নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রিয়দেশ, এক সঙ্গে বিশ্ব দেখি...

হাসান শান্তনু

সাংবাদিক, গণমাধ্যম গবেষক

হাসান শান্তনু › বিস্তারিত পোস্টঃ

বিএনপির সন্ত্রাসের রাজনীতি পরাজিত হতে যাচ্ছে কেন?

১৪ ই মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৪:৫৩


সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সারাবিশ্বে কমিউনিস্ট আন্দোলন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আজ পর্যন্ত সেই বিপর্যয়ের ধাক্কা বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্ট আন্দোলন কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এর প্রধান কারণ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়, তখন অন্য অনেক দেশের মতো আমাদের কমিউনিস্ট পার্টিও (এবং পার্টিগুলোও) জনসম্পৃক্ততা হারিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তি ও সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। নিজ দেশের জাতীয় সংকটে কোনো স্বাধীন সিদ্ধান্ত না নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি সমর্থন করাই তাদের প্রধান কর্মসূচি হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মস্কো সমর্থক বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অনেক শীর্ষ নেতা সর্দি হলেও চিকিৎসার জন্য মস্কো ছুটতেন।

অন্যদিকে ভারতে ও বাংলাদেশে চীনপন্থি হওয়ার নামে যে কমিউনিস্ট দল বা দলগুলো মাওবাদের বিকৃতি ঘটিয়ে সন্ত্রাসের পথ ধরেছিল, এমনকি চীনের স্বার্থে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামেরও বিরোধিতা করেছিল, চীনে মাওপন্থিসহ গ্যাঙ অব কোরের পতনের পর তার রাজনীতিতে যে সংস্কারপন্থি ও সন্ত্রাসবিরোধী পরিবর্তন আসে, তাতে ভারতে ও বাংলাদেশে চীনের ওপর নির্ভরশীল মাওবাদী ও নকশালপন্থিরা ক্রমেই নির্জীব এবং বহু গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এখন কস্ফচিৎ-কদাচিৎ নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেওয়া ছাড়া বাংলাদেশে তারা কোনো শক্তি নয়। নিজ দেশে জনগণের সমর্থন না নিয়ে বাইরের সাহায্য ও সমর্থনের ওপর নির্ভর করে সন্ত্রাস চালিয়ে যে কোনো ভালো-মন্দ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই সফল করা যায় না; ভারতে ও বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী মাওবাদী ও নকশালপন্থি সন্ত্রাসের ব্যর্থতা তার প্রমাণ।

বাংলাদেশে বর্তমানে বিএনপি ও জামায়াত আগুন দিয়ে এত নিরীহ মানুষ পুড়িয়ে মেরে এবং পেট্রোল বোমার সাহায্যে সন্ত্রাস চালিয়ে যে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল করতে পারল না এবং বিদেশি সমর্থন ও একটি সুশীল সমাজের সহায়তা সত্ত্বেও সরকারের পতন ঘটাতে ব্যর্থ হলো, তার প্রধান কারণ তাদের পেছনে জনসমর্থন ছিল না এবং এখনও নেই। আমাকে ঢাকার এক বন্ধু একটি চমৎকার কথা বলেছেন। দেশে বিএনপির প্রতি জনসমর্থন আছে; কিন্তু বিএনপির সন্ত্রাসের রাজনীতির প্রতি নেই।
বিএনপি কিছু বিদেশি শক্তির স্বার্থে ও সমর্থনে এই সন্ত্রাসের রাজনীতিতে নেমেছে। এই বিদেশিরা অধিকাংশই এখন বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের নীতি বদলাতে শুরু করায় বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসের রাজনীতির পেছনের সমর্থন ও উৎসাহদানে ভাটা পড়েছে এবং তাদের পেট্রোল বোমার সন্ত্রাসের রাজনীতিও ব্যর্থতার মুখে পড়েছে। এই ব্যর্থতা স্বীকারেরই প্রমাণ, খালেদা জিয়া তার চার দেয়ালের বিবর (অফিস ঘর) থেকে বেরিয়ে এসেছেন এবং মুখ রক্ষার জন্য একটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি যেসব আপ্তবাক্য উচ্চারণ করেছেন, সেগুলো বড় কথা নয়। বড় কথা তার সন্ত্রাসের রাজনীতি ব্যর্থ হয়েছে অথবা হওয়ার মুখে। এই উপমহাদেশে বিভক্ত কমিউনিস্ট আন্দোলনের একটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যটি চীনের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরতা দ্বারা (নিজ দেশের জনসমর্থনের পরোয়ানা না করে) সংসদীয় ও সন্ত্রাসী দুই রাজনীতিতেই আজ ব্যর্থ, তেমনি বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা হারিয়ে কেবল পাকিস্তান, আফগানিস্তানের জঙ্গিগোষ্ঠী ও সৌদি আরবের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে জামায়াতের মতো একটি স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গিগোষ্ঠীকে সহযোগী করে সন্ত্রাসের রাজনীতিতে নামলে তার পরিণতি কী ঘটে, বিএনপির কিছু নেতা এখন তা সম্ভবত হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন। দেশের মানুষ বিএনপিকে দেখতে চায় শক্তিশালী সংসদীয় দল হিসেবে; কিন্তু বিএনপির খালেদা-তারেক নেতৃত্ব দলটিকে পরিণত করেছেন সন্ত্রাসী দলে।

বিশ্ব পরিস্থিতি যে হঠাৎ করে বদলাচ্ছে এবং তা বিএনপির অনুকূলে নয়, এটা খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমানের পক্ষে হয়তো বোঝা কষ্ট; কিন্তু বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা বিশ্ব পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন। তারা কেন দলের নেতৃত্বের হঠকারিতার কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছেন, তা আমার বোধগম্য নয়। তারেক রহমানের দুর্বৃত্তপনার কাছে নতজানু হয়ে থাকতে তারা কি এতটাই বাধ্য?

এটা জানা কথা, বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসের বড় মদদদাতা পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। কিন্তু পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি এবং সন্ত্রাসবিরোধী ড্রোন হামলায় এই গোয়েন্দা সংস্থাটির শক্তি এখন অনেকটাই খর্ব। বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের ইনভিজিবল বুলডোজিং নীতির ফলে প্রশাসনে ও প্রশাসনের বাইরে আইএসআইর পোষ্য ও অনুচররা এখন অনেকটাই কোণঠাসা। বিএনপির খুব একটা সহায়তায় তারা আসতে পারছে না।

আফগানিস্তান এখনও তালেবানমুক্ত নয়। কিন্তু ক্রমাগত মার্কিন হামলার মুখে তারা আত্মরক্ষায় বেশি ব্যস্ত। অন্যদিকে ওবামা প্রশাসন তালেবানদের বিভক্ত করে তাদের একটা অংশকে গুড তালেবান আখ্যা দিয়ে তাদের সঙ্গে আপস করে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য ফিরিয়ে নিতে চায়। মার্কিন কূটনীতির ফলে আফগানিস্তান থেকে ভারতে ও বাংলাদেশে জঙ্গি প্রেরণ বা স্থানীয় জঙ্গিদের ট্রেনিংদান অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। ফলে বাংলাদেশের সন্ত্রাসীদের শক্তি দ্রুত ক্ষয় হচ্ছে, বাড়ছে না।

বিএনপির আরেকটা আশা ছিল, ভারতের মোদি সরকার তাদের সহায়তা দেবে। তাদের সেই আশায় গুড়ে বালি পড়েছে। বিজেপি সরকার ভারতের নিজস্ব স্বার্থেই বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার নীতি গ্রহণ করেছে। শোনা যায়, নরেন্দ্র মোদিকে জেঠাবাবু সম্বোধন করে চিঠি লিখেও তারেক রহমান কোনো সাড়া পাননি। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জিও বাংলাদেশ সফর করে তিস্তা প্রকল্প ও টিপাইমুখ বাঁধ সমস্যা সমাধানে শেখ হাসিনাকে তার সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে গেছেন।
আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বিএনপি যে জোর সমর্থনের আশা করেছিল এবং যা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেখাও গিয়েছিল, তার দ্রুত পটপরিবর্তন ঘটছে। বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সংলাপ এবং সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে দ্রুত একটি নির্বাচনের আপ্তবাক্যগুলো আওড়ালেও ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলস এখন বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক স্থিতাবস্থার বাস্তবতা মেনে নিয়েছে এবং হাসিনা সরকারকে সহযোগিতা দিচ্ছে। এখন সংলাপের চেয়েও সন্ত্রাসবিরোধী কথাবার্তাই তাদের মুখে বেশি। এখানে খালেদা-তারেকের প্রত্যাশা আরেকটা বড় হোঁচট খেয়েছে।

বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসের রাজনীতি ব্যর্থ ও পরাজিত হতে চলার আরেকটা বড় কারণ সম্ভবত সৌদি রাজনীতিতে দিক পরিবর্তন। আমেরিকার ওবামা প্রশাসন দেখছে, সর্বোচ্চ সামরিক চাপ ও অর্থনৈতিক স্যাঙ্কশন দিয়েও ইরানকে তারা নতজানু করতে পারেনি। সুতরাং ইরানের সঙ্গে ভারতের মতো একটা পরমাণু সমঝোতা চুক্তি করে তেহরানকে কাছে টানা এবং তাদের সহায়তায় ইরাক ও সিরিয়ায় তথাকথিত ইসলামী স্টেটের অভ্যুত্থান দমন করা তাদের লক্ষ্য। অন্যদিকে সৌদি আরবের লক্ষ্য ছিল, ইসরায়েলের সঙ্গে আঁতাত করে আমেরিকার ওপর ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করা এবং আমেরিকার সমর শক্তির দ্বারা মধ্যপ্রাচ্যে সৌদিদের প্রতিদ্বন্দ্বী শিয়া রাষ্ট্রটিকে ধ্বংস করা।

কিন্তু আমেরিকার স্বার্থেই ওবামা প্রশাসন সৌদি আরব ও ইসরায়েলের ইচ্ছা পূরণ না করে ইরানের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করতে এগিয়েছে। ফলে ত্রুক্রদ্ধ ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ওয়াশিংটন সফরে এসে প্রেসিডেন্ট ওবামার কঠোর সমালোচনা করে মার্কিন কংগ্রেসে বক্তৃতা দিয়েছেন এবং রিপাবলিকান সদস্যদের কাছ থেকে বাহবা কুড়িয়েছেন। রিপাবলিকানরাও ইরানের সঙ্গে তাদের দেশের সমঝোতা চুক্তির বিরোধী। কিন্তু ওবামা এই সমঝোতা চুক্তি সম্পাদনে বদ্ধপরিকর এবং তেহরানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সুনি্ন সন্ত্রাসীগোষ্ঠী আইএসের বিরুদ্ধে সম্মিলিত ব্যবস্থা গ্রহণে আগ্রহী। তেহরানের শিয়া সরকারও এই সুনি্ন সন্ত্রাসীদের বিরোধী এবং তাদের হামলা থেকে সিরিয়ার মিত্র আসাদ সরকারকে রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুনি্ন বিরোধে না জড়িয়ে আমেরিকা এখন সুনি্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় রিয়াদ প্রমাদ গুনছে। তারাও এখন ওবামা প্রশাসনকে না চটানোর জন্য সন্ত্রাসবিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করেছে। মক্কায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক বিশ্ব আলেম সম্মেলনে সন্ত্রাসকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দেওয়া হয়েছে এবং প্রভাবশালী সৌদি দৈনিক সৌদি গেজেটের প্রধান সম্পাদকীয় নিবন্ধে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ডদানকে জোর সমর্থন দেওয়া হয়েছে।

সৌদি রাজনীতিতে এই পরিবর্তনের হাওয়া মোটেই বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত জোটের সন্ত্রাসী রাজনীতির অনুকূল নয়। সম্প্রতি সৌদি আরবে অবস্থানকালে আমার মনে হয়েছে, নতুন বাদশাহ সালমানের আমলে বাংলাদেশের জামায়াতের প্রতি সৌদি পৃষ্ঠপোষকতা হ্রাস পেতে এবং সে দেশে জামায়াতের প্রভাব-প্রতিপত্তিও কমতে শুরু করেছে। আমার এ ধারণা যদি সঠিক হয়, তাহলে বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি-জামায়াতের সৌদি কানেকশন ক্রমেই দুর্বল হবে। চাই কি এক সময় বিচ্ছিন্নও হয়ে যেতে পারে। তা যদি হয় তাহলে বাংলাদেশের শান্তিকামী মানুষের আশাবাদী হওয়ার কারণ আছে। সন্ত্রাসের উৎসমুখ যদি বন্ধ হয়, তাহলে সেই সন্ত্রাস ব্যর্থ ও পরাজিত হতে বাধ্য। বিএনপিকেও তখন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে ফিরে আসতে হবে।

(লেখাটি লন্ডনপ্রবাসী কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর, আজকের দৈনিক সমকালে প্রকাশিত)।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.