বিজয়ের মাসে বাঙালির সমর্থন কড়চা - পুরোটুকু পড়ার জন্য অনুরোধ রইলো

০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:২৪

ভাই/আপু, অনুরোধ থাকবে, পুরো লেখাটি না পড়ে কোন সিদ্ধান্তে আসবেন না । আমার এই লেখাটি পুরোটাই যাচাই-বাছাই, আলোচনা-সমালোচনা ইত্যাদির মাধ্যমেই লেখা হয়েছে । এই লেখা সম্পর্কে অনেকের কাছ থেকেই রায় নিয়েছি । পুরোটুকু শুনে তারাও এই লেখার সাথে সম্পূর্ণ একমত হয়েছে । যাই হোক, এবার আসল লেখায় আসি ।

শুরু হয়েছে ডিসেম্বর মাস । যেহেতু ১৪ ও ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের দেশের স্বাধীনতালগ্ন থেকেই দুইটি বিশেষ তারিখ । তাই বলতে গেলে পুরো ডিসেম্বর মাসজুড়েই আমাদের মানে বাঙালিদের একটা বিশেষ আবেগ কাজ করে । এই মাসকেই আমরা বলি, বিজয়ের মাস । জী, হ্যাঁ, ৩০ লক্ষ প্রাণ আর ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা আমাদের লাখো-কোটি গর্বের । যাই হোক, যেহেতু বিজয়ের মাস চলছে, তাই শুরু হয়েছে পাকিস্তান নিয়ে ঘৃণামূলক পর্ব । যে যা পারছে তাই লিখছে পাকিস্তানের বিপক্ষে । কেউ বলছে কূটনীতিক সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলার জন্য, কেউ বলছে আন্তর্জাতিক আদালতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য, কেউবা আবার বলছে পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের দেশ থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে, কেউবা আবার বলছে বিএনপি-জামায়াতকে আর যেন কখনই ক্ষমতায় আনা না হয় কারণ তারা পাকিস্তানের দোসর, কেউবা আবার বলছে পাকিস্তানি হানাদারদের বির্যের কারণে জন্ম হওয়া জারজ পাকি সন্তানরা এ দেশের ভরাডুবি ঘটাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি । জী, ভাই, আপনাদের এই কথাগুলো নিঃসন্দেহে ভাবনার উদয় ঘটাচ্ছে । এর মধ্যে দুই-একটা কথা বাদে আমি আর বাকিগুলোর সাথে সম্পূর্ণই একমত ।

আপনি সরাসরি বা ইনিয়ে-বিনিয়ে পাকিস্তানের দালালি করতে মানা করছেন বাঙালী সকলকে । অত্যন্ত ভালো কথা । আপনি বলছেন পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে সমর্থন না করতে, এটাও অত্যন্ত চমকপ্রদ কথা । রাজনীতি আর খেলাকে আপনি একসাথে মিশিয়ে ডাল বানিয়ে খাবেন, এখানেও আমার মোটেও আপত্তি নেই । কিন্তু ভাই, তাহলে আমাদের এই দেশটা যেহেতু একটি গরীব ও অসচ্ছল একটি দেশ, তাহলে কূটনীতিকভাবে আপনি আমাকে কাদের দালালি করতে বলছেন, আমেরিকার ? কিন্তু তারা তো অনেক দূরের দেশ । আর তাছাড়াও বাংলাদেশের মত এত ছোট দেশের দালালি তাদের খুব একটা লাভবান করবে না । তাহলে কি ভারতের তথা ভারতীয়দের ? জী, হ্যাঁ, আমাদের তথাকথিত বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রের কথাই বলছিলাম । ভারত নাকি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বন্ধু রাষ্ট্র !! সত্য কথাই তো, তাই না ?

একটা স্ট্যাটাস পড়লাম সদ্যই । সেখানে লেখা ভারতীয়দের যখন বাংলাদেশের উপর কোন বিদ্বেষ ছিল না অর্থাৎ ১৯৭১ সালের কয়েক বছর আগের ঘটনা, তখনও নাকি বাংলাদেশীদের মধ্যে চরম আকারে ভারত বিদ্বেষ ছিল । ভারতকে নাকি অধিকাংশ বাঙালী দেখতেই পারতো না । তাহলে আমার মনে একটা প্রশ্ন, এই বিদ্বেষ কি এমনি এমনি সৃষ্টি হয়েছিল নাকি কোন বিশেষ কারণে ? বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু ধর্মীয় কারণেই । আর তাছাড়া আমাদের দেশের তিন দিকেই ভারত । ভারত সবসময়ই তাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র অর্থাৎ বাংলাদেশের উপর কর্তৃত্ব বতিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল । এখনকার পশ্চিম বাংলা তো আমাদের দেশের অধীনেই ছিল তখন, তাও এখনকার পশ্চিম বাংলার লোকজন বাংলাদেশীদের এত ঘৃণা করে কেন, বলতে পারেন ? এর গভীরেও অনেক কারণ আছে । বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকায় হওয়ার কথা ছিল না । কথা ছিল কলকাতায় স্থাপিত হবে । কিন্তু একজন ইংরেজ লর্ড যখন এই কাজটি করেন, তখন ভারতীয়রা প্রতিবাদ জানিয়েছিল । তাছাড়াও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ভারত বাংলাদেশের বেশ কিছু জায়গা নিজেদের অধীনে নিতে চেয়েছিল, যা তারা নিতে পারেনি ।

এ কে খন্দকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইটি নিষিদ্ধ হলো কেন, বলতে পারেন ? হ্যাঁ, এই সেই এ কে খন্দকার, যিনি কিনা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি সেক্টরের (২নং) কমান্ডার । যিনি কিনা আজীবন সমর্থন করে গেছেন আওয়ামী লীগের রাজনীতি । তাকেই বা কেন এত ধিক্কার পেতে হলো সেই আওয়ামী লীগেরই কাছ থেকে ? আপনি বইটি পেলে একটু পড়ে দেখবেন । অনেক সত্য সহজেই জানতে পারবেন । জী, আমি পাকিস্তান ও ভারত দুইটি দেশকেই অপছন্দ করি । যদিও কিছুক্ষেত্রে হয়তো পাকিস্তান ক্রিকেট দলের খেলা বেশ ভালো লাগা থেকেই দেখি তবে সামগ্রিকক্ষেত্রে পাকিস্তান নিয়ে আমি মোটেও আগ্রহী নই । আর ভারত ? জী, হ্যাঁ, আমি বলিউডের সিনেমাগুলো বেশ ভালোলাগা থেকেই দেখে থাকলেও ভারত সম্পর্কেও আমার ভিতর কোন আগ্রহ নেই ।

আপনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী । তাই হয়তো স্বাভাবিকভাবেই আপনি গনজাগরণ মঞ্চের সমর্থক । কিন্তু তারা যেখানে নিয়মিত সমাবেশ করে অর্থাৎ রাজধানীর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় (শাহবাগে), সেখানে সমাবেশ করার আদালত কর্তৃক বৈধতা নেই । তাহলে একটি বেআইনি ব্যাপারকে আপনি কিভাবে সমর্থন করতে পারেন ? আপনি কিন্তু কখনই নিরপেক্ষ নন । আপনি আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেন কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে রাজনীতি করছে । আপনি ঠিক আওয়ামী লীগকে পছন্দ করেন না কিন্তু আপনার পছন্দের ধারে কাছে আর কোন রাজনৈতিক দল নেই বলেই আপনি আওয়ামী লীগকে সমর্থন করতে বাধ্য হয়েছেন ।

ভাই/আপু, একবার বলবেন কি, আওয়ামী লীগের সকল রাজনৈতিক নেতাকর্মীর মত আপনি ভারতের অন্ধ দালাল কি করে হতে পারেন ? আপনাকে কি ফেলানির মৃত শরীর কাঁটাতারে ঝুলে থাকা কাঁদায় না, আপনাকে কি প্রতিদিন প্রায় দশ-বারোজনের হত্যা কাঁদায় না, আপনাকে কি ভারতীয় সিরিয়ালের ভয়ংকর আগ্রাসন ভাবায় না, আমাদের দেশের কোন মিডিয়া টিভি চ্যানেল যখন ভারতে দেখানো হয় না, তখন ভাবায় না, আপনাকে কি ভারতকে প্রতি বছর হাজার-লক্ষ টাকা লোন শোধ করার মত টাকা দেওয়া ভাবায় না, আপনাকে কি ফ্রি ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া ভাবায় না, আপনাকে কি গরু রপ্তানি হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়ার মত ভারতীয় সিদ্ধান্ত ভাবায় না ? ইত্যাদি আরও কত কিছু । হ্যাঁ, তবু আপনি ভারতের সমর্থক । ভারতকে অন্ধ ভকের মত অনুসরন করেন । তাদের পোশাক, তাদের ভাষা, তাদের সংস্কৃতি, তাদের সভ্যতা, তাদের ক্রিকেট দল, তাদের সেলেব্রিটি ইত্যাদি আপনি কঠিন ভাবেই অনুসরণ করেন । ভাই, আপনি কি আসলেই বাঙালী ?

একটা জিনিস খেয়াল করেছেন, এই সরকারের আমলে আমাদের দেশে কঠোরভাবে ইসলাম বিদ্বেষ চলছে । ৫ই মে তে হাজার হাজার হেফাজত কর্মী গণহত্যা, যেকোন ব্লগার মারা গেলেই ইসলামিক দলগুলোর উপর দায়ভার চাপানো, জামায়াতে ইসলামীর সকল নেতাকর্মীকে রাজনৈতিক কারণে গনগ্রেপ্তার আর সকলকে যুদ্ধাপরাধী বলে চালিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা (এমনকি স্বাধীনতা যুদ্ধের পর জন্ম হলেও), অন্যান্য ইসলামিক দলগুলোকে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের অজুহাত দেখিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পায়তারা ইত্যাদি সকল কিছুই কিন্তু স্পষ্ট আলামত । এগুলো কেন হচ্ছে জানেন ? কারণ ভারতীয়রা এই ইসলাম ধর্মকে একেবারেই পছন্দ করে না । তাই ভারতীয়দের অবাধ সমর্থন পাওয়ার জন্যই আমাদের সরকার এই ব্যাপারটিই পরিপূর্ণভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে । কোথায় জানি একটা কথা শুনেছিলাম যে, "আপনি অনেক মুসলমান ভাই/আপুর দেখা পাবেন যারা ভারতীয় ক্রিকেট দলের সমর্থক কিন্তু একজন হিন্দু ভাই/আপুকেও খুঁজে পাবেন না যে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সমর্থক" । আসলেই খাঁটি সত্য কথা । আর এর কারণ এই না যে পাকিস্তান আমাদের দেশে যুদ্ধাপরাধ করেছিল বরং সাম্প্রদায়িক কারণেই আমাদের দেশের হিন্দুরা মুসলমানদের একেবারেই সহ্য করতে পারে না ।

আপনি কি জানেন, ভারতীয়রা নিজেদের স্বার্থেই বলে থাকে, ভারত-পাকিস্তান ভাই ভাই ? এই ভারতীয়দের যদি বলা হয়, বাংলাদেশ তাদের কাছে বড় নাকি পাকিস্তান, তবে তারা তাদের নিজের স্বার্থটুকুই দেখবে । এখন তাহলে একটি প্রশ্নই মনে জাগা স্বাভাবিক । আমরা কি তাহলে ভারত-পাকিস্তান উভয় দেশ থেকেই আলাদা হয়ে একা একা থাকবো ? এ কি আদৌ সম্ভব ? জী, না, সম্ভব না । এখন ধরে নিই, পাকিস্তান পুরো ২৩ বছর আপনার কাছ থেকে যদি ১০০ কোটি টাকাও মেরে দিয়ে থাকে, তাহলে ভারত শতাব্দীর পর শতাব্দি আপনার কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিচ্ছে, দিতে থাকবে । আপনি আমি তাদের পুতুল হয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করতে পারবো না ।

আচ্ছা, অনেককেই দেখলাম, পাকিস্তান ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়দের যাচ্ছে তাই বলে গালাগালি করছে । কেউ শহীদ আফ্রিদিকে ডাক্রিদি, কেউ শোয়েব আক্তারকে বো**দা ইত্যাদি বলে ঠিকই বাঙালী সংস্কৃতির পরিচয় দিচ্ছেন । কেন ভাই/আপু, আমাদের অতীব বন্ধু ভারত কি তাদের নিজেদের দেশে আমাদের ক্রিকেট দলকে ডেকে ক্রিকেট সিরিজের আয়োজন করেছে এই পর্যন্ত ? আপনি ভারতীয় ক্রিকেট ট্রল পেজগুলোতে বাংলাদেশ ক্রিকেট খেলোয়াড়দের সম্পর্কীয় কোন পোস্টে ভারতীয়দের কমেন্টগুলো একটি খেয়াল করবেন । হ্যাংলাদেশ, ভিক্ষাংলাদেশ ইত্যাদি তাদের ভদ্র ব্যবহারের সামান্য নমুনা । আরও অনেক কথাই তারা বলে যেগুলো একজন বাঙালী হিসেবে দেখে থাকলে রক্ত গরম হয়ে যাওয়ার কথা । তবুও আপনি ভারতীয় ক্রিকেট দলের সমর্থক, ভালোই । সদ্য বিশ্বকাপে নিশ্চয় ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কুকর্মের কথা আপনি ভোলেননি ? তাহলে একজন ভদ্রলোক খেলোয়াড় যে কিনা একজন মানুষ হিসেবেই আপনাকে সম্মান করে, তাকে আপনি এতটা অসম্মান করছেন কেন ? শুধুমাত্র একজন পাকিস্তানী বলে ?

ভাই/আপু, আপনি কি ভাবেন, কাকে পছন্দ করেন, কাকে ঘৃণা করেন, সেটা একান্তই আপনার নিজস্ব ব্যাপার । কিন্তু আপনি বলার কে যে, আমি বাঙালী না ? আপনাকে যদি বলা হয়, আপনার বাবা একজন রাজাকার, আপনি তো চোখ বন্ধ করে তাও বিশ্বাস করবেন । কারণ আমার-আপনার জন্মই হয়েছে যুদ্ধের অনেক বছর পরে (তরুণ সমাজকে বলছি) । এখন বর্তমান সরকারের তথাকথিত রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা যাদেরকে আমার বা আপনার সামনে রাজাকার বলছেন, আমরা চোখ বন্ধ করেই সেটা বিশ্বাস করছি । একবারও ভাবছি না, এটা তো মিথ্যাও হতে পারে । তাহলে এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ কেন ১৯৯২ এর দিকে জামায়াতের সাথে একত্র হয়েছিল ? তাই বলছি, আমি বা আপনি হয়তো রাজনীতির মারপ্যাচ বুঝি না, কিন্তু আমি বা আপনি বুঝি আমাদের দেশের সংস্কৃতি কত ভালো, কত সভ্য, কত সুন্দর । তাই আরেকজনের কথায় উঠাবসা না করে, একবার নিজে যাচাই করেই কাউকে ঘৃণা করুন । কারণ বেশিরভাগ সময়ই আমরা অনেক কিছুই করি শুধুমাত্র হুজুগে বাঙালী হয়, আসল কারণটুকু বা ঘটনাটুকু জানারও প্রয়োজন বোধ করি না । আপনার পছন্দ করারও যেমন অধিকার আছে তেমনি আছে যে কাউকে ঘৃণা করারও অধিকার । আর এই অধিকার আপনার কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না ।

৩ টি +০/-০