![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কবিতাই প্রিয়। কিন্তু গদ্যও যে তার আরশিনগর। তাই নারীর চেয়ে যতই প্রিয় বলি দেশকে; প্রকৃতি হেসে বলেঃ ও হলো কথার কথা। এভাবেই একদিন প্রেমে পড়লাম ঢাকার... স্বপ্নের মত সুন্দরী এক বারবনিতা। থাক এসব ব্যক্তিগত প্যাচাল। তার চেয়ে আসুন পাঠ হোক...
ব্লু-ভয়েজের সুইমিং ট্যুরের অংশ হিসাবে গতকাল আমরা প্রচুর ঝিনুক তুলেছি। নাদিয়া এত ভাল সাঁতরায় যে আনোয়ারও তার সাথে পাল্লায় হেরে গেছে। পর্যটকদের মধ্যে যে তিনজন পুরস্কার জিতেছে- তাদের দুজনেই নারী। নাদিয়া প্রথম হয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে নজরুলের ‘উতারো ঘোমটা’ ছেড়ে তুর্কী নারীরা আরো অনেক দূরে এগিয়ে গেছে।
রাতের পার্টি ছিল জমজমাট। থ্রেসিয়ান নারীরা বুকের বসন উড়িয়ে যে নাচ শুরু করে ছিল, তার শেষ হয়েছিল চূড়ান্ত মাতলামীতে। পানোন্মত্ত নারীরা যে পুরুষের চেয়ে বেশি কামনা-কাতর হয়, আমরা তা হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছি। আনোয়ারের উপর হামলে পড়েছিল অন্তত চার চারটি যুবতী- যা দেখে নাদিয়ার শেষপর্যন্ত নেশা কেটে যায়।
কিন্তু সবাই তো আর নাদিয়া নয়! যুগে যুগে এই সোম-রস দুনিয়া জুড়ে বহুত অমঙ্গল আর বিশৃঙ্খল বয়ে এনেছে। মানব জাতির বিপর্যয়ের জন্য যদি মাত্র দুটো বিষয়কেও চিহ্নিত করা হয়- তার একটি হবে দম্ভ; দ্বিতীয়টি শরাব। দুটোই ধাবিত হয় রমনীকে কেন্দ্র করে এবং সমাপ্তিতে অপরিহার্য হয়ে ওঠে রক্তপাত।
সকালের হালকা রোদে অদ্ভুত নীল জলরাশির ঢেউ দেখতে দেখতে আমি আনমনা হয়ে যাই। জাহাজের বেশিরভাগ যাত্রীই এখনো ঘুমের গভীরে। অসম্ভব সুন্দর সুন্দর দ্বীপ এবং রীফ পার হয়ে ‘সিন্দাবাদ’ চলেছে উত্তর দিকে। ডান দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল ঘন সবুজ পাইনে-ছাওয়া আশ্চর্য সুন্দর দ্বীপ ‘হেলেনিকা’- তীক্ষè-ভয়ংকর চোয়াল তার দাঁত উঁচিয়ে মুখ ভ্যাংচাচ্ছে। সেকেন্ড অফিসার জানাল, দ্বীপটা অভিশপ্ত। সম্রাট নীরোর পরে ওখানে আর কোন ‘ভিআইপি’ নামেনি। চেষ্টা যে হয়নি, তা নয়, তবে দুর্ঘটনাই বেশি ঘটেছে বলে সবাই এভাবেই ইতিহাস বর্ণনা করেছে।
*
সেই নির্জন হেলেনিকা পার হয়ে যেতে-যেতে আমার মনে পড়ল রোম সম্রাট নীরোর জীবন-কাহিনী। দ্বীপের মতই তার ইতিহাসও ভয়ংকর-নির্মম, অথচ করুণ রসে সিক্ত।
ধর্মকথার পরেই যে দু’একটি বাক্য বিশ্ব জুড়ে খ্যাতি পেয়েছে, তারই অন্যতম : রোম যখন পুড়ছিল, নীরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল। এ বাক্য থেকে মানুষের মনে যে চিত্রকল্পটি ভেসে ওঠে তা শ্রী-কৃঞ্চের বংশীবাদনের অনুরূপ হলেও নীরোর জীবন কাহিনী সে রকম রোমাণ্টিক নয়। ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাক্যটির উদ্ভব হয়েছে সপ্তদশ শতাব্দীর অন্তিমলগ্নের ইউরোপে; গীর্জার আধিপত্য যখন লোপ পেতে বসেছিল। ইংরেজীতে জনপ্রিয় Niro fiddled while Rome burned বলতে যা বোঝায়, সেই বাঁশি প্রাচীন রোমে ছিলই না। সম্রাট নীরো গানের প্রতি আসক্ত ছিলেন, অভিনয়ে আগ্রহী ছিলেন, কবিতা ও নাটক ভালবাসতেন, কিন্তু বাদ্যযন্ত্রে আগ্রহী ছিলেন বলে জানা যায় না। সঙ্গৎ দানের জন্য যাওবা ব্যবহার করতেন - তা বীণা, বাঁশি নয়। তবু নীরোর প্রতি এই অপপ্রচার কেন?
গবেষকদের মন্তব্যঃ এ হল গীর্জার-ইচ্ছে। খ্রিস্টান পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণিত দুজন মানুষের প্রতি এ-হলো ভ্যাটিকানের আরোপিত বিদ্বেষ; যাদের একজন নীরো, অন্যজন: মার্টিন লুথার। এর মানে কিন্তু এ নয় যে সম্রাট নীরো সাধুসন্তু ছিলেন কিংবা তৎকালীন রোম-সম্রাটদের অহংকার বা পাগলামি তার মধ্যে ছিল না। বরং দেখে অবাক হতে হয় যে অত অল্প বয়সেই উদ্ভট কান্ড-কারখানা উদ্ভাবনে তার ধীশক্তি কত আশ্চর্য উর্বর ছিল।
পূর্বতন সম্রাট, ক্লডিয়াসের ৫৪ খ্রি: আকস্মিক মৃত্যুতে, মাত্র ১৮ বছর বয়সে নীরো সিংহাসনে বসেন। অভিযোগ আছে যে, তার মা এগ্রিপ্পিনা জুনিয়র বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে স্বামীকে হত্যা করেছিলেন, যেন ক্লডিয়াসের পুত্র বৃটানিকাস ক্ষমতা পাবার আগেই এগ্রিপ্পিনার পূর্বপক্ষের সন্তান নীরো ক্ষমতা পান। অবশ্যই নীরো ক্ষমতা পেয়েছিলেন, কিন্তু এগ্রিপ্পিনাকে তার জন্য যে নির্মম বিনিময় দিতে হয়েছিল, সে কাহিনী জানতে হলে আমাদেরকে আরেকটু পেছনে যেতে হবে।
এন্টনি ও ক্লিওপেট্টাকে হারিয়ে অক্টাভিয়ান রোম সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হন খৃস্টপূর্ব ৩০-এ। তার নতুন নাম হয় অগাস্টাস। অগাস্টাস ও লিভিয়ার কোন সন্তান ছিল না। ভাইয়ের দুই পুত্রকে দত্তক নেন তারা। এই দুই পুত্রের মধ্যে কনিষ্ঠ তাইবেরিয়াস যোগ্যতার বলেই রোমের সম্রাট হন (১৪-৩৭ খ্রি। জ্যেষ্ঠপুত্রের ছেলে (অগাস্টাসের নাতি) গেইয়াস ক্যালিগুলা রোম শাসন করেন পরের ৪ বছর (৩৭-৪১)। ক্যালিগুলোকে প্রকাশ্য ফোরামে খুন করা হয় ৪১ খ্রিস্টাব্দে। ফলে, সাংবিধানিক সংকট দেখা দেয়। কারণ, অগাস্টাসের উইলে উল্লেখ ছিল যে, রক্তসুত্রে-অগাস্টান ছাড়া কেউ সম্রাট হতে পারবে না। যদিও তখন ক্লডিয়াস প্রাসাদেই উপস্থিত ছিল, কিন্তু তার কথা কেউ ধর্তব্যেই আনেনি। কারণ, ক্লডিয়াস শারিরীকভাবে এত দুর্বল ছিলেন যে ২৪ বছর বয়সে একবার প্রকাশ্য রাজসভায় মুত্রত্যাগ করে দিয়েছিলেন। অনভিজাত এ-আচরণের জন্য তিনি ছিলেন সিনেটের কাছে ‘পরিত্যক্ত’। নিভৃতচারী ক্লডিয়াসও লাইব্রেরিতেই জীবন কাটাতে অভ্যস্ত হয়েছিলেন। এবং এভাবেই, সবার অজান্তে, তিনি তার শারীরিক দীনতা পুষিয়ে নিয়েছিলেন বেশুমার ‘জ্ঞান-সম্পদ’ কুড়িয়ে। সেই মহাফেজখানা থেকে আকস্মিক ভাবে ধরে এনে তাকে সিংহাসনে বসানো হল ২৪ জানুয়ারী ৪১-এ, কোন দ্বিতীয় অগাস্টান না পেয়ে।
ক্লডিয়াসের স্ত্রী মেসালিনার পার্টি-প্রীতি ছিল অস্বাভাবিক। ঐতিহাসিকদের ধারণা, ক্লডিয়াস শারিরীক ভাবে দুর্বল ছিলেন বলেই মেসালিনার এই ভীমরতি। যাই হোক, এক ভোজসভায় জনৈক সিনেটরকে ‘স্বামী বানিয়ে’ নাটক মঞ্চস্থ করায় ক্লডিয়াস মেসালিনাকে প্রাণদন্ড দেন। এর কিছুদিন আগে, সম্রাট ক্যালিগুলা তার বোন এগ্রিপ্পিনা জুনিয়রকে ব্যাভিচারের অপরাধে পন্তিয়াস দ্বীপে নির্বাসন দিয়েছেন। ক্যালিগুলা আধ-পাগল ছিলেন এবং তার সময়ে অনেক অক্টাভিয়ানই লঘু পাপে গুরু দত্ন্ড পেয়েছেন; যদিও ঐতিহাসিকদের মত : এগ্রিপ্পিনা সত্যিই অপরাধি ছিলেন। যাই হোক, এই ভঙ্গুর ব্যবস্থা অবসানকল্পে সম্রাটকে পরামর্শ দেয় সিনেট: রাজপরিবারের সকল সদস্যকে ঘরে ফিরিয়ে আনুন। এভাবেই, ব্যাভিচারে-দন্ডিত অ্যাগ্রিপ্পিনাও রোমে প্রত্যাবর্তন করেন অগাস্টানদের সাথে।
ছেলে নীরোর বয়স তখন এগারো।
এগ্রিপ্পিনা ছিলেন অভিজাত সুন্দরী। নি:সঙ্গ ক্লডিয়াস তার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং অচিরেই এর বিনিময়ে এগ্রিপ্পিনা অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা পেতে শুরু করেন। সমকালের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক-নাট্যকার সেনেকাকে নিয়োগ করা হল নীরোর গৃহ শিক্ষক। ফলে, একসময় যাকে পৈত্রিক সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছিল, সেই নীরো বড় হয়ে উঠলেন শিল্পকলার প্রতি গভীর ‘অনুরাগ’ নিয়ে-- রাজপুত্রের প্রাপ্য সম্মানে।
রুগ্ন-রাজা নামে খ্যাত ক্লডিয়াস ইতিমধ্যে বৃটেনে অভিযান পরিচালনা করে জয়ী হয়েছেন। এই ঐতিহাসিক বিজয়কে স্মরনীয় করে তার ছেলের নাম বদলে রাখা হয়েছে বৃটানিকাস। নীরোর থেকে দু’বছরের ছোট বৃটানিকাস। এগ্রিপ্পিনা যতই ক্লডিয়াসের দিকে ঝুঁকছিলেন, ততই বুঝতে পারছিলেন যে বালক বৃটানিকাসই নীরোর পথের কাঁটা হবে। সুতরাং ক্লডিয়াসের সাথে বিয়ের আগেই (৪৯ খ্রী তিনি সম্রাটকে বোঝাতে সক্ষম হলেন যে প্রিয়তমা হবু-স্ত্রীর ছেলে নীরোকে তার ‘দত্তক’ নেয়া উচিত। প্রেম-কাতর ক্লডিয়াস জেনে-বুঝেই এ বিপজ্জনক প্রস্তাবে রাজি হন।
শুরু হয় নীরোর উৎত্থান-পর্ব।
আরো পাঁচ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করে ক্লডিয়াস মারা যান। রীতি মাফিক বড়-ছেলে নীরো-ই সিংহাসনে বসেন। নীরোর বয়স তখন আঠারো বছর।
ভারতের শ্রেষ্ঠতম মুঘল সম্রাট আকবরের মত অস্টাদশ বর্ষীয় নীরোর বদলে রোমেও, কার্যত রাজ্য চালাচ্ছিলেন তিন-জন : প্রধান সেনাপতি-অ্যাফ্রানিয়াস, শিক্ষক-সেনেকা এবং মা-এগ্রিপ্পিনা। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সুতেনিয়াস লিখেছেন: তখন পর্যন্ত নীরো অত্যন্তÍ কোমল স্বভাবের ছিলেন। তার এ দাবীর সপক্ষে একটি কাহিনী শুনিয়েছেন সুতেনিয়াস। গল্পটা এ-রকমঃ রোমের প্রিফেক্ট (মেয়র) সেকান্ডাসকে তারই এক গৃহভৃত্য হত্যা করে। শাস্তি স্বরূপ ঐ ঘরের ৪০০ দাসকে একত্রে ফাঁসি দেয়া হয়। তরুণ-নীরো এই দৃশ্য দেখে এতই বিচলিত হন যে ৪ দিন ৫ রাত মদে ডুবে থেকেও সেই বিভৎসতা ভুলতে পারেন নি।
কিন্তু এই কোমল-নীরোর কঠিন-নীরো হতে সময় লাগেনি। এক বছরের মাথায় মারা যায় বৃটানিকাস; দু’বছরে অ্যাফ্রানিয়াস। ঘনিষ্ঠতা হারান সেনেকা এবং এগ্রিপ্পিনাকে বোঝানো হয় যে সম্রাট সম্রাটই। তিনি কারো পিতা বা সন্তান নন। দেখেশুনে পা ফেলা উচিত তার।
কিন্তু এন্টনীর মেয়ের ঘরের নাতনী এগ্রিপ্পিনা এত সহজে হার মানার পাত্রী ছিলেন না।
ইতিমধ্যে নীরো ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন প্রাসাদ-সুন্দরী আক্তির রূপে। তাকে বিয়ে করতে উদ্যোগী তিনি। রাজ ঐতিহ্যে ক্রীতদাসীকে বিয়ে করা সম্ভব ছিল না। এগ্রিপ্পিনাও সুযোগ বুঝে নীরোর পত্নী (ক্লডিয়াসের মেয়ে) অক্টাভিয়াকে দলে টেনে বললেন : অভিজাত রোমান রুচি কখনো গ্রীক রসনায় তৃপ্ত হয় না।
আভিজাত্য নিয়ে খোঁটা দেয়ায় নীরো চরম অপমানিত বোধ করলেন। প্রকাশ্যে বেরিয়ে এলো তার হিংস্র নখর।
বিষ প্রয়োগ করা হল এগ্রিপ্পিনাকে। ভাগ্যগুণে, তার বদলে একজন দাসী মারা গেল। সতর্ক এগ্র্রিপ্পিনা রাজবাড়ি ত্যাগ করে নিজের প্রাসাদে উঠলেন। এক রাতে সে-বাড়ির ছাদই ভেঙ্গে পড়ল। এবারও ভাগ্য সহায়তা করল এগ্রিপ্পিনাকে। আড়াআড়ি পড়া একটি খুঁটির আড়ালে বেঁচে গেলেন তিনি। প্রাণের মায়ায় রোম ছেড়ে সিসিলিতে পালালেন এগ্রিপ্পিনা। একদিন সমুদ্র ভ্রমণের সময় তার প্রমোদতরী ফুটো হয়ে গেল। দু:সাহসী এগ্রিপ্পিনা ২ মাইল সাঁতরে পাড়ে উঠলেন। কিন্তু আর ধৈর্য ছিল না নীরোর। সরাসরি গুপ্তঘাতক পাঠিয়ে জন্মদাত্রী মাকে খুন করান তিনি।
ঘটনার সিলসিলা সিনেটকে দারুন ক্ষুব্ধ করে। কারণ, এগ্রিপ্পিনা-জুনিয়র ছিলেন সম্রাট ক্যালিগুলার বোন, সম্রাট ক্লডিয়াসের স্ত্রী এবং বর্তমান সম্রাটের মা। এত অভিজাত রক্তে কারোই হাত কলুষিত হওয়া উচিত নয়। কেউ যদি তা করে, তো সেটা রাজ্যের জন্য শুভ হতে পারে না।
শুরু হল সিনেটের সাথে দ্বন্দ্ব। কিন্তু দাম্ভিক নীরো সিনেটের অহমকে মাটির সাথে গুড়িয়ে দিলেন চারপাশে এমন কুৎসিত ও ভয়ংকর সব শয়তান ও অপশক্তিকে জড় করে যে, শিক্ষক সেনেকাও পালিয়ে বাঁচতে চাইলেন। নীরোর জড় করা বদমাশদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল তার মায়ের প্রেমিক তাইজেলিনাস-- এগ্রিপ্পিনার সাথে অবৈধ সম্পর্কের কারণে যাকে দ্বীপান্তর দেয়া হয়েছিল। নীরো তাকে নির্বাসন থেকে শুধু ফিরিয়েই আনলেন না, রাজরক্ষী বাহিনীর প্রধান নির্বাচন করলেন। প্রাণের ভয়ে মুখ বুজলেন সিনেট সদস্যরা।
শুরু হল নীরোর চরম স্বেচ্ছাচারিতার পরম বাড়াবাড়ি।
আক্তিকে বিয়ে করতে না পেরে তাকে উপ-পতœী করলেন নীরো। একই সাথে প্রেম শুরু করলেন অগাস্টান-যুগের ‘হেলেন’ বলে খ্যাত ওথোর স্ত্রী পপ্পিয়া স্যাবিনার সাথে।
পপ্পিয়া ছিলেন রূপশ্রেষ্ঠা ও কূটশ্রেষ্ঠা। প্রথম স্বামী রুফিয়াস ক্রিসপিনাসের ছেলেকে নিয়ে তিনি সেনাপতি ওথোর ঘর করছিলেন। তার রূপের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল পারস্য থেকে স্পেন পর্যন্ত। ৫৮ খ্রিস্টাব্দে ওথোকে লসিতানিয়ার গভর্ণর করে পাঠান নীরো এবং পপ্পিয়াকে নিজের রক্ষিতা করেন। স্ত্রী অক্টাভিয়া এবং প্রেমিকা আক্তির সামনেই পপ্পিয়ার সাথে প্রকাশ্য-প্রণয় শুরু হয়। প্রতিবাদ করেন অক্টাভিয়া। শাস্তিস্বরূপ স্ত্রীকে প্রথমে সিসিলিতে নির্বাসনে পাঠান এবং পরে হত্যা করান। আইনানুযায়ী পপ্পিয়াকে বিয়ের পথে আর কোন বাধা রইল না। পরের বছর (০০৬২-তে) আনুষ্ঠানিক ভাবে পপ্পিয়াকে বিয়ে করেন নীরো। ৬৩-তে তাদের একটি কন্যা জন্মায়। রোমান সাম্রাজ্যে এর অর্থ ছিল : পপ্পিয়ার একচ্ছত্র আধিপত্যের রাজনৈতিক স্বীকৃতি। যদিও, বছর পেরুতেই না পেরুতেই নিমোনিয়ায় মারা যায় মেয়েটি। নীরো এজন্য পপ্পিয়ার পূর্ব পক্ষের ছেলে জুনিয়র রুফিয়াসকে দায়ী করেন এবং তাকে গলা টিপে হত্যা করেন।
এভাবেই নীরোর ক্ষমতা পাকাপোক্ত হয় এবং ধীরে ধীরে নিজেকে তিনি ঘোড়দৌড়, সঙ্গীত, কাব্য, অভিনয়, নৃত্য ও পার্টিতে ভাসিয়ে দিতে শুরু করেন। বিচিত্র লালসা এবং বিকৃত যৌনাচারে লিপ্ত হন তিনি। বলা হয়, ভোগবাদিতাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর ছিলেন নীরো। তার শিল্পপ্রীতি ও নাটক সমকালে হাসির উদ্রেক করলেও কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায়নি। তাইজেলিনাস নিয়ম করে দিয়েছিল যে নাটক শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ আসন ত্যাগ করলে তাকে মৃত্যুদ- দেয়া হবে। এমন উদাহরণও আছে, এক সম্ভ্রান্ত গর্ভবতীর প্রসব যন্ত্রনা শুরু হলেও তাকে বাড়ি যেতে না দেয়ায়, জনতার মাঝেই তার সন্তান ভুমিষ্ট হয়। নীরো ও তার বন্ধুরা সে-দৃশ্য উপভোগও করেন।
তার খ্যাপামির চূড়ান্ত ছাপ দেখা যায় পোষাক নির্বাচনে। বেল্ট ছাড়া খাটো টিউনিকের প্রচলন ঘটান তিনি এবং খালি পায়ে দরবারে আসতে শুরু করেন। সেনেকা প্রতিবাদ করায় তাইজেলিনাস তাকে পদত্যাগে বাধ্য করে; যদিও নীরোর ইচ্ছে ছিল গুরুকে দর্শনীয় মৃত্যুদন্ড দেয়ার।
তার জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটানো হয় ৬৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাইয়ে। রোম শহরে আগুন লাগে। আগুন ৬ দিন স্থায়ী হয়। রোমের ১৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩টি ছাই হয় এবং ৭টির ঘরবাড়ী ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। বলা হয়, এ আগুন নীরোই লাগিয়েছিলেন ‘দ্বিতীয় ইলিয়াড’ রচনা করার মানসে। ফলে ঐ বিখ্যাত উক্তির জন্ম হয় যে রোম যখন পুড়ছিল, নীরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল।
যাই হোক, এই অগ্নিকান্ডের জন্য নতুন ধর্মাবলম্বীদের দায়ী করেন নীরো এবং নির্বিচারে খ্রিস্টান হত্যা শুরু হয়। ‘বাগান অন্ধকার থাকা উচিত নয়’ বলে শত শত খিস্টানদের রাতভর পুড়িয়ে মারা হয়। সার্কাস ম্যাক্সিমাসে ক্ষুধার্ত পশুর মুখে ছেড়ে দেয়া হয় নীরিহ খ্রিস্টানদের। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, পুড়ে যাওয়া নগরীর বেশিরভাগই দ্রুত নীরোর হাতেই পুনর্গঠিত হয়। যদিও এ তথ্যটি পশ্চিমা ঐতিহাসিকরা প্রায় উল্লেখই করেন না।
৬৫ খ্রিস্টাব্দে নীরোর বিরুুদ্ধে প্রথম প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে। ষড়যন্ত্রের গোপন নকশা প্রণয়ন করেছিলেন পিসো এবং সেনেকা। ক্রুদ্ধ নীরো বহু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে নির্বাসনে পাঠান কিংবা মৃত্যুদন্ড দেন। পিসো এবং সেনেকা আতœহত্যা বেছে নিতে বাধ্য হন। তাইজেলিনাসের কুবুদ্ধিতে নীরো এসময় ট্রিজন-ল তৈরী করেন। শত শত ব্যাক্তি এই কালা-কানুনের শিকার হয়। অগাস্টানদের বড় অংশই প্রাণ হারায় তার নিপিড়নে। সমকালের সবচেয়ে খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী, পৃথিবীর প্রথম উপন্যাস রচয়িতা বলে যার খ্যাতি-- সেই ‘সৌজন্যের-ধ্বজাধারী’ পেত্রোনিয়াসকেও আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয় (৬৬ খ্রি:। দেখুন: কুয়ো ভাদিস, ঐতিহ্য)।
নীরোর বয়স তখনো তিরিশ পেরোয়নি বলে ‘ট্রিজন-ল’কে তিনি খেলা হিসেবে নিয়েছিলেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রথমে খুব প্রশংসা করে ভ্রমণে পাঠানো হত। তারপর আদেশ যেত কোথাও না নড়ার। প্রকারান্ডরে পালাবার উপায়ও থাকত না কারণ আদেশের আগেই শুরু হয়ে যেত কঠোর নযরদারী। ব্যক্তিত্ব সম্পন্নরা আতœহত্যা করে মান বাঁচাতেন। দুর্বলেরা ফাঁসিতে ঝুলত।
জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটি করেন নীরো পরের বছর। আর্মেনিয়া জয় করে পারস্য পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন বিশ্বস্ত পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার কারবুলো (৬৭ খ্রি। তাইজেলিনাস নীরোকে ধারণা দেয় যে, কারবুলোর জনপ্রিয়তা বিপদের কারণ হতে পারে। ঈর্ষাতুর নীরো তার দক্ষতম সেনাপতিকে রাজধানীতে ডেকে এনে হত্যা করেন।
রাজ্যে শুরু হয় বিশৃংখলা । দিকে দিকে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। দ্রোহের সূচনা করেন গ্যালিয়ার সেনাপতি ভিনদেক্স। কিন্তু ভাগ্যদেবী ভিনদেক্সের সহায় ছিল না। জার্মান-ফ্রন্টে পরাজিত হয়ে ভিনদেক্স আত্মহত্যা করেন। নীরো তখন অলিম্পিক-ক্রীড়ায় ব্যস্ত থাকায় ধিকিধিকি জ্বলে ওটা এসব তুষের-আগুনকে আমলেই নেন নি।
অতিষ্ঠ প্রবীন সেনাপতি গলবা শেষপর্যন্ত বিদ্রোহ শুরু করেন (৭১-বছর বয়সে)। গলবাকে ইন্ধন যোগায় সেনাপতি ওথো। গলবা সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন বলে সম্রাটের বিরুদ্ধে তরবারী কোষমুক্ত করার আগে সিনেটে প্রস্তাব পাঠায় যেন রোমকে রক্ষার জন্য তার যোগ্যতাকে কাজে লাগানো হয়। বর্ষীয়ান সেনাপতির চাতুর্যে মুগ্ধ সিনেট সাহসের সাথে তাকে এগিয়ে আসার ‘সবুজ সংকেত’ পাঠায়।
গলবা অগ্রসর হচ্ছে জেনেও নীরো মত্ত থাকলেন সঙ্গীত, কাব্য, ক্রীড়া এবং প্রমোদ-অনুষ্ঠান নিয়ে। বন্ধুরাও পালাচ্ছে দেখে ৬৮’র জানুয়ারীতে তিনি যেন বাধ্য হয়ে রোমে ফিরে আসেন। তদ্দিনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেছে। সিটি-রক্ষীপ্রধান নিম্ফিডাস স্যাবিনাস এবং উত্তর আফ্রিকার সেনা-প্রধান মেইসারও বিদ্রোহে শামিল হয়েছেন। সিনেটের ভেতরেও প্রকাশিত হচ্ছে চরম গোলযোগ ও অসন্তুষ্টি ।
ওদিকে, ক্ষিপ্ত ও ক্রুব্ধ ওথোর শপথ ছিল স্ত্রী-ছিনতাইয়ের প্রতিশোধ নেবেনই। সে-সুযোগ সামনে আসতেই ওথো আর দ্বিধা করেনি। ৬৮ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে ওথোই হয়ে দাঁড়ালেন প্রধান নিয়ামক।
এই চতুর্মুখী বিপদে দিশাহারা নীরোকে সান্তনা ও বুদ্ধি দিয়ে বাঁচাতে পারত যারা-- ইতিমধ্যেই তাদের প্রায় সবাইকে তিনি হয় হত্যা করেছেন, নাহয় দেশত্যাগে বাধ্য করেছেন। বদমাশদের-রাজা তাইজেলিনাস (রোমের মেয়র ও নগররক্ষী প্রধান) ছিল শেষ ভরসা। কিন্তু চরম অসুস্থতায় সেও তখন শয্যশায়ী। নীরো প্রায় পাগল হয়ে কখনো নির্দেশ দিলেন-- আবার রোমে আগুন লাগাও; কখনো বললেন-- চলো, মিশর অভিযানে রওয়ানা হবো।
যাই হোক, দুর্যোগের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে সিনেট শেষে নির্দেশ জারী করল: মাতৃহন্তাকে শাস্তি পেতে হবে। সেই দন্ডাদেশ কার্যকর হয়েছিল শহরের অদূরে, তারই এক ভৃত্যের বাড়িতে; জুনের ৯ তারিখ সকাল বেলা (৬৮ খ্রিস্টাব্দে) ।
আত্মহত্যার জন্য তার হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল খঞ্জর, যদিও সেটি নিজের বুকে বসাবার সাহস নীরোর ছিল না। শেষপর্যন্ত রাজভৃত্যদের একজন লাথি মেরে ছুরিটা তার গলায় বসিয়ে দিল। মৃত্যুর আগে তার শেষ বাক্য ছিল, ‘কোয়ালিক্স আর্টিফেক্ট পেরেইও’। --হায়! বিশ্ব জানুক: কত বড় এক শিল্পীর মৃত্যু হল!
...এ শুধু নীরোর জীবন কাহিনী নয়, রোমান যুগের বহু সম্রাটের ইতিহাসই এরকম অত্যাচার ও ভাঁড়ামীপূর্ণ। খিস্টধমের আনুষ্ঠানিক-প্রতিষ্ঠাতা যে কনস্টান্টাইনকে নিয়ে ভ্যাটিকান এত গৌরব করে যে, ‘তিনিই মুক্তিদাতা’, কারণ তার শাসনকালেই খ্রিস্ট-ধর্ম রাস্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি পায় (যদিও তিনি নিজে সেই ধর্ম গ্রহণ করেছেন বলে প্রমান পাওয়া যায় না, এবং সেই কনস্টান্টাইন-ই ছিলেন অতি-অত্যাচারী, নিপীড়নকামী এবং বহুভোগী। অধুনা মুক্তিপ্রাপ্ত হলিউড-ফিল্ম ‘গ্লাডিয়েটর’-এর ভিলেন সম্রাট মারকাস অরলিয়াসের (১৬১-১৮০) নির্মমতা তো পুরো বিশ্ববাসীকেই পুনর্বার স্তম্ভিত করেছে। নৃতত্ত্বের-জনক ইবনে খালদুন-তাই দুঃখ করে বলেছেন: রোমান সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগের সম্রাটদের শতকরা নব্বই-জনই ছিলেন চরম নির্যাতনকারী এবং সামাজিক ও ধর্মীয় বিচারে মানুষের অধম।
*
নীরোর জীবন থেকে একটি বিষয় পরিস্কার যে রাজা হিসেবে তিনি যাই করুন না কেন, তার অখ্যাতিতে তিনি অমর। কিন্তু ট্রয় ধবংসের জন্য যদি রাজা প্রিয়ামকে বা প্যারিসকে দোষী করা না হয়, শুধু একবার রোম-পোড়াবার জন্য নীরোকে এত গালি দেয়া কেন? নীরো ছাড়াও অনেকেই রোমে আগুন দিয়েছে। ইস্তাম্বুল পুড়েছে ৬ বার, এমনকি আমাদের ঢাকায়ও মাঝে মাঝে বস্তিÍ পোড়ে। ইতিহাসে তাকালে এও দেখা যায় যে ইচ্ছে করেই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে আলেক্সান্দ্রিয়া ও বাগদাদ লাইব্রেরি এবং যুদ্ধ এখনো পোড়ায় পূর্ব-তিমুর থেকে বাংলাদেশ হয়ে মেক্সিকো পর্যন্ত বহু দেশ। সে আগুন কেন লাগে, তাও সকলের জানা। প্রশ্ন জাগে, তাহলে একা নীরোর বিরুদ্ধেই একবার-মাত্র রোম পোড়াবার দায়ে এত বিষোদ্গার কেন? নীরোর চেয়ে বহুগুনে বেশি অত্যাচারী ছিলেন তারই পূর্বসুরী ক্যলিগুলা, অথচ শুধু নীরোই কেন রোষের পাত্র?
ইতিহাসের হাজারো রহস্যর মত এ প্রশ্নেরও জবাব নেই। মহাকাল এখানে স্ফিংসের মতই প্রাণহীন দর্শক; ভাষাহীন মর্মর!
=============>> ২২।০২।২০১৩।
২| ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ ভোর ৪:০৩
নিষ্কর্মা বলেছেন: খুব ভাল লাগল। অনেক কাহিনী আবারো নতুন করে মনে পড়ে গেল।
৩| ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১০:১২
লক্ষ্যহীন বলেছেন: মহাকাল এখানে স্ফিংসের মতই প্রাণহীন দর্শক; ভাষাহীন মর্মর!
©somewhere in net ltd.
১|
২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ২:৫২
আশিক মাসুম বলেছেন: কমেন্ট করে রাখলাম পরে পড়ব