![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি কবিতা,গল্প,প্রবন্ধ,বই ও লিটলম্যাগ আলোচনা লিখে থাকি । ‘এবং মানুষ’ নামে একটি লিটলম্যাগ সম্পাদনা করি। সমাজের সুবিধা বঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। ব্লগারের অনুমতি ছাড়া কোন লেখা কপি করে অন্য কোথাও ছাপানো নিষেধ।
গণজাগরণ মঞ্চ: পিছন ফিরে দেখা
আনোয়ার কামাল
কাদের মোল্লার ফাঁসি রায় না হয়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং রায়ের পর তার ভি চিহ্ন দেখিয়ে উপহাস করে বাংলার মুক্তি পাগল মানুষকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল কাদের মোল্লা। তার এ উদ্ধত আচরণকে এ দেশের তরুণপ্রাণ যুবারা সহজে মেনে নিতে পারেনি। তাই তারা সেদিনের এই অনাকাঙ্খিত রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। তাৎক্ষণিকভাবে অনলাইন এক্টিভিক্টস ফোরামসহ ফেসবুক ব্যবহারকারীরা তাদের প্রতিবাদের ঝড় সারা বাংলায় টর্ণেডোর গতিতে ছড়িয়ে দিল। রাগে, ক্ষোভে, অভিমানে ফেটে পড়লো এদেশের তরুণ প্রজন্ম, যুব সমাজ। তাদের সাথে সমবেত হল আপামর মুক্তিপাগল মানুষ। আকাশসম অপরাধীর এতটুকু শাস্তি, তা তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে সবাই যে যার মত করে ছুটলো রাজধানীর শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র শাহবাগ মুখে।
রাজাকারের বিচারের দাবি ছড়িয়ে পড়ল শাহবাগ থেকে দেশময় হয়ে বিশ্বময়। আজিজ সুপার মার্কেট থেকে ছুটে এল একঝাঁক কবি, নাট্যকর্মী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টিএসসি, কলাভবন থেকে ছাত্ররা ছুটে এলো, ঘরে বসে রইলনা গৃহিনীরাও। দলে দলে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ডাক্তাররা বেরিয়ে এলো, ছাত্ররা স্কুল-কলেজ, আর মতিঝিল থেকে অফিস ফেরত সরকারি বেসরকারি চাকুরেদের ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসতে দেখা গেল শাহবাগ মুখে। পাবলিক লাইব্রেরিতে যারা বই পড়ছিল তারা বই পড়া ফেলে সবাই ছুটে এলো। রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসে ছিল দলে দলে যুবক-যুবতী, প্রেমিক-প্রেমিকা, সবাই তারা হাত ধরে ছুট দিল শাহবাগ মুখে, পেছনে রমনা ও সোহরাওয়ার্দীর সবুজ ঘাস আর পার্কের গাছগুলো মাথা উঁচু করে সমস্বরে সংহতি জানান দিল শাহবাগের অহিংস আন্দোলনে।
শাহবাগের থরে থরে সাজানো গোলাপ, গাঁদা, রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে শাহবাগের পিচঢালা পথে আলপনা আঁকা শুরু হল। ফুল দিয়ে লেখা হল বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তর এবং দুই হাজার তের এর বিজয় গাঁথা। বাড়তে থাকে মানুষ, নতুন স্লোগান, বাড়তে থাকে ক্ষোভ বারুদসম অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত; তাদের মধ্যে পঞ্চাশোর্ধ একজন মানুষ বুকে বড় বড় হরফে লেখা ’অপেক্ষা’ নিয়ে নির্বাক হয়ে চারুকলার সামনে মাঝপথে বসে পড়লো। কারো সাথে তার কোন কথা নেই। মনে হলো সে যেন রাজাকারের বিচারের দাবিতে জনম জনম প্রতিক্ষার প্রহর গুনতে প্রস্তুত। আর একজন মাথায় হ্যাট পরে তাতে রণাঙ্গনের পাঠাগার লিখে অজস্র বই সাজিয়ে বসে পড়লো শাহবাগে। তাকে দেখে মনে হ’ল ঠিক যেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে সহযোদ্ধাদের অবসরে বই পড়ার আনন্দ দেয়ার জন্য তার এ আয়োজন। বিয়াল্লিশ বছরের জঞ্জাল সরানো হচ্ছে, তাই রাস্তা বন্ধ। এ ধরনের প্লেকার্ড লিখে দাঁড়িয়ে পড়ল কয়েকজন। লক্ষ লক্ষ মোমবাতি প্রজ্জ্বলিত করে অশুভ আঁধার দূর করা হল। হাজার হাজার বেলুন উড়িয়ে শহীদ পরিবারের সদস্যরা তাদের প্রিয়জনের কাছে চিঠিতে অব্যক্ত কথা লিখে পাঠালো। একজন সন্তান তার শহীদ পিতার কাছে, স্ত্রী তার শহীদ স্বামীর কাছে, ভাই তার শহীদ ভায়ের কাছে চিঠি লিখে রঙিন বেলুনে তা উড়িয়ে দিল। সারা বিশ্বের বাঙালি কোটি কন্ঠে, হাত উচিয়ে শপথ নিল বিচার না হওয়া পর্যন্ত ঘরে না ফেরার। দেশে দেশে বাঙালিরা গণজাগরণ এর আদলে তারাও কাঁপিয়ে তুললো বিশ্বময়।
শাহবাগে আমাদের তরুণ প্রজন্ম জেগে থাকলো নিদ্রাহীন অজস্র রাত। ঝড়, বৃষ্টি, রোদ, বোমা, হেফাজতী তান্ডব কোন কিছুই তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। তাদের দেখে বাংলাদেশ স্তম্ভিত হল। আমাদের রাজধানীর শাহবাগ তখন থেকে প্রজন্ম চত্বর হল। একদিন বিকেল চারটায় সমগ্র বাংলাদেশ প্রতিবাদ স্বরূপ সব কাজ ফেলে তিন মিনিট দাঁড়িয়ে রইল। একদিন সমস্ত স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী একযোগে সমস্বরে গেয়ে উঠলো প্রাণের জাতীয় সঙ্গীত, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। শিল্পী সংগ্রামীরা সমবেত হল একই চেতনায়। উদীচী’র সংগ্রামী সাথী বন্ধুরাসহ সকল প্রগতিশীল সংস্কৃতি কর্মীরা সেদিন দিনকে রাত রাতকে দিন করে কাজ করে গেছে। ইতিহাসের এক অনন্য উচ্চতায় ভিন্ন মাত্রায় এ আন্দোলনকে নিয়ে গেছে। সারাদেশে উদীচী ছিল এ সংগ্রামের এক অপরিহার্য অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তার সাথে সকল প্রগতিশীল স্বাধীনতাকামী মুক্তি পাগল মানুষ ছুটে এলো। তৈরি হল ফুল দিয়ে জাতীয় পতাকা, ঢোলের তালে, আবৃত্তি, নাটকে গানে আর স্লোগান কন্যা লাকীর কন্ঠ ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বময়। পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে দেখলো তারুণ্যের জয়, বাঙালির বিজয় উল্লাস নতুন মাত্রায় উদ্ভাসিত হল। পরবর্তীতে গণজাগরণ মঞ্চ ইতিহাস হল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে। প্রথম বিজয় আসে তখনই। যারা অতন্দ্র প্রহরীর মত শাহবাগে রাতকে দিন আর দিনকে রাত করে জেগে ছিল। অনেক বাধা বিপত্তি এসেছে কিন্তু সেই সব অকুতোভয় তুর্কী তরুনরা পিছপা হয়নি। তারুণ্যকে জানাই অভিনন্দন। তাদের দৃঢ়চেতা আন্দোলনেই বিজয় সূচিত হয়েছে। সামনে দীর্ঘ পথ, এ পথ পাড়ি দিতে হবেই। তাই কান্ডারী হুশিয়ার।
এ আন্দোলনে শুরুতে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারসহ অনেক সাথীদের হারাতে হয়েছে, অসংখ্য সাথীদের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে। তবু গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে থামানো যায়নি। সাথীদের খুনে রাঙ্গা রাজপথে এখনো হায়েনার আনাগোলা। সইবোনা, কিছুতেই আমরা সইবোনা। গণজাগরণের এ বিজয় পতাকা জাতিকে সমুখপানে এগুনোর প্রেরণা জোগাবে। জয় আমাদের হবেই হবে।
©somewhere in net ltd.