নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাজিদ উল হক আবির

সাধু সাবধান ! ব্লগের মালিক বঙ্গালা সাহিত্যকে ধরিয়া বিশাল মাপের ঝাঁকি দিতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করিতেছেন। সেই মর্মে তিনি এখন কিটো ডায়েটিং, ডন-বৈঠক ও ভারোত্তলন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ১। শেষ বসন্তের গল্প । (২০১৪)২। মিসিং পারসন - প্যাত্রিক মোদিয়ানো, ২০১৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (অনুবাদ, ২০১৫) ৩। আয়াজ আলীর ডানা (গল্পগ্রন্থ - ২০১৬ ৪। কোমা ও অন্যান্য গল্প(গল্প গ্রন্থ, ২০১৮) ৫। হেমন্তের মর্সিয়া (কবিতা, ২০১৮) ৬। কাঁচের দেয়াল (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯)

সাজিদ উল হক আবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

বরেন্দ্রভূম থেকে জাহাঙ্গীরনগরঃ বাংলার চিত্রকলার ইতিহাস (প্রথম পর্ব)

১৪ ই মে, ২০১৭ রাত ১২:২৫




১।
শিল্পের প্রকাশ ঘটে বিভিন্ন মাধ্যমে। কিন্তু শিল্পী মানস বলতে যা বোঝায়, তা শিল্পচর্চার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের ক্ষেত্রেই এক। কি তুলির আঁচড়ে, কি কলমের কালিতে, কি গানের সুরে, কি ক্যামেরার লেন্সে - একজন শিল্পী মনপ্রান ঢেলে সাজান তার যাপিত জীবন। মানবিক বিষয়বস্তুকে, তথা আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের পাওয়া না পাওয়ার সুখদুঃখকে কেন্দ্রে রেখে তারা আগের থেকে খানিকটা নতুন ভঙ্গীমায় আমাদের সামনে উপস্থাপনের চেষ্টা করেন তারা।

একজন চিত্রকর, লেখক, গায়ক বা সুরকার এবং চলচিত্র নির্মাতার মধ্যে অনেক তফাৎ থাকা সত্যেও তাদের এক সূত্রে গ্রন্থিত করবার এই প্রয়াস নেবার পেছনে কারন এই যে - অ্যাকাডেমিক জগত, লেখালিখি ও সঙ্গীত - এই নিয়েই আমার এতদিনের কারবার ছিল। মাঝে মাঝে টুকটাক শর্টফিল্ম নির্মাণের চেষ্টা চালাতাম। তবে সপ্তাহখানেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের 'বাংলাদেশের শিল্পকলা' শিরোনামে গুরুতর একটি কোর্স পড়ানো শুরু করি। ফলে, ছবি আঁকা অথবা গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ করার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও আমাকে ভাবি শিল্পীদের শিল্পকলার ইতিহাস শিক্ষণের গুরুর গুরুদায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। প্রিয় পাঠক, আপনাকে এই তথ্যটুকুই দেবার জন্যে এতক্ষনের এত ভণিতা যে - বাংলার শিল্পকলার যে সূচনা ও সমৃদ্ধি, তার ব্যাপারে আমার খানিকটা জ্ঞান লাভ হয়েছে, চারুকলায় পড়া - পড়ানোর মাধ্যমে, আমার ইচ্ছে - আমার এই কিয়দাংশ জ্ঞান আমি আপনাদের সাথে ভাগ করে নিই।

চিত্রকলাকে প্রথমে শিল্পের অন্যান্য মাধ্যম থেকে একটু পৃথক করার চেষ্টা করা যাক। চিত্রশিল্প তথা পেইন্টিং ও অন্যান্য সকল আর্টফর্মের মতই কাজ করে মানুষের জীবনকে কেন্দ্রে রেখে। হতে পারে সেটি মূর্ত বা অনুকৃতি চিত্র, হতে পারে সেটি বিমূর্ত চিত্র, ছোট কিংবা বিশাল ক্যানভাসে তুলির আঁচড়ে যা ই আঁকা হোক না কেন - তা আমরা প্রথম দেখায় বুঝতে পারি অথবা না ই পারি, তা শিল্পী জীবনকে যেভাবে দেখেন, যেভাবে যাপন করেন, তার বহিঃপ্রকাশ। অভিজ্ঞতা, একজন চিত্রকরের অথবা যেকোনো মাধ্যমের শিল্পীরই একদম নিজস্ব এবং ঘনিষ্ঠতম সম্পদ। যে কারণে জয়নুল এঁকেছেন দুর্ভিক্ষের ছবি - কামরুল বা সুলতান আঁকেন নি , যে কারণে কামরুল এঁকেছেন দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে - জয়নুল বা সুলতান আঁকেন নি, যে কারণে সুলতান এঁকেছেন প্রথম বৃক্ষ রোপণের মত একটি ছবি - জয়নুল বা কামরুলের সাথে তার গ্রামবাংলার মানুষের জীবনের পাঠকে ভিন্ন করে দেয়। একইভাবে কাজ করেন একজন লেখক, একজন সুরকার, একজন ফিল্ম মেকারও। তাদেরও কাজের মূলে থাকে মানুষের জীবন, এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জন করে নেয়া তাদের জীবনদর্শন।

চিত্রকলার বিশেষত্ব তার সার্বজনীন ভাষারীতিতে। চিত্রকলার বাঙময়তা সাহিত্য- সঙ্গীত অথবা চলচিত্রের মত নয়। চিত্রকলা পাঠের ক্ষেত্রে দর্শকের ইন্টারপ্রিটেশনের গুরুত্ব অন্যান্য যেকোনো শিল্পমাধ্যমের থেকে বেশী। কিন্তু চিত্রকলার ভাষা পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের শিল্পরসিকই বুঝতে পারেন। বাংলা ভাষায় রচিত একটি কবিতা ইংরেজ পাঠকের কাছে সমাদর পাওয়ার জন্যে যেমন ট্রান্সলেশন তথা অনুবাদের একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, চিত্রকলা সে দায়ভার থেকে মুক্ত। বাংলার চিত্রশিল্পীরা তাই মাইকেল মধুসূদন সিনড্রোমে না ভুগেই বার্সেলোনা অথবা প্যারিসে নিজের ছবির প্রদর্শনী করাতে পারেন। পেতে পারেন বিশ্বময় খ্যাতি। এই ব্যক্তিক অর্জনটুকু যদি দূরে সরিয়ে রাখি, তারপরেও বলা যায় যে - আর্টের মাধ্যমে দেশ ও জাতির সীমানাপ্রাচীর ভেঙ্গে দেয়ার কাজটা যদি সত্যিই কোন শিল্প মাধ্যম করে থাকে, তবে তা হচ্ছে চিত্রকলা।

চিত্রকলা দেবীর এই তোষামোদটুকু করার পর এবার শুরু করা যাক ইতিহাসের কচকচানো। ইতিহাস বড় কাঠখোট্টা জিনিস - যদি না তা গল্পের মত করে বলা হয়। বাংলার শিল্পকলা - কোর্সটি পড়াতে গিয়ে আমি সর্বপ্রথম যে সমস্যার সম্মুখীন হই তা হচ্ছে - এই বিষয়ক কোর্স ম্যাটেরিয়ালের অভাব। প্রবন্ধ- বই পুস্তক যা কিছু পাওয়া যায়, তাতে প্রয়োজনীয় তথ্যের থেকে অনেক বেশী পরিমানে থাকের ভাষা ও টার্মিনোলজির বাগাড়ম্বর। কোন শিল্পীর জীবন নিয়ে দু' চারটে গল্পও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বাংলা ভাষার ইতিহাস নিয়ে অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ যেমন লাল - নীল দীপাবলির মত একটি বই লিখেছেন, ঠিক এই ধরনের একটি বই বাংলার চিত্রকলা নিয়েও লেখার খুব প্রয়োজন। হয় নি - তার কারন হয়তো এই যে, চিত্রকলার সমাদর খুব মুষ্টিমেয় একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যেই।

সে যাক, এখন, বাংলার চিত্রকলাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে মোটাদাগে দুটো ভাগে বিভক্ত করি - এক, ১৯৪৮ সালে ঢাকা আর্ট ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার আগের ও পরের যুগ। '৪৮ এর পরে যে বিবর্তন সেটার হিসেব খুব সহজেই করা যায়। কিন্তু '৪৮এর আগের বঙ্গীয় চিত্রকলার বিবর্তনের ঠিকুজী কুলুজী উদ্ধার করতে হলে আমাদের চলে যেতে হবে সুদূর অষ্টম শতকে, পাল রাজাদের শাসনামলে। সেই সময় থেকে নিয়ে ১৯৪৮ সালে ঢাকা আর্ট ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত একটু দ্রুতগতিতে পদসঞ্চালন করে আসা যাক।

যেমনটি বললাম, বঙ্গীয় চিত্রকলার সূচনা পালরাজাদের শাসনামলে, খৃষ্টীয় অষ্টম শতকে। তাদের অনুপ্রেরণা ছিল মূলত বৌদ্ধধর্মীয় বিষয়াদি, এবং গৌতম বুদ্ধ স্বয়ং। তারপর পাল চিত্ররীতিতে এসে ধাক্কা দেয় মধ্যযুগীয় চিত্ররীতি, যার মূল ছিল পশ্চিম ভারতের জৈন পাণ্ডুলিপি বা পুথিচিত্রে। তারপর, সুলতানি শাসনামলে গৌড়ের দরবারে পারসিক চিত্ররীতি এবং চিত্রকরদের দেখা মেলে। হুসেন শাহি আমলে নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব ঘটে এবং তারই সাথে ঘটে বৈষ্ণব চিত্রকলার উন্মেষ। এরপর উল্লেখ করতে হয় মুঘল শিল্পকলার বাঙ্গালী রূপটি যেখানে বিকশিত হয়েছিল তার নাম। বাংলার শিল্পকলার ইতিহাসে সে সুপরিচিত - মুর্শিদাবাদ শৈলী নামে। এরপর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমন ঘটলে ভারতে ইউরোপীয় রীতির চিত্রকলার সুত্রপাত ঘটে। এই ইউরোপীয় চিত্ররীতির ডামাডোলের মধ্যেও বঙ্গের নিজস্ব এক শিল্প অভিব্যক্তি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে কালীঘাটের পটশৈলী। অবনঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ, যামিনী রায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে নব্যবঙ্গীয় চিত্ররীতির বিস্তার ঘটে। শান্তিনিকেতনের কলাভবনে চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসুও এতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। কোলকাতা আর্টস্কুলের প্রথম দিকের ছাত্র আমাদের ময়মনসিং এর ব্রহ্মপুত্র নদকে আজীবন বুকে নিয়ে ফেরা অমর চিত্রশিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন কর্তৃক ঢাকা আর্ট ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চিত্রকলা চর্চার দ্বার উন্মুক্ত হয়।

২।

বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলার প্রথম বিকাশ ঘটে পালরাজাদের আমলে। পালরাজাদের জন্মভূমি ছিল বরেন্দ্র অঞ্চলে, অর্থাৎ উত্তরবঙ্গে। কিন্তু তাদের রাজ্য গড়ে উঠেছিল বাংলা - বিহার এবং উত্তরপ্রদেশ মিলিয়ে। তাদের শাসনকাল অষ্টম শতকের মাঝামাঝি থেকে দ্বাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত।

পালরাজাদের শাসনামলে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরজাগরন ঘটছিল এবং ভারতবর্ষ থেকে ক্রমশ বৌদ্ধধর্ম অপসৃত হচ্ছিল। তবুও তারা বৌদ্ধধর্মের অনুবর্তী হয়ে ভক্তদের পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন। পাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ধর্মপাল (আঃ ৭৭৫-৮৮০) দক্ষিণ বিহার এবং উত্তরবঙ্গের সোমপুর বিহারের প্রতিষ্ঠাতা। দেবপাল ( আঃ ৮১০-৮৪৭) এবং প্রথম মহীপাল (আঃ ৯৭৭- ১০২৭) নালন্দা মহাবিহারের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তবে শাসক হিসেবে পালরাজারা ছিলেন পরধর্মসহিষ্ণু। ফলে তাদের আমলে বহু শিব, বিষ্ণু, সূর্য ও অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে।

বাংলার প্রাচীনতম চিত্রকলা পাল সাম্রাজ্যেই তৈরি। সমস্ত ঐতিহাসিকেরা এ বিষয়ে একমত যে পালরাজা প্রথম মহীপালদেবের শাসনের ষষ্ঠ বছরে নালন্দা মহাবিহারে লেখা একটি পুঁথি - "অষ্টসাহস্রিকা - প্রজ্ঞাপারমিতা" য় অঙ্কিত বারোখানা রঙিন ছবি হচ্ছে বাংলার ইতিহাসে আবিষ্কৃত প্রথম ছবি। পুঁথিটি তালপাতার এবং ছবিগুলি তার ওপরেই অঙ্কিত। সময় আনুমানিক ৯৮৩ খৃষ্টাব্দ।

এছাড়াও প্রচলিত আছে কিছু ঐতিহাসিক কাহিনী। যেমন, প্রাচীনতম একটি বৌদ্ধগ্রন্থ হল - দিব্যবদান, যার একটি কাহিনী - বীতাশোকাবদান। উক্ত কাহিনীতে জানা যায়, সম্রাট অশোকের আমলে পুণ্ড্রবর্ধন নগরের নির্গ্রন্থী উপাসকেরা বুদ্ধদেব নির্গ্রন্থীর পদতলে পড়ে আছেন এমন একটি চিত্র অঙ্কন করেছিলেন। এতে সম্রাট অশোক ক্রুদ্ধ হয়ে নির্গ্রন্থীদের সমূলে বিনাশ করেছিলেন। যদিও এই চিত্র কখনো পাওয়া যায় নি, তবুও অনুমান করা যায় যে - খ্রিষ্টপূর্বকালেও সমৃদ্ধ নগর পুণ্ড্রবর্ধনে চিত্রকলার চর্চা ছিল।

এছাড়া, আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিকরা অজয় নদ আর কুনুর নদীর অববাহিকায়, বর্ধমান জেলার ভেদিয়া ষ্টেশন থেকে মাত্র ছয় মাইল দূরে পাণ্ডুরাজার ঢিবি খুঁড়ে পেয়েছেন বাংলার প্রাচীনতম সভ্যতার নিদর্শন। এখানে হরপ্পা সভ্যতার সমগোত্রীয় তাম্রপ্রস্তর পর্যায়ের পুরাবস্তুগুলোর মধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে নানারকমের নকশা আঁকা মৃৎপাত্র। দুটো ছবি ওখান থেকে উদ্ধার করা গেছে, তন্মদ্ধ্যে একটি হল জালের সংলগ্ন একসার মাছ, আরেকটি হল একটি ময়ূরী সাপ ধরে আছে তার ঠোঁট দিয়ে। মৃৎপাত্রের ওপর অঙ্কিত ছবিদুটির বিশেষত্ব একদিকে যেমন তিনহাজার বছর আগেও বাংলায় চিত্রাঙ্কন প্রচলিত ছিল তা প্রতিভাত করে, এছাড়া বাঙ্গালীর আদি জনগোষ্ঠীর অন্যতম উপজীবিকা ছিল মাছ ধরা এবং মাছ তখনকার দিনেও আজকের মতই ছিল বাঙ্গালীর প্রিয় খাদ্য সেটাও প্রমাণিত করে।

তিব্বতীয় লামা তারনাথের সাক্ষ্য থেকে জানা যায় বাংলার প্রাচীনতম দুই চিত্রশিল্পীর নাম। তিনি ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে লেখেন ভারতীয় বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস নামক একটি গ্রন্থ। এতে তিনি পাল সম্রাট ধর্মপাল এবং দেবপালের সময়কার মূর্তিকলার বর্ণনা লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেন বরেন্দ্র তথা উত্তরবঙ্গের দুই কৃতিশিল্পী ধীমান ও তার পুত্র বিটপালের কথা। তারা উভয়েই ভাস্কর্য, ধাতুমুর্তি গড়নে এবং চিত্রকলায় পারঙ্গম ছিলেন। যদিও পিতা আর পুত্রের চিত্রকলার রীতি ছিল ভিন্ন। ধীমান যেখানে চিত্রকলায় পূর্বদেশীয় রীতির অনুবর্তী ছিলেন, সেখানে বিটপাল ছিলেন মধ্যদেশীয়, তথা মগধ বা দক্ষিণ বিহারে প্রচলিত রীতির অনুবর্তী। তারনাথ এটাও উল্লেখ করেন যে - মধ্যযুগের নেপালি ভাস্কর্য বা চিত্রকলা গড়ে উঠেছে পূর্বদেশীয় রীতির অনুকরণে।

৩।
পাল আমলের চিত্রকলার সবই পুঁথিচিত্র। এবার তাই পাল আমলের সেই পুঁথিগুলোর আঙ্গিক কাঠামো নিয়ে খানিকটা চিন্তা করা যাক।
পুঁথিগুলি লেখা হত তালপাতার ওপর। তালপাতা যেহেতু ভঙ্গুর, তাই তাদের সংরক্ষনের জন্যে নেয়া হত বিশেষ ব্যবস্থা। পূর্বভারতে দুই শ্রেণীর তালপাতা পাওয়া যেত - খড়তাড় ও শ্রীতাড়। তন্মধ্যে শ্রীতাড়ই পুঁথি লিখনের উপযুক্ত ছিল। শ্রীতাড়ের পাতাগুলি দৈর্ঘে ছিল প্রায় ৯০ সেন্টিমিটার আর প্রস্থে ৭.৫ সেমি। পাতলা ও নমনীয় হওয়ায় অপেক্ষাকৃত কম ভঙ্গুর এই পাতা সংগ্রহ করার পর গোছা বেঁধে মাসখানেক জলে ডুবিয়ে রাখা হত। এরপর জল ঝরিয়ে শুকনো করে প্রতিটি পাতা শাখ দিয়ে ঘষে মসৃণ করে পুঁথি লেখার উপযুক্ত করে তোলা হত। তার ওপর লেখা হত পুঁথি। পুঁথির লেখকেরা লেখার ফাঁকে যেখানে চিত্রের প্রয়োজন হতে পারে সেই জায়গাটা খালি রাখতেন। চিত্রকরেরা সেই জায়গা ভরে তুলতেন সম্পুরক চিত্রে।

৪।
যেকোনো সৃষ্টিশীল কাজের সাথেই চলে আসে অনুপ্রেরণার ব্যাপারটি। পালযুগের চিত্রকরদের অনুপ্রেরণা ছিল বৌদ্ধধর্মের প্রতি তাদের নিরঙ্কুশ অনুরক্তি এবং পুন্যকামনা। প্রাচীন গ্রন্থ অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতায় যে তত্ত্বাদর্শ প্রচারিত হয়েছিল, তার থেকেই উদ্ভূত হয়েছে চিত্র রচনার প্রেরণা।

এখানে একটি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য বিষয় হল - পুথির গ্রন্থ এবং চিত্রের মধ্যে সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অর্থাৎ চিত্রগুলি ঠিক গ্রন্থের চিত্র রূপায়ন নয় বরং স্ব মহিমায় স্বতন্ত্রসত্ত্বায় বিরাজমান। পুঁথি নির্বিশেষে চিত্রের বিষয়াদি হল গৌতম বুদ্ধের জীবনের প্রধান আটটি ঘটনা - ১) লুম্বিনী বনে জন্ম, ২) বুদ্ধগয়ায় বোধিলাভ, ৩) সারনাথে ধর্মচক্র প্রবর্তন, ৪) কুশীনগরে মহাপরিনির্বাণ, ৫) শ্রাবন্তী নগরে অলৌকিক ক্রিয়া পরিদর্শন, ৬) সঙ্কাশ্যে স্বর্গাবতরন, ৭) রাজগৃহে নালগিরি বশীকরণ, ৮) বৈশালীর আম্রবনে বানরের মধুদান গ্রহণ।

এছাড়াও প্রাচীন বৌদ্ধধর্মের দুই স্রোত - মহাযান- বজ্রযানসম্মত দেবদেবীর প্রতিকৃতিও পুঁথিতে অঙ্কিত পাওয়া যায়, যার মধ্যে রয়েছে - প্রজ্ঞাপারমিতা, তারা, লোকনাথ, মৈত্রয়, মহাকাল, বজ্রপাণি, বসুধারা, কুরুকুল্লা, চুন্দা, বজ্রসত্ত্ব, মঞ্জুঘোষ প্রমুখ। এই মতাদর্শের সঙ্গে যখন সংযুক্ত হল তান্ত্রিক ধর্ম বিশ্বাস, তখন এই প্রজ্ঞাপারমিতা গ্রন্থেই প্রয়োজন হল নানান তান্ত্রিক দেবদেবীর প্রতিকৃতির সংযুক্তিকরণ।

৫।
অনুপ্রেরণার ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্তে আসা গেল, কিন্তু এই যে পূর্ববঙ্গীয় শৈলী - সেটা কি স্বউদ্ভূত, নাকি তা অন্যকোন চিত্রশৈলীর অনুকরণে তৈরি, বা প্রভাবে প্রভাবান্বিত?

সুবিখ্যাত ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় বলেন -

"স্বল্পায়তন পাণ্ডুলিপি চিত্রের যাহা বিশেষ বৈশিষ্ট্য, অর্থাৎ সুক্ষ্মরেখার ধীর অথচ তীক্ষ্ণগতি, সূক্ষ্ম ও ঘন কারুকার্য, বিন্যাসের ঘনত্ব ও গভীর ভাবনা কল্পনার অনুপস্থিতি প্রভৃতি এই পাণ্ডুলিপি চিত্রগুলিতে নাই। সেইজন্যেই ইংরেজিতে আমরা miniature বলিতে আমরা যাহা বুঝি, এই পাণ্ডুলিপি চিত্রগুলি সেই বস্তু নহে। আয়তন ক্ষুদ্র হওয়া সত্যেও এই পাণ্ডুলিপি চিত্রগুলির ভাবনা কল্পনার আকাশ বিস্তৃত ও গভীর, পরিকল্পনা বৃহৎ, রেখার ডৌল ও বিস্তার দীর্ঘায়িত, রঙের বিন্যাস ও মণ্ডন প্রশস্তায়িত। এই দীর্ঘ, প্রশস্ত ও বৃহৎ বিস্তার একান্তই বৃহদায়তন প্রাচীরচিত্রের।"

অর্থাৎ একথা সহজেই অনুমেয় যে নীহাররঞ্জন ইঙ্গিত করছেন পাল পুঁথিচিত্রের সাথে অজন্তা - ও বাঘের গুহাচিত্রের সাদৃশ্যের। ভারতীয় ভাস্কর্য ও চিত্রকলার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটে গুপ্তসম্রাটদের শাসনামলে (খ্রিঃ ৩২০-৫৭৬) ও তার নিকটবর্তী সময়ে। এই সময়কালটিকে ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসে মার্গ বা ক্লাসিক্যাল যুগ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই সময়ে চিত্রশিল্পের উৎকর্ষতার প্রমাণ মেলে বাঘ, অজন্তা ও বাদামির গুহাচিত্রে। ভারতীয় মার্গ বা ক্লাসিক্যাল রিতির চিত্রকলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তার প্রবহ্মান নিরবচ্ছিন্ন ছন্দময় রেখা ও বর্তনাগুণযুক্ত বর্ণের ব্যবহারে পরিপূর্ণ ডৌলসমৃদ্ধ রূপসৃষ্টি।

পাল পুথিচিত্রকে রীতি ও শৈলীর বিচারে দুটি সুনির্দিষ্ট শিল্পরীতির সঙ্গে সম্পর্কিত করা যায়। চিত্র ঐতিহ্যের দিক থেকে সে বাঘ- অজন্তা- বাদামির ভিত্তি বা প্রাচীর চিত্রের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্বন্ধযুক্ত, এবং রুপাদর্শের দিক থেকেও তারা ঐ প্রাচীর চিত্রেরই অনুবরতক। কিন্তু দেবদেবীর ধ্যান রুপায়নে পাল চিত্রকরেরা ছিলেন সমকালীন প্রস্তর ও ধাতু নির্মিত প্রতিমাশিল্পের উপর নির্ভরশীল। রীতির বিচারে এই হল পাল চিত্রকলার সাধারণ চরিত্রলক্ষণ। কিন্তু সেই সঙ্গে এই কোথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে স্বল্পসংখ্যক ছবিতে হলেও স্বতন্ত্র এক চিত্ররীতির সাক্ষাৎ পাল চিত্রকলায় পাওয়া যায়।

৬।
মধ্যযুগীয় চিত্ররীতির প্রভাবে পাল- শৈলীর অবক্ষয় ঘটে, চিত্রকলা ঐতিহাসিকগণ এ ব্যাপারে একমত।

ক্লাসিক আদর্শের রুপকলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল - রঙ ও রেখার পরিপূর্ণ মণ্ডনায়িত ডৌলে আকৃতি রচনা। প্রাক মধ্যযুগের ভারতে প্রধানত এই আদর্শেরই অনুবর্তন দেখা যায় মূলত ভাস্কর্যশিল্পে। কিন্তু চিত্রকলায় এসময় অপর এক রীতির বিকাশ ঘটে - যে রীতিকে শিল্প ঐতিহাসিকগন "মধ্যযুগীয় রীতি" বলে অবিহিত করেছেন। এই মধ্যযুগীয় চিত্ররীতির বৈশিষ্ট্য হল - ডৌলবিহীন তীক্ষ্ণ রেখা এবং মণ্ডনগুণহীন সমতল রঙের প্রলেপ। এই মধ্যযুগীয় রীতির উদ্ভব ইলোরার ভিত্তিচিত্রে এবং তার ব্যাপক বিস্তৃতি পাল চিত্রকলারই সমসাময়িক পশ্চিম ভারতের জৈন পাণ্ডুলিপি বা পুঁথিচিত্রে।

পাল পুথিচিত্রে এই মধ্যযুগীয় চিত্ররীতির পরিচয় মেলে মহীপালদেবের পঞ্চম রাজ্যাঙ্কে অঙ্কিত অষ্টসাহস্রিকা - প্রজ্ঞাপারমিতার অনুলিপির পনেরোটি চিত্রে। এই পনেরটি চিত্রে মধ্যযুগীয় রীতির পূর্ণ প্রকাশ না ঘটলেও বর্ণের সমতলতা, রেখার তীক্ষ্ণতা আর দেহরূপভঙ্গীর বঙ্কিম ভঙ্গিমা সেই রীতিরই প্রাথমিক পরিচয় বহন করে।

পালশাসনের অবসানে দ্বাদশ শতকের অন্তিমকাল থেকে মধ্যযুগীয় রীতি যে পূর্ব ভারতীয় চিত্রকলায় ছাপ ফেলতে পেরেছিল - তার প্রমাণ মেলে তিনটি সূত্র থেকেঃ ১) বাংলায় আবিষ্কৃত তিনটি তাম্রপট্টে উৎকীর্ণ রেখাচিত্রে, ২) বুদ্ধগয়ায় মহাবোধি মন্দিরের মেঝের প্রস্তরফলকে অঙ্কিত কিছু রেখাচিত্রে, এবং ৩) পাল পরবর্তীকালের তিনটি পুঁথিচিত্রে। উপরুক্ত ক্ষেত্রে অঙ্কিত চিত্রের বৈশিষ্ট্য হল - রেখার দ্রুত ও চঞ্চল গতিশীলতা। স্পষ্টতই এই রেখা মার্গরীতির মণ্ডনগুণযুক্ত রেখা থেকে ভিন্ন চরিত্রের। এই রেখা তীক্ষ্ণ এবং কিছুটা স্থলিত; যেন স্নায়বিক চাপের অভিব্যক্তি। ভগবান ও ভক্তের মুখমণ্ডলও পাল চিত্রকলার দেবদেবীর মুখমণ্ডল থেকে স্বতন্ত্র। নাক চোখ চিবুক এমনকি গদা শঙ্খ পদ্ম ও কিরীটের অগ্রভাগ সুতীক্ষ্ণ ও কৌণিকতা চিহ্নিত। এসবই পূর্ণ বিকশিত মধ্যযুগীয় চিত্ররীতির চরিত্রলক্ষণ।

পাল চিত্ররীতির শেষ নিদর্শন হিসেবে ধরা হয় ১২৮৯ খ্রিষ্টাব্দে লিখিত পঞ্চরক্ষা পুঁথি, ১৪৪৬ খ্রিস্টাব্দে লিখিত কালচক্রতন্ত্র পুঁথি এবং ১৪৫৫ খ্রিষ্টাব্দে লেখা একটি সচিত্রপাটা সহ চিত্রিত পুঁথি। কী কালের বিচারে, কী রীতির বিচারে এই পুঁথি ও পাটার ছবিগুলি পাল চিত্রকলার ধারার শেষ নিদর্শন। স্বভাবতই এই পুঁথিচিত্রগুলিতে পাল চিত্ররীতির অবক্ষয় সুস্পষ্ট।
(চলবে)

ঋণস্বীকারঃ

পাল শাসনামলের ও পাল চিত্রকলা সংক্রান্ত সব তথ্যই সংগৃহীত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদমি হতে প্রকাশিত অশোক ভট্টাচার্যের বাংলার চিত্রকলা ও সরসীকুমার সরস্বতী বিরচিত পালযুগের চিত্রকলা গ্রন্থ হতে।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই মে, ২০১৭ বিকাল ৩:৩১

জেন রসি বলেছেন: পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।

২০ শে মে, ২০১৭ রাত ১১:৫৬

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: প্রিয় জেন রসি, আপনাকে ধন্যবাদ।

২| ১৮ ই মে, ২০১৭ বিকাল ৩:১২

অপু তানভীর বলেছেন: চমৎকার লেখনী । চলুক ! :)

২০ শে মে, ২০১৭ রাত ১১:৫৭

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: ধন্যবাদ, জনাব অপু তানভীর!

৩| ২১ শে মে, ২০১৭ রাত ১:৪২

ডঃ এম এ আলী বলেছেন: মুল্যবান তথ্যসমৃদ্ধ অসাধারণ পোষ্ট , প্রিয়তে গেল ।
শুভেচ্ছা রইল

২৮ শে মে, ২০১৭ রাত ৩:৪২

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: প্রিয় ডঃ আলী, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, আপনার মূল্যবান পঠনে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.