![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কবিতাই প্রিয়। কিন্তু গদ্যও যে তার আরশিনগর। তাই নারীর চেয়ে যতই প্রিয় বলি দেশকে; প্রকৃতি হেসে বলেঃ ও হলো কথার কথা। এভাবেই একদিন প্রেমে পড়লাম ঢাকার... স্বপ্নের মত সুন্দরী এক বারবনিতা। থাক এসব ব্যক্তিগত প্যাচাল। তার চেয়ে আসুন পাঠ হোক...
চেনা চেনা শিখা
+++++++++++++++++++++
বিকেলে শহর ঘুরতে বেরুলাম। তারেক সতর্ক করে দিল ‘ডক্টর, হারিয়ে যেও না।’ বললাম, ‘আমি শহর চিনি।’
‘কিভাবে?’ সে বিস্মিত হয়ে বলল, ‘আগেও কেউ নিয়ে এসেছে নাকি?’
আমি জবাব না দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
টেক্সিওয়ালা আমাকে মানসিয়া স্বয়ারে নামিয়ে দিল।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। আমার বাঙালি চোখ দক্ষিণ দিকে সাগর দেখতে অভ্যস্ত বলেই কিনা জানি না, ভূমধ্যসাগরকে ঠিক সাগর মনে হচ্ছে না। তরুণীদের আধ-খোলা স্কার্ট হাওয়ায় উড়ছে। রাতের গভীরে যেমন জানালা গলিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিতে হাজির হয় শেফালীর সুবাস, তেমনি এই সপ্রতিভ যৌবনকে, জীবনের উজ্জল লীলা-চাঞ্চল্যকে উপভোগ করার উন্মাদনা আমায় নজরুলে ভাসিয়ে দিল। আপন মনে গুনগুন করে উঠলাম ‘নাইয়, ধীরে চালাও তরণী।’ কিন্তু কেমন করে মাঝি থামবে এখানে? এ স্রোত সুন্দরের এমন জান্তব অদম্য-টান, যা কাউকে থামতে দেয় না। নিঃসঙ্গতার তীব্র আলিঙ্গনে আমার শরীর বেতস পাতার মত কেঁপে উঠল ভূমধ্যসাগরের উতল হাওয়ায়।
‘ডু ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?’
আমি চমকে উঠলাম। বই ও ক্যামেরা হাতে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখতেই পাইনি। কোমল শান্ত মুখশ্রী ভারতীয় সৌন্দর্যে উজ্জল। স্বদেশের স্মৃতি আমাকে বাকহীন করে দিল।
সামলে নিয়ে জবাব দিলাম, ‘নট এক্সাক্টলি; বাট ফ্রম বাংলাদেশ। ইউ প্লিজ।’ ‘ইন্ডিয়া। কিন্তু বাঙালী।’ খাঁিট নদীয়ার টানে হাত বাড়িয়ে দিল সে। ‘আমার নাম শিখা। পড়তে এসেছি। আপনি?’
আমি জবাব খুঁজে পেলাম না। যে সমুদ্র হাজার মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে, যার উপকূলে পরাজিত হয়েছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সেনাপতিরা, নারীরাই যার ইতিহাসের অক্ষরেখা, যার তীর আলো দেখিয়েছে পথহারা নাবিকদের, সে মাটিতে আমার পরিচয় কি? চিন্তা না করেই বললাম, ‘কিচ্ছু না। আমার কোন পরিচয় নেই।’
‘বুঝেছি-বুঝেছি, আপনি কবি। সে যাই হোন, আগে তো বসুন। নিন, চিনাবাদাম খান।’
মাতৃভাষার যাদু নাকি নারীর আকর্ষণ, জানি না, তার পাশেই বসলাম। সহসা মনে হল, এ নারী আমার জন্ম জন্মান্তরের চেনা। এ-সেই আইসিসের উত্তরসুরি, মায়ের মত যে আগলে রেখেছে বিশ্ব রমণীকুলকে। অথবা এ-সেই চির অচেনা, যার জিজ্ঞাসায় এখনো কেঁদে ফিরেছে অতৃপ্ত বেদনাঃ আমি যার নূপুরের ছন্দ...।
‘কি ভাবছেন?’
এত সপ্রতিভ তার জিজ্ঞাসা যে আমি চিন্তা না করেই দার্শনিক হয়ে উঠলাম। ‘ভাবছি, কেন এসেছি এখানে, তাই। এসেছি কি সেই ময়দান দেখতে, যেখানে দাঁড়িয়ে আটত্রিশ বছরের এক যুবক ঘোষণা করেছিল: সুয়েজ খাল মিসরের। এ দেশের মাটি ও মানুষের। আমরাই এর মালিক। যে লোকটির নাম গামাল আবদুল নাসের। মিসরের জনগণমনবন্দিত বিপ্লবী প্রেসিডেন্ট। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা।’
‘ইতিহাস বলতে চাচ্ছ? ওয়েল, আমার সাবজেক্টের সাথে মিল আছে। দাঁড়াও, ভাল করে বসে নিই আগে; তারপর শুনি।’
আকাশে চাঁদ উঠে এসেছে। মান জোছনা আর বিদ্যুতের আলোর মিশ্রণ পরিবেশকে করে তুলেছে পাংশটে। নিজের দেশ থেকে তিন হাজার মাইল দূরের সৈকতে অপরিচিত একটি মেয়ে আমারই ভাষায় কথা বলছে। অনুমতির তোয়াক্কা না করেই নেমে এসেছে আপনি থেকে তুমিতে। এটা কি মাটির পৃথিবী, না স্বপ্ন?
মিসর বোধ হয় এমনই দেশ। যেখানেই যাই স্বপ্ন আমাকে আঁকড়ে ধরে। যা কিছুই দেখি তার মধ্যেই উজ্জল হয়ে ওঠে ইতিহাস। উত্থান-পতন ও জয়-পরাজয়ের গলি-ঘিঞ্জির মাঝে দীপ্ত হয়ে ওঠে মানুষের মুখ। যারা সত্যের জন্য সব ছেড়ে দিতে দ্বিধা করেননি; জনকল্যাণে কুরবানি দিয়েছেন নিজেদের সুখ ও বৈভব। কে পারে এর সামনে দাঁড়িয়ে কেবল বাস্তব জগতের বাসিন্দা হতে? এ-তো সেই হ্যাগার্ডের ‘হাশিশ’-যাতে দম দিলে হাজির হয় ‘রূপসী-হেলেন’!
‘বলো, শিখা আমার চোখে অপলকে চেয়ে আছে। ‘আমি তো চীনাবাদাম খেতে পারছি না।’
দু’জনেই হেসে উঠলাম।
‘সুয়েজ খালের পরিকল্পনা ফরাসিরা করেছে, একথা সত্য, কিন্তু সুয়েজ খাল আজকের নয়। লোহিত সাগরের সাথে ভূমধ্যসাগরকে যুক্ত করার প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেনোসেট-থ্রি, আজ থেকে তিন হাজার আটশো চল্লিশ বছর আগে। তিনি অবশ্য বর্তমান সুয়েজ বরাবরে খাল কাটেননি, লোহিত সাগরকে ভূমধ্যসাগরের সাথে যুক্ত করেছিলেন নীলনদের মাধ্যমে। এরপর, দুটি সমুদ্রকে পুনরায় যুক্ত করেন শেটি-ওয়ান, খ্রিস্টপূর্ব তেরোশো দশে। এই খাল আবার খনন করান নেকো-টু, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে। ইরানের বাদশাহ ক্যামবেসিস, যিনি পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে সিওয়া ওয়েসিসের পথে নিশ্চিহ্ন হয়ে যান, তার পুত্র দারিয়ুস-ওয়ান নতুনভাবে খনন করান এই খাল। মিসর তখন দ্বিতীয়বারের মত পারসিকদের অধীন। সিজারিয়ানকে নিয়ে ক্লিওপেট্রা যখন রোমে গিয়েছিলেন সিজারের ‘পতœী’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করতে, তখন যুদ্ধ বিগ্রহের ফলে এই খাল বন্ধ হয়ে যায়। রোমান সম্রাট ট্রেজান এবং মুসলিম সেনাপতি আমর ইবনুল আস আবার খালটিকে চালু করেন কিন্তু যতেœর অভাবে তা বন্ধ হয়ে যায়। দেড় হাজার বছর পরে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের নৌ-প্রকৌশলীরা আধুনিক প্রযুক্তিতে এ-খাল খননের উদ্যোগ নেন, কিন্তু হিসেবের ভুলে-তাদের সেই উদ্যোগ পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত, আঠারোশো ঊনষাটে ফার্দিনান্দ ডি-লেসেপসের তত্ত্বাবধানে খনন শুরু হয় এবং ঊনসত্তরের সতেরোই নভেম্বর সুয়েজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন খেদিব ইসমাইল।
ইতিহাসের এই বিরাট ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য নিমার্ণ করা হয়েছিল। কায়রে অপেরা হাউস, লাইট হাউস অব পোর্ট সাঈদ এবং কায়রো-ইসমাইলিয়া ডেজার্ট রোড। ইতালীয় নাট্যগুরু ভার্দিকে ‘আইডা’ মঞ্চস্থ করার দায়িত্ব দেয়া হয় যদিও ভার্দি সে দায়িত্ব যথাসময়ে শেষ করতে পারেনি। মিশর ও রোমের অমর প্রেমোপখ্যাত আইডা শঞ্চস্থ হয় উদ্ধোধনীর পরের বছর।
আমার হাতের ওপর আলতো হাত ছুঁইয়ে শিখা বলল, ‘তুমি কি ইতিহাস মুখস্থ করে এসেছো?’
লজ্জায় আমি মুখ বন্ধ করলাম। যদিও আমার মনের পর্দায় তখনো দুটি ছায়াছবি অভিনীত হচ্ছেঃ একদিকে, এক স্বভাষী যুবতীর সান্ধ্যকালীন উঞ্চতা; অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট নাসের এবং জেগে-ওঠা মিসরের ইনকিলাব ধ্বনি।
দক্ষিণ মিসর বা আপার ইজিপ্টের লোকদেরকে কায়রোবাসীরা ‘সাঈদী’ বলে ডাকে। ‘বালাদী’ বা গেঁয়ো শব্দের তুচ্ছার্থে ব্যবহ্নত অপভ্রংশ এটি। নাসের জন্মেছিলেন এক সাঈদী-পোস্টমাস্টারের ঘর্ েআর দশটা বালাদীর মত তারও ডাক নাম ছিল ‘গালাম’ মানে সুন্দর। ১৯৩৯-এ মিলিটারি একাডেমি থেকে কমিশনপ্রাপ্ত হন নাসের। ইসরাইল রাষ্ট্রের উদ্ভবকালীন যুদ্ধে তিনি ছিলেন এক দুঃসাহসী মেজর। একদিকে বাদশাহ ফারুকের স্বেচ্ছাচারিতা ও ভোগবিলাস, অন্যদিকে গুটিকতক জমিদারের হাতে সমস্ত জমির তালুকদারি তাকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। দেশকে বদলাবার সংকল্পে ‘ফ্রি অফিসারর্স মুভমেন্ট’ নামের আন্দোলন গড়ে তোলেন। এই গ্রুপ সমস্ত সেনাবাহিনীতে ছড়িয়ে পড়ে। রক্তপাতহীন ক্যু’র মাধ্যমে বাদশাহ ফারুককে বিদায় অভিবাদন জানানো হয়। জেনারেল নাগিব হন প্রেসিডেন্ট নাসের তখনও পর্দার অন্তরালে। কিন্তু ক্ষমতা নাগিবকেও অগণতান্ত্রিক করে তোলে। প্রধান সংগঠক নাসেরকে হত্যার অভিযোগ ওঠে নাগিব এবং মুসলিম ব্রাদারাহুডের বিরুদ্ধে। বিপ্লবের সহযাত্রী ছিলেন তারা। ফ্রি অফিসাররা নাসেরকে ক্ষমতায় বসান বায়ান্নাতে।
এরও আগে ঘটনা আছে। আঠারোশো বিরাশির বারোই আগস্ট বিনা আমন্ত্রণে ব্রিটিশরা যে-দেশে পা রেখেছিল, সেদেশে তারা একতরফা ছেড়ে দেবার ঘোষণা দেয় উনিশশো বাইশের আঠাশে ফ্রেব্রুয়ারি। ভারত বিভাগের মত মিসরকেও নানা কৌশলে ভাগ করার চেষ্টা করে তারাঃ আপার-লোয়ার, আলেক্স-কায়রো-সিনাই-আসওয়ান কিংবা খ্রিস্টান-মুসলিম প্রদেশে। কিন্তু সা’দ জগলুল, মোস্তফা কামেল এবং মোস্তফা আল নাহাসের মত দূরদর্শী নেতারা তাদের অশুভ পরিকল্পনা ভেস্তে দেন। সাধারণ মানুষও দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে আল আজহার রেখেছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সস্তা ফতোয়া দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টাই ছিল না মিসরে। গাদ্দারীর তো প্রশ্নই ওঠে না।
বাধ্য হয়ে ব্রিটিশরা নির্বাচন দেয়। নির্বাচনে সাদ জগলুল জয়ী হন। কিন্তু, যাই-যাবো করেও ব্রিটিশরা কালক্ষেপণ করে এবং পোষারাজতন্ত্রকে মদদ জোগায়। রাষ্ট্রের প্রধান আয়ের স্তম্ভ সুয়েজ খালের মালিক তখনও ইষ্ট-ফরাসী কোম্পানী। সুয়েজে অর্জিত টাকার যে শেয়ার মিসর, অর্থাৎ বাদশাহ ফারুক পান, তার সিংহভাগ ব্যয় হয় তারই মসনদ এবং ভোগবিলাস টিকিয়ে রাখার জন্য।
ফারুককে বিতাড়ণ করার পরও অবস্থার পরিবর্তন হল না। গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হল, কিন্তু রাজকোষ যে শূন্য! অথনৈতিক বিপর্যয় থেকে মুক্তির লক্ষ্যে প্রথমেই শ’খানেক পাশার হাত থেকে নাসের ছিনিয়ে নিলেন দুশো তেতাল্লিশ হাজার হেক্টর আবাদী জমি। ‘লাঙল যার-জমি তার’ নিয়মে বন্টিত হয় কৃষিজমি। বৈপ্লবিক পরিবর্তন এল এতে, কিন্তু পানির অভাব দেখা দিল। নীলের উজানে আরও পানি সংরক্ষণের জন্য পুরানো আসোয়ান বাঁধকে তিরিশ মিটার উঁচু করার জন্য আমেরিকা ও ফ্রান্সের কাছে অর্থ ধার চাইলেন নাসের। সম্মত হল তারা। কিন্তু ব্রিটিশদের চক্রান্তে বিশ্বব্যাংখ হঠাৎ করে ঋণ লেনদেনে অস্বীকার করে। বাধ্য হয়ে, সুয়েজ ক্যানেল জাতীয়করণের ঘোষণা দেন নাসের এই মানসিয়া স্কয়ারে। কারণ সুয়েজের একশো ভাগ অর্থ মিসর পেলে আসওয়ান ড্যাম প্রকল্পের বাইরের অর্থের প্রয়োজন হবে না। ...
শিখা আমার হাতের ওপর চাপ বাড়িয়েছে। আমি বাস্তবে ফিরে আসতে বাধ্য হলাম। আকস্মিক মিসরের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ যেন এসেছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরাইলের দ্বারা সে যুদ্ধ যেন আমাকেই গ্রাস করল। সে চেয়ে আছে দূর সমুদ্রের দিকে। চাঁদের আলোয় ফিনকে ওঠা ভূমধ্যসাগরের ঢেউ অব্যক্ত কামনায় আছড়ে পড়ছে আফ্রিকার পায়ে। হাজার হাজার তরুণ-তরুণী চন্দ্রাহত। আমার চোখের সামনে ক্লিওপেট্রার সেই ছবি ভেসে উঠল, যেখানে তিনি অনাবৃত বক্ষে শুয়ে আছেন বিশাল জাহাজের খোলা ডেকের সুসজ্জিত পালংকে, দেবী আইসিসের সাজে। তার চারপাশে ময়ূর পুচ্ছের পাখা দোলাচ্ছে ক্ষীণবসনা তরুণীরা। সখী চার্মিয়নের বাড়িয়ে দেয়া হাতে দ্রাক্ষারস। অদূরে, আরেক জাহাজ থেকে চেয়ে আছে বিস্মিত মার্ক এন্টনি! আমার শরীর কাঁপতে শুরু করল।
‘তোমার শীত লাগছে। চল, কফি খাই।’
শিখা আমাকে টেনে নিয়ে চলল উজ্জল আলোচিত কার্নিশে।
ভাবাবেগ অবশ্যই বিপজ্জনক, কিন্তু একজন শিল্পীর আবেগই তো সৃষ্টির প্রেরণা। শিল্পী কি করতে পারে যখন তা সংক্রামক ব্যাধির মত ছড়িয়ে যায়? আমার এ রোগের জন্য মূলত আমার বড় ভাইবোনরা দায়ী। আর দায়ী আমার সেই সকল বন্ধু ও শিক্ষক যারা আমার ইতিহাসপ্রীতিকে উসকে দিয়েছে। সাইফুল বা জহির কি কখন আমাকে রক্ষা করবে? কোথায় শামীমুল হক খান? কাই সে আলোর প্রদর্শক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, যিনি আমায় শিখিয়েছিলেন চোখ দিয়ে চোখের বাইরের জিনিস দেখতে? কোথায় আল মাহমুদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ আর শাহাবুদ্দীন আইমদ যাদের কাছে আমি জীবনের আনন্দ বুঝতে শিখেছি। আমি পারি সেই জোয়ারের টানকে অতিক্রম করতে, যা উৎসাহিত হয় হৃৎপিন্ডের ভেতর থেকে, সাইনাস-রিদমের মত?
‘তোমার কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।’ শিখা আমাকে মনে করিয়ে দিল। ‘অবশ্য ঠান্ডাই খেতে বলে ডাক্তাররা।’
‘ঠিক। যদি এসিডিটি থাকে।’ সম্মতি জানিয়ে বললাম আমি, ‘কিন্তু মনে হয় না আজ এসিডের অত সাহস হবে।’
‘ঠিক বলেছ। যেখানে চর্চিত হয়েছে সাপের বিষ, এসিডের মত তুচ্ছ তরলের সেখানে জায়গা কোথায়?’
‘অবশ্যই। আলেক্সের এম্পিথিয়েটারে গ্লাডিয়েটরদের লড়াই কমই হয়েছে। এটাই রোমের সাথে ফারাক। এরা বিজ্ঞান ভালবেসেছে। ভালবেসেছে কলাবিদ্যা। এর জ্যামিতির বির্তক, অংকের প্রতিযোগিতা কিংবা ধর্মের প্রতি তুলনা আলোচিত হয়েছে এদের থিয়েটারে। ট্রয় বা খরেজমের মত এ শহরের মৃত্যু হতে পারত বারবার, কিন্তু আলেক্স কখনোই মরেনি। মরেনি তার এই জীবনবাদিতার জন্য।’
‘তোমার সাথে আমি একমত, তবে পুরোটা নয়। যদিও আমার বলতে ইচ্ছে করছে যে ক্লিওপেট্রাই মৃত্যুর সব বিষ শুষে নিয়েছেন। যদি তাই হত, খুবই ভাল হত, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। এ শহরে রক্তের বন্যা বয়েছে বহুবার, আর তার স্রোতও কম তীব্র ছিল না।’
আমি জবাব না দিয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। ‘চাঁদ হেরিছে চাঁদমুখ তার’ গান ভেসে আসছে হৃদয় নদীতে। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা বিচের টেবিলে তার মুখে আলতো আদর বোলাচ্ছে ত্রয়োদশী চাঁদের হলুদ পুচ্ছ। আমিও আছি বলে সগর্জনে শাঁসাচ্ছে ভূমধ্যসাগর আমার মুখ খানিকটা অন্ধকারে ঢাকা। নইলে যে কল্পবিলাস আমার চেহারায় দোল খাচ্ছে, তা শিখাকে ভয় পাইয়ে দিত।
***
‘সম্রাট দ্বিতীয় টলেমী মহাবীর আলেক্সান্ডারের শবদেহ মেম্ফিস থেকে আলেক্সান্ড্রিয়ায় আনেন। অনেকের মতে, আলেক্্রান্ডার দ্য গ্রেট ‘প্রফেট’ ছিলেন। এ জন্যই তার মরদেহের বিশেষ মর্যাদা ছিল। এ-সম্মান প্রথম ভূলুন্ঠিত করেন চতুর্থ টলেমী, মার দ্বারা প্ররোচিত হয়ে। তারা আলেক্সান্ডারের মমিতে ব্যবহ্নত স্বর্ণ ও রতœসম্ভার চুরি করেন। জনশ্রুতি যে, এরপর থেকেই আলেক্সান্ড্রিয়ায় অশান্তি শুরু হয়।’ শিখা ইতিহাসে হাঁটতে শুরু করল আমায় হটিয়ে দিয়ে।
‘রানী ক্লিওপেট্রার পরাজয়ের পর ক্রুদ্ধ অক্টাভিয়ান। অগাস্টাস নামে বিশাল অংকের ট্যাক্স বসান আলেক্সান্ডিয়ার ওপর। একশো ষোলা খ্রিষ্টাব্দে বিদ্রোহ করে ইহুদিরা। কঠোর হাতে এদের দমন করেন রোম সম্রাট কারাকেল্লা। তিনি প্যাগান (পৌত্তলিক) ছিলেন। তার নির্দেশে আলেক্সের প্রায় সমস্ত পুরুষদের হত্যা করা হয়।
খ্রিস্টধর্মের উত্থানের এই সাংঘর্ষিক কালে রোম এবং আলেক্সে বহু নৃশংস ঘটনা ঘটে। বাইবেলের চার বর্ণনাকারীর অন্যতম সাধু মার্ককে হত্যা করা হয় বাষট্রি খ্রিস্টাব্দে। বলা হয়, এ থেকেই হানাহানির শুরু। রোম ও মিসরের মিশ্র ঐতিহ্যে গঠিত সেরাপিসের উপাসনা বন্ধ করতে বলেছিলেন তিনি। রোমান সম্রাটদের কেউই খ্রিস্টধর্মকে সহ্য করতে পারত না। এদের মধ্যে নিরো, পিয়াস ডেসিয়াস, সেভেয়াস ও ডায়োক্লেটিয়ান প্রত্যক্ষভাবে। আলেক্সান্ড্রিয়াকে মধ্যভূমিতে পরিণত করেন। দুশো চুরাশি সালের একটি মাত্র দাঙ্গায় নিতহ হয় এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার মানুষ। যাদের মধ্যে সাধু মিনা এবং সাধবী ক্যাথরিনও ছিলেন।
‘ঘটনা উল্টোদিকে মোড় নেয় যখন রোম-সম্রাট কনস্ট্যানটাইন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন এবং খ্রিস্টিয়ানিটিকে রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণা করেন। এতদিন খ্রিস্টানদেরকে হত্যা-নির্যাতন করা হয়েছে, এবার শুরু হল প্রতিশোধ। সেন্ট মার্কের সমাধিস্থলে পৃথিবীর প্রথম বাইবেল-ভিত্তিক ‘ক্যাচেটিয়ান স্কুল’ প্রতিষ্ঠিত করা হয়। সেরাপিয়ানদের ভক্তি-মন্দির ‘মৌসিয়ন’ এবং খ্রিস্টানদের ‘যুক্তি-বিদ্যালয়’ দুই মেরুতে অবস্থান নেয়।
‘আলেক্সান্দ্রিয়ার রাজ্যপাল অরিস্টিসের ভূমিকা ছিল দ্বিমুখী। আইনত, রোমানদের প্রতিনিধি হলেও, বিশ্বাসগতভাবে তিনি প্যাগান। নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে দুই মতাবলম্বীদের মাঝে ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান নিলেন তিনি। আলেক্স গির্জায় প্রদান পুরোহিত পেট্রিয়ার্ক সিরিলও একরোখা (তখনো পোপ-প্রথার প্রচলন হয়নি)। রোম, তুর্কী ও আলেক্সান্ড্রিয়ার পেট্রিয়ার্ককেই খ্রিস্টান জগতের তিন স্তম্ভ বিবেচনা করা হত।
ব্যক্তিগতভাবে সিরিল ছিলেন উগ্র ও ধর্মান্ধ। সেরাপিসের বিদূষী অধিকর্ত্রী হাইপেশিয়ার সামনে দাঁড়াবার যোগ্যতা তার ছিল না। তার এই ব্যর্থতা তাকে আরও ক্ষিপ্ত করে তোলে। রোমান সম্রাট থিয়োডেসিয়াসকে প্রভাবিত করে তিনি ‘সেরাপিস’ ও ‘মৌসিয়ন’ ধ্বংসের ডিক্রি লাভ করেন। আলেক্সে ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়। এক বা দুই রাতের মধ্যে ইহুদিসহ সব প্রাচীন ধর্মের লোককে হত্যা করা হয়। জ্যামিতি, যুক্তিবিদ্যা ও ইহিহাসের খ্যাতনামা পন্ডিত হাইপেশিয়া এদের মধ্যে অন্যতম। প্রকাশ্য রাস্তায় জবাই করে তার উলঙ্গ শরীর ঝুলিয়ে রাখা হয়। আলেক্সান্ডারের সমাধি সৌধের সামনে।’
‘তুমি কি জানো, এত কত লোক নিহত হয়েছিল?’ ‘দুঃখের বিষয়, আলেক্স গির্জা দুশো চুরাশি সালের খ্রিস্টান হত্যার সংখ্যা সংরক্ষণ করলেও তিনশো একানব্বইয়ের অ-খ্রিস্টান হত্যার কোন দলিল দিতে পারে না।’ শিখা লজ্জিত হয়ে বলল, ‘তুমি নিশ্চয়ই জানো?’
‘না, শিখা, আমিও জানি না। আমার ধারণা, কেউই জানে না। ইতিহাস তো বিজয়ীদের হাতেই রচিত হয়, তাই না? তবে আমি হাইপেশিয়া সম্পর্কে কিছু বলতে পারি, ব্যক্তিগতভাবে আমি যার ভক্ত।’
শিখা জবাব না দিয়ে ঘাড় কাত করে চেয়ে রইল। তার দৃষ্টিতে মুগ্ধতা না কৌতূহল বুঝতে পারছি না। চাঁদ আরও ওপরে উঠে এসেছে। দামাল হাওয়া উড়িয়ে নিচ্ছে তার রেশমি চুল। কখনো তা এমনভাবে জাফরি কাটছে যে তার মুখাবয়ব হয়ে উঠছে বর্তমান মিসরের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী মোনা-জাকির মত। হোটেলের লবি থেকে ভেসে আসছে কুলসুমের গান ‘ও সমুদ্র, এবার ঘুমাও। আমি তোমার আঁখিতে এঁকে দেব চাঁদের চুমু। অশ্রু মুছিয়ে দেব ভালবাসায়। ও জলপাই পাতা, ওঁকে কাঁদতে বারণ কর। আমি আসছি।’
‘হাইপেশিয়ার রূপের বর্ণনা আমি দেব না। তার চরম শক্র খ্রিস্টান ঐতিহাসকরা পর্যন্ত স্বীকার করেছেন, তার চেয়ে আকর্ষণীয়া নারী সে-সময়ে ছিল না। হতে পারে তিনি পরম রূপবতী ছিলেন। হতে পারে, তার গুণাবলীর বিভায় সাধারণ রূপই হয়ে উঠেছিল অসামান্য। যাই হোক, আজও তার নাম টিকে আছে তার অসাধারণ গুণের কারণেই। যদিও হাইপেশিয়ার সমাপ্তি ছিল সকরুণ।
‘আজকের দুনিয়ার খ্রিস্টানরাই সংখ্যায় অধিক এবং মিডিয়াও তাদের হাতে। সে কারণে বাইবেলের অসঙ্গতি প্রমাণ করা কঠিন যে খ্রিস্টের জীবনের বহু ঘটনা, ক্রশে-মৃত্যুর অসঙ্গতি এবং বিশেষ করে যিশুর মাত্র তিরিশ বছরের জীবনের প্রচারনায় প্রাপ্ত এত বিশাল সংখ্যক খ্রিস্টান ইত্যাদি না বিষয় প্রশ্ন না জাগিয়ে পারে না। পন্ডিত না হয়েও যখন কিছু কিছু অসঙ্গতি ধরতে পারে, বলাবাহুল্য, হাইপেশিয়াও পেরেছিলেন। সিরিলের সাথে তার দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়ে উঠেছিল কারণ ঐসব অসঙ্গতি তিনি আঙুর দিয়ে দেখিয়েও দিতেন।
‘হাইপেশিয়ার বৈকালিক বক্তৃতার পারিশ্রমিক বাড়িয়ে এক-মোহর করা হয়েছিল, তবু মানুষের ভিড় কমত না। তরুণেরা হয়ে উঠছিল অন্ধ ভক্ত। কুমারী হাইপেশিয়ার রূপ লাবণ্যেরও ভুমিকা ছিল তাদের কাছে। যে যাই হোক, এই দ্বিমুখী বিপদকে অতিক্রম করার ক্ষমতা আলেক্স চার্চের ছিল না।
‘এইসব ছাই চাপা আগুনে বাতাস যুগিয়ে ছিলেন অরিস্টিস। তিনি হাইপেশিয়ার শুধু গুণমুদ্ধ ছিলেন, তাই নয়, রূপমুগ্ধও ছিলেন। রাজনৈতিক চাতুরীর কোন এক পর্যায়ে হাইপেশিয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। জীবন রক্ষার স্বার্থে হাইপেশিয়া মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন সে-প্রস্তাব। শিক্ষক পিতা থিওনের বিরাগভাজনও হয়েছিলেন এ-কারণে। শুধু তাই নয়, জনসমক্ষে তাকে দেখতে বাধ্য করা হয়েছিল ‘ভেনাসের জন্ম’। তুমি জানো, গ্রিক পুরাণে বর্ণনা করা আছে যে সমুদ্রের কল্লোলিত তরঙ্গের ঘাড়ে উদ্ভূত ফেনা ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে ভেনাসের রূপ পরিগ্রহ করে এবং নগ্ন দেবী পানির ভেতর থেকে হেঁটে এসে আড়মোড়া ভাঙেন সৈকতে। যেন যুগ যুগ ঘুমের পর জেগে উঠেছেন ইভ এবং তার সেই জেগে ওঠার আনন্দ প্রকাশ পায় তার নর্মসখী নগ্ন মৎস্য কুমারীদের নৃত্যে।’...
শিখা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু সে চোখে আমি নেই। তার উদাস দৃষ্টি আলেক্সের সীমানা ছাড়িয়ে মিশেছে অচেনা কোন নভোমন্ডলে। কালকে অতিক্রম করে এমন কোন মহাকাশে তা পৌঁছছে, যার কাছে ঘড়ির কাঁটা মূল্যহীন।
আমি চুপ করে বসে রইলাম।
কখনো কখনো নীরবতাই অধিক বাঙ্ময়!
--------------->>
২| ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:১৯
*কুনোব্যাঙ* বলেছেন: আবারও ভালো লাগা
©somewhere in net ltd.
১|
২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১২:২৯
কুন্তল_এ বলেছেন: মুগ্ধ হয়ে পড়লাম। ইতিহাসের আঁকাবাঁকা পথ এত সরলভাবে লিখলেন! হাইপেশিয়া আমারও প্রিয় একটি চরিত্র। তাঁর জীবনীর উপর ভিত্তি করে একটা মুভি আছে - এ্যাগোরা ... দেখেছেন নিশ্চয়ই।

ভালো থাকুন।