![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
(*লেখাটি মাসিক কালি ও কলমে প্রকাশিত হয়েছে----লেখক)
প্রবন্ধের মূল খোরাক তথ্য, তত্ত্ব আর যুক্তি। ভাষার সৌন্দর্য অথবা শিল্পমান এখানে গৌণ, কিন্তু কথাসাহিত্যিক কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর-এর প্রথম প্রবন্ধ গ্রন্থ পাঠ করতে গিয়ে আমরা প্রবন্ধ সাহিত্যের এক নতুন সত্তা আবিষ্কার করি, যেখানে হৃদয়গ্রাহি ভাষার ভিতর দিয়ে তথ্য, তত্ত্ব আর যুক্তি এমনভাবে এগিয়ে যায় যেটা গ্রন্থের শেষ অবধি একজন পাঠককে মুগ্ধ করে রাখে। এই মুগ্ধতা দিয়েই আমরা পাঠ করতে পারি লেখকের প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ ‘উপন্যাসের বিনির্মাণ/ উপন্যাসের জাদু-এর প্রথম অধ্যায়। প্রথম অধ্যায়ের বিষয়বস্তু বাংলা উপন্যাসে জাদুবাস্তবতা (ম্যাজিক রিয়েলিজম) বাঙলা সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডার থেকে জাদুবাস্তবতা অনুসন্ধানের জন্য প্রবন্ধিক বেঁছে নিয়েছেন আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির, সৈয়দ ওয়ালী উলাহ্, কমল কুমার মজুমদার, সৈয়দ শামসুল হক, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ও নাসরিন জাহান। এ-লেখকদের গ্রন্থ আলোচনার পূর্বে প্রবন্ধিক জাদু বিষয়ে একটি নাতিদীর্ঘ ভূমিকা লিখেছেন, নির্মেদ ও হৃদয়গ্রাহি ভাষায় লেখা ভূমিকাটার তথ্য ও তত্ত্ব নিয়ে কিছু দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ রয়েছে। যেমন, একজন উপন্যাসিক ও তাঁর প্রবণতা সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে প্রবন্ধিক লিখেছেন, ‘ঔপন্যাসিক ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে বাঁচতে চান! তাতে দেশজ রূপ, হাহাকার রোদনমুখরতা বা মুগ্ধতা প্রকাশ করতে চান।’ ‘ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী’ ব্যাপারটা আমাদের কাছে কেমন যেন ধোঁয়াশাময় মনে হচ্ছে, ঠিক বুঝে উঠতে পারি না উপন্যাসিক কি করে ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী হন। একইভাবে চেতনার ধরন নিয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে প্রবন্ধিক যে দুটি ধারার কথা উল্লেখ করেছেন, ‘জানা’ ও ‘সক্রিয় ক্রিয়া’। এই সক্রিয় ক্রিয়ার তিনটি রূপের কথা প্রবন্ধিক আমাদের জানিয়ে দিলেও, ‘জানা’রও যে কিছু রূপ রয়েছে সেগুলো আমাদের জানাননি। হয়তো বা প্রয়োজন মনে করেনি, আলোচনা জন্য প্রয়োজন না হলেও প্রবন্ধের পূর্ণতার জন্য এগুলো উল্লেখ করা দরকার ছিল, মনে করি। সমকালিন বিশ্বসাহিত্যে জাদুবাস্তবতা এক বিরাট স্থান দখল করে আছে, কিন্তু প্রবন্ধিক সাহিত্যের এই ফর্মকে শুধুমাত্র সাহিত্যের মধ্যে দেখছেন না। তাঁর ভাষায়, ‘মিথের সর্বাঙ্গীন ব্যবহার এখন দেখা যায় শিল্প-সাহিত্যে, নৃ-তত্ত্বে, ইতিহাসে, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্বে।’ যদি বলা হতো মিথের ইতিহাস, তা হলে কোন প্রশ্ন ছিল না; কিন্তু মিথ-আশ্রিত ইতিহাসের কথা যখন বলা হয় তখন ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়েই তো প্রশ্ন উঠে। তাছাড়া, আমরা জানি, মিথ হচ্ছে বিশ্বাস আর বিজ্ঞান হচ্ছে যুক্তি, তবে জ্যোতির্বিজ্ঞান সাথে মিথের প্রয়োগ কী করে হয়? প্রাবন্ধিক জাদু খোঁজার জন্য বাংলা সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডার থেকে যে ক’টা উপন্যাস তুলে এনেছেন, সেগুলোর মধ্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়বনামা এবং সৈয়দ মোস্তাফা সিরাজের অলীক মানুষ আলাদা মনোযোগের দাবি দাবি রাখে। ইলিযাসের মহাকাব্যিক উপন্যাস খোয়াবনামাকে আমরা সাধারণত রিয়েলেস্টিক উপন্যাস হিসেবেই দেখি। প্রাবন্ধিক আমাদের সামনে উপন্যাসটার নতুন পরিচয় তুলে ধরছেন জাদুবাস্তব বলে ! প্রাবন্ধিক কোন যুক্তিতে খোয়াবনামকে জাদুবাস্তবতাস্পৃষ্ট বলেছেন, সেটা অনুসন্ধানের জন্য আমরা প্রবন্ধের স্মরণাপন্ন হতে পারি, ‘গিরিডাঙ্গা, নিজগিরিডাঙ্গা, মেঘ, মোষ, জাল ফেলার ইঙ্গিতময়তা বা কাৎলাহার যাবতীয় অনুষঙ্গ অপূর্ব জাদুময়তা সাজানো।’ আমাদের সাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতা বলে, বাংলা সাহিত্যে বিষয়বস্তুর সাথে সঙ্গতি রেখে সার্থক নামকরণের অনন্য উদাহরণ হতে পারে খোয়াবনামা। তমিজের বাপের কাছে মেঘ তাড়ানোটায় শুধু স্বপ্ন নয়, কাৎলাহার বিলের তাজা মাছের জোল দিয়ে পেট ভরে ভাত খাওয়াটাও স্বপ্ন। তমিজের বাপের এমন উদ্ভট স্বপ্নের কারণ অনুসন্ধানের জন্য আমরা বরং মনোবিশ্লেষক এর আশ্রয় নিতে পারি। তবে আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতা বলে, কর্মম তমিজের বাপের এমন উদ্ভুত ভাবনার ব্যাপারটা মানব প্রজাতিতে নতুন কিছু নয়। স্বপ্নের মধ্যে নয়, বরং আমাদেরকে জাদু খুঁজতে হবে উপন্যাসের বিন্যাসের মধ্যে। এর সার্থক উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করতে পারি সৈয়দ ওয়ালিউলাহ্র কাঁদো নদী কাঁদো। তবে প্রবন্ধিক এ-উপন্যাসটি আলোচনা করার সময় আমাদেরকে যে রাজনৈতিক ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত। কারণ, এটি কোন রাজনৈতিক উপন্যাস নয়। একইভাবে আমরা সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের অলীক মানুষ সর্ম্পকে বলতে পারি। মুস্তাফা সিরাজের পাঠকমাত্রই বলবেন, লেখক রিয়েল্যাস্টিক সাহিত্য করেন, অলীক মানুষ উপন্যাসটি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রাবন্ধিক তার লেখায় যুক্তি হিসেবে বলছেন, ‘মুসলমান সমাজের নানাবিধ খুঁটিনাটি বিষয়, শরিয়ত-মারফত, বাতেনি-জাহেরি, জিন সংক্রান্ত চলিত বিশ্বাস ভালভাবেই এনেছেন তিনি।’ এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, উপন্যাসের চরিত্রের সাথে এ-সমস্ত বিষয় জুড়ে দিলে উপন্যাসটি জাদুবাস্তব হয়ে উঠবে, এটা আমাদের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয় না। তো, গ্রন্থের দীর্ঘ প্রবন্ধ, ‘লীলায় দ্রোহে কমলকুমারের উপন্যাস’ কমল কুমারের পাঠকের জন্য একটা সহায়ক পাঠ হতে পারে। বিষয়-বিন্যাস ও ভাষায় কমল কুমার যে এক দুর্বোধ্য ঘরনা তৈরি করেছেন, সেই দুর্বোধ্যতা থেকে পাঠ উদ্ধার করে পাঠকের সামনে সহজ এবং প্রাঞ্জলরূপে তুলে ধরেছেন প্রাবন্ধিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা আলোকপাত করতে গিয়ে প্রাবন্ধিক যখন লেখলেন, ‘গোরা সহযোগে আলোচনার শুরুতে এ কথাটিও বলে নিতে হয়, রবীন্দ্রনাথ পাঠ করত তাঁকে নিয়ে কিছু লেখা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এক পরে কাছে তিন গুরুদেব, বিশ্ব কবি ইত্যাদি। অন্যপক্ষে কম বলে না সামন্ত প্রতিনিধি, বড়োমাপের বুর্জোয়া, বর্ধনশীল জমিদার, ব্রহ্মবাদী কিংবা বেহিসেবি যৌবনের ব্যাকুল মানুষ ইত্যাদি।’ আমরা প্রবন্ধের এই উক্তি পাঠের মধ্যদিয়ে ধরে নিতে পারি, প্রচলিত চিন্তার বিপরিতে দাঁড়িয়ে স্বতন্ত্র অবস্থান থেকে রবিঠাকুরের গোরা উপন্যাসকে বিশ্লেষণ করতে চান প্রবন্ধিক। প্রবন্ধ পাঠ শেষে যে কেউ বিনা বাক্যে স্বীকার করবেন, কাজটা লেখক বেশ সার্থকতার সাথেই করতে পেরেছেন। তবে প্রবন্ধের কিছু বিষয় লেখককে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। যেমন, ‘সারাটা উপন্যাস গোরা ধর্মের বিষয়-আশয় আর দেশ প্রেম নিয়ে থাকলেও ধর্মের বৌদ্ধবিপ্লব চোখে পড়েনি।’ তো, গোরা উপন্যাস যে সময়-বাস্তবতার উপর দাঁড়িয়ে লেখা হয়েছে, তখন বৌদ্ধবিপ্লবের বিষয় কতটা প্রাসঙ্গিক ছিল? কিংবা প্রাবন্ধিক এই বিষয়টাও আমাদের কাছে পরিষ্কার করেনি যে, প্রসঙ্গটা বাদ পড়ায় উপন্যাসের কী এমন তি-বৃদ্ধি হয়েছে? অনুরূপভাবে আমরা দেখি, ‘তবে ৭১ অনুচ্ছেদ তিনবার ৭৪ অনুচ্ছেদ একবার লেখা হলো গোরা কহিল, কিন্তু গোরা কাকে কী বলল? তার সামনে-পিছনে ডান-বায় কেউ তো নেই।’ এই বাক্যটি পাঠের পর আমাদের মনে হতে পারে, প্রাবন্ধিক বোধকরি ভুলে গেছেন, গোরার আগে-পিছে কেউ থাক আর না থাক সামনে কিন্তু ঠিকই পাঠক আছেন। ‘ধুলোমাটির মানবসকল’ প্রবন্ধটা ননী ভৌমিকের মৌলিক সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা। জীবনের বেশিরভাগ সময় মস্কোতে কাটানো এবং প্রগতির অনুবাদকের চাকরির কারণে তাঁর মৌলিক সাহিত্যের সত্তা বোধকরি পরিপূর্ণরূপে বিকশিত হতে পারেনি! আমাদের কাছে লেখকের যে ক’টা মৌলিক কাজ আছে, এই প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে প্রবন্ধিক সেগুলোর বিশিষ্ট রূপ তুলে ধরতে পেরেছেন। নেহায়েত কমও লেখনি ননী ভৌমিক, চারটা গল্পগ্রন্থ। একটা ভ্রমণ কাহিনি আর ধুলোমাটি নামে একটা উপন্যাস। এই উপন্যাসের বিষয়কে কেন্দ্র করে যে নির্দিষ্ট সময় পাঠকের সামনে স্মর্তব্য করে রাখলেন ননী ভৌমিক, প্রবন্ধিক আমাদেরকে সেই সময়ের কথাই জানিয়ে দিলেন তার নির্মেদ গদ্য আর কৌশলি যুক্তিতে। ঠিক একই রূপ আমরা দেখি, মীর মশারফ হোসেনের বিষাদ-সিন্ধু বিষয়ক প্রবন্ধ ‘তার বিষাদ তার সিন্ধু’তে। তবে এখানে তিনি উপন্যাসের বিষয় ও বিষয় দুর্বলতার দিকেই বেশি মনোযোগি হলেন। মীর মশারফ হোসেনের হাত ধরেই বাঙালি মুসলমানদের উপন্যাস চর্চার সূত্রপাত। না বললে নয়, উপন্যাসটা পাঠ করতে গিয়ে একধরনের অতি আবেগময়তার মুখোমুখি হতে হয়। এই আবেগময়তার কারণেই বোধকরি এটি আজঅবধি বাঙালি মুসলমান আমপাঠকের কাছে সমান জনপ্রিয় এবং বাঙ্গালি মুসলমাদের মধ্যে বিভ্রান্তিও ছড়িয়ে যাচ্ছে! প্রাবন্ধিক এগুলোর কয়েকটি তার প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন। তবে যে বিষয়টা প্রাবন্ধিকের চোখ এড়িয়ে গেছে বলে আমাদের মনে হতে পারে, তা হলো, আমরা আমাদের ইতিহাস পাঠের অভিজ্ঞতা আলোকে জানি, ঐতিহাসিক কারবালার ঘটনা মোটেও নারীঘটিত নয়, এটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক মতা দখলের দ্বন্দ্ব। অথচ আমরা যখন মীর মশারফ হোসেনের বিষাদ-সিন্ধু পাঠ করি, আমাদের মনে হতে পারে মোহাম্মদ-পরবর্তি এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধের কারণ জয়নাব নামক জনৈক সুন্দরী বিধবা নারীর মালিকানা নিয়ে। অকাল প্রয়াত কথাসাহিত্যিক কায়েস আহমেদের উপন্যাস নিয়ে প্রবন্ধ, ‘কায়েসের উপন্যাসে নির্জন দ্রোহ’। খুব বেশি নয়, কায়েস আহমেদ মাত্র তিনটা উপন্যাস রেখে গেছেন আমাদের জন্য। আবার উপন্যাসগুলোর আয়তনও ক্ষুদ্রাকৃতির। ১৪পৃষ্ঠার কতিপয় মৃত্যু স্বপ্নের চোখ, ৩৫পৃষ্ঠার নির্বাসিত একজন এবং ৩৩পৃষ্ঠার দিনযাপন। প্রাবন্ধিক তার ক্ষুরধার বিশ্লেষণ আর যুক্তি দিয়ে কায়েসের এই তিন উপন্যাসের নান্দনিকতা, সময় বিচারে প্রাসঙ্গিকতা আর শিল্পরূপ আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। তাকে নিয়ে আমরা যখন আখ্তারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘জতুগৃহে দিনযাপন’ প্রবন্ধটা পাঠ করি তখন দেখতে পাই ব্যক্তি কায়েসের অস্থিরতা তাঁর সাহিত্য কর্মের মধ্যদিয়ে কতটা প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু প্রবন্ধিক জাহাঙ্গীর ওই পথ মাড়ালেন না, তিনি বরং তাঁর সাহিত্যের ভাঙ্গা-গড়া আর কায়েসের সৃষ্ট উপন্যাসের চরিত্র বিশ্লেষণেই ব্রতী হলেন। মাহামুদুল হকের উপন্যাস বিষয়ক প্রবন্ধের শুরুতে প্রাবন্ধিক মাহামুদুল হকের সৃষ্টি বিচারের জন্য পাঠকের সামনে কতকগুলো শব্দ সাজিয়ে দিয়েছেন যেমন, ‘নির্জনতা, একাকিত্ব, নৈঃশব্দ্য, হতবিহ্বলতা। এই চারটি শব্দের মধ্যেই আমরা পুরো মাহামুদুল হককে পেয়ে যেতে পারি। এই একাকিত্ব যেন তাঁর চৈতন্যের মধ্যে সুপ্তভাবে লালিত হয়ে ক্রমশ বিকশিত হয়েছে তাঁর সৃষ্টির ভিতরে! এবং সময় অতিক্রমের সঙ্গে এই একাকিত্ব লেখার সাথে সাথে লেখককেও যে খুঁড়ে-খুঁড়ে খেয়েছে। এটা আমরা ছোটকাগজ লোকএ প্রকাশিত মাহামুদুল হকের স্বাক্ষাৎকার (আহমদ মোস্তাফা কামালের নেয়া) পাঠের মধ্য দিয়ে বুঝি। উপন্যাস জীবন আমার বোন-এ দেখি খোকা বলছে, মেধার চেয়ে শরীরের মূল্য কোন অংশে কম নয়। আবার কালো বরফ-এ এসে আমরা দেখছি পোকা বড় হয়ে যখন আবদুল খালেক হয়েছে, সুন্দরী বউটা তার কাছে কেমন পুরোনো হয়ে উঠলো। সৃষ্টির এই নিঃসঙ্গতা আদপে শিল্পীর ব্যক্তি নিঃসঙ্গতার প্রতিফলন। প্রাবন্ধিক কালো বরফ-এর বিষয় হিসেবে দেশভাগকে যেভাবে মূখ্য হিসেবে দেখিয়েছেন- এই মতের প্রতি সমমত পোষণ করেও আমাদের মনে হয় উপন্যাসটিতে বরং ব্যক্তি-মানুষের জীবন ও নিরর্থকতার অনুসঙ্গগুলোই মুখ্য হয়ে উঠে। মাটির জাহাজ সম্পর্কে প্রাবন্ধিক যে মন্তব্য করেন, ‘মাটির জাহাজ অভুক্ত নারীসমূহের ভাত-কাপড়ের গল্প বলা যায়, কিংবা নারীপিপাসু পুরুষের নারী থেকে নারীতে গমনের গল্প।’ লেখকের খেলাঘর উপন্যাসের কথা উঠলে আমাদের কাছে আরেকটু বেশি কিছু মনে হতে পারে! মনে হতে পারে একজন আত্মপ্রেমিক কাপুরুষের গল্প। সারাদেশে যখন ভয়ানক যুদ্ধ চলছে দু’জন নারী-পুরুষ একটা নির্জন ঘরে কেবল বাক্যালাপ করেই দিনযাপন করছে। প্রাবন্ধিকের মতে, মাহামুদুল হক কোন ইজম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। কিন্তু আমরা জানি, নিঃসঙ্গতা কিংবা নৈরাশ্যবাদ প্রচলিত পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামোর ব্যক্তিগত প্রকাশ। বাংলা গদ্যসাহিত্যে শহিদুল জহির ভাষার এক আলাদা জগৎ তৈরি করেছেন, তৈরি করেছেন বুননের নিজস্ব ধারা। তাঁর এই সুনিপুণ বুননের বিষয়-আশয়গুলোই প্রবন্ধিক আমাদের কাছে যুক্তি ও বিশ্লেষণ দিয়ে তুলে ধরেছেন ‘জহিরের জাদু, জহিরের বাস্তবতা’ প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে। গ্রন্থের সর্বশেষ প্রবন্ধ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত উপন্যাসসমূহের পর্যালোচনা। এটা ঠিক যে মুক্তিযুদ্ধের মতো এত বিশাল পটভূমি নিয়ে এখন পর্যন্ত তেমন কোন আন্তর্জাতিক মানের উপন্যাস রচিত হয়নি। ভাল-মন্দ মিলিয়ে এ-পর্যন্ত যে ক’টা উপন্যাস লেখা হয়েছে এবং যে ক’টা উপন্যাসই আলোচনার দাবি রাখে প্রাবন্ধিক তার সবগুলোই তাঁর প্রবন্ধে স্থান দিয়েছেন; শুধু বাদ পড়ে গেল আল মাহমুদের উপমহাদেশ নামক উপন্যাসটি। প্রবন্ধিক উপন্যাসটির কথা বেমালুম ভুলে গেছেন, এ-কথা মনে করার কোন কারণ নেই; আমরা বরং মনে করতে পারি এটি আলোচনায় স্থান না পাওয়ার কারণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। এ-ভাবে রাজনৈতিক বিবেচনা দিয়ে যদি সাহিত্য পাঠ করতে যাই, তবে আমরা বিশ্বসাহিত্যের অনেক মহৎ সাহিত্য রস থেকেই বঞ্চিত হবো !
কথাসাহিত্যিক কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের ‘উপন্যাসের বিনির্মাণ/ উপন্যাসের জাদু’ প্রবন্ধগ্রন্থের সামগ্রিক পাঠ-অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা বলতে পারি, লেখক বাংলা সাহিত্যের, বিশেষ করে কথা সাহিত্যের যুগান্তকারী-বিখ্যাত লেখকদের সাহিত্যসম্পদ নিয়ে মনোযোগী এবং দিক-উন্মোচনকারী বীক্ষা আমাদের সামনে হাজির করতে পারার মুন্সিয়ানা দেখাতে পেরেছেন।
উপন্যাসের বিনির্মাণ উপন্যাসের জাদু
লেখক: কামরুজ্জামন জাহাঙ্গীর
প্রচ্ছদ: রনি আহম্মেদ
প্রকাশক : জোনাকী প্রকাশনী
পৃ. ১৪৩, মূল্য : ১৭০
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১১
©somewhere in net ltd.