নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ঝিলাম নদীর দেশ

আমি যত ভালোবাসি ততই উজ্জ্ল হয় সে তোমার নাম...

বুলবুল সরওয়ার

কবিতাই প্রিয়। কিন্তু গদ্যও যে তার আরশিনগর। তাই নারীর চেয়ে যতই প্রিয় বলি দেশকে; প্রকৃতি হেসে বলেঃ ও হলো কথার কথা। এভাবেই একদিন প্রেমে পড়লাম ঢাকার... স্বপ্নের মত সুন্দরী এক বারবনিতা। থাক এসব ব্যক্তিগত প্যাচাল। তার চেয়ে আসুন পাঠ হোক...

বুলবুল সরওয়ার › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রাচ্যের মহারানী ক্লিওপেট্রা

১২ ই জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১:৫৯

‘রাকোদা’ গ্রামের জেলেদের জানার কথা নয়, কে কোন দেশের রাজা বা সেনাপতি। তবুও তারা দ্বীপ থেকে নৌকা বেয়ে পাড়ে এল দেখতে। চব্বিশ বছরের তরুণ মেসিডোনিয়ান সেনাপতি ‘আলেক্সান্ডার’ সিওয়া ওয়েসিসে যাবেন। সকলেই জানে, আমন মন্দিরের আর্শীবাদ পেলেই কারো পক্ষে এশিয়া জয় করা সম্ভব। আর এশিয়া জয় করা মানেই তো বিশ্বজয়! কিন্তু এ তরুণের যে দেবতার মত সোনালি কোঁকড়া চুল, নীল স্বপ্নালু চোখ; এ-কি মহাপ্রাচ্যের যুদ্ধ করতে পারবে?

‘তোমাদের দ্বীপটি তো খুব সুন্দর। ওর নাম কি? ’ জেলেদের প্রতি মনোযোগী হলেন আলেক্সান্ডার।

‘ফারো।’ জেলেরা আনন্দিত কন্ঠে জবাব দিল।

‘ডাইনোক্রেটিস, এখান থেকে ঐ ফারো দ্বীপ পর্যন্ত রাস্তা বানানো সম্ভব?’

‘সম্ভব!’ সম্মতি জানাল প্রধান স্থপতি।

‘তাহলে, রাকোদা গ্রাম থেকে ফারো পর্যন্ত রাস্তা বানাও এবং শহর গড়ে তোল। নতুন রাস্তার দু’ধারে থাকবে গ্রিকদের বসতি। শহরের নাম হবে আলেক্সান্ড্রিয়া।’

তিনি তার নীল চোখ মেলে দক্ষিণে তাকালেন। বিশাল ম্যারিয়ট লেকের ওপর দিয়ে বয়ে আসছে মরুভূমির ঠান্ডা বাতাস। উত্তরে, ভূমধ্যসাগরের অবিশ্রাম কল্লোল। তার অবচেতন মন কি তাকে বলেছিল যে এ শহরই হবে ইউরোপ-আফ্রিকার যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু? কোনো এক কৃঞ্চাঙ্গ রমণী যাকে অমর কওে রেখে যাবে? সেই নারীর নাম হবে ক্লিওপেট্রা!!

হয়ত বলেছিল।

ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মাত্র একশো বছরের মধ্যেই আলেক্সে আস্তানা গেড়েছিল দেড় লক্ষ নাগরিক। যাদের বেশিরভাগ এসেছিল স্পেন, ইরাক, ইরান, তিউনেসিয়া, ইটালি, ফ্রান্স, ভারত ও গ্রিস থেকে। পরবর্তী এগারো বছরে আরও দশটি শহর তিনি নিজের নামে গড়ে তুলেছিলেন, কিন্তু কালের বিবর্তনে আজ শুধু একটি নামই টিকে আছে-আলেক্সান্ডিয়া অব মিসর। দ্য সিটি অব ক্লিওপেট্রা!

কত বিচিত্র ব্যক্তিরা জড়িয়ে আছেন এই নগরীর সাথে- মহাবীর আলেক্সান্ডার, ক্লিওপেট্রা, এন্টনি, হাইপেশিয়া, মরিয়ম, যীশুখ্রিস্ট, সাধু পল, আমর ইবনুল আস থেকে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। টলেমীদের হাতে নির্মিত এ শহরেই বিকাশ লাভ করেছিল ইউক্লিডের জ্যামিতি। পৃথিবীর সবচেয়ে খ্যাতিমান লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এখানে- হাতে লেখা পাঁচ লক্ষ ভলিউম বই নিয়ে। মিসর সরকার এখন সেই লাইব্রেরি পুনঃনির্মাণ করছে। লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্ব নিয়েছেন ইউনেস্কোর প্রাক্তন ডেপুটি চিফ ইসমাইল সেরাগ-আল দীন।

ধীরে ধীরে আমরা আলেক্সে প্রবেশ করছি। পুরো শহরের রাস্তা নিউইয়র্কের মত পারপেন্ডিকুলার। পরস্পরের সাথে সমকোণে নির্মিত। হয়ত এরই কোন রাস্তার ওপর দিয়ে হেঁটেছেন সম্রাজ্ঞী ক্লিওপেট্রা! জেরুজালেম, বাগদাদ ও রোম ছাড়া পৃথিবীর আর কোন নগরী কি এত প্রাচীন ঐতিহ্য ধারণ করে?

আলেক্সান্ডারের মৃত্যু হয় খ্রিস্টপূর্ব তিনশো-চাওে; ব্যাবিলনে। তার মৃত্যুর পরই বিশাল রাজ্যের আধিপত্য নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। আলেক্সান্ডার ও রোখসানার পুত্রের বয়স মাত্র চার বছর হওয়ায় আলেক্সান্ডারের ছোট ভাইকেই আনুষ্ঠানিকভাবে রাজা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু রাজ্য চালাবার যোগ্যতা তার ছিল না। বিরক্ত সেনাপতিরাই বিদ্রোহ শুরু করে। এদের মধ্যে আলেক্সান্ডারের বিশ্বস্ত বন্ধু টলেমী উত্তর আফ্রিকার কর্তৃত্ব গ্রহণে সফল হয় এবং সটার-ওয়ান নামে মিসরের সিংহাসনে বসে। তার এই সাফল্যে পেছনে বিরাট ভূমিকা রাখে আলেক্সান্ডারের লাশ, যা তিনি ব্যাবিলন থেকে মেসিডোনিয়া নেয়ার পথে ছিনিয়ে মেম্ফিসে সমাহিত করেন।

সটারের বংশধারায় অন্তত সাতজন ক্লিওপেট্রার উল্লেখ পাওয়া যায়। পঞ্চশ টলেমী এপিফেন্স বিয়ে করেন সিরিয়ার রাজকণ্যা ক্লিওপেট্রাকে। সিরিয়া এবং মিসরের অব্যাহত সংঘর্ষ এড়াবার জন্যই এ বিয়ে হয়েছিল। এফিফেন্সের মৃত্যুর পর ক্লিওপেট্রা-ওয়ান পুত্র ফিলোমিটারের সাথে যৌথভাবে চার বছর রাজত্ব করেন। ফারাওদের নিয়ম ছিল যে, কোন নারী এককভাবে শাসনকর্তা হতে পারবে না। টলেমীরাও এই নিয়মকে মেনে নিয়েছিলেন।

পৌনে তিনশো বছর শাসন শেষে দ্বাদশ টলেমী অলেট্স ক্ষমতায় বসেন। তিনি শিল্পানুরাগী ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে অষ্টাদশী কন্যা সপ্তম-ক্লিওপেট্রা এবং দশ বছর বয়সী পুত্র ত্রয়োদশ-টলেমীকে যৌথভাবে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন তিনি। এই সপ্তম ক্লিওপেট্রাই ইতিহাস-খ্যাত রানী ক্লিওপেট্রা।

একান্ন খ্রিষ্টপূর্বাব্দের বসন্তকালে ক্লিওপেট্রা সিংহাসনে আসীন হন। তার আরও তিনটি বোন ছিল: ক্লিওপেট্রা-সিক্স, বেরেনিস এবং এরিসনে। প্রথম দু’জন শৈশবেই মারা যায়। দুটি ছোট ভাইয়ের মধ্যে ছয় বছর কনিষ্ঠ ত্রয়োদশ টলেমীকে বিয়ে করে যৌথ শাসনের অধিকার লাভ করেন ক্লিওপেট্রা। কিন্তু অচিরেই তার বয়োজ্যেষ্ঠতা এবং দুঃসাহসী কার্যকলাপের জন্য তিনি ভাইকে ছাড়িয়ে একাই খ্যাতির শীর্ষে উঠে যান।

প্রাচীন ইতিহাসে ক্লিওপেট্রার বহুবিধ চরিত্র পাওয়া যায়। তবে রোমানদের হাতে তার যে নোংরা ও ঘৃণিত চরিত্র আঁকা হয়েছে তা অতিশয় অতিরঞ্জিত। একথা সত্য যে টলেমীদের রাজবংশে টলেমী-ওয়ান ও টলেমী-টু ছাড়া প্রায় সকল শাসকই ছিলেন সংকীর্ণ স্বার্থে লিপ্ত। কিন্তু সপ্তম ক্লিওপেট্রা দু’জন রোমান সম্রাটকে তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে তিনিই টলেমীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফারাও। যদিও তার প্রণয়ের চেয়ে বহু গুণে অধিক ছিল তার শিক্ষানুরাগ, কর্মদক্ষতা ও দেশপ্রেম; কিন্তু পশ্চিমা ঐতিহাসিকবৃন্দ এবং শেক্সপীয়রের মত বিখ্যাত নাট্যকারও ক্লিওপেট্রার চরিত্র অংকনে অসততার পরিচয় দিয়েছেন।

ক্ষমতায় আরোহণের পরপরই ক্লিওপেট্রা কৃষি ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান। দ্রুত বিত্ত-বৈভবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে মিসর। ক্লিওপেট্রার রূপের খ্যাতিও ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ভাইকে বাদ দিয়ে একক নামাংকিত মুদ্রার প্রচলন করেন তিনি; যা মিসরের রীতিতে অবাঞ্ছনীয়। ক্রুদ্ধ শত্রুরা ছোট ভাই (ও স্বামী) ত্রয়োদশ টলেমীর সাথে জোট বাঁধে। সাইপ্রাস, পশ্চিম-সিরিয়া এবং সাইরেনিকা হাতছাড়া হয়ে যায় ক্লিওপেট্রার। এসব ঘটনার পেছনে রোমেরও যথেষ্ট ইন্ধন ছিল। ত্রয়োদশ টলেমী গোপনে রোমানদের সাথে চুক্তিও করেছিলেন বলে ঐতিহাসিকরা দাবি করেন। ক্লিওপেট্রার বিরুদ্ধে যত অপ্রচার, তার অধিকাংশই এ সময়কার। যদিও ঐতিহাসিকরা সকলেই স্বীকার করেন যে সিজার ও এন্টনি ছাড়া ক্লিওপেট্রার আর কোন প্রেমিক ছিল না এবং তাকে যে রকম বহু-ভোগ্যারূপে উপস্থাপন করা হয়, সত্যের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। সাথে একথাও আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, তিনি প্রতাপশালী হলেও ছিলেন সেই যুগের, যে-যুগে সম্রাজ্ঞীও ভাইকে বিয়ে করতে বাধ্য ছিলেন আর অধিনত ছিলেন পুরোহিতন্ত্রের।

খ্রিস্টপূর্ব আটচল্লিশে সিনেটের সাথে ক্লিওপেট্রার মনোমালিন্য শুরু হয়। পার্থিয়ানদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সিরিয়ার গভর্ননের পুত্ররা সাহায্যের আশায় আলেক্সান্ড্রিয়ায় আসার পথে নিহত হয়। রোমান সেনাপতি থিওডেটাস, খোজা-পথিনাস এবং আধা-গ্রিক জেনারেল-একিলাস এই হত্যাকান্ডের জন্য ক্লিওপেট্রাকে দায়ী করেন। ইতিহাসে এর সত্যাসত্য জানা যায় না। কিন্তু এই তুচ্ছ ঘটনার সূত্র ধরেই ত্রয়োদশ টলেমী প্রকাশ্যে রোমান পক্ষ অবলম্বন করেন। খ্রিস্টপুর্ব সাতচল্লিশে এই যৌথ শক্তি ক্লিওপেট্রাকে উৎখাত করে। আর এসব ঘটনা এমন সময় ঘটে, যখন রোমানদের হাতে বিজিত হচ্ছে শহরের পর শহর, দেশের পর দেশ। দুশো বছর টলেমীরা এই পরাশক্তিকে ঠেকিয়ে রেখেছিল নানা উপঢৌকন ও তোয়ায-তদবীরে। কিন্তু ক্লিওপেট্রা এই নতজানু-নীতি পাল্টাতে চাইলেন। সুতরাং ক্ষুব্ধ রোমানরা যে ক্লিওপেট্রাকে সরিয়ে দেবার সুযোগ হাতছাড়া করবেনা, সে-তো বলাই বাহুল্য।

তারপরেও ভাগ্য টলেমীকে সাহায্য করেনি। তীব্র খরায় নীল-নদে পানির ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে দেশ জুড়ে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়।

অপসারিত ক্লিওপেট্রা পালিয়েছিলেন দেশের পূব দিকে: সিরিয়ার প্রান্ডে। তাকে খাদ্যাভাবে মারার জন্য পঞ্চাশ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ত্রয়োদশ টলেমী এক অভিনব ডিক্রি জারি করান যে, আলেক্সান্ড্রিয়া ছাড়া মিসরের আর কোথাও কোন খাদ্য-বোঝাই জাহাজ যেতে পারবে না।

ওদিকে, রোম সাম্রাজ্যে তখন ঘটছিল বিরাট পরিবর্তন। খ্রিস্টপূর্ব ঊনষাট সালে প্রথম রোমান ত্রি-শক্তির পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপতি পম্পেইর সাথে রোমান সিনেটের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। জুলিয়াস সিজার বিদ্রোহী পম্পেইকে আটচল্লিশ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ফার্সালুসের যুদ্ধে পরাজিত করেন। জেনারেল পম্পেই নিরাপদ আশ্রয়স্থল ভেবে আলেক্সান্ড্রিয়ায় পৌঁছেন। তার ধারণা ছিল, যেহেতু রোমান সিনেট তাকে মিসর, সিরিয়া, গ্রিস ও আন্দালুসিয়া দেখভাল করার দায়িত্ব দিয়েছে, সেহেতু আলেক্সান্ড্রিয়া হবে তার পরবর্তী শক্তিকেন্দ্র। কিন্তু টলেমীর কাছে যুদ্ধের ফলাফল আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। জেনারেল পম্পেই তীরে পা রাখা মাত্রই তাকে হত্যা করেন তিনি।

বত্রিশশো পদাতিক, চারশো ঘোড়সওয়ার এবং বিশাল নৌবাহিনী নিয়ে জুলিয়াস সিজার আলেক্সান্ড্রিয়া পৌঁছেন চারদিন পরে। মিসরের দেবতাদের জন্য নির্মিত মন্দিরে (পেলুসিয়ামে) আশ্রম নেন ত্রয়োদশ টলেমী। যে পথিনাস ও একিলাসের সাথে ষড়যন্ত্র করে টলেমী ক্লিওপেট্রাকে উৎখাত করেছিল, তারাই বুদ্ধি দিয়ে টলেমীকে প্রাসাদে ফিরিয়ে আনেন। ওদিকে, ক্লিওপেট্রাও হারানো ক্ষমতা ফিরে পেতে ছিলেন বদ্ধপরিকর। পরের কাহিনী সবারই জানা: শিল্পী ও সাহিত্যিকরা যে বর্ণনায় আজও মুখর; একটি কার্পেটের ভেতর নিজেকে পেঁচিয়ে তিনি সিজারের সামনে হাজির হন এবং বয়স্ক সিজার বন্দী হন ২১-এর প্রণয়জালে।

সমন মোতাবেক, পরদিন, ক্লিওপেট্রা ও টলেমী দু’জনেই দরবারে হাজির হন। জুলিয়ার সিজারের চোখের দিকে তাকিয়েই টলেমী বুঝতে পারেন যে বোনের যৌবনজালে বন্দী হয়েছেন সিজার। তার পরাজয় অবধারিত। উপায়ন্তর না দেখে বন্ধুদের সাহায্য প্রার্থনা করেন টলেমী। পথিনাসের নেতৃত্বে বিশ হাজার সৈন্য যুদ্ধ শুরু করে। সুবিখ্যাত আলেক্সান্ড্রিয়া লাইব্রেরি পুড়িয়ে ফারো দ্বীপ ও লাইটহাউসের দখল নেন সিজার। পানির ওপর জোর যার, মরুভূমিতে তারই ক্ষমতা। টলেমীর পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিলেন জুলিয়াস সিজার। পরাজয় ঘটল টলেমীর।

এ-সময় বোন এরিসনেও ক্লিওপেট্রা ও সিজারের সাথে ছিল। কিন্তু লোভের ফাঁদে পা দিয়ে সিজারের শিবির থেকে পালিয়ে একিলাসের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করে এরিসনে। ভাগ্যের পরিহাস, যুদ্ধে পথিনাস ও একিলাস নিহত হয়। ত্রয়োদশ টলেমীকে হত্যা করা হয় নীলনদের পানিতে ডুবিয়ে, যখন সে সিজারের শিবির থেকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। বন্দী হয় এরিসনে।

টলেমীর মৃত্যুর কারণে ক্লিওপেট্রা মিসরের একক কর্তৃত্ব লাভ করেন। কিন্তু প্রথানুসারে, এগারো বছর বয়সী ছোটভাই চতুর্দশ টলেমীকে বিয়ে করে তাদের যৌথ-ফারাও ঘোষণা করা হয়। এই ফর্মালিটি মেনে নেন সিজার। তার দরকার ছিল মিসরের বিপুল সম্পদ এবং উপচে-পড়া খাদ্য সামগ্রী। নীল-নদের উজানে ডেনডেরা পর্যন্ত ক্লিওপেট্রার সাথে প্রমোদ ভ্রমণ করেন তিনি। নয় মাসের মাথায় পুত্র সন্তানের জনক হন জুলিয়াস সিজার। এটি প্রণয়ের স্বাভাবিক ফসল, নাকি ক্লিওপেট্রার পরিকল্পিত ঘটনাÑ আজও তা নিয়ে জল্পনার শেষ নেই। তবে, এই পুত্র-সন্তান রাজনৈতিক দিক থেকে ক্লিওপেট্রার দারুন কাজে লাগে। প্রথামাফিক, পুত্রের সাথে যৌথ রাজত্ব করায় যেহেতু আইনগত বাধা নেই, হোক সে দু’দিনের শিশু।

ছেচল্লিশের জুলাইতে সিজার রোমে প্রত্যাবর্তন করেন। তেরো বছরের সুশাসন এবং বহু যুদ্ধজয়ের পুরস্কার স্বরূপ রোমবাসী বিপুল সংবর্ধনা দেয় তাকে। বিরল এ সম্মান সিজারকে বিপথে পরিচালিত করে। রিপাবলিকের বদলে একনায়কতন্ত্রের প্রচলন করেন তিনি। নিজেকে আজীবন সম্রাটও ঘোষণা করেন। এই ক্ষমতার ভাগ নিতে দু:সাহসী ক্লিওপেট্রা রোমে গিয়ে হাজির হন এবং তার শিশুপুত্রকে নিজের বলে স্বীকার করে নিতে বাধ্য করান সিজারকে। টলেমী-সিজারের এই স্বীকৃতি সিনেটকে ক্ষিপ্ত করে। কারণ, রোম তখনো বহুবিবাহকে স্বীকার করত না এবং প্রকাশ্য-ব্যভিচারকেও ঘৃণা করত। ফলশ্রুতিতে, চুয়াল্লিশ খ্রিস্টপূর্বের পনেরোই মার্চ সকালে ব্রুটাস, ক্যাসিয়াস ও তাদের সমর্থক অন্যান্য সিনেটরদের হাতে প্রকাশ্য ফোরামে নিহত হন জুলিয়াস সিজার।

রোমে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ায় শিশুপুত্রকে নিয়ে আলেক্সে ফিরে আসেন ক্লিওপেট্রা। অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে নিহত হয় চতুর্দশ টলেমী। যুক্তি এবং ইতিহাস বিশ্লেষণে মনে হয়, এই হত্যাকান্ড ক্লিওপেট্রার দ্বারাই সংঘটিত হয়েছিল। চার বছর বয়সী শিশুপুত্র টলেমী-সিজারের সাথে যৌথভাবে নিজেকে মিসরের ফারাও ঘোষণা করেন তিনি এবং পুরোহিতদের দ্বারা বৈধ করিয়ে নেন এই অভিষেক।

প্লেগ ও দুর্ভিক্ষ ইতিমধ্যে মিসরকে দুর্বল করে ফেলেছিল। ক্লিওপেট্রার অনুপস্থিতিতে নীলের যতœ কমে যায় এবং পানির অভাবে কৃষি ব্যবস্থায় বিপর্যয় নামে। দৃঢ় মনোবল, কঠোর পরিশ্রম এবং প্রশাসনিক দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি এই বিপদের মোকাবিলা করেন। মিসর আবার উঠে দাঁড়ায়। এ-সময়, সিজারের রেখে যাওয়া দুই ব্রিগেড সৈন্যকে ক্লিওপেট্রা রোমে ফেরত পাঠান বিপর্যস্ত রাজধানীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। পথিমধ্যে, বিদ্রোহী সেনাপতি ক্যাসিয়াস এই সৈন্যদের হত্যা করে।

রোমের গৃহযুদ্ধ থেমে আসে। অক্টাভিয়ানের দিকে জয়ের পাল্লা ভারি হয়। সিজারের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ক্ষমতা লাভ করে নতুন ত্রিশক্তি: মার্ক এন্টনী, অক্টাভিয়ান ও লেপিডাস। তিন সেনাপতি রোমান সাম্রাজ্যকে তিনভাবে ভাগ করে শাসন করবেন বলে চুক্তি হয়। লেপিডাস পশ্চিম আফ্রিকা, স্পেন ও পশ্চিম ইউরোপের অধিকর্তা; এন্টনী গ্রিস, আর্মেনিয়া, আনাতোলিয়া, পার্থিয়া, সিরিয়া ও মিসরের এবং অক্টাভিয়ান রোমসহ কেন্দ্রেভর। সিজার উপাধিও থাকল অক্টাভিয়ানের; কারণ জুলিয়াসের উইলে উত্তরাধিকারী হিসেবে তারই নাম ছিল।

পরিস্থিতি শান্ত হবার পর মিসর সম্রাজ্ঞীকে ভূমধ্যসাগরের টরাসে দেখা করার নির্দেশ পাঠান পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপতি মার্ক এন্টনী।

নিজের দেশকে পুর্নগঠিত করার পাশাপাশি ক্লিওপেট্রা রোমান সাম্রাজ্যের গতিপ্রকৃতির উপরও তীক্ষè নজর রাখছিলেন। দূতের মাধ্যমে এন্টনী সম্পর্কে বিস্তারিত খবরাখবর সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। এন্টনী সাহসী বীর, কিন্তু ততটা তীক্ষèধী নন। তার চরিত্রের দুর্বলতা ছিল যে তিনি মদ্যপ, উচ্চাকাংক্ষী এবং নীল রক্তের আভিজাত্যে অহংকারী।

ক্লিওপেট্রা স্পষ্ট বুঝেছিলেন ক্রমবর্ধমান রোম সাম্রাজ্যের নজর মিসরে পড়বেই। স্বাধীনতা হারাবার চেয়ে দেশকে বাঁচাবার কৌশল অবলম্বন করাকেই শ্রেয় মনে করলেন তিনি। যদিও মিসর তখনো পূর্ব গৌরব ফিরে পায়নি, তবু ক্লিওপেট্রা নিজেকে শ্রেষ্ঠতম সজ্জায় সাজিয়ে এন্টনীর সামনে উপস্থিত হলেন এবং ইতিহাস মোড় নিল প্রেমোপখ্যানে...লিজ-টেলর অভিনীত ছবি ‘ক্লিওপেট্রা’য় যা দেখানো হয়েছে, ঐতিহাসিকদের বর্ণনা তার চেয়ে বহুগুণ সরেস: রূপার পাতে নৌকার গলুই মুড়ে, মুক্তা ও রতœরাজিতে পাল সাজিয়ে, আফ্রোদিতির সাজে আধশোয়া ক্লিওপেট্রা যখন মার্ক এন্টনীর নিকটবর্তী হলেন, বলাবাহুল্য, এন্টনী নিজেকে সংবরণ করতে পারেননি। ক্লিওপেট্রার রূপের চমক, বুদ্ধির ঝিলিক এবং যৌবনের প্রস্রবনে বর্ষীয়ান জুলিয়াস সিজারের চেয়ে অনেক বেশি দ্রবীভূত হলেন এন্টনী। শুরু হল মিশর-রোমের দ্বিতীয় প্রণয়-পর্ব।

পুরো একটি বছর তাদের এই প্রেম বহাল থাকল। বলা হয়, এন্টনী এ সময় ক্লিওপেট্রার দাসে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি যা চাইতেন, তাই হতো। মদ্যপ এন্টনী এক রাতের মদের দাম দিতে না পারায় সাইপ্রাস দান করে দিলেন ক্লিওপেট্রাকে। এন্টনীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিদ্রোহী বোন এরিসনকে হত্যা করিয়েছেন বলেও ক্লিওপেট্রার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিকদের অভিযোগ।

তবে প্রেম-প্রণয় যাই হোক, এন্টনী ও ক্লিওপেট্রা মিসরকে সুশাসনেই রেখেছিলেন।

দু’বছর পরে, খ্রিস্টপূর্ব চল্লিশের শীতকালে, মার্ক এন্টনী রোমে ফিরে গেলেন। পরবর্তী চার বছর দু’জনের একবারও দেখা হয়নি। ইতিমধ্যে এন্টনীর স্ত্রী ফুলভিয়ার সাথে অক্টাভিয়ানের জমিদারি সংক্রান্ত বিরোধ বাড়ে এবং ফুলভিয়া গ্রিসে বসে বিদ্রোহ করেন। রোমান ইতিহাসে কোন নারীর বিদ্রোহ এটাই প্রথম।

এন্টনী এই বিরোধ মেটাতে ব্যর্থ হন। তিন বছর পর ফুলভিয়া গ্রিসেই প্রাণত্যাগ করে। অভিযোগ আছে, বিষ প্রয়োগে তাকে হত্যা করেন অক্টাভিয়ান। এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের বিবাদ এড়াবার জন্য অক্টাভিয়ান নিজের বিধবা বোন অক্টাভিয়াকে এন্টনীর সাথে বিয়ে দেন। এটাই ছিল তখনকার শান্তি প্রক্রিয়ার রীতি!

আগের পক্ষের তিন পুত্রসহ সুন্দরী অক্টাভিয়া মার্ক এন্টনীর নতুন সঙ্গী হন। তদ্দিনে ক্লিওপেট্রা দুই জমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছে। এদিকে, অক্টাভিয়ার গর্ভে এন্টনীর এক কন্যা জন্মায়। ঐতিহাসিকরা বলেন, যদি অক্টাভিয়া মার্ক এন্টনীকে পুত্র সন্তান উপহার দিতে পারতেন, ইতিহাস হয়ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হত। পুত্র না হওয়ায় এন্টনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন অক্টাভিয়ার প্রতি।

অন্যদিকে, ক্রমাগত রাজনৈতিক বিপর্যয়ে রোমের অর্থনৈতিক অবস্থা এত খারাপ অবস্থায় পৌঁছে যে টাকার মূল্যমান তিনশো ভাগ হ্রাস পায়। রাজকোষ বৃদ্ধির স্বার্থে এন্টনীকে আবার ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে হয় সিরিয়া ও পার্থিয়ানদের কাছ থেকে বর্ধিত কর আদায় করতে।

পরের বছরও অক্টাভিয়া আবার একটি মেয়ের জন্ম দেন। ফলে, স্ত্রীর প্রতি এন্টনীর আগ্রহে চূড়ান্ত ভাটা পড়ে। পূবের-পথে কর্সিকা দ্বীপ পর্যন্ত সঙ্গ দেবার পর অক্টাভিয়াকে জোর করে রোমে ফেরত পাঠিয়ে পুনর্বার ক্লিওপেট্রার বাহুডোরে নিজেকে সঁপে দেন এন্টনী। রোমান ঐতিহ্যকে পুরোপুরি অবমাননা করে পুত্র আলেক্সান্ডার হেলিয়স এবং কন্যা ক্লিওপেট্রা সেলেনকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেন। ক্লিওপেট্রাকে উপহার দেন সাইপ্রাস, সিসিলি, ফিনিশিয়া, পশ্চিম-সিরিয়া, জুডিয়া এবং আরব উপদ্বীপ। নৌবহর নির্মাণেরও অনুমতি দেয়া হয় মিসরকে।

রোমের বিরাগভাজন হওয়া সত্ত্বেও এন্টনী ছিলেন সুখী। কারণ, ক্লিওপেট্রা তাকে আরেকটি পুত্র উপহার দিয়েছে। তিনি পুত্রের নাম রাখেন টলেমী ফিলাডেলফোস।

পার্থিয়ানদের সাথে দ্বিতীয় যুদ্ধে পরাজিত-এন্টনী ও ক্লিওপেট্রা যখন সিরিয়া হয়ে মিসরে ফিরে যাচ্ছেন, আকুল অক্টাভিয়া তখন নতুন সৈন্য ও সরবরাহ নিয়ে এথেন্সের উপকূলে স্বামীর জন্য অপেক্ষমাণ। তিনি তখনো জানেন না যে এন্টনী তার প্রতি সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

ওদিকে তার ভাই, সিজার অক্টাভিয়ান, এই অসম্মানের প্রতিশোধ নিতে এন্টনীকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে আহবান করলেন। অন্যথায়, এন্টনীকে সিনেটের সামনে ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু এন্টনী তখন শৌর্যে-বীর্যে সে এতটাই আত্মমগ্ন যে এসব হুমকিকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলেন না। অধিকন্তু পূর্ব-সাম্রাজ্যের রানী নীল-দুহিতা ক্লিওপেট্রার প্রেমে বিভোর তিনি।

তার আত্মম্ভরিতার কারণও ছিল। যুদ্ধে এখনো তিনি প্রায় অপরাজেয়। পার্থিয়ার পরাজয়ে দমে না গিয়ে এন্টনী আর্মেনিয়া আক্রমণ করে বিপুলভাবে জয়ী হয়েছেন। এই যুদ্ধের বিজয় উৎসব হল আলেক্সান্ড্রিয়ায় এবং সেই প্যারেডে এন্টনীর পাশে দেবী আইসীসরূপী ক্লিওপেট্রাকে বিজয়িনীর ভূমিকায় দেখা যায়। এন্টনী নিজেকে ডায়েনিসাস (সর্বাধিনায়ক) হিসেবে ঘোষণা করেন। পুরোহিতরা আরও এককাঠি অগ্রসর হয়ে টলেমী সিজারিয়ানকে ‘রাজাদের রাজা’, ক্লিওপেট্রাকে ‘রাজাদের রানী’, হেলিওসকে ‘সেলসিডের সম্রাট’, সেলেনকে ‘সাইরেনিকার রানী’ এবং সর্ব কনিষ্ঠ টলেমী ফিলাডেলফোসকে ‘সিরিয়া এবং এশিয়া মাইনরের সম্রাট’ খেতাব প্রদান করে (যখন ফিলাডেলফোসের বয়স মাত্র দুুই)। ক্লিওপেট্রা হয়ত বিশ্বসম্রাজ্ঞী হবার স্বপ্ন দেখা থেকেই এসব করিয়েছিলেন। কারণ, তার একটি উক্তি রোমান দম্ভের চেয়েও জোরালো হয়ে ইতিহাসের কুঠুরীতে আজো প্রতিধ্বনি তোলে, ‘নিশ্চয়ই সেদিন সমাগত, যেদিন রোমবাসী আমাকে তাকিয়ে দেখতে বাধ্য হবে।’

এসব দাম্ভিকতা রোমান সিনেটের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে অক্টাভিয়ানকে একক সম্রাট হবার সুযোগ করে দেয়। এন্টনী অক্টাভিয়াকে তালাক দিলে ঘটনার চরম অবনতি ঘটে। আশ্চর্যের বিষয়, স্বামীর এতসব বিচ্যুতির পরেও অক্টাভিয়া এন্টনীর প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন। এমনকি, স্বামীর বিরুদ্ধাচারণ করে একবারও তিনি সিনেটরদের প্রভাবিত করেননি। কিন্তু অক্টাভিয়ান এই সুযোগ নষ্ঠ হতে দেননি।

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার জন্য সিনেট ডাকা হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার, সিনেটে যুদ্ধ ঘোষণা করা হল এন্টনীর বিরুদ্ধে নয়, মিসরের বিরুদ্ধে। সবচেয়ে কুৎসিত বিশেষণে ক্লিওপেট্রাকে অভিযুক্ত করে কি করে এই প্রস্তাব রোমান সিনেটে পাস করেছিল, আজও তা ঐতিহাসিকদের কাছে বিস্ময়। গল, আফ্রিকা, সিসিলি এবং সার্দিনিয়ার রাজারাও পক্ষ নিয়েছিল অক্টাভিয়ানের। রাজনৈতিক প্রচারণা ছিল ভয়ংকর বিদ্বেষী: এ হল প্রাচ্যের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের অভিযান। কিংবা, এ যুদ্ধ এক ভ্রষ্টা নারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এমন স্লোগানও উসকে দেয়া হয়েছিল যে, বর্বর সেমেটিকদের বিরুদ্ধে সভ্য রিপাবলিকের শক্তি পরীক্ষার যুদ্ধ এটি।

সত্তর হাজার পদাতিক, বারো হাজার অশ্বারোহী এবং চারশো যুদ্ধজাহাজে সজ্জিত রোমান বাহিনীর বিরুদ্ধে এন্টনীর শক্তি কিন্তু মোটেই কম ছিল না। পঁচাত্তর হাজার পদাতিক, বারো হাজার ঘোড়সওয়ার, পাঁচশো যুদ্ধ জাহাজ এবং অতিরিক্ত পঁচিশ হাজার রিজার্ভ বাহিনীর কমান্ড ছিল তার অধীনে। আশ্চর্যের বিষয়, যে মিশর কোনদিন কোন নৌ-যুদ্ধে অংশ নিয়নি, তারাও দুশো রণতরী সজ্জিত করে। নৌ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং ক্লিওপেট্রা। তার মণিমুক্তাখচিত রাজকীয় শিপের নাম দেয়া হয়েছিল ‘এন্টনীয়’। যার চারপাশে গার্ড দিচ্ছিল ষাটটি ইজিপশিয়ান মিড-শিপ।

গ্রিসের দক্ষিণ উপকূল এপিরাসে দুই বাহিনী প্রথম মুখোমুখি হয়। অক্টাভিয়ান জানতেন, শঠতা ছাড়া তিনি জিততে পারবেন না। সুদক্ষ জেনারেল এগ্রিপ্পাকে দিয়ে প্রথমেই তাই তিনি চারপাশের দ্বীপগুলো দখল করে মিসর বাহিনীর পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেন। এন্টনী ও ক্লিওপেট্রা ঘেরবন্দি হন। তবুও তাদের বিশাল বাহিনী বিপদে পড়ত না, যদি বিশ্বস্ত সেনাপতিদের তিনজন, বিশেষত জেনারেল ডেলিয়াস, বিশ্বাসঘাতকতা করে এন্টনীর যুদ্ধ-পরিকল্পনা অক্টাভিয়ানের কাছে ফাঁস করে না দিতেন।

চার দিন পর, অ্যাকটিয়ামে, শক্রর বেষ্টনী ভেঙে বেরিয়ে যাবার জন্য এন্টনী ও ক্লিওপেট্রা তাদের মালবাহী জাহাজের মধ্যে বিশাল পঞ্চাশটি এবং ক্ষুদ্র দুশোটিতে আগুন লাগিয়ে দিলেন। পিছিয়ে যেতে বাধ্য হল অক্টাভিয়ান। সেই সুযোগে ক্লিওপেট্রার শিপ বেষ্টনী ভেদ করে সাগরে বেরিয়ে গেল।

কিন্তু নিয়তী ছিল বিরূপ। জেনারেল ডেলিয়াসের বিশ্বাসঘাতক চর, আরও একজন মুখোশধারী সেনাপতি, এন্টনীকে বোঝালেন যে ক্লিওপেট্রা এন্টনীকে একা ফেলে তার নৌবহর নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। বিভ্রান্ত এন্টনী ভাবলেন, তার পরাজয় ঘটেছে। এস্কেপ-শিপে করে তিনিও ক্লিওপেট্রাকে অনুসরণ করলেন। নেতৃত্বহীন মাঠে একশো বাইশটি বিশাল জাহাজ রোমানদের হাতে ধ্বংস হল।

এই পরাজয়ের বিশ্লেষণে যদিও রোমানরা ক্লিওপেট্রার পশ্চাদপসরণকেই দোষ দেয়, কিন্তু এদ্দিন পর আজ আর নিশ্চিত করে বলা যায় না যে পরাজয়ের পেছনে সেটাই একমাত্র কারণ ছিল। যাই হোক, পিছু ধাওয়া করে অক্টাভিয়ান মিসর উপকূল পর্যন্ত পৌঁছান। এন্টনী ও ক্লিওপেট্রা পুনর্বার তাদেও বাহিনীকে পুনর্গঠিত করেন আলেক্সান্ড্রিয়ায়। কিন্তু সেখানেও বিশ্বাসঘাতকতা। মিসরীয় বাহিনীর সাথে একত্রে যুদ্ধ করতে রোমান সেনারা নারাজ। দ্বিধাবিভক্ত বাহিনীর কমান্ডার দ্বিতীয়বারও পরাজিত হলেন। হতাশা, মাদকাশক্তি এবং আত্মগ্লানির শেষ পর্যায়ে ভুল সংবাদে প্রতারিত এন্টনী নিজের তরবারিতে আত্মহত্যার চেষ্টা চালালেন। ক্লিওপেট্রা দ্রুত তাকে নিজের সুরক্ষিত ভবনে স্থানান্তর করলেন। প্রিয়ার বাহুতে মাথা রেখেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন রোমান ইতিহাসের অন্যতম দুর্ধর্ষ সেনাপতি মার্ক এন্টনী।

বিধ্বস্ত ও শোকাভিভূত ক্লিওপেট্রা অক্টাভিয়ানের সমস্ত লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জানালেন, কেবলমাত্র টলেমী-সিজারিয়ানকে মিসরের বৈধ সম্রাট ঘোষণা করলেই দু’পক্ষের আলোচনা সম্ভব। কৌশলী অক্টাভিয়ান আলোচনার নামে কালক্ষেপণ শুরু করেন। ইতিমধ্যে এন্টনীকে সমাহিত করা হয় সেরাপিয়নের পাশে। ক্লিওপেট্রা জানতেন, তাকে ক্রীতদাসী হিসেবে রোমের বিজয়-প্যারেডে দেখাতে চাইবে অক্টাভিয়ান। সুতরাং তিনি বেছে নিলেন এমন পথ, পাঠক মাত্রেই জানেন- হাসিমুখে সাপের কামড়ে, আত্মাহুতি দিলেন মিশরের শেষ ফারাও; কিন্তু অক্টাভিয়ানের দম্ভের কাছে মাথা নত করলেন না।

ক্ষিপ্ত ও প্রতারিত অক্টাভিয়ান এসে দেখলেন, রাজদন্ড ও জীবনদন্ড হাতে রানীর পরিপূর্ণ মর্যাদায় এমন প্রশান্তভাবে শুয়ে আছেন রানী ক্লিওপেট্রা, যে-মৃত্যুর সামনে জীবনের সব দম্ভই ম্লান হয়ে যায়। তিরিশ খ্রিস্টাপূর্বাব্দের বারোই আগস্ট, ক্লিওপেট্রার বয়স যখন মাত্র উনচল্লিশ, তখন এই করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয়।

পরের কাহিনী সংক্ষিপ্ত। পুরস্কারের লোভে টলেমী-সিজারিয়ানকে অক্টাভিয়ানের হাতে ধরিয়ে দেয় তারই গৃহশিক্ষক। অক্টাভিয়ান দু’জনেরই শিরোñেদ করেন। বাকি তিন সন্তানকে বন্দী হিসেবে রোমে নিয়ে যাওয়া হয়। দুটো ছেলেকেই কৌশলে হত্যা করেন তিনি। ভাইয়ের রোষ থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে সেলেনকে বড় করেন এন্টনী-পতœী অক্টাভিয়া এবং বিয়ে দেন এক অভিজাত রোমানের সঙ্গে। নারী চরিত্রের দুর্জ্ঞেয় রহস্যের মত তার এ আচরণেরও কোন ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু ভাই অক্টাভিয়ান কৌশলে দু’জনকেই অগ্নিকান্ডে পুড়িয়ে মারেন বোনকে বুঝতে না দিয়েই। ক্ষমতার নিরংকুশ বিজয়ী অক্টাভিয়ান নতুন নাম অগাস্টাস নিয়ে তদ্দিনে রোমের দ্বিতীয় ‘জুলিয়াস সিজার’ হয়ে উঠেছেন।

প্রাচীনকাল থেকেই মিসরীয়রা বিশ্বাস করত, সাপের বিষে মৃত্যু জীবনকে অমরতা দেয়। রানী ক্লিওপেট্রা তাদের সেই বিশ্বাসকেই স্থায়ী করে গেছেন। মৃত্যু তাকে নিঃশেষ করে দেয়নি। আজও তিনি সেই ভাগ্যবতী, যার চর্চা হয় সাহিত্য-চলচিত্র-সঙ্গীত-চিত্রকলা সর্বত্র। যে সভ্যতা পিরামিডের রহস্য নিয়ে চার হাজার বছর জাগরুক, তার সমাপ্তি ঘটেছে এমন এক অসামান্য নারীর রহস্যে, যার চরিত্র-চিত্রন অনাদিকাল ধরে চলতে থাকবে। নয়টি ভাষায় পারদর্শী, ইউক্লিডের জ্যামিতি ও জ্যোতির্বিদ্যায় সুপন্ডিত এই নারীর খ্যাতির তুলনা চলে শুধুমাত্র হেলেন-অব-ট্রয়ের সঙ্গে। প্রশাসনে দক্ষ, কৃষি উৎপাদনে বিশেষজ্ঞ এবং কূটনীতিতে পারদর্শী এই কৃঞ্চকলি প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং যুদ্ধবিগ্রহের মাঝেও নিজের দেশকে এতটা সমৃদ্ধ করেছিলেন যে পরবর্তী পঞ্চাশ বছর রোম তার নিঃস্ব রাজভান্ডার পূর্ণ করেছে মিসরের সম্পদ লুট করে। যে স্বাধীনতার জন্য তিনি লড়েছিলেন, তা তিনি রক্ষা করতে পারেননি, এমনকি নিজেকে উজাড় করে দিয়েও; কিন্তু ইতিহাস তাকে ব্যর্থ-শাসক বলে চিহ্নিত করেনি। যদিও দাম্ভিক পশ্চিম তার চরিত্রচিত্রন করে মিথ্যা-কলংকের রঙে রঞ্জিত কওে কিন্তু এই সত্য কেউই অস্বীকার করার সাহস রাকে না যে ক্লিওপেট্রার মৃত্যুতে মিসরের যে পরাধীনতা শুরু হয়, তার গ্লানি সে-দেশকে বইতে হয়েছে পরবর্তী দু’হাজার বছর। (নীল যমুনার জল/ঐতিহ্য/২০১৩)।

‘রাকোদা’ গ্রামের জেলেদের জানার কথা নয়, কে কোন দেশের রাজা বা সেনাপতি। তবুও তারা দ্বীপ থেকে নৌকা বেয়ে পাড়ে এল দেখতে। চব্বিশ বছরের তরুণ মেসিডোনিয়ান সেনাপতি ‘আলেক্সান্ডার’ সিওয়া ওয়েসিসে যাবেন। সকলেই জানে, আমন মন্দিরের আর্শীবাদ পেলেই কারো পক্ষে এশিয়া জয় করা সম্ভব। আর এশিয়া জয় করা মানেই তো বিশ্বজয়! কিন্তু এ তরুণের যে দেবতার মত সোনালি কোঁকড়া চুল, নীল স্বপ্নালু চোখ; এ-কি মহাপ্রাচ্যের যুদ্ধ করতে পারবে?

‘তোমাদের দ্বীপটি তো খুব সুন্দর। ওর নাম কি? ’ জেলেদের প্রতি মনোযোগী হলেন আলেক্সান্ডার।

‘ফারো।’ জেলেরা আনন্দিত কন্ঠে জবাব দিল।

‘ডাইনোক্রেটিস, এখান থেকে ঐ ফারো দ্বীপ পর্যন্ত রাস্তা বানানো সম্ভব?’

‘সম্ভব!’ সম্মতি জানাল প্রধান স্থপতি।

‘তাহলে, রাকোদা গ্রাম থেকে ফারো পর্যন্ত রাস্তা বানাও এবং শহর গড়ে তোল। নতুন রাস্তার দু’ধারে থাকবে গ্রিকদের বসতি। শহরের নাম হবে আলেক্সান্ড্রিয়া।’

তিনি তার নীল চোখ মেলে দক্ষিণে তাকালেন। বিশাল ম্যারিয়ট লেকের ওপর দিয়ে বয়ে আসছে মরুভূমির ঠান্ডা বাতাস। উত্তরে, ভূমধ্যসাগরের অবিশ্রাম কল্লোল। তার অবচেতন মন কি তাকে বলেছিল যে এ শহরই হবে ইউরোপ-আফ্রিকার যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু? কোনো এক কৃঞ্চাঙ্গ রমণী যাকে অমর কওে রেখে যাবে? সেই নারীর নাম হবে ক্লিওপেট্রা!!

হয়ত বলেছিল।

ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মাত্র একশো বছরের মধ্যেই আলেক্সে আস্তানা গেড়েছিল দেড় লক্ষ নাগরিক। যাদের বেশিরভাগ এসেছিল স্পেন, ইরাক, ইরান, তিউনেসিয়া, ইটালি, ফ্রান্স, ভারত ও গ্রিস থেকে। পরবর্তী এগারো বছরে আরও দশটি শহর তিনি নিজের নামে গড়ে তুলেছিলেন, কিন্তু কালের বিবর্তনে আজ শুধু একটি নামই টিকে আছে-আলেক্সান্ডিয়া অব মিসর। দ্য সিটি অব ক্লিওপেট্রা!

কত বিচিত্র ব্যক্তিরা জড়িয়ে আছেন এই নগরীর সাথে- মহাবীর আলেক্সান্ডার, ক্লিওপেট্রা, এন্টনি, হাইপেশিয়া, মরিয়ম, যীশুখ্রিস্ট, সাধু পল, আমর ইবনুল আস থেকে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। টলেমীদের হাতে নির্মিত এ শহরেই বিকাশ লাভ করেছিল ইউক্লিডের জ্যামিতি। পৃথিবীর সবচেয়ে খ্যাতিমান লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এখানে- হাতে লেখা পাঁচ লক্ষ ভলিউম বই নিয়ে। মিসর সরকার এখন সেই লাইব্রেরি পুনঃনির্মাণ করছে। লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্ব নিয়েছেন ইউনেস্কোর প্রাক্তন ডেপুটি চিফ ইসমাইল সেরাগ-আল দীন।

ধীরে ধীরে আমরা আলেক্সে প্রবেশ করছি। পুরো শহরের রাস্তা নিউইয়র্কের মত পারপেন্ডিকুলার। পরস্পরের সাথে সমকোণে নির্মিত। হয়ত এরই কোন রাস্তার ওপর দিয়ে হেঁটেছেন সম্রাজ্ঞী ক্লিওপেট্রা! জেরুজালেম, বাগদাদ ও রোম ছাড়া পৃথিবীর আর কোন নগরী কি এত প্রাচীন ঐতিহ্য ধারণ করে?

আলেক্সান্ডারের মৃত্যু হয় খ্রিস্টপূর্ব তিনশো-চাওে; ব্যাবিলনে। তার মৃত্যুর পরই বিশাল রাজ্যের আধিপত্য নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। আলেক্সান্ডার ও রোখসানার পুত্রের বয়স মাত্র চার বছর হওয়ায় আলেক্সান্ডারের ছোট ভাইকেই আনুষ্ঠানিকভাবে রাজা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু রাজ্য চালাবার যোগ্যতা তার ছিল না। বিরক্ত সেনাপতিরাই বিদ্রোহ শুরু করে। এদের মধ্যে আলেক্সান্ডারের বিশ্বস্ত বন্ধু টলেমী উত্তর আফ্রিকার কর্তৃত্ব গ্রহণে সফল হয় এবং সটার-ওয়ান নামে মিসরের সিংহাসনে বসে। তার এই সাফল্যে পেছনে বিরাট ভূমিকা রাখে আলেক্সান্ডারের লাশ, যা তিনি ব্যাবিলন থেকে মেসিডোনিয়া নেয়ার পথে ছিনিয়ে মেম্ফিসে সমাহিত করেন।

সটারের বংশধারায় অন্তত সাতজন ক্লিওপেট্রার উল্লেখ পাওয়া যায়। পঞ্চশ টলেমী এপিফেন্স বিয়ে করেন সিরিয়ার রাজকণ্যা ক্লিওপেট্রাকে। সিরিয়া এবং মিসরের অব্যাহত সংঘর্ষ এড়াবার জন্যই এ বিয়ে হয়েছিল। এফিফেন্সের মৃত্যুর পর ক্লিওপেট্রা-ওয়ান পুত্র ফিলোমিটারের সাথে যৌথভাবে চার বছর রাজত্ব করেন। ফারাওদের নিয়ম ছিল যে, কোন নারী এককভাবে শাসনকর্তা হতে পারবে না। টলেমীরাও এই নিয়মকে মেনে নিয়েছিলেন।

পৌনে তিনশো বছর শাসন শেষে দ্বাদশ টলেমী অলেট্স ক্ষমতায় বসেন। তিনি শিল্পানুরাগী ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে অষ্টাদশী কন্যা সপ্তম-ক্লিওপেট্রা এবং দশ বছর বয়সী পুত্র ত্রয়োদশ-টলেমীকে যৌথভাবে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন তিনি। এই সপ্তম ক্লিওপেট্রাই ইতিহাস-খ্যাত রানী ক্লিওপেট্রা।

একান্ন খ্রিষ্টপূর্বাব্দের বসন্তকালে ক্লিওপেট্রা সিংহাসনে আসীন হন। তার আরও তিনটি বোন ছিল: ক্লিওপেট্রা-সিক্স, বেরেনিস এবং এরিসনে। প্রথম দু’জন শৈশবেই মারা যায়। দুটি ছোট ভাইয়ের মধ্যে ছয় বছর কনিষ্ঠ ত্রয়োদশ টলেমীকে বিয়ে করে যৌথ শাসনের অধিকার লাভ করেন ক্লিওপেট্রা। কিন্তু অচিরেই তার বয়োজ্যেষ্ঠতা এবং দুঃসাহসী কার্যকলাপের জন্য তিনি ভাইকে ছাড়িয়ে একাই খ্যাতির শীর্ষে উঠে যান।

প্রাচীন ইতিহাসে ক্লিওপেট্রার বহুবিধ চরিত্র পাওয়া যায়। তবে রোমানদের হাতে তার যে নোংরা ও ঘৃণিত চরিত্র আঁকা হয়েছে তা অতিশয় অতিরঞ্জিত। একথা সত্য যে টলেমীদের রাজবংশে টলেমী-ওয়ান ও টলেমী-টু ছাড়া প্রায় সকল শাসকই ছিলেন সংকীর্ণ স্বার্থে লিপ্ত। কিন্তু সপ্তম ক্লিওপেট্রা দু’জন রোমান সম্রাটকে তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে তিনিই টলেমীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফারাও। যদিও তার প্রণয়ের চেয়ে বহু গুণে অধিক ছিল তার শিক্ষানুরাগ, কর্মদক্ষতা ও দেশপ্রেম; কিন্তু পশ্চিমা ঐতিহাসিকবৃন্দ এবং শেক্সপীয়রের মত বিখ্যাত নাট্যকারও ক্লিওপেট্রার চরিত্র অংকনে অসততার পরিচয় দিয়েছেন।

ক্ষমতায় আরোহণের পরপরই ক্লিওপেট্রা কৃষি ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান। দ্রুত বিত্ত-বৈভবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে মিসর। ক্লিওপেট্রার রূপের খ্যাতিও ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ভাইকে বাদ দিয়ে একক নামাংকিত মুদ্রার প্রচলন করেন তিনি; যা মিসরের রীতিতে অবাঞ্ছনীয়। ক্রুদ্ধ শত্রুরা ছোট ভাই (ও স্বামী) ত্রয়োদশ টলেমীর সাথে জোট বাঁধে। সাইপ্রাস, পশ্চিম-সিরিয়া এবং সাইরেনিকা হাতছাড়া হয়ে যায় ক্লিওপেট্রার। এসব ঘটনার পেছনে রোমেরও যথেষ্ট ইন্ধন ছিল। ত্রয়োদশ টলেমী গোপনে রোমানদের সাথে চুক্তিও করেছিলেন বলে ঐতিহাসিকরা দাবি করেন। ক্লিওপেট্রার বিরুদ্ধে যত অপ্রচার, তার অধিকাংশই এ সময়কার। যদিও ঐতিহাসিকরা সকলেই স্বীকার করেন যে সিজার ও এন্টনি ছাড়া ক্লিওপেট্রার আর কোন প্রেমিক ছিল না এবং তাকে যে রকম বহু-ভোগ্যারূপে উপস্থাপন করা হয়, সত্যের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। সাথে একথাও আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, তিনি প্রতাপশালী হলেও ছিলেন সেই যুগের, যে-যুগে সম্রাজ্ঞীও ভাইকে বিয়ে করতে বাধ্য ছিলেন আর অধিনত ছিলেন পুরোহিতন্ত্রের।

খ্রিস্টপূর্ব আটচল্লিশে সিনেটের সাথে ক্লিওপেট্রার মনোমালিন্য শুরু হয়। পার্থিয়ানদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সিরিয়ার গভর্ননের পুত্ররা সাহায্যের আশায় আলেক্সান্ড্রিয়ায় আসার পথে নিহত হয়। রোমান সেনাপতি থিওডেটাস, খোজা-পথিনাস এবং আধা-গ্রিক জেনারেল-একিলাস এই হত্যাকান্ডের জন্য ক্লিওপেট্রাকে দায়ী করেন। ইতিহাসে এর সত্যাসত্য জানা যায় না। কিন্তু এই তুচ্ছ ঘটনার সূত্র ধরেই ত্রয়োদশ টলেমী প্রকাশ্যে রোমান পক্ষ অবলম্বন করেন। খ্রিস্টপুর্ব সাতচল্লিশে এই যৌথ শক্তি ক্লিওপেট্রাকে উৎখাত করে। আর এসব ঘটনা এমন সময় ঘটে, যখন রোমানদের হাতে বিজিত হচ্ছে শহরের পর শহর, দেশের পর দেশ। দুশো বছর টলেমীরা এই পরাশক্তিকে ঠেকিয়ে রেখেছিল নানা উপঢৌকন ও তোয়ায-তদবীরে। কিন্তু ক্লিওপেট্রা এই নতজানু-নীতি পাল্টাতে চাইলেন। সুতরাং ক্ষুব্ধ রোমানরা যে ক্লিওপেট্রাকে সরিয়ে দেবার সুযোগ হাতছাড়া করবেনা, সে-তো বলাই বাহুল্য।

তারপরেও ভাগ্য টলেমীকে সাহায্য করেনি। তীব্র খরায় নীল-নদে পানির ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে দেশ জুড়ে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়।

অপসারিত ক্লিওপেট্রা পালিয়েছিলেন দেশের পূব দিকে: সিরিয়ার প্রান্ডে। তাকে খাদ্যাভাবে মারার জন্য পঞ্চাশ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ত্রয়োদশ টলেমী এক অভিনব ডিক্রি জারি করান যে, আলেক্সান্ড্রিয়া ছাড়া মিসরের আর কোথাও কোন খাদ্য-বোঝাই জাহাজ যেতে পারবে না।

ওদিকে, রোম সাম্রাজ্যে তখন ঘটছিল বিরাট পরিবর্তন। খ্রিস্টপূর্ব ঊনষাট সালে প্রথম রোমান ত্রি-শক্তির পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপতি পম্পেইর সাথে রোমান সিনেটের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। জুলিয়াস সিজার বিদ্রোহী পম্পেইকে আটচল্লিশ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ফার্সালুসের যুদ্ধে পরাজিত করেন। জেনারেল পম্পেই নিরাপদ আশ্রয়স্থল ভেবে আলেক্সান্ড্রিয়ায় পৌঁছেন। তার ধারণা ছিল, যেহেতু রোমান সিনেট তাকে মিসর, সিরিয়া, গ্রিস ও আন্দালুসিয়া দেখভাল করার দায়িত্ব দিয়েছে, সেহেতু আলেক্সান্ড্রিয়া হবে তার পরবর্তী শক্তিকেন্দ্র। কিন্তু টলেমীর কাছে যুদ্ধের ফলাফল আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। জেনারেল পম্পেই তীরে পা রাখা মাত্রই তাকে হত্যা করেন তিনি।

বত্রিশশো পদাতিক, চারশো ঘোড়সওয়ার এবং বিশাল নৌবাহিনী নিয়ে জুলিয়াস সিজার আলেক্সান্ড্রিয়া পৌঁছেন চারদিন পরে। মিসরের দেবতাদের জন্য নির্মিত মন্দিরে (পেলুসিয়ামে) আশ্রম নেন ত্রয়োদশ টলেমী। যে পথিনাস ও একিলাসের সাথে ষড়যন্ত্র করে টলেমী ক্লিওপেট্রাকে উৎখাত করেছিল, তারাই বুদ্ধি দিয়ে টলেমীকে প্রাসাদে ফিরিয়ে আনেন। ওদিকে, ক্লিওপেট্রাও হারানো ক্ষমতা ফিরে পেতে ছিলেন বদ্ধপরিকর। পরের কাহিনী সবারই জানা: শিল্পী ও সাহিত্যিকরা যে বর্ণনায় আজও মুখর; একটি কার্পেটের ভেতর নিজেকে পেঁচিয়ে তিনি সিজারের সামনে হাজির হন এবং বয়স্ক সিজার বন্দী হন ২১-এর প্রণয়জালে।

সমন মোতাবেক, পরদিন, ক্লিওপেট্রা ও টলেমী দু’জনেই দরবারে হাজির হন। জুলিয়ার সিজারের চোখের দিকে তাকিয়েই টলেমী বুঝতে পারেন যে বোনের যৌবনজালে বন্দী হয়েছেন সিজার। তার পরাজয় অবধারিত। উপায়ন্তর না দেখে বন্ধুদের সাহায্য প্রার্থনা করেন টলেমী। পথিনাসের নেতৃত্বে বিশ হাজার সৈন্য যুদ্ধ শুরু করে। সুবিখ্যাত আলেক্সান্ড্রিয়া লাইব্রেরি পুড়িয়ে ফারো দ্বীপ ও লাইটহাউসের দখল নেন সিজার। পানির ওপর জোর যার, মরুভূমিতে তারই ক্ষমতা। টলেমীর পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিলেন জুলিয়াস সিজার। পরাজয় ঘটল টলেমীর।

এ-সময় বোন এরিসনেও ক্লিওপেট্রা ও সিজারের সাথে ছিল। কিন্তু লোভের ফাঁদে পা দিয়ে সিজারের শিবির থেকে পালিয়ে একিলাসের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করে এরিসনে। ভাগ্যের পরিহাস, যুদ্ধে পথিনাস ও একিলাস নিহত হয়। ত্রয়োদশ টলেমীকে হত্যা করা হয় নীলনদের পানিতে ডুবিয়ে, যখন সে সিজারের শিবির থেকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। বন্দী হয় এরিসনে।

টলেমীর মৃত্যুর কারণে ক্লিওপেট্রা মিসরের একক কর্তৃত্ব লাভ করেন। কিন্তু প্রথানুসারে, এগারো বছর বয়সী ছোটভাই চতুর্দশ টলেমীকে বিয়ে করে তাদের যৌথ-ফারাও ঘোষণা করা হয়। এই ফর্মালিটি মেনে নেন সিজার। তার দরকার ছিল মিসরের বিপুল সম্পদ এবং উপচে-পড়া খাদ্য সামগ্রী। নীল-নদের উজানে ডেনডেরা পর্যন্ত ক্লিওপেট্রার সাথে প্রমোদ ভ্রমণ করেন তিনি। নয় মাসের মাথায় পুত্র সন্তানের জনক হন জুলিয়াস সিজার। এটি প্রণয়ের স্বাভাবিক ফসল, নাকি ক্লিওপেট্রার পরিকল্পিত ঘটনাÑ আজও তা নিয়ে জল্পনার শেষ নেই। তবে, এই পুত্র-সন্তান রাজনৈতিক দিক থেকে ক্লিওপেট্রার দারুন কাজে লাগে। প্রথামাফিক, পুত্রের সাথে যৌথ রাজত্ব করায় যেহেতু আইনগত বাধা নেই, হোক সে দু’দিনের শিশু।

ছেচল্লিশের জুলাইতে সিজার রোমে প্রত্যাবর্তন করেন। তেরো বছরের সুশাসন এবং বহু যুদ্ধজয়ের পুরস্কার স্বরূপ রোমবাসী বিপুল সংবর্ধনা দেয় তাকে। বিরল এ সম্মান সিজারকে বিপথে পরিচালিত করে। রিপাবলিকের বদলে একনায়কতন্ত্রের প্রচলন করেন তিনি। নিজেকে আজীবন সম্রাটও ঘোষণা করেন। এই ক্ষমতার ভাগ নিতে দু:সাহসী ক্লিওপেট্রা রোমে গিয়ে হাজির হন এবং তার শিশুপুত্রকে নিজের বলে স্বীকার করে নিতে বাধ্য করান সিজারকে। টলেমী-সিজারের এই স্বীকৃতি সিনেটকে ক্ষিপ্ত করে। কারণ, রোম তখনো বহুবিবাহকে স্বীকার করত না এবং প্রকাশ্য-ব্যভিচারকেও ঘৃণা করত। ফলশ্রুতিতে, চুয়াল্লিশ খ্রিস্টপূর্বের পনেরোই মার্চ সকালে ব্রুটাস, ক্যাসিয়াস ও তাদের সমর্থক অন্যান্য সিনেটরদের হাতে প্রকাশ্য ফোরামে নিহত হন জুলিয়াস সিজার।

রোমে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ায় শিশুপুত্রকে নিয়ে আলেক্সে ফিরে আসেন ক্লিওপেট্রা। অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে নিহত হয় চতুর্দশ টলেমী। যুক্তি এবং ইতিহাস বিশ্লেষণে মনে হয়, এই হত্যাকান্ড ক্লিওপেট্রার দ্বারাই সংঘটিত হয়েছিল। চার বছর বয়সী শিশুপুত্র টলেমী-সিজারের সাথে যৌথভাবে নিজেকে মিসরের ফারাও ঘোষণা করেন তিনি এবং পুরোহিতদের দ্বারা বৈধ করিয়ে নেন এই অভিষেক।

প্লেগ ও দুর্ভিক্ষ ইতিমধ্যে মিসরকে দুর্বল করে ফেলেছিল। ক্লিওপেট্রার অনুপস্থিতিতে নীলের যতœ কমে যায় এবং পানির অভাবে কৃষি ব্যবস্থায় বিপর্যয় নামে। দৃঢ় মনোবল, কঠোর পরিশ্রম এবং প্রশাসনিক দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি এই বিপদের মোকাবিলা করেন। মিসর আবার উঠে দাঁড়ায়। এ-সময়, সিজারের রেখে যাওয়া দুই ব্রিগেড সৈন্যকে ক্লিওপেট্রা রোমে ফেরত পাঠান বিপর্যস্ত রাজধানীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। পথিমধ্যে, বিদ্রোহী সেনাপতি ক্যাসিয়াস এই সৈন্যদের হত্যা করে।

রোমের গৃহযুদ্ধ থেমে আসে। অক্টাভিয়ানের দিকে জয়ের পাল্লা ভারি হয়। সিজারের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ক্ষমতা লাভ করে নতুন ত্রিশক্তি: মার্ক এন্টনী, অক্টাভিয়ান ও লেপিডাস। তিন সেনাপতি রোমান সাম্রাজ্যকে তিনভাবে ভাগ করে শাসন করবেন বলে চুক্তি হয়। লেপিডাস পশ্চিম আফ্রিকা, স্পেন ও পশ্চিম ইউরোপের অধিকর্তা; এন্টনী গ্রিস, আর্মেনিয়া, আনাতোলিয়া, পার্থিয়া, সিরিয়া ও মিসরের এবং অক্টাভিয়ান রোমসহ কেন্দ্রেভর। সিজার উপাধিও থাকল অক্টাভিয়ানের; কারণ জুলিয়াসের উইলে উত্তরাধিকারী হিসেবে তারই নাম ছিল।

পরিস্থিতি শান্ত হবার পর মিসর সম্রাজ্ঞীকে ভূমধ্যসাগরের টরাসে দেখা করার নির্দেশ পাঠান পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপতি মার্ক এন্টনী।

নিজের দেশকে পুর্নগঠিত করার পাশাপাশি ক্লিওপেট্রা রোমান সাম্রাজ্যের গতিপ্রকৃতির উপরও তীক্ষè নজর রাখছিলেন। দূতের মাধ্যমে এন্টনী সম্পর্কে বিস্তারিত খবরাখবর সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। এন্টনী সাহসী বীর, কিন্তু ততটা তীক্ষèধী নন। তার চরিত্রের দুর্বলতা ছিল যে তিনি মদ্যপ, উচ্চাকাংক্ষী এবং নীল রক্তের আভিজাত্যে অহংকারী।

ক্লিওপেট্রা স্পষ্ট বুঝেছিলেন ক্রমবর্ধমান রোম সাম্রাজ্যের নজর মিসরে পড়বেই। স্বাধীনতা হারাবার চেয়ে দেশকে বাঁচাবার কৌশল অবলম্বন করাকেই শ্রেয় মনে করলেন তিনি। যদিও মিসর তখনো পূর্ব গৌরব ফিরে পায়নি, তবু ক্লিওপেট্রা নিজেকে শ্রেষ্ঠতম সজ্জায় সাজিয়ে এন্টনীর সামনে উপস্থিত হলেন এবং ইতিহাস মোড় নিল প্রেমোপখ্যানে...লিজ-টেলর অভিনীত ছবি ‘ক্লিওপেট্রা’য় যা দেখানো হয়েছে, ঐতিহাসিকদের বর্ণনা তার চেয়ে বহুগুণ সরেস: রূপার পাতে নৌকার গলুই মুড়ে, মুক্তা ও রতœরাজিতে পাল সাজিয়ে, আফ্রোদিতির সাজে আধশোয়া ক্লিওপেট্রা যখন মার্ক এন্টনীর নিকটবর্তী হলেন, বলাবাহুল্য, এন্টনী নিজেকে সংবরণ করতে পারেননি। ক্লিওপেট্রার রূপের চমক, বুদ্ধির ঝিলিক এবং যৌবনের প্রস্রবনে বর্ষীয়ান জুলিয়াস সিজারের চেয়ে অনেক বেশি দ্রবীভূত হলেন এন্টনী। শুরু হল মিশর-রোমের দ্বিতীয় প্রণয়-পর্ব।

পুরো একটি বছর তাদের এই প্রেম বহাল থাকল। বলা হয়, এন্টনী এ সময় ক্লিওপেট্রার দাসে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি যা চাইতেন, তাই হতো। মদ্যপ এন্টনী এক রাতের মদের দাম দিতে না পারায় সাইপ্রাস দান করে দিলেন ক্লিওপেট্রাকে। এন্টনীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিদ্রোহী বোন এরিসনকে হত্যা করিয়েছেন বলেও ক্লিওপেট্রার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিকদের অভিযোগ।

তবে প্রেম-প্রণয় যাই হোক, এন্টনী ও ক্লিওপেট্রা মিসরকে সুশাসনেই রেখেছিলেন।

দু’বছর পরে, খ্রিস্টপূর্ব চল্লিশের শীতকালে, মার্ক এন্টনী রোমে ফিরে গেলেন। পরবর্তী চার বছর দু’জনের একবারও দেখা হয়নি। ইতিমধ্যে এন্টনীর স্ত্রী ফুলভিয়ার সাথে অক্টাভিয়ানের জমিদারি সংক্রান্ত বিরোধ বাড়ে এবং ফুলভিয়া গ্রিসে বসে বিদ্রোহ করেন। রোমান ইতিহাসে কোন নারীর বিদ্রোহ এটাই প্রথম।

এন্টনী এই বিরোধ মেটাতে ব্যর্থ হন। তিন বছর পর ফুলভিয়া গ্রিসেই প্রাণত্যাগ করে। অভিযোগ আছে, বিষ প্রয়োগে তাকে হত্যা করেন অক্টাভিয়ান। এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের বিবাদ এড়াবার জন্য অক্টাভিয়ান নিজের বিধবা বোন অক্টাভিয়াকে এন্টনীর সাথে বিয়ে দেন। এটাই ছিল তখনকার শান্তি প্রক্রিয়ার রীতি!

আগের পক্ষের তিন পুত্রসহ সুন্দরী অক্টাভিয়া মার্ক এন্টনীর নতুন সঙ্গী হন। তদ্দিনে ক্লিওপেট্রা দুই জমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছে। এদিকে, অক্টাভিয়ার গর্ভে এন্টনীর এক কন্যা জন্মায়। ঐতিহাসিকরা বলেন, যদি অক্টাভিয়া মার্ক এন্টনীকে পুত্র সন্তান উপহার দিতে পারতেন, ইতিহাস হয়ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হত। পুত্র না হওয়ায় এন্টনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন অক্টাভিয়ার প্রতি।

অন্যদিকে, ক্রমাগত রাজনৈতিক বিপর্যয়ে রোমের অর্থনৈতিক অবস্থা এত খারাপ অবস্থায় পৌঁছে যে টাকার মূল্যমান তিনশো ভাগ হ্রাস পায়। রাজকোষ বৃদ্ধির স্বার্থে এন্টনীকে আবার ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে হয় সিরিয়া ও পার্থিয়ানদের কাছ থেকে বর্ধিত কর আদায় করতে।

পরের বছরও অক্টাভিয়া আবার একটি মেয়ের জন্ম দেন। ফলে, স্ত্রীর প্রতি এন্টনীর আগ্রহে চূড়ান্ত ভাটা পড়ে। পূবের-পথে কর্সিকা দ্বীপ পর্যন্ত সঙ্গ দেবার পর অক্টাভিয়াকে জোর করে রোমে ফেরত পাঠিয়ে পুনর্বার ক্লিওপেট্রার বাহুডোরে নিজেকে সঁপে দেন এন্টনী। রোমান ঐতিহ্যকে পুরোপুরি অবমাননা করে পুত্র আলেক্সান্ডার হেলিয়স এবং কন্যা ক্লিওপেট্রা সেলেনকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেন। ক্লিওপেট্রাকে উপহার দেন সাইপ্রাস, সিসিলি, ফিনিশিয়া, পশ্চিম-সিরিয়া, জুডিয়া এবং আরব উপদ্বীপ। নৌবহর নির্মাণেরও অনুমতি দেয়া হয় মিসরকে।

রোমের বিরাগভাজন হওয়া সত্ত্বেও এন্টনী ছিলেন সুখী। কারণ, ক্লিওপেট্রা তাকে আরেকটি পুত্র উপহার দিয়েছে। তিনি পুত্রের নাম রাখেন টলেমী ফিলাডেলফোস।

পার্থিয়ানদের সাথে দ্বিতীয় যুদ্ধে পরাজিত-এন্টনী ও ক্লিওপেট্রা যখন সিরিয়া হয়ে মিসরে ফিরে যাচ্ছেন, আকুল অক্টাভিয়া তখন নতুন সৈন্য ও সরবরাহ নিয়ে এথেন্সের উপকূলে স্বামীর জন্য অপেক্ষমাণ। তিনি তখনো জানেন না যে এন্টনী তার প্রতি সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

ওদিকে তার ভাই, সিজার অক্টাভিয়ান, এই অসম্মানের প্রতিশোধ নিতে এন্টনীকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে আহবান করলেন। অন্যথায়, এন্টনীকে সিনেটের সামনে ক্ষমা চাইতে হবে। কিন্তু এন্টনী তখন শৌর্যে-বীর্যে সে এতটাই আত্মমগ্ন যে এসব হুমকিকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলেন না। অধিকন্তু পূর্ব-সাম্রাজ্যের রানী নীল-দুহিতা ক্লিওপেট্রার প্রেমে বিভোর তিনি।

তার আত্মম্ভরিতার কারণও ছিল। যুদ্ধে এখনো তিনি প্রায় অপরাজেয়। পার্থিয়ার পরাজয়ে দমে না গিয়ে এন্টনী আর্মেনিয়া আক্রমণ করে বিপুলভাবে জয়ী হয়েছেন। এই যুদ্ধের বিজয় উৎসব হল আলেক্সান্ড্রিয়ায় এবং সেই প্যারেডে এন্টনীর পাশে দেবী আইসীসরূপী ক্লিওপেট্রাকে বিজয়িনীর ভূমিকায় দেখা যায়। এন্টনী নিজেকে ডায়েনিসাস (সর্বাধিনায়ক) হিসেবে ঘোষণা করেন। পুরোহিতরা আরও এককাঠি অগ্রসর হয়ে টলেমী সিজারিয়ানকে ‘রাজাদের রাজা’, ক্লিওপেট্রাকে ‘রাজাদের রানী’, হেলিওসকে ‘সেলসিডের সম্রাট’, সেলেনকে ‘সাইরেনিকার রানী’ এবং সর্ব কনিষ্ঠ টলেমী ফিলাডেলফোসকে ‘সিরিয়া এবং এশিয়া মাইনরের সম্রাট’ খেতাব প্রদান করে (যখন ফিলাডেলফোসের বয়স মাত্র দুুই)। ক্লিওপেট্রা হয়ত বিশ্বসম্রাজ্ঞী হবার স্বপ্ন দেখা থেকেই এসব করিয়েছিলেন। কারণ, তার একটি উক্তি রোমান দম্ভের চেয়েও জোরালো হয়ে ইতিহাসের কুঠুরীতে আজো প্রতিধ্বনি তোলে, ‘নিশ্চয়ই সেদিন সমাগত, যেদিন রোমবাসী আমাকে তাকিয়ে দেখতে বাধ্য হবে।’

এসব দাম্ভিকতা রোমান সিনেটের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে অক্টাভিয়ানকে একক সম্রাট হবার সুযোগ করে দেয়। এন্টনী অক্টাভিয়াকে তালাক দিলে ঘটনার চরম অবনতি ঘটে। আশ্চর্যের বিষয়, স্বামীর এতসব বিচ্যুতির পরেও অক্টাভিয়া এন্টনীর প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন। এমনকি, স্বামীর বিরুদ্ধাচারণ করে একবারও তিনি সিনেটরদের প্রভাবিত করেননি। কিন্তু অক্টাভিয়ান এই সুযোগ নষ্ঠ হতে দেননি।

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার জন্য সিনেট ডাকা হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার, সিনেটে যুদ্ধ ঘোষণা করা হল এন্টনীর বিরুদ্ধে নয়, মিসরের বিরুদ্ধে। সবচেয়ে কুৎসিত বিশেষণে ক্লিওপেট্রাকে অভিযুক্ত করে কি করে এই প্রস্তাব রোমান সিনেটে পাস করেছিল, আজও তা ঐতিহাসিকদের কাছে বিস্ময়। গল, আফ্রিকা, সিসিলি এবং সার্দিনিয়ার রাজারাও পক্ষ নিয়েছিল অক্টাভিয়ানের। রাজনৈতিক প্রচারণা ছিল ভয়ংকর বিদ্বেষী: এ হল প্রাচ্যের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের অভিযান। কিংবা, এ যুদ্ধ এক ভ্রষ্টা নারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এমন স্লোগানও উসকে দেয়া হয়েছিল যে, বর্বর সেমেটিকদের বিরুদ্ধে সভ্য রিপাবলিকের শক্তি পরীক্ষার যুদ্ধ এটি।

সত্তর হাজার পদাতিক, বারো হাজার অশ্বারোহী এবং চারশো যুদ্ধজাহাজে সজ্জিত রোমান বাহিনীর বিরুদ্ধে এন্টনীর শক্তি কিন্তু মোটেই কম ছিল না। পঁচাত্তর হাজার পদাতিক, বারো হাজার ঘোড়সওয়ার, পাঁচশো যুদ্ধ জাহাজ এবং অতিরিক্ত পঁচিশ হাজার রিজার্ভ বাহিনীর কমান্ড ছিল তার অধীনে। আশ্চর্যের বিষয়, যে মিশর কোনদিন কোন নৌ-যুদ্ধে অংশ নিয়নি, তারাও দুশো রণতরী সজ্জিত করে। নৌ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং ক্লিওপেট্রা। তার মণিমুক্তাখচিত রাজকীয় শিপের নাম দেয়া হয়েছিল ‘এন্টনীয়’। যার চারপাশে গার্ড দিচ্ছিল ষাটটি ইজিপশিয়ান মিড-শিপ।

গ্রিসের দক্ষিণ উপকূল এপিরাসে দুই বাহিনী প্রথম মুখোমুখি হয়। অক্টাভিয়ান জানতেন, শঠতা ছাড়া তিনি জিততে পারবেন না। সুদক্ষ জেনারেল এগ্রিপ্পাকে দিয়ে প্রথমেই তাই তিনি চারপাশের দ্বীপগুলো দখল করে মিসর বাহিনীর পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেন। এন্টনী ও ক্লিওপেট্রা ঘেরবন্দি হন। তবুও তাদের বিশাল বাহিনী বিপদে পড়ত না, যদি বিশ্বস্ত সেনাপতিদের তিনজন, বিশেষত জেনারেল ডেলিয়াস, বিশ্বাসঘাতকতা করে এন্টনীর যুদ্ধ-পরিকল্পনা অক্টাভিয়ানের কাছে ফাঁস করে না দিতেন।

চার দিন পর, অ্যাকটিয়ামে, শক্রর বেষ্টনী ভেঙে বেরিয়ে যাবার জন্য এন্টনী ও ক্লিওপেট্রা তাদের মালবাহী জাহাজের মধ্যে বিশাল পঞ্চাশটি এবং ক্ষুদ্র দুশোটিতে আগুন লাগিয়ে দিলেন। পিছিয়ে যেতে বাধ্য হল অক্টাভিয়ান। সেই সুযোগে ক্লিওপেট্রার শিপ বেষ্টনী ভেদ করে সাগরে বেরিয়ে গেল।

কিন্তু নিয়তী ছিল বিরূপ। জেনারেল ডেলিয়াসের বিশ্বাসঘাতক চর, আরও একজন মুখোশধারী সেনাপতি, এন্টনীকে বোঝালেন যে ক্লিওপেট্রা এন্টনীকে একা ফেলে তার নৌবহর নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। বিভ্রান্ত এন্টনী ভাবলেন, তার পরাজয় ঘটেছে। এস্কেপ-শিপে করে তিনিও ক্লিওপেট্রাকে অনুসরণ করলেন। নেতৃত্বহীন মাঠে একশো বাইশটি বিশাল জাহাজ রোমানদের হাতে ধ্বংস হল।

এই পরাজয়ের বিশ্লেষণে যদিও রোমানরা ক্লিওপেট্রার পশ্চাদপসরণকেই দোষ দেয়, কিন্তু এদ্দিন পর আজ আর নিশ্চিত করে বলা যায় না যে পরাজয়ের পেছনে সেটাই একমাত্র কারণ ছিল। যাই হোক, পিছু ধাওয়া করে অক্টাভিয়ান মিসর উপকূল পর্যন্ত পৌঁছান। এন্টনী ও ক্লিওপেট্রা পুনর্বার তাদেও বাহিনীকে পুনর্গঠিত করেন আলেক্সান্ড্রিয়ায়। কিন্তু সেখানেও বিশ্বাসঘাতকতা। মিসরীয় বাহিনীর সাথে একত্রে যুদ্ধ করতে রোমান সেনারা নারাজ। দ্বিধাবিভক্ত বাহিনীর কমান্ডার দ্বিতীয়বারও পরাজিত হলেন। হতাশা, মাদকাশক্তি এবং আত্মগ্লানির শেষ পর্যায়ে ভুল সংবাদে প্রতারিত এন্টনী নিজের তরবারিতে আত্মহত্যার চেষ্টা চালালেন। ক্লিওপেট্রা দ্রুত তাকে নিজের সুরক্ষিত ভবনে স্থানান্তর করলেন। প্রিয়ার বাহুতে মাথা রেখেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন রোমান ইতিহাসের অন্যতম দুর্ধর্ষ সেনাপতি মার্ক এন্টনী।

বিধ্বস্ত ও শোকাভিভূত ক্লিওপেট্রা অক্টাভিয়ানের সমস্ত লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জানালেন, কেবলমাত্র টলেমী-সিজারিয়ানকে মিসরের বৈধ সম্রাট ঘোষণা করলেই দু’পক্ষের আলোচনা সম্ভব। কৌশলী অক্টাভিয়ান আলোচনার নামে কালক্ষেপণ শুরু করেন। ইতিমধ্যে এন্টনীকে সমাহিত করা হয় সেরাপিয়নের পাশে। ক্লিওপেট্রা জানতেন, তাকে ক্রীতদাসী হিসেবে রোমের বিজয়-প্যারেডে দেখাতে চাইবে অক্টাভিয়ান। সুতরাং তিনি বেছে নিলেন এমন পথ, পাঠক মাত্রেই জানেন- হাসিমুখে সাপের কামড়ে, আত্মাহুতি দিলেন মিশরের শেষ ফারাও; কিন্তু অক্টাভিয়ানের দম্ভের কাছে মাথা নত করলেন না।

ক্ষিপ্ত ও প্রতারিত অক্টাভিয়ান এসে দেখলেন, রাজদন্ড ও জীবনদন্ড হাতে রানীর পরিপূর্ণ মর্যাদায় এমন প্রশান্তভাবে শুয়ে আছেন রানী ক্লিওপেট্রা, যে-মৃত্যুর সামনে জীবনের সব দম্ভই ম্লান হয়ে যায়। তিরিশ খ্রিস্টাপূর্বাব্দের বারোই আগস্ট, ক্লিওপেট্রার বয়স যখন মাত্র উনচল্লিশ, তখন এই করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয়।

পরের কাহিনী সংক্ষিপ্ত। পুরস্কারের লোভে টলেমী-সিজারিয়ানকে অক্টাভিয়ানের হাতে ধরিয়ে দেয় তারই গৃহশিক্ষক। অক্টাভিয়ান দু’জনেরই শিরোñেদ করেন। বাকি তিন সন্তানকে বন্দী হিসেবে রোমে নিয়ে যাওয়া হয়। দুটো ছেলেকেই কৌশলে হত্যা করেন তিনি। ভাইয়ের রোষ থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে সেলেনকে বড় করেন এন্টনী-পতœী অক্টাভিয়া এবং বিয়ে দেন এক অভিজাত রোমানের সঙ্গে। নারী চরিত্রের দুর্জ্ঞেয় রহস্যের মত তার এ আচরণেরও কোন ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু ভাই অক্টাভিয়ান কৌশলে দু’জনকেই অগ্নিকান্ডে পুড়িয়ে মারেন বোনকে বুঝতে না দিয়েই। ক্ষমতার নিরংকুশ বিজয়ী অক্টাভিয়ান নতুন নাম অগাস্টাস নিয়ে তদ্দিনে রোমের দ্বিতীয় ‘জুলিয়াস সিজার’ হয়ে উঠেছেন।

প্রাচীনকাল থেকেই মিসরীয়রা বিশ্বাস করত, সাপের বিষে মৃত্যু জীবনকে অমরতা দেয়। রানী ক্লিওপেট্রা তাদের সেই বিশ্বাসকেই স্থায়ী করে গেছেন। মৃত্যু তাকে নিঃশেষ করে দেয়নি। আজও তিনি সেই ভাগ্যবতী, যার চর্চা হয় সাহিত্য-চলচিত্র-সঙ্গীত-চিত্রকলা সর্বত্র। যে সভ্যতা পিরামিডের রহস্য নিয়ে চার হাজার বছর জাগরুক, তার সমাপ্তি ঘটেছে এমন এক অসামান্য নারীর রহস্যে, যার চরিত্র-চিত্রন অনাদিকাল ধরে চলতে থাকবে। নয়টি ভাষায় পারদর্শী, ইউক্লিডের জ্যামিতি ও জ্যোতির্বিদ্যায় সুপন্ডিত এই নারীর খ্যাতির তুলনা চলে শুধুমাত্র হেলেন-অব-ট্রয়ের সঙ্গে। প্রশাসনে দক্ষ, কৃষি উৎপাদনে বিশেষজ্ঞ এবং কূটনীতিতে পারদর্শী এই কৃঞ্চকলি প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং যুদ্ধবিগ্রহের মাঝেও নিজের দেশকে এতটা সমৃদ্ধ করেছিলেন যে পরবর্তী পঞ্চাশ বছর রোম তার নিঃস্ব রাজভান্ডার পূর্ণ করেছে মিসরের সম্পদ লুট করে। যে স্বাধীনতার জন্য তিনি লড়েছিলেন, তা তিনি রক্ষা করতে পারেননি, এমনকি নিজেকে উজাড় করে দিয়েও; কিন্তু ইতিহাস তাকে ব্যর্থ-শাসক বলে চিহ্নিত করেনি। যদিও দাম্ভিক পশ্চিম তার চরিত্রচিত্রন করে মিথ্যা-কলংকের রঙে রঞ্জিত কওে কিন্তু এই সত্য কেউই অস্বীকার করার সাহস রাকে না যে ক্লিওপেট্রার মৃত্যুতে মিসরের যে পরাধীনতা শুরু হয়, তার গ্লানি সে-দেশকে বইতে হয়েছে পরবর্তী দু’হাজার বছর। (নীল যমুনার জল/ঐতিহ্য/২০১৩)।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে নভেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:২৭

যুলকারনাইন বলেছেন: পোস্টে প্লাস।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.