![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কুরবানীর গরুর সাথে টেলিপ্যাথি সংলাপ
এবং দু'পেয়ে পশুদের জন্য গরুর কান্না
-আবছার তৈয়বী
আমি: আসসালামু আলাইকুম, গরু সাহেব! কেমন আছেন?
গরু: ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ্। মন ভালো নেই- দাদা!
আমি: কেন? আল্লাহর রাস্তায় কুরবানী হবেন- এর চেয়ে সৌভাগ্য আর কী হতে পারে? আপনার তো খুশি হওয়ারই কথা।
গরু: উপলক্ষ তো ভালোই। কিন্তু দাদা, আপনাদের মনুষ্য জাতি তো আর 'মানুষ' নেই। এই কুরবানীতে আমি আল্লাহর রাস্তায় কুরবানী হওয়ার জন্য বড়ই সন্তুষ্টচিত্তে রাজি আছি। কিন্তু আপনাদের মনুষ্য জাতির নিয়ত তো ঠিক নেই।
আমি: কিভাবে জানলেন?
গরু: দুঃখের কাহিনী কী আর বলবো- দাদা! সারা বছর আমার মালিক আমাকে একপ্রকার উপোসই রেখেছে বলতে পারেন। কিন্তু ৩/৪ মাস আগে থেকে আমাকে খাবারের ওপর খাবার দিয়েছে। খেতে না চাইলে মেরে মেরে খাইয়েছে। জীবনে যে সব জিনিস আমার বাপ-দাদায়ও খায় নাই সেসব জিনিস খেতে আমাকে বাধ্য করেছে। আমাকে মোটা-তাজা করার জন্য ভারত থেকে আমদানী করে টেবলেট খাইয়েছে। আমার খাবারের সাথে পঁচা-বাসি পান্তাভাত মিশ্রিত করে দিয়েছে। এসব খেয়ে খেয়ে আমার শরীর ফুলে ফেঁপে উঠেছে ঠিকই, কিন্তু দাদা! বিশ্বাস করুন- আমার কলিজায় পচন ধরছে। আমি কাউকেই এই কথা বলতে পারি না।
আমি: বড়ই দুঃখের কথা!
গরু: দুঃখের কি আর শেষ আছে- দাদা! মালিক আর বেপারীরা মাসখানিক আগে থেকে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার মুখ উঁচু করে চোঙায় ভরে আমার পেটে খাবার ঢেলেছে। ঢালছে তো ঢালছেই, থামাথামির নাম-গন্ধ নাই। যতক্ষণ না আমার ডায়রিয়া শুরু হয়েছে ততোক্ষণ আমার ওপর জুলুম করেছে। এখন আমার শরীরটা অবশ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ভালো মতে হাঁটতেও পারি না।
আমি: বড়ই আফসোসের কথা!
গরু: আফসোসের কথা কি আর বলে লাভ আছে- দাদা! আমাকে এক ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তা খরিদ করেছে। আমার ছোট ভাইকে খরিদ করেছে- এক মজুদদার ব্যবসায়ী। আমার বড় ভাইকে কিনেছে এক ঠক রাজনীতিক। আমার তালত ভাইকে খরিদ করেছে- এক বাতিল আকিদার লোক। আমার চাচাকে খরিদ করেছে- এক পরান্নভোগী পীর। আমার ভাতিজাকে খরিদ করেছে- এক সন্ত্রানী মাস্তান। আমার বোনাইকে খরিদ করছে- এক চেকনাই চেহেরার ওয়াজি মোল্লা। আমার ভাগ্নেকে খরিদ করেছে- এক মদখোর লোক। আমার ছেলেকে খরিদ করেছে- এক বেনামাজী ব্যক্তি। আমার বোনকে খরিদ করেছ- কতগুলো লোভী লোক। এদের কারুরই নিয়ত শুদ্ধ নাই।
গরু: একদম হাছা কথা কইতাছি- ভাইজান! এই লোকগুলা ভিন্ন ভিন্ন পেশার হইলেও এদের সবার উদ্দেশ্য গোস্ত খাওয়া। আমাদেরকে যখন হাটে দেখতে আসে- তখন আগে দেখে আমার গোস্ত কত মন হবে! তারপর তারা মালিক বা বেপারীর সাথে দরদাম করে। কেউই আমাকে ভালোবেসে খরিদ করে না। আমার গতর দেখেই খরিদ করে। আপনিই বলুন- এই অপমান কি সহ্য করা যায়?
আমি: না যায় না। কিন্তু কী করার আছে- তাই বলুন?
গরু: আপনি কী আর করবেন? আপনাদের মনুষ্য প্রজাতির এই দু'পেয়ে পশুগুলোর অত্যাচারে আমি অতিষ্ঠ- দাদা!
আমি: কেন আবার কী হলো?
গরু: এই দেখুন না- দাদা! আমাকে কেনার পর থেকেই কিছুক্ষণ পর পর আমার গা জড়িয়ে ধরে খালি সেলফি তুলতাছে। প্রথমে খরিদদারের ছেলে যেই মাত্র বেপারীর হাত থেকে রশিটা নিল, তখনই বাজারের মধ্যে আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে সেলফি তুলল। সারা পথে আমাকে সামনে পেছনে ডানে-বামে রেখে ছবি তুলল। যেই মাত্র আমাকে বাড়িতে আনলো- ওমা! মালিকের ইয়া বড়া মেয়েটা আমায় জড়িয়ে ধরে সেলফি তুললো। বিশ্বাস করুন- শরমে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল তখন। এতো বড় জোয়ান মাইয়্যা লজ্জার মাথা খেয়ে আমারে জড়াইয়া ধরলে আমার কি আর মাথা-মুথা ঠিক থাকে- বলুন?
আমি: তাও তো একটা কথা?
গরু: রাখেন আপনার কথা! এদের অত্যাচার না হয় সহ্য করলাম। কিন্তু ঘরের আন্ডা-বাচ্চাগুলো যখন আমার সাথে ফটো তুলতে বায়না ধরে- তখন কি আর আমার ইজ্জত থাকে? বলুন- আমার ইজ্জত থাকে?
আমি: আহা ছোট্ট বাচ্চা-পোলাপাইনের একটু সাধ-আহলাদ আছে না? এমন নারাজ হলে কি আর চলে?
গরু: জ্বী দাদা! চলেনা বলেই তো মুখ বুঝে সব সহ্য করি। না হয় আমি কি এই আন্ডা-বাচ্চাগুলোকে পায়ের তলায় পিষে ফেলতে পারতাম না? কিন্তু ভেবে দেখলাম- বড় জানোয়ারগুলো যখন আমারে নিয়া এতো তাল-বেতাল করলো, ছোটদের আর দোষ কি? তাই কিচ্ছু করি নাই।
আমি: খুব ভালো করেছেন। আপনারা হলেন ধৈর্যের পাহাড়। অধৈর্য হলে চলবে কেন?
গরু: বিশ্বাস করুন দাদা! খোদার ভয় যদি আমাদের অন্তরে না থাকতো, তাইলে একটারেও আমরা ছাড়তাম না। ভেবে দেখলাম- আল্লাহর রাস্তায় যখন কুরবান হবো, হয়তো আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা নিতেছেন। আমাদের নিয়ত কিন্তু পরিষ্কার!
আমি: ধন্যবাদ। এইতো একখান কথার মতো কথা বলেছেন!
গরু: কিন্তু দাদা! দুঃখের কথা কী আর বলবো- যাদের নিয়ত পরিষ্কার ও পরিশুদ্ধ হওয়ার কথা তাদের নিয়ত তো পরিষ্কার নাই।
আমি: কেমনে বুঝলেন?
গরু: নিয়ত পরিষ্কার থাকলে কি আর আমাদের ফটো দিয়া ফেইসবুকে 'ইসটেটাস' দিয়া বেড়ায়? আরে ব্যাটা! ছবি যখন তুলছস, স্মৃতির জন্য রাইখ্যা দে। কিন্তু তা- না। ইস্টেটাস দিয়া বলে বেলায়- 'বন্ধুরা! এইটা আমাদের কুরবানির গরু। কেমন হলো? কত মন গোস্ত হবে? কতটাকা দিয়ে কিনেছি আন্দাজ করেন তো? কোন কোন আহাম্মক বুক ফুলিয়ে বলেই ফেলে- এতো টাকা দিয়ে খরিদ করেছি! ভাবখানা এমন- সে যেন কুরবানী নয়, বড় লোকগিরী ফুটানোর জন্য্ই আমাকে খরিদ করেছে।
আমি: গরু সাহেব। দুঃখিত হবেন না। আমার জানামতে, এদের কারুরই কুরবানী হবে না। মানে কুরবানীর উদ্দেশ্যটাই ব্যাহত হয়েছে। (আমার কথা শুনে গরু সাহেব কাঁদতে লাগলন)
গরু: এই জন্যই তো আজ ৩ দিন ধরে কাঁদছি- দাদা! কিন্তু বিশ্বাস করুন। আমার কান্নার দিকে তাদের কারুরই খেয়াল নেই। তারা এখনো সেলফি আর ফটো তুলতেই ব্যস্ত। এমনকি টাইমলি আমার খাবারও দেয় না। তবে আমি খাবারের জন্য চিন্তা করি না। আমার একমাত্র চিন্তা হলো- আল্লাহ যেন আমায় কবুল করেন।
আমি: ভালো বলেছেন। এটাই সকল কথার শেষ কথা।
গরু:ধন্যবাদ দাদা! তবে কথা আরো একখান আছে।
আমি: আবার কী কথা?
গরু: আপনি ওই দু'পেয়ে জানোয়ারগুলোকে বলবেন- আমাদের গোস্তগুলো যেন তিনভাগ করে একভাগ গরীব মিসকিনদের দিয়ে দেয়। গরীব আত্মীয়-স্বজনকে যেন দেয়। বেয়াই বাড়ীতে যেন আমার রান না পাঠায়। তাহলে মরেও আমি শান্তি পাবো না।
আমি: আইচ্ছা, ঠিক আছে- বলে দিমু নে।
গরু: আরো একটা কথা বলবেন।
আমি: কী?
গরু: আমাকে জবাই করার পর আমার রক্ত ও নাড়িভুঁরি, গোবর এবং উচ্ছিষ্ট অংশগুলি যেন সাথে সাথেই গর্ত করে মাটিতে পুঁতে পেলে। না হয়- পরিবেশ দুষিত হবে। দুর্গন্ধে মুসলিম জাতির বদনাম হবে।
আমি: সুবহানাল্লাহ্! আপনি তো দেখছি বেশ পরিবেশ সচেতন! এবং মুসলিম জাতির মান-সম্মান নিয়েও ভাবেন?
গরু: কী যে বলেন- দাদা! পরিবেশ দুষিত হলে তো আল্লাহ কুরবানীদাতাকে পাকড়াও করবেন। এজন্য কুরবানীর পশু হিসেবে কাল হাশরের ময়দানে আমাকে লজ্জায় পড়তে হবে। তাছাড়া মুসলিম জাতির কারণেই তো কুরবানীর মতো মহান উপলক্ষে আমরা আল্লাহর কাছে পৌঁছার সুযোগ পাই। দয়াল নবী বলেছেন- আমাদেরকে হাশরের ময়দানে জীবিত করা হবে এবং কুরবানীদাতাকে আমাদের ওপর সওয়ার করা হবে। দাদা! এটা কি কম সৌভাগ্যের কথা?
আমি: মাশাআল্লাহ্! আপনি তো দেখি অনেক কিছু জানেন? আপনার সাথে কথা বলতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি।
গরু: কিন্তু দাদা! একটা বিষয়ে আমি বড়ই কষ্ট পাই, আবার হাসিও আসে।
আমি: সেটা আবার কী?
গরু: আপনাদের মনুষ্য জাতির কিছু লোক যখন আমাদের মাদীগুলো 'মা' বলে ডাকে এবং পূঁজা করে- তখন মনে বড়ই কষ্ট লাগে। আর যখন প্রত্যুষে উঠে আমাদের মূত্রগুলি ঢকঢক করে গিলতে থাকে- তখন এই মূর্খ আবালদের কাণ্ড-কারখানা দেখে বড়ই হাসি পায়। আইচ্ছা আপনিই বলুন- মূত্র কীভাবে পানীয় হতে পারে?
আমি: সরি, গরু সাহেব! আপনার এই প্রশ্নে আমি সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পাচ্ছি। সুতরাং এইটা বাদ। তাছাড়া দাদারা শুনলে রাগও করতে পারেন।
গরু: ডরপুক কোথাকার! আমি আছি আল্লাহর কাছে কী জবাব দেবো- সেই চিন্তায়, আর আপনি দেখি- সাম্প্রাদায়িতার গন্ধ শুঁকতে ব্যস্ত!
আমি: দেখুন- আমি এক গরীব শব্দচাষী! কেউ যদি আপনার মূত্র খেয়ে খুশি থাকে- তাতে আমার কী করার আছে? আল্লাহ যতোদিন আমায় বাঁচিয়ে রেখেছেন- ততোদিন আমি আপনার গোস খাবো আর আপনাদের মাদীগুলোর দুধ খাবো। আপনার কোন আপত্তি থাকলে বলতে পারেন।
গরু: আপত্তি কিসের জনাব! আপনার সংকল্পের কথা শুনে অন্তরটা খুশিতে বাগ বাগ হয়ে গেলো। আমরা অন্তর দিয়ে আপনার জন্য দোয়া করবো। তবে আপত্তি একটা আছে।
আমি: আবার কীসের আপত্তি?
গরু: নাহ, আপত্তিটা আমাদের বিষয়ে নয়। আপত্তিটা হলো- আপনাদের সমাজপতি, চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের ব্যাপারে।
আমি: তারা আবার কী দোষ করলো?
গরু: দোষ তেমন কিছু না। আমি শুনেছি- হজ্বের মওসূমে মিনাতে যে দুম্বাগুলো কুরবানী দেয়া হয়, তা আপনাদের দেশের গরীব-মিসকীনদের জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু আপনাদের সমাজপতি, মেম্বার, চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, পুলিশ ও সরকারি কর্তা তথা 'বড় বড় মিসকীনরা' সেখান থেকে বৃহৎ অংশ মেরে দেয়?
আমি: সরি, আপনি আমাদের এই হৃদ্যতাপূর্ণ সংলাপের মধ্যে পলিটিক্স ঢুকিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং মনে কষ্ট নিবেন না- আমি সংলাপকে আর দীর্ঘায়িত করতে রাজি নই। আল্লাহ হাফেজ।
গরু: আমি খুবই দুঃখিত। শেষ পর্যায়ে এসে আপনার মনটাই খারাপ করে দিলাম। তবে আমার একটি শেষ ইচ্ছা আছে।
আমি: ঠিক আছে আপনার শেষ ইচ্ছাটা বলুন?
গরু: ধন্যবাদ। আমার শেষ ইচ্ছা হলো- যারা বিশ্বজাহানের অধিপতি আল্লাহ জাল্লা শানুহু সম্পর্কে খারাপ ধারণা করে, যারা আল্লাহর রাসূলের (দরুদ) শানে গোস্তাখী করে, যারা আহলে বায়ত, সাহাবী, মাযহাবের ইমামগণ এবং আউলিয়াদের শানে কটূক্তি করে আমার ইচ্ছে করে আমার এই শিং দিয়ে গুঁতাইয়া তাদের নাড়িভুঁরি বের করে ফেলি।
আমি: ধন্যবাদ। আমি দোয়া করি- আপনাদের কারো না কারো দ্বারা আপনার ইচ্ছাটা পূরণ হোক। আমিন।
গরু: সুম্মা আমিন। জাযাকাল্লাহু খায়রান কাসীরা।আপনি ভালো থাকুন। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। আল্লাহ মুহাফিজ।
তারিখ: ইয়াউমুন নাহার (১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ খৃ.)
আবুধাবি, ইউ.এ.ই।
©somewhere in net ltd.