নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ঝিলাম নদীর দেশ

আমি যত ভালোবাসি ততই উজ্জ্ল হয় সে তোমার নাম...

বুলবুল সরওয়ার

কবিতাই প্রিয়। কিন্তু গদ্যও যে তার আরশিনগর। তাই নারীর চেয়ে যতই প্রিয় বলি দেশকে; প্রকৃতি হেসে বলেঃ ও হলো কথার কথা। এভাবেই একদিন প্রেমে পড়লাম ঢাকার... স্বপ্নের মত সুন্দরী এক বারবনিতা। থাক এসব ব্যক্তিগত প্যাচাল। তার চেয়ে আসুন পাঠ হোক...

বুলবুল সরওয়ার › বিস্তারিত পোস্টঃ

উল্টো দিকে তাকাতেই দেখি কামালের সহাস্য ছবির নিচে লেখা- ‘মানুষ হওয়া অবশ্যই গৌরবের আর তুর্কি হওয়া তার শ্রেষ্ঠতম’। সেই শ্রেষ্ঠ জীবনেরই বার্তাবাহক কি নাজিম হিকমাত?

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১১:৪২

আধুনিক তুরস্কের খ্যাতি যদি কামাল পাশার জন্য হয়ে থাকে, বলা বাহুল্য, তুর্কি সাহিত্যের পরিচিতি নাজিম হিকমাতের জন্য। ‘পদাতিক’-এর কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কারণে বাঙালি পাঠকের কাছে তার খানিকটা-পরিচয় প্রকাশিত হলেও নাজিমের আসল পরিচয় বহুমাত্রিক। মুক্তিকামী মানুষের মঙ্গল-বার্তাবাহক তিনি- যিনি নিজেকে বলতেন ‘আত্মার প্রকৌশলী’।

মোস্তাফা কামাল যে বছর কমিশন লাভ করেন, মানে ১৯০২-এ, সে বছরই নাজিমের জন্ম। জনপ্রশাসক হিকমত বে এবং চিত্রশিল্পী আয়েশা দাশালিলার সন্তান তিনি। কিন্তু দু’জনের কারোরই বৈষয়িক প্রজ্ঞা বা চারিত্রিক স্থিরতা পাননি নাজিম। অস্থিরতা ও অ্যাডভেঞ্চার তাকে এতটাই তাড়িয়ে বেড়িয়েছে যে তার জীবনীকারেরা বলতে বাধ্য হয়েছেন, পুঁজিবাদ হলো সেই আহত-কেউটে, যে বারবার ফণা তুলেছে নাজিমের দিকে, আর নাজিমের বন্দুক থেকে বেরিয়েছে কবিতার-বুলেট। মৃত্যুর প্রায় অর্ধশতাব্দী পরও নাজিম হিকমাত বহুল পঠিত, আলোচিত ও বিতর্কিত। বরং বলা যায় ১৯৬৩ তে তার মৃত্যুর পরে তার পাঠকপ্রিয়তা বেড়ে কয়েক শ গুণ হয়েছে। আরো আশ্চর্য যে, পৃথিবীর কোনো কবির ভাগ্যেই এত নিষেধাজ্ঞা, অবরোধ আর সেন্সর জোটেনি-- যা জুটেছিল নাজিমের কপালে। অথচ সেই একই সেলোনাইকায় জন্মগ্রহণকারী মোস্তফা কামালের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত এই কবি তার-নেতা এবং তার-দেশের কাছ থেকেও সহানুভূতি পেয়েছেন খুবই কম।

ইয়াসমিনার কণ্ঠ লজ্জায় ম্রিয়মাণ। আনোয়ার আমাকে আগেই বলেছিল, মোস্তফা কামালের মর্যাদা তুর্কিদের কাছে প্রায় দেবতার মতো। কিন্তু আমি সেসব গ্রাহ্য না করেই জানতে চাই : লেসবস দ্বীপেই কি নাজিমের সাথে কামাল পাশার দেখা হয়েছিল?

না, লেসবসে নয়। মোস্তফা কামালের সাথে নাজিমের দেখা হয় আংকারায়। তবে তার এই একমাত্র সাক্ষাৎকারের ঘটনাটি শুরু হয়েছিল লেসবসে এবং শেষও হয়েছিল এখানে। মানে তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে ‘হাইজাক’ করে তার কাছে নেয়ার মাধ্যমে।

অদ্ভুত! আমার কৌতূহল লাফিয়ে ওঠে। বলো সে গল্পটা, ইয়াসমিনা।

গল্প নয়, সত্যি।

ওকে, তাই সই। সেই সত্যিই শোনাও।

তখনও মোস্তফা কামালের ‘গ্র্যান্ড অ্যাসেম্বলি’ আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা পায়নি। ১৯২০-এ ইউরোপীয় রাক্ষসদের সামনে ইস্তাম্বুল যখন মেষশাবকের মতো কাঁপছিল, ‘দৈনিক আলিমদার’ আয়োজন করেছিল “দেশপ্রেমের কবিতা” প্রতিযোগিতা। উঠতি-কবি ফারুক নাফিস, ইউসুফ জিয়া ও অরহান সেইফির বিচারে শ্রেষ্ঠ কবি নির্বাচিত হন নাজিম হিকমত। বন্ধু আলা নুরুদ্দীন রানার-আপ। চিন্তা চেতনায় তখনই এরা চরম প্রগতিশীল। মোস্তফা কামালের কাছে পৌঁছার জন্য অস্ত্র বয়ে নিয়ে যাওয়া শিপ ‘ইয়েনি দুনিয়া’য় ছদ্মবেশে উঠে বসেন দুই কবি। লেসবস থেকে। বাধ্য হয় চোরাচালানিরা তাদেরকেও মালামালের সাথে আংকারায় পৌঁছে দেয়; কারণ, ফিরে যাওয়ার রাস্তা নেই। কামালের ‘গ্র্যান্ড অ্যাসেম্বলি’ বা সিক্রেট কাউন্সিল ঘটনা জানতে পেরে গোপনীয়তা ফাঁসের ভয়ে হতভম্ব হয়ে যায়।

যারা ফয়সালার দায়িত্বে ছিল, বাধ্য হয়ে তারা নির্দেশ দেয়Ñ যদি তোমরা এমন কবিতা রচনা করে দেখাতে পারো যা ইস্তাম্বুলের তরুণদের ঘুম ভাঙাতে পারে, তাহলে তোমাদের শাস্তি হবে না। তাদেও নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল, ব্যর্থ হয়ে ছেলে দু’টি ঘরে ফিরে যাবে।

কিন্তু তিন দিন পরে তিন পৃষ্ঠার একটি কবিতা উপস্থাপন করে দুই বন্ধু। সাথে সাথেই কবিতাটি কাউন্সিলরদের পছন্দ হয়ে যায়। ১৯২১-এর মার্চে কবিতাটি ১০ হাজার কপি ছাপা হয় এবং আংকারা ও ইস্তাম্বুলে ঝড় তোলে।

আমার মনে পড়ে গেল, নজরুলের ‘বিদ্রোহী’র কথা। সেটিও তো মনে হয় ওই সময় ছাপা; একই বছর!

এই ঝড় এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে ‘কাউন্সিল’ জরুরি সভায় বসতে বাধ্য হয়। আলোচ্য বিষয় : কী করে এই উত্থিত তরুণ-আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ডাইরেক্টর অভ প্রেস মুহিত্তিন বার্গেনকে মৃদু তিরস্কারও করা হয় ‘অর্বাচীন’ প্রকাশনার জন্য। কিন্তু অমঙ্গলের মধ্যে যেমন মঙ্গল থাকে, তেমনি এ ঘটনার মধ্যেও ছিল কল্যাণ। দুই তরুণকে হাজির করা হয় জেনারেল মোস্তফা কামালের সামনে।

কামাল তাদের সাথে আলোচনা শুরু করেন।

নুরুদ্দিন তার বর্ণনায় লিখেছেন, ‘মোস্তফা কামাল বললেন : কিছু কিছু তরুণ তাদের চটকদার পঙ্ক্তিতে তরুণীদের মোহিত করতে চায়। কিন্তু আমরা চাই সেই কবিতা, যার লক্ষ্য মহৎ ও সুদূরপ্রসারী। কৃশকায় হাজার কবিতার চেয়ে একটি সবল কবিতা হতে পারে সূর্যের মতো উজ্জ্বল...। হঠাৎ এক জরুরি টেলিগ্রাম আসায় কামাল উঠে যেতে বাধ্য হন এবং ‘জাতীয় বৃহত্তর প্রয়োজন’ তাকে ব্যস্ত করে তোলে। আমাদের আর কখনো দেখা হয়নি।’

দুই তরুণকে স্কুল-শিক্ষকের চাকরি দেয়া হয়। কিন্তু শিগগিরই তারা ধর্মনেতা ও প্রাচীনপন্থীদের রোষানলে পড়েন। কারণ তারা রুমি টুপির বদলে ফার টুপি পরছিলেন, আর লিখছিলেন জাগরণমূলক কবিতা। ফলে আবারো দ্বন্দ্ব কোর্টে গড়ায়। ভাগ্যক্রমে ক্রিমিনাল কোর্টের ডেপুটি জাস্টিস জিয়া হিলমির কারণে আইনি শাস্তি থেকে বেঁচে যান তারা। কিন্তু মোল্লারা পিছু ছাড়ে না। শেষে সাহিত্যপ্রেমী হিলমি তাদের পরামর্শ দেন : প্যারিস, বার্লিন বা মস্কো যাও। উচ্চশিক্ষা না-ও। কবিতাও চলতে থাকুক।

সেই মাফিক, কাস্পিয়ান বর্ডার ‘বলু’ থেকে তারা এমন কৌশলে জঙ্গুলদায়ের দিকে রওনা হন, দেখে মনে হয় : ওস্তাদের কাছে যাচ্ছেন তালিম নিতে। ট্রাবজোন পার হয়ে দুই বন্ধু বাটুম পৌঁছান ১৯২১-এর সেপ্টেম্বরে। কমিউনিস্ট ইউনিভার্সিটি অব ইস্টার্ন লেবারার্সের সাহিত্য শাখায় ভর্তি হন দু’জন।

অচিরেই নাজিম ভক্ত হয়ে ওঠেন এক বেনামী কবির মুক্ত ছন্দে। তখনো রুশ ভাষা ভালো বুঝতেন না তিনি। তবু ‘ইজভেস্তিয়া’য় প্রকাশিত ছন্দহীন কবিতার বেনামী কবির নাম তিনি অচিরেই জানতে পারলেন মায়াকোভস্কি। তার অনুকরণে লিখেও ফেললেন মুক্ত ছন্দের শতাধিক তুর্কি কবিতা।

১৯২৩-এ গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর নাজিম দেশে ফিরলেন গোপনে। কারণ গোপনেই তিনি দেশত্যাগ করেছিলেন। তদ্দিনে তার অনেক কবিতা প্রকাশিত হতে শুরু করেছে ইয়েনি-হায়াত এবং আইদিনলিক-এ। জনপ্রিয়তার কারণেই পুলিশি নজরদারিতে পড়েন তিনি। টের পেয়ে, ইজমির সরে যান নাজিম নিজস্ব প্রেস প্রতিষ্ঠা করবেন বলে। সেই সময়ে, শেখ সাইয়েদের বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ায় ব্যাপক ধরপাকড় চলছিল। সেই স্রোতে, আইদিনলিকসহ অনেক পত্রিকা বাজেয়াপ্ত হয়ে যায় এবং তারই সূত্র ধরে, ১ মে ১৯২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত সব লেখকের বিরুদ্ধে আম গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। এই গণবিচারে আংকারার কোর্ট নাজিমকে ১৫ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন।

ভয় পেয়ে নাজিম ইস্তাম্বুল হয়ে আবার সোভিয়েত ইউনিয়নে পাড়ি দেন।

ইতিমধ্যে তুরস্ক স্বাধীনতা লাভ করায় ১৯২৫-এর শেষ দিকেই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। সুযোগটি কাজে লাগানোর জন্য দেশে ফেরার জন্য মস্কোর অ্যাসেম্বলিতে দরখাস্ত করেন নাজিম। কিন্তু তাকে পাসপোর্ট দেয়া হয় না। দীর্ঘ অপেক্ষায় হতাশ নাজিমের প্রথম বই বেরোয় আজারবাইজানের রাজধানী বাকু থেকে ১৯২৮-এ।

ক্রুদ্ধ অথচ আশাবাদী নাজিম ককেশাস বর্ডার হেঁটে আবার দেশে প্রবেশ করেন। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য, বর্ডার-পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। সাধারণ সব কয়েদিদের সাথে তাকেও এমন জেলে রাখা হয় যেখানে লেখার কালি তো দূরে থাক, আলো-হাওয়াও পৌঁছায় না। বৈধ কাগজপত্র ছাড়া বর্ডার পার হওয়ার শাস্তি মাত্র তিন দিন হলেও নাজিমকে হাজতে কাটাতে হয় ৫৯ দিন। সাহিত্যপ্রেমিক সহৃদয় বিচারক এজলাশে তার কবি পরিচয় পেয়ে শাস্তি দেয়া থেকে বিরত থাকেন। সরাসরি তাকে আংকারা পাঠানো হয়, যেখানে সব অভিযোগ একত্র করে ‘একক-বিচারের’ অধীন করা যাবে। ১৯২৮-এর ৪ অক্টোবর হাতকড়া পরানো নাজিমকে হাজির করা হয় আংকারায়।

মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদের চাপে শেষ পর্যন্ত ‘সাধারণ ক্ষমা’র আওতায় এনে নাজিমকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্ত নাজিম যোগ দেন ইস্তাম্বুলের ‘রেসিম্বলি আই’ পত্রিকায়।

তুরস্কে ৮৩৫-পঙ্ক্তি নামে তার প্রথম বই বেরোয় ১৯২৯-এর মে মাসে। একই বছর শেষ দিকে বেরোয় দ্বিতীয় কাব্য গিয়োকোন্ডা অ্যান্ড সি-ইয়া-উ। বিস্ময়কর এই কাহিনীকাব্যের নায়িকা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসা! বইয়ে তার নাম গিয়োকোন্ডা, যে কিনা প্রেমে পড়ে চীনা যুবক সি-ইয়া-উর; সে যখন ল্যুভর মিউজিয়াম পরিদর্শন করে। অদ্ভুত এই কাব্য নাজিমকে তুমুল জনপ্রিয়তা দেয়। ১৯৩০-এ স্বকণ্ঠে উচ্চারিত তার কবিতার রেকর্ড বেরোয় কলাম্বিয়া থেকে, যার ১০ হাজার কপি মাত্র বিশ দিনে শেষ হওয়ায় আবার তিনি পুলিশের ‘সুনজরে’ পড়েন।

এত কবিতা লিখলেন কোন প্রেরণায়? জানতে চাই আমি। প্রেমট্রেম ছিল না, ইয়াসমিনা?

নাজিমের প্রেম? ইয়াসমিনার কণ্ঠ কামনায় ঝলসে ওঠে। রোসো, ইয়া আফেন্দি! প্রেম যখন আনলেই তখন বলি, বড় বড় বিপ্লবীই সবচেয়ে তীব্র প্রেমিক হয়। মাও জে দংকে দেখো, দেখো চে গুয়েভারা বা কার্ল মার্কসকে। নাজিমও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না।

তাই? আমি খানিক তীর্যক কণ্ঠে বলি, তুর্কি মেয়েরা কবিতার এত প্রেরণাদায়ী? এত ভক্ত?

কবিদের আমরা বেশি ভালোবাসলে তোমার আপত্তি আছে?

আনোয়ার হেসে আমার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল, সারোয়ারের জন্য না হয় ওটাই বিস্তারিত বলো, ইয়াসমিনা।

ইয়াসমিনা দুই হাত মাথার পেছনে নিয়ে আড়মোড়া ভাঙল। মনে হলো, আধুনিক তুরস্ক তার সোনাদানা সব দেখিয়ে দিতে উদগ্রীব। এতই যখন ইচ্ছে, শোনো তাহলেÑ

আটাশ বছর বয়সে নাজিম মুনিবভির বার্ককে বিয়ে করেন। এটি ছিল তার দ্বিতীয় বিয়ে। দ্বিতীয় না বলে তৃতীয় বলাই বোধ হয় ভালো। যা হোক, নাজিমের প্রথম স্ত্রীর নাম নুজহাত হানুম। রাশিয়ায়ই তাদের পরিচয় প্রেম ও প্রণয়। নাজিমের বিয়ে আর প্রেম নিয়ে এত মজার ঘটনা আছে যা শুনলে তোমার বিশ্বাসই হবে না, যে তুরস্কের এই সবচেয়ে বিপ্লবী কবি ব্যক্তিগত জীবনে এত রোমান্টিক ছিলেন। অবশ্য এর কারণও আছে। যৌবনের মূল্যবান ১৭টি বছর যাকে জেলেই কাটাতে হয়, তার পক্ষে সময় অপচয় করা সম্ভবও ছিল না।

তৃতীয় বিয়ের ব্যাপারটি কী? আমি মৃদুকণ্ঠে জানতে চাই।

ডাক্তার লিনা। জীবনের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের ফাঁকে মস্কোতে কিছুকালের জন্য তারা একত্র ছিলেন। এ বিয়ের খবর গোপন ছিল অনেক দিন।

তার মানে, নাজিমের কবিতায় যে দুই নারী বারবার ফিরে এসেছে, এরা তারা নন?

তুমি কি ডাক্তার না গবেষক?

না না, ও শুধু পড়ে। আনোয়ার দ্রুত আমাকে উদ্ধার করে।

আচ্ছা, যা-ই হোক। শোনো সারোয়ার, তার তৃতীয় বিয়ে হয় পিরাই আল্টিনাগ্লুর সাথে ১৯৩৫-এ।

তৃতীয় না চতুর্থ?

ইয়াসমিনা তীব্র সন্দেহের চোখে তাকায় আমার দিকে। তোমরা দুই বন্ধু বসে স্ত্রীদের হিসেব মেলাও, আমি যাই।

গটগট করে বেরিয়ে গেল ইয়াসমিনা।

আনোয়ারের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত মান ভাঙল রূপসীর। আধা ঘণ্টা পরে আবার এসে বসল আমাদের পাশে। লেসবস দ্বীপ ছাড়িয়ে সিন্দবাদ ততক্ষণে চলে এসেছে ইজমিরের অনেক কাছে।

...উনিশ শ’ পঞ্চাশে নাজিম পোলিশ নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন এবং সোফিয়া ওয়ারশ ও মস্কোয় বসবাস শুরু করেন। মস্কোতে তিনি প্রেমে পড়েন ভেরা তুুলিয়াকোভার। এত তীব্র ছিল সেই প্রেম যা বর্ণনার অতীত। ভেরার বাবার চেয়েও ছয় বছরের বড় নাজিম লিখেছেন তার কবিতায়, তুমি ছাড়া প্যারিস, যেন আইফেল টাওয়ার ছাড়া নগরী; পিরামিডবিহীন কায়রো!

ওয়াও! চমৎকার তো!

স্টালিন মারা গেলে ক্রুশ্চেভ ক্ষমতায় আসেন এ সময়ে। বিস্ময়কর নানা পরিবর্তন এবং অত্যাচারে অতিষ্ঠ নাজিম অসুস্থ হয়ে বারভিকা স্যানেটারিয়ামে ভর্তি হন। সেখানে তিনি প্রেমে পড়েন ক্লিনিকের ডাক্তার গ্যালিনা কলেসনিকোভার। বেশ কিছুকাল তারা লিভটুগেদার করেন। কিন্তু তুমি যে কবিতার নারীদের কথা জানতে চাইছিলে, তারা ছিল ওই দু’জনইÑ মুনিবভির বার্ক আর পিরাই আল্টিনাগ্লু।

কিভাবে?

নাজিমের জীবনটা অদ্ভুতই বলতে হয়। যে নেতার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে তিনি বিপ্লবী হয়েছিলেন, তার জীবিতকালে নাজিম এক দিনের জন্যও জেলের বাইরে আসতে পারেননি। মস্কোও তাকে চরম হতাশ করেছে। এক দিকে সাম্য-মুক্তির সেøাগান, আরেক দিকে সুপার পাওয়ার হওয়ার নিরন্তর চেষ্টার মধ্যে অবশ্যই প্রবল স্ববিরোধিতা ছিল।

ডাক্তার গ্যালিনা কলেসনিকোভার। বেশ কিছুকাল তারা লিভটুগেদার করেন। কিন্তু তুমি যে কবিতার নারীদের কথা জানতে চাইছিলে, তারা ছিল ওই দু’জনইÑ মুনিবভির বার্ক আর পিরাই আল্টিনাগলু।

কিভাবে?

নাজিমের জীবনটা অদ্ভুতই বলতে হয়। যে নেতার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে তিনি বিপ্লবী হয়েছিলেন, তার জীবিতকালে নাজিম এক দিনের জন্যও জেলের বাইরে আসতে পারেননি। মস্কোও তাকে চরম হতাশ করেছে। এক দিকে সাম্য-মুক্তির স্লোগান, আরেক দিকে সুপার পাওয়ার হওয়ার নিরন্তর চেষ্টার মধ্যে অবশ্যই প্রচণ্ড স্ববিরোধিতা ছিল।

যদিও ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল তাকে নবজীবনের সহায়তা দিয়েছিল, কিন্তু কার্যত তা-ও ছিল কোল্ড-ওয়ারেরই লেফট-সাইড! পুঁজিবাদ বিরোধিতার নামে ক্রমাগত মার্কিন-বিরোধিতা আর স্টালিনের লৌহনিগড়ের কোনোটাই পছন্দ করছিলেন না তিনি।

তাই বুঝি প্রেম করছিলেন অত?

ইয়াসমিনা ক্ষিপ্ত কণ্ঠে প্রতিবাদ করতে গেলে আনোয়ার দুই হাত ধরে আবার তাকে বসিয়ে দিলো। প্রেমট্রেম দরকার নেই, ইয়া হাবিবÑ তার কবিতার কথা বলো।

আমার দিকে সে এমনভাবে তাকালো যেন আমি মেষশাবক আর সে বাঘিনী। হেসে আমি নজর দিলাম বার্সার দিকে। কিন্তু কুয়াশার ঘন পর্দায় কি কাক্সিক্ষত কিছু দেখা যায়?

১৯৩৮ থেকে ৫১ পর্যন্ত কারাগারে কাটানো নাজিম তত দিনে বিশ্বসাহিত্যের পরিচিত নাম। জেলখানার চিঠি, রাত ৩টার কবিতা, পিরাইয়ের জন্য রুবাঈ, আমার দেশের মানুষের মানচিত্র ইত্যাদি অনূদিত হয়েছে পূর্ব ও পশ্চিমের প্রায় সব দেশে। ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল তাকে প্রথমে ডিরেক্টর পরে সভাপতি নির্বাচিত করে। জাপান থেকে কিউবা পর্যন্ত বহু দেশ তিনি ভ্রমণ করেন। তার ডাকে সাড়া দিয়ে বিশ্বশান্তির পক্ষে সমতা প্রকাশ করেন জ্যাঁ পল সার্ত্রে, পাবলো নেরুদা, দিয়েগো রিভেরা, আর্নল্ড জোয়েগ ও ফ্রেডরিক জুলিয়ো কুরি। সুইডেন থেকে মিসর পর্যন্ত ছড়িয়ে যায় তার নাম। তার একটি নতুন লেখার দাম ওঠে পাঁচ হাজার পাউন্ড। কিন্তু অর্থের চেয়ে বড় ছিল তার কাছে প্রেম। মানুষের ভালোবাসা।

আবার প্রেম?

নয়তো কী? জীবন কি প্রেমের বাইরে হতে পারে? বিশেষত কবিদের জীবন!

আমি ইয়াসমিনাকে খোঁচা না দিয়ে পারলাম না। তাহলে তো কামালেরও প্রেম থাকার কথা অনেকগুলো। তা কি আছে? বরং আমি যতটুকু জানি- এই বিশ্বপ্রেমিককেও তিনি প্রশ্রয় দেননি। তাই না ইয়াসমিনা?

ইয়াসমিনা খানিক চুপ করে রইলো। তার বিস্মিত ও উদাস চোখে এখন প্রশান্তি ভর করেছে। এতক্ষণে সে বুঝতেও পেরেছে যে আমি তাকে উত্তেজিত করার জন্যই খোঁচাচ্ছিলাম। স্নিগ্ধ হেসে উঠল সে- কামাল? কামাল আমার সবচেয়ে বড় কবি। তার প্রেম কবিতার চেয়ে, ধর্মের চেয়ে, দেশের চেয়েও বড়। তুমি কি জাজা গাবরের নাম শুনেছ?

হলিউডের অভিনেত্রী?

জি-হ্যাঁ। এখন যার বয়স পঁচানব্বই পার হয়ে গেছে। তিনিই সেই সৌভাগ্যবতী, কামালকে যিনি পেয়েছেন।

একা তিনি?

আর কেউ তো মুখ খোলেনি।

কেন, ইয়াসমীনা, ভয়ে?

হলোই বা। এত বড় বিশ্বনেতাকে নিয়ে তো আর ছেলেখেলা চলে না। আর জানোই তো, কামাল না থাকলে আমাদের এই দেশ আর এর সব সম্পদকে ওই সভ্য ইউরোপীয়রাই অসভ্যের মতো ছিঁড়েখুঁড়ে খেতো। নিজেদের দিকে একবার তাকিয়ে বলো- পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা ভারতকে কি আসলে ‘স্বাধীন’? নামেই তোমরা ‘মুক্ত’- আসলে বন্দী হয়ে আছো হাজার-শৃঙ্খলে।

এবার আমার মুখটা আনমনে নিচু হয়ে এলো। ফিসফিস করে বললাম, দুনিয়ায় কে বন্দী নয়-রে ভাই? মুক্তি কি আর মুক্ত কে-- তাই বুঝতে তো জীবন পার হয়ে গেল--!

আনোয়ার হঠাৎ বলে উঠল- দেখ দেখ, বার্সা এসে গেছে। ‘কই-কোথায়-?’ বলতে বলতে আমরা ঝুঁকে পড়লাম জাহাজের রেলিংয়ে।

কিন্তু আনোয়ারের কৌশল দীর্ঘস্থায়ী হলো না। সমুদ্রের-জাহাজ তো গাড়ির চেয়েও মন্থর। প্লেনের গতি সে কোথায় পাবে?

ফিরে এসে তাই আবার বললাম, ওসব ছাড়ো, ইয়াসমিনা। বলো, কামাল কেন নাজিমের প্রতি সদয় হলেন না?

এটা আমিও অনেক ভেবেছি- উদাস কণ্ঠে বলল ইয়াসমিনা। হয়তো এটাই ঠিক, সারোয়ার। শেখ সাইয়েদের অনুসারীরা এখনো তুরস্কে আছে; আছে নাজিমের অন্ধভক্তরাও। আমার ধারণা, কামালের মধ্যে ঐশ্বরিক কিছু ছিল, যা দিয়ে তিনি অকল্যাণ থেকে কল্যাণকে ফারাক করতে পারতেন। হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন- সমাজতন্ত্রও শেষ পর্যন্ত টেকসই নয়। হয়তো বুঝেই তিনি কামালের এক্সট্রিম মতবাদকে সমর্থন করেননি।

হয়ত-!

কেন, তুমি জানো না, নাজিম এমনকি রাশিয়ারও সমর্থন পাননি জীবদ্দশায়? মৃত্যুর মাত্র দেড় বছর আগে, ১৯৬১তে নাজিমকে পাসপোর্ট দেয় রাশিয়া।

তার আগে?

তার আগে ১৯৫১ তে আমাদের সরকার তার নাগরিকত্ব বাতিল করে।

কেন?

কারণ, তিনি টের পেয়েছিলেন, তাকে আবার বন্দী করা হবে। সুতরাং রিস্ক নিতে চাননি আর। বাড়ির বাইরে পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকলে অবশ্য সব কবিই পালিয়ে যেতে চাইবে, তাই না সারোয়ার?

আমি হেসে বললাম, সেটা নির্ভর করে পুলিশ সদস্যরা নারী না পুরুষ, তার ওপর। কিংবা তারা কি ইয়াসমিনা না বোরকাওয়ালি-- তার ওপরেও।

ভালো বলেছো- মনের মেঘ ঝেঁটিয়ে বিদায় করে জোরগলায় হেসে উঠল ইয়াসমিনা।

আনোয়ার বলল, নাজিমের লেখা আসলেই সীমা-ছাড়ানো বিপজ্জনক। রাষ্ট্র তো সবসময়ই বাড়াবাড়িকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। নাজিম বিশ্বপ্রেমিক হলেও অতিশয় প্রান্তিকীয় মতবাদ প্রকাশ করেছেন সব সময়। তাই নিজের মতামত হওয়া সত্ত্বেও- এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নও তার ব্যাপারে সদা-সতর্ক ছিল।

ইয়াসমীনা যোগ করণ, ১৯৫১-তে তার কোনো পাসপোর্ট ছিল না। সে কারণে, সোভিয়েত বলয়ভুক্ত দেশে যেয়েও তিনি বিপদে পড়তেন। রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা তো ভাববাদে চলতে পারেন না। শেষ পর্যন্ত তার পোলিশ বন্ধুরা কী করল, শোনো- তার পূর্বপুরুষ পোলিশ ছিল, এমন প্রচারণা চালিয়ে তার নামে পাসপোর্ট ইস্যু করায় পোল্যান্ড থেকে-- যেখানে তার নাম লেখা হয় : নাজিম হিকমাত ব্রোজেনেস্কি।

বুঝলাম, ইয়াসমিনা ভালোই প্রেমিকা তার। আবার আমার মাথায় দুষ্টুমি ভর করল। বললাম, তো ইয়াসমিনা- রুশরা তাকে এত-সব প্রেমিকা সাপ্লাই দিলো, আর তোমরা শুধু দিলে শৃঙ্খল? কি খারাপ তোমরা! সে যাই হোক, কার বিনিময়ে তিনি এত কাব্য দিলেন?

আবার! কপট বিস্ময়ে ভুরু কুঁচকালো ইয়াসমিনা। শোনো পর্যটক, রুশরা জাতি হিসেবে বরাবরই দুঃখী ও নির্যাতিত। প্রকৃতিও তাদের প্রতি নির্মম। সূর্যের আলোর সাথেই ওদের কত দূরত্ব দেখো। এমন জাতির নারীরা বেশি উষ্ণ, বেশি প্রেমময় হবেই। মদ তো ওরা এমনিতে খায় না, বাঁচার জন্য খেতে হয় বলে খায়। দুনিয়ার এমন কোনো সমুদ্রের নাম বলো তো, যার জেলেরা হাঙরের তেলে গা গরম করে না।

সত্যিই আমি লা-জওয়াব। হাতজোড় করে বললাম, ক্ষমা করো বন্ধু। মাফ চাই। অনেক দুষ্টুমি হয়েছে, এবার ছাড় দাও।

ম্লান হেসে বলল সে- নাজিমও একবার, মাত্র একবার নিজের দেশে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬৩-র নিউমোনিয়া তাকে সে সুযোগ দেয়নি। মৃত্যুর আগে লিখেছেন “কবরের উত্তরাধিকার” নামের কবিতা। কৌশলে মুক্ত করে মুনিবভিরকে নিয়ে গেছেন নিজের কাছে। প্রাক্তন প্রেমিকা ডা. গ্যালিনাকে দিয়েছেন স্থাবর সম্পত্তির সবটুকু। মস্কোর একটিমাত্র ফ্ল্যাটে ভেরা আর ‘কবিতা’কে বুকে জড়িয়েই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

শেষ জীবনটা বেশ কষ্টেই কেটেছে তাহলে?

হয়তো; হয়তো নয়। কবিদের কষ্ট কি দুনিয়ার সাথে সম্পৃক্ত? তুমিই বলো?

আমি নির্বাক হয়ে গেলাম তার প্রশ্নে। সত্যিই তো তাই। কত রাজা-মহারাজা ভোগের সাগরে ভেসে যান কিন্তু কিছুই দিয়ে যান না পৃথিবীকে। কেউ রেখে যান শুধুই রক্ত আর যাতনার ইতিহাস। প্রতিতুলনায়, কবিরা কত অল্পেই সন্তুষ্ট। যদিও তাদের রেখে যাওয়া সৃষ্টিতে মানুষ আনন্দ ও তৃপ্তি খুঁজে পায় যুগের পর যুগ; শতাব্দীর পর শতাব্দী।

সুতরাং সব রাজনীতির বেড়া ডিঙিয়ে আমরা নাজিমের প্রেমিকা। আমাদের আত্মায় ধ্বনিত হবে তারই গান- যত দিন আমাদের হৃদয়ে ভালোবাসা থাকবে।

আর কামাল? তাকে কোথায় রাখবে?

তাকে রাখতে হবে না। তিনিই আমাদের রেখে গেছেন। যে নেতা মাতৃভূমিকে দেন স্বাধীনতা, সাফল্য আর সাহস-- তার জন্য কোনো গানই যথেষ্ট নয়। কোনো প্রেমই তার বিনিময় হতে পারে না। নাজিমের কবিতার মতো করে বলি- আমার প্রাণটুকু খোদার জন্য আর প্রেমটুকু তোমার।

আমি বুঝতে পারলাম না, এই ‘তুমি’ বলতে ইয়াসমীনা আসলে কাকে বোঝালো?

শুরুর সেই কৌতূহল চাপতে না পেরে বলেই ফেললাম- আর এই লেসবস? বলেছিলে যে এখানেই ঘটনার সমাপ্তি? সেটা কী?

সে-ই তো প্রেমিকার শেষ ইতিহাস।

ইয়াসমিনা হাসতে হাসতে বলল, ইতালির মেয়ে জায়স লুসু প্রেমে পড়েছিল নাজিমের; জাজা গাবর যেমন জড়িয়েছিল কামালের জালে। লুসু ঘনিষ্ঠ হয়েই বুঝতে পারল- নাজিমের দেহই পড়ে আছে মস্কো বা ওয়ারশতে, মন আসলে ইস্তাম্বুলে। কারণ খুঁজতে যেয়ে সে চিনলে মুনিবভির ও তার সন্তান মেহসমত (মোহাম্মদ)-কে। তাই সে এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে নাজিমের প্রতি তার প্রেমকে অমর করে যায়। তার আরেক-ফিয়াঁসে ধনকুবের কার্লোকে নিয়ে বেড়াতে যায় তুরস্কের আইভালিক বন্দরে। দেদার টাকা উড়ানোর ফাঁকে লুমু ইস্তাম্বুল যেয়ে মুনিবভিরদের তার সাথে আসতে রাজি করায়। মোহাম্মদকে নিয়ে তার মা ইয়টে উঠতেই টের পায় পুলিশ। তাদের হাত থেকে বাঁচতে কার্লো অন্ধের মতো ইয়ট চালায়। লেসবসের কিনারে এসে উল্টে যায় ইয়ট।

তারপর?

তারপর আর কী? গল্পের মতো সমাপ্তি টানে ইয়াসমিনা। বহু কষ্টে মুনিবভির ও মোহাম্মদকে নিয়ে প্যারিসে হাজির হয় লুসু। বন্দী ও পলাতক কবির জীবনে ফিরিয়ে দেয় বেঁচে থাকার আনন্দ--নিজের গোপন প্রেমের বিনিময়ে।

তারপর?

তার আর পর নেই। বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় ইয়াসমিনা- এক দিকে ক্রুশ্চেভ তার নাটক ও কবিতার প্রকাশ বন্ধ করে দিয়ে তার হৃদয় ভেঙ্গে দেয়, অন্য দিকে জীবন তাকে বলে: ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই, পাখা মেলো পাখি--!

মানে?

মানে, এর মাত্র ছয় মাস পরে আমাদেরকে, মানে তার সব প্রেমিকাদেরকে, তোমাদের মতো বেরসিকদের হাতে তুলে দিয়ে পালালেন সেই জগতে-- যাতে তার ‘বিশ্বাস’ নেই বলে তিনি সারা জীবন গর্ব করতেন।

মানে মৃত্যু?

আর কী? দেখো সারোয়ার, তোমাদের এই একটি ব্যাপার আমার বুঝে আসে না। গল্প-গান-কাব্য নিয়ে ফখর করো, আপত্তি নেই-- কিন্তু জীবন নিয়ে টানাটানি করো কেন? ছাড়ো না ওই একটি ব্যাপার ঈশ্বরের ওপর।

বলতে বলতে সে হেঁটে গেল সুইমিং পুলে। আরআধুনিক তুরস্কের খ্যাতি যদি কামাল পাশার জন্য হয়ে থাকে, বলা বাহুল্য, তুর্কি সাহিত্যের পরিচিতি নাজিম হিকমাতের জন্য। ‘পদাতিক’-এর কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কারণে বাঙালি পাঠকের কাছে তার খানিকটা-পরিচয় প্রকাশিত হলেও নাজিমের আসল পরিচয় বহুমাত্রিক। মুক্তিকামী মানুষের মঙ্গল-বার্তাবাহক তিনি- যিনি নিজেকে বলতেন ‘আত্মার প্রকৌশলী’।

মোস্তাফা কামাল যে বছর কমিশন লাভ করেন, মানে ১৯০২-এ, সে বছরই নাজিমের জন্ম। জনপ্রশাসক হিকমত বে এবং চিত্রশিল্পী আয়েশা দাশালিলার সন্তান তিনি। কিন্তু দু’জনের কারোরই বৈষয়িক প্রজ্ঞা বা চারিত্রিক স্থিরতা পাননি নাজিম। অস্থিরতা ও অ্যাডভেঞ্চার তাকে এতটাই তাড়িয়ে বেড়িয়েছে যে তার জীবনীকারেরা বলতে বাধ্য হয়েছেন, পুঁজিবাদ হলো সেই আহত-কেউটে, যে বারবার ফণা তুলেছে নাজিমের দিকে, আর নাজিমের বন্দুক থেকে বেরিয়েছে কবিতার-বুলেট। মৃত্যুর প্রায় অর্ধশতাব্দী পরও নাজিম হিকমাত বহুল পঠিত, আলোচিত ও বিতর্কিত। বরং বলা যায় ১৯৬৩ তে তার মৃত্যুর পরে তার পাঠকপ্রিয়তা বেড়ে কয়েক শ গুণ হয়েছে। আরো আশ্চর্য যে, পৃথিবীর কোনো কবির ভাগ্যেই এত নিষেধাজ্ঞা, অবরোধ আর সেন্সর জোটেনি-- যা জুটেছিল নাজিমের কপালে। অথচ সেই একই সেলোনাইকায় জন্মগ্রহণকারী মোস্তফা কামালের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত এই কবি তার-নেতা এবং তার-দেশের কাছ থেকেও সহানুভূতি পেয়েছেন খুবই কম।

ইয়াসমিনার কণ্ঠ লজ্জায় ম্রিয়মাণ। আনোয়ার আমাকে আগেই বলেছিল, মোস্তফা কামালের মর্যাদা তুর্কিদের কাছে প্রায় দেবতার মতো। কিন্তু আমি সেসব গ্রাহ্য না করেই জানতে চাই : লেসবস দ্বীপেই কি নাজিমের সাথে কামাল পাশার দেখা হয়েছিল?

না, লেসবসে নয়। মোস্তফা কামালের সাথে নাজিমের দেখা হয় আংকারায়। তবে তার এই একমাত্র সাক্ষাৎকারের ঘটনাটি শুরু হয়েছিল লেসবসে এবং শেষও হয়েছিল এখানে। মানে তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে ‘হাইজাক’ করে তার কাছে নেয়ার মাধ্যমে।

অদ্ভুত! আমার কৌতূহল লাফিয়ে ওঠে। বলো সে গল্পটা, ইয়াসমিনা।

গল্প নয়, সত্যি।

ওকে, তাই সই। সেই সত্যিই শোনাও।

তখনও মোস্তফা কামালের ‘গ্র্যান্ড অ্যাসেম্বলি’ আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা পায়নি। ১৯২০-এ ইউরোপীয় রাক্ষসদের সামনে ইস্তাম্বুল যখন মেষশাবকের মতো কাঁপছিল, ‘দৈনিক আলিমদার’ আয়োজন করেছিল “দেশপ্রেমের কবিতা” প্রতিযোগিতা। উঠতি-কবি ফারুক নাফিস, ইউসুফ জিয়া ও অরহান সেইফির বিচারে শ্রেষ্ঠ কবি নির্বাচিত হন নাজিম হিকমত। বন্ধু আলা নুরুদ্দীন রানার-আপ। চিন্তা চেতনায় তখনই এরা চরম প্রগতিশীল। মোস্তফা কামালের কাছে পৌঁছার জন্য অস্ত্র বয়ে নিয়ে যাওয়া শিপ ‘ইয়েনি দুনিয়া’য় ছদ্মবেশে উঠে বসেন দুই কবি। লেসবস থেকে। বাধ্য হয় চোরাচালানিরা তাদেরকেও মালামালের সাথে আংকারায় পৌঁছে দেয়; কারণ, ফিরে যাওয়ার রাস্তা নেই। কামালের ‘গ্র্যান্ড অ্যাসেম্বলি’ বা সিক্রেট কাউন্সিল ঘটনা জানতে পেরে গোপনীয়তা ফাঁসের ভয়ে হতভম্ব হয়ে যায়।

যারা ফয়সালার দায়িত্বে ছিল, বাধ্য হয়ে তারা নির্দেশ দেয়Ñ যদি তোমরা এমন কবিতা রচনা করে দেখাতে পারো যা ইস্তাম্বুলের তরুণদের ঘুম ভাঙাতে পারে, তাহলে তোমাদের শাস্তি হবে না। তাদেও নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল, ব্যর্থ হয়ে ছেলে দু’টি ঘরে ফিরে যাবে।

কিন্তু তিন দিন পরে তিন পৃষ্ঠার একটি কবিতা উপস্থাপন করে দুই বন্ধু। সাথে সাথেই কবিতাটি কাউন্সিলরদের পছন্দ হয়ে যায়। ১৯২১-এর মার্চে কবিতাটি ১০ হাজার কপি ছাপা হয় এবং আংকারা ও ইস্তাম্বুলে ঝড় তোলে।

আমার মনে পড়ে গেল, নজরুলের ‘বিদ্রোহী’র কথা। সেটিও তো মনে হয় ওই সময় ছাপা; একই বছর!

এই ঝড় এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে ‘কাউন্সিল’ জরুরি সভায় বসতে বাধ্য হয়। আলোচ্য বিষয় : কী করে এই উত্থিত তরুণ-আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ডাইরেক্টর অভ প্রেস মুহিত্তিন বার্গেনকে মৃদু তিরস্কারও করা হয় ‘অর্বাচীন’ প্রকাশনার জন্য। কিন্তু অমঙ্গলের মধ্যে যেমন মঙ্গল থাকে, তেমনি এ ঘটনার মধ্যেও ছিল কল্যাণ। দুই তরুণকে হাজির করা হয় জেনারেল মোস্তফা কামালের সামনে।

কামাল তাদের সাথে আলোচনা শুরু করেন।

নুরুদ্দিন তার বর্ণনায় লিখেছেন, ‘মোস্তফা কামাল বললেন : কিছু কিছু তরুণ তাদের চটকদার পঙ্ক্তিতে তরুণীদের মোহিত করতে চায়। কিন্তু আমরা চাই সেই কবিতা, যার লক্ষ্য মহৎ ও সুদূরপ্রসারী। কৃশকায় হাজার কবিতার চেয়ে একটি সবল কবিতা হতে পারে সূর্যের মতো উজ্জ্বল...। হঠাৎ এক জরুরি টেলিগ্রাম আসায় কামাল উঠে যেতে বাধ্য হন এবং ‘জাতীয় বৃহত্তর প্রয়োজন’ তাকে ব্যস্ত করে তোলে। আমাদের আর কখনো দেখা হয়নি।’

দুই তরুণকে স্কুল-শিক্ষকের চাকরি দেয়া হয়। কিন্তু শিগগিরই তারা ধর্মনেতা ও প্রাচীনপন্থীদের রোষানলে পড়েন। কারণ তারা রুমি টুপির বদলে ফার টুপি পরছিলেন, আর লিখছিলেন জাগরণমূলক কবিতা। ফলে আবারো দ্বন্দ্ব কোর্টে গড়ায়। ভাগ্যক্রমে ক্রিমিনাল কোর্টের ডেপুটি জাস্টিস জিয়া হিলমির কারণে আইনি শাস্তি থেকে বেঁচে যান তারা। কিন্তু মোল্লারা পিছু ছাড়ে না। শেষে সাহিত্যপ্রেমী হিলমি তাদের পরামর্শ দেন : প্যারিস, বার্লিন বা মস্কো যাও। উচ্চশিক্ষা না-ও। কবিতাও চলতে থাকুক।

সেই মাফিক, কাস্পিয়ান বর্ডার ‘বলু’ থেকে তারা এমন কৌশলে জঙ্গুলদায়ের দিকে রওনা হন, দেখে মনে হয় : ওস্তাদের কাছে যাচ্ছেন তালিম নিতে। ট্রাবজোন পার হয়ে দুই বন্ধু বাটুম পৌঁছান ১৯২১-এর সেপ্টেম্বরে। কমিউনিস্ট ইউনিভার্সিটি অব ইস্টার্ন লেবারার্সের সাহিত্য শাখায় ভর্তি হন দু’জন।

অচিরেই নাজিম ভক্ত হয়ে ওঠেন এক বেনামী কবির মুক্ত ছন্দে। তখনো রুশ ভাষা ভালো বুঝতেন না তিনি। তবু ‘ইজভেস্তিয়া’য় প্রকাশিত ছন্দহীন কবিতার বেনামী কবির নাম তিনি অচিরেই জানতে পারলেন মায়াকোভস্কি। তার অনুকরণে লিখেও ফেললেন মুক্ত ছন্দের শতাধিক তুর্কি কবিতা।

১৯২৩-এ গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর নাজিম দেশে ফিরলেন গোপনে। কারণ গোপনেই তিনি দেশত্যাগ করেছিলেন। তদ্দিনে তার অনেক কবিতা প্রকাশিত হতে শুরু করেছে ইয়েনি-হায়াত এবং আইদিনলিক-এ। জনপ্রিয়তার কারণেই পুলিশি নজরদারিতে পড়েন তিনি। টের পেয়ে, ইজমির সরে যান নাজিম নিজস্ব প্রেস প্রতিষ্ঠা করবেন বলে। সেই সময়ে, শেখ সাইয়েদের বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ায় ব্যাপক ধরপাকড় চলছিল। সেই স্রোতে, আইদিনলিকসহ অনেক পত্রিকা বাজেয়াপ্ত হয়ে যায় এবং তারই সূত্র ধরে, ১ মে ১৯২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত সব লেখকের বিরুদ্ধে আম গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। এই গণবিচারে আংকারার কোর্ট নাজিমকে ১৫ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন।

ভয় পেয়ে নাজিম ইস্তাম্বুল হয়ে আবার সোভিয়েত ইউনিয়নে পাড়ি দেন।

ইতিমধ্যে তুরস্ক স্বাধীনতা লাভ করায় ১৯২৫-এর শেষ দিকেই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। সুযোগটি কাজে লাগানোর জন্য দেশে ফেরার জন্য মস্কোর অ্যাসেম্বলিতে দরখাস্ত করেন নাজিম। কিন্তু তাকে পাসপোর্ট দেয়া হয় না। দীর্ঘ অপেক্ষায় হতাশ নাজিমের প্রথম বই বেরোয় আজারবাইজানের রাজধানী বাকু থেকে ১৯২৮-এ।

ক্রুদ্ধ অথচ আশাবাদী নাজিম ককেশাস বর্ডার হেঁটে আবার দেশে প্রবেশ করেন। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য, বর্ডার-পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। সাধারণ সব কয়েদিদের সাথে তাকেও এমন জেলে রাখা হয় যেখানে লেখার কালি তো দূরে থাক, আলো-হাওয়াও পৌঁছায় না। বৈধ কাগজপত্র ছাড়া বর্ডার পার হওয়ার শাস্তি মাত্র তিন দিন হলেও নাজিমকে হাজতে কাটাতে হয় ৫৯ দিন। সাহিত্যপ্রেমিক সহৃদয় বিচারক এজলাশে তার কবি পরিচয় পেয়ে শাস্তি দেয়া থেকে বিরত থাকেন। সরাসরি তাকে আংকারা পাঠানো হয়, যেখানে সব অভিযোগ একত্র করে ‘একক-বিচারের’ অধীন করা যাবে। ১৯২৮-এর ৪ অক্টোবর হাতকড়া পরানো নাজিমকে হাজির করা হয় আংকারায়।

মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদের চাপে শেষ পর্যন্ত ‘সাধারণ ক্ষমা’র আওতায় এনে নাজিমকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্ত নাজিম যোগ দেন ইস্তাম্বুলের ‘রেসিম্বলি আই’ পত্রিকায়।

তুরস্কে ৮৩৫-পঙ্ক্তি নামে তার প্রথম বই বেরোয় ১৯২৯-এর মে মাসে। একই বছর শেষ দিকে বেরোয় দ্বিতীয় কাব্য গিয়োকোন্ডা অ্যান্ড সি-ইয়া-উ। বিস্ময়কর এই কাহিনীকাব্যের নায়িকা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসা! বইয়ে তার নাম গিয়োকোন্ডা, যে কিনা প্রেমে পড়ে চীনা যুবক সি-ইয়া-উর; সে যখন ল্যুভর মিউজিয়াম পরিদর্শন করে। অদ্ভুত এই কাব্য নাজিমকে তুমুল জনপ্রিয়তা দেয়। ১৯৩০-এ স্বকণ্ঠে উচ্চারিত তার কবিতার রেকর্ড বেরোয় কলাম্বিয়া থেকে, যার ১০ হাজার কপি মাত্র বিশ দিনে শেষ হওয়ায় আবার তিনি পুলিশের ‘সুনজরে’ পড়েন।

এত কবিতা লিখলেন কোন প্রেরণায়? জানতে চাই আমি। প্রেমট্রেম ছিল না, ইয়াসমিনা?

নাজিমের প্রেম? ইয়াসমিনার কণ্ঠ কামনায় ঝলসে ওঠে। রোসো, ইয়া আফেন্দি! প্রেম যখন আনলেই তখন বলি, বড় বড় বিপ্লবীই সবচেয়ে তীব্র প্রেমিক হয়। মাও জে দংকে দেখো, দেখো চে গুয়েভারা বা কার্ল মার্কসকে। নাজিমও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না।

তাই? আমি খানিক তীর্যক কণ্ঠে বলি, তুর্কি মেয়েরা কবিতার এত প্রেরণাদায়ী? এত ভক্ত?

কবিদের আমরা বেশি ভালোবাসলে তোমার আপত্তি আছে?

আনোয়ার হেসে আমার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল, সারোয়ারের জন্য না হয় ওটাই বিস্তারিত বলো, ইয়াসমিনা।

ইয়াসমিনা দুই হাত মাথার পেছনে নিয়ে আড়মোড়া ভাঙল। মনে হলো, আধুনিক তুরস্ক তার সোনাদানা সব দেখিয়ে দিতে উদগ্রীব। এতই যখন ইচ্ছে, শোনো তাহলেÑ

আটাশ বছর বয়সে নাজিম মুনিবভির বার্ককে বিয়ে করেন। এটি ছিল তার দ্বিতীয় বিয়ে। দ্বিতীয় না বলে তৃতীয় বলাই বোধ হয় ভালো। যা হোক, নাজিমের প্রথম স্ত্রীর নাম নুজহাত হানুম। রাশিয়ায়ই তাদের পরিচয় প্রেম ও প্রণয়। নাজিমের বিয়ে আর প্রেম নিয়ে এত মজার ঘটনা আছে যা শুনলে তোমার বিশ্বাসই হবে না, যে তুরস্কের এই সবচেয়ে বিপ্লবী কবি ব্যক্তিগত জীবনে এত রোমান্টিক ছিলেন। অবশ্য এর কারণও আছে। যৌবনের মূল্যবান ১৭টি বছর যাকে জেলেই কাটাতে হয়, তার পক্ষে সময় অপচয় করা সম্ভবও ছিল না।

তৃতীয় বিয়ের ব্যাপারটি কী? আমি মৃদুকণ্ঠে জানতে চাই।

ডাক্তার লিনা। জীবনের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের ফাঁকে মস্কোতে কিছুকালের জন্য তারা একত্র ছিলেন। এ বিয়ের খবর গোপন ছিল অনেক দিন।

তার মানে, নাজিমের কবিতায় যে দুই নারী বারবার ফিরে এসেছে, এরা তারা নন?

তুমি কি ডাক্তার না গবেষক?

না না, ও শুধু পড়ে। আনোয়ার দ্রুত আমাকে উদ্ধার করে।

আচ্ছা, যা-ই হোক। শোনো সারোয়ার, তার তৃতীয় বিয়ে হয় পিরাই আল্টিনাগ্লুর সাথে ১৯৩৫-এ।

তৃতীয় না চতুর্থ?

ইয়াসমিনা তীব্র সন্দেহের চোখে তাকায় আমার দিকে। তোমরা দুই বন্ধু বসে স্ত্রীদের হিসেব মেলাও, আমি যাই।

গটগট করে বেরিয়ে গেল ইয়াসমিনা।

আনোয়ারের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত মান ভাঙল রূপসীর। আধা ঘণ্টা পরে আবার এসে বসল আমাদের পাশে। লেসবস দ্বীপ ছাড়িয়ে সিন্দবাদ ততক্ষণে চলে এসেছে ইজমিরের অনেক কাছে।

...উনিশ শ’ পঞ্চাশে নাজিম পোলিশ নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন এবং সোফিয়া ওয়ারশ ও মস্কোয় বসবাস শুরু করেন। মস্কোতে তিনি প্রেমে পড়েন ভেরা তুুলিয়াকোভার। এত তীব্র ছিল সেই প্রেম যা বর্ণনার অতীত। ভেরার বাবার চেয়েও ছয় বছরের বড় নাজিম লিখেছেন তার কবিতায়, তুমি ছাড়া প্যারিস, যেন আইফেল টাওয়ার ছাড়া নগরী; পিরামিডবিহীন কায়রো!

ওয়াও! চমৎকার তো!

স্টালিন মারা গেলে ক্রুশ্চেভ ক্ষমতায় আসেন এ সময়ে। বিস্ময়কর নানা পরিবর্তন এবং অত্যাচারে অতিষ্ঠ নাজিম অসুস্থ হয়ে বারভিকা স্যানেটারিয়ামে ভর্তি হন। সেখানে তিনি প্রেমে পড়েন ক্লিনিকের ডাক্তার গ্যালিনা কলেসনিকোভার। বেশ কিছুকাল তারা লিভটুগেদার করেন। কিন্তু তুমি যে কবিতার নারীদের কথা জানতে চাইছিলে, তারা ছিল ওই দু’জনইÑ মুনিবভির বার্ক আর পিরাই আল্টিনাগ্লু।

কিভাবে?

নাজিমের জীবনটা অদ্ভুতই বলতে হয়। যে নেতার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে তিনি বিপ্লবী হয়েছিলেন, তার জীবিতকালে নাজিম এক দিনের জন্যও জেলের বাইরে আসতে পারেননি। মস্কোও তাকে চরম হতাশ করেছে। এক দিকে সাম্য-মুক্তির সেøাগান, আরেক দিকে সুপার পাওয়ার হওয়ার নিরন্তর চেষ্টার মধ্যে অবশ্যই প্রবল স্ববিরোধিতা ছিল।

ডাক্তার গ্যালিনা কলেসনিকোভার। বেশ কিছুকাল তারা লিভটুগেদার করেন। কিন্তু তুমি যে কবিতার নারীদের কথা জানতে চাইছিলে, তারা ছিল ওই দু’জনইÑ মুনিবভির বার্ক আর পিরাই আল্টিনাগলু।

কিভাবে?

নাজিমের জীবনটা অদ্ভুতই বলতে হয়। যে নেতার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে তিনি বিপ্লবী হয়েছিলেন, তার জীবিতকালে নাজিম এক দিনের জন্যও জেলের বাইরে আসতে পারেননি। মস্কোও তাকে চরম হতাশ করেছে। এক দিকে সাম্য-মুক্তির স্লোগান, আরেক দিকে সুপার পাওয়ার হওয়ার নিরন্তর চেষ্টার মধ্যে অবশ্যই প্রচণ্ড স্ববিরোধিতা ছিল।

যদিও ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল তাকে নবজীবনের সহায়তা দিয়েছিল, কিন্তু কার্যত তা-ও ছিল কোল্ড-ওয়ারেরই লেফট-সাইড! পুঁজিবাদ বিরোধিতার নামে ক্রমাগত মার্কিন-বিরোধিতা আর স্টালিনের লৌহনিগড়ের কোনোটাই পছন্দ করছিলেন না তিনি।

তাই বুঝি প্রেম করছিলেন অত?

ইয়াসমিনা ক্ষিপ্ত কণ্ঠে প্রতিবাদ করতে গেলে আনোয়ার দুই হাত ধরে আবার তাকে বসিয়ে দিলো। প্রেমট্রেম দরকার নেই, ইয়া হাবিবÑ তার কবিতার কথা বলো।

আমার দিকে সে এমনভাবে তাকালো যেন আমি মেষশাবক আর সে বাঘিনী। হেসে আমি নজর দিলাম বার্সার দিকে। কিন্তু কুয়াশার ঘন পর্দায় কি কাক্সিক্ষত কিছু দেখা যায়?

১৯৩৮ থেকে ৫১ পর্যন্ত কারাগারে কাটানো নাজিম তত দিনে বিশ্বসাহিত্যের পরিচিত নাম। জেলখানার চিঠি, রাত ৩টার কবিতা, পিরাইয়ের জন্য রুবাঈ, আমার দেশের মানুষের মানচিত্র ইত্যাদি অনূদিত হয়েছে পূর্ব ও পশ্চিমের প্রায় সব দেশে। ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল তাকে প্রথমে ডিরেক্টর পরে সভাপতি নির্বাচিত করে। জাপান থেকে কিউবা পর্যন্ত বহু দেশ তিনি ভ্রমণ করেন। তার ডাকে সাড়া দিয়ে বিশ্বশান্তির পক্ষে সমতা প্রকাশ করেন জ্যাঁ পল সার্ত্রে, পাবলো নেরুদা, দিয়েগো রিভেরা, আর্নল্ড জোয়েগ ও ফ্রেডরিক জুলিয়ো কুরি। সুইডেন থেকে মিসর পর্যন্ত ছড়িয়ে যায় তার নাম। তার একটি নতুন লেখার দাম ওঠে পাঁচ হাজার পাউন্ড। কিন্তু অর্থের চেয়ে বড় ছিল তার কাছে প্রেম। মানুষের ভালোবাসা।

আবার প্রেম?

নয়তো কী? জীবন কি প্রেমের বাইরে হতে পারে? বিশেষত কবিদের জীবন!

আমি ইয়াসমিনাকে খোঁচা না দিয়ে পারলাম না। তাহলে তো কামালেরও প্রেম থাকার কথা অনেকগুলো। তা কি আছে? বরং আমি যতটুকু জানি- এই বিশ্বপ্রেমিককেও তিনি প্রশ্রয় দেননি। তাই না ইয়াসমিনা?

ইয়াসমিনা খানিক চুপ করে রইলো। তার বিস্মিত ও উদাস চোখে এখন প্রশান্তি ভর করেছে। এতক্ষণে সে বুঝতেও পেরেছে যে আমি তাকে উত্তেজিত করার জন্যই খোঁচাচ্ছিলাম। স্নিগ্ধ হেসে উঠল সে- কামাল? কামাল আমার সবচেয়ে বড় কবি। তার প্রেম কবিতার চেয়ে, ধর্মের চেয়ে, দেশের চেয়েও বড়। তুমি কি জাজা গাবরের নাম শুনেছ?

হলিউডের অভিনেত্রী?

জি-হ্যাঁ। এখন যার বয়স পঁচানব্বই পার হয়ে গেছে। তিনিই সেই সৌভাগ্যবতী, কামালকে যিনি পেয়েছেন।

একা তিনি?

আর কেউ তো মুখ খোলেনি।

কেন, ইয়াসমীনা, ভয়ে?

হলোই বা। এত বড় বিশ্বনেতাকে নিয়ে তো আর ছেলেখেলা চলে না। আর জানোই তো, কামাল না থাকলে আমাদের এই দেশ আর এর সব সম্পদকে ওই সভ্য ইউরোপীয়রাই অসভ্যের মতো ছিঁড়েখুঁড়ে খেতো। নিজেদের দিকে একবার তাকিয়ে বলো- পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা ভারতকে কি আসলে ‘স্বাধীন’? নামেই তোমরা ‘মুক্ত’- আসলে বন্দী হয়ে আছো হাজার-শৃঙ্খলে।

এবার আমার মুখটা আনমনে নিচু হয়ে এলো। ফিসফিস করে বললাম, দুনিয়ায় কে বন্দী নয়-রে ভাই? মুক্তি কি আর মুক্ত কে-- তাই বুঝতে তো জীবন পার হয়ে গেল--!

আনোয়ার হঠাৎ বলে উঠল- দেখ দেখ, বার্সা এসে গেছে। ‘কই-কোথায়-?’ বলতে বলতে আমরা ঝুঁকে পড়লাম জাহাজের রেলিংয়ে।

কিন্তু আনোয়ারের কৌশল দীর্ঘস্থায়ী হলো না। সমুদ্রের-জাহাজ তো গাড়ির চেয়েও মন্থর। প্লেনের গতি সে কোথায় পাবে?

ফিরে এসে তাই আবার বললাম, ওসব ছাড়ো, ইয়াসমিনা। বলো, কামাল কেন নাজিমের প্রতি সদয় হলেন না?

এটা আমিও অনেক ভেবেছি- উদাস কণ্ঠে বলল ইয়াসমিনা। হয়তো এটাই ঠিক, সারোয়ার। শেখ সাইয়েদের অনুসারীরা এখনো তুরস্কে আছে; আছে নাজিমের অন্ধভক্তরাও। আমার ধারণা, কামালের মধ্যে ঐশ্বরিক কিছু ছিল, যা দিয়ে তিনি অকল্যাণ থেকে কল্যাণকে ফারাক করতে পারতেন। হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন- সমাজতন্ত্রও শেষ পর্যন্ত টেকসই নয়। হয়তো বুঝেই তিনি কামালের এক্সট্রিম মতবাদকে সমর্থন করেননি।

হয়ত-!

কেন, তুমি জানো না, নাজিম এমনকি রাশিয়ারও সমর্থন পাননি জীবদ্দশায়? মৃত্যুর মাত্র দেড় বছর আগে, ১৯৬১তে নাজিমকে পাসপোর্ট দেয় রাশিয়া।

তার আগে?

তার আগে ১৯৫১ তে আমাদের সরকার তার নাগরিকত্ব বাতিল করে।

কেন?

কারণ, তিনি টের পেয়েছিলেন, তাকে আবার বন্দী করা হবে। সুতরাং রিস্ক নিতে চাননি আর। বাড়ির বাইরে পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকলে অবশ্য সব কবিই পালিয়ে যেতে চাইবে, তাই না সারোয়ার?

আমি হেসে বললাম, সেটা নির্ভর করে পুলিশ সদস্যরা নারী না পুরুষ, তার ওপর। কিংবা তারা কি ইয়াসমিনা না বোরকাওয়ালি-- তার ওপরেও।

ভালো বলেছো- মনের মেঘ ঝেঁটিয়ে বিদায় করে জোরগলায় হেসে উঠল ইয়াসমিনা।

আনোয়ার বলল, নাজিমের লেখা আসলেই সীমা-ছাড়ানো বিপজ্জনক। রাষ্ট্র তো সবসময়ই বাড়াবাড়িকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। নাজিম বিশ্বপ্রেমিক হলেও অতিশয় প্রান্তিকীয় মতবাদ প্রকাশ করেছেন সব সময়। তাই নিজের মতামত হওয়া সত্ত্বেও- এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নও তার ব্যাপারে সদা-সতর্ক ছিল।

ইয়াসমীনা যোগ করণ, ১৯৫১-তে তার কোনো পাসপোর্ট ছিল না। সে কারণে, সোভিয়েত বলয়ভুক্ত দেশে যেয়েও তিনি বিপদে পড়তেন। রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা তো ভাববাদে চলতে পারেন না। শেষ পর্যন্ত তার পোলিশ বন্ধুরা কী করল, শোনো- তার পূর্বপুরুষ পোলিশ ছিল, এমন প্রচারণা চালিয়ে তার নামে পাসপোর্ট ইস্যু করায় পোল্যান্ড থেকে-- যেখানে তার নাম লেখা হয় : নাজিম হিকমাত ব্রোজেনেস্কি।

বুঝলাম, ইয়াসমিনা ভালোই প্রেমিকা তার। আবার আমার মাথায় দুষ্টুমি ভর করল। বললাম, তো ইয়াসমিনা- রুশরা তাকে এত-সব প্রেমিকা সাপ্লাই দিলো, আর তোমরা শুধু দিলে শৃঙ্খল? কি খারাপ তোমরা! সে যাই হোক, কার বিনিময়ে তিনি এত কাব্য দিলেন?

আবার! কপট বিস্ময়ে ভুরু কুঁচকালো ইয়াসমিনা। শোনো পর্যটক, রুশরা জাতি হিসেবে বরাবরই দুঃখী ও নির্যাতিত। প্রকৃতিও তাদের প্রতি নির্মম। সূর্যের আলোর সাথেই ওদের কত দূরত্ব দেখো। এমন জাতির নারীরা বেশি উষ্ণ, বেশি প্রেমময় হবেই। মদ তো ওরা এমনিতে খায় না, বাঁচার জন্য খেতে হয় বলে খায়। দুনিয়ার এমন কোনো সমুদ্রের নাম বলো তো, যার জেলেরা হাঙরের তেলে গা গরম করে না।

সত্যিই আমি লা-জওয়াব। হাতজোড় করে বললাম, ক্ষমা করো বন্ধু। মাফ চাই। অনেক দুষ্টুমি হয়েছে, এবার ছাড় দাও।

ম্লান হেসে বলল সে- নাজিমও একবার, মাত্র একবার নিজের দেশে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬৩-র নিউমোনিয়া তাকে সে সুযোগ দেয়নি। মৃত্যুর আগে লিখেছেন “কবরের উত্তরাধিকার” নামের কবিতা। কৌশলে মুক্ত করে মুনিবভিরকে নিয়ে গেছেন নিজের কাছে। প্রাক্তন প্রেমিকা ডা. গ্যালিনাকে দিয়েছেন স্থাবর সম্পত্তির সবটুকু। মস্কোর একটিমাত্র ফ্ল্যাটে ভেরা আর ‘কবিতা’কে বুকে জড়িয়েই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

শেষ জীবনটা বেশ কষ্টেই কেটেছে তাহলে?

হয়তো; হয়তো নয়। কবিদের কষ্ট কি দুনিয়ার সাথে সম্পৃক্ত? তুমিই বলো?

আমি নির্বাক হয়ে গেলাম তার প্রশ্নে। সত্যিই তো তাই। কত রাজা-মহারাজা ভোগের সাগরে ভেসে যান কিন্তু কিছুই দিয়ে যান না পৃথিবীকে। কেউ রেখে যান শুধুই রক্ত আর যাতনার ইতিহাস। প্রতিতুলনায়, কবিরা কত অল্পেই সন্তুষ্ট। যদিও তাদের রেখে যাওয়া সৃষ্টিতে মানুষ আনন্দ ও তৃপ্তি খুঁজে পায় যুগের পর যুগ; শতাব্দীর পর শতাব্দী।

সুতরাং সব রাজনীতির বেড়া ডিঙিয়ে আমরা নাজিমের প্রেমিকা। আমাদের আত্মায় ধ্বনিত হবে তারই গান- যত দিন আমাদের হৃদয়ে ভালোবাসা থাকবে।

আর কামাল? তাকে কোথায় রাখবে?

তাকে রাখতে হবে না। তিনিই আমাদের রেখে গেছেন। যে নেতা মাতৃভূমিকে দেন স্বাধীনতা, সাফল্য আর সাহস-- তার জন্য কোনো গানই যথেষ্ট নয়। কোনো প্রেমই তার বিনিময় হতে পারে না। নাজিমের কবিতার মতো করে বলি- আমার প্রাণটুকু খোদার জন্য আর প্রেমটুকু তোমার।

আমি বুঝতে পারলাম না, এই ‘তুমি’ বলতে ইয়াসমীনা আসলে কাকে বোঝালো?

শুরুর সেই কৌতূহল চাপতে না পেরে বলেই ফেললাম- আর এই লেসবস? বলেছিলে যে এখানেই ঘটনার সমাপ্তি? সেটা কী?

সে-ই তো প্রেমিকার শেষ ইতিহাস।

ইয়াসমিনা হাসতে হাসতে বলল, ইতালির মেয়ে জায়স লুসু প্রেমে পড়েছিল নাজিমের; জাজা গাবর যেমন জড়িয়েছিল কামালের জালে। লুসু ঘনিষ্ঠ হয়েই বুঝতে পারল- নাজিমের দেহই পড়ে আছে মস্কো বা ওয়ারশতে, মন আসলে ইস্তাম্বুলে। কারণ খুঁজতে যেয়ে সে চিনলে মুনিবভির ও তার সন্তান মেহসমত (মোহাম্মদ)-কে। তাই সে এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে নাজিমের প্রতি তার প্রেমকে অমর করে যায়। তার আরেক-ফিয়াঁসে ধনকুবের কার্লোকে নিয়ে বেড়াতে যায় তুরস্কের আইভালিক বন্দরে। দেদার টাকা উড়ানোর ফাঁকে লুমু ইস্তাম্বুল যেয়ে মুনিবভিরদের তার সাথে আসতে রাজি করায়। মোহাম্মদকে নিয়ে তার মা ইয়টে উঠতেই টের পায় পুলিশ। তাদের হাত থেকে বাঁচতে কার্লো অন্ধের মতো ইয়ট চালায়। লেসবসের কিনারে এসে উল্টে যায় ইয়ট।

তারপর?

তারপর আর কী? গল্পের মতো সমাপ্তি টানে ইয়াসমিনা। বহু কষ্টে মুনিবভির ও মোহাম্মদকে নিয়ে প্যারিসে হাজির হয় লুসু। বন্দী ও পলাতক কবির জীবনে ফিরিয়ে দেয় বেঁচে থাকার আনন্দ--নিজের গোপন প্রেমের বিনিময়ে।

তারপর?

তার আর পর নেই। বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় ইয়াসমিনা- এক দিকে ক্রুশ্চেভ তার নাটক ও কবিতার প্রকাশ বন্ধ করে দিয়ে তার হৃদয় ভেঙ্গে দেয়, অন্য দিকে জীবন তাকে বলে: ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই, পাখা মেলো পাখি--!

মানে?

মানে, এর মাত্র ছয় মাস পরে আমাদেরকে, মানে তার সব প্রেমিকাদেরকে, তোমাদের মতো বেরসিকদের হাতে তুলে দিয়ে পালালেন সেই জগতে-- যাতে তার ‘বিশ্বাস’ নেই বলে তিনি সারা জীবন গর্ব করতেন।

মানে মৃত্যু?

আর কী? দেখো সারোয়ার, তোমাদের এই একটি ব্যাপার আমার বুঝে আসে না। গল্প-গান-কাব্য নিয়ে ফখর করো, আপত্তি নেই-- কিন্তু জীবন নিয়ে টানাটানি করো কেন? ছাড়ো না ওই একটি ব্যাপার ঈশ্বরের ওপর।

বলতে বলতে সে হেঁটে গেল সুইমিং পুলে। আর আমি উল্টো দিকে তাকাতেই দেখি কামালের সহাস্য ছবির নিচে লেখা- ‘মানুষ হওয়া অবশ্যই গৌরবের আর তুর্কি হওয়া তার শ্রেষ্ঠতম’।

এই শ্রেষ্ঠ জীবনেরই বার্তাবাহকই কি নাজিম হিকমাত?

--------(চলবে??)-------

আজ অমার প্রথম বই বেরুলো, ঝিঙেফুল থেকে---“পানি নিয়ে পুনরায়”।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১২:১৮

তুষার আহাসান বলেছেন: +দিয়ে প্রিয়তে নিলাম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.