![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সীমাহীন লোভ মানুষকে ধ্বংস করবেই। অসৎ উপার্জন শুধু মাদকেই প্ররোচিত করে না, গোটা সমাজ, এমনকি রাষ্ট্রকে চরম অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দেয়। আর এ কারণেই আমাদের সমাজে দিন দিনেই বেড়ে চলেছে সামাজিক নিষ্ঠুরতা। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের সুন্দর মানুষ করে গড়ে তোলার নানা রকম পরিকল্পনা করছি। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছি, তার আগে দরকার নিজের সঠিক পথ অনুসরণ করা। যদি এখনো না ভেবে থাকি, তাহলে এখনই ভাবতে হবে, না হলে এমন অন্ধকারে ডুবতে হবে, যেখান থেকে হয়তো আর কোনো দিনই আলোর মুখ দেখা যাবে না। আমি হলফ করে বলতে পারি, সব ধরনের সামাজিক অস্থিরতা, নিষ্ঠুরতা, রাষ্ট্রীয় সংকটের প্রধান ও প্রথম কারণ হচ্ছে অসৎ উপার্জন। চোখের সমানে কালো পর্দা টেনে না রেখে, চোখ মেলে সমাজের দিকে তাকালেই খুব ভালোভাবে দেখা যাবে, সৎ মানুষ দ্বারা কতটা বিপর্যয় ঘটেছে সমাজের। আর অসৎ মানুষ কতটা বিপর্যয়ের সঙ্গে জীবন যাপন করছে।
আমার মনে হয, আগামী ২০ বছরের মধ্যে আমরা একটি বিকারগ্রস্ত জাতিতে পরিণত হব। রাষ্ট্রই সেটা আমাদের উপহার দিচ্ছে। কেবল রাজনৈতিক সচেতনতাই কি একটি দেশেকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারে? বাস্তাবতা কী হচ্ছে, দিন দিন বিশাল এক সামাজিক বিপর্যয়ের দিকে হাঁটছি আমরা। সেদিকে কি কারও খেয়ায় আছে? কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা দলের কথা বলছি না। একজন দিনমজুরকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, দেশের চলমান রাজনীতির অবস্থা, তাহলে তিনি এত সুন্দরভাবে রাজনীতির আদ্যোপান্ত ব্যাখ্যা করবেন, শুনে মনে হবে, তিনি বুঝি রাজনীতির ওপর বিশাল ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
এর কারণ কী? কারণ হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মিডিয়াগুলোও রাষ্ট্রের সব সমস্যাকে মাটিচাপা দিয়ে শুধুই রাজনৈতির আলাপ-আলোচনা করতেই পছন্দ করছে। আর আমাদের দেশের বড় দল দুটি সব শ্রেণীর নাগরিককে এমনভাবে ভাগ করে রাখাতে পেরেছে, যেখানে দল বা দলীয় রাজনীতি ছাড়া অন্য কোনো আলোচনা কেউ করে না। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী আর দেশের সব শ্রেণীর জনগণই এর মধ্যে আবদ্ধ।
দেশের বিভিন্ন মিডিয়াগুলোয় চোখ রাখলে দেখা যায় শুধুই রাজনীতির তর্ক-বিতর্ক আর আলোচনা-সমালোচনা। মনে হয়, এ দেশে রাজনৈতিকি সমস্যা ছাড়া আর কোনো সমস্যাই নেই! সব যেন খুবই ঠিকমতো চলছে। এখন রাজনৈতিক সমস্যা দূর হলেই বাংলাদেশ বুঝি একটি স্বর্গীয় রাষ্ট্রে পরিণত হবে। হাত বাঁচাতে গিয়ে মাথা শেষ করার মানে কী? দেশের যুব সমাজই যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে রাজনীতি করবে কারা। কবর থেকে উঠে এসে আবার তো কেউ দেশে চলাতে বসবে না।
সরকার, বিরোধী দল, দৈনিক সংবাদপত্র আর টিভি চ্যানেলগুলো যতটা সময় রাজনৈতিক সংকট সমাধানে ব্যস্ত থাকে, সেই সময় যদি সমাজের বিভিন্ন সংকট সমাধানের কথা ভাবত, তাহলে এ দেশের সমাজিক কাঠামো, নিরাপত্তা আর নাগরিকের জীবন-মান সহস্র গুণ উন্নত হতো। এখন প্রশ্ন হলো, এ দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল দুটি কী চায়? তাদের চাওয়ার ওপরই এ দেশের কোটি কোটি মানুষ ভাগ্য জড়িয়ে থাকে। অনেকটা অপদেবতার মতোই! বাংলাদেশেটা যেন একটি অন্ধকার গুহা, আর দুই নেত্রী পালাবদল করে সেই গুহার মুখে বসে থাকেন। যিনি যখন ক্ষমতায় থাকেন, তাঁর হাতে থাকে কঙ্কালের শক্ত হাড়! কথা বললেই মহা বিপদ। তাদের ইচ্ছেমতোই সবাইকে চলতে হবে।
মাদকের এই যে বিশাল বাজার বাংলাদেশ, এর সঙ্গে কি সরকার জড়িত নয়? যদি না-ই হবে, তাহলে এত বেপরোয়া অবস্থায় মাদক দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে কী করে। একটা উদাহারণ দিই, সরকার চায়নি এ দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটুক। সরকার তা সফলতার সঙ্গেই মোকাবিলা করতে পেরেছে। এটা সরকারের দারুণ সফলতা! তাহলে মাদক কেন নিয়ন্ত্রণে নেই? কারণ, এই ব্যাপারে সরকারের প্রত্যেকটি সদস্য এক হয়ে কাজ করতে পারেনি। কেউ কেউ অবশ্যই মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জড়িত।
বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে মাদক। কারণ, নেশা মানুষকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করবে। আর বিকারগ্রস্ত জাতির কাছ থেকে কখনোই ভালো কিছু আশা করা যায় না। মাদকের ভায়াবহ জ্বরে যখন পুড়ছে গোটা জাতি, তখনো কিন্তু মাদকবিরোধী আন্দোলন চলছে না আমাদের সমাজে। এখনই সামাজিক আন্দোলন দরকার। এই আন্দোলনে যোগ দিতে হবে মা-বাবাকে। আমরা আমাদের রাজনীতি নিয়ে এতই ব্যস্ত যে (মূলত রাজনীতি নিয়ে নয়। নির্বাচন নিয়ে। কারণ, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে হবে। ক্ষমতায় যেতে পারলেই তো টাকার বিছানায় ঘুম! খুবই শান্তি। আর তা না হলে কারাগার। মশার কামড়!) ভবিষতে যাঁরা রাজনীতি করবেন, দেশে চালাবেন, তাঁদের প্রতি কি কোনো রকম দায়িত্ব নেই আমাদের?
নবীনেরা ধীরে ধীরে রাষ্ট্র পরিচালান দায়িত্ব পাবে। কীভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে তারা। ভারত থেকে আসা ফেনসিডিল, গাঁজা আর মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা বড়ি খেয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে! কথাটা হাস্যকর মনে হলোও দেশের জনগণকে বলছি, এটাই ঠিক। নিজের এলাকায় একটু খোঁজখবর করে দেখুন, যেসব ছেলে আজকাল মিটিং-মিছিল করছে, তাদের কতজন মাদকমুক্ত। মাদক বলতে আমি কিন্তু সিগারেটকে বোঝাচ্ছি না। নিয়মিত নেশা করে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকার সংখ্যা কত। এরাই একসময় বড় রাজনীতিবিদ হবে। তার পর দেশ চালাবে।
আমাদের দেশে একটা কথা চালু আছে, লোকটা তো ভালো, ভদ্র, সে কেন রাজনীতিতে গেল। নির্বাচনে যাবে! এ কথার মানে কী? রাজনীতিতে কোন ভালো মানুষ যায় না? বর্তমান বাংলাদেশে অবস্থা অনেকটা সে রকমই। আবার ভালো কোন মানুষ টিকেও থাকতে পারে না। ১০টি খারাপ মানুষের সঙ্গে একা একজন সৎ মানুষের টিকে থাকাটাও কষ্ট। বিভিন্নভাবেই লাঞ্ছিত হতে হয়। তার ওপর প্রাণনাশের হুমকি-ধমকি তো আছেই।
বাঙলাদেশের ধনী-গরিব প্রায় প্রতিটি পরিবারই এখন দারুণভাবে আতঙ্কিত। ঐশীর একটি ঘটনায় বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষ ভয়ে কুঁচকে গেছে। কিন্তু ঐশীর এই ঘটনার জন্য কি পুরোপুর ঐশীই দায়ী। তাঁর অসৎ বাবার কতটুকু দায় ছিল, তা-ও ভেবে দেখতে হবে। আমাদের খুঁজে নিতে হবে, সামাজিক এসব নিষ্ঠুরতা থেকেই আমাদের ভুল কোথায়। গায়ে স্পেনের দামি কম্বল টেনে এসির বাতাসে ঘুমিয়ে থেকে আর বেশি দিন চলা যাবে না। তাহলে সন্তানের হাতে এভাবেই খুন হতে হবে!
সুসন্তান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রথমে যে প্রতিষ্ঠানকে উগ্যোগী হতে হবে, তা হচ্ছে পরিবার। দ্বিতীয়ত, সমাজ তারপর রাষ্ট্র। মূলত পরিবারকেই প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে। আমরা আমাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠা আর প্রতিপত্তি নিয়ে খুবই বস্ত হয়ে পড়ছি। যদি রাস্তায় দেখি, আপন ভাইয়ের সন্তানটিও অন্যায় করছে, তাকে শাসন করতে কুণ্ঠিত হই। কারণ, সময় নষ্ট করে ওসব ঝক্কি-ঝামেলার মধ্যে জড়তে চাই না অনেকেই। ভাবি, আমার ছেলে তো আর নষ্ট হচ্ছে না। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে চাই না, পৃথিবীর অনেক কিছুই সংক্রামক। আর সবারই একটা বয়স থাকে, ভালোমন্দ যা কিছু আছে, তার সবই ভালো লাগে। কৌতূহল হয়।
নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে কেউ কোনো দিন সুন্দর কিছু গড়তে পারে না। সমাজিক অবয়ব থেকে ফিরে আসতে হলে সমাজকেই দায়িত্ব নিতে হবে। আজ যদি অন্যর ছেলের নষ্ট হওয়াটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি, তাহলে কাল যে নিজের ছেলেটি সেই একই পথ ধরবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই সমাজের বিশল একটি দায়িত্ব রয়েছে সমাজকে মাদকমুক্ত রাখার।
যেসব মা-বাবা ছেলেমেয়েদের ভবিষতের কথা ভেবে অবৈধভাবে টাকা উপার্জনে ডুবে আছেন, তাঁদের সেই টাকা মূলত কোন কাজে লাগছে? চোখের সামনের কালো কাপড়টা সরিয়ে সামজের দিকে একটু লক্ষ করলেই তা আর বুঝতে বাকি থাকে না। সন্তানের ভবিষতের জন্য অবৈধ টাকা কতটা প্রয়োজন? মা-বাবার কাছ থেকেই প্রথম শিক্ষা লাভ করে প্রত্যেক সন্তান। এখন তাঁরাই যদি অসৎ পথে চলেন, তাহলে সন্তান কি শিখবে। আমরা বারবারই ভুলে যাই, মা-বাবার সৎ জীবনযাপন সন্তানকে সুন্দর করে। আমি বলছি না এর ব্যতিক্রম নেই, তবে তা উদাহারণ হতে পারে না। আমি যদি ছোটবেলা থেকেই আমার বাবাকে অসৎ হয়ে চলে চলতে দেখি, তাহলে আমি কতটা সৎ-সুন্দর পথে পরিচালিত হতে পারব। পরিচালকই তো বিপথের অন্ধকার একজন মানুষ। আমি আলোকিত মানুষ হব কী করে।
আমরা অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের দোষ এড়িয়ে যেতে চাই। সন্তান নষ্ট হচ্ছে, দোষ দিচ্ছি সমাজ আর রাষ্ট্রের। সমাজ আর রাষ্ট্রর যে ভূমিকা নেই, আমি তা বলছি না। রাষ্ট্রকে অবশ্যেই ভূমিকা নিতে হবে। তার সঙ্গে সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু প্রধান দায়িত্ব পরিবারের।
আবারও বলছি, সমাজিক এসব বিপর্যয়ের মূল কারণ হচ্ছে, অসৎ উপার্জন। আর যা-ই হোক, বাবার সৎ উপার্জনের টাকায় অন্তত সন্তানের নেশার খরচ জোগাড় হয় না। আর যদি হয়ও, তার সংখ্যাই বা কত। যা কিছু সত্যি, তা নেমে নিয়ে সুখী হতে পারে শুধু সভ্য-সৎ মানুষেরাই। আর অসৎ মানুষ চিরকালই অসুখী; সুন্দর আর সরল পথ বিবর্জিত।
কাজী সাইফুল ইসলাম
সাহিত্যিক ও কলাম লেখক
সৌদি আরব
<[email protected]>
সংগৃহীত প্রথম আলো হতে ।
Click This Link
©somewhere in net ltd.