নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ঝিলাম নদীর দেশ

আমি যত ভালোবাসি ততই উজ্জ্ল হয় সে তোমার নাম...

বুলবুল সরওয়ার

কবিতাই প্রিয়। কিন্তু গদ্যও যে তার আরশিনগর। তাই নারীর চেয়ে যতই প্রিয় বলি দেশকে; প্রকৃতি হেসে বলেঃ ও হলো কথার কথা। এভাবেই একদিন প্রেমে পড়লাম ঢাকার... স্বপ্নের মত সুন্দরী এক বারবনিতা। থাক এসব ব্যক্তিগত প্যাচাল। তার চেয়ে আসুন পাঠ হোক...

বুলবুল সরওয়ার › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রাগৈতিহাসিক যুগের অভিযাত্রী মনে হচ্ছে নিজেকে। ছোটখাটো ঝোপঝাড়, বাড়ীঘর, দালান-কোঠার পাশ কাটিয়ে গাড়ী আস্তে আস্তে সামনে এগুচ্ছে। আমি জানালা দিয়ে সামনে তাকিয়ে আছি- কখন হিমালয় দেখা যায়।

২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৩:৫৪

নাস্তা শেষ না হতেই টয়-ট্রেনের সিটি শোনা গেল। জয়ন্ত আর পরাগ আগেও এ পথে ভ্রমণ করেছে। আমাকে মাল-সামান বুঝিয়ে দিয়ে তারা দুজন ছুটল সীট দখল করতে। জলপাইগুড়ির কুলিরাও হার মানল চলন্ত ট্রেনের জানালায় ওদের অনুপ্রবেশের কায়দা দেখে।

একরাশ কয়লার গুড়ো ছিটিয়ে মিনি ট্রেন এসে লাইনে দাঁড়াল । দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই লোকের হুড়মুড়ি। জয়ন্ত আর পরাগের কল্যাণে আমরা বসার ঠাঁই পেলাম ডান দিকের জানালায়। মুখোমুখি বসেছে এক বাঙালী দম্পতি আর এক শ্বেতাঙ্গ তরুণ। কয়েক মিনিটেই তিনটে বগীতে দাঁড়াবার জায়গা রইল না। ট্রেন ছাড়ল ন’টা চল্লিশে। রাইট টাইমের পঁচিশ মিনিট পরে।

প্রাগৈতিহাসিক যুগের অভিযাত্রী মনে হচ্ছে নিজেকে। ছোটখাটো ঝোপঝাড়, বাড়ীঘর, দালান-কোঠার পাশ কাটিয়ে গাড়ী আস্তে আস্তে সামনে এগুচ্ছে। আমি জানালা দিয়ে সামনে তাকিয়ে আছি- কখন হিমালয় দেখা যায়। যে কোন হিলি--স্টেশনের পথে এই ছেলেমানুষী আমি দমন করতে পারি না। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি, কখন মেঘের নীলচে আভাসের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারবে পাহাড়। বার বার পাহাড়-না-মেঘ সংশয়ের দোলায় দুলতে দুলতে একসময়ে নিশ্চিত হয়ে দেখব : আহ্- সত্যি পাহাড়!

শিলিগুড়ি শহরের পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে ঘুম এসে গেল। কাল সারারাত ট্রেনের বার্থে কাটাতে হয়েছে। আজ থেকে ‘আসাম-বন্দ’ চলছে বলে ট্রেনে ছিল অকল্পনীয় ভীড়। তিন জনের রিজার্ভ বার্থে আঠার জনকে বসতে হয়েছে। সাধারণ মানুষের শেষ ভরসা রেলগাড়ী- বসতে না দিয়ে উপায় নেই। এমনিতেই দার্জিলিঙে বিদেশীদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রিত, তদুপরি আমি পরদেশী এবং মুসলমান; বাঁধা দেবার শক্তি কোথায়?

ধর্মের বিষয়টি মনে পড়তেই হাসি পেল আমার। পরশু যখন রবীন্দ্র-সদনে টিকেট বুক করতে যাই, কাউন্টারের বাবু কিছুতেই আমার নাম উচ্চারণ করতে পারলেন না। আমি যত বলি আমার নাম বুলবুল সরওয়ার, তিনি ততবারই জবাব দেন, কি বললেন- বাবুল সরকার? লোকটি হিন্দুস্থানী বা দক্ষিণী নয়, ভেতো বাঙালী। বার বার তার এই ইচ্ছাকৃত ব্যাঙ্গের জবাবে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আমার। বললামঃ আপনার যা খুশি লিখুন, ভট্টাচার্য লিখলেও চলবে। রেলের কর্মকর্তাটি এতই ধর্মানুরাগী যে আমার প্রতি সদয় হয় হাসলেন। কম্পিউটারাইজড টিকিট হাতে নিয়ে দেখি লেখা : বুলবুল দত্ত!

বাবুটির এই কান্ড শেষপর্যন্ত শাপে বর হল। আগেই বলেছি, আসাম বন্দের কারণে গাড়ীতে অত্যাধিক ভীড়। কুলির খবরদারীতে সীটের কাছে যদিও-বা পৌঁছাঁন গেল, কিন্তু বসার জায়গা মিলল না। একদিকে পরাগ নাগ আর তার বন্ধু জয়ন্ত ঘোষ, অন্যদিকে চমৎকার সিথি-সিঁদুরের বাঙ্গালী বৌদী আর তার স্বামী। সবারই টিকেট-কাম-রিজার্ভেশন আছে কিন্তু সীটের মা-বাপ নেই। আপাতত সীট মেলাতে গিয়ে বসার জায়গাটুকু হারাতে রাজী নন কেউ। সুতরাং দাঁড়িয়ে থাকতে হল।

ভ্রমণের সুবিধে হল আড্ডা। আড্ডা মানেই প্রতিবেশিদের মাঝে অনুপ্রবেশ। আমিও একসময় সেই জালে জড়ালাম। ঘন্টা দুয়েকের মাঝে শুধু বসার জায়গাই নয়, রাতের খাবারও পেলাম। আর পেলাম অন্তরঙ্গ হবার সুযোগ। সেই অন্তরঙ্গতা বন্ধুত্বে গড়াতে সময় লাগল না। যখন জানা গেল আমার নাম বুলবুল দত্ত- দ্বিধার শেষ মেঘটুকুও কেটে গেল।

তারই ফলাফল টয়-ট্রেনের এই টিম। এক রাত্রের ভেতরেই জয়ন্ত আর পরাগ বন্ধুতে পরিণত হয়েছে। ওরা পশ্চিম বাঙলারই ছেলে; তাই স্বতঃস্ফুর্ত। বস্তায় বেঁধে নিয়েছে চাল-ডাল, আলু-পেয়াঁজ, বাসন-কোসন; অগ্রীম বুকিং আছে হলিডে-হোমে। চমৎকার আয়োজন। আরও একজনের আসার কথা ছিল, আসেনি। আমাকে পেয়ে শূন্যস্থান পূর্ণ হয়েছে।

ইতিমধ্যেই ঘন কুয়াশার মত জেগে উঠেছে হিমালয়। আবছা ছায়ার সাথে একেঁবেঁকে মিশে গেছে আকাশের বুকে। পাহাড় দেখলেই মন শিহরিত হয় আমার। অলৌকিক রোমাঞ্চে কেঁপে ওঠে শরীর; দাঁড়িয়ে যায় গায়ের লোম। অব্যক্ত আনন্দে সবকিছু মধুর হয়ে ওঠে। সুতরাং ঝিমুনী কেটে যেতে সময় লাগল না। আমার উচ্ছ্বাসে জয়ন্ত আর পরাগ সামান্য সচকিত হয়ে বললঃ আরে, তুই পাহাড় দেখিসনি আগে ?

দেখবনা কেন? কিন্তু একবার দেখলেই কি দেখার আনন্দ কমে যায়?

ঠিক। পাহাড় যতবার দেখা যায়, ততবারই নতুন। সামনের সীট থেকে কথা বললেন বৌদি।

আমরা তিনজনেই খানিক চমকালাম। মহিলা সহজ গলায় বললেন ঃ আমরাও যাচ্ছি দার্জিলিঙ; হানিমুনে। অবশ্য বিয়ের তিন বছর পরে। কিগো, হিসেব ঠিক আছে তো? বলেই হেসে স্বামীকে জড়িয়ে ধরলেন।

ভদ্রলোক খানিকটা মুখচোরা। সংকুচিত হয়ে বললেন: ঠিকই আছে। তবে একমাস বেশি বলা হয়েছে।

ঐ হল। ভদ্রমহিলা পরিচয় করিয়ে দিলেনÑ আমার স্বামী। সুকুমার রায়।

দু’জনেই হাত তুলে নমস্কার করলেন। জয়ন্ত আর পরাগ আড্ডায় জমে গেল। আমি কান দিয়ে শুনছি আর চোখ দিয়ে দেখছি- কী আশ্চর্য এই দুনিয়া। জলপাইগুড়ি থেকে মনেই হয়নি যে আর দশ পা সামনে বাড়ালেই পৃথিবী-শ্রেষ্ঠ হিমালয় হাত ধরে টান দেবে। এই যে বনফুল শোভিত পাহাড়ী রাস্তা, দুধারে বাবলা ও রাবার বাগান, বিশ্ববিখ্যাত দার্জিলিঙ চায়ের শ্যামল বিস্তৃতি, তারই মাঝ দিয়ে চলা তিন-বগীর খেলনা ট্রেন- এর মধ্যে আত্মীয়তা কোথায়? এই যে দেশ থেকে পালিয়ে বিদেশ আসা এবং প্রকৃতির সীমাহীন বৈচিত্র্যের মাঝে লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা, এ পলায়নের অর্থ কি?

আমার মন ভাবাবেগে আপ্লুত হল। কিন্তু সামনের সীটে বসা বিদেশীটি আমাকে সে তন্ময়তায় ডুবতে দিল না। তার দেখার আগ্রহ প্রবল; জানার আগ্রহ প্রবলতর। কিন্তু সুকুমার বাবু বা বৌদি, কেউই বাংলা ভিন্ন অন্য ভাষায় স্বচ্ছল নন। শেষপর্যন্ত আমাকেই সে বগলদাবা করল। কারণ, ইতোমধ্যেই আমি মিথ্যা পরিচয় দিয়েছি যে, আমার বাড়ী আসামের করীমগঞ্জে আর ছোটবেলা থেকে মানুষ হয়েছি দক্ষিণে। বর্তমান ঠিকানা ঃ ভেলোর, মাদ্রাজ।

এন্ড্রুর বাড়ী স্কটল্যান্ড। তিন মাসের ছুটিতে ইন্ডিয়া ঘুরতে এসেছে। আপাতত পাটনা থেকে বোলপুর হয়ে দার্জিলিঙ।

এরপর কোথায় যাবে? আমি জানতে চাই

এন্ড্রু সে কথার জবাব না দিয়ে সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল ঃ দেখ দেখ, পাকা রাস্তা যাচ্ছে পাশাপাশি। আচ্ছা কোন্টা আগে পৌঁছুবে, গাড়ী না ট্রেন?

আমি বললাম ঃ গাড়ী পৌঁছুবে তিন থেকে চার ঘন্টায় আর ট্রেন ছ’ কিংবা সাত।

কেন, ট্রেনে এত দেরী হবে কেন? মিনি বলে?

হ্যাঁ সেটাও একটা কারণ। তবে সবচে’ বড় কারণ অতিরিক্ত চড়াই। কোন কোন সময়ে তো আমাদেরকে পিছন দিকেও যেতে হবে।

কি রকম? সামনে থেকে মুখ বাড়িয়ে জানতে চাইলেন গৌরী বৌদি।

পাহার বিশারদের মত গম্ভীর কন্ঠে বলল জয়ন্ত, আসলে বৌদি কোন কোন জায়গায় পাহাড় এত খাড়া যে ইঞ্জিন অত খাড়া চড়তে পারে না। সে সব যায়গায় জেড আকৃতিতে ভেঙ্গে ভেঙ্গে লাইন উপরে তুলতে হয়েছে। ট্রেন একবার সামনে থেকে বগী উপরে তোলে, আবার সাটল্ করে পিছনে ঠেলে।

ভারী মজার কান্ড তো!

এটাই ত মিনি-রেলের মজা। কেন আপনি উটি যান নি, বৌদি ?

না ভাই, উটি আর কোত্থেকে যাব, বল ? বিয়ের রাত থেকে প্লান করে আজ তিন বছর পর হানিমুন। তাও নিজের প্রোভিন্সে। অদ্দুর যাওয়া কি আর কপাল আমাদের?

বৌদির দীর্ঘশ্বাসে পরিবেশটা শীতল হয়ে গেল। এন্ড্রু ব্যাপারটা ঠিক ধরতে না পারলেও বিব্রতকর পরিস্থিতির ভয়ে চুপ।

রেল চলতে লাগলো ঝিকঝিক ঝকর-ঝকর গানের তালে। ছোটবেলায় পড়া একটা চমৎকার কবিতার কথা মনে পড়ল আমার ঃ

চলছে ট্রেন, দুলছে বগী, দুলছে তোমার চুল ...

আশরাফ সিদ্দিকী নতুবা আবুল হোসেনের লেখা। একই রকম আরেকটি কবিতা আছেÑ ‘শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিংÑ চলে ট্রেন, চলে ট্রেন’। এ ধরণের তীব্র বাস্তব কবিতাগুলো কোথায় হারিয়ে গেল? কেন হারাল?

দুপুর একটার দিকে টয়-ট্রেন এক বাজারে দাঁড়াল। যাত্রীরা হুড়মুড় করে তেলে ভাজার দোকানে ঝাপিয়ে পড়ল। আমার কাছে ছিল বিস্কুট, বৌদির কাছে নারকেলের পিঠে, জয়ন্ত ও পরাগের কাছে চিড়ে ভাজা আর এন্ড্রুর কাছে চা। ভুরি-ভোজন হয়ে গেল সবার। এন্ড্রু প্রথমে খেতে চায়নি। কিন্তু বৌদির চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত রাজী হয়ে গেল। গত দু’মাসে আগ্রা-দিল্লী ভ্রমন করে তার ভারত-ভীতি অনেকখানি কেটেছে।

পনের মিনিট পর গাড়ী হুইসেল বাজিয়ে সংকেত দিল। যাত্রীরা নিজের নিজের কামরায় উঠে বসল। ট্রেন কদ্দুর এগিয়ে আর সামনে এগোয় না। কি ব্যাপার? চল, দেখে আসিÑ বলতে বলতে নেমে গেল পরাগ আর জয়ন্ত। খানিক পরেই ফিরে এল পাংশু মুখে। বললঃ সামনে ডাউন ট্রেন একসিডেন্ট করেছে। রাস্তা ব্লক।

তাহলে ?

দেখা যাক, রেল কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই কিছু একটা করবে। এতগুলো যাত্রী তো আর এই পাহাড়ে পড়ে থাকবে না।

কিন্তু পরাগের কথায় কেউ খুব উৎসাহ বোধ করলাম না।

বিরক্তিকর অবসর কাটাতে আমরা গাড়ী থেকে নীচে নামলাম। চারদিকে তাকাতেই চোখে পড়ল ঘন সবুজের আদিগন্ত বিস্তার। পাহাড়ী রঙিন ফুল আর অর্কিডের মাঝখানে আকাশ ছোঁয়া দেবদারু আর পাইন। কড়া রোদের ঝিলিক ম্লান করে দিয়েছে গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ। পাহাড় কেটে জুম চাষ করছে ভুটিয়া, লেপচা ও নেপালীরা। বাতাসে শীতের আমেজ। অথচ নীচে জলপাইগুড়িতে দেখে এসেছি ঝাঁঝাল গরম। কেউ কি বিশ্বাস করবে এটাই সেই দীন-দুখী পশ্চিমবাংলা? সাতাশি হাজার আট শো তেপ্পান্ন স্কোয়ার কিলোমিটারে যেখানে পাঁচ কোটি চুয়াল্লিশ লক্ষ পঁচাশি হাজার পাঁচশ ষাট জন আদম সন্তানের অধিবাস! দারিদ্র, শঠতা আর অহংয়ের মিথ্যা বাগড়াম্বরে যার জীর্ণদশা হৃদয়বান পর্যটকের চোখ অশ্রুসজল করে। আর সেই রাজধানী কলকাতা! Ñ মনে পড়তেই আমার ঠোঁটে হাসি খেলে গেল।

কি দত্ত মশাই, হাসছ যে একা একা ?

আমার শহরের কথা মনে পড়ল। মানে কলকাতার কথা, তাই।

কেন, কলকাতা এমন কি অপরাধ করল, শুনি ?

না, কলকাতা আবার কি করবে ? করেছে কলকাতাবাসীরা, মানে আমরা।

ব্যাপার তো সুবিধের নয়, দত্তজি। তলে তলে তুমি দর্শন চর্চা শুরু করে দিলে ? আমাদের তো ভারী অসুবিধা। তা হোক, তা শোনাও দেখি কলকাতার কাহিনী। কিসে বলবে- কবিতায়, না গল্পে ?

কবিতায়।

যা ভেবেছিলাম। গল্পদাদুর আসরের মতÑ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন বৌদিÑ আমরা সাঁট করে বসে নেই। হ্যাঁ, এইবার পাঠ হোক। কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন আমাদের দত্তমশাই, শ্রীÑ

বৌদির রেডিও-রেডিও কান্ডে আশপাশের সবাই হেসে খুন। সুকুমার বাবু আর এন্ড্রু কথা বলতে বলতে সরে গেল একপাশে। দেবদারুর লম্বা ছায়ার নীচে বসে আমি, বৌদি আর পরাগ। জয়ন্ত খোঁজ নিতে গেছে আশেপাশের কোথাও চা মেলে কি না।

মিনিট দশেক পর ফিরে এল সে। শূন্য ফ্লাক্স। বলল, শালার ভুটিয়ারা আচ্ছা হারামী, একটা চায়ের দোকান পর্যন্ত নেই। কি করে সময় কাটবে?

দেখতে দেখতেই কেটে যাবে। বললেন বৌদি। শুধু রাগ না-করার প্রাকটিস জানতে হবে তোমায়, বুঝেছ?

বৌদির মুরুব্বীপনায় আরেকচোট হাসি।

জয়ন্ত হঠাৎ বলল, আচ্ছা বৌদি, তুমি কি পাশ?

ওমা, এ আবার কি প্রশ্ন? বৌদি আৎকে ওঠার ভান করে বল্লেন, আমি কিচেন পাশ।

জয়ন্ত হাত-পা নেড়ে প্রতিবাদ করে বললো, আরে দুষ্টমি ছাড়ো। ঠিক করে বলো, তুমি কি পাশ?

বলতেই হবে? বৌদি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, এম.এ. টা শেষ করেছিলাম কোন রকম। সেও তিন বছর আগে। তারপর বি.এড. দিতে দিতে বিয়ে।

বৌদির সুরে কোথায় যেন গভীর কষ্ট। আমরা সকলেই চুপ হয়ে গেলাম। আড্ডাটা জমলোনা আর।

***

প্রায় পাঁচ ঘন্টা পর ক্লিয়ার সিগনাল এল। পাহাড়ী উপত্যকায় তখন সন্ধ্যা নামছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। দিনের আলোয় কোথাও যাবার মজাই আলাদা। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে দার্জিলিঙ যেতে হচ্ছে রাত্রে।

আরও ঘন্টা খানেক পিছন যাও-সামনে যাও করে টয়-ট্রেন খানিকটা সমতলে পৌঁছুলো। বেশ দুরে দেখা গেল ঝিকিমিকি আলো। আমি বললাম, বৌদি, দার্জিলিঙ এসে যাচ্ছি।

সত্যি? দেখি দেখি- বলে ঝুঁকে পড়লেন জানালায়।

পরাগ হেসে অস্থির। আমি তার দিকে তাকাতেই সে বলল, আরে এটা তো কার্সিয়াং। এরপরে ঘুউম, তারপরে দার্জিলিঙ।

আমি অবাক হয়ে বললাম, মানে? দার্জিলিঙের পথে আরও শহর আছে নাকি?

তো আর বললাম কি! ঐ যে আলো দেখা যাচ্ছে, ওটা কার্সিয়াং। কার্সিয়াংও কম উঁচুতে না, প্রায় দেড় হাজার মিটার।

মানে পাঁচ হাজার ফিট?

তুই কিচ্ছু জানিস না? পরাগ পন্ডিতের মতো গম্ভীর হয়ে বললোঃ সী লেভেল থেকে টু থাউজান্ট ওয়ান হান্ড্রেড এন্ড টুয়েন্টি থ্রি মিটার অ্যালটিচুডে দার্জিলিঙ। বুঝেছিস?

মনে মনে হিসাব করতে লেগে গেলাম। এক মিটার সমান তিন দশমিক দুই আট ফিট। অর্থাৎ দার্জিলিঙের উচ্চতা ছ’হাজার ন’শ তেষট্টি ফুটের কাছাকাছি। তার মানে প্রায় সাত হাজার ফিট!...

ভাবতে ভাবতে ট্রেন প্লাটফর্মে প্রবেশ করলো। ঢং ঢং ঘন্টা বাজিয়ে স্বাগত জানালো কার্সিয়াং। ঘড়িতে দেখি- আটটা বাজে। মাথায় টুপি আর বিশাল বিশাল ওভারকোট পরা নেপালী যাত্রীরা উঠে এলো কামরায়। আমাদের গায়ে তখনো হাফ সোয়েটার।

মিনিট দশেক পর ট্রেন ছাড়লো। ঘুউম শহরের দুরত্ব এখান থেকে ৪০ কিলোমিটার। এই চল্লিশ কিলোতে ট্রেন তিন হাজার ফিট চড়াই উঠবে। ভাবতে ভাবতে চব্বিশ ঘন্টার ক্লান্তি যেন আঁকড়ে ধরলো শরীরটাকে।

কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। মানুষের কোলাহল আর গম্ভীর ঘন্টাধ্বনিতে চোখ মেলে তাকালাম। ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে অচেনা ষ্টেশনে। কামরার অনেক যাত্রি নেমে গেছে। বৌদি সুকুমার বাবুর কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছেন। সুকুমার বাবু ঘুমাচ্ছেন জানালায় ঠেস দিয়ে। পরাগ আর জয়ন্ত কাঁধব্যাগে মাথা দিয়ে অচেতন। ঠান্ডার প্রবল পরশে সবাই কুঁকড়ে জড়সড়ো।

ট্রেন ছাড়লো দেরী না করেই। আমার আর ঘুম এলো না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। ট্রেনের হুস-হুস শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। নিঃসাড় পাহাড়ী পথে ছুটে চলছে ফ্রাংকলিনের যন্ত্রদানব।

আমার মনে পড়লো, দার্জিলিঙ একসময় সিকিমের অংশ ছিল। এই ক্ষুদ্র পাহাড়ী গ্রামের নাম ছিল দোর্জে-লিং। দোর্জ মানে বজ্র এবং লিং মানে পাহাড়। সিকিমের আদিবাসী ভুটিয়া-লেপচারা স্থানটিকে ‘বজ্রের দেশ’ বলে পরিচয় দিত। এর কারণ দার্জিলিঙের বিশাল উচ্চতা ও অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সহাবস্থান। যে কোন আদিবাসীরাই আকাশকে মনে করে ঈশ্বরের আবাসস্থল। অতি প্রাকৃতিক সবকিছুকেই তারা ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে। দার্জিলিঙের চমৎকার প্রকৃতি ও উচ্চতা তাই দোর্জে-লিঙ নামে পরিচিত হয়।

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে লেপচা ও ভুটিয়াদের মধ্যে জাতিদ্বন্দ্ব যখন তীব্র হয়ে ওঠে, তখন সিকিমের সপ্তম চো-গিয়াল (ধর্মরাজা) চুন-ফুদ প্রতিবেশী (ভারত-প্রশাসক) বৃটিশের কাছে সাহায্যের আবেদন জানায়। গভর্ণর লর্ড বেন্টিংক। জেনারেল লয়েড (তখন ক্যাপ্টেন) ও মালদা জেলার বাণিজ্য প্রতিনিধি গ্রান্টকে সিকিম পাঠান কলহ মিমাংসার জন্য। লয়েড সমস্যা সমাধানে কৃতকার্য হন। পুরস্কার স্বরূপ, সমগ্র সিকিম ভ্রমণের সুযোগ পান তিনি। দোর্জে-লিঙ গ্রামটি দেখে লয়েড খুবই মুগ্ধ হন এবং জায়গাটি সম্পর্কে গভর্ণর জেনারেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন- ‘এই গ্রামটি পাওয়া গেলে তা যে কেবল বৃটিশ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের গ্রীষ্মাবাসের উপযুক্ত হবে তাই নয়, সামরিক ঘাঁটিও স্থাপন করা যাবে।’

অতঃপর গ্রামটি কেনার জন্য সিকিমের রাজাকে প্রস্তাব পাঠায় বৃটিশ। রাজা প্রথমে এটিকে হাতছাড়া করতে রাজী হন নি। কিন্তু বৃটিশের বার বার অনুরোধে শেষপর্যন্ত ১৮৩৫ সালে এক দানপত্র অনুসারে দোর্জে-লিঙ গ্রামটিকে বৃটিশের হাতে সমর্পণ করা হয়। শর্ত ছিল, এর বিনিময়ে গোর্খা-অধিকৃত দেবগাঁও ফেরত দিতে হবে এবং মোরাঈ অঞ্চলের নেপালী রাজা রামু প্রধানের সমস্ত বাকী খাজনা মিটিয়ে দিতে হবে।

দানপত্রে শর্তের উল্লেখ করেনি বেনিয়া বেন্টিংক। রাজা যখন জালিয়াতি টের পেলেন, তখন ইংরেজ পাহাড় চূড়ায় গেঁড়ে বসেছে। অনেক বাদানুবাদের পর শেষ পর্যন্ত বার্ষিক তিন হাজার টাকা খাজনার বিনিময়ে দোর্জে-লিংয়ের রফা হলো। কিন্তু এই সামান্য অনুপ্রবেশের পথ ধরেই ইংরেজ চিরাচরিত নিয়মে সিকিম দখল করে (১৮৯০) এবং আগ্রাসনের সেই পথ ধরে পৃথিবীর-ছাদ তিব্বতও স্বাধীনতা হারায় (১৯০৪)।

যদিও একথা অনস্বীকার্য যে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মত দোর্জে-লিঙেও ইংরেজরা আধুনিক তারও অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিল, তবু ইংরেজের এই সাম্রাজ্যবাদী আচরণকে মানুষ ঘৃণা করে। দার্জিলিংও তার ব্যতিক্রম নয়। ১৮৩৬ সালের দিকে যে গ্রামের জনসংখ্যা ১০০ জনের বেশী ছিল না, ১৮৫০-এ তাই বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় দশ হাজারে। দরিদ্র নেপালী ও ভুটিয়াদের সাথে বাংলাদেশ থেকেও বহু লোক দার্জিলিঙে বসতি স্থাপন করে। বৃটিশও এই নতুন জনপদে নানা রকম সুযোগ সুবিধা দেয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বনজ সম্পদের অবাধ ব্যবহার ও শুল্কমুক্ত বাণিজ্য। স্থাপিত হয় স্কুল, কলেজ, ক্রীড়াঙ্গন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। বেনিয়া বৃটিশের বাণিজ্য-নীতির কারন দার্জিলিঙ পরিচিত হলো বিশ্বের সেরা ‘চা’ উৎপাদন-কেন্দ্র’ হিসেবে।...



***

ট্রেন যখন দার্জিলিঙ পৌঁছালো, তখন রাত এগারোটা। আগেই শুনেছি, গুর্খা আন্দোলনে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলছে, তার ফলে এই পর্যটন শহরটি ভুতের-নগরীতে পরিণত হতে চলছে। কামরার বাইরে পা রেখেই ঘটনার সত্যতা টের পেলাম। সারা শহর অন্ধকারে ঢাকা। রাস্তায় বাতি আছে কি নেই। কেবল টহল পুলিশ আর সি.আর.পি’র খটখট আওয়াজ ছাড়া চারদিকে শুনশান।

শীতে ঠকঠক করছি আমরা। পরাগ বললো ঃ দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। হোটেলে যাওয়া যাক। চল- হাঁটি।

কিন্তু জয়ন্ত বাঁধ সাধলো ঃ কোথায় হাঁটব? তুই হলিডে হোম চিনিস?

না চিনলে কি যাওয়া যায় না?

কিভাবে?

পরাগ জবাব দিতে পারলো না। ইতিমধ্যেই তিনজন সি.আর.পি এগিয়ে এসেছে ঃ আবলোগ কিতনা দুর যায়েগা? কাঁহা যানা পরেগা?

ফরেষ্ট রোড মে। বললো জয়ন্ত। ক্যায়সা দুর হোগা?

পুলিশ তিনজন পরষ্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ী করে বললো ঃ নেহি। হামলোগ মালুম নেহী।

আমরা প্রায় বারো-চৌদ্দ জন যাত্রী উন্মুক্ত প্লাটফর্মে বসে কাঁপছি। এই সময় রেলের গার্ড যেতে যেতে ফিরে আসলো। বললো ঃ এত রাতে কুথায় যাবেন? রাতটুকু গাড়ীতে কাটিয়ে দিন, খুব ভাল হোবে। সকালে চলে যাবেন।

কিন্তু নিরাপত্তা? গুর্খারা চারদিকে তৎপর। যদি কোন বিপদ হয়?

গার্ড নিঃশব্দে হাসলো। হোবে না। হামি ভি গুর্খা আছি না। আপনারা শুয়ে যান, আমি বাইরে থেকে লক করে দেব।

অগত্যা বগীতে ঢুকে পড়লাম। সকালের সেই আরামদায়ক সীটগুলো এখন শক্ত কাঠের যন্ত্রণায় পিঠে খোঁচা দিচ্ছে। বাইরে ঘন কুয়াশা আর হাড় কাঁপানো শীত। যার ব্যাগে যে কাপড় ছিল তাই দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে ঘুমাবার চেষ্টা করলাম। আমার সামনে শুয়েছে এন্ড্রু, ওপাশে পরাগ আর জয়ন্ত। উল্টোদিকে সুকুমার বাবু আর বৌদি। একটা বেঞ্চীতে মালপত্র রেখে শিকল দিয়ে আটকানো হয়েছে। দরোজার কাছাকাছি সীটে শুয়েছে আরো তিনজন। তাদের বলা আছে, কোন বিপদ টের পেলে আগেই সাবধান করে দেবে।

সবার পক্ষ থেকে দিল্লীওয়ালা ভিজয় বাবুকে অনুরোধ করা হলো সি.আর.পি.কে বলে রাখতে। কারণ, ডিউটিরত সি.আর.পি’রা হিন্দুস্থানী। ভিজয় বাবুর মাতৃভাষাও হিন্দী। ভিজয় বাবুর অনুরোধে সি.আর.পি’রা এসে আমাদের আশ্বাস দিয়ে গেল ঃ কুছ প্রব্লেম নেহি। তুম লোগ আরাম্সে সো যাও।

কিন্তু ভয় আর উদ্বেগের মধে কি অত সহজে ঘুম আসে? অন্তত আমার আসতে চায় না। চোখ বুজে বুজে শুনলাম দূরের গীর্জা থেকে ভেসে আসা ঘন্টাধ্বনি। এই ঘন্টা বাজছে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তরে। এর বাহকেরা একদিন শান্তির বাণী নিয়ে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। আর আজ?...

শেষ রাতে প্রবল ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছি। সহসা কার হাতের স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি, বৌদি কাপড় ভাজ করে আমার গায়ের চারদিক গুঁজে দিচ্ছেন। আমি চমকে উঠে বসতে চাইলে তিনি ঠেলে শুইয়ে দিলেন। নিঃশব্দে তার হাত দুটি আমার ঘুম ভাঙা চোখ দুটিকে শাড়ী দিয়ে ঢেকে দিল।

ছ’টা বাজার আগেই গার্ড দরজা খুললো। সবাই উঠে বসলাম। দিনের আলোর সাথে মানুষের অন্তরঙ্গতা অনাদিকালের। কালকের সেই আশংকাজড়িত ষ্টেশনেই জেগে উঠলাম আনন্দ ও খুশির পরশ নিয়ে। ব্যথায় শরীর টনটন করছে। কিন্তু কুয়াশা-স্নিগ্ধ পাহাড়ের দিকে চাইতেই কোথায় মিলিয়ে গেল ক্লান্তি।

লজ্জা পাবার আগেই গৌরী বৌদি তার কাপড় চোপড় ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছেন। পরাগ ও জয়ন্ত কোথা থেকে প্রাতঃকৃত্য সেরে আসতেই গোটা দল বাইরে বেরুলো।

প্লাটফর্মে পা দিতেই কনকনে ঠান্ডা হাঁড় কাঁপিয়ে দিলো। হি-হি করে রাস্তায় উঠে আসলাম আমরা। শুধু এন্ড্রুই শীতকে ভ্রুক্ষেপ করছে না।

বাড়ীর গঠন দেখেই টের পাওয়া যায় যে দার্জিলিঙ বৃটিশদের গড়া। পুরোনো বাড়ীর অনেকগুলোতেই চিমনী আর চৌকো ঘুলঘুলি। প্রাচীন লন্ডনের বাড়ীগুলোর সাথে সাদৃশ্য রেখে তৈরী হয়েছিল এইসব গীর্জা আর গ্রীষ্মাবাস। ঘুমন্ত সকালেই সেই চিমনী থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। একটু পরেই চা কিংবা কফির গন্ধে জেগে উঠবে পর্যটকরা। নতুন অভিযাত্রার প্রস্তুতি নিয়ে রওয়ানা হবে মিরিখ কিংবা বিজনবাড়ী, কালিমপং বা সান্দাক্পু।

খানিকটা এগিয়েই আমরা পথের খেই হারিয়ে ফেললাম। চড়াই-উৎরাই পার হতে গিয়ে ইতিমধ্যেই শরীর ঘামতে শুরু করেছে। একটু আগে যে গরম কাপড়গুলোকে মনে হচ্ছিল রক্ষক, এখনই তা বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছে। সবাই দাঁড়িয়ে পড়লাম পথের মাঝখানে। একটু জিড়িয়ে নেয়ার ফাঁকে পথঘাট জেনে নেয়া যাক।

দূর থেকে পুলিশের একটা জীপ এসে গাঁ ঘেষে দাঁড়ালো। বেঁটে খাটো একজন অফিসার সোজা এন্ড্রুর দিকে এগিয়ে এসে বললেন ঃ পাসপোর্ট?

এন্ড্রু পিঠ থেকে হ্যাভারস্যাক নামালো। কোমর থেকে খুললে চামড়ার ছোট ব্যাগ। ভেতর থেকে পাসপোর্ট বের করে অফিসারের হাতে ধরিয়ে দিলো।

অফিসার পাসপোর্টটা ফেরত না দিয়ে বললেন ঃ এন্ট্রি-পারমিট?

আমার হার্টবিট বেড়ে গেল। আগেই শুনেছিলাম, দার্জিলিঙে বিদেশীদের প্রবেশ সংরক্ষিত। আমি যে বিদেশী তা এদের কেউ জানে না। তবু ঠান্ডা একটা অনুভূতি আমার মেরুদন্ড বেয়ে নীচে নামতে লাগলো।

পুলিশ অফিসার এন্ড্রুর কাগজপত্র দেখে সন্তোষ প্রকাশ করলো। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে জানতে চাইলাম ঃ আম্ব্যাসেডরা হোটেলটা কোনদিকে?

সোজা চলে যান। উপরে। বাস স্ট্যান্ডের কাছেই। কে যাবেন?

দাদা-বৌদি সামনে এগিয়ে এলেন। বললেন ঃ আমাদের বুকিং আছে। গতকাল থেকে।

তো আজ সকালে এলেন যে? ও বুঝেছি, টয়-ট্রেনে চেপেছিলেন। খুব ভোগান্তি গেছে তাইনা?

তা একটু গেছে বৈকি। আচ্ছা কোন অসুবিধা হবে না তো? ওরা বুকিং ক্যান্সেল করে দিলে ভারী বিপদে পড়বো যে!

বৌদির আশংকাকে হেসে উড়িয়ে দিলো অফিসার। কিস্যু না, কিস্যু না। গোর্খা আন্দোলনের ফলে এমনিতেই দার্জিলিঙে মানুষ আসছে না। তারপরে ট্যুরিস্ট ফিরিয়ে দেবে? হাঃ হাঃ হাঃ। হাসালেন মাইরী। আচ্ছা চলুন আমার সাথে, আমরা ওদিকেই যাচ্ছি, নামিয়ে দেবো’খন। আর তোমরা? আমাদের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, তোমরা কোথায় যাচ্ছ?

আমরা যাচ্ছি হলিডে হোমে। আনজুমানের পাশে। একটু দেখিয়ে দেবেন?

আরে ঐ-তো সামনে মসজিদ দেখা যাচ্ছে না, ওটাই আনজুমান। সোজা বাঁয়ে চলে যাও। ওখানে কোন বাঙালী বা মুসলমানকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে।

পুলিশ অফিসার গাড়ীতে গিয়ে উঠলেন। এন্ড্রুকেও সাথে নিলেন। সে যাবে উইন্ডমেয়ার হোটেলে। সেটাও ঐদিকে। যাবার সময় বৌদি বার বার বললেন ঃ দাদারা, এসো কিন্তু। আমি তোমাদের অপেক্ষায় থাকব।

গাড়ী ধোঁয়া উড়িয়ে চলে গেল। আমাদের সবার মন খারাপ। পরাগ অশ্লীল খিস্তি দিয়ে বললো ঃ শালা। মেজাজটাই খারাপ করে দিল।

আনজুমান থেকে দশ কদমও যেতে হোল না। হলিডে হোমের সিঁড়ি পাওয়া গেল। প্রায় একশ ধাপ পার হয়ে আঙ্গিনায় পৌঁছলাম। রেসের ঘোড়ার মত হাঁফিয়ে উঠছি সবাই। এক বুড়ো উঠান ঝাঁট দিচ্ছিলো। আমাদের দেখে অবাক হয়ে বললো ঃ তোমরা কারা?

জয়ন্ত পকেট হাতড়ে রিজার্ভেশনের কাগজ বের করে বললো ঃ আমরা কলকাতা থেকে এসেছি। এটা ইলেকট্রিক ডিপার্টমেন্টের রেস্ট হাউস না?

হ্যাঁ। কিন্তু তোমাদের তো কালকে আসার কথা। এই সাত সকালে কিভাবে এলে?

আর বলেন কেন, দাদা? জয়ন্ত কথার বাজার বসিয়ে দিলো ঃ উঠেছিলাম ট্রেনে। তো শালার ট্রেন মাঝপথে ছ’ঘন্টা লেট। রাত বারোটায় পৌঁছেছি স্টেশনে। অত রাতে কি করে আপনাকে খুঁজে পাই, বলুন? তাও বেরুচ্ছিলাম, শালার সি.আর.পি ঠেকিয়ে দিলো। তা দাদা রুম-টুম আছে, না দিয়ে দিয়েছেন কাউকে?

না-না, দিয়ে দেব কেন? চলো, তোমাদের ঘর দেখিয়ে দিচ্ছি।

নরম বিছানা-কম্বলে বসে মনে হলো কতযুগ পরে আরামের স্পর্শ পেলাম। ইচ্ছে হলো, সেঁধিয়ে যাই। কিন্তু পরাগ খুব টনটনে ছেলে। সবাইকে তাড়া লাগিয়ে বললো ঘুম. কি-রে, ঘুম কি? খেতে টেতে হবে না শালারা? কাল রাতে কিস্যু পেটে পড়েনি সে খেয়াল আছে?

খিদেটা এমনই আশ্চর্য অভ্যেস, মনে পড়লেই চাগিয়ে ওঠে। নিজের গরজেই সবাই উঠলাম। কেয়ার টেকার ততক্ষণে গরম পানি দিয়ে গেছে। হাত মুখ ধুয়ে তার কাছেই জানতে চাইলাম ঃ দাদু, চা-নাস্তা কোথায় মিলবে?

এখানেই পাবেন। অর্ডার দিলেই বাবুর্চী তৈরী করে দেবে। উপরে যেয়েও খেতে পারেন। ম্যাল পর্যন্ত যেতে হবে তাহলে।

‘ম্যাল’ কি? আমি পরাগের দিকে চেয়ে জানতে চাই।

আরে ম্যাল মানে বিবিদি বাগ। দার্জিলিঙের এসপ্লানেড। ওখান থেকেই চারিদিকটা দেখতে হয়। ও দাদু আপনাদের এখানে কি কি পাওয়া যাবে?

পরোটা হবে, মাখন-রুটি হবে, অমলেট হবে। কি চাই,

চা হবে তো? আমি সাগ্রহে জানতে চাই।

চা হবে না মানে? বুড়ো প্রাণ খুলে হেসে ওঠে, ভাল কথা কয়েছেন গো, দার্জিলিঙে চা হবে না তো চা হবে লন্ডনে?

পরাগ আর জয়ন্তও সে হাসিতে শামিল হলো। আমি মুখ নীচু করে ঘরে এলাম।

আধা ঘন্টা পরে নাস্তা পাওয়া গেল। ডিম-পরোটা আর চা। ক্ষুধার প্রচন্ডতায় প্রথমটায় কিছুই টের পাইনি। খানিক পরে জয়ন্ত ফিস ফিস করে বললো ঃ কবেকার পরোটারে, পরাগ?

পরাগও একই রকম মুখ নীচু করে জবাব দিল ঃ মনে হয় না এ বছরের।

নাস্তা শেষ করে চায়ের কাপ হাতে নিলাম। মুখে দিয়েই আমার চক্ষু চড়কগাছ। একে চমৎকার পানীয় বলা যেতে পারে বটে কিন্তু চা বলা যায় না। তবু চুপ করে আছি দুই বন্ধুর মুখ চেয়ে। দেখি, ওরা কি করে?

পরাগ চায়ে অনভ্যস্ত। তবু ‘দার্জিলিঙে এসেছি, চা খাবোনা মানে?’ এমনি বীরদর্পে চুমুক দিল। তরল পদার্থটুকু ভিতরে যেতে না যেতেই অবস্থা খারাপ। কোন রকমে বাথরুমে যেয়েই গলগল করে বমি। জয়ন্ত চালাক ছেলে। না খেয়েই বললো ঃ চল উপরে যেয়ে আবার নাস্তা করে নেব।

দরজায় তালা বন্ধ করার আগেই বুড়ো এসে হাজির। শূন্য কাপগুলো তুলে নিতে নিতে বললো, বোর্ডাররা কেউ এখানে খায় না। সবাই বড়লোক, উপরে যায়। আজ আমার কত জন্মের পূণ্যি, আপনার খেয়েছেন। তা দাদা, চা-টা ভাল হয়েছিল তো?

পরাগ কটমট করে বুড়োকে দেখলো একবার। বললো ঃ ভালো মানে ভালো, একেবারে অমৃত।

সরল বৃদ্ধ গলে গিয়ে বললো ঃ তা যা বলেছেন, আমার বাবুর্চি কালা হলেও কাজে ফাঁকি নাই। তিরিশ বছরের অভিজ্ঞতা। বুঝলেন না, তি-রি-শ বছর।

***

শহর হিসেবে দার্জিলিঙ বড় নয়। কিন্তু পাহাড়ী শহরের যে সব বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত, তার সবগুলোই বিদ্যমান। যদিও সাম্প্রতিক সশস্ত্র আন্দোলনে তার অনেকগুলোই ম্লান হয়ে গেছে।

হাঁটতে হাঁটতে ম্যালে পৌঁছলাম। বিশাল চত্বরের একদিকে কবি ভানুভক্ত আচার্যের আবক্ষ মূর্তি। ইনি সেই নেপালী কবি যিনি প্রথম মহাভারত অনুবাদ করেছিলেন। মূর্তির সামনে ফুলের শ্রদ্ধার্ঘ। পূজাও হয় মাঝে মাধ্যে।

ম্যালের চারদিকে রেলিঙ-ঘেরা। এটি দার্জিলিঙের সবচেয়ে উঁচু চত্বর। এর উপরে রয়েছে মন্দির। ম্যালের একদিকে লাইব্রেরী ও স্টেশনারী দোকান, অন্যদিকে হোটেল-রেস্তোরাঁ। উন্মুক্ত খাওয়ার টেবিলে ইতিমধ্যেই জড়ো হয়েছে বিদেশীরা। চত্বরের সামনে ঘোড়া ও খচ্চরের প্রদর্শনী। বাচ্চারা ঘোড়ার পিঠে উঠছে ছবি তুলতে। ছোট একটি বৃত্তের মধ্যে ঘুরে ফিরছে পাহাড়ি টাট্রু।

আমরা তিন বন্ধু নাস্তার জন্য রেস্তোঁরার দিকে এগুলাম।

দুর থেকে এন্ড্রু আমাদেরকে ডাক দিলো ঃ হাই ফ্রেন্ডস ! কাম হিয়ার।

আমরা এন্ড্রকে দেখে পুলক বোধ করলাম। সে বীফ-রোল আর কফি খাচ্ছিলো। জয়ন্ত বললো ঃ পরাগ, খাবি?

পরাগ আমার দিকে চেয়ে একটু দোটানায় পড়লো। আমি বললাম, আমার আপত্তি নেই।

নাস্তা খেতে খেতে এন্ড্রু বললো যে সে এখানে থাকছে না। বিকেল তিনটার জীপে কালিমপঙ যাবে। ওখান থেকে গ্যাংটক ও থিম্পু হয়ে ফিরবে কাঠমুন্ডু। সেখান তেকে প্লেনে কোচিন। কোচিন থেকে ত্রিবান্দ্রাম হয়ে বোম্বে। এরপর ব্যাক টু প্যাভেলিয়ন।

জয়ন্ত বললো ঃ তোমরা কি আবার এদেশ দখল করতে চাও নাকি? যে ট্যুর প্রোগ্রাম নিয়েছো তাতে তো সে রকমই মনে হচ্ছে।

এন্ড্রু হেসে বললো ঃ ও কথা ইংরেজদের কাছে জানতে চেয়ো। আমি ইংরেজ নই, আইরিশ। নিজেরাই আমরা পরাধীন; তোমাদের উপর আগ্রাসন চালাবো কোন সাহসে?

তার চাপা ক্ষোভে আমি বিস্মিত। সচরচার ইউরোপিয়ানরা ইমোশনাল হয় না। এন্ড্রকে তার ব্যতিক্রম মনে হল।

চা সেরে ম্যালের চারপাশটা ঘুরে দেখতে রওয়ানা হলাম। এন্ড্রু বসে রইলো একা। সে এখানে বসে মেঘ দেখবে। মেঘের রূপের নাকি শেষ নেই। তার প্রিয় সখ মেঘ দেখা।

আর কিছু দেখবে না? আমি জানতে চাইলাম।

হ্যাঁ, তোমাদের নেতা সি. আর. দাশের বাড়ীটা দেখবো।

তার আগ্রহের বিষয় শুনে চমকে উঠলাম। কজন বাঙালী আজ চিত্তরঞ্জন দাশের নাম জানে? আমার মনে পড়লো তার শেষ যাত্রার পদাবলী :

না ফুরাতে শরতের বিদায় শেফালী/ না নিভিতে আশ্বিনের কোমল দীপালী/ তুমি শুনেছিলে বন্ধু পাতা-ঝরা গান . . .

একটি জাতির স্বাধীনতার জন্য, সার্বভৌমত্বের জন্য, স্থিতির জন্য দেশবন্ধুর মত ব্যক্তির প্রয়োজন চিরায়ত। এঁদের অভাবেই আজ আমাদের দীনতা; সংকীর্ণতা। বন্ধুত্বের বদলে আমাদের হাতিয়ার হয়েছে বিদ্বেষ ও হিংস্রতা। প্রেমের বদলে প্রতিশোধ।

ম্যালের চারপাশেই দেখা গেল জীর্ণতা ও ধ্বংসের চিহ্ন। গুর্খা লিবারেশন ফ্রন্টের সহিংসতার চিহ্ন ছড়িয়ে আছে চারপাশে। ডানে একটা বিশাল ইন্ডাস্ট্রির পোড়া কংকাল। বোমা ও গুলির দাগ সর্বত্র। থেকে থেকে পড়ছে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর ছাউনি। শৈলাবাস হয়ে আছে সৈনাবাস। আমার মনটা বিষাদে ভরে গেল।

ততক্ষণে মেঘ নেমে এসেছে মাথার উপর। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ভিজে গেলাম তিনজনেই। দ্রুত রেস্টুরেন্টের দিকে ফিরে এসে দেখি, অনেক লোক ছাদের তলে আশ্রয় নিয়েছে। তার ভেতর থেকেই নারী কন্ঠের ডাক ভেসে এলো ঃ দত্ত বাবুরা, এই দিকে।

বৌদির কন্ঠে খুশির চমক বয়ে গেল সবার ভেতর। কাছে যেতেই তোয়ালে বের করে দিয়ে বললেন ঃ ছাতা ছাড়া কেউ পাহাড়ে বেরোয়? যতোসব উড়নচন্ডি! নাও, তাড়াতাড়ি মাথা মুছে ফেল। নইলে ঠান্ডা বসে যাবে।

দেখতে দেখতে বৃষ্টি ধরে এলো। আমরা চত্বরে নেমে এলাম আবার।

পাহাড়ী বৃষ্টির আমেজই আলাদা। কয়েক মিনিটের বৃষ্টিতেই সজীব হয়ে উঠলো চারদিক। বুনো ফুলের সোঁদা গন্ধে ভরে উঠলো বাতাস। পর্যটকরা হৈ হৈ করে রাস্তায়। দূর পাল্লার জীপগুলো রওয়ানা হলো আপন পথে। আমরা ম্যাল থেকে এ্যাম্বাসেডর হোটেলে উঠে এলাম। সুকুমার বাবু টেনে নিয়ে গেলেন নিজের রুমে।

বৌদি ইতিমধ্যেই ঘরটাকে সংসার বানিয়েছেন। তার মনের ভেতরে-বাইরে মধুচন্দ্রিমার ছোঁয়া। ঢুকেই বললেন ঃ সকালে মিষ্টি আনিয়েছি, খাবে তোমরা?

না করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু মিষ্টির মিঠা আস্বাদ শেষ না হতেই সুকুমার বাবু ড্রয়ার থেকে বোতল বের করে বললেন ঃ জমবে না এবার?

জয়ন্ত আর পরাগ লাফিয়ে উঠলো, আরে আগে বলবেন তো দাদা, আমাদেরগুলোও নিয়ে আসতাম।

তাই নাকি? আচ্ছা, কাল ককটেল হবে। আজ শুধু হুইস্কি-সোডা চলুক।

চলুক, চলুক। জয়ন্ত আর পরাগ পা উঠিয়ে বসে গেল। সুকুমার বাবু বের করলেন তাস। বললেন ঃ কি হবেÑ স্পেড না ব্রীজ?

আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। বললাম ঃ বৌদি, আমি একটু বারান্দায় গিয়ে বসি?

কেন, তুমি পার্টিসিপেট করছো না?

না সুকুমার দা, আমার খেলতে ইচ্ছে করছে না। আমি বরং প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখি।

যাও-যাও। কুছ পরোয়া নেই।

সুকুমার বাবু বললেন, তা গৌরী, তুমিও যাওনা ওনার সঙ্গে। নিচেই ঘুরে এসো না হয়, আমরা একটু ওয়ার্ম হয়ে নেই। শালার দার্জিলিঙে বহুত ঠান্ডা।

বারান্দায় চেয়ার টেনে বসতে বসতে লক্ষ্য করলাম বৌদির চোখ টলোমলো। রেলিঙে মাথা নেড়ে কেঁদে চললেন তিনি। আমি নিরবে দেখছি শৈল সুন্দরীর রূপ আর ক্রন্দসী-নারী। রোদবৃষ্টির এই অদ্ভুত লুকোচুরির জন্যই হয়ত এর নাম হয়েছিল প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড। কি আশ্চর্য বিস্ময় প্রকৃতির এই গোপন গহবরে। মানুষের মনে যেমন বিষন্ন দুপুুর।

দত্ত বাবু?

বৌদি ক’মুহুর্ত চুপ করে চেয়ে রইলেন। তারপর মৃদু গলায় বললেন ঃ কিছু মনে কোর না, ভাই। প্রেম করে বিয়ে করেছি বলে প্রতিবাদ করতে পারিনে। আমাকে ক্ষমা করো।

এসব বলে খামোকা নিজের কষ্ট বাড়াচ্ছেন কেন? আমি তো আপনাদের ব্যক্তিগত জীবনে আগ্রহী নই। বেড়াতে এসে আপনার সাথে যেটুকু পরিচয়, তাতে ক্ষমা চাইবার প্রশ্ন ওঠে না। আপনি অহেতুক সেন্টিমেন্টাল হচ্ছেন।

বৌদি কোন কথা বললেন না। চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে গেলেন। ফিরে এলেন এক প্যাকেট চিপ্স্ নিয়ে। কান্নাভেজা করুণ মুখে পাউডারের প্রলেপ বুলিয়েছেন। স্নিগ্ধ হাসিতে মুখ উজ্জ্বল করে বললেন ঃ এগুলো ধরো। আমি চা আনতে বলে দিয়েছি।

আমি হতবাক।

বৌদি হেসে বললেন ঃ কি হলো, প্রেমে পড়েছো নাকি? কিন্তু ভরদুপুরে প্রেমে পড়ে কি লাভ? তার চেয়ে এগুলো খেয়ে নাও, চা এল বলে।

চা খাওয়া শেষ না হতেই পরাগরা বেরিয়ে এলো। সবার চোখ লাল। সুকুমার বাবু বললেন ঃ চলো, খেয়ে নেয়া যাক। কোথায় খাবে তোমরা?

জয়ন্ত বললো ঃ আপনি যেখানে যাবেন, আমরাও সেখানে।

পরাগ বললো ঃ না, বৌদি যেখানে নিয়ে যাবে, সেখানে। এই দত্ত বাবু, তাড়াতাড়ি চলো। বসে বসে বাতাস খেলে তো আর পেট ভরবে না।

খেতে বসলাম গুর্খা হোটেলে। পরিচ্চন্ন হোটেল। ভরপেট ভাত খেয়ে বেরুতে বেরুতে দেড়টা বেজে গেল। সুকুমার বাবুরা রুমে গেলেন। জয়ন্ত আর পরাগের চোখ ঢুলুঢুলু। ওদেরকে হোটেলে ফিরে যেতে বলে আমি আবার ম্যালে ফিরে গেলাম। পথ থেকে একটা ভেড়ার লোমের টুপি আর উলেন মোজা কিনলাম। মাথায় টুপি আর গরম মোজা পায়ে গলিয়ে ম্যালে পৌঁছুতেই ভিজয় বাবু ও ভাবিজীর সাথে দেখা। দূর থেকে আমাকে দেখে পাঁচ বছরের ছেলে সোনু চেঁচিয়ে উঠলো ঃ ড্যাডি-মাম্মি দেখ, আংকেল আ গিয়া।

আমি কাছে যেতেই ভিজয় বাবু বললেন, কোথায় চললেন, দত্ত বাবু?

আমি বললাম ঃ কোথাও না। আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?

আমরা যাবো টিবেটিয়ান রিফিউজি ক্যাম্প দেখতে।

সেটা আবার কোথায়?

কাছেই। জীপে করে যাবো। ওদিকে টি গার্ডেন আছে বলে শুনেছি। খুব সুন্দর সিনারী। যাবেন? জীপ নিয়ে নেবো।

চলো, আংকেল। সোনু আমর গলা জড়িয়ে ধরে বললো ঃ উধার মে বহুৎ হনুমান হ্যায়।

সহি বাত তো বেটা? আমি সোনুর মাথার চুল অগোছালো করে দিয়ে বললাম ঃ আপ ক্যায়সা জানতা?

ডেডি বোলা। মাম্মী বোলা। তুম মেরা সাথ-সাথ চলো, আপনা আখোঁসে দেখেঙ্গে।

ঠিক হ্যায় বেটা, হাম তুমহারী সাথ যায়েগা। চলে। সোনু তার ছোট হাত দিয়ে আমার হাত এমনভাবে আঁকড়ে ধরলো যেন সেই দার্জিলিঙের পথ-নির্দেশক। হাসতে হাসতে সবাই জীপে উঠলাম।

দার্জিলিঙের আশেপাশে ৭০টি চা বাগান। যেদিকেই চোখ যায়-সবুজ আর সবুজ। সেই নকশাল বাড়ী থেকে শুরু করে কার্সিয়াং, ঘুউম আর ওদিকে আসাম পর্যন্ত এই চা বাগানের বিস্তৃতি। বাগানের অলি গলি বেয়ে চলেছে পীচ ঢালা পথ।

কিছুক্ষণের ভেতরেই আমরা রিফিউজী সেন্টারে এসে পৌঁছলাম। ক্ষুদ্র এলাকাটি সংরক্ষিত। একদিকে রয়েছে পশম থেকে উল বানাবার প্রদর্শনী, অন্যদিকে কার্পেট। হস্তশিল্পের মধ্যে তিব্বতী স্টাইলে প্রস্তত কাপড় এবং হাতে তৈরী কাগজই প্রধান। একপাশে ছোট একটি গুম্ফাও আছে।

তিব্বতের প্রধান ধর্মগুরু (ও রাজা) ১৩ তম দালাই লামা ১৯১৯ থেকে ১৯২২ পর্যন্ত এখানে অবস্থান করার কারণে এই ক্যাম্প গড়ে ওঠে। তখন চীন তিব্বতকে দখল করে নিয়েছিল। চীনের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্ব সুবিদিত। সেই সূত্রে তিব্বতীরা ভারতে আশ্রয় নেয়। এ সিলসিলা এখনও অব্যাহত আছে।

ভিজয় বাবু বেশ কিছু কেনাকাটা করলেন। আমি নিলাম হাতে তৈরী কাগজের গ্রীটিংস কার্ড আর একটি তিব্বতী জোব্বা। গাঢ় রঙের এই সব পোষাক মূলত মহিলারাই বেশি পড়ে।

ভাবিজী হেসে বললেন ঃ কি বাবুজী, ওদিকে কেউ পথ চেয়ে আছে বুঝি?

না-না ভাবী, কি যে বলেন। আমি লজ্জিত হয়ে বললাম, যেখানেই যখন বেড়াতে যাই, একটা না একটা স্মৃতিচিহ্ন তো নেয়া উচিত। স্মৃতি হিসাবে এর চেয়ে ভাল আর কি হতে পারে, বলুন?

ঠিকই বলেছেন। ভাবী সায় দিলেন।

এখানকার মহিলাদের খালি হাতে কার্পেট বোনার নিপুণতা দেখে সবারই চোখ জুড়িয়ে গেল। সোনুর চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত ভাবীজিকে একটা কার্পেট কিনতেই হলো। বেরিয়ে আসার পথে ভিজয় বাবু আমাকে বল্লেন ঃ প্রত্যেক জাতিই তার নিজস্বতা ধরে রাখতে চায়। এরা যেমন দীর্ঘদিন এখানে বাস করেও স্বপ্ন দেখে লাসার। কিন্তু মানুষ কি এভাবে চিরদিন স্বপ্নে অবগাহন করতে পারে?

কথাটার ভেতর কোথায় যেন তীব্র চাবুক আছে। সিকিম-ভুটান আস্তে আস্তে তার স্বাধীন অস্তিত্ব ও বিশিষ্টতা হারিয়ে ফেলছে। যে অকপট সরলতা ও অজটিল বিশ্বাস এক সময় সিকিমের শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ ছিল, আজ তা বিলুপ্তির শেষ পর্যায়ে। ভুটানে আজ ভুটিয়ারাই বিতর্কীত। এই দুর্যোগের শেষ কোথায়? আমার নিজের দেশেও কি এই অবস্থা শুরু হয়নি?

বিষন্ন মনে আমি গাড়ীতে ফিরে এলাম। কথা ছিল, ম্যালেই ফিরে যাবো। কিন্তু ভিজয় বাবু বললেন ঃ চলুন, রোপ-ওয়েটা দেখে যাই।

আমি অবাক হয়ে বল্লাম ঃ এখানেও রোপ-ওয়ে আছে নাকি? জানতাম না তো!

আমার কথায় ভিজয় বাবু হো-হো করে হেসে উঠে বললেন ঃ ভালো বলেছেন, দাদা। আপনি হিল্লী-দিল্লী চেনেন আর ঘরের খবর রাখেন না? আরে মশাই, এই রোপÑওয়ে হচ্ছে ইন্ডিয়ার প্রথম যাত্রীবাহী রোপÑওয়ে।

ড্রাইভার মুখ তুলে বললো ঃ এখন কিন্তু বন্ধ আছে, দাদা।

কেন, কেন? ভিজয় বাবু চমকে উঠে বললেন ঃ ও বুঝেছি, ঘিসিঙের কারণে?

না। সরকারের ইচ্ছায়। ড্রাইভার গম্ভীর মুখে বললো।

আমরা সতর্ক হয়ে চুপ রইলাম। কারণ ড্রাইভার গুর্খা। বলা তো যায় না, কার মনে কি আছে!

সত্যি সত্যিই রোপÑওয়ে বন্ধ। স্টেশন মাস্টার বললো ঃ দিন পনেরো পর খুলতে পারে। রাজীব গান্ধী আসছেন তো। তখন চুক্তি-টুক্তি কিছু হবে।

প্রায় আট মাইল লম্বা রোপ-ওয়ে দেখে আমি সত্যিই বিস্মিত। শুনলাম ওদিকের স্টেশনের নাম ঃ শিংড়া বাজার। রঙ্গীত উপত্যকার চমৎকার পিকনিক স্পট। আসা যাওয়ার ভাড়া ১৫ রুপী।

সোনু এই ক্যাবল-কারে ওঠার জন্য রীতিমত কান্না শুরু করলো।

চলো, হিমালয়ান মাউন্টেরিয়ান ইনস্টিটিউটে যাই, সোনু। ভিজয় বাবু ছেলেকে ভোলাবার চেষ্টা করলেন। ওখানে এভারেষ্টজয়ী তেনজিং শেরপার জামা-জুতো আছে।

সোনু কান্না ভুলে গেল বাপের গলা জড়িয়ে ধরে ফের চিৎকার করে উঠলো ঃ আভি এভারেষ্ট চলো ড্যাডি।

বাধ্য হয়ে গাড়ী ঘোরাতে হলো। ভিজয় বাবু ক্ষমা চেয়ে বললেন, আপনার অনেক দেরী করিয়ে দিলাম, দত্ত বাবু। কিছু মনে করছেন নাতো?

না না, মনে করবো কেন? ছোট বাচ্চাদের আবদার এমনই যখন-তখন। চলুন দেখে আসি।

আমার মাথায় ঘুরছে সুভাষ ঘিসিঙের নাম। একবার এই পাহাড়ী নেতার সাথে দেখা করা যাবে কি? ভাবতে ভাবতে গাড়ী হিমালয়ান মাউন্টেরিয়ান ইনস্টিটিউটে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু পাঁচটা বেজে গেছে বলে এন্ট্রি আজকের মত বন্ধ। শুরু হলো ক্ষিপ্ত সোনুর চিৎকারÑ ম্যাল সে নেই যায়েঙ্গে, নেহি যায়েঙ্গে।

হলিডে হোমে ফিরে এসে দেখি সাংঘাতিক কান্ড! সুকুমার বাবু আর বৌদি বাক্স-পেটরাসহ হাজির। ব্যাপার কি? জানতে চাইলে পরাগ ও জয়ন্ত বললো ঃ আরে, কিস্যু না। একা একা ওখানে ভাল লাগছিল না বলে চলে এসেছেন।

কিন্তু বৌদির মুখে যে বিষন্নতার ছাপ, তা দেখে আমার মনের মেঘ কাটল না। শেষপর্যন্ত বৌদিই মুখ খুললেন ঃ তোমার দাদা একটু বেশি ড্রিংক করেছিল। কি কথা নিয়ে হোটেল ম্যানেজারের সাথে হাতাহাতি। পরে মিটমাট হয়েছে। কিন্তু ম্যানেজার গুর্খা বলে আমার থাকতে সাহস হল না। তোমাদের খুব অসুবিধা করে দিলাম, তাই না?

আমি কোন জবাব দিলাম না। নিজেই যে বহিরাগত, তার জবার দেবার হকও নেই।

খানিক পরে (কেয়ার টেকার) সোমেন এসে নজর দিয়ে দেখল সবাইকে। আমতা আমতা করে বলল ঃ আপনারা এসেছেন, বেশ হয়েছে। চা দেব কি?

পরাগ কঠোর গলায় বলল ঃ না, চায়ের দরকার নেই। তুমি বালিশ-বিছানা-কম্বল দিয়ে যাও দিকিন। আর চুলোটা দিয়ে যাও।

কেন, চুলো দিয়ে কি করবে? আমার চা’টা পছন্দ হয়নি?

খুব হয়েছে। চুলোটা দাও। ওতে রাতের খাওয়া পাক হবে, বুঝলে?

সোমেন আশ্চর্য চোখে সবার দিকে চাইলো। তারপর ক্লান্ত গলায় বললো ঃ দিয়ে যাচ্ছি এক্ষুনি।

বৌদির সাহায্যে পরাগ আর জয়ন্ত ভালোই পাক করলো। আমি এ বিষয়ে পুরোপুরি অজ্ঞ। তাই বিছানায় বসে সুকুমার বাবুর সাথে গল্প করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তার চোখে এখনও নেশার ঘেরি। কথা বলছেন ধীর লয়ে। সব কথার জবাব দিতে পারছেন না। তাল কেটে যাচ্ছে। বৌদি কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমাদের দিকে তাকাচ্ছেন। তার চোখ ভরা শ্রাবণ।

আলু ভর্তা, ডিম আর পেঁয়াজ-ভাজা দিয়ে ভাত খাবার পর আমার চোখে ঘুম এসে গেল। কিন্তু গরম ভাতের আঁচে সুকুমার বাবু জেগে উঠেছেন। পরাগ আর জয়ন্তও প্রস্তত। খাবার পর তিনজনেই আবার বোতল খুলে বসলো।

পাঁচ জনের লম্বা বিছানার এক প্রান্তে বৌদি আরেক প্রান্তে আমি শুয়ে পড়লাম। মাঝখানে তাস আর নেশার গেলাস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রইলো পরাগ, জয়ন্ত আর সুকুমার বাবু। থ্রি স্পেড, ডাবল-ট্রাম ইত্যাদি শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, টের পাইনি।

ঘুম ভাঙলো মেয়েলী কন্ঠের ডাকা ডাকিতে। জেগে দেখি, বৌদি আমার পা ধরে টানছেন। আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম ঃ কোন বিপদ-টিপদ নয় তো?

কিন্তু না। তাকিয়ে দেখি ঃ পরাগ, জয়ন্ত আর সুকুমার বাবুর কাপড় পরা সারা। আমাকে চোখ খুলতে দেখে জয়ন্ত ফোরণ কাটলো ঃ কুম্ভকর্ণ উঠেছে রে। রাবণের এবার রক্ষে নেই।

এখনও তো রাত পোহায়নিÑ এই রাত্তিরে যাবি কোথায়?

টাইগার হিলে। বাঘ এসেছে, বাঘ!

বাঘ?

ইতিমধ্যে বৌদি কাপড় পাল্টে ফিরে এসেছেন। এসেই তাড়া লাগালেন ঃ হয়েছে, হয়েছে; অত ভড়ং করতে হবে না, তাড়াতাড়ি কাপড় পড়। টাইগার হিলে যাবো; সানরাইজ দেখতে।

আমার ঘোর তখনও কাটেনি। সানরাইজ তো দেখা যায় সমুদ্রে। এই পাহাড়ের ভেতর কিসের সানরাইজ? নাকি, মিড-নাইট সানের দেশে এসে পড়লাম?

কাঁপতে কাঁপতে ঘরের বাইরে পা দিলাম। ঘন কুয়াশার মত মেঘ রাস্তায় ভেসে বেড়াচ্ছে। কয়েক মিনিটেই হাত-পা বোধশূন্য হয়ে গেল। নিজের অজ্ঞাতে চলার গতি বাড়িয়ে পাঁচজনের দলটা ধরতে দৌড় শুরু করলাম। ভয়ংকার শীত থেকে বাঁচার দ্বিতীয় কোন পথ নেই। মিলিটারীদের মত হাঁপড় তুলে মহাত্মা গান্ধী রোডে এসে পৌঁছলাম।

গান্ধী রোডের উত্তর প্রান্তে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। সেখানে যেন মেলা বসেছে। শত শত জীপের হেড লাইট, ইঞ্জিনের গর্জন আর লোকজনের হাকডাকে পুরো চত্বর দিনের মত ব্যস্ত। অকুস্থলে পৌঁছেই সবাই একটা জীপে উঠে বসলাম। লক্ষ্য টাইগার হিল।

ঠেঁসে যাত্রী বোঝাই করে জীপ স্টার্ট নিল। ফগ লাইটের আলোয় হলদে হয়ে উঠেছে সামনেটা। পথ ছেড়ে দিচ্ছে অন্যান্য গাড়ী। লোকজন সরে দাঁড়াচ্ছে একপাশে। শুরু হলো ঘন অন্ধকারের ভেতর দৌঁড়-ঝাঁপ। আমি বহু কষ্টে হাত মোজা আর জ্যাকেটের ফাঁক গলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ঃ তিনটে বেজে পঁয়ত্রিশ।

গান্ধী রোড পার হয়ে সামনে বাড়তেই চোখে পড়লো আরও গাড়ী। সবাই চলছে একই দিকে; একই উদ্দেশ্যে।

পথে আমার ঘুম এসে গেল। গত দু’রাতের ক্লান্তি এখনও দূর হয়নি। কিন্তু ঘুমাবার উপায় নেই। একে তো পাহাড়ী পথে গাড়ী অনবরত ঝাঁকি খাচ্ছে, তদুপরি তিনজনের সীটে ঠাসাঠাসি করে বসতে হয়েছে। পাঁচজনকে। তবু যেটুকু পারা যায়, তন্দ্রার মধ্যেই ছেড়ে দিলাম নিজেকে।

জেগে উঠলাম গাড়ী ব্রেক করার ঝাকুনিতে। সামনে তাকিয়ে দেখি জীপ আর জীপ। রাস্তা উঠে গেছে বিশ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে। আর সামনে যাবে না গাড়ী। বাকি পথ হেঁটে যেতে হবে।

বাতাস আর মেঘের প্রতিযোগিতার মধ্যেই নেমে দাঁড়াতে হলো। ড্রাইভার সবাইকে গাড়ীর নম্বর লিখে নিতে অনুরোধ করলো। নইলে ফেরার সময় খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমরা তার কথায় পাত্তা দিলাম না।

পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে প্রায় কুড়ি মিনিট লাগলো। ঘেমে শরীর চুপচুপ। বৌদির অবস্থা বেশি খারাপ। পরাগ আর জয়ন্ত ভাগাভাগি করে টেনে তুলেছে তাকে। উপরে পৌঁছে বুক ভরে ঠান্ডা বাতাস নিয়েও যেন আঁশ মেটে না। কিন্তু পাহাড়েরর এমন গুন- দু’মিনিটই বসতেই ক্লান্তি দূর। আশ্চর্য সজীবতায় বুকের পেশী চাঙ্গা হয়ে উঠলো আবার।

টাইগার হিলের এই চূড়াটি মাটি থেকে ৮,৪৮২ ফুট উঁচুতে। প্রায় দু’একর পরিমান সমতল জমি চূড়ায়। চারপাশে রেলিং ঘেরা। মাঝখানে রেস্ট রুম। টেলিস্কোপও আছে। কিন্তু গুর্খাদের আন্দোলনে এই মুহুর্তে অচল।

ইতিমধ্যেই এক দেড় হাজার লোক জড়ো হয়েছে। সবাই উত্তর পূর্ব দিকের রেলিঙের কাছাকাছি থাকতে চায়। ওদিকেই কাঞ্চনজংঘার বিশাল অবয়ব। এভারেস্ট আরও উত্তর-পশ্চিমে। যদি সৌভাগ্যক্রমে আকাশ মেঘমুক্ত থাকে তাহলে এভারেস্টও দেখা যেতে পারে। আর মেঘ বেশি হলে কাঞ্চনজংঘাও দেখা যাবে না। উপস্থিত অনেকেই গত চার পাঁচ দিন ধরে নিয়মিত আসছে। কিন্তু প্রতিদিনই মেঘের ঘনঘটায় ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে। এই অভূতপূর্ব আলোর খেলা শেষ দেখা গেছে গত শুক্রবার।

আজও শুক্রবার। আমার মন চঞ্চল হয়ে উঠলো। ফেরিওয়ালার কাছ থেকে এক কাপ চা নিয়ে বসে গেলাম দক্ষিণ পাশের চত্বরে। এদিকটায় ভীড় খুব কম। সুকুমার বাবু আর বৌদিও বসলেন। পরাগরা গেল টাওয়ারে।

সুকুমার বাবু বললেন ঃ জানো দত্ত বাবু, এই পাহাড়ের মূল নাম খাঙ-চেন-জোঙা। অর্থাৎ ঠান্ডা বরফের পঞ্চকোষ। পাঁচটি চূড়ায় সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বলে তিব্বতী ভাষায় এই নাম।

তিব্বতী ভাষায় কেন? আমি অবাক হলাম।

সুকুমার বাবু হেসে বললেন ঃ সিকিম আসলে তিব্বতেরই অংশ। কাঞ্চনজংঘারও নামও তো ওদের দেয়া।

মানে? আমি চায়ে চুমুক না দিয়ে জানতে চাই।

মানে হলো, তিব্বত আর সিকিমের সংস্কৃতিÑ মানে অ্যানথ্রোপলজি একই। সিকিমে এখন লেপচা, ভুটিয়া ও নেপালীদের যে সংমিশ্রন দেখা যাচ্ছে, তা রাজনৈতিক দোষে দুষ্ট হলেও আদিতে এখানে একচেটিয়াভাবে বৌদ্ধরা, মানে ‘লেপচা’ ভুটিয়ারাই বাস করত। নেপালী বা হিন্দুরা এসেছে পরে। বলা যায়, সিকিম ছিল পৃথিবীর আদি ধর্ম রাজ্যের একটি, যেখানে রাজতন্ত্র আর ধর্ম পরষ্পরের পরিপূরক ছিল। কিন্তু সে কথা থাক, তোমাকে খাঙ-চেন-জোঙা’র কথাই বলি, ক্যামন?

আমি গল্পের লোভে ঘন হয়ে বসেছি। সোৎসাহে বললাম ঃ নিশ্চয়ই দাদা, বলুন।

খাঙ-চেন-জো-ঙা, যার সংক্ষিপ্ত নাম জোঙা, সিকিমবাসীরা তাকে অভিভাবক দেবতা মান্য করে। স্থানীয় অধিবাসীদের বিশ্বাস ঃ জোঙ্গা বাস করেন কাঞ্চনজংঘার শীর্ষে। ধর্ম, শান্তি ও সমৃদ্ধির দেবতা ইনি। ঐশ্বর্যের মূলেও ইনি। এরা এও বিশ্বাস করে যে, কাঞ্চনজংঘা পর্বতে অমূল্য সম্পদ সঞ্চিত আছে।

মজার তো !

জোঙ্গা দেবতার কল্পিত রূপ রক্তবর্ণের । তিনি সাদা সিংহের উপর আসীন। তার ডান হাতে বিজয় দন্ড আর বাম হাতে নকুল। শান্তির প্রতীক জোঙ্গা দেবতার মুকুটের পাঁচটি চূড়া যথাক্রমে কাঞ্চনজংঘার পাঁচটি শৃঙ্গ। সর্বোচ্চশৃঙ্গে বাঘ, দ্বিতীয়তে সিংহ, তৃতীয়তে হাতি, পরেরটিতে ঘোড়া আর শেষটিতে গ-ার থাকে।

পূরাণে আছে, অষ্টম শতাব্দীতে রাজা বীসানদের আমন্ত্রণে অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন ভারতীয় বৌদ্ধপুরুষ পদ্মসম্ভব তিব্বতের পথে রওয়ানা হন। পথে তিনি আবিষ্কার করেন অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যম-িত এই দেশ। তিনি দেশটির আনাচে কানাচে ভ্রমণ করেন এবং কাঞ্চনজংঘার কোন এক অজ্ঞাত গুহায় বহু অমূল্য সম্পদ এবং মূল ত্রিপিটক লুকিয়ে রাখেন। তিব্বতে পৌঁছে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে নয়শ’ বছর পরে আবার তিনি আবির্ভূত হবেন এবং ধর্মপরায়ণ, নীতিনিষ্ঠ ও সৎ মানুষের জন্য সেই অজ্ঞাত গুহার দ্বার উন্মুক্ত করবেন।

বৌদ্ধ-তিব্বতের প্রতিষ্ঠাতা লামা লাচেন-চেমবোকে সিকিমের মানুষ গুরু পদ্মসম্ভবের সেই ‘অবতার’ মনে করে। তিনি যখন ডুবডী পর্বতে ধ্যানমগ্ন ছিলেন, তখন বিশালাকৃতির দু’জন দেবতা আবির্ভূত হন। এই দেবতাদের একজন হচ্ছেন জোঙ্গা এবং অন্যজন ‘ইয়ার-দু’ (তার প্রধান সহযোগী)। লামা লাচেন-চেমবো তাদেরকে ভক্তি-সমাদরে পুজার্ঘ দেন এবং তারা সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বরদান করতে চাইলে লাচেন-চেমবো তাঁদেরকে সিকিমের অভিভাবকত্ব গ্রহনের অনুরোধ জানান। সেই থেকেই জোঙ্গা পুজিত হয়ে আসছে গুরুদেবতা রূপে। তার পুজার নাম মাঙ-লাব-সোল অর্থাৎ ‘শ্যামল ভূমি দেবতার পূজা’।

আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম ঃ পূজা হচ্ছে পর্বতের আর নাম ভূমি দেবতার কেন?

সুকুমার বাবু হেসে বললেন ঃ সব পূজার পেছনেই তো এরকম উপকথা আর যুক্তিহীন গোঁজামিল। কিন্তু দত্ত বাবু, মানুষের বিশ্বাস তো লজিকের ধার ধারে না। তুমি আজ যে লজিকে এ-সব পূরাণকে বাদ দেবে, ভাবী কালের মানুষের সামনে তোমার সেই-সব অকাট্য যুক্তিও অচল হয়ে যাবে। যুক্তি মানেই গতি, বুঝলে হে।

তা অবশ্য ঠিক। আমি স্বীকার করলাম। কিন্তু একটা না একটা অন্ত:মিল থাকে, এক্ষেত্রে তো কোন মিলই নেই।

একেবারে যে নেই, তা বলা ঠিক নয়। বর্তমানে সিকিমের আদি নাম অর্থাৎ তিব্বতী নাম ছিল বেউল-দেমাজং বা ‘অজ্ঞাত ধানের ক্ষেত’। চির তুষারবাসী তিব্বতীদের কাছে ধান ছিল অপরিচিত। তারা প্রথম যখন এই দেশের সন্ধান পায়, তখন এই নামকরণ করে। প্রায় ৫০০ বছর পরে পরিবর্তিত হয় এই নাম। তারও পেছনে আছে লোকগাঁথা।

বলুন দেখি। আমার উৎসাহ বেড়ে যায়।

বহুদিন আগে এক সম্ভ্রান্ত লিম্বু (নেপালী) যুবতীর সঙ্গে বিয়ে হয় সিকিম রাজপুত্রের। সিকিমের ট্র্যাডিশনে বরকে বধুর বাড়ীতে তিন বছর বাস করতে হয়। এই তিন বছরে যদি তাদের মনের মিল ঘটে এবং মনোমালিন্য না হয়, তাহলে বিয়ের আয়োজন চলে।

এই তিন বছর কি বর-বধু একসঙ্গে থাকে? আমি কথার মাঝখানে বাঁধা দিয়ে জানতে চাই ঃ মানে তাদের শারিরীক সম্পর্ক হয় ?

ওহ-হো, তোমাকে তো বলাই হয়নি যে সিকিমিরা বহুভর্তৃকা ও বহুপতœীক উভয় নিয়মেই বিশ্বাসী। পুরুষের মত নারীরাও সেখানে বহুবিবাহ করার অধিকার রাখে। কয়েকজন ভাই মিলে একটি নারীকে বিয়ে করার প্রথা এখনও সিকিমের বহু গ্রামে অবশ্য-পালনীয়। যৌন জীবন সম্পর্কে এদের সংস্কার খুব কম। সে কারণে, পারিবারিক দ্বন্দ্ব বা ঈর্ষা তেমন নেই।

ভারী চমৎকার তো! যাকে বলে আদি ও অকৃত্রিম সমাজ!

হ্যাঁ, তা বলতে পার। গৌরী ? হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে অন্যত্র চলে গেলেন সুকুমার বাবু ঃ বোতল-টোতল আনো নি নাকি?

বৌদি ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে ছোট্ট এক শিশি মদ সুকুমার বাবুর হাতে নিঃশব্দে ধরিয়ে দিল। আনন্দিত আলস্যে বোতলের ছিপি খুলে সুকুমার বাবু দু’ঢোক গিললেন। তারপর আবার শুরু করলেন ঃ কি যেন জানতে চাইলে, দত্ত বাবু ? ও হ্যাঁ, সহাবস্থান। মানে সেক্সুয়াল ব্যাপারটাতো ? তা বেশ স্বচ্ছন্দেই চলে তখন। অনেকের ছেলে মেয়েও হয়। হোক বা না হোক, কিছু যায় আসে না। আসল ব্যাপারটা হল মনের। মনের মিল হল তো বিয়ে হল, না হল তো চুকে-ফুকে গেল; ব্যাস্।

ব্যাস্ ? আমি হেসে মাথা নাড়লাম। তারপর সেই কি যেন বললেন, লিম্বু না কি নাম যেন, সেই সুন্দরীর কি হল ?

সুন্দরীর আর কি হবে ? কটাক্ষ করে নিজের বৌয়ের গায়ে চিমটি কাটলেন সুকুমার বাবু ঃ হয় ছেলে হবে, নয় মেয়ে হবে। হাঁ: হাঁ: হাঁ:।

আমি শংকিত হয়ে ভাবলাম, মদ খেতে না খেতেই মাতাল ? লোকটা ভাল অভিনয় জানে তো!

কিন্তু সুকুমার বাবু মোটেও মাতাল নন। শান্তভাবে বললেন ঃ শোন দত্ত বাবু, তিন বছর পর সেই লিম্বু যুবতীর বিয়ে হল রাজকুমারের সাথে। মহা ধুমধামের সাথে বৌকে নিয়ে সিকিম এসে পৌঁছলেন যুবরাজ। নেপাল হচ্ছে কংকরময় পাহাড়ের দেশ, আর সিকিম সবুজ বরফের। এই অভুতপূর্ব চমৎকার সৌন্দর্য ও প্রকৃতির অসাধারণ লীলাবৈচিত্র দেখে নববধু শিহরণে চিৎকার করে উঠল ঃ সু-হীম! সু-খীম! ‘নতুন ঘর, সুখের ঘর’। লিম্বু নারীর সেই আনন্দধ্বনি থেকেই ধীরে ধীরে ‘সিক্থিম’ বা সিকিম শব্দের গোড়াপত্তন। পরে ইংরেজরাই নামটিকে জনপ্রিয় করে তোলে। বলা যায়, নামটির বয়স বড় জোর তিনশো বছর।

আমি বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেলাম।... যেন দূর প্রাচ্য থেকে হঠাৎ ধেয়ে এল কোটি কোটি আলোক স্তম্ভ। অন্ধকার চিরে আছড়ে পড়তে লাগল পর্বতের সুউচ্চ চূড়ায়। বরফের দুগ্ধধবল প্রিজমে উদ্ভাষিত হিমালয়ের এক চূড়া থেকে অন্য চূড়ায় পিছলে যেতে যেতে বদলে যাচ্ছে তার রঙ; তার রূপ; তার ঔজ্জ্বল্য; তার বিভঙ্গ। এ থেকেই কি তবে উৎপত্তি হয়েছে ভরত নাট্যমের এই চিকন-চঞ্চল তরঙ্গভঙ্গী তো কেবল লাস্যময়ী নারীকেই সাজে! এ-যে মর্জিনার খঞ্জরের চেয়ে দ্রুতগামী বিদ্যুৎশিখা! পূব-দিগন্তের প্রান্ত থেকে থেকে রঙের ঢেউ ছড়িয়ে যেতে লাগল পশ্চিম দিগন্তে। যেন ধানের শ্যামল ক্ষেতে ঢেউ দিচ্ছে বসন্ত বাতাস আর আন্দোলনে কেঁপে কেঁপে উঠছে নওগাঁর মাঠ। বিভাজিত সাত রঙে একে একে জ্বলে উঠল হিমালয়ের অদৃশ্য অবয়ব। নীলচে-বেগুনী থেকে হলুদ, হলুদ আর কমলা আর কমলা থেকে লাল। কমলা রঙের ছোঁয়ায় বন্দী- প্রমিথিউসের মত হঠাৎ ঈষাণ কোণে মোচড় দিলো ইন্দ্রপ্রস্ত এভারেষ্ট। লাল রঙের শেষ বর্ণালীটুকুতে তা এতই জীবন্ত, মনোমুগ্ধকর এবং বিশাল যে, ভয়ে-বিস্ময়ে-মুগ্ধতায় উপস্থিত সকলেই স্তম্ভিত।

কয়েক মুহূর্ত পরেই আবার অন্ধকার। তারপর সাধারণ ভোরের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল চারদিক। কুয়াশার চাঁদর আর মেঘের পর্দায় মুখ লুকাল শৈল-সুন্দরীরা। মনেই হোল না, মাত্র ক’মিনিট আগে এখানেই ঘটেছে অভূতপূর্ব সুন্দর ও শাশ্বতের অলৌকিক সঙ্গম। আশ্চর্য এই দুনিয়া আর পরমাশ্চার্য তার লীলা-বৈচিত্র!

একপা-দু’পা করে সবাই ফিরে চলল গাড়ীর দিকে। কিন্তু কেউ যেন আর যেন আর আগের মানুষ নেই। আমি নিজেও অলক্ষ্যে কখন সুকুমার বাবু ও বউদীর হাত ধরে হেঁটে চলছি, টের পাইনি। যখন হুঁশ হল, দেখি ঃ পরাগ আর জয়ন্ত শূন্য রাস্তার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে অসংখ্য গাড়ী। আমরা চারজন বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকলাম, কারণ গাড়ীর নম্বর কারুরই মনে নেই ! এই মহাতীর্থে কে কার খোঁজ রাখে ?

***

রাস্তার ভোগান্তি শেষে সাড়ে সাতটায় হোটেলে পৌঁছুলাম। সুকুমার বাবু ঘরে ঢুকেই হাঁক দিলেন : দাদারা, একটা বোতল খোলতো দেখি; তেষ্টায় প্রাণ যায়।

আমি কেয়ারটেকার সোমেনকে অনেক অনুরোধ করে আধা বালতি গরম পানি যোগাড় করে কাঁপতে কাঁপতে ঢুকে পড়লাম গোসল খানায়।

বৌদি ততক্ষণে ডিম আর পরোটা আনিয়ে নিয়েছেন। পাহাড়ে ক্ষুধা লাগে বেশী। হজমও হয়। সুতরাং খাওয়ার প্রতি টানটা থেকেই যায়। আমি এমনিতে কম খাই। কিন্তু দার্জিলিঙে এসে পেটুক হয়ে উঠছি। খাচ্ছিলাম আর আড় চোখে তাকাচ্ছিলাম সবার দিকে ঃ কেউ আবার দেখে ফেললো না-তো!

বৌদি একসময় হেসে বললেন ঃ খাও খাও, খেতে বসে অত চোরা-চুরি করতে হবে না।

লজ্জায় বিষম খেলাম। সবাই হেসে ফেলল আমার অবস্থা দেখে।

খাওয়ার পাট চুকতেই লেপের মধ্যে ডুব। আমার পাশে জয়ন্ত, তারপর পরাগ। ওপাশে সুকুমার দা আর বৌদি। মাঝের তিনজনের মুড খুব ভাল। আমার অস্বস্তি লাগছিল চায়ের জন্য। শেষ পর্যন্ত উঠেই পড়লাম। বললাম ঃ না, এভাবে হবে না। বৌদি, আমি গলায় দু’কাপ চা ঢেলে আসি। তোমরা ইতিমধ্যে ঠিক করো, সকালে কোথায় বেরুবে।

রাস্তায় এসে ফেরার কথা ভুলে গেলাম। টিপ টিপ করে বৃষ্টি ঝরছে আর তারমধ্যেই তাজা রোদের লুকোচুরি। তিব্বতী যুবতীরা রঙিন ছাতার নীচে কথা কইতে কইতে ছুটছে। তাদের গাঢ় উজ্জ্বল রঙের সোয়েটার ও কার্ডিগান ছাপিয়ে ঝিকমিক করছে গালের লাল-ছোপ। ফর্সা পায়ের গোছায় শক্তি ও যৌবনের উদ্দামতা দেখে বয়স বোঝা ভার। সবার চেহারায় একই রকম পাহাড়ী কমনীয়তা। প্রকৃতির অকৃপণ দয়া তাদের মুখে এঁকেছে চিরস্থায়ী প্রসাধন- কপোলে দিয়েছে আবির, কপালে দিয়েছে বরফ-কান্তি; চিবুকে এঁকেছে টোল আর নির্মিলিত চোখে দিয়েছে শিশুর সরলতা।

চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা পত্রিকা নিলাম। বাংলাদেশে চলছে সেই একই দৃশ্য ঃ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট, বোমাবাজি। রাজশাহীতে খুন; চট্টগ্রামে হরতাল। আমি বিষন্ন হয়ে বসে রইলাম।

কতক্ষণ বুঁদ ছিলাম, খেয়াল নেই। সম্বি ফিরে পেলাম বৌদির কণ্ঠে ঃ বলেছিলাম না, এখানেই থাকবে। যা ভেবেছি, তাই। ওমা, পত্রিকা নিয়ে বসে আছ দেখি। এদিকে আমরা যে সবাই ভেবে ভেবে মরি- বলি, সেকথা কি একবারও মনে ছিল?

আমি আন্তরিক ভাবে ক্ষমা চাইলাম। কিন্তু বৌদি বললেন ঃ না ভাই, ওতে ক্ষমা হবে-টবে না। খাওয়াও দেখি কিছু, মন ভেজে কি না। পেট চো চো করছে।

পাকুরা ও চা খাবার পর ঠিক হল মিরিখ যাওয়া হবে।

আজই যাবেন?Ñ আমি একটু শংকিত হয়ে জানতে চাই।

হ্যাঁ, আজই। মানে এক্ষুনি। কেন তোর অসুবিধা আছে?

না, তেমন কিছু না। পরাগের কথার জবাবে বললাম আমি, ক্যামেরাটা ফেলে এসেছি তো তাই...

দরকার হবে না। আমাদেরটা আছে, বৌদিরটা আছে। আর কত দরকার? শুধু মানি ব্যাগ পকেটে আছে কিনা, সেইটা দেখ।

চা-পাকুরার পর্ব চুকিয়ে হাঁটা ধরলাম জীপের দিকে।

গিয়ে দেখি, দিল্লীওয়ালাও হাজির। আমাদেরকে দেখে সোনু আবার চেচাঁমেচি শুরু করল। শিশুদের বয়সটাই এ রকমÑ সজীব, ফুটফুটে, চুম্বকীয় সৌন্দর্য ঘেরা। সবাইকে ভালবাসতে চায়, আঁকড়ে ধরতে চায়।

ভিজয় বাবুরাও মিরিখ যাবেন। সুতরাং একই গাড়ীতে উঠলাম সবাই। জন প্রতি চল্লিশ ভাড়া টাকা। প্রথমে যাবে মিরিখ। সেখান থেকে ফেরার পথে নেপালের পশুপতি মার্কেট ও মন্দির দেখিয়ে আবার দার্জিলিঙ। পরাগ আর জয়ন্ত মিরিখ যাত্রায় খুব উত্তেজিত। কিছুটা সতর্কও মনে হল।

চা-বাগানে ঘেরা সবুজ বন-জঙ্গলে ছাওয়া পাহাড়ী পথের অনুভূতিই আলাদা। ড্রাইভার একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে ঃ শুনুন-দাদারা এই গাড়ীতে হেমা মালিনী আর ধর্মেন্দ্রও শুটিংয়ে গিয়েছিলেন। দিলীপ কুমার আর অমিতাভও এ গাড়ী ব্যবহার করেছেন। শক্তি দেখেননি, শক্তি? এ গাড়ীতেই তো শুটিং প্যাকআপ হল ... রাখীর কথা বলবেন না। খুব যাচ্ছেতাই ব্যবহার। মাল টেনে সব সময় আউট। নায়িকা হচ্ছে মালা সিনহা। হাইটে এই আমার চেয়েও একহাত বেশী। আর কি মধুর ব্যবহার।...

যে কোন হিলি-স্টেশনে এই একই গল্প। কোন না কোন ছবির শুটিং হলেই সব জনপ্রিয় ছবির ফ্লাশ-ব্যাকে তারা তাদের নাম-ধাম জুড়ে দেবে। ড্রাইভারদের চেয়ে টাঙ্গাওয়ালা বা পনি’র সহিসরা আরও সাংঘাতিক। একবার আগ্রার এক গাড়োয়ান আমাকে তার চকমকে বিদেশী জামাটা দেখিয়ে বলেছিল ঃ বাবুজি, সহি বাত এহি হ্যায়... এই যে জামাটা দেখছেন, এটি সুনীল দাৎ (দত্ত) আমাকে খুশি হয়ে দিয়ে গেছেন। সেই যখন পাকিস্তানে একটা বিরাট দাঙ্গা হল...। আরেকবার কোদাইক্যানেলের এক ট্যাক্সিওয়ালা তার রুপোর আংটিতে কপাল ঠেকিয়ে বলেছিল ঃ জানেন, এই আংটিটি রেখার। রেখাজী যখন দো-আনজানে ছবির শুটিংয়ে এসেছিলেন, তখন একবার মরতে মরতে বেঁচে যান। আমি ধরে না ফেললে সে যাত্রায় একেবারে পাহাড়ের নীচে... বুঝলেন না। খুশি হয়ে এই আংটিটা দিয়েছিলেন। এই যে পাথরটা দেখছেন, লাকি স্টোন ঃ গোমেথ। দিয়েছেন ওয়াহিদা রেহমান...।

এসব কাহিনীর সত্য-মিথ্যা নিরূপন করা অর্থহীন। ওরা বলে খুশি হয়; শুনে যাওয়াই ভাল। অবিশ্বাস কখনও কখনও ভয়ংকর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। একবার মাদ্রাজের এক অটোওয়ালা বর্ণিত তথ্যে ভুল আবিস্কার করায় সে এমন তীব্র ভাবে গাড়ী ব্রেক করেছিল যে সামনের শিকে ধাক্কা লেড়ে আমার মাথা কেটে যায়।

এ যাত্রাও আমি হালকা মেজাজে শুনছিলাম। লক্ষ্য করে দেখি ঃ জয়ন্ত, পরাগ, সুকুমারদা এবং বৌদি গভীর বিশ্বাস ও মনযোগে কাহিনী গিলছেন। শুধু দিল্লী-ওয়ালারা নিজেদের গল্পে ব্যস্ত। একে তো তারা বাংলা ভাল বুঝছেন না, উপরন্তু ধরতে পেরেছেন ফাঁকিটা।

গাড়ী মিরিখ পৌঁছুলো সাড়ে এগারোটায়। সামনেই বাজার। বাজার পেরিয়ে ডানে ঘুরতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। বিশাল পাইন ও দেবদারু গাছের ছায়ায় আশ্চর্য সুন্দর টলটলে নীল পানি। চিকন ঢেউয়ের সাথে ছন্দ রেখে রোদ-মেঘের খেলা। পদ্ম ও শাপলা ফুটেছে ঝোপে-ঝোপে। রাজহাঁসের দল রাজকীয় গ্রীবা বাঁকিয়ে ভেসে চলছে পংখীরাজের মত। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত নৌকায় উচ্ছল নারী-পুরুষ। প্যাডেল বোটের মন্থর গতি আর স্পীড বোটের আওয়াজে মুখরিত চারদিক। পাশের উদ্যানে মনোরম রঙে সজ্জিত ডালিয়া, কসমস আর চায়না গোলাপের সারি। পালিশ করা যতেœ লালিত দূর্বার খোপ কেটে কেটে বসানো সুরকী ও সিমেন্টের বুদবুদ। চোখের তৃষ্ণা আর মেটে না। দু’তিনটি তাবুর আশেপাশে লোকের ভীড়Ñ সম্ভবত শুটিং হচ্ছে। অন্য পাশে বিরাট কাঁচ ঘেরা মোটেল। খাবার ও থাকার চমৎকার বন্দোবস্ত। পরিবেশটা সব মিলিয়ে এত সুন্দর যে প্রথম দর্শনের মুগ্ধতায় নির্বাক হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

আমরা মোটেলে ঢুকতে বাধ্য হলাম। কারণ, বোট ও স্পীড-বোটের টিকেট কাউন্টার বন্ধ। যে তিনশ’ টিকেট ইতিমধ্যেই দেয়া হয়েছে, তা শেষ হতে এখনও অনেক দেরী। সোয়া বারোটা থেকে আবার টিকেট দেয়া হবে। সুতরাং খেয়ে নেয়াই ভাল।

মোটেলটি ছিমছাম। আটজনের একটি টেবিল দখল করে বসলাম আমরা। পশ্চিমবাংলায় গরুর মাংস নিষিদ্ধ। কিন্তু এখানে দেদার বিক্রি হচ্ছে। আমার ভারী লোভ হচ্ছিল, কিন্তু দত্ত বাবু ‘যদি ধরা পড়ে যায়’Ñ সেই ভয়ে সামলে নিলাম। মাটন কারী, সালাদ, ডালভাজী দিয়ে ভাত খেলাম। তারপর চা। দার্জিলিঙে এসে এই প্রথম জিভের স্বাদ মিটিয়ে চা খাওয়া গেল। চা’টা এত ভাল যে আমরা সবাই আরেক প্রস্থ অর্ডার দিলাম।

কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য। চা খেতে খেতেই অন্ধকার নেমে এল। দেখতে না দেখতেই ঝুপঝুপ বৃষ্টি। বাইরের লোকজন দৌড়ে মোটেলে আশ্রয় নিল। কেউ আবার মোটেল থেকে বেরিয়ে গেল বৃষ্টির স্বাদ নিতে। বৌদিরও ভেজার শখ। সুকুমার বাবুকে নিয়ে বেরুলেন বাইরে। ছেলে মানুষের মত ছুটোছুটি করলেন খানিকটা। তারপর ক্লান্ত হয়ে ফিরে এলেন। ভেজা শাড়ীতে লেপটে থাকা নারীর শরীর থেকে চোখ ফেরানো মুনিÑঋষিদের আয়ত্বে; আমাদের জন্য খুবই কঠিন কাজ। কমনীয় কমনায় সে পুরুষের তৃষ্ণাকে জাগিয়েই চলে। চেষ্টা করেও আমি যখন চোখ ফেরাতে পারছি না, তখন টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ভিজয় বাবু বলেলন ঃ ভিজবেন নাকি, দাত্ত বাবু ?

আমি হেসে মাথা নাড়লাম ঃ না ভাই, অত সাহস নেই। পাহাড়ী বৃষ্টিতে ঠান্ডা না বসলেও ভেজা কাপড়ে বসে থাকার সাধ্য নেই আমার।

আমি বিশাল জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ আগের সেই সুনীল জলের লেকে এখন আবছা অন্ধকার। গর্বোদ্যত রাজহংসীদের চিহৃ মাত্র নেই। জনশূন্য বোটগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে দড়ি টান করে। ফুলের পাপড়িতে আছরে পড়ছে দীর্ঘ পানির ফোঁটা। সেই আঘাতে একবার ঝুঁকে পড়ছে, পরক্ষণেই সাহস করে উঠে দাঁড়াচ্ছে পুষ্পবৃন্ত। দেখতে দেখতে আশ্চর্য মুগ্ধতায় আমি নীল হয়ে গেলাম।...

ভুল করে এঁকে তুমি বোল না বকুল

এ হল গোলাপ। নাম ঃ লালারুখ ফুল!

এ হল হৃদয়; এরই নাম কস্তরী

এর পথ চেয়ে কত হরিনী ব্যকুল!

ভুল করে পৃথিবীতে অন্ধ থেকো না

রুপের নীচেই অপরূপের জগত;

দৃষ্টি বাড়াও কর চেতনা আকুল

পথের প্রান্তে থাকে খোলা বহুপথ।...

একা একা কি ভাবছেন ? ভিজয় বাবু সোনুকে নিয়ে পাশে এসে দাঁড়ালেন।

সচকিত হয়ে বললাম ঃ ভাবছি নয়, দেখছি। দেখছি এই জগতের আশ্চর্য সুন্দর রূপ। দেখছি এর বৈচিত্র্য ও পালাবাদল। দেখছি, একটু আড়ালে থাকেন বলেই যাকে আমরা যাকে মিথ্যা ভাবি; নেই বলে অহংকার কার করি- তার বহুবিধ প্রকাশ।

আপনি দেখছি কাব্য করতে শুরু করেছেন। ভাবিজী প্রশংসার সুরে বললেন, কবিটবি নাকি ভাই ?

আমি হেসে বললাম ঃ এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘন ঘোর বরিষায়।

বেচারার এমন লাÑজওয়া হলেন যে আর প্রশ্ন করলেন না।

দু’ঘন্টা অপেক্ষার পরও যখন বৃষ্টি থামলো না, তখন সবাই মিলে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। ততক্ষণে বৃষ্টিটাও একটু ধরে এসেছে। আমাদের দেখাদেখি আরও বেশ কিছু পর্যটক বাড়ীর দিকে পা বাঁড়ালো।

জীপ স্টার্ট দিয়েই ড্রাইভার জানতে চাইল ঃ জয়া প্রদার সাথে দেখা হল, দাদা?

জয়া প্রদা? অবাক কন্ঠে তাকালাম সবাই।

কেন, দেখলেন না দুটো তাবু? আরে ওখানেইতো উনি গত চারদিন ধরে শ্যুটিং করছেন।

গৌরী বৌদী জয়া প্রদার অন্ধ ভক্ত। চেচিয়ে বললেন ঃ ইস একটু আগেল বলবে তো। আচ্ছা, আরেকবার যাওয়া যায় না?

গাড়ী ততক্ষণে অনেকদূর এগিয়েছে। আমরা বৌদীকে বোঝালাম যে, কথাটা সত্যি নাও হতে পারে। কিংবা ওদের কাজ শেষও হয়ে যেতে পারে। মিছামিছি কষ্ট করে লাভ কি? যদি সত্যিসত্যিই জয়া প্রদা থাকে, তবে কালকেও আসা যাবে।

বৌদি ম্লান মুখে বললেন ঃ তা কি আর হয়, ভাই? আচ্ছা থাক, কালকের ব্যাপার কালকেই দেখা যাবে’খন।

ছায়া ঢাকা পাহাড়ের কোল বেয়ে ছোটা জীপের মধ্যে আমরাও বিষন্ন হয়ে রইলাম বৌদীর জন্য। কিন্তু ড্রাইভারের গল্পের ঠেলায় সে নিস্তব্ধতা স্থায়ী হল না। কিছুক্ষনের মধ্যে সকলেই মজে গেল তার গল্পে।...

***

পশুপতি মার্কেট নেপাল-সিকিম বর্ডারে অবস্থিত ছোট্ট একটি বাজার। পর্যটকদের জন্য বিশেষ কিছু নেই। তবে ভারতীয়দের কাছে বিদেশী জিনিসের চাহিদা ব্যাপক। নেপালের লঘু শুল্কনীতির ঐ কারণে মার্কেটে বিদেশী জিনিস অনেক পাওয়া যায়। বিশেষত ছাতা, ঘড়ি, ক্যালকুলেটর, টি-শার্ট, গেঞ্জী, জুতা, সিগরেট, কোল্ড ও হট ড্রিংস। এগুলো ভারতের অভ্যন্তরে যেমন সুলভ নয়, তেমনি দামেও চড়া। সেহেতু এই অতি আগ্রহ।

ফর্মাল চেক-পোষ্ট ও কাস্টমস পার হয়ে যাবার সময় গুর্খা পুলিশ পই পই করে জানতে চাইল ঃ কেউ অ-ভারতীয় আছেন কি না। থাকলে পাসপোর্ট দেখিয়ে যাবেন।

আমি কিছুটা শংকা বোধ করলাম। কিন্তু পরাগ ও জয়ন্তের অতি-উৎসাহে সেটা চাপা পড়ে গেল। হৈ চৈ করে ভেতরে ঢুকলাম আমরা।

সারি সারি দোকানে নেপালী যুবতীরা পসরা সাজিয়ে বসেছে। রঙিন ছাতা আর ঝকমকে ব্যাগে প্রত্যেকটি দোকান উজ্জ্বল। আমি ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত বোধ করলাম। বৌদি আর সুকুমার বাবু টুকিটাকি বেশ কিছু জিনিস কিনলেন। পরাগ আর জয়ন্ত ততক্ষণে দুটো করে জিন্সের প্যান্ট পরে ফেলেছে। হাত ভরে নিয়েছে স্যান্ডেল, জুতা, বিয়ার ও টি-শার্ট। ভিজয় বাবু আর ভাবীও কিনেছেন বেশ কিছু।

আমার নেবার কিছু ছিল না। কিন্তু সকলের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে তিষ্টাতে না পের একজোড়া চপ্পল নিলাম। কাঠমান্ডুতে তৈরী। নেপালী ভাষার ছাপ আছে।

ফেরার সময় কাস্টমস তার আসল চেহারা দেখিয়ে দিল। সবার সামনেই দিল্লীওয়ালী ভাবী ও গৌরি বৌদির শরীরে এমন ভাবে হাত চালালো যে আমাদের মাথা নীচু হয়ে গেল। প্রতিবাদ করা গেল না, কারণ সবার মনেই অপরাধী ভাব। চুপচাপ সবাই পাড় হয়ে যেতে পারলেই যেন বাঁচে।

গাড়ীতে ফিরে সুকুমার বাবু ফেটে পড়লেন ঃ শুয়ারের বাচ্চাদের কান্ডটা দেখলেন? শালা গুর্খাদের এজন্যই দেখতে পারি না আমি। হারামীর বাচ্চারা দুশো বছর আমাদের জ্বালিয়েছে। এখনো জ্বালাচ্ছে। ইংরেজদের মত ওদেরও পোদে লাথ্ মেরে খেদানো উচিত। শালা! তারপর আস্তে বললেন ঃ গৌরি, তোমার লাগেনি তো?

বৌদি চোখের জল আটকাতে না পেরে বুকের কাপড় সরালেন। তার ব্লাউজের তিনটে বোতামই ছেড়া।

দিল্লীওয়ালী ভাবীর চোখও টলোমলো। পিছন ফিরে ভাঙ্গা গলায় বললেন, আমার ভেতরের হুকটাই বোধ হয় গেছে। ছি: ছি:।

আমি, পরাগ আর জয়ন্ত এমন ভাব করলাম, যেন কিচ্ছুটি শুনতে পাইনি! (১৯৮৮)।

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৪:০২

কামরুল ইসলাম (সুমন) বলেছেন: শিরনাম পড়ে চটি চটি লাগসে তাই পড়িনি , সামুর এমন বিপদের সময় এমন শিরনামে পোস্ট না করাই ভালো।

২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৪:৩৭

বুলবুল সরওয়ার বলেছেন: ধন্যবাদ। ঠিক করে দিলাম। কৃতঞ্গ থাকলাম। জানাবেন।

২| ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:২২

কুন্তল_এ বলেছেন: দুরন্ত লেখা। রাজিব গান্ধির উল্লেখ দেখলাম এক জায়গায়, কবে গিয়েছিলেন দার্জিলিং? :)

২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ৯:২৬

বুলবুল সরওয়ার বলেছেন: জ্বি। কিছু কিছু বিষয় গোপনই থাক না!

৩| ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:২৬

সূচিপত্র বলেছেন: দীর্ঘ সময় নিয়ে পড়তে হলো। বারবার মনোযোগে হানি ঘটালো কয়েকজন । ভাল লিখেছেন। আপনার লেখার ধরনটা ভাল। অনেক কিছুর ইতিহাসও জানতে পারলাম। যা কাজে লাগবে।
ধন্যবাদ

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১২:৩৫

বুলবুল সরওয়ার বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ। ১৯৮৬ থৈকে আমি ভারত সফর শুরু করি। কিছু কিছু ‘ডাইরী’ তখনই লেখা, কিছু পরে। এসব তথ্য নানা বই, বিশেষত টুরিস্ট গাইড থেকে নেয়। পিসি আরো পরে, আর ইন্টারনেট অ-নে-ক পরের। ভুলৈ থেকে যেতে পারে দু’এক জায়গায়। তবে আপনাদের আগ্রহ আর নিষ্ঠায় আমি মুগ্ধ!

৪| ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৪০

কামরুল ইসলাম (সুমন) বলেছেন: সুন্দর লিখছেন, প্রথম ভালো লাগা :D

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১২:৪১

বুলবুল সরওয়ার বলেছেন: আপনার পরিচয় জানতে চাই। সম্ভব?

৫| ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১২:৪০

বুলবুল সরওয়ার বলেছেন: লেখক বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ। ১৯৮৬ থেকে আমি ভারত সফর শুরু করি। কিছু কিছু ‘ডাইরী’ তখনই লেখা, কিছু পরে। এসব তথ্য নানা বই, বিশেষত টুরিস্ট গাইড থেকে নেয়া। পিসি আরো পরে, আর ইন্টারনেট তো অ-নে-ক পরের। ভুল থেকে যেতে পারে দু’চার জায়গায়। তবে আপনাদের আগ্রহ আর নিষ্ঠায় আমি মুগ্ধ! (বানান ঠিক করতে হল। দু:খিত)!

৬| ০৯ ই মে, ২০১৪ সকাল ৭:০২

সাবিউল হক বলেছেন: আপনি এত সুন্দর লেখেন কিভাবে? আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে যাই। মুগ্ধ হয়ে আছি -প্রতিপক্ষে সেনাপতি -থেকেই । ধন্যবাদ । এ বছর নতুন বই কী বেরিয়েছে ?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.