![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কবিতাই প্রিয়। কিন্তু গদ্যও যে তার আরশিনগর। তাই নারীর চেয়ে যতই প্রিয় বলি দেশকে; প্রকৃতি হেসে বলেঃ ও হলো কথার কথা। এভাবেই একদিন প্রেমে পড়লাম ঢাকার... স্বপ্নের মত সুন্দরী এক বারবনিতা। থাক এসব ব্যক্তিগত প্যাচাল। তার চেয়ে আসুন পাঠ হোক...
মার্মারা সাগরের পশ্চিম পাড়ের ছোট্ট দ্বীপে আমরা কফি খাচ্ছি। পৃথিবীর যত সমুদ্রে আমি শরীর ডুবিয়েছি- তার মধ্যে মার্মারার পানিই সবচেয়ে নীল। পর্যটকদের অনেকের গায়েই কোন কাপড় নেই। নগ্ন নারীদের পাশে স্কার্ট-টপ পরা ইয়াসমীনাকেই বরং পর্দানশীল লাগছে। আনোয়ার সচরাচর সানগ্লাস ব্যবহার করে না। আজ সেও কালো পর্দায় লজ্জা ঢেকে তাকিয়ে আছে অন্যদিকে!
ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড- ইয়াসমীনা বুকের বোতাম খুলতে খুলতে বলল- আই লাইক টু সুইম বিফোর লাঞ্চ। উইল ইউ, ফ্রেন্ডস্?
আনোয়ার উঠে বাথরুমে চলে গেল।
বড় একটা তোয়ালেতে ব্রা আর প্যান্টি ঢেকে ইয়াসমিনা নেমে গেল সিঁড়িতে। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, নগ্নতার মধ্যে নগ্নতা কোন অনুভুতি জাগায় না; অথচ একটি বোরকা-ঢাকা চোখের ইশারা মহাকবি হাফেজকে সমরখন্দ ও বোখারা দান করে দিতে বাধ্য করেছিল। আসলেই যুদ্ধ ও প্রেমের কোন নিয়ম নেই- গ্রীক অ্যাপ্রিকটের শরবতে চুমুক দিয়ে ভাবলাম আমি, অথচ প্রেমের বর্তমান রূপ হয়ে দাড়িয়েছে কত ভার্চুয়াল কত অস্থায়ী!;
শর্ট মেসেজের যুগে এটাই তো স্বাভাবিক, সারোয়ার। আনোয়ার তার মোবাইলের বাটন টিপতে টিপতে হাজির। টু’ডে আই লাইক টু টক প্যারিস।
আমি হেসে বললাম, হোয়াই নট! রাশিং হেলেন ইজ অলওয়েজ ওয়ান্টেড!
*
ফরিদউদ্দীন আত্তারের ‘দ্য কনফারেন্স অভ বার্ডস্’ বইটি হাতে নিয়ে আমি উত্তর দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। প্রেম-কাহিনী বিকশিতই হয়েছে সুফীদের হাতে। লাইলী মজুন কিংবা শিরি-ফরহাদের বহু আগে এই বসফরাস প্রণালীতে কেঁদে ফিরছে তেমনি এক অমর প্রেমোপখ্যান- দ্য লিজে- অভ হেরো-লিয়েন্ডার। আজ যেটাকে আমরা এজিয়ান-সী বলি, তার নাম এই কিছুদিন আগেও ছিল সী-অভ হল্লে। আমার ধারণা ছিল, নামটির উৎস হেলেন অভ ট্রয় থেকে। কিন্তু না, এ কাহিনীর মূল উৎস আরো আগে- যখন বসফরাসের দুই তীরে দুই রাজা ছিল... উইলিয়াম শেক্সপীয়ার তার বহু নাটকের মত যে কাহিনী সাজিয়েছেন নিজের মত: রোমিও-জুলিয়েট নামে!
ইতিহাস, পুরান আর তাজকেরাতুল আউলিয়ার মধ্যে তফাৎ কি? আমি ভাবতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু লাক্সারী-শিপের রূপসী রমনীদের যৌবনের-জেল্লা আর মার্মারার খোলা-হাওয়া আমায় উড়িয়ে নিয়ে এলো বর্তমানে। পায়ের নিচে ঐতিহাসিক তুরাগ, চোখের সামনে স্বল্পবসনা নারী আর হাতে ফরিদুউদ্দীন আত্তার- এই ত্রিমাত্রিক ভুবন ডেকে উঠলে কোন্ কাঠ পারে পালিয়ে যেতে?
*
বাংলাদেশের সেরা জ্যোতিষী মহাজাতক কৈশোর থেকেই আমায় আকর্ষণ করেছেন তার নামের জন্য। ম-হা-জা-ত-ক! নামটাই অদ্ভুত। বারবার আমি মাহবুব ভাইর কাছে জানতে চাইতাম- লোকটা কেমন? সে-কি গুরুগম্ভীর, না ঋষিসুলভ?
মাহবুব ভাই হেসে বলতেন, আরে না-না, শহীদ একেবারেই আধুনিক মানুষ।
আধুনিক মানুষ? আমি অবাক না-হয়ে পারি না। আধুনিক মানুষ জ্যোতিষ চর্চা করে?
হ্যাঁ, করে। আধুনিক মানুষেরই তো অকাল্ট রিসার্সে আগ্রহী হওয়া উচিত। অদৃশ্যই যদি আগ্রহ জাগাতে না পারে, তো তুমি আধুনিক হলে কেমনে?
জ্যোতিষীদের বুঝতে হলে বুঝি আধুনিকও হতে হয়?
খানিকটা তো হয়ই। চাইলেই কি তুমি হাজার মানুষকে ভেল্কি দেখাতে পারো? তাহলে তো সবাই জুয়েল আইচ হত।
আমি আরো অবাক হই মাহবুব ভাইর কথায়। শেষে বলি, আমাকে একদিন নিয়ে চলুন না?
চলো।
কবে?
যখন তুমি যেতে চাও।
কিন্তু আমার আর যাওয়া হয়ে ওঠে না। ব্যস্ততার নীচে চাপা পড়ে থাকে কৌতূহল, উৎসাহ আর অবিশ্বাস!
*
মিস্টার সারোয়ার?
ইয়েস।
বসতে পারি?
আমাকে অবাক করে হোস্নী এসে টেবিল দখল করল। আলবেনিয়ার মেয়ে হোস্নী। মিশর সেনাপতি মোহাম্মদ আলী পাশার জন্মস্থান আলবেনিয়া। গভর্ণর হিসেবে মিশরে যেয়ে শেষ পর্যন্ত মোহাম্মদ আলী সেখানকার স্বাধীন অধিপতি হয়ে ফাটল ধরান ওসমানী-খিলাফতের সুদৃঢ় দেয়ালে।
তোমার জন্য কি করতে পারি, হোস্নী?
কিছু না।...বাট, তোমার হাতে কি বই?
সুফী সম্রাট আত্তারের বই।
কেন?
ফরিদউদ্দীন আত্তারকে কিভাবে চেন তুমি? তিনি কি তোমার দেশেও জনপ্রিয়?
না।
তাহলে তোমার হাতে তার বই যে!
বাহ্! তাতে কি হয়েছে? চিনিনা বলেই তো পড়ব।
কিনেছ? না কেউ দিয়েছে?
ইউরোপকে আমি যতটা চিনি, কেউ এমন ব্যক্তিগত বিষয়ে চর্চা করে না। অবাক হয়ে বললাম, ব্যাপার কি হোস্নী? এনিথিং রঙ?
নো-নো। আই বিলংস্ টু আত্তারস্ ফ্যামিলি। সো...। তার গলা ভারী হয়ে এলো আবেগে।
ইট মিন্স, ইউ আর এ মোজলেম?
নট রিয়েলি। আই হ্যাভ নো বিলিভ। বাট মাই গ্র্যান্ড ফাদারস্ ওয়্যার টু বি। তুমি কি ইভো আন্দ্রিচের ‘ব্রীজ অন দ্রীনা’ পড়েছ? আমাদের আসলে কোন ধর্ম নেই। আছে কিছু ইতিহাস, কিছু স্মৃতি আর চেতন-অচেতন বিদ্রোহ। গত দুশো বছরের সাম্প্রদায়িকতা ইউরোপের প্রাচ্য-সংস্কৃতিকে পুরো টাই পাল্টে দিয়েছে।
ইউরোপের প্রাচ্য-সংস্কৃতি? আমার চোখ কপালে উঠে যায়। সে আবার কি?
এই বইটা দেখ।
ব্রা-প্যান্টি পরা হোস্নীর হাত থেকে আমি বইটা নিলাম। কোন আগ্রহ ছাড়াই খুললাম প্রথম পৃষ্ঠা। খুলেই নি:শ্বাস আটকে এলো আমার। বইটির নাম- ‘দ্য গার্ল ফ্রম দ্য গোল্ডেন হর্ন’! লেখক- কুরবান সাঈদ।
কুরবান সাঈদ? মানে, আলী এন্ড নিনো’র রাইটার?
ইউ আর রাইট।
তার এ-নামে কোন বই আছে বলে তো জানতাম না। ভেরি স্ট্রেঞ্জ।
আরো অনেক স্ট্রেঞ্জ তুমি পূর্ব-ইউরোপে খুঁজে পাবে। যদি পৃথিবীতে সত্যিকারের স্বাধীনতা থাকত- তাহলে হয়ত বলতাম, এখনো আমরা প্রাচ্যকে ভালবাসি। কিন্তু মানুষের কি কোনদিন অতটা স্বাধীনতা ছিল?
আমার নির্বাক চোখ তার দিকে তাকিয়ে রইল। হোস্নী আসলে কি বলতে চায়? নাটকীয়তা বা ভাবাবেগ ইউরোপীয়ানদের বৈশিষ্ট নয়। হোস্নী কি তবে--? নাহ্, আমি ভাবতে পারলাম না কিছুই।
*
ফরিদ উদদীন আত্তার, হোসনী আর শহীদ আল বোখারীর দেয়া বই আমাকে নিয়ে গেল সুফী সাধকদের মর্মমূলে। পারস্যের প্রাচীন মৃত্তিকা এর বীজতলা হলেও আধুনিক দুনিয়ার মরসীবাদ, সুফি-চেতনা আর মওলানা রুমী প্রায় একাকার হয়ে গেছেন। যদি ও ‘মসনবী’ আসলে কবিতার সংকলন এবং তার রচয়ীতা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। দীর্ঘতম এই কাব্য রচনা করেছেন মহান শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক জালালউদ্দীন রুমী; যিনি সুফীদের-রাজা বলেই খ্যাতিমান। এবং আশ্চর্যের বিষয়, তিনি এসব কবিতা লিখেছেন জীবনের প্রায় শেষাংশে। প্রথমাংশে তিনি ছিলেন তাত্ত্বিক, পাঠক ও শিক্ষক। তার জন্ম আফগানিস্তানের বল্খে- ১২০৭-এর ৩০ সেপ্টেম্বর। ফার্সী ভাষার এই সবচেয়ে খ্যাতিমান প্রতিভা পিতা বাহাউদ্দীনের সাথে পালিয়ে যান তুরস্কের কোনিয়া’য়- মোঙ্গলদের ধ্বংসলীলা থেকে বাঁচার জন্য। পথে নিশাপুরে তাদের সঙ্গে দেখা হয় ফরিদউদ্দীন আত্তারের। বাপের পেছনে রুমীকে আসতে দেখে আত্তার বলেন: একটি সাগর আসছে, পেছনে আরেক মহাসাগরকে নিয়ে।...
আশ্চর্য! আমি অবাক হয়ে বলি। এ-যে রূপকথাকেও হার মানায়!
হ্যাঁ। ফরিদউদ্দীন আত্তার ছিলেন তার সময়ের সবচেয়ে বড় দার্শনিক। রুমীকে তিনি দোয়া করেন এবং তার ভবিষ্যতে সম্পর্কেও উজ্জ্বল ভবিষ্যদ্বানী করেন।
শামসে তাবরিজের ব্যাপারটা কি?
তাবরিজের শামস্ও ছিলেন উঁচু মাপের আধ্যাত্বিক গুরু। সত্যের সন্ধানে তিনি ব্যস্ততা ও ভীড় থেকে পালিয়ে বেড়াতেন। শিক্ষকদের জন্য বিষয়টা অবশ্যই কঠিন। একবার ফরিদউদ্দীন আত্তার তাকে বললেন, তুমি আসলে নি:সঙ্গতার প্রেমিক নও, তুমি খুঁজছ প্রেম; যদিও তুমি তা জানো না। আমার মনে হচ্ছে, তোমায় যেতে হবে তুর্কিস্থানে। কোনিয়ার জালালুদ্দীন হবে তোমার অপ্রত্যাশিত বন্ধু।
শামস্ তুর্কিস্থানে পৌঁছে দেখেন- একটি চৌবাচ্চার পাড়ে বসে রুমী তার পিতার লেখা বই ‘মারিফ’ পাঠ করছেন আর গভীর মনযোগে তার শিষ্যেরা শুনছে। শামস্ তার হাত থেকে বইটি কেড়ে নিয়ে পানিতে ফেলে দেন এবং বলেন- যদি তুমি জালালুদ্দীন হয়ে থাকো, এই পাঠের কোন প্রয়োজন নেই।
সবচেয়ে প্রিয় বইয়ের এই দশা দেখে রুমী চেচিয়ে উঠলেন- এ আপনি কি করলেন, শায়খ? মা’রিফ ছাড়া আমার জীবন অচল।
তাই? বলে পানির মধ্যে হাত ডুবিয়ে শামস্ বইটি তুলে এনে বললেন, নাও তাহলে।
রুমীর চোখের সামনে বইটির ঝরঝরে শুকনা পাতা উড়ছে-। ভেড়ার চামড়া গায়ে-দেয়া শাম্সের দিকে তাকিয়ে অবাক চোখে তিনি বল্লেন, ঠিকই বলেছেন। মা’রিফ ওখানেই থাকুক। আমার জীবনে অন্য কিছু এসে গেছে...।
আমি অবাক হয়ে হোস্নীর গল্প শুনি। সে-আমার জীবনে দেখা প্রথম শ্বেতাঙ্গিনী, যে সুফীবাদের জটিল তত্ত্ব নিয়ে কথা বলছে। হেসে বলি- আমি যদি দুটো অ্যাপ্রিকট জুস আনতে বলি, কিছু মনে করবে হোস্নি?
নো, থ্যাংকস্।
সে আবার বলতে শুরু করে- আমার পিতৃপুরুষ আত্তারের বংশধর এবং আত্তারের শিষ্য রুমী। কিন্তু কি বিচিত্র, দেখ রুমী লিখেছেন কবিতা, যদিও তিনি ছিলেন কোনিয়া বিদ্যালয়ের মহাধ্যক্ষ; আর আত্তার লিখেছেন গল্প, যদিও তিনি শিক্ষা দিতেন কবিতা।
আমার হাত থেকে ‘কনফারেন্স অভ দ্য বার্ডস’ বইটি হাতে নিয়ে হোস্নী ভাবাবেগে আপ্লুত হল। -এ বইয়ে আত্তার অসংখ্য পাখির কন্ঠে মানব চরিত্রের বহুবিচিত্র রূপ এঁকেছেন। যদিও রুমির ‘ফানা (খেলা) এবং ‘বাকা’ (ব্যবচ্ছেদ) থেকে এর উপস্থাপনা পুরোপুরিই ভিন্ন- কিন্তু আসলে দুটো একই বিষয়। সুফীবাদ যে সত্যকে অনুভব করে চেতনার গভীর থেকে গভীরতর স্তরে- দুটোই তার স্তর মাত্র।
আমার চোখে ভেসে উঠল দুটি দৃশ্য: মহাজাতক নামক জ্যোতিষী- অর্থাৎ শহীদ আল বোখারীর কালো ভি-গলার হাতে-বানানো ফতুয়ার উপর উজ্জ্বল ফর্সা হাসি-হাসি মুখ এবং তুরস্কের দক্ষিণ-পশ্চিম শহর কোনিয়ায় জালালুদ্দীন রুমীর মাজারের ছবি। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) ছাড়া একমাত্র রুমীর কবরেই আমি সবুজ গম্বুজ দেখেছি। মদীনাতুন্নবীর গম্বুজ গোলাকার, মসৃন, অর্ধেক-কাটা উল্টানো সবুজ তরমুজের মত। রুমীর কবরের গম্বুজ লম্বা- রকেটের আকৃতি, যার তীক্ষ্ম শীর্ষদেশ একত্ববাদের পরম-সত্তার দিকেই অঙ্গুলী নির্দেশ করে। দুটি কৌনিক-মিলনের অ্যাঙ্গেল সিরামিকের জরি দিয়ে ঢাকা- যেন তা মিলন ঘটিয়েছে ফানা এবং বাকা’র।
রুমীর জন্যই সম্ভবত কোনিয়া বা আইকোনিয়ামের নাম মৌলভীর শহর। কেউ-কেউ সুফীদের আস্তানাও বলেন একে। রুমী মারা যান ১৭ ডিসেম্বর, ১২৭৩-এ। ডিসেম্বরের এই দিনে, প্রতি বছর কোনিয়া হয়ে ওঠে সুফীদের স্বপ্নপুরী। লক্ষাধিক রুমী-ভক্ত জড় হয় এখানে এবং তারা পালা করে রুমী, তার পিতা বাহাউদ্দীন, বন্ধু শাম্স তাবরেজী এবং পরবর্তী সুফীদের কবর জিয়ারত করে। রুমীর পিতার কবর রুমির কবর থেকে একটু পেছনে: উত্তরে এবং সামান্য বাঁকা। বলা হয়, রুমী এমনই বড় মাপের সুফি যে সবার আগে তাকে বিনয়-বিগলিত সালাম জানায় তারই জন্মদাতা পিতা বাহাউদ্দীন।
আমার চোখে ভেসে উঠল কবরে সোনার কাজ করা সেই উজ্জ্বল লাল আচ্ছাদন আর বিশাল সবুজ পাগড়ির কথা। আশ্চর্য হয়ে আমি আওড়ালাম রুমিরই একটি কবিতা: --
তুমি যেই হও- বন্ধু, এসো
অবিশ্বাস বা অগ্নিপূজার জন্য গ্লানি নেই
ভয় কোর-না অজ্ঞানতার অভিশাপকে
যদি ভুলেও থাকো অনুতাপের কথা
এসো,
প্রেমের মাহফিলে সবাই সমান।
যখন শাম্সে তাবরিজের সঙ্গে রুমীর দেখা হয়, তখন তার কোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল দশ হাজারেরও বেশি। তরুণ ও প্রবীন শিক্ষার্থীরা রুমীর কাছেই সরাসরি জ্ঞান লাভ করতেন ধর্মতত্ত্ব, কবিতা, সঙ্গীত, রন্ধন প্রণালী এবং পশুপালন বিষয়ে। রুমী বলতেন, পশুদের কাছেই আমরা শিখি এবং বাঁচার জন্য খাওয়াকে শিল্পে রূপ দেই; যেহেতু আল্লাহকে পাওয়ার উপায় হচ্ছে ধর্ম এবং প্রেমই তার বাহন- সুতরাং নিমগ্ন ও আত্মহারা হবার মাধ্যম কাব্য এবং সঙ্গীত চর্চায় মনোযোগ দেয়া কর্তব্য। সত্তা সেখানেই পরম সত্তার সাথে লীন হয় শুধুমাত্র প্রেমে।
শাম্সের সাথে রুমীর আলোচনা, পাঠ এবং অনুসন্ধান এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে রুমী তার বিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীর কথা ভুলে যান। এতে অন্যান্য শিক্ষকরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং রুমীকে শাম্স থেকে বিচ্ছিন্ন করার নানা চেষ্টা চালায়। মূখ্য বিষয় ছিল অর্থ, কারণ রুমীর নামেই স্কুলের উপার্জন। ষড়যন্ত্র করে শাম্সকে ইরানে চলে যেতে বাধ্য করে তারা- কিন্তু রুমীর আহ্বানে আবার তিনি কোনিয়ায় ফিরে আসেন। শেষ পর্যন্ত কিছু শিক্ষক, মুরীদ এবং রুমীর পুত্র আলাউদ্দীন মিলে শাম্সে তাবরিজকে হত্যা করে এবং তার লাশ লুকিয়ে রাখে।
রুমী এই আঘাত সহ্য করতে না পেরে যে-খেঁজুর গাছের নীচে দু’বদ্ধু শেষবার আলোচনায় রত ছিলেন- সেই গাছের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে ঘুরতে থাকেন আর বিরহের কবিতা আবৃত্তি করেন। এই প্রতীকী-ঘূর্ণন থেকেই জন্ম হয় সুফী নৃত্যের, ‘ফেমা’ নামে যা আজো তার অনুসারীরা পালন করে। পশ্চিমা অনেক দার্শনিক সুফীদের এই চক্রনৃত্যের সাথে মিল খুঁজে পেয়েছেন ছায়াপথ, গ্রহ-উপগ্রহ এবং অনু-পরমানুর মূলতত্ত্বের যার প্রতিটি বন্ধনেই রয়েছে ঘূর্ণন।
রুমী তার জীবনের শেষ ১২ বছরে একটি মাত্র দীর্ঘ কবিতা লেখেন- যার নাম মসনবী। চৌষট্টি হাজার লাইনের এই কাব্য ছ’টি অধ্যায়ে বিভক্ত। কবিতার লিপিকার হুশাম চেলেবি ছিলেন শাম্সের শিষ্য। ফুটনোটে তিনি লিখে গেছেন বন্ধুর প্রতি বন্ধুর প্রগাঢ় প্রেমের বর্ণনা- যা আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনাকাংখার মত দুর্জ্ঞেয় এবং বিরামহীন। রুমীর মৃত্যু বার্ষিকীকে এজন্যই তিনি উল্লেখ করেছেন ‘ওরস’ বা বাসর-রাত্রি নামে!
*
হোস্নী আমাকে ফিরিয়ে আনল মার্মারা সাগরের সুনীল ঢেউয়ে। তার উপচে-পড়া যৌবন এবং ইউরোপীয়-অনুতাপ সহসা আমার কাছে পরস্পর বিরোধী মনে হল এবং আমি ভালো করে বুঝতে চাইলাম- আসলেই সে আত্তারের অনুসারী কিনা।
আমি জানি, তোমার মধ্যে সংশয় জেগেছে। জাগাটাই স্বাভাবিক, সারোয়ার। তোমাদের মুঘল সম্রাট আকবরের রাজ্য সমগ্র ইউরোপের চেয়ে বড় ছিল। কিন্তুআকবরের সেই শাসনামল জ্ঞান-বিজ্ঞানে কেন এত কূপমন্ডুক হলো- যে তিনি নিজেই ‘ঈশ্বর’ হবার চেষ্টা করলেন? এটি কি দ্য গ্রেট আকবরের সাথে মানানসই?
আমি হতভম্ব হয়ে হোস্নীর দিকে তাকিয়ে আছি। তার টাইট অন্তর্বাসের কিনারে কিনারে উদ্বেলিত যৌবন। তা-যে বেদনার যুক্তিতেও এত সুকোমল, আমার যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না।
হ্যাঁ, সারোয়ার। পূর্ব ইউরোপও তেমনি। খিলাফতের বিলুপ্তির সাথে সাথে কেবল আমাদের রাজনৈতিক সীমানাই লোপ পায়নি, মিটে গেছে আমাদের জ্ঞানপিপাসা, মুক্তবুদ্ধি এবং সত্যের অন্বেষা। এগুলো না থাকলে যা থাকে, তার নাম বেঁচে থাকা হলেও- জীবন নয়।
মোস্তফা কামাল শুধু যে টুপির বদলে হ্যাট পরিধান করেছেন আর বোরকাকে নিষিদ্ধ করেছেন তাই নয়- তিনি টান দিয়েছেন আমাদের আত্মার মূল অস্তিত্বেও। তুমি নিশ্চয়ই জান, রুমীর মাযারকে তিনি যাদুঘরে রূপান্তরিত করেন ১৯২৭-এ। কিন্তু তাতে কি সিক ম্যান অভ ইউরোপ গ্রেটম্যান হয়েছে? না, মোটেই না। বরং তুরস্ক হারিয়ে ফেলেছে তার স্বকীয়তা, তার পরিচয়, তার অস্তিত্ব। যেমন, আমরা যখন বলি যে আমাদের কোন বিশ্বাস নেই, ধর্ম নেই তখন ভাব করি যে, এটা আমাদের গৌরব। আসলে তা আমাদের আত্মাহীনতাকেই কুড়ে-কুড়ে খায়। আমাদের অন্তরাত্মা চিৎকার করে বলে: কেউ আমাদেরকে আপন করে নাও; বুকে জড়িয়ে ধরে কেউ বলো- আমি তোমাকে ভালোবাসি। তখনই আমাদের রুমীকে প্রয়োজন হয়। দরকার পড়ে ফরিদ উদ্দীন আত্তারের।
বই দুটো টেবিলে রেখে হোস্নী হুট করে উঠে গেল আমাকে বিস্ময় ও বিপন্নতায় পাথর করে দিয়ে। তাহলে কি পুরো পূর্ব ইউরোপের আত্মাই এমন রিক্ততায় হাহাকার করে ফিরছে? কাঁদছে কোনো দৃঢ় অবলম্বনের জন্য?
‘পাখিদের পার্লামেন্ট’-- মনে মনে আমি নাম দিলাম আত্তারের ‘কনফারেন্স অভ বার্ডস’-কে এবং পড়লাম তার ভূমিকা। অনুবাদক রুমীর মসনবী সম্পর্কে বলেছেন: ‘প্রিন্সিপল্স অভ দ্য প্রিন্সিপল্স অভ দ্য প্রিন্সিপল্স অভ রিলিজিয়ন।’ সাধে কি আর পার্সীরা বলে, মসনবী হল দ্বিতীয় কোরান!
হোস্নীর সাদা পিঠের উপর সরু কালো চুল সাপের মত আছড়াচ্ছে- যেন আকাশ থেকে দেখা দানিয়ুব- যা ইউরোপকে সংযুক্ত ও বিচ্ছিন্ন করেছে পরতে পরতে। কেউ কি ভাবতে পারে, ঐ শতধা বিচ্ছিন্ন ভূখন্ডে এখনো আত্মার অনুসন্ধান করে ফিরছে সেই সব মানুষ- যাদের কারো পূর্বপুরুষ ফরিদ উদ্দীন আত্তার, কারো জালাল উদ্দীন রুমী?
দীর্ঘশ্বাস চেপে আমি দেহ ও মনকে এলিয়ে দিলাম বসফরাসের ঘুমের দোলনায়।
(----চলবে কি ?)
২| ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৪৯
মুনসী১৬১২ বলেছেন: চলেব না মানে..............
©somewhere in net ltd.
১|
৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ২:২১
উদ্যমী বলেছেন: জনাব, অবশ্যই চালিয়ে যান। আপনার "ঝিলাম নদীর দেশে" আমি কয়েকবার পড়েছি। এরকম সুলেখনি খুব একটা চোখে পড়ে না...।
আসছে বইমেলায় কোন নতুন বই কি বেরোবে? আর যদি এসব মনকাড়া লেখার সাথে নজরকারা ছবি দিতে পারতেন পোস্ট আরও সমৃদ্ধ হতো।ব্লগে আপনাকে নিয়মিত দেখার খুব ইচ্ছে...
ভালো থাকবেন।