নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

দেওয়ান তানভীর আহমেদ

দেওয়ান তানভীর আহমেদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

অশরীরী

২৬ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ২:১১


হইচইয়ের শব্দ শুনে চোখ মেললো রবি। চোখ মেলতেই প্রচণ্ড বিরক্ত হল নিজের চারপাশের বিশাল জটলা দেখে। অসংখ্য লোকজন তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার দিকে, যেন সে একটা চিড়িয়াখানার জন্তু!
মানুষগুলোর মুখ এরকম ছাইয়ের মত ফ্যাকাসে কেন হয়ে আছে রবি বুঝতে পারল না। সে প্রচণ্ড বিরক্তির সাথে শোয়া অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ালো, তারপর ভিড়ের ফাক গলে বেরিয়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে দ্রুতগতিতে হাটা ধরল। ততক্ষণ পর্যন্ত হাটলো যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষগুলোর হইচইয়ের শব্দ মিলিয়ে গেল। তারপর আবার আরাম করে শুয়ে পড়ল রেললাইনের ওপর। এখন শুধু একটা ট্রেন আসার অপেক্ষা।
ট্রেনের নিচে কাঁটা পড়ে আত্মহত্যা করার উদ্দেশ্যে এখানে এসেছিলো রবি। রেললাইনের ওপর শুয়ে ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে কখন যে চোখ লেগে এসেছিলো সে টেরই পায় নি। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে নিজেও জানে না। ঘুমের মধ্যেই ট্রেন তার ওপর দিয়ে চলে যেত, সে টেরও পেত না। পুরো ব্যাপারটাই খুব শান্তিপূর্ণভাবে মিটে যেত, যদি না ঐ লোকগুলো তাকে ঘিরে চেঁচামেচি শুরু করে তার ঘুম ভাঙিয়ে দিত! রবি খেয়াল করল তার কানের হেডফোনটা নেই। শুধু তাই না, পকেটে তার সেলফোনটাও নেই। নির্ঘাত ঐ লোকগুলোর মধ্য থেকেই কেউ মেরে দিয়েছে!
“যাক গে! মরার পর ওসব আমার আর কোন কাজে আসবে?!” আপনমনে কথাগুলো বলে আবার চোখ মুদলো রবি। কিন্তু কিছুক্ষণ না যেতেই একটা মেয়ের বিকট চিৎকার শুনে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো সে।
“খবরদার আমার পেছন পেছন আসবেন না!”
রবি তাকিয়ে দেখলো, রেললাইন থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে তারই বয়সী একটা মেয়ে আঙুল উচিয়ে একজন লোককে শাসাচ্ছে। লোকটির বেশভূষা খুবই অদ্ভূত! তার পরনে পুরনো আমলের অসংখ্য ফুটকিওয়ালা একটা সাদা শার্ট আর ধূসর রঙের বেলবটম প্যান্ট। দুই হাজার আঠারো সালে এরকম পোশাক দেখে যারপরনাই অবাক হল রবি। মেয়েটির ধমক খেয়ে লোকটি মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “তুমি ছাড়া আর কে আমাদের সাহায্য করবে বলো? আমরা কার কাছে যাব?!”
“আপনারা কার কাছে যাবেন সেটা আমি কি জানি?” মেয়েটা মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, “সেই ছোটবেলা থেকে আমি আপনাদের এই অত্যাচার সহ্য করে আসছি, আমার জীবনটাকে নরক বানিয়ে ছেড়েছেন আপনারা! অনেক সহ্য করেছি, আর না!”
লোকটি এবারে কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে বলল, “তুমি ছাড়া আমাদেরকে সাহায্য করার মত আর কেউ নেই বলেই তো আমরা তোমার কাছে আসি। আমাদের তো যাওয়ার মত আর কোনো জায়গা নেই। তুমিও যদি মারা যাও, তাহলে আমরা কার কাছে গিয়ে হাত পাতব?”
“এজন্যেই তো এসেছি আত্মহত্যা করতে!” মেয়েটি দাঁতমুখ খিচিয়ে বলল, “বেঁচে থাকতে যেহেতু আপনারা শান্তিতে থাকতে দেবেন না, তাই মরে অন্তত শান্তি পেতে চাই!”
লোকটি মেয়েটির সামনে হাতজোড় করে বলল, “আমাদের ওপর একটু দয়া করো......”
“আমি দয়ার দোকান খুলে বসি নি!” মেয়েটি হাত তুলে থামিয়ে দিলো লোকটিকে। তারপর বলল, “আপনি যদি আমার মৃত্যুর দৃশ্য নিজের চোখে দেখতে না চান, তাহলে এই মুহুর্তে এখান থেকে চলে যান!”
লোকটি কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে মেয়েটির দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। তারপর বিড়বিড় করে আপনমনে কিছু একটা বলতে বলতে ঘুরে অন্যদিকে হাটা শুরু করল। লোকটি অনেক দূরে চলে যাওয়ার পর মেয়েটি গটগট করে হেটে এসে রেললাইনের ওপর বসে পড়ল। তার থেকে বেশ খানিকটা দূরেই যে আরও একজন আধশোয়া হয়ে বসে আছে আত্মহত্যা করার জন্যে, সেটা বোধহয় সে খেয়ালই করে নি।
“এই যে শুনছেন?” রবি ডাকলো মেয়েটিকে। মেয়েটি তার ডাক শুনে তার দিকে তাকালে সে বলল, “আপনিও এখানে আত্মহত্যা করতে এসেছেন বুঝি?”
“আমিও মানে?” মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, “আপনিও কি আত্মহত্যা করতে এসেছেন নাকি?”
রবি মুচকি হেসে বলল, “এরকম নির্জন একটা জায়গায় রেললাইনের ওপর মানুষ দু’টো কাজই করতে আসে- হয় প্রেম করতে, আর নাহয় রেললাইনে কাটা পড়ে আত্মহত্যা করতে। আমার জীবনে তো প্রেম বলে কিছুই অবশিষ্ট নেই। অতএব বুঝতেই পারছেন!”
“হুম বুঝলাম।“ মেয়েটি গম্ভীর হয়ে বলল, “তা, আত্মহত্যা করার চিন্তা কেন এলো মাথায়?”
“ঐযে বললাম,” রবি আকাশের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে জবাব দিলো, “আমার জীবনে প্রেম ভালোবাসা বলে কিছু অবশিষ্ট নেই। যাকে ভালোবাসতাম, সে আমাকে ধোঁকা দিয়ে অন্য একজনের সাথে চলে গেছে!”
মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ করে রবির দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘঃশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, “অন্য সময় হলে হয়ত আপনাকে একটা মোটিভেশনাল স্পিচ শুনিয়ে দিতাম। কিন্তু আজ আমার সেই অধিকার নেই। কারণ আমি নিজেই এসেছি আত্মহত্যা করতে!”
মেয়েটির কথা শুনে হাসলো রবি। সে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কেন আত্মহত্যা করতে চাচ্ছেন?”
মেয়েটি মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর রবির দিকে না তাকিয়েই দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দিলো, “আমার চারপাশের লোকগুলোর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে! শুধুমাত্র আমি মরলেই তারা আমার পিছু ছাড়বে!”
“কেন? তারা কী চায় আপনার কাছে?” কৌতুহল ঝরে পড়ল রবির কণ্ঠে।
“সাহায্য। সাহায্য চায় তারা।" মেয়েটি বলতে শুরু করল, “বুঝতে শেখার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই তেইশটা বছর ধরে সাহায্য চাইতে চাইতে আমার কানে তালা লাগিয়ে দিয়েছে এই লোকগুলো! তাদের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে যেখানেই যাই না কেন, সেখানেই এসে হাজির হয় তারা!”
মেয়েটির কথা শুনে অবাক হল রবি। সে বলল, “তাহলে তাদের সাহায্য করলেই তো হয়! তাদেরকে সাহায্য করে তাদের সমস্যার সমাধান করলেই তো আপনার সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তখন আর তারা আপনাকে বিরক্ত করবে না।"
মেয়েটি চোখ সরু করে রবির দিকে তাকিয়ে বলল, “তাদেরকে একবার সাহায্য করলেই তারা পারমানেন্টলি আমার ঘাড়ের ওপর চেপে বসবে! তখন?”
“আপনি কি তাদের একজনকেও সাহায্য করেছেন এ পর্যন্ত?”
“নাহ।"
“তাহলে আপনি এই কথা কীভাবে বলছেন যে তাদের উপকার করলে তারা আপনার ঘাড়ে চেপে বসবে?” ভ্রু কুচকে বলল রবি। “এমনটা তো নাও হতে পারে। আগে তো দুই একজনের উপকার করে দেখবেন! তা না করেই এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন?”
রবির কথা শুনে মেয়েটি যেন দ্বিধায় পড়ে গেল। সে চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। রবি এবারে সোজা হয়ে বসে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, আপনার কাছে যারা সাহায্য চায়, তারা কারা? আপনার আত্মীয় স্বজন?”
“না।"
“তাহলে?”
“বললে আপনি বিশ্বাস করবেন না। আমাকে পাগল ভাববেন।"
“তাও বলুন শুনি।"
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো মেয়েটি। তারপর রবির দিকে না তাকিয়েই বলল, “অশরীরী আত্মা।"
রবি আকাশ থেকে পড়ল। বিস্ফারিত চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, “কারা?!”
“মৃত মানুষদের অশরীরী আত্মা।" মেয়েটি মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল, “আমি অশরীরী আত্মাদের দেখতে পাই, তাদের কথা শুনতে পাই। কোটিতেও একজন খুঁজে পাওয়া যায় না যাদের এরকম ক্ষমতা আছে। আর এই কারণেই মৃত ব্যক্তিরা আমার কাছে আসে সাহায্য চাইতে। তারা চায় আমি যেন তাদের কথা শুনি, তাদের শেষ ইচ্ছা পূরণ করি।"
রবির বুঝতে বাকি রইলো না, মেয়েটি মানসিকভাবে অসুস্থ। হঠাৎ করেই মেয়েটির প্রতি একধরনের মমতা অনুভব করতে শুরু করল রবি। সে কোমল গলায় মেয়েটিকে বলল, “তুমি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?”
নিজের অজান্তেই মেয়েটাকে তুমি বলে সম্বোধন করে ফেলেছে রবি। ব্যাপারটা খেয়াল হতেই রবি এক ধরনের অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেল। তার সেই অস্বস্তি কাটাতেই কিনা কে জানে, মেয়েটাও তাকে তুমি বলে সম্বোধন করতে শুরু করল।
“বলো।"
“আমার পরিচিত একজন সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন।" রবি খানিকটা আমতা আমতা করে বলল, “তুমি রাজি থাকলে আমি কালই তার এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে তোমাকে তার কাছে নিয়ে যেতে পারি।"
রবি ভেবেছিলো কথাটা শুনে মেয়েটি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবে। কিন্তু হলো তার ঠিক উল্টোটা! মেয়েটি হি হি করে হেসে উঠলো। আর তার সেই হাসি দেখে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলো রবি। কী অপূর্ব হাসি মেয়েটির!
“তুমি বোধহয় ভুলে গেছো যে তুমি এখানে কী করতে এসেছিলে!” মেয়েটি হাসতে হাসতেই বলল, “আজকে যদি তুমি আত্মহত্যা করো, তাহলে কাল আমাকে নিয়ে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাবে কী করে?!”
মেয়েটি ভেবেছে রবির হয়ত মনেই নেই যে সে আত্মহত্যা করতে এসেছে। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে তা নয়। রবির ঠিকই মনে আছে। সত্যি বলতে রবির আত্মহত্যা করার ইচ্ছেটা যেন হঠাৎ করেই চলে গেছে। তার কাছে মানসিকভাবে অসুস্থ এই মেয়েটার সমস্যার কাছে নিজের সমস্যাকে অনেক বেশিই তুচ্ছ লাগতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে এই অল্প সময়ের মধ্যেই মেয়েটার প্রতি একটা অন্য রকম ভালো লাগার অনুভূতি কাজ করতে শুরু করেছে তার মনে। কিন্তু সেই ভালো লাগার ব্যাপারটা মেয়েটিকে বুঝতে দিতে চাচ্ছে না সে। তাই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে হাসলো।
“ভাবছি আত্মহত্যা করার প্ল্যানটা দুই একদিনের জন্য পিছিয়ে দেব।" মুখের লাজুক হাসিটা ধরে রেখেই রবি বলল, “মরার আগে কারো উপকার করে যেতে পারলে মরার মুহুর্তে একটা মানসিক শান্তি নিয়ে মরা যাবে!”
মেয়েটি আবারও হেসে উঠলো রবির কথা শুনে। বেশ কিছুক্ষণ লাগলো তার সেই হাসি থামতে। হাসি থামার পর সে বলল, “আমি কী ভাবছি জানো?”
“কী?”
“ভাবছি আমিও আত্মহত্যার প্ল্যানটা কয়েকদিনের জন্যে পিছিয়ে দেব।" মেয়েটি তার দুই হাতে পেছনের দিকে ভর দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, “এই কয়দিনে কয়েকজনের উপকার করব, কয়েকজন মৃত মানুষের শেষ ইচ্ছা পূরণ করব। আমার থেকে তাদের পিছু ছাড়ানোর জন্য না, নিজের মনের শান্তির জন্য। তারপর দেখি তোমার থিওরী অনুযায়ী মনের শান্তি নিয়ে মরতে পারি কিনা!”
কথাগুলো বলে আকাশের দিকে তাকিয়েই মৃদু হাসলো মেয়েটি। রবি ভ্রু কুচকে বলল, “তাদের উপকার যদি করো, তাহলে আবার আত্মহত্যা কেন করবে? তাদের শেষ ইচ্ছা পুরণ হয়ে গেলে তো তোমারও সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে!”
“তাও তো ঠিক!” মেয়েটি রবির দিকে তাকিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল।
“একটা ব্যাপার কি জানো? একবার কারো উপকার করে আনন্দ পেয়ে গেলে উপকার করাটা তখন একটা নেশা হয়ে দাঁড়ায়!” রবি বলতে লাগলো, “আর সেই নেশা থেকেই অনেকে একের পর এক মানুষের উপকার করে যেতে থাকে। যেমন ধরো মাদার তেরেসা কিংবা ফ্লোরিন্স নাইটিঙ্গেল।"
মেয়েটা যেন আরো চিন্তিত হয়ে গেল রবির কথা শুনে। সে বলল, “কিন্তু আমি যদি তাদের মত মহান হতে না পারি? উপকার করার নেশা যদি আমার না হয়?!”
রবি একটু চিন্তা করার জন্য সময় নিলো। তারপর বলল, “আগে তো কয়েকজনের উপকার করে দ্যাখো! তারপর যদি ভালো না লাগে আর উপকার করার নেশা তৈরি না হয়, তাহলে এই রেললাইন তো আছেই। আজ থেকে দশ বছর পরেও এখানে কোনো শপিং মল তৈরি হয়ে যাবে না! অতএব দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই!”
মেয়েটি আবারও শব্দ করে হেসে উঠলো। রবি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলো। এত প্রাণবন্ত হাসি সে আগে কখনো দেখে নি। মেয়েটি হাসতে হাসতেই উঠে দাঁড়ালো। তারপর রবির দিকে তাকিয়ে বলল, “চলো তাহলে, দু’জনে মিলে উপকার করা শুরু করি!”
রবিও উঠে দাঁড়ালো। হাসিমুখে সে বলল, “চলো।"
তারা দু’জনে মিলে হাটতে শুরু করল। রেললাইন ছেড়ে অনেকটা পথ হেটে চলে আসার পর রবির হঠাৎ করেই মনে পড়ল অদ্ভূত দর্শন সেই লোকটির কথা। সে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, ঐ ভদ্রলোক কে ছিল?”
“কোন ভদ্রলোক?” মেয়েটা অবাক হয়ে তাকালো রবির দিকে।
“আরে অদ্ভুত পোশাক পড়া ঐ লোকটা,” রবি মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল, “যে তোমার পেছন পেছন আসছিলো তখন। যাকে তুমি ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিলে!”
চমকে উঠলো মেয়েটা রবির কথা শুনে। বাকরুদ্ধ হয়ে রবির দিকে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ। তারপর তোতলাতে তোতলাতে বলল, “স-সর্বনাশ! তুমিও ম্-মৃত মা-আ-নুষদের দে-দেখতে পাও?!”
রবি বুঝতে পারল না মেয়েটা কী বলতে চাইছে। সে বোকা বোকা ভঙ্গিতে মত জবাব দিলো, “না তো!”
“তারমানে তু-তুমি......!” মেয়েটা শেষ করতে পারল না, বিস্ফারিত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো রবির দিকে। তারপর দুই হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে নিজের সমস্ত শক্তি আর্তচিৎকার করে উঠলো, “নাআআআআআআ! এটা হতে পারে না! এ-এটা হতে পা-পারে না! এটা......!!”
রবি কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেয়েটি জ্ঞান হারিয়ে ধপাস করে পড়ে গেল মাটিতে!
“অ্যাই মেয়ে! অ্যাই...!” রবি উত্তেজিত হয়ে মেয়েটিকে ডাকতে গিয়ে খেয়াল করল, সে মেয়েটির নামও জানে না! মেয়েটির জন্য একধরনের অস্থিরতা কাজ করতে শুরু করেছে তার মধ্যে। সে দ্রুত হাটু গেড়ে বসে পড়ল মেয়েটির পাশে। তারপর মেয়েটিকে ধরে ঝাকি দিয়ে গিয়েই একটা অদ্ভূত ব্যাপার লক্ষ্য করল। তার দুই হাত মেয়েটির শরীর ভেদ করে চলে যাচ্ছে! সে আবারও মেয়েটিকে স্পর্শ করার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। কী হচ্ছে এসব?! নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করল সে!
“তুমি ওকে স্পর্শ করতে পারবে না রবি।"
একটা ভরাট গলার আওয়াজ শুনে পেছন ফিরে তাকালো রবি। তাকিয়ে দেখলো, ফুটকিওয়ালা শার্ট আর বেলবটম প্যান্ট পড়া সেই অদ্ভূত দর্শন ভদ্রলোকটি তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে! লোকটি ধরা গলায় বলল, “কারণ তুমি অশরীরী!”
“আ-আমি কী?!” রবি যেন ঠিকমত শুনতেই পায় নি লোকটির কথা।
“তুমি একজন অশরীরী আত্মা।” লোকটি আগের মতই ধরা গলায় বলল, “তোমার দেহের ছিন্নভিন্ন অংশ আরো চার ঘণ্টা আগেই রেললাইনের ওপর থেকে সরিয়ে মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।"
“না! এটা হতে পারে না! মিথ্যে বলছেন আপনি!” উত্তেজণায় রীতিমত চিৎকার করে উঠলো রবি।
লোকটি সহানুভূতিশীল কণ্ঠে বলল, “এটাই হয়েছে রবি। এখন থেকে চার ঘণ্টা আগে যখন তুমি রেললাইনের ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলে, তখন একটা ট্রেন তোমার ওপর দিয়ে দিয়ে চলে যায়। পুরো ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে গেছে যে তুমি টেরও পাও নি!”
“তারমানে... আ-আমি মৃত?!” রবি যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে সে আর বেঁচে নেই! আর মেনে নেবেই বা কীভাবে? অন্য কারো মৃত্যু সংবাদ হলেও একটা কথা ছিল। কিন্তু এটা তো তার নিজের মৃত্যুসংবাদ! সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না, কেউ একজন তার সামনে দাঁড়িয়ে তার মৃত্যসংবাদ তাকেই দিচ্ছে। পুরো ব্যাপারটা তার কাছে একটা দুঃস্বপ্নের মত মনে হচ্ছে!
রবি শূণ্য দৃষ্টিতে তাকালো অচেতন অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকা মেয়েটির দিকে। অল্প সময়ের ব্যবধানেই মেয়েটির প্রতি একটা অন্যরকম ভালো লাগার অনুভূতির জন্ম হয়েছিলো তার মনে। সেই ভালো লাগার অনুভূতি থেকেই তার ভেতরে জেগে উঠেছিলো বেঁচে থাকার একটা শেষ ইচ্ছা। কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে!
এখন সে শুধুই একটা অশরীরী আত্মা!

এক মাস পর
“তুমি সত্যিই আমার শেষ ইচ্ছা পূরণ করবে?” বিস্ময় ঝরে পড়ল ফুটকিওয়ালা শার্ট আর বেলবটম প্যান্ট পড়া অদ্ভূত দর্শন ভদ্রলোকটির কণ্ঠে। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না, গত বিশ বছর ধরে হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করেও যাকে নিজের শেষ ইচ্ছা পূরণ করার জন্যে রাজি করাতে পারে নি, সে আজ নিজে থেকেই তার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে চাইছে!
ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো শৈলী। এক মাস হল সে এক এক করে তার কাছে আসা সব অতৃপ্ত আত্মাদের শেষ ইচ্ছা পূরণ করে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত ছয়জনের শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। এই এক মাসে ছয়জন অশরীরী আত্মার শেষ ইচ্ছা পূরণ করে দেয়ার মধ্য দিয়ে শৈলীও যেন তার মানসিক অশান্তি থেকে একটু একটু করে মুক্তি পেতে শুরু করেছে। রবি ঠিকই বলেছিলো, অন্যের উপকার করার মধ্যে একবার আনন্দ পেয়ে গেলে উপকার করাটা একটা নেশা হয়ে দাঁড়ায়।
“অবশ্যই করব। বলুন আপনার শেষ ইচ্ছা কী?” জানতে চাইলো শৈলী।
লোকটি বলতে শুরু করল, “আজ থেকে ষাট বছর আগে আমি একটি মেয়েকে প্রচণ্ড ভালোবাসতাম। মেয়েটিও আমাকে ভালোবাসত। তাকে কথা দিয়েছিলাম যে আমি তাকে বিয়ে করব। বাবাকে জানালাম মেয়েটার কথা। বাবা মেনে নিলেন না। কারণ তিনি আমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলেন তার এক বাল্যবন্ধুর মেয়ের সাথে। আমিও জেদ করলাম, আমি এই মেয়েকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করব না! ফলাফল হলো, আমার বাবা আমাকে ত্যাজ্য পুত্র করলেন।"
“তারপর?”
“তারপর আমি শহরে চলে এলাম চাকরির খোঁজে। আসার আগে মেয়েটিকে বলে এলাম, আমি চাকরি পেলেই চলে আসব তাকে নিতে।" লোকটি বলে যেতে লাগলেন, “শহরে এসে কত জায়গায় যে ছোটাছুটি করেছি একটা চাকরির জন্যে! কিন্তু কেউ আমাকে চাকরি দিচ্ছিলো না। এভাবে কয়েক মাস পাড় হয়ে গেল চাকরি খুঁজতে খুঁজতে। শেষমেষ ছোটখাট একটা চাকরি জুটিয়েও নিলাম। প্রতি মাসে চারশ’ টাকা করে বেতন, যা তখনকার সময়ে আমাদের দুইজনের সংসার চালিয়ে নেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।"
লোকটি নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য একটু থামলো, তারপর আবার বলতে শুরু করল, “চাকরিতে ঢোকার এক মাস পর প্রথম বেতন পেয়ে দিন সাতেকের ছুটি নিয়ে রওনা হলাম গ্রামের উদ্দেশ্যে। ভেবেছিলাম এই সাতদিনের মধ্যেই ওকে বিয়ে করে নিজের কাছে নিয়ে আসব। কিন্তু তা আর হল না! নৌকায় করে যাচ্ছিলাম। নৌকা যখন নদীর ঠিক মাঝখানে, তখনই প্রচণ্ড ঝড় উঠলো। সেই ঝড়ে নৌকা ডুবে গেলো, আমিও তলিয়ে নদীর গভীরে। কেউ আর কোনোদিন আমার খোঁজ-ও পেলো না!”
“আর মেয়েটা?” কৌতুহলী ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল শৈলী, “ওর কী হল?”
“ও আমার জন্যে অনেকদিন অপেক্ষা করেছিল। এরই মধ্যে একজন উড়ো খবর নিয়ে এলো, আমি নাকি শহরের এক ধনীর মেয়েকে বিয়ে করে তার সঙ্গেই সংসার করছি।" লোকটি ম্লান হেসে বলল, “মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেই লোকটা যখন ওকে এই খবরটা দিচ্ছিলো, তখন আমি ওর পাশেই বসা! আমি সেদিন প্রতিবাদ করতে চেয়েও করতে পারি নি। কারণ আমি তো অশরীরী! আমাকে কেউ না পায় দেখতে, আর না পায় শুনতে!”
“তারপর কী হল?”
“ও এই খবরটা শুনে একদম পাথর হয়ে গিয়েছিলো।" লোকটা বলল, “অনেকদিন পর্যন্ত ও কারো সাথে একটা কথাও বলে নি। এরই মধ্যে ওর বাবা মা ঠিক করলেন, ওর বিয়ে দিয়ে দেবেন। তাদের ধারনা, মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে, ও আবার আগের মত স্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করবে। তারপর তখনকার এক উচ্চ শিক্ষিত ছেলের সাথে ওর বিয়ে দিয়ে দিলেন ওর বাবা মা।"
“সেই মেয়েটি কি এখনও বেঁচে আছেন?” জানতে চাইলো শৈলী।
“হ্যা। সাত-আট বছর হল মিরপুরের একটা বৃদ্ধাশ্রমে আছে ও। আজও ও মনে করে, আমি ওর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি!” কথাটা বলতে গিয়ে ধরে এলো লোকটার গলা। “চিন্তা করতে পারো, সেই উনিশ শ’ সাতান্ন সাল থেকে আজ পর্যন্ত এই ষাটটা বছর ধরে আমি নিজের ভেতরে একটা অপরাধবোধ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, যেখানে কিনা আমি কোনো অপরাধ-ই করি নি?!”
শৈলীর চোখ ছল ছল করছে। এক মাস আগেও এই লোকটার সাথে সে কত বাজে আচরণ করেছে, তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে, সেই কথা ভাবতেই নিজেকে প্রচণ্ড রকমের অপরাধী মনে হল তার। চোখ মুছলো শৈলী। তারপর মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বলল, “আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকে সঙ্গে নিয়ে যাব তার কাছে। তারপর সবকিছু খুলে বলব তাকে।"
“সত্যি?” লোকটির মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তার মুখে ফুটে উঠলো কৃতজ্ঞতার হাসি।
“হ্যা সত্যি।" শৈলী লোকটিকে আশ্বস্ত করে বলল, “আমি তাকে বলব, আপনি কেন তার কাছে ফিরে আসতে পারেন নি। এটাও বলব, আপনি তাকে কতটা ভালোবাসেন যে মৃত্যুর পরেও তাকে ছেড়ে যেতে পারেন নি!”
কথাটা বলেই লোকটার পেছনে খানিকটা দূরে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রবির দিকে তাকালো শৈলী। রবি হাসিমুখে তাকিয়ে আছে শৈলীর দিকে। শৈলীও একটা মৃদু হাসি উপহার দিলো তাকে।
রবি এখনও নিজের শেষ ইচ্ছার কথা জানায় নি শৈলীকে। অতৃপ্ত আত্মাদের শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়ে গেলে তারা মুক্তি পেয়ে যায়। আর মুক্তি পাওয়ার পর পৃথিবী থেকে চিরতরে অদৃশ্য হয়ে যায় তারা। রবি এত তাড়াতাড়ি মুক্তি পেয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে চায় না। সে চায় আরো কয়েকটা দিন শৈলীর কাছাকাছি থাকতে। আর এই কারণেই সে চায় না, শৈলী তার শেষ ইচ্ছার কথা জানুক। যদিও শৈলী আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে তার শেষ ইচ্ছাটা জানার জন্যে!
পাঠক, বলুন তো কী হতে পারে রবির সেই শেষ ইচ্ছা?

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ২:২৮

চাঁদগাজী বলেছেন:


এটা উদ্ভট ভাবনার ফসল; চেষ্টা করলে আপনি হয়তো গল্প লিখতে পারবেন।

২| ২৬ শে জুলাই, ২০১৮ সকাল ৯:১৮

রাজীব নুর বলেছেন: "বিপন্ন বাংলা আজ নিরুপায় বেহুলা সুন্দরী।"
...
আহমদ ছফা

৩| ২৬ শে জুলাই, ২০১৮ সকাল ৯:২৫

নীল আকাশ বলেছেন: আপনি বরং হাতুরীলীগ নিয়ে লিখলে চাদগাজী পছন্দ করতো। এত সুন্দর একটা গল্প তার মাথার উপর দিয়ে গেছে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.