![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সেই ক্লাস ফাইভে থাকতে লেখালেখির ভুত মাথায় চাপল। ঐ সময়টাতে রকিব হাসানের লেখা গোয়েন্দা কাহিনী পড়তাম আর নিজেকে শখের গোয়েন্দা হিসেবে কল্পনা করতাম। অত ছোট বয়সে গোয়েন্দা হওয়া তো আর বাস্তবে সম্ভব না। কিন্তু গল্পের বই পড়ে ব্যাপারটাকে কিছুটা হলেও বাস্তব মনে হত। নিজেকে গোয়েন্দা কল্পনা করে গল্প লিখার চেষ্টা করতাম।\n\nহতে চেয়েছিলাম শখের গোয়েন্দা, কিন্তু লিখতে লিখতে খেয়াল করলাম শখের গোয়েন্দা হওয়ার চেয়ে শখের লেখক হওয়াটা আমার জন্য তুলনামূলক সহজ। বরং এতে করে শুধু গোয়েন্দা না, আরও অনেক কিছুই হওয়া সম্ভব (কল্পনায়)। তখন থেকেই লেখালেখির উপর কমবেশি পড়াশোনা করা শুরু করলাম। অজানা বিষয়গুলো সম্পর্কেও জানার আগ্রহ ছিল বরাবরের মত। এজন্য বিশ্বকোষ এনকার্টা এবং ব্রিটানিকা ঘাটাঘাটি করতাম। পাশাপাশি লেখালেখির চর্চাটাও সমানে চলতে থাকল। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, আমার লেখা প্রথম গল্পটা ছিল একটা রহস্য গল্প। নাম ছিল \'নীল সাগরের ঢেউ\'। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় গল্পটা লিখেছিলাম। বয়স তখন বেশি হলে বার কি তের বছর। তখনও আমি বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত সব লেখকদের সাথে পরিচত হইনি। তাই লেখালেখি জীবনের প্রথম গল্পটায় খুব বেশি সুবিধা করতে পারিনি। লেখার ধাঁচটা কেমন হওয়া উচিৎ তখনও বুঝে উঠার সুযোগ হয়নি। ক্লাস এইটে উঠার পর প্রথম গোয়েন্দা কাহিনী ছেড়ে মৌলিক সাহিত্যের হাতেখড়ি শুরু হল। হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবাল, শরৎ চন্দ্র, রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর, ডাঃ লুৎফর রহমান, শীর্ষেন্দু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মুনির চৌধুরী, প্রমথ চৌধুরী, সমরেশ মজুমদার ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যের সব বড় বড় সব লেখকের বই পড়তাম। বিদেশী ভাষার লেখকদের মধ্যে জুলভার্ন, ডেল কার্নেগী, এডগার অ্যালান পো, এইচ জি ওয়েলস, স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, চার্লস ডিকেন্স, মার্ক টোয়েন, মেরী শেলী, হাওয়ার্ড পাইল, জোনাথন সুইফট, জে কে রাওলিং ইত্যাদি লেখকের ক্লাসিক সব বইও পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। \n\nআমি শুধু গল্প, নাটক, উপন্যাস পড়ে এর মধ্যকার গল্পের মজাটাই নিতাম না। সেই সাথে সেই সব কাহিনীর লেখকদের লেখার ধরণ, শব্দ চয়ন এবং কাহিনীর বিন্যাসও খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করতাম। এভাবেই একসময় নিজের জন্য লেখার নির্দিষ্ট একটি গঠনপ্রণালী নির্ধারণ করি। লেখার যে ধরণ দেখে মানুষ সহজেই অনুমান করতে পারবে এটা আমার লেখা। \n\nকোন লেখা এখন পর্যন্ত ছাপাইনি। আমি ঠিক করেছিলাম যতদিন পর্যন্ত আমি নিজের লেখা পড়ে সন্তুষ্ট না হব ততদিন পর্যন্ত লেখা ছাপাব না। সেই সময়টা মনে হয় খুব শীঘ্রই আসতে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা উপন্যাস লিখছি। নাম দিয়েছি \'রক্তরেখা\'। এই লেখাটা ছাপানর ব্যাপারে আমি আশাবাদি। আশা করছি আগামী বই মেলায় লেখাটি বই আকারে প্রকাশ করতে পারব।
কোন কাজ কখনও ছোট হয় না, ছোট হয় মানুষের মানসিকতা। আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা সমাজের নানা ধরণের পেশাকে নানা ভাগে ভাগ করে থাকেন। পেশার মধ্যে সম্মান-অসম্মানের দুটি পর্যায় দাঁড় করান। যেমন, মা-বাবারা অনেক সময় তাদের সন্তানদের শিখিয়ে দেন সমাজের নিচু তলার মানুষদের সাথে বা তাদের ছেলেমেয়েদের সাথে না মিশতে (যদিও আমার মাবাবা আমাকে এমন শিক্ষা দেননি এবং অনেক মাবাবাই দেন না)। এ থেকে যারা নিম্ন আয়ের মানুষ তারাও বুঝে যান তারা নিচু তলার মানুষ, অবজ্ঞার পাত্র এবং তাদের পেশা খুব একটা সম্মানজনক নয়।
এমন আরও উদাহরণ আছে। ভাড়া নিয়ে সমস্যা হলেই রিকশাওয়ালা বা বাসের হেল্পারের গায়ে হাত তোলা (তাদের বয়স যাই হোক), শ্রমিক পেশার মানুষকে 'তুই' বলে সম্বোধন করা, কথায় কথায় গালি দেওয়া ইত্যাদি। এসব করে সমাজের তথাকথিত উঁচু তালার মানুষ বা তাদের ছেলেমেয়েরা শ্রমিক পেশার মানুষকে তাদের অধিকার, বাক স্বাধীনতা, ক্ষমতা, সম্মান ইত্যাদি সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা দিয়ে দেন। ফলে শ্রমিক পেশার মানুষেরা সব সময় তাদের পেশা নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে। তারা ভাবতে শুরু করে যে তারা আসলেই নিচু স্তরের মানুষ। যদিও তা সত্যি না। মানুষের কোন স্তর হয় না। কাজ কখনও ছোট বা বড় হয় না।
আমার প্রশ্ন হল মানুষ কেন এমনটা ভাববে? একটা সভ্য সমাজে সব মানুষ কেন অধিকারের দিক থেকে সবাইকে সমান ভাবতে পারে না? সৎ কাজের সাথে অসম্মানের ঠিক কি সম্পর্ক? সেটা কি মানবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, নাকি না?
একবার তুরাগ সিটিং সার্ভিসে চড়ে রামপুরা থেকে বসুন্ধরা যাচ্ছি। বাসে দুইজন লোক ভাড়া নিয়ে হেল্পারের সাথে ঝগড়া লেগে গেল। ঝগড়ার এক পর্যায়ে দুইজনের মধ্যে একজন হেল্পারকে খুব বাজে একটা গালি দিল। ঐ লোক দুইজনের পেছনে আরও দুইজন লোক বসে ছিল। তারা ব্যাপারটার প্রতিবাদ করল এবং বলল, "ভাড়া নিয়ে আপনার সমস্যা থেকতেই পারে, সেটা আপনি সুন্দরভাবে বলতে পারতেন, কিন্তু আপনি একজন শ্রমিককে গালি দিতে পারেন না"। ঘটনাটা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। আসলেই তো, নিচু স্তরের পশু থাকতে পারে, কিন্তু নিচু স্তরের মানুষ থাকতে পারে না! একজন শ্রমিক যে চুরি চামারি করে না, খেটে খেয়ে বাঁচে, তাকে অসম্মান করা অনেক বড় স্পর্ধার ব্যাপার। কারণ সে সৎ পথে রোজগার করে, অবৈধভাবে না। এমন স্পর্ধা একটা সভ্য দেশে যাতে কারও না হয়। সৎ কাজ কখনোই নিম্ন শ্রেণীর কাজ না। নিম্ন শ্রেণীর কাজ বলতে যদি কিছু থেকে থাকে তবে সেটা অসৎ পথে অর্থ উপার্জন, যা অনেক উঁচু তলার মানুষ করে থাকেন।
এবার আসি কাজ নিয়ে লজ্জা পাওয়া বা গর্ব বোধ করার বিষয়ে। আমাদের সমাজে এমন অনেক লোক আছেন যারা নিজের পেশা নিয়ে লজ্জা পান। আবার এমন অনেকে আছেন যারা মাত্রাতিরিক্ত গর্ববোধ করেন। এর কোনটাই ঠিক না। সৎ পথে অর্থ উপার্জনে লজ্জার কিছু নেই, বরং গর্বের ব্যাপার আছে। লজ্জা পাওয়া উচিৎ তাদের, যারা অসৎ পথে উপার্জন করে।
মাসখানেক আগে যে কোন একটা ইলেকট্রনিক পন্য কেনার জন্য একটা নামকরা ইলেক্ট্রনিক পন্যের শোরুমে গেলাম। শোরুমে আমার এক কলেজ ফ্রেন্ড এর সাথে দেখা হয়ে গেল। ভাবলাম সেও কিছু কিনতে এসেছে। কথার একপর্যায়ে জানলাম সে ঐ শোরুমের একজন সেলসম্যান। খেয়াল করেছিলাম, আমি যখন শোরুমে ঢুকছিলাম তখন সে আমাকে দেখে একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছিল, যেই নার্ভাসনেস আমি শোরুম থেকে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত ছিল। ওর সাথে কথা বলতে গিয়েই আমি ব্যাপারটা ধরতে পারি। বুঝলাম সে লজ্জাবোধ করছে। আমি তাকে সেলসম্যান হিসেবে দেখে ফেলেছি এবং হয়তো সে ভাবছে আমি তাকে নিয়ে অন্যদের সাথে হাসি ঠাট্টা করব। আমার কাছে পুরো ব্যাপারটাই খুব খারাপ লাগল।
সেলসম্যানের চাকরি মানে তো সৎ পথে অর্থ উপার্জন, এখানে লজ্জা পাওয়ার কি আছে? বরং তার তো বুক ফুলিয়ে বলা উচিৎ যে সে অসৎ পথে অর্থ উপার্জন করে না। আর উন্নত দেশগুলোতে অনেক কোটিপতির ছেলেও পড়াশোনার পাশাপাশি সেলসম্যানের কাজ করে, তারা তো লজ্জা পায় না! বরং লজ্জা পাওয়া উচিৎ আমাদের মত মানুষের, যারা বয়স হওয়ার পরও বাপের হোটেলে বসে বসে খায়, কিছুই করতে পারে না। আমি লজ্জিত, সত্যিই লজ্জিত। আমি লজ্জিত সেই সব মানুষের জন্য যারা সৎ পেশাকে সম্মান করতে জানে না। যাদের কারণে পরিশ্রমী মানুষকে তাদের পেশা নিয়ে লজ্জা পেতে হয়।
লেখা- ইয়াসীন মারুফ
শখের লেখক ও গবেষক
ফেইসবুক আইডিঃ https://www.facebook.com/yeasinmaruf
©somewhere in net ltd.