নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রিয়দেশ, এক সঙ্গে বিশ্ব দেখি...

হাসান শান্তনু

সাংবাদিক, গণমাধ্যম গবেষক

হাসান শান্তনু › বিস্তারিত পোস্টঃ

যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে সৌদি মনোভাব কি পাল্টাচ্ছে?

১১ ই মার্চ, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৪৪

২১ বছর আগে পবিত্র হজ করার জন্য সৌদি আরবে গিয়েছিলাম। আমার সৌভাগ্য, সেবার আকবরি হজ পেয়েছিলাম। সেবার হজ করার সঙ্গী ছিলেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট একজনই এখন আর নেই। তিনি আমিনুল হক বাদশা। এবার আমার সঙ্গী হয়েছিল মেয়ে বিনীতা এবং বন্ধু সৈয়দ মোজাম্মেল আলী ও তার স্ত্রী। এ বছর হজ নয়, ওমরাহ করার সুযোগ পেয়েছি। সে সুযোগটা করে দিয়েছে জেদ্দায় বাংলাদেশি পরিচালিত দুটি স্কুল। তারা তাদের একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। ফলে জেদ্দায় তাদের অনুষ্ঠানে যোগদান এবং মক্কা ও মদিনায় গিয়ে ওমরাহ পালন দুটিই করতে পেরেছি। জেদ্দায় আমাদের কনসাল জেনারেল শহীদুল করিম ও তাঁর স্ত্রীর আতিথেয়তায় আমাদের এবারের সৌদি আরবে অবস্থান অত্যন্ত আনন্দদায়ক হয়েছিল।

২১ বছর আগে যখন সৌদি আরবে যাই তখন ছিল মে মাস। দারুণ অগ্নিবানে সারা সৌদি আরব জ্বলছে। এবারের ফেব্রুয়ারির সৌদি আরব ছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত। জেদ্দায় আমাদের দূতাবাসের একুশের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে লন্ডনের মতো দারুণ ঠাণ্ডায় ঠকঠক করে কেঁপেছি। পাশেই লোহিত সাগর (Red sea) থেকে যে এমন ঠাণ্ডা হাড়কাঁপানো বাতাস বইতে পারে সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না।

২১ বছর পর সৌদি আরবে গিয়ে তার শহরগুলোর উন্নয়ন এবং সামাজিক পরিবর্তন দেখে বিস্মিত হয়েছি। রাজধানী রিয়াদে যাইনি। কিন্তু জেদ্দা এবং মক্কা-মদিনার পরিবর্তন অত্যন্ত স্পষ্ট। তিনটি শহরকেই ইউরোপের যেকোনো উন্নত শহরের সঙ্গে তুলনা করা চলে। মরুভূমিতে সবুজ বনানী সৃষ্টির পরিকল্পনা মন ও চোখ দুই-ই তৃপ্ত করে। সামাজিক জীবনে আগে যে ধর্মীয় কঠোরতা ছিল, তা ক্রমশ শিথিল হচ্ছে। মক্কা ও মদিনায় তা তেমন না হলেও পোর্টসিটি জেদ্দাতে এই কঠোরতা শিথিল হওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট।

জেদ্দায় শুধু বাংলাদেশিদের দ্বারা পরিচালিত স্কুল-কলেজ নয়, পাকিস্তানি ও ভারতীয়দের দ্বারা পরিচালিত স্কুল-কলেজও আছে। তাতে হারমোনিয়াম, তবলা বাজিয়ে গান-বাজনা হয়। বাংলাদেশিদের স্কুলে একুশের অনুষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের নৃত্য পরিবেশন করতে দেখেছি। স্কুলের কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করেছি, এসব অনুষ্ঠান করার ব্যাপারে সৌদি অথরিটি বাধা দিচ্ছে কি না? তারা বলল, আগের মতো কঠোরতা আর নেই। বিধিনিষেধ ক্রমশই শিথিল হচ্ছে।

বিশ্বায়নের অনেক মন্দ দিকের সঙ্গে একটা ভালো দিক এই যে সে অন্ধ সংস্কার ও রীতিনীতির দেয়ালগুলো ভেঙে দিচ্ছে। সৌদিদের পরিচালিত টেলিভিশনে গান-বাজনা, নাটক প্রচার বন্ধ রাখলে কী হবে, বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বের আর সব টেলিভিশনের অনুষ্ঠান প্রচার তো আর বন্ধ রাখা যাচ্ছে না। ইন্টারনেট, ফেসবুকের কল্যাণে সৌদি আরবের তরুণ প্রজন্মকেও আর বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা যাচ্ছে না।

সৌদি আরব বদলাচ্ছে। তবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত ধীর ও মন্থরগতিতে। একটি আধুনিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে এবং তাদের নারীসমাজ এখন ক্রমশই অধিকার আদায়ে সরব। ওয়াহাবি রাজতন্ত্রকে এই সামাজিক জাগরণের মুখে ধীরে ধীরে নমনীয় হতে হচ্ছে। যদি তারা তা না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা প্রকট।

সৌদি রাজনীতিতেও একটা পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। সন্ত্রাসের মাধ্যমে ধর্মের নামে সৌদি প্রভাব বিস্তারের জন্য সৌদি সরকারের একটা ভূমিকা রয়েছে- এই অভিযোগ খণ্ডনের জন্যই সম্ভবত মক্কায় সম্প্রতি সন্ত্রাসবিরোধী বিশ্ব ওলামা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তাতে সন্ত্রাসকে ইসলামবিরোধী বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এমনকি গোটা মুসলিম বিশ্বকে সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ডদান সম্পর্কেও সৌদি রাজাদের মনোভাব বদলাচ্ছে কি না এ প্রশ্নটিও এখন দেখা দিয়েছে। এতকাল মনে করা হয়েছিল, বাংলাদেশের জামায়াতিরা যেহেতু ওয়াহাবিস্ট এবং সৌদি আরবের আর্থিক ও অন্যান্য মদদ পায়, সেহেতু তাদের প্রতি সৌদি সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতা প্রবল এবং দলটির যুদ্ধাপরাধী নেতাদের দণ্ড না দেওয়ার জন্যও বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের ওপর সৌদি চাপ প্রচণ্ড।

এবার সৌদি আরবে অবস্থানকালে আমার মনে হয়েছে, জামায়াতিদের (এবং তাদের সহযোগী হিসেবে বিএনপিরও) পেছনে সৌদিদের সমর্থন থাকার খবরটি ভিত্তিহীন নয়; কিন্তু এই সমর্থনটিকে জামায়াতিরা অতিরঞ্জিত করে বাংলাদেশে প্রচার করে। বিশ্ব পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ও রিয়াদের পরিবর্তে তেহরানের সঙ্গে আমেরিকা মৈত্রী প্রতিষ্ঠায় অধিকতর আগ্রহী হয়ে ওঠায় রিয়াদও সতর্ক হয়ে উঠেছে এবং তাদের অনেক নীতির যথার্থতা আবার খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে মনে হয়। সন্ত্রাস এবং যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কেও তাদের আগের মনোভাবে পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন।

সম্প্রতি জার্মানিতে হিটলারের অবশিষ্ট কোলাবরেটর এবং যুদ্ধাপরাধীদের আবার নতুন করে ধরা হচ্ছে; যদিও যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে ৬৫ বছর আগে এবং ধৃত যুদ্ধাপরাধীদের বয়সও এখন নব্বইয়ের ওপরে, তবু তাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এই যুদ্ধাপরাধীরা নাৎসি কনসেনট্রেসন ক্যাম্পে অসংখ্য ইহুদি হত্যার জন্য দায়ী। এই অপরাধীদের আইনজীবীরা বলছেন, বহুকাল আগে এই অপরাধ তারা করেছে এবং তারা নিজেরাও জীবন সায়াহ্নে উপনীত। কারাদণ্ড হলেও তারা আর জীবিত অবস্থায় কারাগার থেকে বেরোবে না। কফিনে চড়ে বের হবে। সুতরাং তাদের বয়স বিবেচনা করে সুদীর্ঘকাল আগে যে অপরাধ তারা করেছে, তা ক্ষমা করে দেওয়া হোক।

হলোকাস্টের ঘাতকদের পক্ষের আইনজীবীদের এই যুক্তি সম্পর্কে সৌদি আরবের মনোভাব কী? এই মনোভাবটি স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছে বহুল প্রচারিত সৌদি ইংরেজি দৈনিক 'সৌদি গেজেট' তাদের ২৬ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবারের সংখ্যায়। এই পত্রিকাটিকে সৌদি সরকারের অঘোষিত মুখপত্র হিসেবে ধরা হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারির সংখ্যায় এই পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিল, ‘Justice for war crimes is never too late’ (যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেরি হলেও কখনো দেরি নয়)।

এই সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘War crimes against humanity do not diminish ever decades later. They remain as an indictment, not simply of those who committed them, but of those who by omission or failure permitted them to carry them out.... They, like all who slaughter innocents...should all be brought to book however long it takes.’ এর মর্মার্থ হলো, মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ বহু দশক পরেও লঘু হয় না। যারা এই অপরাধ করেছে এবং যারা যেকোনো কারণেই হোক, এই অপরাধ করার ব্যাপারে অনুমোদন দিয়েছে তারা সবাই শাস্তিলাভের যোগ্য। নির্দোষ ব্যক্তিদের হত্যার দায়ে যত দীর্ঘ সময় লাগুক, তাদের শাস্তি হওয়া দরকার।

জার্মানিতে দীর্ঘ ৬৫ বছর পর যদি ৩০ জন অতিবৃদ্ধ যুদ্ধাপরাধীর বিচার হতে পারে এবং সৌদিরা তাতে জোর সমর্থন দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ডদানে তারা সমর্থন দেবে না কেন- এই প্রশ্নটি এখন স্বাভাবিকভাবেই উঠবে। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে মাত্র ৪৪ বছর আগে এবং যুদ্ধাপরাধীদের অনেকেই অচল বৃদ্ধ নন, বরং সচল ও সুস্থ ব্যক্তি। নিজেদের ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কেও তাঁদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা ও অনুতাপ নেই। এ অবস্থায় যত দীর্ঘ সময় লাগুক মানবতার এই শত্রুদের দণ্ডদান কি সমীচীন নয়?

সৌদি আরবে কয়েক দিন অবস্থানকালে আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশের জামায়াতি যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কেও সৌদি জনমত ধীরে ধীরে সচেতন হচ্ছে। এই জনমতের প্রভাব আজ হোক, কাল হোক, সৌদি সরকারের ওপর পড়বেই। আমি জেদ্দায় এক সৌদি ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা প্রতি শুক্রবার প্রকাশ্যে কিছু মানুষের গর্দান কাটো। অপরাধ, তারা মানুষ খুন করেছে। তোমাদের আইন বলে, খুনিকে নিহতের পরিবার মাফ না করলে সরকার তাকে মাফ করতে পারে না। তার প্রাণদণ্ড হবেই। এটা যদি শরিয়ত মোতাবেক ন্যায়বিচার হয়, তাহলে বাংলাদেশে জামায়াতি যুদ্ধাপরাধীরা যে লাখ লাখ নিরীহ নারী-পুরুষ হত্যা করেছে বা হত্যায় সহায়তা জুগিয়েছে, তাদের পরিবার-পরিজন যুদ্ধাপরাধী ঘাতকদের ক্ষমা না করলে দেশের সরকার তাদের ক্ষমা করে কিভাবে? সৌদি ভদ্রলোক বলেছেন, 'না, তোমাদের সরকার তা পারে না।'

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সৌদি মনোভাব যেমন বদলাচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ডদান সম্পর্কেও তাদের মনোভাব বদলাবে অথবা বদলাতে চলেছে, অবস্থা দেখে তা অনুমান করা যায়। সৌদি গেজেট পত্রিকা স্পষ্টই বলেছে, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বিলম্ব কোনো বিলম্বই নয়।' এ কথা শুধু জার্মান যুদ্ধাপরাধীদের জন্য নয়, বাংলাদেশের একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কেও প্রযোজ্য। বর্তমানে বিএনপি ও জামায়াত যুক্ত হয়ে দেশে যে নতুন যুদ্ধাপরাধ করে চলেছে, তাতেও তারা সৌদিদের সমর্থন পাবে বলে কি আশা করে? আমার ধারণা, শিগগিরই তাদের এই ভ্রমটিও ভাঙবে।

লন্ডন, সোমবার, ৯ মার্চ ২০১৫

(উপরের লেখাটি প্রখ্যাত কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরীর। ১০ মার্চ, ২০১৫ খ্রি.- দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত)।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ৯:১৮

সাদী ফেরদৌস বলেছেন: গভীর মনোযোগ দিয়ে লেখাটা পড়লাম , অনেক ভালো লাগা

১২ ই মার্চ, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:০৫

হাসান শান্তনু বলেছেন: ভাই, মন্তব্য করায় ধন্যবাদ।

২| ১২ ই মার্চ, ২০১৫ সকাল ৭:১৪

আমার বাংলাদেশ স্বাধীন বলেছেন: বিচার চলছে..রায় হচ্ছে...কার্যকর হয়েছে...হয়ত আরও হবে। কোন দেশ কি বলল! এটা দেখার দরকারই বা কি? নাকি অন্যর মাথায় কাঠাল ভাঙতে গিয়ে ধরা খাওয়ার শঙ্কা..............যদি গনেশ আবারও উল্টে যায় অথবা নুন খেয়েছি গুণ তো গাইতেই হবে !:#P

;) সুবিধাবাদ জিন্দাবাদ ;)

১২ ই মার্চ, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:০৫

হাসান শান্তনু বলেছেন: ভাই, মন্তব্য করায় ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.