![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কবিতাই প্রিয়। কিন্তু গদ্যও যে তার আরশিনগর। তাই নারীর চেয়ে যতই প্রিয় বলি দেশকে; প্রকৃতি হেসে বলেঃ ও হলো কথার কথা। এভাবেই একদিন প্রেমে পড়লাম ঢাকার... স্বপ্নের মত সুন্দরী এক বারবনিতা। থাক এসব ব্যক্তিগত প্যাচাল। তার চেয়ে আসুন পাঠ হোক...
রাজকন্যা হেরোর প্রাসাদ ছিল বসফরাসের পশ্চিম পাড়ে। এলাকার বহু পৌরানিক কাহিনীর নায়ীকার মত হেরোকেও বলা হয় জিউসের ঔরসজাত। সুতরাং বলাবাহুল্য, তার রূপ হবে ভুবনভোলানো এবং খ্যাতি হবে আকাশচুম্বি। সেই রূপের আগুনের আঁচ সমুদ্রতরঙ্গের মত চারিদিকে ছড়িয়ে যাবে-এও খুব স্বাভাবিক। সেই ঢেউ এসে লাগল বসফরাসের পূর্ব তীরে- যেখানে বাস করত এক তরুণ যুবরাজ- লিয়েন্ডার। দুজনেই তরুণ, জীবনের নিষ্ঠুরতা ও পরাজয় যাদের ছোয়ঁনি এখনো। প্রেমের পবিত্র জালে জড়াল তারা। এবং জীবনের স্বাভাবিক স্রোতধারায় এই প্রেম দ্রুতই গড়াল প্রণয়ের দিকে।
বসফরাস প্রণালী হলেও সমুদ্রের হাত। তার মুষ্ঠি কখন যে আলিঙ্গন আর কখন যে মৃত্যুবাহী---- বলা মুশকিল। হেরোর বাবা যখন পূর্ব-পাড়ের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজার পুত্রকে অনাহূত ঘোষণা করলেন এবং গার্ডদের নির্দেশ দিলেন তাকে রুখতে- তখন দু:সাহসী লিয়োন্ডার বসফরাসকে বুড়ো আঙুল দেখাবার সিদ্ধান্ত নিল। রাতের অন্ধকারে সে সাঁতরে পাড় হল প্রণালী এবং গাছের লতা বেয়ে উঠে গেল হেরোর শয়ন কক্ষে।...
প্রেম দৈহিক না আত্মিক- চিরকালীন এ বিতর্কের অশেষ ধারাকে উস্কে দিয়ে আনোয়ার বলল যে, ইউরোপ হামেশা আমাদেরকে অবজ্ঞা করে ‘পিছিয়ে-পড়া’ বলে- সেই ইউরোপই কিন্তু এসব আশ্চর্য বিতর্কের জন্ম দিয়েছে- পৃথিবীর সকল রহস্যের পেছনে যুক্তি দেবার অভিপ্রায়ে।
বিতর্কের চেয়ে গল্পই আমার প্রিয়। তাই শুনতে অধীর হয়ে উঠি ইয়াসমীনার সুললিত কন্ঠের যাদুতে।
...হ্যাঁ, রাতের এই অভিসার চলতে থাকে এবং চাঁদও পাল্লা দিয়ে বেড়ে ওঠে। পূর্ণিমার রাতে দুজনে প্রথম মিলিত হয় চন্দ্রালোকিত প্রাসাদের ছাদে।
হয়ত কোন গার্ড বা গুপ্তচর জেনে গিয়েছিল গোপন এই প্রেমের কথা। অমাবস্যার আগের রাতে হেরোর অপেক্ষা আর শেষ হয় না। রাত্রির মধ্য-যাম অতিক্রম হতে দেখে নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে চিৎকার করে ওঠে সে- লিয়েন্ডার, আমার লিয়েন্ডার, তুমি কোথায়? নিচ থেকে এক গুপ্তচর জবাব দেয়: ডুবে মরেছে সমুদ্রের স্রোতে!
কাহিনীর সত্য মিথ্যা আমরা জানি না, তবে হেরো সেই ঝুল বারান্দা থেকেই প্রেমিকের উদ্দেশ্যে লাফিয়ে পড়ে। বসফরাসের রাক্ষসী স্রোত গিলে নেয় রূপসী রাজকন্যাকে।
হেলেনের পরে ভূমধ্যসাগরের উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে জনপ্রিয় গাঁথা এই হেরো-লিয়েন্ডার কাহিনী। ইয়াসমিনা লাস্য ভঙ্গিতে বলে- যদিও আনোয়ার তা বিশ্বাস করে না। না করুক, সেটা তার ব্যাপার। তবে আমরা যদি তার দেশের রানী বিলকিসের কাহিনী নিয়ে প্রশ্ন তুলি- আফেন্দি আনোয়ার যেন তাতে রুষ্ট না হয়।
সফরের শুরু থেকেই আমরা আনোয়ার ও ইয়াসমিনার মধুর রাগ-অনুরাগ উপভোগ করছি। লাজুক আনোয়ারের পাশে ইয়াসমীনা যেন এক চঞ্চল প্রজাপতি। কিন্তু আমি আনোয়ারকে যতটুকু চিনি- ও বান্দা, এত সহজে ধরা দেবার পাত্র নয়। খাঁিট বেদুঈন স্বভাব বইছে তার রক্তে। একবার কায়রোর খাবে-খলিলি বাজারে বেশ কিছু কাপড় দেখেছিলাম আমি। আনোয়ারও সাথে ছিল। সেদিন শুধু দেখতেই গিয়েছিলাম। স্কলারশিপের টাকা পেয়ে পরে কিনব ভেবেছি। পরদিন বিকালে দেখি এক সবগুলো কাপড় নিয়ে মটরসাইকেল ডেলিভারীম্যান বাসায় হাজির। আমাকে সই করে রাখতেই হল- কারণ, আনোয়ারের জিনিস ফেরত দেবার হাংগামা অনেক। সে গল্প সময়ে হবে।
*
তুরস্কের রাজধানী আকাংরাকে যতই গুরত্ব দেয়া হোক না কেন, ইস্তাম্বুলই দেশের রানী। এ-তো মিশর নয় যে কায়রোর সাথে আলেক্সান্দ্রিয়ার পাল্লা দেবার প্রশ্ন ওঠে না; কিংবা নয় রোম আর নেপল্সও। তবুও দূরদশী আতাতুর্ক দেশের প্রান্ত থেকে দেহের হৃৎপিন্ড কেন্দ্রে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিলেন---এমন এক জনপদে, যে জনপদকে পৃথিবীর আদি মানবগোষ্ঠীর উৎসস্থল মনে করা হয়---যদিও আজ তার কোন চিহ্নই অবশিষ্ঠ নেই; সেই আকাংরা হল নব্য তুরস্কের রাজধানী।
আকাংরা নামের যতগুলো উৎস খুঁজে পাওয়া যায়- তার সবগুলোই মজার। খিস্টপূর্ব ৭৫০-এ ফ্রিজিয়ানরা সমুদ্রতীর থেকে অনেক ভেতরের এই জায়গাকে দেশের রাজধানী হিসেবে বেছে নেয়। কিন্তু তাদের মন পড়ে থাকত ‘অ্যাংকর’-এর দিকেই। সেই শব্দ থেকেই আংকারা! দ্বিতীয় সুত্র মতে, গালাটিয়ানরা খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে যখন এ-স্থানকে তাদের রাজধানী বানায়- তারা তাদের পিতৃভূমি ‘আনাছিরা’ কে স্মরণ করে জায়গায় নাম দেয় আকাংরা। তৃতীয় মতানুযায়ী মহামতি আলেক্সান্ডার তার বিশ্বজয়ের শুরুতেই আসিরিয়ানদের পরাজিত করেন বলে এলাকার নাম হয় আংকারা।
তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য যুক্তি হচ্ছে, শহরের সুপ্রাচীন উলের ব্যবসা, বিশ্বব্যাপী যার কদর ‘আংগুরা’ নামে, সেই শব্দ থেকেই আংকারা’র উৎপত্তি।
বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া এই আংকারাকেই, ১৯২১ সালে, পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসেন নব্য তুর্কীর নতুন মহানায়ক- কামাল পাশা।
*
আধুনিক তুরস্কের রাজধানী হবার পরেও আংকারায় রাত্রি যাপনের ‘অপশন’ চাওয়া হল আমাদের কাছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, আনোয়ার! রাজধানীতে যাবো, তাও মাত্র এক-রাত থাকব কিনা জানতে চাইছে; ব্যাপার কি?
আনোয়ার হেসে বলল, ফ্রেন্ড। কামাল যতই তার রাজধানীকে তিলোত্তমা বানাক, ওখানে দেখার বেশি কিছু নেই। বড় জোর তোমার ভালো লাগবে আনাদলু মুজেসি (আনাতোলিয়া মিউজিয়াম), আতাতুর্কের সমাধী, আর সিটাডেল। আরো বড় কথা, আকাংরার কেন্দ্রস্থলে ভালো মানে ভদ্রস্থ হোটেল বেশি নেই; অথচ খরচ খুব। পর্যটকরা এ জন্য রাতের ট্রেনে যেয়ে সারাদিন আংকারা দেখে পরের রাতে হিট্টাইটদের ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজধানী হাত্তুসাস অথবা কায়সারি চলে যায়। তুমি চাইলে অবশ্য এসব বাদ দিয়ে সরাসরি বদরুমও যেতে পারি। বদরুম হল তুরস্কের মানব-বিপনী কেন্দ্র।
মানে?
মানে হল- এশিয়ান সংস্কৃতির সবটুকু জলাঞ্জলী দিয়ে বদরুমকে গড়ে তোলা হয়েছে ব্যাংকক করে! ন্যূড-ড্যান্স থেকে টাইগার-শো সবই পাবে। জলবিহার থেকে জলকেলীর বিচিত্র সমাহার সেখানে। মিশরে যেমন শার্ম আল শেখ, আমিরাতে যেমন দুবাই, তুরস্কে তেমনি বদরুম।
কিন্তু দুবাই থেকে শার্মের পার্থক্য অনেক। দুবাইতে প্রকাশ্য নগ্নতা নেই বললেই চলে; আর শার্ম যথেষ্ট খোলামেলা হলেও তা ধরতে ঘীলু লাগে--সাধারণের কম্মো নয়---।
বিয়োগ কর, দোস্ত, বিয়োগ কর। শার্ম থেকে দুবাই বাদ দিলে যা হবে, বদরুম থেকে শাম বাদ দিলেও তাই হবে। এবার বুঝলে?
আমি অবাক হয়ে দেখি- ইয়াসমীনা আমাদের যুক্তি শুনে হাসছে, আর আনোয়ারকে আক্রমনের জন্য তরবারি শানাচ্ছে।
অবশ্যই, সারোয়ার! বিয়োগ কর; তবে যত যোগ-বিয়োগই করা না কেন, ইয়েমেনে কিন্তু কোন ইকুআলটু-ই মিলবে না।
আনোয়ার ঠান্ডা ছেলে। সচরাচর রাগ-টাগ করে না। হঠাৎ সে এত ক্ষিপ্ত হলো যে ভয়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম। ইয়াসমিনার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাঁ, ইয়েমেনে এসব অংক মিলবে না। আর আমি চাইও না যে এসব অংক মেলাবার জন্য আমার দেশে কোন আতাতুর্ক জন্মাক। সেই আধুনিকতাকে আমি ঘৃণা করি- যা আমার বিশ্বাস ও সম্ভ্রমকে ভূলুন্ঠিত করে। সেই উরু দেখে আমি মোহগ্রস্থ হতে চাই না- যা গ্রহণ করে অসংখ্য পুরুষ!
লজ্জায় লাল ইয়াসমিনা এই অপ্রস্তুত-আঘাতে বসে পড়ল। আনোয়ারের কাঁধে হাত রাখতেও আমার ভয় হচ্ছিল- পাছে সে না ছিটকে ফেলে। তবু সাহস করে আমি তার হাত ধরলাম, নূর-এ শামস্-এর গানটা তুমিই না আমাকে শুনিয়েছো, বন্ধু?
তার রাগ কমে দু’চোখ জলে ভরে উঠল। সহসাই ইয়াসমিনার বাম হাত টেনে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল, আমি সত্যিসত্যিই দু:খিত, বন্ধু। মাফিশ--!
ইয়াসমিনার চরিত্র এত প্রাণবন্ত যে আমরাও মাঝে মাঝে মুশকিলে পড়ে যাই। বিদুচ্চমকের মত হেসে উঠে বলল সে, নেভার মাইন্ড। লেটস্ গো ফর ডিনার।...
*
পূর্ব-ইস্তাম্বুলের হায়দার-পাশা স্টেশন থেকে আংকারার ট্রেন ছাড়ে - দূরত্ব ৪৫৪ কিলোমিটার। বাসকেন্ট, বোগাজি, আনাদলু এবং ফাতিহ্ নামের ৪টি এক্সপ্রেস ট্রেন যায় সকাল ১০টা, দুপুর দেড়টা, রাত ১০টা এবং ১০:৩০-এ। ভাড়া শ্রেণীভেদে বাংলাদেশী ৭০০ থেকে ১২০০ টাকা। তবে ‘একমাত্র স্লিপার-কার’ “আংকারা এক্স”-এ যেতে হলে খরচ পড়বে মাত্র পাঁচগুন।
আমরা উঠলাম আনাদ্লু-তে।
তুর্কী ট্রেনের প্রশংসা করতেই হয়। আসন, শীতাতপ ব্যবস্থা, টাইমিং এবং ডাইনিং খুবই ভালো। আড্ডা, আনন্দ, ঘুম ও স্বপ্নের মধ্য দিয়েই আমরা কাকডাকা ভোরে পৌঁছে গেলাম রাজধানীতে।
আংকারা! আংকারা!!
*
উত্তর দক্ষিণে সোজা লম্বা আতাতুর্ক বুলেভারিই আংকারার প্রাণ। পুরো শহরেই যেন কামালের ছড়াছড়ি। অসংখ্য স্থাপত্য, মাযার, মিউজিয়াম- সব আতাতুর্কের নামে। যে কোন যুক্তিবাদী মানুষের মত আমারও ক্লান্তি লাগল দেখতে দেখতে। আশি বছর আগে পত্তনি নেয়া যে-শহর যাত্রা শুরু করেছিল মাত্র তিরিশ হাজার অধিবাসী নিয়ে, সে-নগরী এখন চার লক্ষ নাগরিকের চাপে রূদ্ধশ্বাস। তারপরেও বলা উচিত- আংকারা অনেক খোলামেলা এবং নিউ-দিল্লীর মত পরিকল্পিত।
হাজী বৈরাম মসজিদ, জুলিয়ান-স্তম্ভ, অগাস্টাসের মন্দির এবং রোমান-বাথ আমরা ভাসা-ভাসা চোখে দেখলাম। তবে হতাশার শেষ বিন্দুও কেড়ে নিল আনাদ্লু যাদুঘর এবং সিটাডেল--তার অসাধারণ রুপমাধুর্য দিয়ে।
দুপুরের খাওয়া খেলাম সুবিখ্যাত ওয়াশিংটন রেস্টুরেন্টে। তুরস্ক বিখ্যাতই তার কাবাব আর শরবতের জন্য। আমরাও চেখে দেখলাম ‘মান্তি’।
ওয়াশিংটন হোটেলের মত বড় বাগান-রেস্তোঁরা পৃথিবীতে খুব বেশী আছে বলে মনে হয় না। এর মালিক এক সময় ওয়াশিংটনের তুর্কী-এম্বেসীতে কাজ করতেন বলে এই নাম- যদিও রেস্তোঁরাটি দাঁড়িয়ে আছে সিটাডেলের ভেতরে; পাহাড়ের উঁচুতে। পুরো মধ্য ও দক্ষিণ আংকারা দেখা যায় এখান থেকে।
*
হিসার বা সিটাডেল কবে, কার হাতে তৈরি--জানা না গেলেও জনশ্রুতি যে, এটি গ্যালাটিয়ান্সের হাতে নির্মিত। দুই স্তর বিশিষ্ট দেয়াল ঘেরা এই দুর্গের পুরোটাই ইতিহাস, বিশেষত মোহাম্মদ দ্য কনকোয়ারারের শাসনামলকে ধরে রেখেছে।
আনাদলু যাদুঘরটি সর্বার্থেই বিস্ময়কর। গড়া হয়েছে পনেরো শতকের একটি বিশাল সরাইকে আশ্রয় করে। মানব সভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন (৮০০০ বছর পুরানো) নিদর্শনগুলো এখানে রাখা আছে। ইজিপশিয়ান যাদুঘরের মতই স্তরে স্তরে ভাগ করা এটি- প্লিওলিথিক, নিওলিথিক এবং কালকোলিথিক যুগের পর হিট্টাইট কক্ষঅ এরাই পৃথিবীতে প্রথম কৃষি ও ধাতব সভ্যতার প্রচলনকারী। রাজা মিডাসের কবরের প্রতিরূপ আছে এখানে! মসনবি’র প্রথম কপির কয়েকটি পাতার কারুকাজ এবং নান্দনিকতা দেখে আমি বিস্ময়ে নির্বাক!
সন্ধ্যার পর নগরীর প্রাণ কেন্দ্র হিট্টাইট মনুমেন্ট থেকে মেট্রোতে উঠে কিজিলে গেলাম। সেখান থেকে উপরে উঠে হাঁটতে হাঁটতে আবার ফিরব উলুসে। তারপর মেট্রো ধরে আস্তি বাস স্ট্যান্ডে ফিরে যাবার ট্রেনে---।
হাঁটতে হাঁটতেই লক্ষ্য করছি ইয়াসমিনা খানিকটা চুপ। কারণ কি? আনোয়ার চুপি চুপি বলল, দু’দিকে যে বাজার এবং সুন্দরীদের মেলা দেখছ, আসল ওরা দেহ-পসারিনী। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় পতিতালয় এই আংকারায়। মোস্তফা কামালের আরেকটি আধুনিকতা! আনোয়ারের মন্তব্যে বিদ্রুপের চেয়ে বেদনাই বেশি।
ইয়াসমিনাও শুনেছে তার কথা; কিন্তু প্রতিবাদ করছে না। নারী হয়ে নিজেও সে বোধহয় লজ্জায় ম্রীয়মান।
আমি ভাবলাম, পৃথিবীর কোথাও কি পুরুষ-পতিতালয় আছে? ছিল কি কোনদিন? হয়ত ছিল--- লুত জাতির মধ্যে। যাদেরকে শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করা হয়েছে মৃত সাগরের নিচে। সম্প্রতি এই জঘন্য যৌনাচারকে লাইসেন্স দিয়েছেন দুনিয়ার-মোড়ল ক্লিনটন। ক্লিনটন কি বিলটি পাশ করার আগে একবারও নেপল্স, কাপ্রি বা ডেড-সী ভ্রমণ করেছেন? দেখেছেন ধ্বংসপ্রাপ্ত পম্পেই? আজও যে বিসুভিয়াস সতর্ক-সংকেতের মত দাঁড়িয়ে আছে, ক্লিনটন সাহেব কি একবারও কান পেতেছেন তার মাটিতে? আমি নিশ্চিত যে, ক্ষমতাগর্বী এসব নেতারা অভিসারের জন্য যথেষ্ট সময় পেলেও, এসব দেখার সময় পান না।
*
কেন, জানি না- আমি ভাবাবেগে আক্রান্ত হলাম।...আমার সামনে থেকে মুছে গেল আংকারা এবং তার বিপুল নির্মান। চোখের সামনে ভেসে উঠল সদোমা, গোমরা ও পম্পেই নগরী। কোরান এবং বাইবেলে ঘটনাগুলো প্রায় একইভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এখন যেখানে মৃত সাগর অবস্থিত, ইসরাইল ও জর্দান সীমান্তের সেই কিনারেই বাস করত (নবী) লুত-এর জনগোষ্ঠী। খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ শতাব্দীর দিকে জনপদের অধিকাংশ মানুষই বিকৃত যৌনাচা পায়ূকাম-এ (ইংরেজীতে সডোমি; এসেছে সদোমা থেকে) লিপ্ত হয়। ইতালীর নেপল্স-এর পূর্ব পাশে পম্পেই শহরেও ছড়িয়ে পড়ে একই যৌন-বিকৃতি। ঐতিহাসিকরাই স্বীকার করেন, পম্পেইর মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ পুরুষই ছিল যৌন-বানিজ্যে নিয়োজিত। সদোমা ও গোমরার মানুষকে সতর্ক করেছিলেন লুত, কিন্তু তারা শোনে নি। বরং পরিহাস করে বলছিল, তোমার খোদা যদি এতই শক্তিমান হয়, আমাদেরকে শাস্তি দেয় না কেন?
কোরানের ১০টি সুরায় (শুয়ারা, আরাফ, কাবুত, জারিয়াত, হুদ, হিজর, এবং কামার) এই কাহিনীর ইঙ্গিতময় বর্ণনা রয়েছে। ... অবশেষে সেই-শাস্তি নিয়ে এল দু’জন পুরুষ-বেশী ফেরেশতা। তারা এসেছিল হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর ঘর হয়ে। রাতের অন্ধকারে ঢুকলেও নগরবাসী টের পেয়ে গেল যে দুজন সুন্দর চেহারার অতিথি এসেছে লুতের ঘরে। তারা জড় হল চারপাশে এবং এত সুদর্শন দুই পুরুষকে দেখে কামনাকাতর উল্লাসে ফেটে পড়ল।
লুত তাদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন; এমনকি নিজের যুবতী-কন্যাদেরকেও দিয়ে দিতে রাজি হলেন-- তবু যেন মেহমানদেরকে অসম্মান না করা হয়-- কিন্তু তারা শুনল না। শেষে, রাত্রির শেষ-যামে পুরো শহরকে ধ্বংস করা হল- লুত এবং তার হাতে গোনা ক’জন বিশ্বাসী মানুষকে শহরের বাইরে বের করে দিয়ে। লুতের নিজের (অবিশ্বাসী) স্ত্রীও মাটি-চাপা পড়ল অভিশপ্তদের সাথে।...
আমি যখন ডেড-সি পরিভ্রমন করি, ইহুদি-প্রফেসর আইজাক পেরন বলেন--মৃত সাগর বা ডেড-সী’র কমপক্ষে চারটি বাস্তবতা এই ভয়াবহ ঘটনার পক্ষে যুক্তি দেয়:
(১) ডেড-সী’র পানির উচ্চতা ভূমধ্যসাগর থেকে ৪০০ মিটার নিচে (পৃথিবী-পৃষ্ঠে গভীরতম);
(২) ডেড-সী’তে এখন পর্যন্ত কোন জীবন নেই- না মাছ; না পোকা-মাকড়। এমনকি ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ারও অস্তিত্ব নেই- এর পানির অসম্ভব বেশি লবনাক্ততার জন্য;
(৩) ভূতত্ত্ববিদ এবং বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন- ডেড-সী কোন প্রাকৃতিক সমুদ্র বা হ্রদ নয়। এর সৃষ্টি হয়েছে আকস্মিক ভূমিকম্প বা অগ্ন্যুৎপাতের ফলে। যেহেতু আশে-পাশে জর্ডানের ‘বাসান’ ছাড়া বড় কোন পাহাড় নেই- তাই ভূতত্ত্ববিদদের ধারণা- ভূমিকম্প হবার সম্ভাবনাই বেশি। সেই ভূমিকম্পের ধরণটা ছিল অদ্ভুত-- ইদুর মারা কলের মত-- একটা কফিনের ছাদ ফাঁক হয়ে যেন নিচে বসে গেল, আর দু’ধারের মাটি উল্টে পড়ল ভেতরে। চারপাশের জঞ্জাল এসে ভরাট করে দিল সেই গর্ত, যদিও পুরোপুরি পারল না। নিচু সেই জায়গায় এল চারপাশের পানি- জর্ডান নদীর স্রোত কিংবা তারাস পাহাড়ের জলপ্রপাত। পানির একমুখী স্রোতে লবনাক্ততা বাড়তেই থাকল এবং তার তীব্রতায় নিভে গেল জীবন-ধারণের সমস্ত সম্ভাবনা। এমনকি মানুষও এখন ভেসে থাকে সেই ভারী-পানিতে!
(৪) এখনো মৃত সাগরের দক্ষিণ-কোনে চোখে পড়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িঘর।
আমি হতবাক হয়ে দেখলাম পৃথিবীর সেই সবচে নির্মম অভিশাপের খানিকটা আর প্রফেসরকে বললাম, দ্রুত সরে যেকে!
হেসে জানালেন তিনি, পম্পেইতেও ঘটেছিল একই ঘটনা। ঘুমন্ত বিসুভিয়াস জেগে উঠল আকস্মিক গর্জনে এবং কর্মব্যস্ত জনপদকে নিমেষে পাথর করে দিল। খননের ফলে দেখা গেছে- পম্পেইয়ের ধ্বংসাবশেষে স্থির-চিত্রের মত ‘মমি’ হয়ে আছে কামরত যুগল, ব্যাভিচারী পুরুষদ্বয় এবং শিশু-ধর্ষনকারী!! কেন জানি না, মিডিয়া এসব নিষ্ঠুর-সত্যকে খুব বেশি সামনে আনে না। অবাক হয়ে বাবি, সেই নেপল্স আবার এখন জগতজোড়া খ্যাতি পেয়েছে ‘যৌন-নগরী’ হিসেবে এবং কাপ্রি দ্বীপে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর সবচে বড় ‘হোমোসেক্সুয়াল্স প্যারাডাইস’!
আমার অবচেতন মন যেন নিজের কাছেই জানতে চাইল, ‘আবার কি তাহলে জেগে উঠবে বিসুভিয়াস’?
আমি এর উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই চেপে বসলাম কায়সারি যাবার ট্রেনে-- মহামহিম মোস্তফা কামালের সুবিশাল মৌসুলিয়মে বিস্মিত না হয়েই!
দেখা যাক, জীবন আমাকে কোথায় সিজদানত করে; কোন বৃন্দাবনে স্থিত হয় সবুজ জায়নামাজ!!
-------------
১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ২:৩৪
বুলবুল সরওয়ার বলেছেন: আমি এখানে শুধু নতুন নই, অনভিঞ্গ-ও বটে। আর এগুলো আমার ‘ডাইরি’। আমি সম্প্রতি ব্লগ-গুলো পড়তে শুরু করে--- লোভে-লোভে--- ২/১টি লেখা দিচ্ছি মাত্র। আপনাদের ভালোলাগাটা শুধূ আনন্দের না, বিস্ময়েরও বটে! তবু, যদি উৎসাহ দেন, ইস্তাম্বুল ভ্রমণটা শেষ করব। জানাবেন---।
২| ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ২:৫৯
*কুনোব্যাঙ* বলেছেন: শেষ করবেন মানে অবশ্যই শেষ করবেন। তুর্কির উপর এত চমৎকার সাবলীল বর্ণনা এবং সাথে বিভিন্ন ইতিহাস ঐতিহ্য মিথ বর্তমান প্রেক্ষাপট সব মিলিয়ে অসাধারণ ভ্রমণ ব্লগ দিয়ে লোভ ধরিয়ে দিয়েছেন। তাই শেষ করার অনুরোধ না জানিয়ে উপায় নেই। আমার খুব প্রিয় একজন মানুষকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম যদি তোমাকে একটি দেশ ঘুরে দেখতে বলা হয় তাহলে কোন দেশে যাবে? নির্দিধায় উত্তর দিয়েছিল, তুর্কি। এমনকি আমার বোনকে জিজ্ঞাসা করেও আমি একই উত্তর পেয়েছি। আমার নিজের প্রথম পছন্দ না হলেও অনেক ইচ্ছা তুর্কি ঘুরে দেখার। অবশ্য সবার পছন্দের মিল এটাকে আমি কোইন্সিডেন্স বলতে নারাজ, তুর্কি নিজ গুনেই সবার পছন্দের তালিকায় থাকে হয়তো। জানিনা তুর্কি ঘোরার ইচ্ছা কোনদিন পূরণ হবে কিনা।
শুভ কামনা। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে আপনি অনেক উঁচু মাপের চিন্তাশীল এবং শক্তিশালী একজন লেখক।
৩| ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৩:৩২
মুনসী১৬১২ বলেছেন: চলছে চলবেই
©somewhere in net ltd.
১|
১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ২:২৪
*কুনোব্যাঙ* বলেছেন: আপনার লেখাগুলো পড়ে সত্যি অনেক মুগ্ধ হয়ে যাই।
+