![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কবিতাই প্রিয়। কিন্তু গদ্যও যে তার আরশিনগর। তাই নারীর চেয়ে যতই প্রিয় বলি দেশকে; প্রকৃতি হেসে বলেঃ ও হলো কথার কথা। এভাবেই একদিন প্রেমে পড়লাম ঢাকার... স্বপ্নের মত সুন্দরী এক বারবনিতা। থাক এসব ব্যক্তিগত প্যাচাল। তার চেয়ে আসুন পাঠ হোক...
খুব সকালেই বাস স্ট্যান্ডে হাজির হলাম। বিশ লিরার টিকেট নিয়ে ডান দিকের তৃতীয় সারিতে বসলাম। আড়াই ঘন্টার জার্ণি- দেখতে দেখতেই কেটে যাবে।
কাল রাতে হোটেলের গাইড দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাসেই যাবো। ট্রেন জার্নি বেশি আরামদায়ক হলেও সময় লাগে প্রায় দেড় ঘণ্টা বেশি। পর্যটকের জন্য সময়ই মূল্যবান।
অতি চমৎকার রাস্তা। দুধারে পাইন আর পপলার গাছ। ঝাটিতে চোখে পড়ছে টিউলিপ গার্ডেন। রঙ যেন প্রজাপতির পাখায় মাখা। বাংলাদেশে এই রঙের চুম্বক চোখে পড়ে শুধু শর্ষে ফুলে। তামাক পাতাও দেখতে সুন্দর- কিন্তু সে দৃশ্যে ভদ্দরজনের চোখ বেশি না বোলানোই ভালো।
যৌক্তিক মন নিষেধ করলেও বাংলাদেশের দুটো রাস্তা আমার মনকে টেনে নিল: প্রথমটি রংপুর থেকে বাংলা-বান্ধা; দ্বিতীয়টি কুষ্টিয়া থেকে মেহেরপুর। দুটো রাস্তারই নৈসর্গিক সৌন্দর্য আমাকে মোহাবিষ্ট করে। গাছ, ছোট-বড় নদী-নালা, আর সবুজের সমারোহ যে কী সুন্দরÑ তা কাউকে কয়ে বোঝানো যায় না।
ওসমানদেও দ্বিতীয় রাজধানী এদির্ণে যাবার পথের প্রতিটি বাঁকে আমার মন ছুটে গেল বাংলাদেশে আর চোখ আটকে রইল ইউরোপীয় রঙের সাইনপোস্টে। স্পষ্ট, পরিচ্ছন্ন এবং সুলিখিত পোস্টগুলো দেখেই বলে দেয়া যায় যে তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নে ঢোকার জন্য উদগ্রীব। কিন্তু যে ওসমানী সুলতানদের হাতে বারবার পরাজিত হয়েছে পূর্ব ও মধ্য ইউরোপ- তারা কি এত সহজে তুর্কীদের ওয়েলকাম করবে?
তুন্দ্ঝা নদীর নামটাই আমাকে আকৃষ্ট করে। মারিৎসাও তাই। শত শত ইতিহাস আর পৌরানিক কাহিনী জড়িয়ে আছে এর পাতায় পাতায়। পূর্ব তুর্কীস্থানে যেমন মুরাত নদী আর লেক-ভান, থ্রেসে ঠিক তেমন কিছুর প্রতিতুলনা না থাকলেও এটা যে পশ্চিমাঞ্চলের ক্ষুদে ইউফ্রেটিস-টাইগ্রিস, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
দূর থেকেই চোখ পড়ল সেলিমিয়ার মিনার আর গম্বুজ। তাজমহলের মতই নয়নাভিরাম। বাস যত কাছে এগুলো, ততই মসজিদটিকে মনে হল চেনা-চেনা। পাশে বসা ভদ্রলোক বললেন, আপনি তো ব্লু-মস্ক দেখে এসেছে, তাই না? তার একটু নিচেই তো সুলেমানিয়া!
সাথে সাথেই হাসি পেল আমার। সত্যিই তো ভুলে গেছিলাম, সেলিমিয়া আর সুলেমানিয়া আসলে দুই যমজ বোন। মহাশিল্পী সিনান নিজেই কবুল করেছেন, তার সৃষ্টির মাঝে সেলিমিয়াই রাজ-তিলক। মুসলিম সভ্যতা ইউরোপে যেন নিজেকে চিনিয়ে দেয়Ñ সুলতানের এ আদেশের পরিপূর্ণ মমার্থ সিনান কুটিয়ে তুলেছেন স্থাপত্যকর্মের মধ্যেই।
ভিতরে ঢুকে হতভম্ব হলাম। সাধারণ একজন মানুষ কি করে এত বিশাল নির্মানের পরিকল্পনা করে? চিত্রশিল্পী এস.এম.সুলতানের ছবির সাইজ দেখেই যেখানে আমি ভিড়মি খাই, সেখানে সিনানকে বুঝতে চাওয়া প্রায় অসম্ভব বৈকী। একত্রিশ মিটারেরও বেশি ব্যাসের সুবিশাল ডোমের দিকে তাকিয়ে আমার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেল ঢাকা বা কলকাতার প্লানেটারিয়াম। সত্যিই এ কাজ আধুনিককালে করা আর সম্ভব নয়। পিরামিডের মত কিছু গোপনীয় কৌশল অবশ্যই আছেÑ যার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে কঠিন ভূমিকম্প!
অনেকের মতে, চার খলিফা এবং রাসুলুল্লার প্রতীক চিহ্ন এই সেলিমিয়া। মূল ডোমের চারপাশের চারটি অর্ধ-ডোমের আরও নানা ব্যাখ্যা আছে। আমি সে-সব হেঁচিপেচির মধ্যে না গিয়েই মিনারগুলোর মাথা দেখতে চেষ্টা করলাম। সূর্যের মধ্যে গিয়ে আমার দৃষ্টি অন্ধ হয়ে গেল।
কুতুব মিনার থেকে মাত্র পৌনে দু’মিটার ছোট স্তম্ভগুলো পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ মিনারেট। এ যেন ইউরোপকে ঘাড় ধরে দেখিয়ে দেয়া, খোদাই সর্বাগ্রে এবং তার অবস্থান মধ্যাহ্ন সূর্যের চেয়েও দীপ্র-দীপ্ত-সমুজ্জ্বল। ঐ-ঐ নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ- হে সাধারণ মানুষ! দেখ, তাঁর তুলনায় আমরা কত ক্ষুদ্র; কত অনু-পরমানু।
নাশতার জন্য কাছের একটি ক্যাফেতে ঢুকলাম। কিছু কিছু তুর্কী শব্দ এদ্দিনে বলতে পারছি। তাই কাজে লাগিয়ে ছোট একটুকরা রুটি আর কাবারের অর্ডার দিতে অসুবিধে হল না। কিন্তু বাঙাল কি আর অত সহজে পার পায়? ভুলেই গেছিলাম যে ইস্তাম্বুলের মত বড়-বড় শহরের বাইরে পুরো তুর্কিস্তানেই কাবাবের অর্ডার দেয়াই যথেষ্ট। দু’এক টুকরা রুটি এমনিতেই দেয়া হয়; Ñফাও!
ফ্রম হুইচ কান্ট্রি, স্যার? ফেজটুপি-পরা ওয়েটারের মুখে প্রসন্ন সিগ্ধতা। আর ইউ এ মোজলেম?
নিজের পরিচয় দেবার পরই সে বলল, আমিও তাই ভেবেছিলাম; ইন্ডিয়ান বা মালয়েশিয়ান হবেন। এদির্নেতে কি প্রথমবার, স্যার?
জ্বি-হাঁ।
প্রোগ্রাম কি?
কফিতে চুমুক দিতে দিতে এক-দিনের সফরের কথা বললাম তাকে।
তাগিদান বলল, আপনি যদি সবকিছু কাভার করতে চান, বিশেষত দুটো বর্ডার-পোস্ট, তাহলে রিজার্ভ টেক্সি নেয়াই ঠিক হবে। ওরা পুরোটা ঘুরিয়ে মাগরিবের কফি এখানেই পান করাতে পারঙ্গম।
আর গাইড?
আপনি অনুমতি দিলে আমি আমার ভাইকে সে-রকম একজন টেক্সিওয়ালা দেব, যে টুকটাক গাইডিংও পারবে।
তাগিদানের বলার ভঙ্গি এত আন্তরিক যে খরচের কথা জিজ্ঞাসা করতেই সাহস পেলাম না। আজও নিশ্চিত জানি, আমার সংকোচ আমাকে ডোবাবে।
টেক্সি ঠিক হলে তাগিদান বলল, এফেন্দি! আগে বাইরেটা ঘুরে এসে সেলিমিয়ায় পরে ঢুকবেন। আসর থেকে মাগরিব অব্ধি এই মসজিদে চলে রঙের খেলা। নামাযও পড়তে পারবেন; মনও ভাল হয়ে যাবে।
তাগিদানকে ধন্যবাদ জানিয়ে টেক্সিতে উঠে বসলাম। এদির্নে পার হয়েই দুটো বর্ডারের রাস্তা দু’ভাগ হয়ে গেছে। কারাগাছ পার হয়ে দক্ষিণের রাস্তা গেছে পাজারকুলে, গ্রীসের দিকে; সারায়েসি হয়ে পশ্চিম-উত্তরে গেছে বুলগেরিয়ার কাপিকুলে। ড্রাইভার মেহমেত জানাল, দুটোরই দূরত্ব কম-বেশি ১০-১৫ কিলো। কোন দিক যাবো, সাইয়েদ?
কারাগাছ দেখারই আগ্রহ বেশি আমার। বিশেষত মেরিৎসা নদীর পশ্চিম পাড়ের এই এক ফালি জায়গায়ই তুরস্কের দখলে আছে। ট্রিটি অফ লুজানের (১৯২৩) ফলে তুরস্ক খন্ড বিখন্ড হওয়া থেকে রক্ষা পেলেও, গ্রীকরা এই ভূমিটুকু ছাড়তে চায়নি, কারণ এর সাথে জড়িত আলেক্সন্ডার দ্য গ্রেট এবং তার মা-অলিম্পিয়ার স্মৃতি। অন্যদিকে মোস্তফা কামালও ছিলেন অনড়, কারণ এ-এলাকার পাশেই তার জন্মস্থানÑ সেলোনাইকা!
কারাছ ব্রীজটি প্রাচীন ইউরোপের সবচে সুন্দর ব্রীজগুলোর একটি। সম্ভবত দানিউব ছাড়া কোন নদীর উপর এমন কারুকার্যময় লম্বা পাথুরে ব্রীজ নেই। নোবেলজয়ী উপন্যাস ‘ব্রীজ অন দ্রীনা’র ব্রীজটি দেখে বিশ্বাসই হয় না যে সেটি চারশো বছরের বলকান-সভ্যতার দলিল। এবং মহা আশ্চর্যের বিষয়, বসনিয়ার সেই সকলোভিচ ব্রীজটিও স্থপতি সিনানেরই তৈরী।
ব্রীজ পার হয়ে বর্ডারে পৌঁছাতে বিশ মিনিটের বেশি লাগল না। পথে দু’জায়গায় পুলিশ থামিয়েছে। তৃতীয় চেক-পোস্ট সামনে দেখেই মেহমেতকে বললাম, আর যাওয়ার দরকার নেই, আফেন্দি। চলো, দেখা তো হয়েছে।
ড্রাইভার তাই করল।
কিন্তু ভাগ্য ছিল বিরূপ। কি কারণে জানি না, বর্ডার পুলিশের সন্দেহ হয়েছে। নীল টর্চ জ্বেলে তারা ড্রাইভারকে পোস্টে যাবার ইঙ্গিত করল।
মেহমেত ভয় পেয়ে বলল, আপনি কি সিক্রেট সার্ভিসের লোক, সাইয়েদ?
আমি চমকে উঠলাম। মুহূর্তেই জেমস্বন্ড ছবিগুলো মনের পর্দায় ভেসে উঠল। নাহ্ গ্রীস-তুর্কি নিয়ে কোন কাহিনী এখনো বানানো হয়নি। দ্বিতীয় ছবি ‘ফ্রম রাশিয়া উইদ লাভ’ যদিও ইস্তাম্বুলকে ঘিরেই, কিন্তু সে-তো ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস নিয়ে। কেন তবু ড্রাইবারের মনে হল যে আমি গোয়েন্দা হতে পারি?
পুলিশরা আমার দিকে আঙুল তোলার আগেই আমি নেমে পড়লাম টেক্সি থেকে। আল্লাই ভালো জানেন, কোন বিপদে জড়িে যাচ্ছি।
আই-ডি, প্লিজ।
আই অ্যাম জাস্ট এ টুরিস্ট।
হোয়াই বর্ডার?
জাস্ট টু সি।
হোয়াই টু সি?
জাস্ট এ লুক।
জাস্ট এ লুক? স্ট্রেঞ্জ।
নো স্ট্রেঞ্জ, স্যার। আই অ্যাম এ রাইটার।
রাইটার? ইউ নো পামুক?
আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে ভাবলাম, সে-কি আমাকে অরহান পামুকের কথা জিজ্ঞাসা করছে? বুঝতে না পেরে ডানে-বায়ে মাথা দোলালাম।
নো এনিবডি তুর্ক?
নো।
এনি পাসপোর্ট?
নো।
এরকম কথাবার্তা চলতেই থাকত, যদি না আমার হঠাৎ তাগিদানের কথা মনে না পড়ত। দ্রুত বুক পকেট থেকে হোটেলের মেনুতে লেখা তার সেল-ফোনটা দেখিয়ে দিতে পারলাম।
অফিসার পোস্টে ফিরে গেল। ফোন তুলে কোথাও কথা বলল। আয়নার ভেতর দিয়ে সব ঝাপসা দেখাচ্ছে।
কিন্তু আমার আশংকা আর ভয়কে মিথ্যা প্রমান কওে সে বেরিয়ে এলো হাসিমুখে। নো প্রোব্লেম, স্যার। তাগিদান আপনাকে লাঞ্চের দাওয়াত দিয়েছে। আর সবুজ পাসপোর্টকে আমরা ‘বিপদ’ মনে করি, যদিও তা আপনার কাছে নেই। সরি স্যার, সালামালেকুম!
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল আমার। পাসপোর্ট সঙ্গে না রাখায় মত ভুল আগে কখনো হয়নি। আজ হয়ত তাই শাপে বর হয়েছে। যদিও এতক্ষণ সকালে ব্যাগ না নিয়ে খালি হাতে বেরিয়ে পড়ার জন্য মনে মনে নিজেকে গালমন্দ করছিলাম।
কারাগাছ ফেরার পথে লুজানে-মনুমেন্ট দেখলাম। তারপর লাঞ্চ খেতে বসলাম সারিৎসা নদী পাড়ের এক দেহাতী হোটেলে রেকি, কাবাব আর চা খেলাম। মেহমেত শুধু কাবাব খেল। মাথার উপরের ছাতার উপর রোদ তেমন নেই। আকাশে সামান্য মেঘ। পাথরের খাঁজে খাঁজে ¯্রােত বইছে শব্দ করে। পাহাড়ী নদী এরকমই হয়। অথচÑ
Ñযদি ঢল নামে, চিন্তিত মুখে জানাল মেহমেত, আপনি এমনকি এদির্নে ফিরে যাবারও সুযোগ পাবেন না। পনেরো বিশ মিনিটেই এ-জায়গা তলিয়ে যাবে। রাস্তার উপর পানি উঠে আসবে এবং যদি দ্রুত গাড়িতে উঠতে না পারি, হেলিকপ্টার ছাড়া ফিরতে পারবেন না।
হে-হেলি-হেলিকপ্টার...? আমি প্রায় বিষম খেতে খেতে জানতে চাই, কি বলছ এসব? এত দ্রুত পানি কোত্থেকে আসবে, মেহমেত?
মেরিৎসা নদীর বৈশিষ্ট্যই এই। প্রতি বছরই আট-দশবার আটকে পড়ার ঘটনা ঘটে। আকাশে মেঘ দেখলেই ট্যাক্সি বন্ধ করে দেই। সবই আল্লার ইচ্ছা।
চার পাশের পাহাড় দেখে বোঝারই উপায় নেই যে এরকম অলৌকিক কিছু ঘটা সম্ভব। সন্দেহের বশেই জিজ্ঞাসা করলাম, কারাগাছ ব্রীজ কি এজন্যেই পাথরে বানানো?
ঠিক ধরেছেন, সাইয়েদ। আমরা শুনেছি, সিনানের শৈশব এদিকেই কেটেছিল। তিনি জানতেন মারিৎসা ও তুন্দ্ঝা নদীর তান্ডবের কথা। সে কারণেই ব্রীজটি অত লম্বা, অত শক্ত। জানেন তো, লোকে বলেÑ কারাছ ব্রীজকে নাকি হাতিও ভয় পায়।
হেসে কফির শেষ চুমুক দিতেই মেহমেত বলল, সিগার চলবে?
আমি মাথা নাড়তেই সে জানতে চাইল, কখনো খাও নি?
না।
জীবন তাহলে চলে কিভাবে?
আমি তার কথার জবাব না দিয়ে কারাছ ব্রীজের দিকে চেয়ে ভাবলাম, এই সিনান কত ভাবেইনা বেঁচে আছেন। তার অসামান্য সব সৃষ্টিকর্মের খুব অনুল্লেখযোগ্য একট হল সকলোভিচ ব্রীজ। অথচ, সেই ব্রীজকে কেন্দ্র করে লেখা উপন্যাস-ই নোবেল পুরষ্কার পেল।
ঘুরপথে আমরা পৌঁছলাম বুলগেরিয়ান সাইডে। আগেই মেহমেতকে বলে রেখেছি, এবার বর্ডারের খুব কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কাছাকাছি কোন ক্যাফেতে গিয়ে এমনভাবে দাঁড়াবে, যেন চা-খেতে থামছি।
সেভাবেই দূর থেকে দেখলাম কাপিকুলে-বর্ডার। মেয়েদের পোষাকেই বোঝা যাচ্ছে এরা প্রায় ইউরোপীয়ান। যে-মেয়েটি চা পরিবেশন করল, তুর্কী হলেও তার স্লিভলেস ব্লাউজ আর শর্ট-স্কার্ট যথেষ্ট অন্যরকম। আর যখন সে জানতে চাইল, আজ রাতে বর্ডারেই থাকবো কিনা, তখন স্পষ্টই বোঝা গেল তার চোখে অন্য প্রত্যাশা। হেসে বললাম, নো ম্যাম, সরি। আজই আমাকে ইস্তাম্বুল ফিরতে হবে।
আবার আসছ কবে?
আমি তার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। মিথ্যে আশা জাগিয়ে তো লাভ নেই।
সে আমাকে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করছিল। টাকা দেবার সময় দেখি বিলের উল্টোদিকে লেখা: মারিয়া; +৯০৫৪৯৫৪০৫...। হেসে বললাম, সি-ইউ ম্যাম। সি-ইউ সুন।
ফিরে আসার রাস্তা একেবারেই অন্যরকম। গ্রীসের সাইডের রাস্তা ছিল খুবই আঁকাবাঁকা, সর্পিল; কিন্তু বুলগেরিয়ার এদিকটায় রাস্তা সোজা এবং মসৃন। পূর্ব-দক্ষিণে তাকাতেই মনে হল, সেলিমিয়ার চার-চারটি সুউচ্চ মিনার হাত বাড়িয়ে ডাকছে: আহলান, ওয়া সাহলান! এসো শান্তির দিকে; এসো প্রাচ্যের দিকে।
কাভার্ড বাজার, রেল স্টেশন, এসকি কামি (পুরানো মসজিদ) আর মেসিডোনিয়ান টাওয়ার ঘুরিয়ে মেহমেত আমাকে নিয়ে এলো তাগিদানের ক্যাফেতে। সেই ফেজ-টুপি, সেই আলখেল্লা আমাকে এমন গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরল যে মনেই হল না মাত্র সকালেই পরিচয় হয়েছে লোকটির সাথে। চা পানের পর বলল, চলো আমিই তোমাকে সেলিমিয়া দেখিয়ে আনি।
নামাযের পর বেশ ক’মিনিট তুর্কী ভাষায় বয়ান হল। আমি সেদিকে মনযোগ না দিয়ে আকাশের মত উঁচু গম্বুজ আর খিলানের দিকে নজর ফেরালাম। গম্বুজের পশ্চিম দিকে কামানের গোলা পড়েছিল। এখান থেকে অবশ্য সেই ক্ষতস্থানে দেখা যাচ্ছে না। তবে বইয়ে পড়েছি, আতাতুর্ক সেই ক্ষতচিহ্ন মুছে দিতে মানা করেন। বিপ্লব-পরবর্তী কালে এই একটি নির্দেশই তার জীবনের সাথে বেখাপ্পা লাগে, যখন তিনি বলেছিলেন: ইউরোপ যেন সেলিমিয়ায় এসে দেখতে পায়, মুসলমানদের তুলনায় তারা কত বর্বর!
সিনানের বহু নির্মাণই বিস্ময়কর; তবে সেলিমিয়া বিশালকায়ও বটে। আমাদের তাজমহলের সাথে এর গঠনশৈলীরও যথেষ্ট মিল। এদির্নের প্রায়-সমতল ভূমি থেকে খানিকটা উঁচু জায়গাটিতে মসজিদটি বানানো হয়েছে চারকোনা বেদির উপর। পশ্চিম দিকে প্রবেশ মুখ। পশ্চিম দিক দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে আমার মন সব সময়েই খুঁত খুঁত করে। আমার কাছে পশ্চিম যেন শুধু কিবলা নয়, অস্তগামী সূর্যের সাথে মৃত্যুর দিকেও অবচেতন নতি! অনেকবারই আমি ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিতে চেয়েছি; কিন্তু মন আমার বার বার খাঁচা কেটে উড়ে যেতে চায় পূবে, যেখানে আমি সিজদা দিতে পারি পশ্চিমে।
মাগরিব হয়ে গেল সেলিমিয়া ঘুরে দেখতে। সূর্য ডুবে যেতে না যেতেই বিদ্যুতের আলোয় ঝিলমিল করে উঠল সেলিমিয়া। পেন্সিলের মত চারকোনা মিনারগুলোর মাঝের তিনটি ঝুল-বারান্দা খুবই চমৎকার আলোয় সাজানো। ভেতর থেকে আলোগুলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে আকাশের দিকে।
তাগিদানের ক্যাফেতে বসে আবার যখন সেদিকে তাকালাম- অন্ধকার প্রেক্ষাপটে সেগুলো যেন আলোর স্তম্ভ হয়ে অনন্তের সাথে গিয়ে মিশছিল। বিমুগ্ধ চিত্তে ভাবলাম: ভোগবাদী ও স্বার্থপর মানুষের মাঝেই খোদা কত মহান কারিগরদের পাঠানÑ যারা মানুষের কলুয়িত অন্তরকে আলোয় উদ্ভাসিত করেন যুগের পর যুগ; শতাব্দীর পর শতাব্দী!
*
ওসমানদের প্রথম রাজধানী বার্সা দেখার ইচ্ছে ছিল দুটো কারণে- প্রথমত ২৩০ কিলো দূরত্বের এই পথ যেতে হয় ওয়াটার টেক্সি বা হুভারক্রাফটে করে; দ্বিতীয়ত ওসমান এবং অরহানের স্মৃতিগুলো দেখা সর্বার্থেই উচিত মনে হয়েছেÑ যারা এই বিশাল ওসমানী সা¤্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বহুলাংশে ধর্মীয় কর্তব্য-বিবেচনায়, যা সিন থেকে দানিয়ুব পর্যন্ত মানুষের মন থেকে মুছে দেবে ক্রুসেডের বর্বরতা।
ইয়েনিকাপি ফেরি টার্মিনালে পৌঁছালাম সকাল সাতটায়। হালকা কুয়াশার মার্মারাকে মনে হচ্ছে চাঁদর-ঢাকা রূপালী ময়দান। বিশাল বিশাল জাহাজগুলো দাঁড়িয়ে না থাকলে হয়ত গোল্লাচুটের জন্য দৌড়-ই দেয়া যেত।
ইয়েনিকাপি থেকে বাহন নির্বাচন করা কঠিন কাজ। ইয়াসমীনা আমাকে বার বার না করেছিল একা যেতে। কিন্তু ওদের অপেক্ষায় থাকলে আমার ভ্রমণ তৃষ্ণা তো মিটবে না। আনোয়ারের টাকা আছে ঠিকই, কিন্তু শেখদের মতই সে-টাকা সে খরচ করতে চায় তার নিজস্ব কায়দায়। আমি চঞ্চল বাঙালী, না আছে ট্যাকের জোর, না বীর্যের। সুতরাং ছোট্ট একটি ব্যাগ কাঁধে ফেলে রওয়ানা হয়েছি ফজরের পরেই।
দু’রকম ফেরিপথে বার্সা যাওয়া যায়- প্রথমত ইয়ালোভা হয়ে; যেখান থেকে বার্সা বাসপথে ৫৫ কিলো; অথবা গুজিয়ালালী হয়ে, যেখান থেকে মেট্রো (বার্সারী) আছে ২৪ কিলোর। দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঝেড়ে আমি গুজিয়ালালীর টিকেট কাটলাম।
ক্যাটামেরন ফেরী প্রায় থ্রি-স্টার হোটেলের মত; এরা বলে সি-বাস। প্লাস্টিকের পয়সার মত কম্পিউটারইজড টিকেট; ভেতর আছে কম্প্যূ-চিপ। এবং যথারীতি, এরও একদিকে আতাতুর্ক অন্যদিকে ৫ লিরার ছাপ; যদিও কোম্পানী নিলো সাড়ে সাত লিরা।
বিজনেস ক্লাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মনে হলো: হ্যাঁ, এ দেশের জন্য যুদ্ধ করে মরা যায়। যে-যুদ্ধ মানুষকে শান্তি দেয় না, পরবর্তী প্রজন্মকে নৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তি দেয় না, সে-যুদ্ধ আসলে অর্থহীন রক্তপাত ছাড়া কিছু নয়। একটি নতুন গান কিংবা রঙবেরঙের পতাকার আসলে কী মূল্য, যদি সে খাওয়া-পরার নিশ্চয়তা না দেয়? এক অব্যক্ত বেদনায় আমার চোখ ভিজে গেল।
এক ঘণ্টা দশ মিনিট পর নামলাম গুজিয়ালালীতে। ম্যাক্সির মত ডলমায় উঠতে হবে এখান থেকেই। যেখানেই যান, ভাড়া দুই-লিরা। এক অসহ্য ভার বুকের উপর চেপে আছে। মোস্তফা কামালের মত একজন জেনারেল আমার দেশে কবে জন্মাবে? কবে আমরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারব, সকল দেশের সেরা সে-যে আমার জন্মভূমি?
এক তরুণী আমাকে টেনে নিয়ে এলো ফুটপাতের উপর। প্রায় ধাক্কা খেতে যাচ্ছিলাম একটি ডলমার সাথে। সচকিত হয়ে বললাম, থ্যাংকিউ, ম্যাম। পার্ডন মি, প্লিজ।
কোথায় যাবে তুমি? আসছ কোত্থেকে? বিদেশী তো দেখতেই পাচ্ছি।
যাচ্ছি বার্সা ঘুরতে। ওয়ান-ডে ট্রিপ। বাংলাদেশ থেকে আসছি। তুমি কে?
আমি? আমি বিথিয়া।
আমি সারোয়ার।
তুমি মুসলমান, তাই না?
হ্যাঁ, কিন্তু কেন? আমি অবাক না হয়ে পারি না।
নাম শুনে বুঝছ না, আম ইহুদী। থাকি প্রিন্সেস আইল্যান্ডে। যাচ্ছি বার্সার মেয়র অফিসে। তাদের ওয়াটার সাপ্লাইয়ের নকশাটা নিতে হবে। আমাদের গভর্ণর চাইছেন। জান তো, আমাদের দ্বীপগুলো ইস্তাম্বুলের কাছাকাছি হলেও নাগরিক সুবিধায় প্রায় প্রাগৈতিহাসিক যুগের। তাইÑ
এর আগে কোন ইহুদী নারীর সাথে বন্ধুত্ব হয়নি। বুকের ভেতর তীব্র কৌতূহল লাফিয়ে উঠল। এর সাথে সখ্য গড়ে যদি ইসরাইল ঢোকা যায়। সাদামাটা উপায়ে তো মসজিদুল আকসা দেখার সুযোগ নেই। আমার পাসপোর্টে তো সিল মারা অমুক দেশে যেতে মানা।
ডলমা ৩০ মিনিটে ছানায়ী মেট্রো স্টেশন যাবে। সেখান থেকে ডলমা ধরে শহর- কেন্দ্রে। পুরো রাস্তার আগেই যদি বিথিয়া নেমে যায়, তখুনি বুঝতে হবে বিথিয়ারা পথের বন্ধু ছাড়া কিছু নয়। তাকে ধরে জেরুসালেম যাবার চিন্তা করেছি দেখে আপন মনেই হেসে উঠলাম।
ঘটলোও তাই। ‘ইডো’ থেকে সে নিলো অন্য টিকেট। আমি আবার আগের মতই একা হয়ে নামলাম বার্সায়Ñ যেখান থেকে শুরু হয়েছিল ওসমানী খিলাফত।
তেরশো নিরানব্বইয়ে গড়া উলু-কামি বা গ্রেট-মস্ক দিয়ে শুরু করলাম পথ চলা। তার আগে পেট পুরে নাস্তা করে নিলাম সুবিখ্যাত ইস্কান্দারি কাবাবে। এই কাবাব মধ্য এশিয়ায় শ্রেষ্ঠতম দাবী তুর্কীদের। ছোট ছোট রুটি আর ঘন দইয়ের সাথে পরিবেশিত হয়। আমার সাথে র্যাকসাক আর ক্যামেরা ছাড়া কিচ্ছু নেই। সুতরাং ঝামেলা ছাড়াই ঘোরা যাবে আশা কওে আস্তে-ধীরেই কফিতে চুমুক দিলাম।
উলু-কামি মসজিদের গঠন দেখেই আমার ষাট গম্বুজ মসজিদের কথা মনে পড়ল; বিশেষত ছাদ দেখে। একই রকম শ্যাওলা পড়া খয়েরী গম্বুজ : সেলজুক সভ্যতার স্মারক-নির্দশন। আমাদের ষাট গম্বুজ বা ঢাকার সাত মসজিদে এ ছাপ কোথেকে এলো?
বার্সা মানে সবুজ। গাছপালার জন্য এই নাম নয়; এই নামের পেছনে আছে পুরানো বিল্ডিংগুলোর সবুজ রঙ। শোনা যায়, সুলতান ওসমানকে যে সুফী পবিত্র তরবারি দিয়েছিলেনÑ যা জয় করবে খ্রিস্ট-দূর্গ, তারও সজ্জায়ন ছিল সবুজ। সেই তরবারি ওসমান থেকে ওরহান হয়ে ছয়শো বছর (১২৯০Ñ১৯২২) হাত বদল হয়েছে এইউপ সুলতানে। সেই এইউপ মসজিদের সাথে এই ওসমান-কমপ্লেক্সের আশ্চর্যজনক মিল।
জোহরের নামাজের আজান হচ্ছে। পুরো পৃথিবীতে এই একটি সুর প্রায় একই ঢঙে সারা বিশ্বে ধ্বনিত হয়। জনসভার বক্তৃতা নয়, নয় কোন যুদ্ধের আহবান; বরং শান্তি ও ঐক্যের চিরায়ত এক আহ্বান একই সাথে ভেসে বেড়ায় দেশ থেকে দেশান্তরে। শুনলেই আমার হৃদয় উদাস হয়ে যায়। সংকীর্ণ স্বার্থ আর দ্বন্দ্বমুখর পৃথিবী থেকে ক্ষণিক মুক্তির জন্য প্রাণ আনচান করে ওঠে। ভাবি, সমাজতাত্ত্বিকরা বিষয়টা চিন্তা করে দেখে না কেন যে বিশ্ব ঐক্যের পক্ষে আজান কোন বিশিষ্টতা বহন করে কিনা।
গতকালও ভেবেছিলাম, দিনে দিনে বেড়িয়ে রাতেই ইস্তাম্বুল ফিরে যাবো। কিন্তু ওসমান-অরহানের কবর জিয়ারত শেষে মত পাল্টালাম। রাস্তার উল্টোদিকেই সিফরান হোটেলের সামনে গ্রান্ড-ডিসকাউন্ট সাইনবোর্ডের লেখাও মত বদলাবার একটি অসিলা হল। মাত্র চল্লিশ ডলারে ডিবি-বিবি দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। ডাবল-বেড, বেড-উইদ-ব্রেকফাস্টের চেয়েও আমাকে নজরুলের সৃষ্টি সুখের উল্লাসী ছন্দ টেনে নিল জুলিয়াস সিজারের ভিনি-ভিডি-ভিসি’তে, মানে আসলাম-দেখলাম-জয় করলাম এর চক্র ভেঙ্গে বাইরে যেতে; যা তিনি এই বার্সা থেকে আংকারায় যেতে যেতে বলেছিলেনÑ যে উচ্চারণ অমরতা পেয়েছে রাজনীতির পরিভাষায়।
দোতলার একটি রুমে ফ্রেশ হয়ে নামলাম কোজা-হানে। তুরস্কের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ সিল্ক বাজার কোজা-হান। সোনার মত উজ্জ্বলতা চোখকে ধাঁধিয়ে দিতে বাধ্য। এ-তো সেই বিলাসী মানুষের আগ্রহের জায়গা, যেখানে আসবে বেহিসেবী পুরুষেরা, নিজ নিজ প্রেমিকদের মনে দৃঢ়তর আসন গড়ার বাসনায় উদ্বেলিত হয়ে; এখানে আমার কি কাজ? ভেবে আমি উলুদাগ পর্বতে ওঠার সিঁড়ি খুঁজলাম। কিন্তু আমার দুর্বল পা এই কঠিন কাজের যোগ্য বিবেচিত হল না। পায়ে হেঁটে তো দু’হাজার পাঁচশো তেতাল্লিশ মিটার ওঠা সম্ভব নয়। ডলমায় যেতেও প্রায় ৩০ কিলো।
ডলমায় চেপে গেলাম কেবল কার-স্টেশনে। বেশ মজার এই ডলমা-সার্ভিস। আমাদের বাসের টিকেট থাকে গাড়ির ভেতরে কিংবা কাউন্টারে। তুরস্কে টিকেট পাবেন সর্বত্রÑ চায়ের দোকান, ক্যাফে, মুদিখানা আর রেস্টুরেন্টে। আর প্রায় সব বাসের ভাড়াই এক রকম, যেখানে থেকে যেখানে যাও, দুই লিরা। সুতরাং যে-কোন শহরে ঢুকেই পর্যটকদের প্রথম কাজ হবে কয়েকটি টিকেট কিনে পকেটে ফেলা।
কেবল-কার মনটাকে ফুরফুরে করে দিল। আকাশ থেকে পৃথিবী দেখার আনন্দই আলাদা। পাহাড় যে পৃথিবী পৃষ্ঠের পেরেক, তা বুঝতে হলে আপনাকে অবশ্যই পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে হবে, কিংবা কেবল কারে বসে দেখতে হবে পেরেকটা কিভাবে গাড়া হয়েছে। সম্প্রতি কাশ্মীরের গুলমার্গ গিয়ে দুই-স্তর বিশিষ্ট কেবল-কারে উঠলাম। এখানেও দেখছি সেই অবস্থা। কুয়ালালামপুরের গেংটিঙ আইল্যান্ডের ‘কেবল’ দৈর্ঘ্যে অবশ্য এদের চেয়ে বড়। একসময়ে দার্জিলিঙের রোপ-ওয়ে ছিল দৈর্ঘ্যে এর চেয়েও বড়। এশিয়ার মধ্যে দীর্ঘতম। কিন্তু সেই দিন কি আর আছে?
মাঝের ল্যান্ডিং পোস্ট থেকে লাইন দিয়ে দ্বিতীয় ক্যাবল কারে উঠছি। মরক্কান গ্রুপের দুটি মেয়ে আর গ্রীসের ১টি ছেলে এবারের সঙ্গী। কথা শুরু হল- হাজারের নাম নিয়ে।
এটাই কি তাহলে মাউন্ট অলিম্পাস, রুখসানা? বান্ধবীকে জিজ্ঞাসা করল আরেক মরোক্কান, যেখান থেকে জিউস তার পারিষদ নিয়ে ট্রোজান-ওয়ার দেখেছিলেন।
কি জানি! বান্ধবী জবাব দিল হাতের গাইড মেলে ধওে, এখানে তো পাহাড়ের দুটো নাম দেখছি, উলুদাগ এবং মাউন্ট অলিম্পাসÑ
মাউন্ট অলিম্পাস অভ এশিয়া মাইনর। মরোক্কানদের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে গ্রীক যুবক শুরু করল। সরি ম্যাম, এটা সেই সেই অলিম্পাস নয়। এর নাম আসলে অলিম্পাস অভ বিথিয়া। বিথিয়া হচ্ছে এশিয়া মাইনরের কেন্দ্রীয় অংশ, যা পরে সেলজুক সা¤্রাজ্য হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিল।
মরোক্কান মেয়ে দুটির চোখ রসগোল্লার মত বড় হলো। পশ্চিম আফ্রিকান এই নারীরা তাদের চোখ আর চুলের সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। স্পেন এবং ফ্রান্সের প্রভাবে এরা আধুনিক হলেও ইসলামের প্রতিও অনাসক্তি নেই।
ও মাই গড! আঁৎকে উঠল দুই বান্ধবী। চলন্ত কারের মধ্যেই এগিয়ে এলো হাত বাড়িয়ে, আই অ্যাম সুরাইয়া; আই অ্যাম লতিফা। গ্লাড টু মিট ইউ, মিস্টার...
অ্যালেক্স। ফ্রম সেলোনাইকা।
অ্যান্ড, ইউ?
আমার দিকেও এগিয়ে এলো দুজন। আমি খানিকটা অবাক হলেও সহজ ভাবেই নিলাম। অবাক হবার কারণ দুটো। প্রথমত: গ্রীক যুবকের নাম আলেক্সান্ডার, সংক্ষেপে অ্যালেক্স। আবার তার জন্মস্থান স্যালোনাইকা, মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের জন্মস্থান। দ্বিতীয়ত: আমার নিজের দুই বোনের নাম সুরাইয়া এবং লতিফা। প্রায় শিহরণ জাগানো ঘটনা। হাত বাড়িয়ে বললাম, সারোয়ার ফ্রম বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ? আশরাফী পাকিস্তান? উই নো.....
আমার সামনে থেকে হারিয়ে গেল উলুদাগ আর তার বিশাল সৌন্দর্য। চন্দ্রাহতের মত নিস্তব্ধতা আমাকে গিলে ধরল।
প্রায় পঁচিশ বছর আগে তাজমহলের মোতয়াল্লী এই পরিচয়ের জন্য আমাকে পানি খেতে দেয় নি। রাজনীতি এমন খেলাই খেলছে, শুধু আমরাই বা কেন, মরক্কোর এই স্কার্ট-পরা মেয়েদুটোও মনে করে আমরা ভুল করেছি। মরস্কোর বিখ্যাত নায়িকা লতিফার সাথে আলেক্সান্ড্রিয়ায় এ-নিয়ে একবার ঝগড়া হয়েছিল। সেনুসিরাই প্রথম অটোমান সা¤্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছিল- যে সেনুসীদের মধ্যে জন্মেছিলেন ওমর মুখতার এবং গাদ্দাফী। স্বরা জবা স্বাধীনতা মানেই তো ইসলাম বিরোধীতা নয়। ওসমানী সালতানাতও একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা, তার সঙ্গে ধর্মকে না মেলানোই ভালো। ওসমান বা তার উত্তরসুরীরা যে-সব রাজ্য বা এলাকা দখল করে তুর্কী খিলাফত কায়েম করেছিলেন তার বেশিরভাগ এলাকাই তো ছিল মুসলিম। রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য রাজনীতিকরা শক্তি হিসেবে কখনো ব্যবহার করেন স্বরাজ, কখনো ভাষা, কখনো আঞ্চলিকতা। ধর্ম এদের সবার সঙ্গে থেকেও আলাদা। রাজনীতি আর ধর্মের এই পার্থক্য না বুঝলেই সমস্যা। জাতীয়বাদ এবং স্বাজ্যত্যবোধ সব সময় এক নাও হতে পারে। সত্যটা আমরা মোটেই বুঝতে চাই না।
উলুদাগের চূড়ায় পৌঁছে অজান্তেই আমরা চারজনের-দল হয়ে গেলাম। কোন ব্যক্তি একা ট্যুর করলে এই স্বাভাবিক। আমার থরথর আবেগ বুঝতে পেরেই বন্ধুরা নিজেদের সামলে নিয়েছে। রাজনীতি নিয়ে কেউ আর আলোচনায় যায় নি।
শিশ কাবাব আর কফি খেতে খেতে বলল অ্যালেক্স, যদি চাও আমি তোমাদেরকে মাউন্ট অলিম্পাসও দেখাতে পারি। তবে তার জন্য এফেসুস বা ট্রয়ে যেতে হবে। যাবে?
লতিফা ও সুরাইয়ার চোখে আমি আগ্রহ দেখতে পেলাম না। যদিও আমার মন লাফ দিয়ে উঠল। কিন্তু মনের এই লাফালাফি এবার আর কাজে লাগবে না। না আছে পকেট রেস্ত্, না সময়। যদিও মন গেয়ে উঠতে চাইল রবীন্দ্রনাথকে : এখনি অন্ধ, বন্ধ কোরনা পাখা। কিন্তু রবি ঠাকুর কি আর সবসয়ই কাজে লাগে?
কফি হাতে নিয়ে রেলিঙে গিয়ে দাঁড়ালাম। কী অপূর্ব আল্লার এই সৃষ্টি। এখান থেকে পুরো বার্সাকে মনে হচ্ছে সাদা ক্যানভাসে ছিটিয়ে দেয়া সবুজ-লালের কালি। ওখানের ঐ মানুষগুলো তো আমাদের মতই লম্বা-চওড়া, অথচ দেখে মনে হচ্ছে পিঁপড়ে!
ডলমা করে হিসার (ক্যান্টনমেন্ট) গেলাম আমরা। ও-মা, এ দেখি আমারই হোটেলÑ সিফরান। আসলে সিল্ক-বাজার এখান থেকেই শুরু, কাভার্ড বাজারও। বার্সার মসজিদগুলোও এর কাছাকাছি; আর সামান্য নেমে গেলেই বিনোদন কেন্দ্রগুলো।
আমি টার্কিশ-বাথে যাবো শুনে তিনজনেই প্রস্তাব দিল: আমরাও যাবো।
আমার চোখ ছানাবড়া। কিন্তু কিছু করার নেই। কেউ যদি তুরস্কে এসে হামামে না যায়, তাকে যথার্থ পর্যটক বলা যায় না। সুতরাং বন্ধুদেরকে ওয়েটিং রুমে বসিয়ে হ্যান্ডপ্যাক নিয়ে এলাম। নামার পথে দেখা হল প্রাচ্য বাগানÑ আনাতোলিয়ার গৌরব! এশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন বৃক্ষগুলো দাঁড়িয়ে আছে এখানেই। প্রায় ৬০০ বছর বয়সী বুড়ো গাছের নিচের ইনকিয়া-ক্যাফেতে আরেক দফা কফি খাওয়া হল।
হামাম এক অদ্ভুত জায়গা। ব্যাংককে যেমন ম্যাসেজ, তুর্কীতে তেমনি হাম্মাম। তবে ম্যাসেজের মত এখানকার খাদেমরা বিপরীত-লিঙ্গের নয়। আর পুরুষ-নারীদের ব্যবস্থাও আলাদা।
ইস্তাম্বুলের রাজকীয় হামাম দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। দিল্লীর লাল কেল্লা আর আগ্রা ফোর্ট থেকেও অস্পষ্ট একটা ধারণা পেয়েছিলাম আগে। তবে তুর্কী হাম্মাম সম্পূর্ণই নিজস্ব সংস্কৃতি। হংকং ম্যাকাওয়ের হট-শাওয়ার থেকে এ-একেবারে অন্যরকম। ঠান্ডা ও গরম পানির পাশাপাশি ব্যবস্থার সাথে সওনা বা স্টিম-বাথ থাকে প্রাকৃতিক কায়দায়। আর বার্সার পানি তো গরমও করার দরকার হয় না। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উষ্ণ প্রস্রবনী উলুদাগ পাহাড় থেকেই বেরুচ্ছে। কমবেশি সবগুলো দামী হোটেল আর হামামে যাচ্ছে সেই পানিÑ যথাযথ ট্যাক্সের বিনিময়ে।
অ্যাটেনডেন্ট দাঁড়িয়ে ছিল সেবা দেবার জন্য। সেবা মানে, সাবান বা ফেনা লাগিয়ে দেয়া, টাবে শোয়ানো-ওঠানো, পিঠ মেজে দেয়া এবং ম্যাসাজ। এদের ম্যাসাজ পুরোপুরি ব্যথা দেয় এবং সতেজও করে খুব দ্রুত। জর্জিয়ার রাজধানী তিবলিসিতে যে গন্ধক ঝর্ণার প্র¯্রবনী আছে, শুনেছি সেটাই পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাময়ী ম্যাসেজ, যেখানে পর্যটকদের প্রথমেই মৃত্যুভয় জাগিয়ে তোলা হয়। ভাগ্যিস, বার্সার অ্যাটেনডেন্টরা সে তুলনায় প্রায় দরবেশ!
আমি কৌতুহলের কারণে ইস্তাম্বুলের চেম্বারলিটাস হামাম এবং বাইওগ্লুর গ্যালাটাসারী হামাম দেখেছি। অদ্ভুত এই গোসলখানার ভেতরটা এতই ব্যতিক্রমী যে বিশ্বাসই হয় না যে এটা আধুনিক দুনিয়া। চেম্বারলিটাস আসলে তিন তলা এবং সিনানের নিজ হাতে গড়া যেসব নিত্য ব্যবহার্য ইমারত এখনো টিকে আছে, সেটি তারই একটি।
প্রবেশের প্রথমে বিশাল গোবেকতাসি বা ‘পেটের উঠান’। ঢোকার মুখেই কাপড় চোপর রাখা হল লকারে এবং চাবিটা বেঁধে দেয়া হল কব্জিতে। পাশের দেয়ালগুলো থেকে চুইয়ে নামছে গরম পানি;- সেই ঘুলঘুলির নাম কুর্ণা। ভেবে অবাক হয়ে যাই যে সিনান এই হামাম তৈরী করে গেছেন প্রায় পাঁচশো বছর আগে এবং গরম পানির অবিরাম প্রবাহের পরেও তা চমৎকার ভাবে টিকে আছে। কুর্ণার ¯্রােত টাইলসের মেঝেকে উষ্ণ রেখেছে এবং থিকথিকে পানি পেস্তেমাল (টাওয়েল) ভিজিয়ে পিঠ পেটকে করে তুলেছে ঘুম-ঘুম। কুয়াশার মত বাষ্প উঠছে চারপাশে এবং তার ফাঁকে ফাঁকে উপরের জানালা-গলে বিচ্ছুরিত হচ্ছে সুর্যালোক, রঙিন কাঁচকে নানা বর্ণে চিত্রিত করে। এর নাম এলিফ্যান্ট-আইজ।
এক সাথে চল্লিশ জন পুরুষ চেম্বারলিটাস-এ আরাম নিতে পারে। পনেরো বিশ মিনিট থাকার পর ঝামা জাতীয় নরম পাথর দিয়ে শরীর থেকে মরা চামড়া ঘষে তুলে ফেলা হয়। প্রথম প্রথম মনে হয় শরীর জ্বলে যাচ্ছে কিন্তু নার্সিংয়ের কায়দাটা এমন যে একটু পর পরই যেন জীবন ভরে ওঠে তৃপ্তিতে।
এরপর আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো তিন তলায়; এলিফ্যান্ট আইজের কাছাকাছি। এখানে রয়েছে ঠান্ডা পানির বাথ-টাব এবং ম্যাসেজ টেবিল। এত নিপুনতার সাথে শরীরের প্রতিটি লোমকূপে নার্সরা প্রাণ প্রবেশ করালো যে, ঠা-া পানিতে ঝাপ দিয়ে মনে হলো ‘মরণ’ হয়েছে। এবং দু’মিনিট পরেই যখন ফেনা ও জৈতুন তেলে ‘বেঁচে’ উঠলাম, মনে হলো না এই-আমি সেই-আমি। আয়না সামনে থাকলে নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করতাম: তোমার নাম কি? জন্ম তারিখ কবে? আজকে নয় তো!
সব মিলিয়ে খরচ হয়েছিল একশো বিশ লিরা। আরো বিশ লিরা বখশিশ দেয়ায় ‘নার্স-হাসান’ এত খুশি হয়েছিল যে আবার সেখানে যাবার জন্য আমাকে ফোন পর্যন্ত করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ততক্ষণে আমি এয়ারপোর্টের এম্বারকেশন লাউঞ্জে পৌঁছে গেছি।
হামাম থেকে বেরুবার পর মনে হল, বয়স দশ বছর কমে গেছে। সুরাইয়া ও লতিফার চাঞ্চল্য এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে আমি সংকুচিত হয়ে ভাবলাম: আমার বাকী প্রোগ্রাম দেখা হবে তো?
জীবনে এই প্রথম ওরা বাথ নিল। প্রজাপতি-হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু অ্যালেক্সের মুখ ভার। বলল, সকালে আমার হোটেল ম্যানেজার জানিয়েছিল, অ্যাটেনডেন্ট ‘নার্সরা’ মেয়ে হবে। এখানে তো তা দেখলাম না।
লতিফা আর সুরাইয়াা শুধু মুখ টিপে হাসল।
আমরা হামামে ঢুকেই সবুজ-চা খেয়েছি। এটা চায়নিজ বা থাই পার্লারের মতই স্বত:স্ফূর্ত রেওয়াজ। কথিত যে, মাও জে-দংয়ের আগে নাকি সাধারণ চীনারা চা খেতে অভ্যস্থ ছিল না। মাও ব্যাপারটাকে এমনভাবে জাতীয়করণ করেন যে, গরম পানি কেটলিতে থাকতেই হবে; চা থাক বা না থাক। আর তাতে সবসময় দিতে হবে গাছের পাতা। ওই পানীয়’র নামই চীনা-চা। আমি পৃথিবীর যত দেশের ফুটপাতে চা খেয়েছি, এর মধ্যে সবচেয়ে অখ্যাদ্য হচ্ছে চীন। যদিও, তারাই তৈরী করে পৃথিবীর সেরা গ্রীন-টি, জেসমিন টি এবং ফ্রুট-টি।
*
মুরাদিয়া কমপ্লেক্সে পৌঁছুতে সন্ধ্যা নেমে এলো। এমনিতেই কবর আমাকে বিষন্ন করে, তারপরে আবার সেই সব মহিমান্বিত সুলতানরাÑযাদের বীর্যবত্তা, পরাক্রম এবং প্রশাসনিক দক্ষতা পুরো বিশ্বকে ছয়শো বছরেরও অধিককাল আাকাশের তারার মত জ্বলজ্বলে করে রেখেছেÑতাদের প্রবল প্রতাপাহ্নিত স্মৃতির সামনে দাঁড়িয়ে আমি ভয়াবহ আবেগে কেঁপে উঠলাম। দু’চোখ ফেটে বেরিয়ে এলো পানির নহর। আমার নি:স্ব, রিক্ত, অসফল জীবন তীব্র কষাঘাতে জর্জরিত করে দিল আমায়। কিছুই করতে পারিনি আমি আমার জীবনে। অথচ উম্মী-নবী এ-বয়সেই অর্জন করেছিলেন নবুয়ত; আলেক্সান্ডার হয়েছিলেন বিশ্বজয়ী, মোহাম্মদ টু অধিকার করেছিলেন কনস্টান্টিনোপলস, প্রেসিডেন্ট জিয়া বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন ধ্বংসোন্মুখ বাংলাদেশকে, চে গুয়েভারা আর মাইকের জ্যাকসন পৌঁছে গিয়েছিলেন কোটি মানুষের হৃদয়ে, অথচ আমি কিচ্ছু দিতে পারলাম না। না ধর্ম স্বাধীনতা আমাকে শান্তি দিল, না ধর্মে আমি স্বস্থি পেলাম। অথচ এই লোকান্তরিত মানুষগুলো, যারা আমার মত সাধারণ মানুষ হয়েও অসাধারণ ছিলেন আম-জনতার কাছে, কারণ ব্যক্তিগত লাভালাভের চেয়ে তারা উপওে রেখেছিলেন কল্যাণকে। অশান্তি আর হানাহানির মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়েও তারা প্রতিষ্ঠা করেছেন সাম্য এবং স্থিতি। সাধারণ মানুষকে দিয়েছেন জানমালের নিরাপত্তা এবং অবিশ্বাস্য সফলতার সাথে সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করেছেন ভিয়েনা থেকে বাগদাদ, কায়রো থেকে আযারবাইজান পর্যন্ত। ঝুটঝামেলা যে হয়নি, তা নয়; তবে কল্যাণমুখী এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গি তাদেরকে সুলতানের চেয়েও অধিকতর মহত্ব দিয়ে লোকে তাদের সম্মান করে ডেকেছেন বাদশাহ। এমনকি খ্রিস্টানরাও তাদের মেনে নিয়েছিল কাইজার-ই-রুম খেতাবে। উল্টোচিত্রও দু’একটা আছে। সুলতান বায়েজিদের (১৩৮৯-১৪০২) বাহিনী যখন দানিয়ুব দখল করে নেয়, ভীত পোপ তাকে বর্জ্র (ইলদ্রিম : থান্ডারবোল্ট) বলে অপপ্রচার করেন। বায়েজিদই কনস্টান্টিনোপল দখলের প্রথম উদ্যোগ নেন। কিন্তু তৈমুর লঙ পূর্ব তুরস্কে অভিযান পরিচালনা করায় তার সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। যদিও সেই অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণ করেন তারই নাতি মেহেমত টু দ্য কনকোয়্যারার।
আমি বায়েজিদের কবরে দাঁড়িয়ে যেন শুনতে পেলাম সেই আশ্চর্য এলানÑ আলা হযরত-ই-আকদাস-ই-হুমায়ুন, হুংকার-ই-খানিদান-ই-আলী-ই-উসমান, সুলতানুস সেলাতিন, খাকান সুলতান, আমীরুল মুমেনিন-ই-খলিফাতুল রাব্বুল আলামীন, খাদিমুল হারামাইনুস সেরিকান, কাইজার-ই-রুম, পাদিশাহ বায়েজিদ সুলতানুল ইসলাম-ওয়া-মুসলেমিন, হাজির-ই-নাজির-ই-জামান, আমির-উল-রুমেলিয়া, এদির্নে ওয়া-সেলজুক... তাশরিফ আঞ্জাম। আমার চোখ ভিজে এলো। মওলানা রুমীর বন্ধু এদেবালি শেখ এর হাত থেকে নেয়া যে তরবারিকে বলা হয় ‘জয়ীর জন্য’, সেই তরবারি এসব দোর্দন্ড প্রতাপশালী স¤্রাটদের হাত ঘুরে পৌঁছে গিয়েছিল সুলতান মোহাম্মদ টু’র কাছে এবং বিজিত হয়েছিল ইস্টার্ন রোমের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল্স।
আমার দুর্বল মুনাজাত ভিজিয়ে দিল আমার পোষাক আর আমার মনে পড়ে গেল অরহানকে বলা ওসমানের সেই অন্তিম অসিয়ত: হে পুত্র, মনে রেখ, জীবন মাত্র একবার এবং তা আল্লার অনুগ্রহ ছাড়া কিছু নয়। মায়ের ইজ্জত রক্ষা কর এবং জেনো, তোমার প্রজাদের সকলেই মাতৃগর্ভজাত। কখনো সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলো না আর কনস্টান্টিনোপল্স জয়ের যে অঙ্গীকার আমি তোমাকে আমি পৌঁছে দিলাম, তা তুমি ছড়িয়ে দেবে তোমার নিজের আত্মায় এবং তোমার উত্তরাধিকারীদের হৃদয়ে। মনে রেখ, মহৎ মানুষ আল্লার সন্তুষ্টির জন্যই কাজ করে এবং বাদশার দায়িত্ব আল্লার বান্দাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করা। প্রিয় পুত্র, ক্রসেডকে ভুলে যেও না এবং পিছপা হয়ো না নিজের কর্তব্য থেকে। সর্বদাই মনে রেখো আল্লাহ তোমার একমাত্র রক্ষক এবং তিনি তোমার মধ্যে ততক্ষণই জারি থাকবেন, যতক্ষণ তুমি তার চিন্তা ও তার বান্দাদের ভালোবাসাকে সজাগ রাখবে।
লতিফা আর সুরাইয়া এতক্ষণে বুঝতে পারছে যে আমি ‘মাশরেকী-পাকিস্তানী’ হলেও মুসলমান। কিছুটা লজ্জিত হয়েই তারা বুকের ওড়না মাথায় টেনে দিলো কিন্তু তাদের হাঁটু ঢাকার অতিরিক্ত কোন পরিচ্ছদ ছিল না। মনে মনে বললাম: খোদা, মানুষ তো বরাবরই পাপী। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই বিবেচনা করবে তার ইন্টেশন। ইন্নামাল আমালু বিন্নিয়াত...।
সাফরান হোটেল থেকে ফ্রি ট্রিপ ছিল ‘সেমা’ দেখার। ওসমানদের প্রথম রাজধানীর প্রদর্শনী দেখার এই সুযোগ কে ছাড়ে?
সন্ধ্যার পরপরই সেখানে পৌঁছে দেখি লতিফা আর সুরাইয়াও হাজির। হাসতে হাসতেই হাত মেলালাম তাদের সাথে। ম্যাগিলান প্রমান না করলেও প্রমানিত হল যে পৃথিবীটা গোল!
তাই? আমরা তো ভাবলাম, বাংলাদেশে আর মরক্কোর সূর্য আলাদা। আচ্ছা, বলো তো মাই ডিয়ার, তোমাদের দেশের ছেলেরাও কি তরুণীদের ভালোবাসে? মানে, আমাদের মত মেয়েদেরকে?
সুরাইয়ার রূপ অসাধারণ। লতিফার চোখ ছাড়া সবকিছুকেই হারাতে পারবে এই চতুর্বিংশতি তরুণী। তার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বললাম, সূর্য যেদিকেই উঠুক বন্ধু, গোলাপ তার সৌরভ ছড়াতে ভুল করে না। যেমন আমাদের অপেক্ষায় থাকা টিউলিপগুলোও সুফিনৃত্যের এই পবিত্র আখরায় প্রেমের প্রদীপ জ্বালিয়েছে।
কিন্তু, ওর তো গন্ধ নেই। বলল সে বেদুঈন ভ্রুভঙ্গিতে।
আমি ঠোঁটকাটার মত জবাব দিলাম, কে জানে, আছে কিনা? কাছে গেলে তো টের পাবো।
আচ্ছা-আচ্ছা। দু’ বান্ধবী একযোগে হেসে উঠল: আমরা অপেক্ষায় রইলাম।
রাতে ঘুমাতে যাবার আগে আবারও গেলাম অরহানের কবরে। অরহান বাবার ইচ্ছাকে মূল্য দিয়ে এখানেই ওসমানকে সমাহিত করেন এবং পিতৃআজ্ঞা পালন করে ক্রমাগত রাজ্যবিস্তার করেন পশ্চিমে। তার তেত্রিশ বছর শাসনামলে তিনি পূবের লেক ভান থেকে ইস্তাম্বুল পর্যন্ত পৌঁছে যান। তার পুত্র মুরাদ (ওয়ান) পরবর্তী বিশ বছর এই অভিযান আরো জোরদার করেন এবং গাল্লিপলি পার হয়ে এদির্নে জয় করেন। এটাই ছিল ওসমানদের প্রথম ইউরোপে প্রবেশ। পিতা পিতামহের রাজধানী তিনি স্থানান্তর করেন এদির্নেতে। যদিও কনস্টান্টিসেপল্স সহ থ্রেসের বিস্তৃত এলাকা তখনো ছিল খ্রিস্টানদের অধীন। কসোভো দখল করতে যেয়ে মুরাদ নিহত হলে তার পুত্র বায়েজিদ ওসমানের তরবারি তুলে নেন আরো দৃঢ়তর হাতে; ফলে ইউরোপিয়ানরা তার নামের আগে ইলদ্রিম বা ‘বর্জ্র’ বিশেষণ যোগ করতে বাধ্য হয়। বায়েজিদ পৌঁছে যান দানিউবের তীর পর্যন্ত এবং ওসমানী খিলাফত মধ্য পৃথিবীর সর্ববৃহত ক্ষমতা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। যদিও তৈমুর লঙের বিধ্বংসী কর্মকান্ডে তাকে ফিরে আসতে হয় পূর্বাঞ্চলে এবং তিনি নিহত হন মোঙ্গলদের হাতে। কিন্তু তার ছেলে মেহমেত দ্য কনকোয়্যাবার সালতানাতকে অসীম উচ্চতায় নিয়ে যান কনস্টান্টিনোপল্স জয় করে।
বার্সারী করে ফেরার লোভ সংবরণ করে বাসে উঠলাম ইয়েলোভার পথে। যেতে যেতে যেহেতু দুপুর হয়ে যাবে, সিদ্ধান্ত নিলাম প্রিন্সেস আইল্যান্ড দেখেই যাই। একে তো পথে পড়বে, দ্বিতীয়ত এই ‘কালাপনি’-আন্দামান দেখার ইচ্ছেটা বুকের মধ্যে আগে থেকেই লুকিয়ে ছিল।
ফেরীতে উঠে দেখা হয়ে গেল বিথিয়ার সঙ্গে। ভীষণ চমকে উঠলাম। গতকার তার কাজ শেষ হতে সন্ধ্যা হয়েছে। রাতের মার্মারায় ফেরি চলে না। সুতরাং বার্সায় রাত কাটিয়ে সকালে ফিরছে সে।
আমি সসংকোচে জানতে চাই: বিথিয়া, তুমি কিভাবে যাবে?
কেন, ফেরীতো প্রিন্সেস টাচ করেই যাবে। শুধু আমার টিকেট ফেরীর টাচ-কনসোলে এন্ট্রি করে এলেই হল। কেন, তুমি নামবে না কি?
ইচ্ছে তো হচ্ছে। কিন্তু কাউকে যে চিনি না।
আমার সাথে চলো। জানো তো, প্রিন্সেসে কোন গাড়ি নেই। শুধু ঘোড়া, গাধা আর কুকুরে টানা কার্ট আছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, তাই। যদি জাস্ট-এ-লুক দেখতে চাও, ডিনারের আগেই ইস্তাম্বুল ফিরতে পারবে।
গুড আইডিয়া। কিন্তু তুমি তো অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকবে। অন ডিউটি। আমাকে কে সাহায্য করবে?
ও-আচ্ছা, এই কথা। আমিই করব। আমাদের জার্নি ডে-কে ছুটি ধরা হয়। আজ আমি নাহয় তোমার-অফিসই করলাম।
অদ্ভুত ভালোলাগা নিয়ে কেবিনে ঢুকলাম। বিথিয়া আমার ইডোকে এন্ট্রি টাচ করিয়ে এনেছে। আমি তার সম্মানে দুটো কোক, দুটো কফি আর দুটো চকোলেট পেস্ট্রি কিনলাম।
দেখে বিথিয়ার চোখ কপালে উঠল। হায় হায়, সারোয়ার, একি করেছ?
মুখে যতই অবাক হবার ভান করুক, স্পষ্ট বুঝলাম, খুব খুশি হয়েছে সে। আমার ধারণা, এটি সমস্ত এশিয়ার বৈশিষ্ট্য। খাবার আমাদের সেরা আপ্যায়ন। যে যতই ওয়েষ্টার্ন ভদ্রতার কথা বলুক, এশিয়ানদের খাবার পরিবেশন করার রেওয়াজ আমার ভালোই লাগে।
ঘড়ির কাটাকে পাঁচ মিনিট দয়া দেখিয়ে ফেরি ছাড়ল। মার্মারার পাড় থেকে দ্রুত মিলিয়ে গেল বার্সার তীর। ভীড় করে এলো সী-গাল আর কাকাতুয়া। এ ধরনের কাকাতুয়া আমি আগে দেখিনি। অনেকটা ম্যাকাওর মত তবে অনেক ছোট সাইজ। ছোট সাগর বলেই কি ওরা ছোট?
আমি কয়েক টুকরা পেস্ট্রি ছুঁড়ে দিলাম তাদের দিকে, কিন্তু পাখিগুলো ছোঁ মারল না। কিন্তু ছুটে এলো ঝাক ঝাক সি-গাল। কাছ থেকে না দেখলে খুব সাধারণ পাখি মনে হলেও সিগালের ঠোঁট আসলে হিং¯্র। দ্রুত জানালা বন্ধ করে দিল বিথিয়া; নিজের খেয়ে বনের মোষ ডাকছ কেন, সারোয়ার?
প্রিন্সেস আইল্যান্ডের ফেরীতে ভীড় অপেক্ষাকৃত কম। বেশ আরাম করেই বসা গেল বিথিয়ার সাথে। জানতে চাইলাম, বিথিয়া- তুমি তো ওখানেই কাজ কর। আচ্ছা, দ্বীপগুলোর নাম প্রিন্সেস আইল্যান্ড কেন?
বিথিয়া হাসল। সে হাসিতে খানিকটা লজ্জাও আছে। সুলতানদের ঘরে তো ক্ষমতার লড়াই লেগেই থাকে। আর এতে আমাদের ভূমিকাও কম নয়।
আমাদের মানে?
মানে নারীদের। যারা রানী, মানে হাসেকি সুলতান, তাদের ক্ষমতা তো তোমাদের নূরজাহানের মত। কিন্তু বাকীরাও কি বসে থাকে? তারাও চেষ্টা করতেন নিজ নিজ সন্তানদেরকে ক্ষমতায় আনার জন্য। এজন্য কত ষড়যন্ত্র, কত খুনোখুনি।
তাই?
হ্যাঁ, তাই। কেন জানো না, ১৪৮০ থেকে প্রায় একশো বছর এসব নারীরাই ওসমানী খিলাফতের কলকাটি নেড়েছেন।
সত্যি? আমি হতবাক হয়ে বললাম- একশো বছর?
জ্বি-হ্যাঁ, জনাব। একশো বছর। এছাড়াও ১৫৯০-এ ঘটেছিল সাফাভিদ বিদ্রোহ। তাতেও নারীদের বড় ভূমিকা ছিল। মানে হেরেমের। ১৭৩০-এ আহমদ থ্রিকে যখন শিরোচ্ছেদ করা হয়, তার পেছনেও ছিলাম আমরা।
আমি লা-জওয়াব। বিথিয়ার বলার ভঙ্গিটি এমন যেন, সে-ই ইস্তাম্বুলের রাজকুমারী মিহিরমাহ্ (কানুনী সুলতান সুলেমানের কন্যা)। তারই অঙ্গুলীহেলনে কারো উত্থান আর কারো পতন ঘটছে।
তা তোমার ঐ কলকাঠি নাড়ার সাথে আইল্যান্ডের সম্পর্ক কি? আমি তো জানতে চেয়েছি প্রিন্সেসের খবর।
হ্যাঁ, সেজন্যই এই হেঁয়ালী করলাম, আফেন্দি। রাজ্য যত বড় হয়, বিদ্রোহও তত বেশি হয়। যেসব রাজকন্যা বা রানীরা ষড়যন্ত্র করে ধরা পড়তেন, তাদের সবাইকে তো আর শিরোচ্ছেদ করা যেত না। কারণ, তারা সবাইই তো কারো না কারো বোন, কারো সৎ-মা। সুতরাং মার্মারার এই নির্জন দ্বীপ-ই হত তাদের শেষ আবাসস্থল। ইংরেজীতে যাকে বলা হয় সলিটারী কনফাইনমেন্ট। সেই রাজকন্যাদের সম্মানেই এর নাম হয়েছে প্রিন্সেস আইল্যান্ড- যদিও অনুচ্চারিত থেকে গেছে ‘জেলখানা’ শব্দটি।
আমি হতবাক হয়ে ভাবলাম, কি নিষ্ঠুর এই সা¤্রাজ্য চালাবার কানুন। নিশ্চয়ই এসব হতভাগীদের কেউ না কেউ পাগল হয়ে গেছেন, কেউ আত্মহত্যা করে বেঁচেছেন। হায়-রে মসনদ!
তুমি নিশ্চয়ই জানো, কুখ্যাত রোম স¤্রাট নীরোর মা-ও এরকম নির্জন দ্বীপেই বন্দী ছিলেন? সেখান থেকে ফিরে গিয়ে এগ্রিপ্পিনা আবার রানীও হয়েছিলেন।
হ্যাঁ, জানি। আর এও জানি যে, সেই সন্তানের হাতেই তিনি নিহত হয়েছিলেন।
বিথিয়ার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। সে পরের ঘটনা জানত না। অবাক কণ্ঠে বলল, সরি ফ্রেন্ড, আর ইতিহাস বলছি না আমি। মাফ চাই।
হেসে বললাম, না-না, মাফ চাইছ কেন? ইতিহাস বলার দরকার নেই, জিওগ্রাফি বলো।
মানে?
মানে হলো প্রিন্সেস দ্বীপের বর্ণনা দাও। এটা কি একটা মাত্র দ্বীপ? নাকি কয়েকটা? ইস্তাম্বুল থেকে ঝাপসা ভাবে তো ওগুলোকে পাহাড়ই মনে হয়।
আসলেই ওগুলো ছোট ছোট পাহাড়। না, একটা নয়, মোট দ্বীপ আসলে নয়টি। নয়টিকে নিয়েই আমাদের মিউনিসিপ্যালিটি। প্রধান অফিস বিউকাদায়। ওটাই সবচেয়ে বড় দ্বীপ। এরপর আছে হেভিলি, বুরগাজ, কিনালি এবং সেদেফ। বাকীগুলোতে জনবসতি নেই।
এখনো কি রাজকন্যারা থাকে ওখানে?
নিশ্চয়ই। একজনকে এখনই চিনে নাও; তোমর সামনে বসা মিস বিথিয়া রোজউড।
ওয়াও! আমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বাউ করলাম: নাইস টু মিট ইউ, ইয়োর হাইনেস প্রিন্সেস রোজ উড।
হাসতে হাসতে সে গড়িয়ে পড়ে সোফার উপর।
শোন-শোন, দ্বীপগুলো খুব আধুনিক নয়। তবে তুমি যদি দু’একদিন থাকো, বুঝতে পারবে যে নিরবতার কী অমিত শক্তি।
মানে?
মানে হলো, প্রিন্সেস আইল্যান্ডে কোন মোটর চালিত গাড়ি নেই তো, তাই শব্দদূষণ একেবারেই নেই। আমাদের সব গাড়ি হয় ঘোড়ায় টানে, নাহয় কুকুরে।
সত্যি?
অফকোর্স সত্যি। এবং আরো সত্যি যে দ্বীপের প্রধান বাসিন্দা আমরাই।
আমরাই মানে?
মানে ইহুদীরা। অবাক হচ্ছ না শুনে?
আমি কোন জবাব দিতে পারলাম না। কিন্তু এতই বিস্মিত হলাম যে বোবা হয়ে গেলাম।
শোন বন্ধু, ধর্ম নিয়ে তুর্কিয়ায় কোন বাড়াবাড়ি নেই। আর্মেনীদের যখন গণহত্যা হয়েছিল, তারাও পালিয়ে এসেছিল এখানে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আমরা এসে আস্তানা গেড়েছি বিগ আইল্যান্ডে; মানে লোকে এখন যার নাম রেখেছে বিউকাদা। সবচেয়ে বড় পাহাড় এটাই। গাধার গাড়ি-ই বেশি পাবে বিউকাদায়। দ্বীপ কিনালি বিখ্যাত হল দার্শনিক ডায়াজিন্সের জন্য। সেই যে, আলোক্সান্ডারকে যিনি বলেছিলেন, তুমি যা দিতে অপারক, তা কেড়েও নিতে পার না।
আমি চমকে উঠে বললাম, সেই যখন তিনি তার দোলনায় শুয়ে রোদ পোহাচ্ছিলেন আর আলেক্সান্ডার দাঁড়িয়েছিলেন সূর্যকে আড়াল কওে, যেন কারুরই চোখে ঝলকানী না লাগেÑ সেই ঘটনা তো?
হ্যাঁ, সেই ঘটনা। বিথিয়া তোতলা মুখে বলল, আচ্ছা, এভাবে তো কখনো চিন্তা করে দেখিনি। সারোয়ার প্লিজ, আজ তুমি থেকে যাও। আমার ঘর খালিই আছে। আমি তোমার কাছে ইতিহাস শুনবো।
আমি তার মাথার চুল নাড়িয়ে দিয়ে বললাম, পাগলি। আমি শুধু জানি নাটুকে ঘটনাগুলো। মানে রোমান্টিক হিস্ট্রি উইদ স্টোরি। এ-শুনে ভাব জাগবে, কিন্তু বিথিয়ার মনে কোন প্রভাব পড়বে না।
জাহাজ ভেঁপু বাজাল বিইউকুদায় ভেড়ার জন্য। আশ্চর্য শান্ত সমাহিত দ্বীপÑ যেন ভিঞ্চির আকা নিরব শহর। পরের ছোট্ট দ্বীপ দেখিয়ে বলল বিথিয়া, ঐ যেÑ ঐটাতে থাকে আর্মেনিয়ানরা। ওর নাম কিনালি-আদা মানে ‘মেহেদী-রাঙা’। আমি পুলকিত হলাম নামের অর্থে।
সত্যি সত্যিই অফিসে না গিয়ে বিথিয়া আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেল। তার মা এসে আমার কপালে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমরা অনেক শুনেছি বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা। অনেক অনেক রক্ত দিয়েছ তোমরা। কিন্তু এখনো তোমাদের রাস্ট্রে শান্তি নেই কেন?
আমি চোখের জল লুকাবার জন্য মুখ ঘুরিয়ে বললাম, সমুদ্রের নোনা-জল থেকে প্রিন্সেস আইল্যান্ডের বাতাস আসলেই অন্যরকম। বিথিয়া, আমাকে একটা টিস্যু দেবে, প্লিজ?
সে দিলো। তার মা-ও কি বুঝে আর কথা বাড়ালেন না।
বুদ্ধিমতী তরুণীটির সাথে আমি পাহাড়ের চূড়া, লুনা পার্ক, জর্জ মনাস্ট্রি দেখলাম। বিথিয়া সবসময় সতর্ক ছিল যেন আবার আমাকে টিস্যু দিতে না হয়।
সন্ধ্যার লালিমায় বিদায় নিলাম মা-মেয়ের কাছ থেকে। মা আমার কপালে চুমু খেয়ে বললেন, দোয়া করি, বাংলাদেশ যেন ভালো থাকে।
আমি আবারও চোখ লুকিয়ে ভাবলাম, আমার দেশে কি কোন মা আছে? আছে কোন বোন?
আমাকে বিদায় দিতে বিথিয়া ডক পর্যন্ত এসেছে। তার হাতে এক ঠোঙ্গা পিচ। দুজনেই অজ্ঞাত বেদনায় চুপ করে আছি। শেষে জাহাজের ভেঁপু বেজে উঠলে সে আমার গালে আলতো ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল: সালোম-সালোম, বিদেশী বন্ধু আমার, যেখানেই থাকো ভালো থেকো।
চোখের জল নাকি তার করুণ চোখ, কি লুকাতে জানিনা, আবার আমি ঘুরে দাঁড়ালাম।
===============২০এপ্রিল, ২০১৩।
©somewhere in net ltd.
১|
২২ শে জুন, ২০১৩ রাত ২:৩২
কুন্তল_এ বলেছেন: অসাধারণ লেখা ভাই। +++