নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার সম্পর্কে: https://t.ly/atJCp এছাড়া, বইটই-এ: https://boitoi.com.bd/author/2548/&

দারাশিকো

লেখালিখির প্রতি ভালোবাসা থেকে লিখি

দারাশিকো › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প: ভদ্রতার খাতিরে

০৫ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ১০:২৪



আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিমুল সদ্য বিয়ে করে ছোট্ট বাসায় সংসার পেতেছে। কদিন আগে আমরা দশ-বারোজন বন্ধু-বান্ধব সদলবলে তার বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। মুরগির রোস্ট-গরু-পোলাও দিয়ে পেট ভরে খাওয়ানোর পর বন্ধু-পত্নী সবাইকে ছোট ছোট বাটিতে করে রসমালাই খেতে দিয়েছে। নতুন সংসারে চা চামচ বোধহয় বেশী নেই, একটা বাটিতে কাটা চামচ দিয়েছে রসমালাই খাওয়ার জন্য, সেটা আবার আমার ভাগেই পড়ল।

কাটাচামচ দিয়ে রসমালাইয়ের ডিমগুলো খাওয়া সহজ, কিন্তু মালাই খাবো কিভাবে? নতুন সংসার দেখার উছিলায় আমি হাতে মিষ্টির বাটি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। ঘরের এক কোনায় রাখা বুকশেলফের বই দেখতে দেখতে চট করে একবার আশেপাশে দেখে নিয়ে সুৎ করে টান দিয়ে মালাইটুকু খেয়ে ফেললাম। জিহবা দিয়ে বাটিতে লেগে থাকা মালাই চেটে নিয়ে পেটে চালান করে দিয়ে তাকিয়ে দেখি - শিমুলের নববধূ রান্নাঘরের দরজা থেকে আমার দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে!

লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার দশা। ভদ্রতা বজায় রেখে মিষ্টির বাটি রেখে দিলেই হতো। আসলে ভদ্রতার খাতিরে আমাদের কত কিছুই না করা লাগে। চারজনকে পাঁচটি মিষ্টি খেতে দিলে ভদ্রতার খাতিরে একটি মিষ্টি রেখে দিতে হয়। চায়ের কাপে রাখতে হয় তলানী। ভদ্রতার খাতিরে খেতেও হয়, আবার মুখ বন্ধও করা লাগে কখনও কখনও। ভদ্রতা নিয়ে সেই কৌতুকটার কথা আরেকবার বলা যাক।

ছোট্ট খোকনকে তার আম্মু শিখিয়েছে - মেহমান হয়ে কোথাও গেলে যদি বিস্কুট খেতে দেয়, তাহলে সব খাওয়া যাবে না, একটি বিস্কুট রেখে দিতে হবে। কেন? কারণ, এটা ভদ্রতা। কিছুদিন পরে খোকনদের বাসায় বাসায় মেহমানকে এসেছে। তাকে চা-বিস্কুট খেতে দেয়া হয়েছে। মেহমান যখন শেষ বিস্কুটটি হাতে নিয়েছে তখনই ছোট্ট খোকন চিৎকার করে বলল, আম্মু! আম্মু! আন্টি ভদ্রতা খেয়ে ফেলল কিন্তু।

ভদ্রতা করে খাওয়া বন্ধ করার গল্প বললাম, মুখ বন্ধ করার গল্পটা বলি। অফিসের বড় কর্তার রুমে বেশ গালগপ্প চলছে, আমিও আছি। গল্পে গল্পে কর্তা বললেন, আমি নিশ্চিত গৌতম বুদ্ধকে তার বউ বাচ্চার পটি পরিস্কার করতে দিয়েছিল, এই শোকেই তিনি সংসারত্যাগী হয়েছিলেন। কর্তার এই কথায় সবাই হা হা করে তৈলাক্ত হাসি হাসতে শুরু করলেও আমি হাসতে পারলাম না। গৌতম বুদ্ধের মত একজন ধর্মগুরুকে নিয়ে হাস্যরস করা যে শিষ্টাচার বহির্ভূত, সেটা বলার জন্য মুখ খুলেও বন্ধ করে ফেললাম। কেন? সেই ভদ্রতার খাতিরেই।

আমাদের আরেক বন্ধু রাব্বী একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শক পদে চাকরী করে। পরিদর্শনের কাজে যেখানেই যায়, সেখান থেকেই নগদ টাকা-পয়সা ছাড়াও নানা রকম গিফট পায়। রাব্বীও দিলদরিয়া লোক, আশেপাশের মানুষের মধ্যে গিফট বিলিয়ে দেয়। সেদিন আমাকে ডেকে নিয়ে এক পিস স্যুটের কাপড় দিল।

'হঠাৎ স্যুটের কাপড় দিচ্ছিস যে?’
'এক ক্লায়েন্ট গিফট দিল। শুধু কাপড় দিলে হয়, বল? স্যুট বানাতে মিনিমাম দশ হাজার টাকা লাগে, সেটা না দিলে স্যুট বানাবো কিভাবে?' - রাব্বী বেশ উদাস গলায় বলল।
'চাইলেই পারতিস।'
'ভদ্রতার খাতিরে চাইতে পারলাম না দোস্ত। আমার আবার এইসব চাইতে ইয়ে লাগে।'
'আমার কিন্তু ইয়ে ফিয়ে নাই। স্যুট বানানোর টাকা নাহয় কদিন পরেই দিস। তদ্দিন কাপড়টা আলমারিতে তুলে রাখলাম।'
বেচারা রাব্বী। সে ভদ্রতার খাতিরে আমাকেও 'না' বলতে পারলো না। মাসখানেক পরে বিকাশ করে স্যুট বানানোর টাকা পাঠিয়ে দিল।

শান্তনুর ঘটনাটা বলে এই নিবন্ধ শেষ করি।

শান্তনু একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরী করে। পোস্টিং ফেনীর বসুরহাটে। শুক্র-শনিবারে একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে আসে। আমিও সেখানে ক্লাস করি, আর এভাবেই শান্তনুর সাথে পরিচয়। শান্তনু খুব লাজুক ছেলে। এই বয়সেও ক্লাসের স্যার-ম্যাডামদের সাথে মুখ ফুটে কথা বলতে পারে না, প্রেজেন্টেশনের সময় ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে যায়।

আমাদের দুই বছরের কোর্স শেষ হবার শেষের দিকে একটা ঘটনা ঘটে গেল। রাতের ট্রেনে চেপে ঢাকায় ফিরছিল সে। ভোরের দিকে সহযাত্রীর অনুরোধে একটি মাত্র বিস্কুট খেয়েছিল, তারপর টানা আঠারো ঘন্টার ঘুম। এর মাঝে রেল পুলিশ তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছে দিয়েছে, সেখানে তার পেট ওয়াশ করা হয়েছে। পরের সপ্তাহ থেকে শান্তনু আবার ক্লাসে আসতে শুরু করল।

দেখা গেল, বিস্কুট খাওয়ার আগের শান্তনু আর পরের শান্তনুর মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক। আমাদের লাজুক, মুখচোরা সেই শান্তনুকে রিপ্লেস করে বেজায় উৎফুল্ল এক শান্তনু আমাদের সাথে ক্লাস করতে লাগল। নতুন শান্তনু অল্পতেই হো হো করে হাসে, কোর্স টিচারের সস্তা কৌতুকে রীতিমতো টেবিল চাপড়ায়। তার সেই লাজ সঙ্কোচ কোথায় যে হারালো কে জানে। তার সুপার এ্যাকটিভ রোল দেখে মাঝেমধ্যে আমরাই বিব্রত হয়ে যাই। একদিন তো অল্পবয়সী কোর্স টিচারকে সবার সামনেই 'ম্যাডাম আপনাকে আজকে খুব সুন্দর লাগছে' বলে ফেলল। ম্যাডাম না শোনার ভান করলেও মুখের লজ্জা রাঙ্গা ভাব লুকাতে পারলো না।

কোর্স শেষ হয়ে গেলে যে যার জায়গায় ফিরে গেল। মাস তিনেক পরে আমি একদিন ফোন দিলাম।
'শান্তনু, আমি নাজমুল। কেমন আছেন?’
'ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?'
'শান্তনু, আমাকে চিনতে পেরেছেন তো? আপনার সাথে কোর্স করলাম কিছুদিন আগে।'
'ও নাজমুল! এবার চিনতে পেরেছি। কি খবর তোমার?'
'আমাকে এখনও চিনেন নাই মনে হচ্ছে। আপনি তো আমাকে তুমি করে বলতেন না।'
'মনে করতে একটু কষ্ট হচ্ছিল রে। এখন তোকে ঠিক চিনতে পারছি। তুই নাজমুল না? এক সাথে কোর্স করলাম... '

আমি মনের দুঃখে অল্প কথায় শেষ করলাম। শান্তনু আমাকে 'তুই' করে বলেছে এজন্য দুঃখ পাইনি। সে আসলে আমাকে চিনতে পারেনি। খুব রাগও হচ্ছিল। ভদ্রতার খাতিরে বিস্কুটটা না খেলে শান্তনুটাও আগের মতো থাকতো।

সব দোষ ভদ্রতার।

দারাশিকো'র ব্লগ ।। বইটই অ্যাপ-এ

মন্তব্য ১৮ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১৮) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ১১:০১

ওমেরা বলেছেন: আপনার লিখাটা পড়ে ছোট বেলার একটা ঘটনা মনে পড়ল । আমার ভাইয়া ও দুই কাজিনের সাথে একবার কোন একটা বাসায় গিয়েছিলাম । তাদের চেয়ে আমি অনেক ছোট । আমাদের সবাইকে দুইটা করে মিষ্টি দিয়েছে । আমার ভাইয়া ও এক কাজিন একটা করে মিষ্টি খেয়েছে , আরেক কাজিন দুটোই খেয়েছে সে আমার একটা মিষ্টি নিয়ে থেকে তার প্লেটে রেখে বলে, না হলে আমাকে অভদ্র বলবে , আমি আমার প্লেট থেকে বাকী মিষ্টিটা তুলে তার প্লেটে রেখে বলি এখন তোমাকে অনেক বেশী ভদ্র বলবে তাই না ভাইয়া ? সে, আরে না এটাও অভদ্রতা বলে সে আরো একটা মিষ্টি খেয়ে ফেলে ।

ধন্যবাদ আপনাকে।

০৬ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ৮:১০

দারাশিকো বলেছেন: হা হা হা। আপনার ঘটনা পড়ে বেশ মজা পেয়েছি। চমৎকার।

ভালো থাকবেন।

২| ০৫ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ১১:২৯

কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: ভাইরে এই ভদ্রতাই খাইলো! বিয়ের পর স্ত্রীর এক খালার বাসায় গেছি। নতুন জামাই সবাই আপ্যায়নের ত্রুটি করছে না। ঝামেলা পাকালো স্ত্রীর বড় খালাতো বোন। তিনি সম্প্রতি রান্না বান্না শিখেছেন। উনার একটি স্পেশাল আইটেম হলো গিয়ে ডাবের পানির পুডিং। জিনিসটা সামনে আনার পর আমি ভদ্রস্থ কোন উপমা পাচ্ছিলাম না তুলনা করার জন্য। আমি স্ত্রীকে ডেকে ফিস ফিস করে বললাম, আপু কি ডিম চিনেন না?
স্ত্রী বললেন, ডিম চিনবেন না কেন?
তাহলে ডিমের বদলে ডাব দিয়ে পুডিং বানিয়েছেন কেন?

স্ত্রী বলল, প্লীজ একটু কষ্ট করে চেখে দেখো।
আমি বললাম অসম্ভব! এই সব অখাদ্য খাওয়া মানে হচ্ছে উনাকে লাই দেয়া। আমাকে যদি খেতে দাও, আমি প্রজিম বমি করে সিন ক্রিয়েট করব।

স্ত্রী আমাকে চিনেন। অল্প যে বিষয়গুলো নিয়ে আমি মিথ্যা বলি না তার মধ্যে খাবার আর দেখতে কেমন লাগছে এই দুইটা বিষয় অন্যতম। ফলে তিনি ভদ্রতা রক্ষার কবল থেকে আমাকে রক্ষা করেছিলেন।

০৬ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ৮:১৩

দারাশিকো বলেছেন: আপনার ঘটনা তো ক্লাইমেক্সে পৌছেঁ ঠান্ডা হয়ে গেলো! টারান্টিনো হলে নির্ঘাৎ বমির সিন ক্রিয়েট করে দেখোতো!

৩| ০৬ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ১২:০৮

রাজীব নুর বলেছেন: শিরোনাম যথাযথ হয়েছে।

০৬ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ৮:১৪

দারাশিকো বলেছেন: ধন্যবাদ রাজীব নুর।

৪| ০৬ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ১২:১৪

আমি সাজিদ বলেছেন: শান্তনু ভদ্রতার খাতিরে বিস্কুটটা খেয়ে এত পরিবর্তন হয়ে গেল!

চমৎকার লেখা। প্লাস।

০৬ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ৮:১৬

দারাশিকো বলেছেন: ধন্যবাদ সাজিদ। ভালো থাকবেন।

৫| ০৬ ই নভেম্বর, ২০২০ সকাল ৮:২১

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেছেন:

আসলেই বিরাট ব্যাপার।
ভদ্রতা করে প্লেটে খাবার রেখে দেয়া।


তবে রেখে দেয়া খাবার তো হোস্টকে শেষ পর্যন্ত ফেলে দিতে হবে। তার চেয়ে গেস্ট যদি খেয়ে ফেলে সেটাই তো বেশী ভালো।

খাবার অপচয় করা মহা অন্যায়।

০৬ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ৮:১৭

দারাশিকো বলেছেন: মনে হচ্ছে গল্পটা আপনি পড়েন নাই :(

তবে, আপনার মন্তব্যের সাথে কোন দ্বিমত নাই।

৬| ০৬ ই নভেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:৪৮

নেওয়াজ আলি বলেছেন: চমৎকার এবং মুগ্ধকর লেখা।

০৬ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ৮:১৮

দারাশিকো বলেছেন: আন্তরিক ধন্যবাদ নেওয়াজ আলি।

৭| ০৬ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ৯:৪২

রাজীব নুর বলেছেন: অনেক দি মুভি নিয়ে পোষ্ট দিছেন না।

০৬ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ১১:২২

দারাশিকো বলেছেন: মুভি নিয়ে তো অনেক পোস্ট দিলাম, এবার অন্য বিষয় নিয়ে কিছুদিন পোস্ট দেই। সারাজীবন কি ভিলেন চরিত্রেই অভিনয় করতে হবে?

৮| ০৬ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ১১:৩৮

নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:

আমি আবার ভদ্রতার বাহুল্য করিনা।
যেটাতে মজা পাই তার শেষটাও ছাড়িনা।

০৭ ই নভেম্বর, ২০২০ সকাল ৮:১৫

দারাশিকো বলেছেন: এটাও ভালো।

৯| ১০ ই আগস্ট, ২০২২ সকাল ৮:২৮

শেরজা তপন বলেছেন: কি ব্যাপার ভাই দারাশিকো- হারিয়ে গেলেন কেন??

০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ রাত ৮:২৯

দারাশিকো বলেছেন: হারাই নাই, আসা যাওয়ার মাঝে আছি। এটাই জীবন! আছেন ভালো?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.