![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
‘খাবো- আরো খাবো’
- আবছার তৈয়বী
খেয়ে খেয়ে আমার ‘পেট’ টা একেবারে ‘ডোল’ হয়ে গেছে। আমি ছোটখাটো মানুষ। ছোট মানুষ মোটা হলে যা হয় তা- দূর থেকে কেউ আমাকে দেখলে ‘লাটিম’ মনে করে ভুল করতে পারে। তারপরও আমি রাত-দিন খাওয়ার পেছনে পড়ে আছি। ‘খাওয়া’ যদি ভালো কাজ হয়- তো এই ‘ভালো কাজ’টা আমি খুব ‘ভালোভাবে’ করতে পারি। যদি আপনাদের কারো মনে সন্দেহ জাগে, তাহলে ৩ কেজি গরুর গোস্ত, ৩ কেজি খাসি, ৩ টা মুরগী, ৩ হালি মুরগীর ডিম, মাছ ও শাক-সবজি পরিমাণ মতো রান্না করে আমাকে ‘দাওয়াত’ দিতে পারেন। জানি, আপনাদের মাঝে সে রকম ‘হিম্মতওয়ালা’ বা ‘হিম্মতওয়ালী’ কেউ নেই। তাহলে শুধু শুধু সন্দেহ করে লাভ কী? বলুন- লাভ আছে?
পরিমাণ মতো খাওয়া সুন্নাত। পরিমাণের চেয়ে বেশি খাওয়া মাকরুহ। বেশি খেলে দেহ-মনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। জানি- সব জানি। কিন্তু নানা রকম উপাদেয় খাবার সামনে থাকলে শাস্ত্রের কথা কিছুই মনে থাকে না। কী কইরতাম আফনেরাই কন! ডাক্তারের কাছে গেলে গালি খাই, গিন্নীর কাছে গেলে ঝাড়ি খাই। সব আমার কপালের দোষ। চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মুহতারাম মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী আমাকে বেশ স্নেহ করেন। তাঁর সাথে খেতে বসলে তিনি আমার প্লেটে আগে বড় একটা মাছ তুলে দেন। তারপর দেন ভাত। যে পরিমাণ ভাত তিনি প্রথমবার আমার প্লেটে দেন, সেই পরিমাণ ভাত আমার মা প্রতিদিন ‘ভাত্য মনা’ (একপ্রকার গ্রাম্য পাখি) কে খাওয়ান। তিনি তাঁর মাছ অর্ধেকও খেয়ে শেষ করেন নি, ততক্ষণে আমার মাছ আর ভাত দু'টোই শেষ- প্লেটটা আমার গড়ের মাঠ। তিনি বড় বড় চোখ করে দেখেন প্লেটে আমার কিছুই অবশিষ্ট নাই। তিনি মুচকি হাসি দিয়ে আমার প্লেটে আবার ১ বা ২ চামুচ ভাত দেন, তারপর মেছবাহ ভাই বা অন্য কাউকে ডাক দিয়ে বলেন- তৈয়বীর সামনে থেকে ভাতের জামটা (বড় পেয়ালা) সরাও’। আমার চোখ ‘ছলছল’ করে ওঠে। পেটের খিদেয় নয়, তাঁর ভালোবাসায়। তাঁর সাথে দেখা হলে তিনি আমাকে খাবার বা অন্য ব্যাপারে একটা না একটা উপদেশ দেবেনই দেবেন। এমন পরোপকারী ও দিলখোলা মানুষ আমি জীবনে কম দেখেছি।
সুফিয়ায়ে কিরামগণ খুব কম খেতেন। না খেয়ে খেয়ে তাঁদের শরীর শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেতো। জীবন ধারণের জন্য নিতান্তই যৎ-সামান্য খাওয়া প্রয়োজন, শুধু তা-ই খেতেন। আমরা যে সময়টা খাবার আহরণ, রন্ধণ ও গলাধঃকরণে ব্যয় করি- তাঁরা সেই সময়টা ইবাদাত-বন্দেগী, মুরাকাবা-মুশাহাদায় ব্যয় করতেন। ফলে তাঁদের ‘নফস’ যতোই নিস্তেজ হতো ‘রূহ’ ততোই প্রবল হতো। ‘ক্বানাআত’ (অল্পে তুষ্টি) ছিল তাঁদের ভুষণ, আর নিজের বেলায় জীবনের সর্বক্ষেত্রে ‘কৃচ্ছতা-সাধন’ ছিল তাঁদের ভিশন। কিন্তু কোন ভুখা-নাঙ্গা লোক তাঁদের দুয়ারে আসলে কেউ খালি হাতে বা খালি পেটে যেতে পারতো না। আজকাল সে অর্থে ‘সূফি’ যারা আছেন- সবই নামের সূফি। ‘সূফি’ তাঁরা হোন বা না হোন, তাঁরা প্রত্যেকেই কিন্তু মোটাতাজা ‘পীর’। তাঁদের ভুঁড়িটাও বেশ দশাসই। এই ভুঁড়ি দেখে আমাদের দেশের লোকেরা পীরের কদমে লুটিয়ে পড়েন। রূহানিয়ত বা সুন্নাতের পায়রবী দেখে না। এসব লোকে কান্ড-কীর্তন দেখে আমার বেশ মজাই লাগে। ইচ্ছে হয় আমিও কোথাও গিয়ে ‘পীর’ সাজি। কারণ, এরকম পুঁজিহীন ব্যবসা পৃথিবীতে আর একটিও নেই। এরা ‘গণিকা’ থেকেও নীচু স্তরের। গণিকারা নিজের শরীরটাকে এফোঁড় -ওফোঁড় করে পয়সা কামায়, আর এসব ভন্ডপীরের শুধু ভুঁড়ি দেখিয়েই মানুষকে প্রলুব্ধ করে। মোটা পেট যদি ‘পীর’ হওয়ার মাপকাঠি হয়, তো আমারও সে রকম ‘সম্পদ’ একখান আছে। ওরা পারলে আমি পারবো না কেন? ঢাকার বুকে আল্লাহ-রাসূল (দরূদ) ও প্রিয়নবীর আহলে বায়ত সম্পর্কে কটূক্তিকারী এক ভণ্ডপীর আছে- তার এই বিশাল ভুঁড়িতে আমার মতো কয়েকজন ‘পেটুক’ হেসে-খেলে অবস্থান করলেও কোন অসুবিধে হবে না।
‘কম খুর্দন, কম গুফতন ও কম শুসতন’ (কম খাওয়া, কম বলা ও কম ঘুমানো) আওলিয়ায়ে কিরামদের (রা.) একটি নীতি। কিন্তু আমার/ আমাদের নীতি ঠিক তার উল্টো। ফলে আমরা শারিরীক, মানসিক ও আত্মিক ভাবে দিন দিন রসাতলে যাচ্ছি। যত পয়সা আমরা খাবারের পেছনে ব্যয় করি, তার দ্বিগুণ পয়সা ব্যয় করি- কোট-টাই পড়া কসাই ‘ডাক্তার’দের পেছনে। ওরা আমাদেরকে ভোঁতা ছুরি দিয়ে যেমন ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা জবাই করে। প্রথমে মোটা অঙ্কের ফি, তারপর বাজারের ফর্দের মতো লম্বা স্লিপের অষুধের কমিশন। এরপর বিভিন্ন দামি দামি পরীক্ষা/টেস্ট ইত্যাদির কমিশন খেয়ে ডাক্তারের ভুঁড়িটাও খানিকটা বেড়িয়ে পড়ে।
আমরা ‘মাছে-ভাতে বাঙালী’ বললেও ‘গরুর গোস্ত’ বাঙালীর এক নম্বর প্রিয় খাবার। (কারো সন্দেহ হলে জরিপ চালিয়ে দেখতে পারেন)। বিশেষ করে চট্টগ্রামের মানুষরা গরুর গোস্ত বেশি খান। গরু ও গরুর গোস্তের সাথে সুন্নীদের কেবল পেটের আর দেহের সম্পর্ক নয়, একেবারে আত্মার সম্পর্ক। আমি দেখেছি- অনেক বড় বড় লোক ১২ পদের খানা খেতে বিয়েতে যায় না, কিন্তু গাঁটের পয়সা খরচ করে ‘মেজবান’ নামক খাঁটি গরুর তাজা গোস্ত খেতে সকাল সকাল চেয়ার দখল করে বসে থাকেন। গরু গোস্তের প্রতি আত্মার টান না থাকলে এমনটি করা যেতো না।
গরু গোস্ত ভক্ষণের ক্ষেত্রে সুন্নীদের অবস্থান এক ‘ডাং’ ওপরে। ভারত থেকে পাহাড়ের মতো উঁচু যে গরুগুলো আসে- তার ৯৫% ভাগ কারা খায় জানেন? সুন্নীরা। একবার কী এক অসুখের কারণে আমি ‘গরুর গোস্ত’ খেতে পারছিলাম না। খাবার টেবিলে বসে যখন বললাম- 'আমি গরুর গোস্ত খাই না'। অমনি একজন ফোঁড়ন কাটলো- ‘গরুর গোস্ত না খেলে আবার কীসের সুন্নী? মনে মনে বললাম- হায়রে গোস্ত পাগল সুন্নী! সুন্নিয়তকে আর কতো নীচে নামাবি?
আমার মুহতারাম ওস্তাদ জামেয়ার তৎকালীন (১৯৮৯-১৯৯৩) ১ম মুহাদ্দিস আল্লামা আবদুল হামিদ সাহেব (রহ.) খুবই সাদাসিধে চলাফেরা করতেন। হালকা-পাতলা ছিপছিপে ধরণের এই মানুষটি যে গরুর গোস্তকে এতো বেশি ভালোবাসেন- আমি জানতাম না। একবার তাঁর শরীরে খুঁজলি ও চর্মরোগ হলে তিনি ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার সব দেখে শুনে ওষুধ দিলেন। ডাক্তার যখন বললেন যে, ওষুধ সেবনকালীন সময়ে গরুর গোস্ত খাওয়া যাবেনা- অমনি তিনি ডাক্তারকে বললেন ‘আপনার ওষুধ আপনি খান, আমি চললাম। ঘটনা শুনে আমি হুজুরের কাছে বিস্তারিত জানতে চাইলাম- হুজুর আমাকে বললেন- এদিকে আয়, গেলাম। বস- বসলাম। তিনি বাম হাতে আমার ডান কান টেনে ধরে পিঠের মাঝ বরাবর একটা চাপড় দিয়ে বললেন, তৈয়ুবী শোন্! ‘গরুর গোস্ত হইল আল্লাহর নেয়ামত। ডাক্তার বেটা কোন আক্কেলে আমারে গরুর গোস্ত খাইবার নিষেধ করে?!!!
সেই থেকে এই ‘নেয়ামত’ পাইলে আমিও ছাড়ি না। বর্তমানে আমার ব্লাড প্রেসার আছে। ওবেসিটি আছে। কোলেস্টরল আছে। ওষুধও খাচ্ছি। কিন্তু ‘আল্লাহর নেয়ামত’ (গরুর গোস্ত) যদি ‘ফাও’ পাই, তো- ‘ভাত কম গোস্ বেশি’ এই থিউরী এপ্লাই করে ‘পটাপট’ কয়েক কিলো ‘নেয়ামতুল্লাহ’ আন্দর মহলে চালান করে দেই। কোন সময় পটল তুলি- কে জানে? তার আগে ফ্রী তে পাওয়া ‘নেয়ামতুল্লাহ’কে না করবো- কোন দুঃখে? যেখানে আমি ফ্রি পেলে ‘বিষ’ খেতেও রাজি! দীর্ঘ ৮-১০ বছর অসুখের কারণে আমি গরুর গোস্ত কী জিনিস- তা চেটেও দেখতে পারি নাই। এখন ‘সুদে-আসলে’ সব উসুল করছি। কোরেস্টরল ও ব্লাড প্রেসার যদি না থাকতো- তো গরু আর গরুর গোস্তকে আমি একবার দেখে নিতাম।
সক্রেটিস বলেছেন, ‘পৃথিবীতে মানুষ দু’ধরনের। ১. কেউ বাঁচার জন্য খায়, আর ২. কেউ খাওয়ার জন্য বাঁচে’। বলাবাহুল্য. সক্রেটিস প্রথম অপশন বেছে নিয়েছিলেন। আর আমি নিলাম ২য় অপশন। তাড়াতাড়ি পটল তুললেও অসুবিধা কি? আমি তো আর ‘সক্রেটিস’ না।
তারিখ: ০২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫
আবুধাবি, ইউ.এ.ই।
আবছার তৈয়বী
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি- প্রবাসী সাংবাদিক সমিতি (প্রসাস)- দুবাই, ইউ.এ.ই।
প্রতিষ্ঠাতা: আদর্শ লিখক ফোরাম (আলিফ), চট্টগ্রাম।
নির্বাহী সদস্য: আনজুমানে খোদ্দামুল মুসলেমীন, ইউ.এ.ই কেন্দ্রীয় পরিষদ, আবুধাবি।
ছবি পরিচিতি: 'নেয়ামতুল্লাহ' (গরু আর খাসি) দিয়ে ভুঁড়িভোজন চইলতে আছে। ডিস্টাব দিয়েন না। কেউ মান্নত কয়িয়া একবেলা খাওয়াইলে বহুত ছওয়াব পাইবেন। যাতায়াত খরচ নিজে বহন করিয়া থাকি। ছবি কৃতিত্ব : সাংবাদিক আবদুল মান্নান (আবুধাবি)
©somewhere in net ltd.