![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমরা বাহুল্য কথা বলে থাকি প্রায়ই। যেমন বলি- লোকটি অন্ধ, চোখে দেখে না। অন্ধ মানেই তো লোকটি চোখে দেখে না, সুতরাং আলাদাভাবে চোখে দেখে না বলার দরকার নেই।
বাহুল্য কথার মতো স্বতঃসিদ্ধ কথাও বলি আমরা। যে বলায় কোনোই কৃতিত্ব নেই। শৈশব-যৌবনে নিকটাত্মীয়দের কেউ মারা গেলে যখন সান্ত্বনা দিতে আসা কেউ বলতেন- কী আর করবে বাবা, আমি-তুমি সবাই একদিন মরবো- ওই চরম দুঃখেও হাসি পেত। যে কথাটি আমিও জানি, সেই কথা বললে কি সান্ত্বনা পাওয়া যায়? পৃথিবীতে এত কথা থাকতে আমারই উপলব্ধি দিয়ে আমাকে সান্ত্বনা দেয়া! সেভেন-এইটে থাকতে খন্দকার স্যার ‘মানুষ মরণশীল’ বাক্যের ট্রান্সলেশন ধরেছিলেন। ‘ম্যান ইজ মরটাল’ উত্তর দেয়ার পর জিজ্ঞেস করেছিলাম- স্যার মানুষ যে মরণশীল, এতে কোনো সন্দেহ আছে?
তবে মানুষ মরণশীল হলেও তার অকালমৃত্যু হবে কি-না, তা স্বতঃসিদ্ধ নয়। তাই কেউ যদি অকালে প্রাণ হারায়, তাহলে সেই মৃত্যু নিয়ে মন্তব্য করাই যায়। যেমন- এখন আমরা প্রায় প্রতিদিনই বলছি, আহ্হা লোকটা এভাবে অকালে মরলো! পরিণত বয়সে বার্ধক্যজনিত কারণে কেউ মারা গেলে আমরা বলি না- ইস লোকটা এভাবে মারা গেলেন! কারণ ওই যে আগেই বলেছি মানুষ মরণশীল- এ তো স্বতঃসিদ্ধ। আসল কথায় আসি।
বাংলাদেশে এখন অকালমৃত্যুর ছড়াছড়ি। বলা যেতে পারে, আমরা মরণশীলতার সংস্কৃতির মধ্যে বাস করছি। ডানে যদি তাকাই, দেখি পেট্রলবোমায় মরছে কেউ; বাঁয়ে তাকালে ক্রসফায়ারে; সামনে সড়ক অথবা লঞ্চ দুর্ঘটনায়; পেছনে তাকিয়ে দেখি গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিটির ছায়া পর্যন্ত নেই। সংবাদপত্র ও টেলিভিশন এখন আমাদের এমন এক অভ্যাস গড়ে তুলেছে যে, মৃত্যুর খবর পড়তে বা দেখতে না পারলে আমাদের ভালো লাগে না। এই অভ্যাস যদি প্রতিরোধ করা না যায়, তাহলে অচিরেই হয়তো এটা নেশায় পরিণত হবে। আমাদের জীবন থেকে তখন মৃত্যুর খবর উইথড্র করে নিলে বমি-বমি ভাবসহ নানা উইথড্রল সিম্পটম দেখা দেবে।
হ্যাঁ, আজ আমরা মৃত্যু নিয়েই কথা বলবো শুধু। পীড়িত তার রোগের কথা ছাড়া অন্য কিছু বলতে চায় না, তেমন। এ দেশে কিছু মৃত্যু আছে যেগুলোর তাৎপর্য রয়েছে, সেগুলো প্রেরণার উৎসও। ’৫২-র বরকত-সালামরা, ’৬৬-র মনু মিয়া, ’৬৯-এর আসাদ-মতিয়ুর, ’৭১-এর লাখ লাখ নাম জানা-অজানা মানুষ, এমনকি এরশাদ আমলের নূর হোসেনের মৃত্যুর রয়েছে গভীর তৎপর্য, এককথায় বললে এগুলো
গ্লোরিফাইড মৃত্যু। কিন্তু তৎপর্যহীন, খামোখা মৃত্যুগুলোর ধকল কেন সইতে হবে আমাদের? অপ্রয়োজনীয়, বেদনার যে মৃত্যুগুলো এখন প্রত্যক্ষ করছি আমরা, কোনো কার্যকারণেই সেগুলো মেনে নেয়া যায় না। আমরা একটু আগে থেকে শুরু করি।
১৯৬৪ অথবা ’৬৫ সালের কথা। পুরান ঢাকায় সামাদ নামের একজন প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার খুন হলেন। মালীর সঙ্গে পরকীয়া ছিল তার স্ত্রীর। ওরাই হত্যা করেছিল তাকে। ইত্তেফাকে খবরটি ছাপা হওয়ার পর পুরো ঢাকা শহর থমথমে হয়ে পড়লো। কারও মুখে কথা নেই, সবার কপালে চিন্তার রেখা। বাবা সন্ধ্যায় ইত্তেফাকের একটি কপি হাতে ফিরেছিলেন বাসায়। তার দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল তিনি বুঝি চাকরি হারিয়ে এসেছেন। মনে পড়ে, সবাই গোল হয়ে বসে পড়েছিলাম খবরটি। এমন অজানা আশংকায় কোনোদিনও ভুগিনি আমরা। একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ খুন হতে পারে! মা শোকে-দুঃখে রান্নার হাঁড়ি চাপাতে চাইলেন না। সবাইকে না খেয়ে থাকতে হবে ভেবে বাবা ওই চরম বেদনার মুহূর্তেও মাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টায় রসিকতা করেছিলেন- আমাদের বাগান নেই, তাই মালীও নেই, সুতরাং আমি খুন হবো না।
সেই তো ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল ঠিকই আছে। সেই চন্দ্র-সূর্য একই রকম আছে, ছয় ঋতুর পালাবদলও ঘটছে একই নিয়মে; তবু কেন অর্ধশতাব্দীর মধ্যেই এখানকার মানুষের এতটাই বিমানবীয়করণ (dehumanisation) হয়েছে যে, পত্রিকার পাতা খুলতে কিংবা টেলিভিশনের রিমোট হাতে নিতেই ভয় হয়, পাছে মৃত্যুর খবর শুনতে হয়। বাঙালির বিমানবীয়করণ প্রক্রিয়াটি প্রকৃতপক্ষে শুরু হয়েছিল স্বাধীনতা লাভের শুরু থেকেই এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের দোষে এই প্রক্রিয়া তর তর করে এগিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু-মোশতাক-জিয়া-এরশাদ-খালেদা-হাসিনা- সব সরকারের আমলেই রাষ্ট্র মৃত্যু ঠেকাতে পারেনি, বরং কখনও কখনও রাষ্ট্র নিজেই মৃত্যুর কারণ হয়েছে। পাঠক লক্ষ করুন, বঙ্গবন্ধুসহ সৈয়দ নজরুল-তাজউদ্দীন-ক্যাপ্টেন মনসুর-কামরুজ্জামান-শেখ ফজলুল হক মণি-জিয়াউর রহমান-কর্নেল তাহের-খালেদ মোশাররফ-মঞ্জুর-ক্যাপ্টেন হায়দার- মুক্তিযুদ্ধের এই চমৎকার ব্যক্তিত্বদের কেউই স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেননি। আবার ঘুরিয়ে বললে একে অন্যের মৃত্যুর কারণ ঘটিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের রক্ষীবাহিনী হত্যা করেছিল জাসদ কর্মীসহ অনেককে, আবার বঙ্গবন্ধুও তার সরকারের চার নেতাসহ নিহত হয়েছিলেন সামরিক বাহিনীর একাংশের হাতে। জিয়া হত্যা করেছিলেন অসংখ্য সেনা সদস্যকে; আবার তিনিও নিহত হয়েছিলেন সামরিক বাহিনীর অন্য সদস্যদের হাতে। কর্নেল তাহেরের নির্দেশে হত্যা করা হয়েছিল অনেক সামরিক অফিসার; আবার তাকে প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে হত্যা করেছিলেন জিয়া। জিয়াকে মারলেন মঞ্জুর, আবার মঞ্জুরকে মারলেন অন্য সেনা সদস্য। খালেদ মোশাররফ ও ক্যাপ্টেন হায়দার তৈরি করেছিলেন মৃত্যুর যে পটভূমি, সেই পটভূমিতেই তাদের হত্যা করেছিল প্রতিপক্ষ। এভাবে হত্যা ও হত্যার দায় শোধের খেলা চলে এসেছে একের পর এক। আবার দেখুন, আমাদেরই ইতিহাসে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, রমনা বটমূলে বোমা হামলা, বিডিআর বিদ্রোহ, সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে সহিংসতা- এ সবই রক্ত দিয়ে লেখা একেকটি যারপরনাই বেদনার অধ্যায়।
এ তো গেল রাজনৈতিক হত্যার উদাহরণ। অরাজনৈতিক ক্ষেত্রেও হত্যা ও পাল্টা হত্যার ঘটনা দেখেছি আমরা একের পর এক স্বাধীনতার শুরু থেকেই। স্বাধীনতার স্বাদ পেতে না পেতেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘জল্লাদের দরবার’ নাটকে ইয়াহিয়া খানের চরিত্রে রূপদানকারী রাজু আহমেদকে হত্যা করেছিল একটি অরাজনৈতিক চক্র; আবার তিনি নিহত হওয়ার পরপরই হত্যাকারীও নিহত হয় তার সমর্থকদের হাতে। ডাকাতি অথবা ছিনতাই করতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ডাকাত ও ছিনতাইকারীদের হাতে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের তালিকাও অনেক দীর্ঘ। আবার প্রতিপক্ষ ভেবে নিছক খেয়ালের বশে কাউকে হত্যা করার ঘটনাও কম নেই এ দেশে। পুরান ঢাকার
বিশ্বজিৎ হত্যা যেমন।
এই ক্ষুদ্র পরিসরে বাংলাদেশের ৪৪ বছরের ইতিহাসের সব হত্যার বিবরণ তুলে আনা সম্ভব নয়। যেমন শুধু ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারের মৃত্যুগুলো নিয়ে লেখা যেতে পারে একটি আলাদা কলাম। কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টার ধরনের হত্যাকাণ্ডগুলোর আবার রয়েছে ভিন্ন শোকাবহ ব্যঞ্জনা। তবে সাম্প্রতিক সময়ের পেট্রলবোমা হামলার হত্যাগুলো কোন্ ক্যাটাগরিতে ফেলবো বুঝে উঠতে পারি না। হত্যা মানে টার্গেটেড ব্যক্তি
হত্যাকারীকে ক্ষুব্ধ করেছে অথবা তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে বৈষয়িক লাভালাভের একটা ব্যাপার রয়েছে। কিন্তু পেট্রলবোমায় মারা যাচ্ছে কারা? ঘোর নির্বিবাদী মানুষ। ন্যাংটার নেই বাটপারের ভয়- প্রবাদটি ভুল। ন্যাংটারও বাটপারের ভয় আছে। তার পরনে কাপড় কিংবা হাতে সোনা-দানা নেই তো কী হয়েছে? তার শরীর খামচে ধরতে পারে বাটপার। দেখুন না, কুড়িগ্রাম থেকে নাইট কোচে যিনি ঢাকায় আসছেন, পেট্রলবোমা নিক্ষেপকারীরা তার কাছে কিচ্ছু চায় না, তার শরীরটা পুড়িয়ে ছাই করতে চায় শুধু। কী সেই স্বার্থ, যার কারণে অজানা-অচেনা এক অজাতশত্র“র শরীরে ছোড়া হলো বোমা? খালেদা জিয়া খুশি হবেন, তাই? তাতে আপনার কী লাভ?
হ্যাঁ, মরণশীলতার সংস্কৃতিই এখন পার্মানেন্ট, বাকি সব টেমপোরারি। এমন যদি হতো, রক্তের বিনিময়ে আমরা যেমন পেয়েছি স্বাধীনতা, তেমনি স্বাধীনতার পর রক্তেরই বিনিময়ে পেয়েছি অর্থনৈতিক মুক্তি কিংবা গণতন্ত্র, তাহলেও একটা কথা থাকতো। সম্ভাবনার চেয়ে প্রাপ্তি অনেক কম এ দেশে, তবু কেন ঝরছে এত রক্ত, ছাইভস্ম হচ্ছে মানবদেহ? বঙ্গবন্ধু নেই, জিয়াও নেই; হাসিনা-খালেদা তো আছেন। হ্যাঁ, আমরা তাদের কাছেই রাখছি এ প্রশ্ন। ফাজলামো নয়, এটা সিরিয়াস প্রশ্ন। মজা লুটবেন আপনারা আর রক্ত ঝরাবো আমরা? ইয়ার্কি নাকি? এটা প্রাচীন রোম নয় যে, গ্লাডিয়েটররা যুদ্ধ করে একে অপরের প্রাণনাশ করবে আর গ্যালারিতে বসে সম্রাজ্ঞী সেই দৃশ্য উপভোগ করবেন। এটা বাংলাদেশ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, কোনো রানী-সম্রাজ্ঞীর সাম্রাজ্য নয়। হাসিনা-খালেদাকে দেয়ার মতো একটাই উপদেশ আছে এই লেখকের। অজ্ঞ নিয়ম মেনে চলে আর বিজ্ঞ নিয়ম তৈরি করে। আপনাদের যেহেতু আমরা বিজ্ঞ বলেই জানি, তাই ভালো নিয়ম তৈরি করুন। সেক্ষেত্রে আপনাদের অনুসারীরা সেই নিয়মই মেনে চলবে।
আজ আমরা যারা ভাবছি, মরে মরুক
লোকে, আমি তো বেঁচে আছি- ভাবনাটি শেষ হতে না হতেই সাঙ্গ হতে পারে তাদের ভবলীলা। যে রাজ্যে নিয়ম বলে কিছু নেই, সেখানে ব্যতিক্রম বলেও কিছু থাকে না। হ্যাঁ, ইংরেজিতে বললে, রিঃয হড় বীপবঢ়ঃরড়হ আমাদের
সবারই শিরে সংক্রান্তি।
মানুষ মরণশীল অর্থাৎ সে জন্মেছে মরার লক্ষ্য নিয়েই। আমাদের সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে
উঠেপড়ে লেগেছে রাজনীতি। কী আর করবে রাজনীতি! সে তো মহৎ কোনো লক্ষ্য অর্জন করতে পারছে না, তাই মানুষের মৃত্যুর লক্ষ্য বাস্তবায়নেই সচেষ্ট সে।
পুনশ্চঃ অকাল অথবা অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা লিখতে গিয়ে অসংখ্যের ভিড়ে অনেকের নামই চাপা পড়ে গেছে। হুমায়ুন আজাদ তাদের একজন। কী আনন্দই না দিতেন তিনি! বিগ বিগ টক করতেন, তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাব ছিল সবকিছুতেই; তারপরও একটা কেমন যেন সৌন্দর্য ছিল তার কথায়। তিনি নিজেই একটা টাইপ, কারও সঙ্গেই মেলে না। পৃথিবীতে বিচিত্র সব টাইপ আছে বলেই জায়গাটা এত সুন্দর। মূর্খরা বুঝলো না!
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
[email protected]
©somewhere in net ltd.
১|
২৪ শে মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৪:৫৩
যাযাবরমন বলেছেন: লাইক
এরই নাম স্বাধীনতা, এর জন্যই ৩০ লক্ষ প্রানের আত্মদান?