নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন কুনোব্যাং এর চোখে দুনিয়াদারী

আসিফ হাসান জিসান

স্থাপত্যের অমনোযগী ছাত্র। অধিক ওজন, মধ্যম উচ্চতা ও নিচু একাডেমিক গ্রেডধারী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, আশাবাদী ও সারকাস্টিক এক সাধারণ মানব সন্তান।

আসিফ হাসান জিসান › বিস্তারিত পোস্টঃ

একজন নভেরা আহমেদ, একটি শহীদ মিনার ও কয়েকটি ট্রাজেডী।

২৫ শে অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৩:২০

খুব অল্প কয়দিন আগের কথা। জাতীয় জাদুঘরে নভেরা আহমেদ এর ভাস্কর্য প্রদর্শনী চলছে। দেখতে গেলাম অতি আগ্রহের সাথে। রিলিফ, ফ্রি স্ট্যান্ডিং আর ক্লে থেকে সিমেন্ট সব মিলে মোটামুটি ৩০ টির মত ভাস্কর্য। কিন্তু নিচে বিস্তারিত তথ্য নেই। কোনটার নামের জায়গায় শুধু “কম্পোজিশান” লেখা। কোনটা কোন প্রেক্ষাপট এ করা সেসব এর বালাই তো নেই ই বলা যায়। ভাবলাম ছবি তুলে নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করব। তুলতে শুরু করা মাত্রই একঘেয়ে বিরক্তিকর কন্ঠে একজন বলে যেতে লাগলেন যে ৫ টার বেশি ছবি তোলা যাবে না। নভেরা আহমেদ সব সময় দেশ থেকে একটা দুরত্ব বজায় রাখতে চেয়েছেন জীবনের বড় একটা সময়ে। আজকে তিনি নেই। তার অভিমান যাদের উপরে ছিল তারাই এখন সচেষ্ট তিনি যেন আড়ালেই থাকেন সেটা নিশ্চিত করতে। কী হত যদি ৫ টার জায়গায় ছয়টা ছবি তুলতাম? নভেরা আহমেদ এর স্কালপচার এর সস্তা রেপ্লিকা বানিয়ে বাজারে ছাড়তাম? সে সামর্থ্য আমার নেই। মানুষ নভেরা আহমেদ কে বুঝবে এমন রুচিও বিরল এখনকার ক্রেতামহলে। তাও দুই চারটা লোক উনার নামটা জানত। সেটাও কী জাতি হিসাবে আমাদের ব্যার্থতাকে একটু কমাত না?
আমরা এক নজরে দেখে আসি নভেরা আহমেদ কে। একুশে পদক পাওয়া ভাস্কর ও জাতীয় শহীদ মিনার এর প্রাথমিক দুই নকশাকার এর একজন (অন্যজন হামিদুর রহমান) নভেরা আহমেদ। আমরা আজকাল প্যাশান আর কর্মজীবন মেলাতে হাবুডুবু খাচ্ছি। এই সুন্দরবন এ জন্মানো মহিলা বাচ্চাকাল থেকে প্রেম এ পড়েছিলেন মাটির। কর্মজীবনে ভাস্কর হয়ে ওঠাটা তার ই ফসল। ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস হয়ে ফ্লোরেন্স ও ভেনিস ঘুরে ঘুরে ভাস্কর হিসাবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন বাংলার প্রথম স্বীকৃত নারী ভাস্কর, আরেকটু সাহস নিয়ে লিঙ্গ ভেদাভেদ থেকে বের হয়ে বললে বাংলার প্রথম আন্তর্যাতিক খ্যাতি পাওয়া ভাস্কর।এটা বলা মোটেও অন্যায় নয় যে উপমহাদেশ কে পাল-গুপ্ত যুগের সনাতন ভাস্কর্য এর ধারণা থেকে বের করে এনে যে মানুষটী আধুনিক ভাস্কর্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি নভেরা আহমেদ। এখানে আমি যা লিখতে যাচ্ছি তা নভেরা আহমেদ এর জীবনী নয়। নভেরা আহমেদ ইন্টারনেট এ পাতার পর পাতা বরাদ্দ পান নি। তাই তাকে নিয়ে জানার উৎস সীমিত, একটু ঘাটাঘাটি করলেই পাওয়া সম্ভব।ইন্টারনেট এর কয়টা পাতা আর কয়টা বই। সাথে নিজের একাডেমিক পড়ালেখায় জানতে পারা উনার নাম। এই ই আমার সম্বল।
এখানে একটা প্রশ্ন আসবে, সাধারণ জ্ঞান এর বইতে যখন আমরা শহীদ মিনারের ডিজাইনার এর নাম পড়ি শুধু হামিদুর রহমান কেন লেখা থাকে? নভেরা আহমেদ কেন লেখা থাকে না? এর উত্তরটা একটা Typical উপমহাদেশীয় গল্পবিশেষ। সেটাই আমার সামান্য জ্ঞান থেকে লিখব।১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন এর প্রেক্ষাপট এ অনেক কেন্দ্রীয় সরকারী অসহযোগীতার মুখেও ১৯৫৬ সালে শহীদ মিনারের নির্মান কাজ শুরু হয়। বিষয়টি এতটাই স্পর্শকাতর ছিল যে কোন নকশা আহবান বা টেন্ডার খবরের কাগজে বের করা হয়নি। পূর্ব পাকিস্তান এর তখনকার মূখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান জয়নুল আবেদিন কে সরাসরি ডিজাইন দিতে বলেছিলেন। এই সময়ে জয়নুল আবেদীন এর স্নেহধন্য হামিদুর রহমান ও নভেরা আহমেদ একই সাথে শিক্ষাজীবন শেষ করে দেশে ফেরেন। তারা যাবার সময়েও একই সাথে গিয়েছিলেন। জয়নুল হামিদ এর কাছে স্কেচ ও মডেল সহ ডিজাইন আহবান করেন ব্যাক্তিগতভাবে। এ সময় সরকার এর স্থাপত্যবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন জ্যাঁ দেলোরা। তার উপরে ভার ছিল এই কাজের তদারকি করা। এইখানে যেটা fact সেটা হল শহীদ মিনারের ডিজাইন নভেরা এবং হামিদুর রহমান মিলেই করেছিলেন। এবং এর উৎসাহ এসেছিল নভেরার seated woman নামের দুটি ভাস্কর্য থেকে। সেখানে মাতৃ প্রতিকৃতি ও আনত সন্তানের সম্পর্ক ছিল যেটা শহীদ মিনারের মূল উপজীব্য। তবে বর্তমান শহীদ মিনার থেকে নভেরা বা হামিদ কারো ডিজাইন ই বর্ননা করা সম্ভব নয় কারণ তাঁদের মূল ডিজাইন এর একটি বড় অংশ পরে আর বাস্তবায়িত হয় নি। যাই হোক, হামিদুর রহমান যে স্কেচ গুলো জমা দিয়েছিলেন তাতে বেশ কিছু স্তম্ভ ছিল যেগুলোর দৈর্ঘ্য দেলোরা পরিবর্তন করে দেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে শহীদ মিনারের কাজ সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। পরে দায়সারা ভাবে জিনিসটা শেষ করা হলেও মূল নকশা আর বাস্তবায়িত হয় নি। তবে তার চেয়েও আশ্চর্যভাবে স্থপতি হিসাবে নভেরা আহমেদ এর নাম বাদ পড়ে যায়। এর পেছনে কারণ কী এ নিয়ে অনেক মতবাদ আছে। অনেকে বলেন শহীদ মিনারের মূল স্তম্ভ গুলোর নকশা করেছিলেন হামিদুর রহমান। আর সাথে প্রচুর ভাস্কর্য ছিল যার পেছনে ছিলেন নভেরা। যেহেতু ভাস্কর্য গুলো পরে তোলা হয় নি তাই তাঁর নাম ও গেজেটে দেয়া হয় নি। যুক্তিটা কতটা খেলো আর সংকীর্ন তাতে না গিয়ে যদি প্রশ্ন করা হয় “কেন ভাস্কর্য গুলো তোলা হল না?” অর্থাভাব বা ধর্মীয় অনুভূতি জাতীয় শব্দ এনে আপনার মনকে বিষিয়ে দেবার কাজটি পাকিস্তান সরকার করেছিল অত্যন্ত সূচারুভাবে। অনেকে বলে থাকেন ধর্মীয় ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তান সরকার সেই রক্ষনশীল সময়ে একজন প্রগতিশীল নারী ভাষ্করকে একটা উটকো ভেজাল বলে মনে করেছিলেন। উড়িয়ে দেয়া যায় না কথাটা।

এর অভিমানে হোক বা সামরিক শাসনের অত্যাচার এর ভয়ে হোক নভেরা আহমেদ আবারো ফ্রান্স এর পথে পা বাড়ান। এবং এরপর আর ফেরত আসেন নি। মাঝে বেশ কয়েকবার গুজব উঠেছিল তিনি মারা গেছেন। অবশেষ এ সত্যি একসময় চলে যান না ফেরার দেশে। নভেরা আহমেদ এর এই দীর্ঘ অভিমান পর্ব নিয়ে আরেকদিন লেখার ইচ্ছা রাখি। তাই সে প্রস্নগ তোলা থাক।আমরা ফেরত যাই নভেরা আহমেদ আর হামিদুর রহমান এর স্বপ্নের শহীদ মিনারে। তাঁদের পরিকল্পনায় ছিল অনেকখানি জায়গা নিয়ে বেশ বড় আয়তনের শহীদ মিনার কমল্পেক্স নির্মাণ করার। নকশায় মিনারের ভিত্তি সংযুক্ত মূল অংশে ছিল মঞ্চের ওপর দাঁড়ানো মা ও তাঁর শহীদ সন্তানের প্রতীক হিসেবে অর্ধবৃত্তাকার স্তম্ভের পরিকল্পনা। স্তম্ভের গায়ে হলুদ ও গাঢ় নীল কাচের অসংখ্য চোখের প্রতীক খোদাই করে বসানোর কথা ছিল, সেগুলি থেকে প্রতিফলিত সূর্যের আলো মিনার-চতঙ্গরে বর্ণালির আভা তৈরি করবে। এছাড়া মিনার-স্থাপত্যের সামনে বাংলা বর্ণমালায় গাঁথা একটি পূর্ণাঙ্গ রেলিং তৈরি ও মিনার চতুঙ্গরে দুই বিপরীত শক্তির প্রতীক হিসেবে রক্তমাখা পায়ের ও কালো রঙের পায়ের ছাপ আঁকাও মূল পরিকল্পনায় ছিল। পাশে তৈরি হওয়ার কথা ছিল জাদুঘর, পাঠাগার ও সংগ্রাম-বিষয়ক দীর্ঘ দেয়ালচিত্র (ম্যুরাল)। আশপাশের জায়গা নিয়ে চোখের আকৃতিবিশিষ্ট ঝরনা নির্মাণের পরিকল্পনাও ছিল, যার প্রান্তে থাকবে ঢেউ-খেলানো উঁচু বেদী। আমি জানি ভাষায় বিষয়টি প্রকাশ করা খুব ফলপ্রসু নয়। তবে এই ধারণাটা দিতে চাই যে যা আমাদের পাওয়ার কথা ছিল তা আমরা পাই নি। পান নি নভেরা আহমেদ। হয়তো হামিদুর রহমান ও।
এর পরের ইতিহাস শুধুই আশাভঙ্গের ইতিহাস। ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর আজম খানের নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী মূল নকশা প্রায় আদ্যোপান্ত পরিবর্তন করে এবং পরিকল্পিত স্থাপত্যের অপরিকল্পিত সব বিদঘুটে পরিবর্তন ঘটিয়ে একটি নকশা দাঁড় করানো হয়। এ নকশা অনুযায়ী তড়িঘড়ি করে শহীদ মিনারের কাজ শেষ করা হয় এবং ১৯৬৩ সালের একুশে ফেব্র“য়ারি এ মিনার উদ্বোধন করেন শহীদ বরকতের মা হাসিনা বেগম। তবে শহীড মিনারের ট্রাজেডি এখানেই শেষ হয় নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আবারো শহীদ মিনার ভেঙ্গে সেখানে “মসজিদ” শীর্ষক একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়।মুক্তিযুদ্ধের পরে শহীদ মিনার আবার হয়েছে। ফেরত এসেছে ৫২ এর চেতনা বছরে এক দিনের জন্যে হলেও। নভেরা আসেন নি। আমরাও তাকে আনতে যাইনি। বা চাইনি। তাঁকে বুঝিনি। নীরবে নিভৃতে হারিয়ে গেছেন তিনি।একজন শিল্পীর ও তাঁর শিল্পের সাথে এত লম্বা ট্রাজিক ইতিহাস খুব বেশি মনে হয় নেই। বেচে থাকতে তো অনেক গুনী ব্যাক্তিকেই আমরা সম্মান দিতে পারি নাই। উনি এখন নেই। উনার কর্ম, কীর্তিগুলো মানুষের সামনে এনে মানুষকে দীর্ঘ সময় দেখার সুযোগ করে দেয়াটা আমার মনে হয় একটি অতি সামান্য যৌক্তিক দাবী।আর নভেরা আহমেদ সম্পর্কে জানতে হাসনাত আবদুল হাই এর “নভেরা” আমাকে বেশ সাহায্য করেছে।

বিঃদ্রঃ এই লেখাটী একটি জোড়াতালি দেয়া লেখা। তবে বাস্তব ইতিহাস আসলে মৌলিক লেখনী থেকে লেখার জিনিস না।রেফারেন্স হিসাবে “নভেরা” বইটি ছাড়াও টুকিটাকি ইন্টারনেট ঘাটা আর নিজের একাডেমিক বই খাতার ও সাহায্য নিতে হয়েছে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.