নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি কেউ না।

আফলাতুন হায়দার চৌধুরী

আফলাতুন হায়দার চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভ্রমণ: আইফেল টাওয়ার বিজয় (২০২৩)

২৬ শে জুলাই, ২০২৩ দুপুর ২:০৮


ব্রাসেলস্ থেকে ব্রুঝ যাবার প্ল্যান ভেস্তে গেলে বিকেলটা মোটামুটি লোকাল এরিয়ায় হাল্কা ঘুরে ফিরে প্যারিসের উদ্যেশ্যে রওয়না হলাম আমরা চার জন। আমি, বৌ, দশ বছরের মেয়ে আর সাত বছরের ছেলে।

দুই দিন আগে লন্ডন থেকে গাড়ী নিয়ে সাগর তলের টানেল দিয়ে ট্রেনে করে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ফ্রান্সের কালাই, ইউরোপিয়ান হাইওয়ে A16 ধরে ডানকার্ক, সেখান থেকে বর্ডার পেরিয়ে বেলজিয়াম অংশের আরেক ইউরোপিয়ান হাইওয়ে E40 ধরে খানিকটা ঘুরপথে ব্রাসেলস পৌঁছি মাঝরাতের খানিক আগে। তখন ফ্রান্সের লোকাল রোড, হাইওয়ে, তারপর বেলজিয়ান হাইওয়ে এবং পরে ব্রাসেলসের জটিল এবং ব্যস্ত শহুরে রাস্তায় রাতের বেলা গাড়ী চালিয়ে ইউরোপিয়ান ড্রাইভিং করায়ত্ব হয়ে গেছে। সে কারনেই হয়তো ব্রাসেলসের ব্যাস্ত রাজপথে আবার নেমে প্যারিসের হাইয়ওয়ে ধরার আগ পর্যন্ত লোকাল পথ, দীর্ঘ হাইওয়ে, তারপর আবার রাতের প্যারিসে সীমাহীন ব্যস্ত লোকাল রাস্তায় গাড়ী চালাতে খুব একটা বেগ পেতে হয় নি। আমরা সময় মত পৌঁছে গেলাম বাল্যবন্ধু রাসেলের বাসার সামনে। সুন্দর মনোরম আবাসিক এলাকা, রাতের বেলায়ও ওর ফ্লাটের দুই পাশের সুন্দর বাগান দেখছিলাম, আর অনূভব করছিলাম গ্রীষ্মের রাতের নিদারুণ নাতিশীতোষ্ণ বাতাস। আহ্লাদে গদ গদ হয়ে ফোন দিলাম,
“আস্‌সালামুআলাইকুম বন্ধু, আমরা তোর বাসার ঠিক সামনে।”

কড়া ধমকে এমন কেঁপে উঠলাম যেন ভুমিকম্প। কি রে ভাই? এত দুর থেকে এই গভীর রাতে এলাম দোস্তোর কাছে। থাঁতি মারে কা?
“তোর লগে কি কথা আছিলো?” ঝাঁঝের সাথে রাসেলের প্রশ্ন? কি কথা থাকতে পারে? ভেবে কুল পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ মনে পড়লো রাসেল পই পই করে বলে দিয়েছিলো যেন পৌঁছার এক ঘন্টা কিংবা তারও আগে তাকে জানাই তাহলে সে ভাবীকে বাসায় পাঠাবে সে থাকবে এবং আমরা ঘরে ঢুকবো। মর জ্বালা, আমি ইউরোপিয়ান ড্রাইভিংয়ের উত্তেজনায় এতই উত্তেজিত ছিলাম যে এতসব প্ল্যান বেমালুম ভুলে গেছি। জিপিএস যখন চমৎকারভাবে ওর বাসার সামনে এলে বলে, “ইউ হ্যাভ রিচড্ দ্য ডেস্টিনেশন।” তখন মনে পড়লো, ফোন করতে ভুলে গেছি। বাসায় কেউ নেই, তালা। ঢুকবো কিভাবে?

“তুই অন-ই মেহী দ্যূ মুথোয়াই (Mairie de Montreuil) ইষ্টিশনের সামনে যাই খাড়া।” টেলিফোনে রাসেলের রাগী কন্ঠ আমার মাথায় হাতুড়ি পেটাচ্ছে। আমি ফ্রেঞ্চ উচ্চারণের আগা মাথা বুঝি না। লেখা এক রকম, আওয়াজ আরেক রকম। যেমন, সারা জীবন উচ্চারণ করেছি ‘নটর ডেম’ (Notre Dame) আর প্যারিসে এসে শুনি নত্-থোদাম্। প্যারিস বললে হবেনা, বলতে হবে পারি বা পাহী। এখানেও ইংরেজীতে লেখা মেরী ডি মনট্রূইল। মনট্রূইল লোকাল শহরের নাম, মেরী মানে পৌরসভা। সাবওয়ে (বা আন্ডারগ্রাউন্ড রেল) স্টেশন লোকাল পৌরসভা সংলগ্ন হওয়ায় এই নাম। কিন্তু না, উনারা আওয়াজ করেন অন্যভাবে, “মেহী দ্যূ মুথোয়াই”। কেমন লাগে? থাবড়াইতে ইচ্ছা করে না?

মেহী দ্যূ মুথোয়াই স্টেশন ওর বাসা থেকে পনের মিনিটের রাস্তা। আমার লাগলো তিরিশ মিনিটেরও বেশী। আজ ফ্রান্সেও জাতীয় দিবস উদযাপিত হয়েছে, তাই যায়গায় যায়গায় রাস্তা বন্ধ। জিপিএস তো এসব অস্থায়ী রোড ক্লোজার রেকর্ড করেনা, তাই আমি একবার এথা যাই, আবার ওথা যাই। জিপিএস রিক্যালকুলেট করে নতুন পথ দেখায়। এভাবে প্রায় পৌনে এক ঘন্টা পর স্টেশনের সামনে গিয়ে অপেক্ষা করি। এক সময় ভাবী আসেন, আমাদের সাথে করে বাসায় নিয়ে আসেন। বাসার সামনে নিরাপদে গাড়ী পার্ক করে ঘরে ঢুকে মন ভরে গেলো।

গ্রেটার প্যারিসের পুর্বদিকের বাগান ঘেরা, খানিক উঁচু নিচু Montreuil এর স্থানীয় নাম মুথোয়াই সু বোয়া, এটি সেন-সাঁ-দেনি (Seine-Saint-Dénis) ডিপার্টমেন্টের (প্রশাসনিক এলাকা) অন্তর্গত। রাসেলের বাসা এখানকার সুনসান নিরিবিলি মোহিওঁন (Morillon) আবাসিক এলাকায়। রাসেলের ফ্ল্যাটে ঢুকে আমার মেয়ের প্রথম মন্তব্য ছিলো “এটা আমারদের বাসার মত।” ছেলেও উৎফুল্ল, অর্থাৎ বাসা পছন্দ হয়েছে। খানিক বাদে রাসেল এলো, অনেকদিন দিন পর বাল্যবন্ধুর সাথে দেখা। কোলাকুলি, কুশল বিনিময়ের পর আরেক দফা ঝাড়ি, কেন এক ঘন্টা আগে ফোন করলাম না? এদিকে ভাবী ম্যাজিকের মত দুনিয়ার সব দেশী খাবার রেডি করে ফেলেছে। খেয়ে দেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম, সকালে চার তলার উপর থেকে চারপাশটা দেখে মন ভরে গেলো।

লিভিং রুমের সাথে এক চিলতে দক্ষিনমুখি বারান্দা। সেখান থেকে বাইরের উঠান, প্রচুর গাছপালা। তার ওপাশে আরেকটি সাদা বহুতল ভবন যার চারপাশে আছে বিশাল বাগান, আর আছে প্রচুর বৃক্ষ। গ্রীষ্মের এই মনোহর সকালে আশপাশের গাছগুলোর পাতার উপর বয়ে যাওয়া বাতাসের সড়সড় শব্দ বাংলার বসন্তকাল মনে করিয়ে দেয়। মিষ্টি হাওয়া আদরের প্রলেপ মেখে দেয় চোখে-মুখে, গায়ে।

এর মধ্যে ভাবী টেবিল ভরে নাস্তা দিয়েছে। উনি পারেনও। রাসেলের সাথে গল্প করছিলাম। ওর সাথে শেষ দেখা হয়েছিলো আমার বিয়েরও আগে। এর মাঝে কতগুলো বছর কেটে গেলো, অথচ মনে হয় এই সেদিন। বিদেশ বিভূঁইয়ে সময় বড় দ্রুত কেটে যায়। ভুলে যাবার আগে বন্ধুর হাতে তুলে দিলাম বই। আমার লেখা প্রথম উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী 'সাগরের গল্প'। তারপর বন্ধুর সাথে গল্প আর শেষ হয় না, কখন যে বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলো টের পেলাম না। বের হতে হবে, প্যারিস এসে ঘরে বসে থাকলে চলে? কিন্তু বাসার ভেতরে আমাদের সবার খুব ভালো লাগছিলো, আমাদের মেয়ে ছেলে দুটোই আমাদের মত হয়েছে। ঘর ভালোবাসে, সেটা যেখানেই হোক।


কিন্তু বের না হলে প্যারিসের ট্যূরিষ্ট স্পটগুলো বাদ পড়ে যাবে। আমাদের আজকের অভিযান, আইফেল টাওয়ার বিজয়।

রাসেলের ফ্লাটের বাইরে বাস স্টপ, নাম লো মোহিওঁন (Le Morillon)। সেখান থেকে ১২২ নং বাসে করে সবাই মিলে মাত্র ১২ মিনিটে চলে এলাম মেহী দ্যূ মুথোয়াই মেট্রো স্টেশনে। গত রাতে এখান থেকেই ভাবীকে নিয়ে বাসায় ফিরেছিলাম। এখান থেকে ৯ নং মেট্রো ট্রেনে করে ত্রোকাদেরো স্টেশনে নামলেই আমাদের স্বপ্নের আইফেল টাওয়ার। ত্রোকাদেরো এসেছিলাম আজ থেকে প্রায় বাইশ বছর আগে। যাই হোক আমরা ত্রোকাদেরো না গিয়ে নেমেছিলাম আরো দুই স্টপেজ আগে, উদ্দেশ্য কিছুক্ষণ সবাই মিলে হাঁটা। ট্রেনের ভেতর আমার আমার মেয়ে আর ছেলে মিলে স্টপেজ গুনছিলো।

প্রায় চল্লিশ মিনিট পর আমরা চারজন নামলাম আলমা-মেহ্‌স্যূ (Alma-Marceau) স্টপে, ইচ্ছে করেই দুই স্টপ আগে নেমে গেছি পায়ে হাঁটার জন্য। প্যারিস শহরে হেঁটে বেড়াবোনা এটা হতে পারে না। মেট্রো স্টেশন থেকে পুন্দু লেলমা (Pont de l’Alma বা আলমা ব্রীজ। উফ্, কি জঘন্য উচ্চারণ!)-এর উপর থেকে ব্যাকগ্রাউন্ডে সেন নদী, তার পেছনে আইফেল টাওয়ার নিয়ে ছবি তুলেছি। অসম্ভব সুন্দর আবহাওয়া। গাঢ় নীল আকাশে ঝকঝকে সুন্দর রোদ, নদীর পরিষ্কার জলতরঙ্গ, রাস্তার দুধারে প্রচুর গাছ আর সবুজের সমারোহ, পেছনে খানিক দুরে গাঢ় সবুজ ঘেরা আইফেল টাওয়ার নীল আকাশ চীরে উপরে উঠে গেছে অনেক খানি। আলমা ব্রীজ পেরিয়ে যে মহাসড়কের ফুটপাথ ধরে হেঁটেছি তার নাম জ্যাক শিরাক কী (Quay Jackues Chirac)। বেশ খানিকটা হেঁটে আইফেল টাওয়ারের নীচে এসে পৌঁছলাম।

আইফেল টাওয়ার যে বাগানটা আছে সেটা চারদিক থেকে কাঁচের দেয়াল ঘেরা। টাওয়ারের অবস্থান বিশাল মার্স ফিল্ডের (Champ de Mars) উত্তর-পশ্চিম অংশে সেন নদীর পাড়ে, দক্ষিন-পুর্ব অংশে রয়েছে এফিমিয়ার ডিসপ্লে। এয়ারপোর্ট স্টাইল সিকিউরিটি পার হয়ে আইফেল টাওযারের নীচে দাঁড়াতে অন্য রকম অনুভূতি হল। তেইশ বছর আগে প্রথম এসেছিলাম কোন এক ঠান্ডার দিনে। বয়স কম ছিলো, তরুন বয়সের রোমাঞ্চের অভিজ্ঞতা ছিলো অন্য রকম। তখন শুধু আইফেল টাওয়ার একা দাঁড়িয়ে থাকতো, এতো সিকিউরিটি, এতো কন্ট্রোল ছিলো না। আজ এসেছি স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে, আজকের অনুভূতি অন্য রকম।

দিনটি ছিলো সোমবার, দুপুর গড়িয়েছে সেই কখন। কিন্তু ঝকঝকে রোদ আর অসম্ভব সুন্দর দিনটিতে মনে হচ্ছিলো এই বুঝি সকাল ১১ টা। অনেক অনেক মানুষ, সবাই দর্শনার্থী। টিকেট কাটার জন্য বিশাল লম্বা লাইন, একটু পর পর ডিসপ্লেতে দেখা যাচ্ছে টিকেট কাউন্টারে পৌঁছানোর আনুমানিক সময় দেড় ঘন্টা। সুখের বিষয়, সোয়া এক ঘন্টার মধ্যে টিকেট কাটা হয়ে গেলো। আমাদের চার জনের টিকেটের দাম পড়লো ৭০.১০ ইউরো, বড়দের জনপ্রতি ২৮.৩০ ইউরো, বাচ্চাদের ৭.১০ ইউরো। যেহেতু আমরা থার্ড লেভেল বা সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠবো তাই দাম বেশী। সেখানে এখনও বিশেষভাবে সংরক্ষিত আছে গুস্তাভ আইফেলের বিশেষ এ্যাপার্টমেন্ট।

প্রায় ১১০০ফুট (৩৩০মিটার) উঁচু টাওয়ারের উচ্চতা ৮১ তলা বিল্ডংয়ের সমান। এটি প্যারিসের সর্বোচ্চ অবকাঠামো যা কিনা পৃথিবীর সবাই এক নামে চেনে। সেন নদীর ধারে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বিশেষ এই অবকাঠামো বর্তমানে ইউনেস্কো কর্তৃক 'সংরক্ষিত ঐতিহ্য’। যদিও চীফ ইঞ্জিনিয়ার মি. গুস্তাভ আইফেলের নামে টাওয়ারের নাম রাখা হয়েছে তবে স্থানীরা একে ডাকে 'লা দাম দে-ফেহ্‌' বা দি আয়রন লেডী (La dame de fer)। আইফেল টাওয়ার প্যারিসের সবচেয়ে জনপ্রিয় লোকেশন। যখন কেউ প্যারিস বা ফ্রান্স সম্পর্কে শোনে তখন প্রথম মনে আসে আইফেল টাওয়ার। প্যারিসে বেড়াতে গিয়ে আইফেল টাওয়ারে না ওঠার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারে না।

দর্শনার্থীদের জন্য কি ব্যবস্থা রয়েছে আইফেল টাওয়ারে?

উচ্চতাভেদে আইফেল টাওয়ারকে চারটি ধাবে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ধাপ বা ফ্লোর থেকে উচ্চতা বিশেষে প্যারিস নগরী দেখার ব্যবস্থা বা অবজারভেশন ডেক যা আইফেল টাওয়ারের মূল আকর্ষণ।

গ্রাউন্ড ফ্লোর (দি এসপ্লানেড):-
টাওয়ারের চারটি কলাম বা খুঁটি যার প্রতিটিতে আছে সিঁড়ি এবং এলিভেটর যার মাধ্যমে প্রথম তলায় যাওয়া যায় তবে ট্যূরিষ্টদের জন্য দক্ষিন কলাম (ফাউন্ডেশন) উম্মুক্ত যার মাধ্যমে সিঁড়ি বা লিফটের মাধ্যমে প্রথম তলার স্যূভেনির শপ এবং রেস্তোঁরাগুলোতে যাওয়া যায়। এখানে একটি পিলারের সামনে আছে গুস্তাভ আইফেলের ভাষ্কর্য। পিতলের ঝকঝকে এই ভাষ্কর্যটি শুধুমাত্র গুস্তাভের মুখমন্ডলের যেন পাসপোর্ট সাইজ ছবির মুর্তি। খুব কাছ থেকে বিশাল এই টাওয়ারের জাদুকরী স্থাপত্যশৈলী দেখা যায় এখান থেকে। এছাড়া পুর্ব আর পশ্চিমের পিলারগুলোতে আছে শত বছরের পুরোনো এলিভেটর সিস্টেম (দুই প্রকোষ্ঠের হলুদ লিফট)। টিকেট অফিসটা পশ্চিম পিলারের নীচে। এত কাছ থেকে এদের কর্মযজ্ঞ, অপারেশনস, পুরোনো অথচ নিখুঁত ইঞ্জিনিয়ারিং দেখে রোমাঞ্চে আবেগাপ্লুত হয় হাজার হাজার ট্যূরিষ্ট।

ফার্স্ট লেভেল (উচ্চতা ৫৭মি. বা ১৮৭ফুট):-
এখানে রয়েছে আইসক্রীম পার্লার, ফার্স্ট ফুড শপ, স্যূভেনির কর্ণার, এবং বিশাল রেস্তোঁরা কেউ যদি ফুল কোর্স লাঞ্চ বা ডিনার করতে চায়। এখান থেকেও চমৎকারভাবে হলুদ এলিভেটরের ওঠানামা দেখা যায়। এছাড়া এখানে আছে প্রজেক্টর, ডিজিটাল ডিসপ্লে ইত্যাদি যার মাধ্যমে আইফেল টাওয়ার সম্পর্কে সবকিছু জানা যাবে।

সেকেন্ড লেভেল (১৩৬মি. বা ৩৭৭ফুট):-
এখানেও সিঁড়ি বা এলিভেটেরের মাধ্যমে আসা যায়। ডুও লিফটে করে উঠতে উঠতে দেখছিলাম আইফেল টাওয়ারের অসাধারণ স্থাপত্যশৈলী, সুনিপুণভাবে বানানো প্রায় ১১০০০ টন ওজনের রট আয়রনের বিশাল পিলার যা কিনা দাঁড়িয়ে আছে গত ১৩৪ বছর ধরে।

সেকেন্ড লেভেলে আরো আছে বেশ কিছু টপ রেটেড রেস্তোঁরা আর একটি মনোরম ইকোলজি পার্ক। আছে স্যূভেনির আর ফার্স্টফুড শপ যেখানে সব সময় ভীড় লেগে থাকে। সঙ্গত কারনে এই লেভেল সবচেয়ে জনপ্রিয়। এখান থেকে মোটামুটি প্যারিসের সব আইকনিক স্পটগুলো ‘কাছে থেকে’ স্পষ্ট দেখা যায় যার কারন উচ্চতা। গ্র্যান্ড প্যালেস, ল্যূভর মিউজিয়াম, ধবধবে সাদা মন্টমার্ট্রে ব্যাসিলিকা (প্রাচীন রোমান চার্চ), প্যালেস ইনভালিদেস (এটা এখন পাঁচতারা হোটেল), অপরূপা সেইন নদী, তার উপরকার সেইন্ট ল্যূইস আইল্যান্ড এবং জগদ্বিখ্যাত নট্‌র ডেম ক্যাথেড্রাল। চারিদিকে ঘুরে ঘুরে শুধু দেখি আর দেখি। ভুলে যাই ছবি তোলার কথা, সে এক দম আটকানো অনুভূতি, ভালোলাগায় চোখে জল আসে।

আমার বৌ না থাকলে জানা হতনা আইফেল টাওয়ারের ম্যাকারন ঐতিহাসিক, অতি সুস্বাদু এবং বিশ্বসেরা। ট্যূরিষ্টদের শপিং করতে নেই, কিন্তু আমি তো ট্যূরিষ্ট না। আমি এক বৌ এর স্বামী, দুই সন্তানের বাবা।

থার্ড লেভেল (২৭৬মি. বা ৯১০ ফুট):-
সর্বোচ্চ স্তর যার নাম দ্য টপ সামিট।
সামিটের বাংলা যদি হয় সম্মেলন তাহলে এই নামকরণ যথার্থ। তিনশ’ মিটার উঁচু টাওয়ারের মেঝের অবস্থান ২৭৬ মিটারের উপর। এটা প্যারিসের সর্বোচ্চ ওয়াচ টাওয়ার যাকে বলা যায় গোটা টাওয়ারের মুকুট। টপ সামিট বা সম্মেলন নামকরণের কারন অনেক নিচ থেকে টাওয়ারের ফাউন্ডেশন, স্তম্ভ, সকল পিলার উপর দিকে উঠতে উঠতে শীর্ষে এসে মিলিত হয়েছে। ‘শীর্ষ সম্মেলন’ নামকরণ যথার্থ।

সেকেন্ড থেকে থার্ড লেভেলের দুরত্ব ১৪০মিটার বা ৪৬০ ফুট। লিফটে করে পাক্কা দেড় মিনিট লেগেছে। লিফট থেকে বেরিয়ে এক অন্য জগত। হঠাৎ নির্জনতা, কোলাহল মুক্ত নীরব পরিবেশ। আলো বাতাসে ভরা। অনেক উঁচু থেকে জগত দেখার সে কি অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আমার মন প্রান জুড়ে আছে মেয়ে আর ছেলে, ওদের এটা দেখাই ওটা দেখাই। আমি দেখি দুটি শিশুর চোখেমুখে অবাক বিষ্ময়, আমার ছেলেবেলা। একেবারে ছোখাট অথচ নিশ্ছিদ্র নিরাপদ এই অতি উচ্চতার অবজারভেশন টাওয়ার থেকে প্যারিস মহানগরীর আশপাশ ছাড়িয়ে গোটা জগত দেখা যাচ্ছে। সমগ্র প্যারিস নগরীর প্যানারমিক ভিউ। ঝকঝকে উজ্জ্বল রোদেলা গ্রীষ্মের দিন, চারপাশে সব দেখতে দেখতে হারিয়ে যাচ্ছে দিগন্তে কারন পৃথিবী গোল। নীচে কারুকাজ করা প্যারিস নগরী। রাস্তা, ঘরবাড়ী, গাছপালা, নদী সব মিলিয়ে উপর থেকে মনে হয়ে শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছাবি। সেন নদীর উপর এত্তো এত্তো ব্রীজ দেখে বহু বছর আগে কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছিলেন, “নদীর উপরে নয়, যেন সেতুগুলোর নীচ দিয়ে নদী বয়ে গেছে।”

পায়ের নীচে সেন নদী, ব্যাস্ত রাস্তায় পিঁপড়ার মত ইতিউতি গাড়ী চলাচল। গাঢ় সবুজ জলে ভরা সেন নদী। বোট, স্টীমার, ক্রুজ বোট চলছে, নদীর পাড়ে ছোট্ট খেলনার মত মেরী-গো-রাউন্ড যেখানে ঘুরন্ত প্লাস্টিকের ঘোড়ার উপর শিশুরা বসে উঁচুনিচু পাক খায়। নদীর ওপাশে ত্রোকাদেরো গার্ডেন, সেখানে বিশাল ফোয়ারা, অনেক উপর থেকে মনে হচ্ছে ওয়াটার ডিসপ্লে। অবজারভেশন টাওয়ারের উপর থেকে ঘুরতে ঘুরতে চারিদিকে সব দেখি। উত্তর-দক্ষিন-পুর্ব-পশ্চিম প্যারিসের সবকিছু।

এখানে আছে ছোট্ট একটি রুম, যেখানে আছে গুস্তাফ আইফেল, তার মেয়ে ক্লেয়ার এবং টমাস আলভা এডিসনের সুচারু মুর্তি। দেখা যাচ্ছে টপ ফ্লোরর এই অফিস রুমে গুস্তাভ আর তার মেয়ে বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনকে আপ্যায়ণ করছে, তার সাথে গল্প করছে। একদম জীবন্ত। সত্যি কথা বলতে, গুস্তাভের একটা গোপন এ্যাপার্টমেন্ট এই টাওয়ারের উপর ছিলো। অ্যাপার্টমেন্টটি ছোট তবে এটি আরামদায়ক ছিল, দেয়ালগুলি সুন্দর ওয়ালপেপারে আচ্ছাদিত, এবং সেখানে কাঠের আসবাবপত্র আর দেওয়াল ছিলো তেলচিত্রদিয়ে সজ্জিত। ঘটনা জানাজানি হবার পর অনেক ক্ষমতাশালী, রথি-মহারথীরা এখানে যে কোন মূল্যে এক রাত থাকতে চেয়েছিলো। গুস্তাভ কখনো রাজী হয় নি। তবে সে নিজেও এখানে ঘুমিয়েছে এমনটাও কখনো শোনা যায় নি।

চার ঘন্টারও বেশী সময় পেরিয়ে গেছে টের পাই নি। নামার সময় আবার সেকেন্ড লেভেলে ঘুরলাম কিছুক্ষণ। কাছ থেকে ত্রোকাদেরোর সাথে ছবি নিলাম। বাইশ বছর আগে ছাত্রজীবনে যখন এসেছিলাম অদ্ভুত কোন কারনে ত্রোকাদেরো আমাকে ইমপ্রেস করেছিলো।

টাওয়ার থেকে নেমে উত্তরে সেন নদীর ধারে সাফের্ন ঘাটে গেলাম সবাই মিলে। এক আমেরিকান সিনিয়র সিটিজেন ভদ্রমহিলা আমাদের ফ্যামিলী ছবি তুলে দিলেন। এর পর লেনা ব্রীজ (পুন্দু লেনা, Pont d’lena) পেরুনোর সময় ফুটপাথে স্যূভেনির বিক্রী করছিলো আফ্রিকান ছেলেপেলেরা। পুলিশ দেখলেই সহজে ঝোলা বানিয়ে ওরা হাঁটতে থাকে, তখন পুলিশের কিছু করার থাকেনা। পুলিশ চলে গেলে আবার ঝোলা নামিয়ে ফুটপাথে দোকানের পশরা বসায়। বাইশ বছর আগে ঠিক একই চিত্র দেখেছিলাম, তখন ছিলো আমাদের দেশী ভাইয়েরা। জীবন হাতে নিয়ে ভুমধ্য সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে ইমিগ্র্যান্টরা আসে, অনেকে প্রান হারায়। যারা আসতে পারে তারা প্রথম প্রথম এই কাজ করে, নিজ পরিবারের জন্য টাকা পাঠায়। ধীরে ধীরে ভাষা শেখে, তারপর আরো ভালো কিছু করে। রক্ত জল করা এইসব রেমিটেন্স যোদ্ধাদের আমি শ্রদ্ধা করি, তাঁদের জন্য আমি দোয়া করি।
লেনা ব্রীজ পার হবার সময় চমৎকার বিষয় খেয়াল করলাম। ব্রীজের উপর এক লোক হার্ট শেপের অনেকগুলো বেলুন নিয়ে দাঁড়িয়ে, পাশে ফটোগ্রাফার। জানতে চাইলো ছবি তুলতে চাই কিনা, প্রতি ছবি দশ ইউরো। ব্যাস্ত সড়কের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সুড়ুৎ করে ছবি তুলতে হবে। তারপর দ্রুত আসা যাওয়া গাড়ীর ফাঁক ফোকর গলে আবার ফুটপাথে ফিরে আসতেে হবে।

আমার স্ত্রী তাৎক্ষনাৎ রাজী, এত সুন্দর ছবি উঠলো। মনে হল পঞ্চাশ ইউরোও কম হবে। যাই হোক, ব্রীজ পেরিয়ে গেলাম নদীর ওপাশে, ত্রোকাদেরো প্রান্তে। ঘাটের নাম দেবিলি। সেখানেও বেশ কিছু ছবি তুলে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম ত্রোকাদেরো গার্ডেনে। সবুজ বাগানের মাঝখানে বিশাল ফোয়ারা মেলা। গ্রীষ্মের এই গরমে পানির শক্তিশালী স্প্রে আশপাশটাকে করে দিচ্ছে নির্মল আর সুশীতল। ফোয়ারা লেকের উত্তরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে প্যালেস দ্যূ শ্যালট যেখানে আছে দুটো মিউজিয়াম, একটি বড় হল আর অফিস। আইফেল টাওয়ারের মুখোমুখি হলেও ট্রোকাদেরো আরেকটি ব্যস্ত ট্যূরিষ্ট স্পট। এখানেও আছে প্রচুর পর্যটক আর আছে নানান রকমের বাস্কার (Busker টকার আশায় যে চিত্তবিনোদন করে) কেউ গান করছে, কেউ খেলা দেখাচ্ছে ইত্যাদি। আরো আছে সুযোগ সন্ধানী স্যূভেনির বিক্রেতা, চাদর বিছিয়ে এটা ওটা বিক্রী করছে। আমরা বেদীর উপর থেকে আইফেল টাওয়ারকে নিয়ে প্রচুর ছবি আর ভিডিও নিলাম। সাথে ছিলো এ্যাকশন ফটোগ্রাফী, আমাদের লম্ফঝম্ফের স্টিল ফটোগ্রাফী, দারুন হয়েছে। প্রাসাদের সামনে অগনিত ভাষ্কর্য, প্রচুর পুরুষ ভাষ্কর্য আছে যেগুলোর নুনুর অস্তিত্ব বিপন্ন। আমার ছেলে জানতে চাইছিলো ঘটনা কি? আমি কিভাবে বলবো? গাতবার সবগুণো নুনু ছিলো এত বছর পর কিভাবে ক্ষয় হয়ে গেলো ঠাহর করতে পারছিলাম না।

ত্রোকাদেরো হিলের উপর বিশাল খোলা বেদী থেকে সামনের বাগান, জল-ঝলসানো ফোয়ারা, তারপর লেনা সেতুর ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা ফ্রান্সের অহংকার, সারা বিশ্বের অহংকার ‘আইফেল টাওয়ার’। চোখের সামনে এক অনন্য সুন্দর বিশালতা। ছবি তুলতে তুলতে এক সময় দেখে আর পারছিনা, আলো কমে গেছে। রাত নেমে গেছে, বাড়ী ফেরার পালা।
(© সকল ছবি ব্যক্তিগত)

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে জুলাই, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:২৭

শেরজা তপন বলেছেন: এর আগে আপনার লেখা পড়েছি কিনা মনে করতে পারছি না। বেশ বড় লেখা কিন্তু আপনি যাদুকরী কায়দায় আমাদেরও আপনার সাথে ভ্রমণ করিয়ে ছাড়লেন। লেখার মাঝে মাঝে টুকরো টুকরো ইতিহাস, গোলমেলে ফরাসী ভাষার দুরুহ উচ্চারণ, ২২ বছর আগের প্যারিসের সাথে এখন প্যারিসকে মিলিয়ে দেখা- আর ছবি টবি মিলিয়ে চমৎকার হয়েছে।
তবে সমস্যা একটা সেটা লেখার নামকরণে। অনেক ব্লগার এটা ইতিহাসভিত্তিক লেখা মনে করে এড়িয়ে যাবে- চমৎকার একটা ভ্রমণ কাহিনী মিস করবে।
গোস্তাফার একটা গোপ্ন এপার্টমেট ওইখানে ছিল ভাবতেই শিহরিত হচ্ছি।

২৭ শে জুলাই, ২০২৩ বিকাল ৩:২৫

আফলাতুন হায়দার চৌধুরী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাই কষ্ট করে লম্বা লেখা পড়ার জন্য। ভালো কথা বলেছেন, 'নামকরনের কারনে ইতিহাসভিত্তিক লেখা মনে করে এড়িয়ে যাবে', বিষয়টা বুঝতে পারিনি। পরেরবার ইন্টারেষ্টিং নাম দেবার চেষ্টা করবো।

২| ২৬ শে জুলাই, ২০২৩ রাত ৮:৩৮

রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর লেখা।
চমৎকার।

২৭ শে জুলাই, ২০২৩ বিকাল ৩:২৬

আফলাতুন হায়দার চৌধুরী বলেছেন: অশেষ ধন্যবাদ এবং কৃজ্ঞতা। ভালো থাকবেন।

৩| ২৬ শে জুলাই, ২০২৩ রাত ১১:৫১

করুণাধারা বলেছেন: বরাবরের মতই চমৎকার লেখা, তাই এত বড় পোস্ট একটানে পড়ে ফেললাম!

আগের একটা পোস্টে আপনি পুলিশি অভিযানের বর্ণনা দিয়েছিলেন। সেই পোস্টটা ভালো লেগেছিল, তাই আপনার পোস্ট দেখলে পড়ার চেষ্টা করি। কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে পারছি না, আপনি টানেল পার হয়ে ফ্রান্সে ঢুকে বেলজিয়াম গেলেন, তারপরে মাঝরাতে প্যারিস যাত্রা করলেন। কেন একবারে প্যারিসে গেলেন না? আর বন্ধু, বন্ধু- পত্নী দুজনেই কি রাতে ডিউটি করেন?

২৭ শে জুলাই, ২০২৩ বিকাল ৫:০৮

আফলাতুন হায়দার চৌধুরী বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ, কষ্ট করে লম্বা লেখা পড়েছেন।

আপনার প্রশ্ন প্রসঙ্গে:
প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি লেখায় সময়ের (আনুক্রমিক) ভুল বিবরণের কারনে আপনার গোলমেলে ঠেকেছে।
বিষয়টা এরকম: আমি থাকি লন্ডনে। গ্রীষ্মের শুরুতে ভাবলাম ছয়দিন সময় পেয়েছি তাই ঘুরে আসি। প্ল্যান হচ্ছে প্রথমে ব্রাসেলসে কলেজ সহপাঠী বান্ধবীর বাসায় যাবো, সেখানে দুই দিন থেকে তারপর যাবো প্যারিসে। প্রথমে লন্ডন থেকে রওয়ানা হয়েছিলাম এক দুপরে, গন্তব্য ব্রাসেলস্‌। কিন্তু ব্রাসেলস্‌ যেতে হলেও ফ্রান্স পার হয়ে যেতে হয়। দুরত্ব ২২৫ মাইল বা ৩৬২কিমি, সময় পাঁচ ঘন্টা।

সেখানে দুই দিন পর রওয়ানা হয়েছিলাম বিকেল বেলা ৭ টার দিকে। দুরত্ব ১৯৩ মাইল বা ৩১২কিমি, সময় চার ঘন্টা। প্যারিস পৌঁছি, রাত এগারোটার একটু আগে। বন্ধু আর বৌ মিলে সেন্ট্রাল প্যারিসে একটা ফিউশন রেষ্ট্যূরেন্টে চালায়, বাসা থেকে ঘন্টাখানেকের পথ। বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় মিডনাইট হয়। এখন বিজনেস সীজন তাই খুব বিজি, তবুও বন্ধু বলেছিলো এক ঘন্টা আগে ফোন করে জানালে ভাবীকে পাঠিয়ে দিতো, কারন আমরা গাড়ী নিয়ে ওয়েট করবো এটা ওর পছন্দ না।

আশা করছি এবার কনফিউশন দুর হয়েছে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.