কথা হয়েছে। নানা বোরহান উদ্দিনের চিঠির বিষয়টা ইতিমধ্যেই হোসেন স্যার জেনে গেছেন। স্যারকে রুদ্র বললো- হয়তো কাল আমি কিছু দিনের জন্য হোস্টেল থেকে চলে যাচ্ছি স্যার।
হোসেন স্যার অবাক হয়ে বললেন- তুমি তো বেশ কিছু দিন পরে আজই হোস্টেলে এলে। আবার কোথায় যেতে চাচ্ছো?
- একটু বেড়াতে যাবো স্যার।
- লেখাপড়া বাদ দিয়ে শুধু বেড়ালে হবে?
- একটু কাজ আছে স্যার।
- আমি আশ্চার্য হচ্ছি! একদিকে তোমার নানু চিঠি দিয়েছেন, আবার আবুলের বাবাও চিঠি পাঠিয়েছেন। ব্যাপারটা কি?
আবুলের বাবার চিঠির কথা শুনে রুদ্রও অবাক হলো। এটা ওর জানা ছিলো না। পাশের রুমে আবুল ছিলো। আবুলও এটা জানতো না। ও নিজেও স্যারের কথা শুনে কম আশ্চার্য হলো না। স্যারের কাছে রুদ্র জানতে চাইলো- আবুলের বাবা কি বিষয়ে চিঠি দিয়েছেন স্যার?
- আবুল কিছু দিন তোমার সাথে থাকবে আর ও যদি কোথাও যেতে চায় তাহলে আমরা যেনো বাধা না দেই। তোমার নানার মতই.......
হঠাত কথা থামিয়ে দিতে বাধ্য হলেন স্যার। ওদের সবাইকে চমকে দিয়ে টিনের চালে ঝুরঝুরে ঢিলের শব্দ হতে লাগলো। কেউ যেনো অনেকগুলো ছোট ছোট মাটির ঢিল একত্রে টিনের চালে ছুড়ে মারছে। ঘরের ভিতরে ওরা কিছুক্ষন ভয়ে জমে বরফ হয়ে থাকলো। শরির শিউরে উঠলো। তারপর রুদ্র দৌড়ে বাহিরে এসে চিতকার করে বললো- কে কে?
কিন্তু কেউ কোন জবাব দিলো না। কাউকে কোথাও দেখাও গেলো না। টিনের চালে তখনও শব্দ হচ্ছে। হোসেন স্যার এবং আবুলও বাহিরে এলো। এবার শব্দ থেমে গেলো। হ্যারিকেন জালিয়ে মাটিতে ঢিল খোজা হলো কিন্তু পাওয়া গেলো না। হোস্টেলের আরো কয়েক জন ছাত্র জমা হয়েছে। সবার চোখে মুখেই আতংক। হোসেন স্যার সবাইকে রুমে চলে যেতে বললেন। সবাই যে যার রুমে ফিরে গেলো। রুদ্র এবং আবুলও নিজেদের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।
হোসেন স্যার প্রথমে একটু ভয় পেলেও কিছুক্ষনের মধ্যে নিজেকে সামলিয়ে নিলেন। ভাবলেন এটা হয়তো ফাজিল কারো কাজ। রুদ্রদের টিনের চালের সাথে হোস্টেলের বাকি ঘরের চালের সংযোগ আছে। সম্ভবত সেই সংযোগ স্থানে ঢিলগুলো আটকে গেছে। কাল সেটা দেখতে হবে। তিনি দক্ষিন হোস্টেলে একটা চক্কর দিয়ে পশ্চিম হোস্টেলে যাওয়া শুরু করলেন। পশ্চিম হোস্টেলের কয়েকটা ছাত্রকে তিনি কোন মতেই শিক্ষা দিতে পারছেন না। রাতে ওরা লেখাপড়া বাদ দিয়ে তাস খেলে। আজও ওরা যদি তাস খেলে তবে পিঠের চামরা তুলে নিবেন।
মেঘে চাদ ঢাকা পড়েছে। সব কিছু আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। শিরশিরে বাতাস বইছে। কেমন একটা ভৌতিক পরিবেশ। হোসেন স্যার ভয় পাওয়ার লোক না হলেও আজ তিনি কিছুটা হলেও ভয় পেয়েছিলেন। রুদ্রদের টিনের চালে হঠাত করে যেভাবে ঝুরঝুরে ঢিলের শব্দ হলো তাতে ভয় না পাওয়ার কথা নয়। একবার ভেবেছিলেন পশ্চিম হোস্টেলে আজ যাবেন না। কিন্তু একটু আগেই সে সিদ্ধান্ত বাতিল করেছেন। কারন আজ না গেলে সবাই ভাববে তিনি ভয় পেয়েছেন।
দক্ষিন হোস্টেল থেকে পশ্চিম হোস্টেলে যাওয়ার পথে কয়েকটা বড়সড় রেইন্ট্রি গাছ পড়ে। অন্ধকারের বুক চিরে দাড়িয়ে আছে গাছগুলো।গাছের পাতাগুলো বাতাসে দুলছে। পাতাগুলো থেকে কেমন যেনো ভৌতিক শব্দ হচ্ছে। আজ সব কিছুই ভৌতিক ভৌতিক লাগছে। গাছগুলোর কাছাকাছি যেতেই হোস্টেলের বিদ্যুত চলে গেলো। আর তখনই তিনি নাকি সুরে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলেন। ভয়ে থমকে দাড়িয়ে পড়লেন। পা সামনে অগ্রসর হতে চাইছে না। পায়ে যেনো শিকড় গজিয়ে গেছে। সামনের রেইন্ট্রি গাছ থেকে অদ্ভুদ একটা শব্দ হতেই গাছের দিকে তাকালেন তিনি। এবার তার অন্তরাত্মা কেপে উঠলো! একি দেখছেন তিনি! কয়েকটা উলঙ্গ মুর্তি গাছের এক ডাল থেকে আরেক ডালে ছুটে বেড়াচ্ছে। এমন সময় কুকুর আর শেয়ালের এক টানা ডাক শুনতে পেলেন। নাকি সুরের কান্নাটাও জোরালো হলো এবার। নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না তিনি। ভয়ে তার শরির থরথর করে কাপতে লাগলো। কোন মতে বাচাও বাচাও বলে পিছনে ছুটতে শুরু করলেন। এক ছুটে রুদ্রদের রুমের সামনে এসে দরজায় কয়েক বার জোরে জোরে করাঘাত করলেন। রুদ্র দরজা খোলার আগেই জ্ঞান হারালেন তিনি।
রুদ্র এবং আবুল স্যারকে ধরে বিছানায় শুয়ে দিলেন। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে তার জ্ঞান ফেরানো হলো। জ্ঞান ফেরার পরে তিনি থরথর করে কাপতে লাগলেন। তার শরির ঘেমে জবজবে হয়ে গেছে। চিপ দিয়ে ঘামের চিকন স্রোত নেমেছে। রুদ্র স্যারকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। স্যার কাপা কাপা হাতে পানিটুকু খেয়ে নিলেন। চিতকার শুনে বাকি ছাত্ররাও ইতিমধ্যে চলে এসেছে। পশ্চিম হোস্টেল থেকেও অনেকে এসেছে। রুদ্র বললো- কি হয়েছে স্যার?
হোসেন স্যার তোতলাতে তোতলাতে সংক্ষেপে ঘটনার বর্ননা দিলেন। কুকুর, শিয়ালের ডাক এবং নাকি সুরের কান্না অনেকেই শুনেছে। কিছু সাহসি ছাত্র এক জোট হয়ে রেইন্ট্রি গাছের নিচে গেলো। কিন্তু সেখানে তারা কিছুই পেলো না। রুদ্রদের রুমের সামনে ছাত্রদের শেষ রাত পর্যন্ত জটলা থাকলো। তারপর একে একে সবাই যে যার রুমে চলে গেলো।
হোসেন স্যার রাতে একা থাকার সাহস পেলেন না। তিনি রুদ্রের বিছানায় শুলেন। রুদ্র আবুলের সাথে আবুলের বিছানায় শুয়ে পড়লো। এক সময় সবাই ঘুমের কোলে ঢলে পড়লো। কেবল ঘুমাতে পারলো না রুদ্র। কাল মিজুর সাথে ফুলছড়ি যেতে হবে ওকে। বাকি রাতটুকু কালো বাদুরকে ধরার পরিকল্পনা করেই কাটাতে চায় ও। পরিকল্পনা নিখুত না হলে চন্দ্রের কাছাকাছি যাওয়ার আগেই খুন হতে হবে ওকে।
চলবে......
চন্দ্র উপন্যাসের ভুমিকা ও পর্ব সমুহের সুচিপত্র
©somewhere in net ltd.