![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমান
আনোয়ার শাহজাহান: অদ্যাবধি যেসব বীর সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত হয়েছেন, তার মধ্যে সিপাহি হামিদুর রহমান সর্বকনিষ্ঠ। তিনি তদান্তিন যশোর জেলার বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার মহেষপুর উপজেলার ঘোরদা খালিশপুর গ্রামে ১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মো. আক্কাস আলী ম-ল এবং মা কায়েদুননেছা
ছোটবেলা থেকেই হামিদুর ছিলেন পরোপকারী ও কঠোর পরিশ্রমী। সুঠাম দেহের অধিকারী হামিদুর ছিলেন কর্মঠ। একান্ত আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও আর্থিক দৈন্যের কারণে ষষ্ঠ শ্রেণির বেশি তিনি পড়ালেখা করতে পারেননি। সংসারে আর্থিক সহায়তার বাসনায় প্রতিবেশীর পরামর্শে ১৯৭০ সালে মুজাহিদ বাহিনীতে যোগদান করেন হামিদুর। ১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদান করেন এবং প্রশিক্ষণের জন্য চট্টগ্রাম ইবিআরসিতে (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার) অবস্থান করেন। চট্টগ্রাম ইবিআরসিতে তখন ২৫০০ জন রিক্রুট ছিলেন। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর বর্বর গণহত্যা চালায়। তাতে ইবিআরসিতে অবস্থানরত অধিকাংশ বাঙালি রিক্রুটসহ সৈনিকেরা শাহাদাতবরণ করেন। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান হামিদুর।
১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল যশোর ক্যান্টনমেন্টে। ৩০ মার্চ এই ইউনিটের সৈনিকেরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে বিদ্রোহ করে ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে এসে যশোর জেলার চৌগাছায় অবস্থান করছিলেন। হামিদুর দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে রেজিমেন্টের সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর সৈনিক নম্বর ছিল ৩৯৪৩০১৪।
যোদ্ধা ইউনিট হিসেবে খ্যাত ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদানের পরও হামিদুরকে সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে নিয়োজিত করা হয়নি। পরবর্তী সময়ে লেফটেন্যান্ট কাইয়ুমের নেতৃত্বে সি কোম্পানিতে তাঁকে যোদ্ধা হিসেবে নিয়োজিত করা হয়। হামিদুর রহমান মূল দলের সাথে তখন কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার কোদালকাঠি ইউনিয়নের দশঘরিয়া গ্রামে অবস্থান করছিলেন।
২৪ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি সেনারা সি কোম্পানির ওপর মর্টার, মেশিনগান ও অন্যান্য ভারি অস্ত্রের সহায়তায় আক্রমণ করে। যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর তড়িৎ পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তানি সেনা, রাজাকারসহ প্রায় ১০০ জন নিহত হয়। এ যুদ্ধে রাইফেল হাতে হামিদুর সর্বাগ্রে অবস্থান করেন। দুর্ভেদ্য শত্রুর বাঙ্কারে দুঃসাহসীকভাবে গ্রেনেড ছুড়ে চা-বাগান এলাকাটি দখলে তিনি অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন।
মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার অন্তর্গত ধলই একটি সীমান্ত চৌকি। ভারতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র ৪০০ মিটার দূরে অবস্থিত অবস্থানগত সুবিধা ও আর্থিক বিবেচনায় এলাকাটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত সৈনিক, রসদ, গোলাবারুদ, মেশিনগান, মর্টার ও ভারি অস্ত্রের সমারোহ এবং বাহ্যিকভাবে লোহার বিম, কাঁটাতার, মাইন ও অন্যান্য অনুষঙ্গের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনারা এই ঘাঁটিকে দুর্ভেদ্য করে গড়ে তুলেছিল। জেড ফোর্সের কমান্ডার এই শত্রুঘাঁটি দখলের জন্য ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সি কোম্পানিকে নিয়োজিত করেন।
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের দল ২৮ অক্টোবর সমাবেশস্থলে পৌঁছায়। ক্যাপ্টেন মাহবুবের অ্যামবুশে ৭ জন পাকিস্তানি সৈনিক নিহত হয়। মূলত এই খ-যুদ্ধের মাধ্যমে শুরু হয় ধলইয়ের রক্তাক্ত যুদ্ধ। শত্রুসেনাদের ক্রমাগত ভারি অস্ত্রের আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা বিশেষ কোনো সুবিধা করতে পারছিলেন না। লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম লক্ষ করেন, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে অবস্থিত দুটি মেশিনগান পোস্ট থেকে পাকিস্তানি সেনারা ক্রমাগত গুলি চালিয়ে যাচ্ছে।
যুদ্ধ জয়ের জন্য লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম তাঁর সর্বাধুনিক মারণাস্ত্র হামিদুরের স্মরণাপন্ন হন। অধিনায়ক তাঁর সেরা সৈনিককে নিজেদের অবস্থান ও তাঁর করণীয় বিষয় বুঝিয়ে দিয়ে হাতে দুটি গ্রেনেড তুলে দেন। অকুতোভয় হামিদুর পাহাড়ি নালার ভেতর দিয়ে ক্রলিং করে মেশিনগান পোস্টের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। প্রায় ৫০০ গজ দূরে অবস্থিত প্রথম মেশিনগান পোস্টটি সফলভাবে ধ্বংসের পর দ্বিতীয় পোস্টে গ্রেনেড চার্জের মুহূর্তে তিনি শত্রুর বুলেটে ধরাশায়ী হন। যদিও হামিদুর উভয় মেশিনগান পোস্টই ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছিলেন, কিন্তু নিজে আর জীবিত অবস্থায় ফিরে আসতে পারেননি।
মেশিনগান পোস্ট ধ্বংসের পর হামিদুরের সহযোদ্ধারা দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে দেখেন, শত্রুর বুলেটের আঘাতে তাঁর সমস্ত শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। সহযোদ্ধারা পরম মমতায় হামিদুরকে ত্রিপুরার আম্বাসা জেলার হাতিমার ছড়ায় দাফন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করে। তাঁর সনদ নম্বর ৩।
তিনি অবিবাহিত ছিলেন।
স্বাধীনতার ৩৬ বছর পর ২০০৭ সালের ১১ ডিসেম্বর হামিদুরের মৃতদেহ বাংলাদেশে আনা হয় এবং মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
তথ্যসূত্র ■■■
স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা - আনোয়ার শাহজাহান